পুতুল নাচের খেল
৫ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশের মানুষ দখলীকৃত ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান শোনে না। গত পঁচিশে মার্চের পর থেকেই ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে তারা বর্জন করতে শুরু করে। এখন এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশের নারী, পুরুষ, শিশু
কেউ শোনে না। কে শুনবে? যারা নিজেদের চোখে দেখেছে মেঘনা নদীকে কারবালার রক্তরাঙা ফোরাত নদী হয়ে যেতে, যাদের চোখের সামনে হয়েছে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, তারা কি করে বিশ্বাস করবে দখলীকৃত ঢাকা বেতারের নির্লজ্জ মিথ্যা প্রচার? গল্পের পাগলা মেহের আলীর মতো অবস্থা হয়েছে ঢাকা বেতারের। মেহের আলী থেকে থেকে কেবল বলতো, সব ঝুট হ্যায়- সব ঝুট। ঢাকা বেতারও সেই মার্চ মাসের সাতাশ তারিখ থেকে কেবল চেচাচ্ছে, সব নর্মাল হায়- সব নর্মাল।
এবার রমজান মাসের শুরুতে যশোরের এক মুক্তাঞ্চলে গিয়েছিলাম। দেখি মাগরিবের নামাজ ও ইফতার সেরে গ্রামের মসজিদের এক ইমাম সাহেব তার ট্রানজিষ্টর রেডিও নিয়ে বসেছেন। নিবিষ্ট মনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছেন। পরিবেশটি বড় চমৎকার। আকাশে চাঁদ নেই। মিটি মিটি জ্বলছে তারার প্ৰদীপ। কার্তিকের হিমেল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। যে পুকুরের পাড়ে ইমাম সাহেব বসেছেন, তার পানিতে ঝিকিমিকি তারার প্রতিভাস। ক’দিন আগেই এই গ্রামটিতে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে- তার চিহ্ন এখন নেই। হানাদারেরা পালাবার সময় কোন কোন বড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ধানের গোলা পুড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতিতে গ্রামের মানুষ আবার নতুন উৎসাহে ঘর বাঁধার কাজে হাত দিয়েছে। তাদের কেউ হারিয়েছে তার প্রিয়তম ভাইকে। কেউ হয়েছে পিতৃহারা। কারো যুবতী বোন লাঞ্ছিত হয়েছে বর্বর হানাদার দস্যুদের হাতে। কিন্তু তাতে কারো চোখে অশ্রুকণা নেই। সব অশ্রুকণা পুড়ে যেন ক্রোধের বারুদ হয়ে গেছে। সকলের মুখে, সকলের বুকে এক প্রতিজ্ঞা- মরতে হয় আরো মরবো, তবু হানাদারদের দেশছাড়া করবো।
ইমাম সাহেবের পাশে বসে আমি দেখছিলাম সোনার বাংলার সংগ্রামী রূপ। এই তো কার্তিকের হিমে ভেজা বাংলার সবুজ ঘাস। মাথার উপরে সাদা মেঘের কারুকাজ করা নীল আকাশ। ইমাম সাহেব নিবিষ্ট মনে শুনছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম। এই গ্রামে আপনি কি একাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনেন, না সবাই শোনেন? ইমাম সাহেব হেসে বললেন, কি যে বলেন, সবাই শোনে। এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য আমরা সারাদিন পাগল হয়ে থাকি।
প্রশ্ন করলাম, এই অনুষ্ঠান শুনে কি লাভ হয় আপনাদের?
