রণ দামামা
৬ জুলাই, ১৯৭১
“এসো শ্যামল সুন্দর,
আনো তব তৃষ্ণাহারা তাপহারা সঙ্গসুধা
বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে”
গ্রীষ্মের খরদাহ তাপক্লিষ্ট রুদ্র রূপের পর বর্ষা তুমি এসেছে। তোমার রুমঝুমঝুমু নৃত্য আমার হৃদয়ে ফেনিল তরঙ্গোচ্ছাস তোলে না। রুদ্র দাহনের পর তোমার শ্যাম-সুন্দর সরল আগমন। আজ জনমত সঞ্জীবিত তোমার রসসিঞ্চনে। হারান সম্পদ বিয়োগব্যথার ত্রিধরা প্রকৃতি আজ শীতল হল।
গুরু গুরু মেঘ গুমরি গরজে গগনে গগনে। সেই সাথে গরজে আমার উত্তাল তরঙ্গ বিষুব্ধ মন। আজ হৃদয় দুর্জয়, অশান্ত, টালমাটাল। ঘন বর্ষার বাংলার ঘুমন্ত রানীল তন্দ্ৰালু স্বপ্নাচ্ছন্ন বেশ ঝমঝম করে একটানা করছে। ঝরে পড়া জলের সমুদুরে আরও নতুন ধারা পড়ে বাঙ্ময় হয়ে উঠছে। আমার হৃদয় সমুদ্রেও তেমনি বিক্ষুব্ধ কল্লোলধারা অশান্ত উৰ্মিমালা উখিত-পতিত হচ্ছে ভীমবেগে। আজ জনতা সাগরে জেগেছে উর্মি টালমাটাল’। স্বাধীন বাংলায় বর্ষা এসেছে নতুন জাগরণের বাণী নিয়ে, উত্থানের মন্ত্র নিয়ে- ঘুমপাড়ানী গান যেন নয় শিকল-ছেড়া বাঁধনহারার গান গেয়ে। তরুণ অরুণের বহ্নিশিখার মতো প্রতিজ্ঞার ভাস্বরতা নিয়ে।
হৃদয়-বারিধি তীরে সে আহবানের অনুরণন। নতুন নতুন শপথের দীপ্ত প্রতিভাস, নবীন প্রত্যয়ের সুরে ঝংকৃত অসংখ্য প্রতিজ্ঞার মালা হৃদয়কে আরও কঠিন, আরও ভৈরব-রুদ্র করে তুলছে। বরষার মন্দ্রার মঞ্জরী উত্তরীয় আর হৃদয়পদ্মের কোমল পাপড়িকে আন্দোলিত করে না, বরং নব উচ্ছাসে হৃদয়ের ঘুমন্ত বিদ্রোহী সত্তাকে জাগিতে তোলে। আজ প্রাণের রুদ্রবীণায় একটি সুরের লয় মিলে-মুক্তির সুর, স্বাধীনতার সুর। রিমঝিম সুরের ঐকতান হৃদয়ের নিকুঞ্জবনকে স্বর্ণমদিরায় অসল-উতল ঘুম আর্দ্র করে তোলে না, বরং বিসুভিয়সের সুপ্ত লাল লাভা উদগীরণ করে। বর্ষার কলকল্লোল বারিধারা, ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনীর উদম কলহাস্য, তাল-তমালের শিহরণ এখন আর হৃদয়ের পেলবতন্ত্রীতে সুন্দরে ঝঙ্কার তোলে না বরং দুরন্ত দুর্দম কালবোশেখীর প্রলয়বিষাণ বাজায় হৃদয়মধ্যে। কদম্ব-কেতকী-কামিনী আর কুমুদ-কহলার অনুপম অনাবিল সৌন্দর্যের মধ্যে দেখি ভয়ঙ্কর সুন্দরের প্রতিভাস। স্ফীতকায়া নির্বারিণীর সলিল-উল্লম্ফনে রক্তের ফিনকি চমক দিয়ে যায়। বজ্রামানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ়ের মালায় একটি রক্তকবরী গেথে দেই। যেন এক শপথের গুচ্ছ শহীদী রক্তের সিক্ত হয়ে নতুন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করছে। বিজলী চমকের ঝিলিকে সে প্রত্যয় আরও প্রোজ্জ্বল, আরও দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে। মেঘমল্লার রাগে নতুন করে বাজুক রণদামাম- ‘জয় নিপীড়িত প্রাণ, জয় নব উত্থান’।
(দিলীপ কুমার ধর রচিত)