গুপ্ত পথে যাত্রা
সুন্দরবন বাংলাদেশের বিখ্যাত অরণ্যানি। এই সুন্দরবনের গোপন পথ ধরেই আমার ভারত যাত্রা শুরু হলো। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ ও অজগরে সুন্দরবন ভরপুর। জানা-অজানা অনেক শংকা ও বিপদের ঝুঁকি দিয়ে ছোট একটি লঞ্চ, পথের জন্য সপ্তাহের কিছু রেশন ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সবাই মিলে লঞ্চে আমরা বিশজন নাবিক ছিলাম। এদের মধ্যে দু’জন প্রকৃত যুদ্ধ করার মত। পনের থেকে বিশের মধ্যে এদের বয়স। আগে সেনাবাহিনীতে ছিল। নাম সিদ্দিক ও জব্বার। আমাদের বলা হয়েছিল সুন্দরবনের চারপাশে পাকিস্তানী হানাদাররা ‘গানবোট’ নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর বর্বরের মতো নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে ভয়ানক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করছে। সন্ধ্যার দিকে অনেক দূরে ‘পশুর’ ও ‘শিপ্সা’ নদীর মোহনায় হঠাৎ করে একটা গানবোট চোখে পড়লো। এই বিরাঠ নদী দুটো অতিক্রম করে আমাদের নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে। সামনেই দিগন্তবিস্তৃত বঙ্গোপসাগর। ‘পশুর’ ও ‘শিপ্সা’ এই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। অন্ধকারে বিশাল জলরাশির দৃশ্য ভয়ংকর ও ভীতিপ্রদ। একটা প্রেতপুরীর মতো। দলের অধিনায়ক হিসেবে আসন্ন বিপদের ভয়কে চেপে গিয়ে আত্মবিশ্বাসকে ঘা দিয়ে চাংগা করে তুললাম। আমাদের লঞ্চের প্রধান পাইলট কিছুদিন আগেও একজন চোরাচালানী ছিল। জংগলের সব গোপন রাস্তা তার নখদর্পণে। তাকে বললাম যদি কোন পথ থেকে থাকে তাহলে লঞ্চের গতি সেই দিকেই ঘোরাতে। সে আমার আদেশ মানলো। আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। পরদিন ভারতের সীমান্তবর্তী চৌকি ‘পারগোমতী’ এসে পৌছলাম। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা আগেই আমাদের আসার খবর পেয়েছিল। তারা আমাদের আসার বৈধতা পরীক্ষা করে সামনে এগুবার অনুমতি দিল।
২৪শে এপ্রিল ভোরে ‘পারগোমতী’র একটা জায়গায় ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ইন্সপেক্টর মিঃ পি কে ঘোষ আমাদেরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন এবং অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যোগাযোগের পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্ক পাহারায় ক্যাপ্টেন হুদা ও আমাকে সামনে এগুবার অনুমতি দিলেন। এই সময় আমরা ‘হিঙ্গুলগঞ্জ’ নামক অপর একটি ভারতীয় সীমান্ত চৌকির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। সিদ্দিকসহ লঞ্চের অন্যান্য সাথীদের লঞ্চসহ এখানেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রেখে গেলাম।
নিরাপদ স্থানে পৌঁছার জন্য ভারতের সীমান্ত ধরে আমরা এগুতে লাগলাম। কারণ, নদীর ওপারেই পাকিস্তানী হানাদাররা ওঁৎ পেতে বসেছিল। ওপারের দূরত্ব এক হাজার গজের বেশি নয়। বর্বর পাকিস্তানী হানাদারদের মেশিনগানগুলো যে কোন সময় গর্জে উঠতে পারে। এই ভয়ে আমরা সতর্ক ও সচেতন ছিলাম। দেখতে পেলাম ওপারে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্রিগারে হাত দিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। নদীর ঢেউগুলো স্পীডবোটের কাঠের দেহটাকে হাপরের মতো পিটাচ্ছিল। ভয় হল ওর দেহটা না টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
ঢেউয়ের বুক চিরে ক্ষুদে দৈত্যের মতো স্পীডবোটটা আমাদের নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললো গন্তব্যস্থানের দিকে। মুখ ঘুরাতেই সামনে দেখতে পেলাম নদীর তীর বরাবর ভারতীয় সীমান্তে বেশ বড় বড় কতকগুলো বাড়ি। উপর দিকটা লাল, এমন কতকগুলো সেনানিবাস এই বাড়িগুলো চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। বহু আকাংক্ষিত স্থানে নিরাপদে পৌঁছাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। নতুন করে ইস্পাত কঠিন সংকল্প ও শক্তি সঞ্চয় করলাম। ওই দিনই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিরে পাকিস্তানী পশুগুলোর উপর বর্বরতার সমুচিত জবাব দেবার জন্য মনটা আমার কঠিন হয়ে উঠলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। যাতে করে সাড়ে সাত কোটি অগ্নিদগ্ধ আত্মার শান্তির জন্য হিংস্র জানোয়ারদের উপর চরম আঘাত হানা যায়।