ইমাম সাহেব বললেন, আমাদের আশা বাড়ে, সাহস বাড়ে, বুকের হিম্মত বাড়ে।
এরপরই আমার কাছে সরে এসে বললেন, একটা সত্য ঘটনা বলি শুনুন। তখনো আমাদের এই গ্রাম মুক্ত এলাকা হয়নি। পাকিস্তানী সৈন্যরা চারিদিকে ঘোরাঘুরি করছে, দিনে-দুপুরে লুটপাট চালাচ্ছে, ঘরের মেয়েকে বে-আব্রু করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বুড়ো মানুষরা তখন কেবল চোখের পানিতে ভাসি, আল্লাহকে ডাকি আর ভাবি, মুক্তিবাহিনীর নওজোয়ানেরা কবে আমাদের গ্রামে আসবে? আমার ছোট নাতিটির বয়স বছর দশ। সে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনে। আমি তাকে একদিন সাবধান করে দিলাম, বললাম- নানু, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনিস না। মিলিটারিরা জানতে পারলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। নাতি বলল, কতজনকে মারবে! এই গ্রামের সকলেই তো লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনে। কেউ ঢাকা বেতারে হুক্কামে মারশাল ল’-র অনুষ্ঠান শোনে না।
এর পরই নাতি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো- আচ্ছা নানা, হুক্কামে মারশাল ল’র অর্থ কি?
নাতির প্রশ্ন শুনে এই বুড়ো বয়সেও ঠাট্টার লোভ সামলাতে পারলাম না। বললাম, নানু, হুক্কামে মারশাল ল’-র অর্থ- মার শালাদের। এই শালা কারা জানো? ওই বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যরা। বৃদ্ধ ইমাম তার নাতির গল্প শেষ করে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। আমি তাকে বললাম, আপনার নাতির কথা বুঝতে পারলাম। কিন্তু আপনি এবং আপনার এই মসজিদের অন্যান্য মুসল্লিরাও কি ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান শোনেন না?
ইমাম সাহেব বললেন, মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ। মুসলমানদের কাছে তো কবিরা গুনা। এটা পবিত্র রমজান মাস বাবা। আমাদের কাছে বড়ই পবিত্র মাস। এই মাসে মিথ্যা কথা বলার মতো শোনাও মস্তবড় পাপ। ঢাকা বেতার থেকে এই রমজান মাসেও রাত দিন যে মিথ্যা বলা হয়, আল্লাহর বান্দা, নবীর উম্মত হয়ে তা কেমন করে বরদাস্ত করি বাবা?… তবু মনকে চোখ ঠেরে না হয় ঢাকা বেতারের প্রাচারই বিশ্বাস করলাম, কিন্তু এর পরই একদিন শুনলাম নতুন প্রচার। শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তানের মিলিটারি সরকার বর্ডারে অভ্যর্থনা শিবির খুলেছেন। শুনে আমরা সবাই বেকুব ঢাকা বেতারই এতদিন বলে এসছে, যারা দেশ ছেড়ে গেছে তারা দৃস্কৃতকারী, তারা ভারতের চর। এখন সেই দৃস্কৃতকারী ও ভারতের চরদেরই আবার ফিরিয়ে আনার জন্য অভ্যর্থনা শিবির খোলা কেন?
এটা গেল জুলাই মাস পর্যন্ত প্রচার। আগষ্ট মাস ও সেপ্টেম্বর মাসে শোনা গেল নতুন কথা। দলে দলে শরণার্থী ভারত থেকে দখলীকৃত বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। ঢাকা বেতার থেকে বলা হলো, রোজ হাজারে হাজারে মানুষ ফিরে আসছে। আগে যারা বলেছিলেন মুষ্টিমেয় দুষ্কৃতকারী দেশ ছেড়েছে- তারা পরে কি করে বললেন, হাজারে হাজারে দেশত্যাগী ফিরে আসছে? এটা যে বাবা আমাদের সেই পুঁথির বয়ানের মত-
লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতারে
শুমার করিয়া দেখি চল্লিশ হাজার।
