প্রতিধ্বনি

প্রতিধ্বনি

১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সেখানে অন্যায় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, যেখানে মানুষ মানুষের রক্ত চোষে, যে দেশে রক্তের স্রোত বয়, পংকিলতা আর কুটিলতার শত আচ্ছাদন ভেদ করে সেখানেই ফুটে ওঠে নতুন সূর্য রক্তনদীর ঢেউ চুরমার করে দেয় শোষণ-নির্যাতনের যাতাকল। এটাই চিরন্তন সত্য। আর এই মহাসত্যের ভিত্তিইে এই নরম রোদের দেশবাংলায় আজ আমরা হয়েছি সৈনিক। পক্ষান্তরে পাক জঙ্গিশাহী বাংলাদেশে শোষণ, নির্যাতন ও নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েও যখন আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারনি বরং বাংলাদেশের অর্থের ওপর নির্ভরশীল গোটা পশ্চিম পাকিস্তানই টুকরো টুকরো হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে, তখন গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচারণায় বিশ্বজনমতকে ধোঁকা দেবার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে ইয়াহিয়া চক্র।

বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় খুনী টিক্কার পরিবর্তে ডাক্তার মালিককে গবর্নর নিয়োগ এমনি একটি চক্রান্ত। এর পেছনে জঙ্গিশাহীর চারটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত বাঙালী গবর্নর নিয়োগ করে বাঙালীদের বিভ্রান্ত করে যুদ্ধকে দুর্বল করে দেয়। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসন চালু হচ্ছে বলে বিশ্ব-বিবেককে ধোঁকা দেয়া।

ডাক্তার মালিককে গবর্নর নিয়োগের তৃতীয় কারণটি হচ্ছেঃ ইয়াহিয়া খান একটা ব্যাপারে অত্যন্ত সুনিশ্চিত যে, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার গবর্নর আজ হোক, কাল হোক মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের হাতে নিহত হবেই। সুতরাং জঙ্গিশাহীর কথা হচ্ছে, মরবেই যখন পশ্চিম পাকিস্তানী কেন, একজন বাঙালীই মরুক। চূড়ান্ত এবং প্রধান কারণটি হচ্ছে বেসামরিক প্রশাসনের মুখোশ ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থাকে চাঙ্গা করবার জন্য বৈদেশিক সাহায্যে বাগানো। কারণ বাংলাদেশ পরিস্থিতির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জঙ্গিশাহীকে সাহায্যদান বন্ধ করে দিয়েছে।

ডাক্তার মালিককে গবর্নর নিয়োগের দুরভিসন্ধি ধরা পড়ে গেছে বিশ্ববিবেকের কাছে। তাই বিশ্বের নামকরা পত্রপত্রিকা ও বেতারে এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া চক্রের কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার ব্রডকাস্টিং কমিশনের রিপোর্টার মি.শ্যোন ও কনার ঢাকা সফর শেষে বলেছেন। “টিক্কা খানকে সরিয়ে ডা. মালিককে দখলীকৃত এলাকার গবর্নর নিয়োগের আসল উদ্দেশ্য বিদেশী সাহায্য বাগানো এবং বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করা।”

এ প্রসঙ্গে গাডিয়ান পত্রিকার মি. মার্টিন এডিনি বি-বি-সি থেকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় অসামরিক গবর্নর নিয়োগ করা হলেও সামরিক তৎপরতার কোন পরিবর্তন ঘটবে না ।” অর্থাৎ “বাংলার নিরীহ জনগণের ওপর পাক বর্বরতা ঠিকই চলবে এবং বেসামরিক গবর্নর ডা. মালিক সামরিক বাহিনীর হাতের পুতুল মাত্র ।”

জন্মভূমি থেকে হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করে দেশকে মনের করে গড়ে তুলতে আজ আমরা বদ্ধপরিকর। আমাদের দুর্বার প্রথিরোধের সম্মুখে টিকতে না পেরে দখলীকৃত এলাকায় জাতিসংঘের রিলিফ কর্মী নিয়োগের আরেকটি চক্রান্ত এটেছে জঙ্গীশাহী। কিন্তু আমরা জানি এই রিলিফ কর্মী নিয়োগের আসল উদ্দেশ্য কি। জঙ্গীশাহী চাচ্ছেঃ রিলিফ কর্মীর কথা বলে বাংলার বুভুক্ষ জনতাকে যেমন যুদ্ধ সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা যাবে, তেমনি বিশ্বজনমতকে বাঙালীর দরদি সেজে ধোঁকা দেয়া যাবে।

আমরা এও জানি, জাতিসংঘের এই তথাকথিত রিলিফ কর্মীদের বাংলাদেশে নিয়োগের উদ্দেশ্য হচ্ছে জঙ্গশাহীর বর্বরতা-ও পৈশাচিকতায় সহায়তা করা। অর্থাৎ এদের ভূমিকা হবে দস্যুবাহিনীর দালালদের প্রতি আমাদের যে ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে এদের প্রতিও তাই করা হবে।

এই প্রসঙ্গে বি-বি-সি থেকে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনীর একজন মুখপাত্র জাতিসংঘকে এই বলে হুশিয়ার করে দিয়েছেন যে, তাদের রিলিফ কর্মীদের জঙ্গীশাহীর দালাল বলেই গণ্য করা হবে এবং তারা দালালদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থারই আওতায় পড়বে। বি-বি-সি থেকে আরও বলা হয়, এ ব্যাপারে জাতিসংঘ থেকে কোন মন্তব্য করা হয়নি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীর মুখপাত্রের এই হুশিয়ারি জাতিসংঘকে বেশ খানিকটা ভাবিয়ে তুলেছে।”

ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে বলা হয়, “ডেমোক্রাট দলের নেতা এডওয়ার্ড কেনেডির মতো রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর পার্সীও পাকিস্তান সরকারকে আমেরিকান সাহায্য দান বন্ধের দাবী জানান।”

বি-বি-সি রিপোর্টার মিঃ মাটিন বেল সম্প্রতি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের জন্য ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি শরণার্থীদের অসীম দুঃখ-দুর্দশাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন- শুনেছেন পাক জঙ্গীশাহীর চরম বর্বরতা ও পৈশাচিকাতর অনেক করুণ কাহিনী। কিন্তু তিনি লাখ লাখ লাঞ্ছিত মানুষের শুধু একটা প্রমাণই দেখেছেন। শুনেছেন একই কথা। চাপ চাপ যন্ত্রণায় সে কথা চাপা পড়ে যায়নি বরং আরো বলিষ্ঠ হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। আর সে কথাটি হচ্ছে বাঙালীর অন্তর মথিত হৃদয়-সঙ্গীত “জয় বাংলা।’

(শহীদুল ইসলাম রচিত)

Scroll to Top