<১০, ২০.২, ৪৬৩-৪৬৫>
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর জিয়াউল হক
২৭-৬-৭৪
আমরা ই-পি-আর’ এর তিন কোম্পানি এবং আনসার-মুজাহিদের আনুমানিক ৬/৭ কোম্পানি নিয়ে ফুলপুর-হালুয়াঘাট হয়ে ভারতের ডালুতে আশ্রয় নিই।এবং বাংলাদেশের কমালাকান্দা থানার বিপরীতে ভারতের রংরায় সুবেদার আজিজ এক কোম্পানি,ডালুতে আমরা এক কোম্পানী এবং পুরাখাশিয়া -মহেন্দ্রগঞ্জ এ সুবেদার হাকিমের এক কোম্পানি -যেখানে আনসার,মুজাহিদ এবং পুলিশ ছিল।ডালু,বারেংগাপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।জেলা সদর দপ্তর তুরা এখান থেকে নিকটবর্তী ছিল।পুরো এপ্রিল মাস মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠন এবং প্রশিক্ষন দেয়া হয়।ইতিমধ্য সীমান্ত এলাকার লোকজন পাক সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।
মে মাস থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ‘আঘাত কর এবং পালাও’এ কৌশলে গেরিলা অপারেশন শুরু করা হয়।উল্লেখযোগ্য যে হাতেম আলী তালুকদার এম-সি-এ এবং আবুল মনসুর আহমদ এম-সি এ ভারতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত গেরিলা অপারেশনে আমাদের সাহায্য – সহযোগীতা করেছেন।
.
গেরিলা অপারেশন
২রা মে তারিখে সিপাহী এ,কে এম ফজলুল হক ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হালুয়াঘাটের ফুলপুর থানার রামভদ্রপুরে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে রাজাকার বাহিনীর দু’জন কে হত্যা করে এবং ৬টি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়।২৫-৬-৭১ তারিখে নায়েক ফরহাদ ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নরুন্দী রেলওয়ে ষ্টেশনে এক্সপ্লোসিভের সাহায্য অপারেশন করে এবং ৮-৭-৭১ তারিখে রেললাইনের নীচে এন্টি-ট্যাংক মাইন বসিয়ে পাক-বাহিনীর খাদ্যদ্রব্য -অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই তিনটি বগি ইঞ্জিনসহ ধ্বংস করে দেয়।২৫-৬-৭১ তারিখে হাবিলদার হাফিজকে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ পাঠানো হয়।৬/৭ জুলাই তারিখে তারা মুক্তাগাছা আক্রমণ করে এবং ১৫ টা রাইফেল,একটি এস-এম-জি,২৮ টি এল-এম-জি ম্যাজিন এবং থানার টেলিফোন সেট সমেত সমস্ত গোলাবারুদ উদ্ধার করে নিয়ে আসে।৪জন বাঙ্গালী পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করা হয়।থানার ওসি পালিয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম।আরো ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে করইতলি বি-ও-পি তে ( মহেশলাঠি গ্রাম) রাজাকারদের ক্যাম্পে হামলা চালায়।ক্যাম্পের সেন্ট্রিকে তারা ধরে নিয়ে আসে।৯ ই জুন তারিখে আমি আমার সাহসী ল্যান্স নায়েক মেজবাহউদ্দীন,আমার কুক আব্দুস সোবাহান মোল্লাসহ নালিতাবাড়ি থানার অধীনে বারমারি বি-ও-পি এবং খৃস্টানদের মিশনের মধ্যবর্তী জায়গায় মাইন পুঁতে রাখি।ঐ পথ দিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন মেজর সব সময় যাতায়াত করত।৯ ই জুন ঐ সকালে মেজর,মিশনের সিস্টার,একজন সুবেদার,দুই সিপাহী ঐ পথে যাবার সময় মাইন বিস্ফোরণে নিহত হয়।
ই-পি-আর’ এর ল্যান্স নায়েক আব্দুল্ল মান্নান এবং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক আফসারউদ্দিন আহম্মদ ভালুকা থানার ভাউলিয়া বাজার এলাকাতে পাক বাহিনীর সাথে এক সংঘর্ষে লিপ্ত হন।সাত থেকে সাড়ে সাতশ মুক্তিযোদ্ধা এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে।পাক-বাহিনীর প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে।এই আক্রমণে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।পাক বাহিনীর পক্ষে বেশ হতাহত হয়।পাক বাহিনী চারদিক থেকে যাওয়ায় ডাক থেকে হেলিকপ্টার গিয়ে তাদেরকে ৫ জুলাই উদ্দার করে।পাকিস্তানীদের পক্ষে প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছিল।মুক্তিযোদ্ধারা ৭১ টি রাইফেল,১২ টি চীনা রাইফেল,৩ টি এল-এম-জি,২ টি ২” মর্টার উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