আমরা হিংণ্ডলগঞ্জে নামলাম এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন পান্ডের অফিসে হেঁটে গেলাম। তিনি তাঁর অফিসে আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। ক্যাপ্টেন পান্ডে সুঠামদেহী, সুন্দর ও বেশ লম্বা। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানালেন। আমি যা আশা করেছিলাম তার চাইতে বেশী।
এক কাপ গরম কফির পর আমাকে আবার এখনই হবে প্রথম হাসনাবাদ, পরে ব্যারাকপুর। প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী সেখনে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় ক্যাপ্টেন পান্ডে শরণার্থী হয়ে ভারত চলে আসেন। আমাকে স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুব আনন্দবোধ করলেন। তার চোখের কোণে আশা ও প্রত্যয়ের ছাপ দেখলাম।
আমাদের অনেক রাস্তা যেতে হবে। সুতরাং সময় নষ্ট না করে ওদের সেনাবাহিনীর পাহারায় আমরা তিনচাকার একটা গাড়ীতে চেপে পড়লাম। এই গাড়ীটির বন্দোবস্ত করেহিলেন মিঃ পান্ডে। তিনি হাসনাবাদে আমাদের আগমন বার্তা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। সহকারি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।
হিংণ্ডলগঞ্জ থেকে হাসনাবাদের দূরত্ব ১২ মাইল। কিন্তু মাঝপথে আমাদের দুটো খেয়া পার হতে হবে। এই তিনচাকা গাড়ীটা দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগে। এটার নাম টেম্পো।
বেশ কষ্টকর ভ্রমণের পর আমরা হাসনাবাদ পৌঁছে গেলাম। গণপরিষদ সদস্য মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছ থেকে ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং আমার সম্বন্ধে অনেক কথা আগেই শুনেছেন। মিঃ মঞ্জুর সাথে আগে থেকেই এদের জানাশুনা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন সিং কোমল হৃদয়ের অধিকারী, সুন্দর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমাদের সবার কাছেই খুব প্রাণখোলা মনে হলো। সামনে এসে মিসেস সিংও আমাদের খোশ আমদেদ জানালেন। এই ভদ্রমহিলা আর এক মধুর ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘাংগী, সুন্দরী। তারা আমাদের সাথে অতি পরিচিত বন্ধুর মত ব্যবহার করলেন। বেশ কয়েক রকুম সুস্বাদু খাবার খাওয়ার পর আমরা ব্যারাকপুর যাত্রা করলাম। এখান থেকে ব্যারাকপুর প্রায় সত্তর মাইল সামনে। এবার স্বয়ং ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং-এর পাহারায় রওনা হলাম। হঠাৎ করে ঝড় ও অবিরাম বর্ষণ শুরু হলো। কিন্তু সামরিক গাড়ীগুলোর আশ্রয় পেয়ে কতটা নিরাপদ হলাম। দীর্ঘ দু’ঘণ্টা ভ্রমণের পর গাড়ীটা একটা দালানের কাছে থামলো। ওর গায়ে লেখা ছিল ‘অফিসার মেস’, ৭২নং বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে)। এটাই আমাদের সামরিক গন্তব্য স্থান। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশে তারাগুলো উঁকি মারলো। বাইরে কিছুক্ষণ কাটানোর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ওদের অফিসার মেসে। আমাদের ৭২নং বিএসএফ অফিসার মেসে। পথের ক্লান্তিতে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা করলাম। সুতরাং শিগগিরই পানীয় এলো। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের ধ্বনি ছড়িয়ে এক ঝলক হাসি মুখে নিয়ে উপস্থিত হলেন একজন নতুন যুবক। ইনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন সরকার। ভাই ও বন্ধুর চেয়েও বেশী অমায়িক ব্যবহার পেয়েছিলাম এই ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে। পরে আমরা আত্মীয়র চাইতে বেশী আপন হয়েছিলাম। এই ৭২ বিএসএফ বাহিনীর এডজুট্যান্ট ছিলেন তিনি। মিত্রবাহিনীর বন্ধুদের উল্লাসের ধ্বনিতে আমি স্বস্তি অনুভব করতে লাগলাম। বাস্তবিক পক্ষে আমরা খুব সুখে ছিলাম। এই সময় অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী এসে পৌঁছালেন। অধিনায়কের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। বয়সী লোক। ধূসর চুল, মুখাবয়বে অভিজ্ঞতার ছাপ। আমরা খুব আস্তে আস্তে কথা বললাম।
ভেতরটা তার বড্ড নরম, বড্ড কোমল। পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যে সফলতা এসেছে সেটা সম্ভব হয়েছিল তার সুষ্ঠ নির্দেশনা ও ব্যক্তিত্বের জন্য। তাকে ভুলব না।