রেনেসাঁর সূচনাঃ বাংলাদেশ
৪ নভেম্বর, ১৯৭১
রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ কথাটা আজ নানা সূত্রে- বিশেষ করে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ প্রগতি উপলক্ষে বারংবার উচ্চারিত। রেনেসাঁর দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের সামনে রয়েছে বহু আলোচিত ইওরোপীয় রেনেসাঁ এবং উনিশ শতকে বাংলার রেনেসাঁধর্মী নবজাগরণ। বর্তমানে বাংলায় যে মুক্তি আন্দোলন বাঙালী চাই। এই জাগরণ বা অভ্যুত্থানকেই রেনেসাঁ না বলে রেনেসাঁর লক্ষণ বলতে চাই এই কারণে যে, রেনেসাঁ মুখ্যতঃ গঠনধর্মী, আর এখন আমরা একটি অচলায়তন ভাঙ্গার কার্যে ব্ৰতী- ভাঙ্গার পরে গড়বার পালাস্বভাবতঃই সে দায়িত্বও হবে দুরূহ এবং তাতে প্রয়োজন হবে মুক্তিযুদ্ধের মতোই চরিত্র ও সংকল্পের প্রতি একনিষ্ঠতা। বর্তমান সংগ্রামে যে দুর্জয় শক্তি ও মানসিক বলের পরিচয় বাঙালী দেখিয়েছে- তা মুক্ত নবজীবনকে অঙ্গীকার করার প্রবল বাসনা থেকেই জাগ্রত।
বাঙালীচিত্তের এই নবজীবন প্রয়োগের পশ্চাতে যেসব অনুপ্রেরণা কার্যকরী সেসবের লক্ষণ বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারব রেনেসাঁর সূচনা কত স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী।
স্বাধীনতা নিজেই একটি জাতির জীবনে অনুপ্রেরণাস্বরূপ হতে পারে এবং তার নবজাগরণ সূচিত করতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সে আশাকে সফল হতে দেয়নি। বৃহত্তম জনসমষ্টির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে পঙ্গু করার চক্রান্তের মধ্য দিয়ে তার জাগরণ সম্ভাবনাকে-সুপরিকল্পিতভাবে বিনষ্ট করার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় মেতে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী পাঞ্জাবী চক্রান্ত। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এর ফল হয়েছে বিপরীত। জলস্রোত যেমন আপন গতিপ্রবাহেই সব বাধাকে অতিক্রম করে সম্মুখগামী- তেমনি বাঙালীর নবজীবন তৃষ্ণাও কোন ষড়যন্ত্র বা বাধাকে গ্রাহ্য করেনি বরং বিরুদ্ধতা তার শক্তিকে সংহত করেছে। রেনেসাঁর বিশেষত্বগুলিকে সংক্ষেপে এভাবে প্রকাশ করা যায়। যেমনঃ
১। জাতির অতীত ঐতিহ্য থেকে রস আহরণ এবং তার পুনর্মুল্যায়ন।
২। সংস্কারমুক্ত উদার জীবনবোধ।
৩। অপরিময়ে জীবনতৃষ্ণা।
মাটির রস যেমন বৃক্ষদেহে সঞ্চারিত হয়ে তাকে সজীব রাখে, তেমনি ঐতিহ্যও একটি জাতির জীবনের সঞ্জীবনী সুধা। পাকিস্তানী শাসকচক্র প্রথমেই আঘাত হানে বাঙালীর যুগ যুগ সঞ্চিত ঐতিহ্য সম্পদের ওপর। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সৃষ্টি হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও লোকশ্রুতিকে হিন্দুয়ানীর গোড়া অজুহাতে বাতিল করে দেওয়া হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা হয়, নজরুলের
সাহিত্যে হিন্দু পৌরাণিক দেবদেবীর উল্লেখের জন্যে তাকে পৌত্তলিক বলে উপেক্ষা করা হয়- সর্বোপরি দেশের শতকরা ৬৫ জনের ভাষা বাংলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা বলে ফতোয়া জারি করে বাঙালীর প্রাণরস শুষ্ক করে দেবার ষড়যন্ত্রের মেতে ওঠে এই কীর্তিমানেরা। কিন্তু মনন-সমৃদ্ধ বাঙালী সেদিন ধরে ফেলে এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের স্বরূপ। সে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করল, বাংলার আবহমান কালের ঐতিহ্য-ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি