সুত্রাকান্দির যুদ্ধ
(২৪ মে, ১৯৭১)
আমরা গোপালগঞ্জ এর প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে পিছু হটার পরে বড়গ্রাম বিওপিতে আমাদের বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করলাম। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল অগ্রগামী পাকিস্তানী বাহিনীকে শেওলা ঘাট থেকে কুসিয়ারা নদী অতিক্রম করতে না দেবা। সেসময় বিয়ানী বাজার আর জাকিগঞ্জ থানার পুরো এলাকা ছিল মুক্তাঞ্চল।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এক কোম্পানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট নদীর অপর পাড়ে শেওলা ঘাটে আসল। ২য় সপ্তাহের মধ্যে তারা আরও শক্তি বৃদ্ধি করলো।আমি বুঝতে পারছিলাম, তারা খুব তাড়াতাড়ি নদী পার হয়ে আমাদের উপর আক্রমন করার চেষ্টা করবে। আমার কাছে সব মিলিয়ে এক কোম্পানি এর মত মুক্তি্যোদ্ধা ছিল। এর মধ্যে আমরা অতর্কিত চোরাগপ্তা হামলার মাধ্যমে পাকবাহিনীকে ব্যাতিব্যস্ত রাখলাম এবং নদী পার হবা থেকে তাদের বিরত রাখলাম। এর মাঝে আমি সেক্টর কমান্ডার মেজর দত্ত এর মাধ্যমে ভারত ঠেকে কিছু অস্ত্র আর গোলা বারুদ পাবার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু তিনি সফল হননি।
২০ মে শত্রুবাহিনী ঘুরা পথে কুশিয়ারা নদী পার হতে সক্ষম হলো। তাড়া কুশিয়ারা নদী বরাবর তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করল। শত্রুবাহিনী তখন আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে।
২৩ মে ১৯৭১ ছিল চাঁদনি রাত। চারদিকে তখন পিনপতন নিরবতা। আমি ভোর হবার আগেই শত্রুকে অভ্যর্থনা জানাতে দৃঢ় প্র্তিজ্ঞ ছিলাম। রাত ১১টার দিকে দুজন গ্রামবাসী দৌরে এসে আমাদের জানালো পাকবাহিনীর এক বিশাল বহর আমাদের আমাদের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে।
দুর্ভাগ্যবসত সেই সন্ধ্যাতেই আমি এক প্লাটুন মুক্তি্যোদ্ধা সবুজপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে শত্রু ঘাটি রেইড করতে পাঠিয়েছিলাম। আমি ভোর হবার আগেই যেভাবে হোক তাদের আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহে ফেরত আসতে নির্দেশ দিলাম। অল্প ফোর্স নিয়ে বিশাল শত্রুবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু আমাদের মনোবল তখন তুঙ্গে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, হয় তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে, না হলে মরার আগে প্রচুর সংখ্যক শত্রুবাহিনীকে মেরে তারপরে মরব। ভোর হবার আগেই এক প্লাটুন মুক্তি্যোদ্ধা সবুজপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে ফেরত আসল।
ভোরবেলা, ২৪ মে, ১৯৭১। ৬টার দিকে শত্রুবাহিনী আমাদের রাইফেলের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসল। আমরা এতটুকু হতচকিত হইনি, বরং আমরা তাদের প্রতিক্ষাতেই ছিলাম। আর্টিলারী কাভার নিয়ে ২ কোম্পানি পাকসেনা আমাদের উপর হামলা করল। এক কোম্পানি সুত্রাকান্দি আক্রমন করলো, আর এক কোম্পানি লাপ্সাল গ্রাম দিয়ে বড়গ্রাম বিওপিতে আক্রমণ করলো।
আমরা শত্রুর অপেক্ষাতেই ছিলাম। এটা ছিল দিনের আলোয় খোলা ময়দানে আক্রমণ। আসলে আমরা বিরাট এলাকা অল্পসংখ্যক মুক্তি্যোদ্ধা নিয়ে ধরে রেখেছিলাম।
শত্রুর প্রথম হামলা আমরা সাফল্যের সাথে প্রতিহত করলাম। খোলা মাঠে যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির হার ছিল ব্যাপক। আধাঘন্টার মধ্যে ২৫ জনের মত শত্রুর লাশ পরে থাকল। আমাদের একমাত্র মিডিয়াম মেশিনগান খুব কাজে আসল। শত্রুবাহিনীর আর সাহস হয়নি মেইন রোড দিয়ে আগানোর।
ভারতের সীমানার অপর পাড়ে বিওপিতে সেদিন মাত্র ১৫ জনের মত পাহারায় ছিল। কিন্তু ৩ মেইল দূরত্বের মধ্যে ২ কোম্পানি ভারতীয় বিএসএফ ছিল রিসার্ভ ফোর্স হিসেবে। দুর্ভাগ্যবসত রিসার্ভ ফোর্স কিছু বুঝার আগেই পাকবাহিনী ভারতীয় সীমানার বিওপি আক্রমণ করে সেদিন বেলা ১২ টার দিকে, যা তাড়া ধারনা করেনি।তাদের ২ জন সিপাহী মারা পড়ে এবং পাকবাহিনী তাদের কিছু অস্ত্র হস্তগত করে।
এর পরে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে শত্রুবাহিনী সামনের দিক থেকে এবং ডানদিক থেকে আমাদের উপর আক্রমণ করে। কিন্তু বেলা ১০টা পর্যন্ত তারা আমাদের একচুলও নড়াতে পারল না। আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসছিল। আমাদের অনুরধে ভারতীয় বিএসএফ আমাদের কয়েকশ রাউন্ড গোলাবারুদ দিল, কিন্তু এর বেশী তারা আর দিতে পারছিল না। সকাল সাড়ে এগারটার দিকে আমাদের সব গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেল। কোন উপায় না দেখে আমি আমাদের বাহিনীকে পিছু হটতে নির্দেশ দিলাম। আমাদের দলের ২ জন সেদিন শত্রুর হাতে ধরা পড়ল। শত্রুবাহিনী আরও এগোতে থাকল এবং এক সময় আন্তর্জাতিক সীমা রেখা অতিক্রম করল।পাকবাহিনী তাদের উপর হামলা করার আগ পর্যন্ত বিএসএফ এক রাউন্ড গুলিও ছুড়ল না। তারা চিন্তাও করতে পারেনি যে, পাকবাহিনী সীমানা অতিক্রম করে তাদের উপর আক্রমণ করার সাহস সত্যি দেখাবে। বেলা ১২টা নাগাদ পাকবাহিনী ভারতীয় বিওপি দখলে নিল।
যদিও আমাদের পিছু হটতে হয়েছিল, আমরা আমাদের লক্ষ অর্জন করি। তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, এবং আমরা পিছু হটার আগে তাদের ৩৯ জনের লাশ পড়ে ছিল। আমরা ২ জনকে হারাই আর কয়েকজন সামান্য আহত হয়। ২ জন পাঞ্জাবীকে আমরা পাকড়াও করি। সবচেয়ে বড় ব্যপার হল, এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের নিজেদের সামর্থের উপর সাহস ও ভরসা হাজারগুনে বাড়িয়ে দিল।
১লা জুন, ১৯৭১। এদিন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানী আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং সবরকমের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আমাদের শক্তি-সামর্থ দিন দিন বেড়ে চলছিল। ১০জুন, ১৯৭১ আমরা বড়পঞ্জিতে আমাদের ক্যাম্প করলাম। এর মধ্যে ইন্ডিয়া আমাদেরকে অস্ত্র,গোলাবারুদ, আর রেসমের খাবার সরবরাহ শুরু করে। আমাদের কাউন্টার পার্ট ছিল ইন্ডিয়া ইকো সেক্টর, যাদের কাজ ছিল আমাদের সবরকমের সাহায্য করা।
আমরা এর মধ্যে ট্রেনিংক্যাম্প এর বন্দোবস্ত করেছিলাম। সেটা তখন পুরদমে চলছিল। নতুন ট্রেনিং পাওয়া গনবাহিনী তখন বেশ ভাল করছিল। মধ্য জুনের মধ্যে আমার সাব-সেক্টর এর সদস্য সংখ্যা ৬০০ হল আর তাদের সবার কাছে অস্ত্রও ছিল। ব্রিজ আর রেললাইন ধ্বংস করা ছিল আমাদের রুটিন কাজ। আমাদের এরিয়াতে একটা ব্রিজও পাওয়া যাবে না, যেখানে আমরা অপারেশন করিনি।অন্যদিকে বর্ডার এরিয়া তে সাধারন জনগনের উপরে পাকবাহিনীর বর্বরতম নির্যাতন সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রতিরাতে আমাদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য কোন না কোন রেইড, অ্যাম্বুস বা গেরিলা হামলায় অংশ নিত। প্রায় প্রতিদিনই আমরা কিছু পাঞ্জাবি বা রাজাকার ধরে নিয়ে আসতাম।
পাকবাহিনীর বর্বর নির্যাতন ক্রমেই বেড়ে চলছিল। জুলাই মাসের কোন একদিন আমাদের ২জন গেরিলা যোদ্ধা তাদের হাতে ধরা পরে।পাকিস্তানীরা তাদের খোলা মাঠে গরুছাগলের মতো জবাই করে।আমার মনে আছে, তারা ২ জনই ইন্টারমিডিয়েট এর ছাত্র ছিল। আর একদিন তারা আমাদের ৩জন গেরিলাকে ধরে ফেলে। তাদের উলটা করে ঝুলিয়ে রাখা হয় ৭ দিন। তাঁরা কাদতে কাদতে মারা যায়। আর একবার তারা আমাদের দলের একজন কে ধরে ফেলে। তাঁর ২ চোখ উপড়ে ফেলা হয়। সে ওইখানেই শহীদ হয়। এসব দেখার পরে স্বাভাবিক কারও পক্ষে মাথা ঠিক রাখা বা পাকিস্তানীদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ন না হয়ে উঠার কোন কারন নাই।