১৩ জুলাই ল্যান্স নায়েক মন্নান ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ২০০ জন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ফুলবাড়িয়া থানার লক্ষীপুর গ্রামে একটি পাক আর্মি পেট্রলকে এমবুশ করেএবং ৪৩ টি রাইফেল,৩ টি এল-এম-জি ১ টি চীনা এল-এম-জি,২ টি চীনা রাইফেল,২ টি এস-এম-জি ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
৯ ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধা আবু হানিফকে ফকির বেশে ফুলপুর থানায় পাঠানো হয়। ভিক্ষা চাওয়ার ভাণ করে থানা সেন্ট্রির নিকট থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে হত্যা করে থানা থেকে একটি রাইফেল এবং ষ্টেনগান নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
হালুয়াঘাট এবং শম্ভুগঞ্জ এর মধ্যবর্তী নাগাল পুল অবস্থিত।মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক চৌধুরীকে ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ উক্ত পুল ধ্বংস করার ভার দেয়া হয়।সে ১৬ ই জুলাই রাত ১ টার সময় ঐ পুলে পাহারারত রাজাকারদের হত্যা করে তাদের নিকট থেকে ৫ টি ষ্টেনগান এবং পুলটি ধ্বংস করে দেয়।
নালিতাবাড়ি থানায় বেগুনবাড়ি ব্রীজ ধ্বংস করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হকের নেতৃত্বে তার কোম্পানীকে পাঠানো হয়।সে উক্ত পুল ধ্বংস করে।পার্শবর্তী গ্রামে সে আশ্রয় নেয়।ইতিমধ্যে পাক বাহিনী ওখানে এসে পড়ে এবং তাদেরকে আক্রমণ করে।এই আক্রমণে কোম্পানী কমান্ডার নাজমুল হক শাহাদাত বরণ করেন।উল্লেখযোগ্য যে,নাজমুল হক ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন।নালিতাবাড়িতে তার নামে একটি কলেজের নামকরণ করা হয়েছে।১৯ শে জুলাই পাক সেনাবাহিনীর তিনটি কোম্পানী ভোর পাঁচটার সময় হালুয়াঘাট ক্যাম্প থেকে রওনা হয়।এক কোম্পানী রামচন্দ্রকোরা বি-ও-পি হয়ে আমাদের হাইড-আউট ডালুর পূর্ব দিকে অবস্থান নেয়।আর এক কোম্পানী হাতি পাগার বি-ও-পি হয়ে আমাদের হাইড-আউটে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়।আর এক কোম্পানী সোজা ফালু চেকপোস্ট অভিমুখে অগ্রসর হয়।আমার তিন দিক থেকে ঘেরাও হিয়ে যায়।তখন ক্যাপ্টেন ত্যাগীও আমাদের সাথে ছিলেন।আমরা খুব অসুবিধায় পড়ে যায় এবং তাদের সাথে মোকাবিলা করি।আমাদের পক্ষে দু’জন শহীদ হয়।এই আক্রমণে ভারতীয় বি-এস-এফ’ এর ১১ জন সিপাহী নিহত হন এবং তাদের একজন জমাদার নায়েক সুবেদারকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়।
২৭ শে জুলাই ল্যান্স নায়েক মেজবাহউদ্দিন ও তার দলের সংগে নালিতাবাড়ি থানার অন্তর্গত তন্তর এবং মায়াঘাসিতে পাকিস্তানি সৈন্যর এক পেট্রোল পার্টির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।এই সংঘর্ষে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।মেজবাহউদ্দিন ও মারাত্নকভাবে আহত হন।
৬ ই আগষ্ট বান্দরকাটা বি-ও-পি ২ কোম্পানী এফ-এফ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র মাসুদ,ছাত্রনেতা হাশেম,এবং আমাদের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়।বান্দরকাটা বি-ও-পি তে পাকিস্তানীদের যথেষ্ট হতাহত হয়।শত্রুপক্ষের ৩০ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়।আমাদের পক্ষে পাঁচজন শাহাদাৎ বরণ করেন।
স্বাক্ষরঃ মোহাম্মদ জিয়াউল হক/২৭-৬-৭৪
সুবেদার মেজর