সমস্তই তার রক্তধারায় প্রবাহিত। বাংলা ভাষা তার বুকের রুধিরের চেয়েও প্রিয়। প্রমাণ দিতে হলো বুকের রক্ত দিয়েই। ভাষার জন্যে প্রাণদান। লিখিত হলো নব ইতিহাস। বাঙালী মুসলমান তার ধর্মের প্রতি অনুগত থেকেও খর্জুর কুঞ্জের পরিবর্তে আম্ৰবীথির শোভা নিরীক্ষণ করলেন। শুরু হলো বাঙালীর আত্মঅন্বেষা এবং তার পুনর্জাগরণ। ইওরোপের এবং উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসেও দেখি ঐতিহ্যের পুনরালোচনা এবং তার থেকে শক্তি সঞ্চয়। সুতরাং ঐতিহ্যের নব-স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালী জীবনেও রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়েছে এ ঘোষণা করা চলে নিদ্বিধায়।
২। সংস্কারমুক্ত উদার জীবনবোধ রেনেসাঁর একটি বিশেষ লক্ষণ। সংস্কারের আবাসস্থল হলো আচল মন। যে মন নিত্য বহমান, সে মনে কখনো সংস্কারের জড়বুদ্ধি আশ্রয় পায় না, সেই আচল মনের নিত্যসংগ্রাম বিশ্ব মানবসমুদ্রের চিন্তা-তরঙ্গে। মধ্যযুগের অন্ধকার অতিক্রম করে ইউরোপ রেনেসাঁ যুগের আলোকোজ্জ্বল পথে পা বাড়ালো মুক্তিবুদ্ধির প্রদীপ হাতে নিয়ে। উনিশ শতকে বাংলার চিত্ত বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল ইউরোপের এই সচল মনের স্পর্শেই। মানস-মুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পদক্ষেপের বেলায়ও একথা অনেকখানি সত্য। এই আলোকাভিসারের প্রথম যাত্রী ঢাকার শিখা গোষ্ঠী। সংস্কারমুক্তির ক্ষেত্রে তাঁদের সেদিনের ক্ষুদ্র অথচ উজ্জ্বল অর্থপূর্ণ প্রয়াসের ফল ভেতরে ভেতরে আজও অবশ্যিই ক্রিয়াশীল। মহৎ আজ বা আন্দোলন- তা যতো সামান্যই হোক- এইভাবেই যুগতিক্রমী হয়। সেদিন তাঁদের আন্দোলন নির্বিরোধে হয়নি। বর্তমান জাগরণের সূত্রপাতে বাধা এসেছে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল পাঞ্জাবীচক্রের তরফ থেকে। তাদের আশংকা, আলোকপ্রাপ্ত বাঙালী হবে শোষণের প্রতিবন্ধক। তাই ওদের ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেয়াল গাঁথার আরা আমাদের নিয়ত প্রয়াস দেয়াল ভাঙ্গার। শিক্ষার সংকোচন, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের লাঞ্ছনা, বাংলার ঐতিহ্যকে বিদেশীয় বলে ঘোষণা, বিভিন্ন জাতির মধ্যে কৃত্রিম বিরোধ সৃষ্টির দ্বারা এক-জাতীয়তার ধারণাকে বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস-এর প্রত্যেকটি বাঙালীকে অন্ধকারে রাখার ষড়যন্ত্রের অংশ।
তবে এ ষড়যন্ত্রের পূর্ণ স্বরূপ বাঙালীর নিকট পরিষ্কার। সর্বপ্রকার অচলায়তানকে দূর করে জাতির যাত্রা এক মহাজীবনের পথে, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এক বাঙালী জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির পথে। এক্ষেত্রে একটা কথা অবশ্যি স্বীকারযোগ্য যে, বিংশ শতাব্দীর এই রাজনীতি-প্রাধান্যের যুগে যেহেতু সব রকম আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রাজনীতির অবস্থান, সুতরাং বাংলাদেশের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি এখানেও নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং এই মুহুর্তে আমাদের প্রধান লক্ষ্য যুদ্ধজয়ের দ্বারা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন। কিন্তু সমগ্র জাতির পরম লক্ষ্য এক বিপুল জীবনের আহবান সেই আহবানের পথে সার্থক পদক্ষেপেই পথে বাঙালী জীবনের সার্বিক জাগরণ বা রেনেসাঁ।
(সুকুমার হোড় রচিত)