শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০। ১১ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের বিবরণ | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র | ১৯৭১ |
<১০, ২০.১, ৪৬০-৪৬২>
সাক্ষাৎকারঃমেজর আব্দুল আজিজ*
৭-৬-১৯৭৩
১১ নং সেক্টরের যুদ্ধ বিবরণঃ
১১ নং সেক্টর ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম সেক্টর।ময়মনসিংহ জেলা, টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় এই সেক্টর। ভারতীয় সীমান্ত এলাকার ভারতীয় সিকিউরিটি পোস্ট মাইনকারচর থেকে মহেশখোলা পর্যন্ত এটি বিস্তৃত ছিল। ময়মনসিংহ জেলার প্রায় সম্পূর্ন এলাকা ২৪ শে এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। যদি তৎকালীন সামরিক নেতৃবৃন্দ সুষ্ঠুভাবে উপলব্ধি করতে পারতেন তাহলে এই এলাকা মুক্তিযুদ্ধে আরও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারতো। কিন্তু এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি মুক্তিসেনারা তাড়াতাড়ি এলাকা ছেড়ে চলে যায় এবং পাক সেনারা স্থান দখল করে। নেতৃত্বহীন মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের পথে পা বাড়ায় এবং বেশীরভাগ লোক ভারতের ডালু এবং মহেন্দ্রগঞ্জে সমবেত হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করে উল্লেখযোগ্যভাবে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী,ময়মনসিংহের ভালুকার আফসার উদ্দিন এবং সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জার নাম উল্লেখযোগ্য। এই সেক্টরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কামালপুর,জামালপুর,টাঙ্গাইল-ঢাকা রোড। ঢাকা সড়ক ঢাকা আক্রমণের জন্য অত্যন্ত জরুরি পথ। এই সেক্টরের সামরিকগুরুত্ব প্রাথমিক অবস্থায় ভারতীয় বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক নেতৃবৃন্দ কেউই উপলব্ধি করেননি। যার ফলে এই সেক্টর সর্বদা ৭১ সনের জুন মাস পর্যন্ত অবহেলিত ছিল। আগষ্ট মাসের পূর্ব পর্যন্ত এই সেক্টর একজন ভারতীয় অফিসার ব্রিগেডিয়ার সান্তসিংহের পরিচালনাধীন ছিল। এবং কোন বাঙ্গালী অফিসারকে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংহ সেক্টরকে নিম্নলিখিত সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন(ক)মাইনকারচর(খ)মহেন্দ্রগঞ্জ (গ)পুরাখাশিয়া (ঘ)ঢালু (ঙ) বাগমারা (চ)শিববাড়ি ও (ছ) মহেশখোলা।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অধিনায়করাই সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এই সমগ্র সাব-সেক্টরের অধীনে দেশের অভ্যন্তরে কোন উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়নি।যুদ্ধ সাধারনতঃ সীমান্ত এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। দূর্ভাগ্যবশত, তাদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে সাব-সেক্টর কমান্ডারদের উস্কানিতে ডাকাতি,রাহাজানি ও লূটতরাজ করছে বলে একটি সাংঘাতিক বদনাম রটে যায়। গেরিলা যুদ্ধে স্থানীয় জনসাধারণের সমর্থনে প্রয়োজনীয়তা ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। অন্যপক্ষে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী নিজেদের ক্ষমতা সুদূঢ়রুপে প্রতিষ্ঠিত করে। সমস্ত প্রবেশ পথ বন্ধ করার জন্য সীমান্তের সর্বত্র্য তারা সুদূঢ় ঘাঁটি নির্মাণ করে। তারা এই সুযোগে রাজাকার ও আলবদর নামে প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়। এই অসুবিধা থাকা সত্বেও রংপুর জেলা সম্পূর্ন রৌমারী থানা এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকা সবসময়ে মুক্তিবাহিনীর অধীন ছিল।এই এলাকা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম মুক্ত এলাকা।এই সেক্টরের অধীনে ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর জন্য একটি ট্রেনিং স্কুল খোলে।ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং এই সেক্টর ছাড়া ও ট্রেনিং এর দেখাশোনা করতেন। সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন জায়গায় যুব শিবিরও স্থাপন করা হয়। এই শিবিরগুলি ট্রেনিং স্কুলের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সরবরাহ করতো। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে মেজর (বর্তমানে কর্ণেল) জিয়াউর রহমান ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি ব্যাটালিয়ান নিয়ে ১১ নং সেক্টরে আসেন এবং তাঁকে প্রথম নিয়মিত ব্রিগেড গঠন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে ব্রিগেড গঠন করেন,যা পরে জেড ফোর্স নামে পরিচিত হয়। ঐ সময়ে মুক্ত এলাকা রৌমারী পাকিস্তানী বাহিনীর হুমকির সম্মুখীন হয় এবং তিনি তাঁর দুটি ব্যাটালিয়ানকে রৌমারী রক্ষায় নিযুক্ত করেন। ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হবার অল্প সময় পরে মেজর জিয়াউর রহমান কতিপয় দুঃসাহসিক অভিযান চালান যা স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অংশের দাবি করতে পারে।
আগষ্ট মাসের শুরুতে মেজর আবু তাহের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়কল্পে সফরে বের হয়ে এই সেক্টরে আগমন করেন। এই এলাকায় অভিযানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি এই সেক্টরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর থেকে তাঁকে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হয়ে তিনি কামালপুর, জামালপুর,টাংগাইল এবং ঢাকা সড়কের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। এর উপর ভিত্তি করে কামালপুরের বিপরীতে ভারতে মহেন্দ্রগঞ্জে এই সেক্টরের সদর দফতর স্থাপন করেন। এখান থেকে তিনি কতিপয় বিখ্যাত আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করেন যা বিস্তারিত উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্যে চিলমারীর যুদ্ধ,কামালপুরের যুদ্ধ,তেরীখারীন যুদ্ধ,বাহাদুরাবাদ যুদ্ধ,দেশের অভ্যন্তরে টাংগাইলের জাহাজ মারার যুদ্ধ, সরিষাবাড়ি যুদ্ধ,রংপুর অভিযান এবং নেভাল কমান্ডো অভিযান উল্লেখযোগ্য।
আগষ্ট মাসের শেষ দিকে এবং সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে এই সেক্টরের সমস্ত সেক্টর ট্রুপস,মুক্তিযোদ্ধা এবং জেড ফোর্স নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা করা হয়েছিল যাতে দেশের অভ্যন্তরে গণযুদ্ধের রুপ দেওয়া যায়। তারপর স্বাভাবিকভাবে ঢাকা অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এজন্য অন্যান্য সেক্টরেও ভারতীয় এলাকা ত্যাগ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী মেজর জিয়াউর রহমান যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরি করেন, যা লেঃ জেনারেল অরোরা ও অন্যান্য ভারতীয় সামরিক উচ্চ অফিসারবৃন্দ কর্তৃক খুব প্রশংসিত হয়েছিল। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে মুজিব নগরে সেক্টর কমান্ডার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। যার ফলে সে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। পক্ষান্তরে সকলকে বিস্মিত করে কর্ণেল জিয়াকে তার ‘জেড ‘ ফোর্স সহ এই সেক্টর থেকে সিলেট পাটিয়ে দেওয়া হয়। ‘জেড’ফোর্সের এই স্থানান্তর ১১নং সেক্টরের জন্য ছিল সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত। মুক্ত এলাকা প্রতিরক্ষা ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধ দ্রুতগতিতে দেশের অভ্যন্তরে বিস্তার লাভ করতে পারেনা।জেড ফোর্স চলে যাবার পরে এই সেক্টরে মাত্র ২ জন নিয়মিত অফিসার অবস্থান করেন-স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ ও লেঃমান্নান।নানা অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই সেক্টর উল্লেখযোগ্য অপারেশনে অংশগ্রহণ করে।
১৫ ই নভেম্বর আমি ১১ নং সেক্ট্ররে পৌঁছি এবং মেজর তাহেরের অবর্তমানে অস্থায়ীভাবে সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করি। সেক্টর হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে আমি সেক্টরের গুমোট, নির্জীব অনিশ্চয়তার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের দেখতে পাই। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাদের নেতাকে হারিয়ে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিল। আমি এসে হেডকোয়ার্টার সাব সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। বিস্তারিত যুদ্ধের অবস্থা অবলোকনের পর আমি কর্মপদ্ধতি স্থির করি এবং আক্রমণাত্মক অভিযান পরিত্যাগ করে অবরোধমূলক অভিযান পরিচালনার জন্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে পরামর্শ পাঠাই। সমগ্র সীমান্ত এলাকাতে অভিযান শুরু করে।