মাঝখানে ঢাকা বেতারের মুরুবিবরা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের মিথ্যা প্রচার বিশ্ববাসীর কাছে ধরা পড়ে গেছে। তাই ফাঁক বুঝে এক সময় বলা হলো, ভারতে কিছু শরণার্থী গেছে বটে, কিন্তু তাদের ভয় দেখিয়ে ও লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শোন বাবা কথা। বিদেশের রেডিওতেও শুনেছি, বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে নব্বুই লাখ শরণার্থী গেছে। কেউ লোভ দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে এতগুলো লোককে রাতারাতি দেশছাড়া করতে পারে? আর যদি তা পারাই যায়, তাহলে তোরা কেন বাপু ভারতের অন্তত এক হাজার লোককেও ভয় দেখিয়ে, কি লোভ দেখিয়ে তোদের দিকে নিয়ে আসতে পারিস না? দেখা না তোদের কথার সত্যতা!।
ইমাম সাহেব থামলেন, দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, কত আর বলবো বাবা, বললে কিসসা ফুরায় না। সারা আগস্ট আর সেপ্টেম্বর মাসে শুনেছি, ভারত থেকে হাজার হাজার শরনার্থী ইয়াহিয়া খানেদের অভ্যর্থনা শিবিরে ফিরে যাচ্ছে। যে হারে হিসাব দেয়া হয়েছে, তাতে এতদিনে নব্বুই লাখ লোকেরই দেশে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন ওই ঢাকা বেতারেই তাঁবেদার গভর্নর মল্লিক মিয়ার একটা ভাষণ শুনলাম। মল্লিক মিয়া বলেছেন, ভারত রাজি হলে তারা বিমান পাঠিয়ে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবেন। শোন বাবা কথা! এতদিন তোরা বল্লি সব শরণার্থী ফিরে গেছে। তাহলে বিমানে কবে কাদের আবার ফিরিয়ে নিতে চাইছিস? এ জন্যই কথায় বলে, মিথ্যাবাদীর স্মরণশক্তি কম। আগে জেনে শুনেও ওরা কত মিথ্যা বলতে পারে, তা যাচাই করার জন্য ঢাকা বেতর ধরতাম। এখন আর ধরি না। এই রমজান মাসে মিথ্যা শোনাও পাপ। বাবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই কথাটা কেন তোমরা ঢাকা বেতারকে জিজ্ঞাসা কর না- প্রত্যেক দিন এত মিথ্যা কথা বলতে ওদের জিহবা আড়ষ্ট হয়ে যায় না? ঈমান কমজোর হয়ে যায় না? আমি বাবা এখন ঢাকা বেতার ধরি না। কেউ ধরে না। খামোখা কেন মিথ্যা কথা শুনে গুণাহগার হই বলো! তার উপর এখন তো আবার রমজান মাস।
ইমাম সাহেবকে বললাম, এ নিয়ে দুঃখ করবেন না। দখলীকৃত ঢাকা বেতারে এখন চলছে পুতুল নাচের খেল। পুতুলকে দিয়ে যা বলানো হচ্ছে, তাই তারা বলছে। যে খেল খেলানো হচ্ছ তা-ই তারা বলছে। মেফিষ্টোফিলিস আর ফাউষ্টের কাহিনী আপনি জানেন না- শয়তানের কাছে আত্মা বন্ধক রেখে এক সাধুর কি পরিণতি হয়েছিল। ঢাকা বেতারেরও এক শ্রেণীর ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী তাদের আত্মা, বিবেক, সততা ও মনুষ্যত্ববোধ কয়েকটা টাকায় বন্ধক রেখেছে খুনী দস্যু ইয়াহিয়া চক্রের কাছে।
ইমাম সাহেব কি বুঝলেন জানি না। দুঃখিত স্বরে বললেন, বাবা, এর কি কোন প্রতিকার নেই? তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম, আছে এবং সেই প্রতিকারের দিনও খুব দূরে নয়। শিগগিরই বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ঢাকা বেতার কেন্দ্রসহ সারা দখলীকৃত এলাকা মুক্ত করবে। আবার ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে আপনারা শুনতে পাবেন মুক্ত বাংলার মুক্ত কণ্ঠ, সত্য ও সুন্দরের জয় ঘোষণা ।
ইমাম সাহেব ভাবাবেগে আশ্রম্নপূর্ণ চোখ মুছে বললেন, আমিন, আমিন। ইয়া আল্লা, রব্বুল আলামিন, বাংলাদেশের সেই সুদিন যেন দেখে যেতে পারি।
কার্তিকের সেই স্বপুসন্ধ্যায় ইমাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
(আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত)