স্বদেশ স্বকাল
২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশে পাকিস্তানের মৃত্যু হলো আনুষ্ঠানিকভাবে এবং সেই সাথে শেষ হলো শাসনের এবং শোষণের একটি কলংকজনক অধ্যায়। হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা এক তুলনাহীন বেঈমানকে, যে ভাইয়ের মুখোশ পরে সিন্দাবাদের গল্পের সেই অসহ্য দৈত্যটার মত বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছিল গত চব্বিশ বছর ধরে, অবশেষে আমরা উৎখাত করলাম বাংলাদেশের মাটি থেকে। স্বেচ্ছায় ঘাড় থেকে নামেনি লোভী দৈত্যটা বারবার প্রচণ্ডভাবে মার খেয়ে একটি পরাজিত আহত কুকুরের মত সে আত্মসমর্পণ করেছে প্রাণ বাঁচাবার নিতান্ত জৈবিক তাড়নায়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের কবর রচিত হবার সাথে সাথে মৃত্যু হলো উগ্র সাম্প্রদায়িকতার, যে বিষ একদিন বাংলাদেশের মানুষের উপর উগড়ে দেবার চেষ্টা করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানী প্রাসাদষড়যন্ত্রীরা। বিগত চব্বিশ বছর ধরে পাকিস্তানী প্রভুরা এই উৎকট বিষবৃক্ষটিকে বাংলাদেশের মাটিতে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। কারণ, নিরবচ্ছিন্ন শাসন এবং শোষণ চালিয়ে যাবার জন্যে প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, একজন বাঙালীকে অন্য একজন বাঙালীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। এর জন্যে আমদানী করার চেষ্টা চলেছিল সাম্প্রদায়িকতার, যা মানুষকে ঘৃণা করে, অবিশ্বাস করতে এবং অর্থহীন হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে।
এই সচেতন উগ্র সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রভুরা- এ কথা সত্যি, কিন্তু এই বিষবৃক্ষটির লালনে এবং পুষ্টিসাধনে নিরন্তর সহায়তা যুগিয়েছে একদল বাংলাদেশের ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীযারা সামান্য কিছু লাভের আশায় নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমা প্ৰভুদের প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে পদলেহী কুকুরের মত। সাম্প্রদায়িকভাবে বাংলাদেশের মাটিতে জিইয়ে রাখবার জন্যে এরা সব রকম ঘৃণ্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে- এমনকি বাঙালী সংস্কৃতিকে সমূলে বিনাশ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেও এদের বিবেকে বাধেনি। এরাই প্রচেষ্টা চালিয়েছে, উর্দু হরফে বাংলার প্রচলনের, এরাই ফরমান দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ বর্জনের, এরাই মুখর হয়েছে বাঙালী আচার-অনুষ্ঠান পালনের বিরুদ্ধে। সর্বস্তরে এই উৎকট ব্যাধিটিকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে সমগ্র দেশব্যাপী গড়ে তুলেছে বিএনআর, পাকিস্তান কাউন্সিল ইত্যাদি মগজ ধোলাইয়ের প্রতিষ্ঠান। এরাই বিকৃত করে রচনা করেছে ইতিহাস, এমনকি সুকুমারমতি শিশুদের মনটিকে পর্যন্ত বিষিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে- সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে। এদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাঙালীর বাঙালিত্ব, তার আচার অনুষ্ঠান, তার ভাষা, তার আজন্মের অন্তরঙ্গ সংস্কৃতি। পশ্চিমা প্ৰভুদের সুরে সুর মিলিয়ে এরাও গান ধরেছিলঃ বাঙালীয়ানা আসলে হিন্দুয়ানীরই নামান্তর মাত্র। বাংলা ভাষাটাই নাকি হিন্দুদের ভাষা- মায়ের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাঙালী মুসলমানের তাতে কোন অধিকার নাই। অতএব একজন সাচ্চা পাকিস্তানী হতে হলে এইসব বাঙালীয়ানা সযত্নে পরিহার করতে হবে এবং তার বদলে গ্রহণ করতে হবে পশ্চিমা প্ৰভুদের প্রেরিত সেই ঘৃণ্য, ব্যাধিটিকে, যার নাম সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা। বাংলাদেশে বাঙালী সংস্কৃতি চলবে না, তার বদলে বরণ করতে হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ধোলাই হয়ে আসা পাকিস্তানী তমদ্দুন নামক আজব বস্তুটিকে। এসব কুকীর্তির বিনিময়ে কুচক্রী প্ৰভুদের কাছ থেকে কিছুই যে ইনাম মেলেনি তা নয়। এই পাপের পথে পদচারণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কুখ্যাত শিক্ষকটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ লাভ করেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ঘৃণ্য মীরজাফরটি পেয়েছে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের রাষ্ট্ৰীয় পুরস্কার এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ। এবং একইভাবে লাভবান হয়েছে তাদের সমগোত্রীয় ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু এই সমস্ত ঘৃণ্য দেশদ্রোহীদের চক্রান্ত কোদিনই বিভ্রান্ত
করতে পারেনি বাংলাদেশের মানুষের মুক্তবুদ্ধিকে- ফেলে আসা কয়টি উজ্জ্বল গণআন্দোলন এবং আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায় এই মন্তব্যের সপক্ষে রায় দেবে। নগ্ন অর্থনৈতিক শোষণ যখন বাংলাদেশের মানুষকে নিক্ষেপ করেছে এক অকল্পনীয় দুঃসময়ের বিবরে, তাদের কাছে দিনের আলোর মত স্বচ্ছ হয়ে গেছে চক্রান্তের আসল রূপটি।
মুক্ত বাংলাদেশে তাই আজ সাম্প্রদায়িকতার কোন ঠাই নেই। আপন ধর্মবিশ্বাসে অবিচল থেকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দিতে রাজি নই। আমার সোনার বাংলাদেশে তাই আর সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কোন কথা নেই- প্রতিটি মানুষের আপন আপন ধর্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা এবং স্বাধিকার নিয়ে বাঁচবার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মুক্তবুদ্ধিকে কিভাবে আচ্ছন্ন করে, এ কথা আলোচনা করতে গিয়ে এই মুহুর্তে অনেক দিন আগে পড়া সুসাহিত্যিক শ্রী মনোজ বসুর একটি আশ্চর্য সুন্দর গল্পের কথা আমার মনে পড়ছে। দেশ বিভাগকালীন অর্থহীন সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার পটভূমিতে লেখা গল্পটি। এক গ্রামে পাশাপাশি বাস করত দুটি পরিবার- একটি হিন্দু, অন্যটি মুসলমান। এই দুই পরিবারের সম্পর্ক ছিল নিবিড় সম্প্রীতির এবং অন্তরঙ্গতার। তারপর- এক সময় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের একটি ছোট্ট ঢেউ সেই সুদূর গ্রামটিতেও গিয়ে লাগল এবং ফাটল ধরল সম্পর্কের। একে অন্যকে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করল, সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। বন্ধ হয়ে গেল মেলামেশা পর্যন্ত। দু’বাড়ির দুটি ছোট ছেলেমেয়ে কিন্তু এতসব জানতো না। তাই বাপ-মা’র নিষেধ সত্ত্বেও তাদের লুকিয়ে মেলামেশা বন্ধ হয়নি।
একদিন হিন্দু বাড়ির সেই ছোট্ট ছেলেটি মুসলমান বাড়ির মেয়েটিকে বলল, “জনিস মুসলমানরা হিন্দুদের দেখলেই কেটে ফেলছে।’
তুই কিছু জানিস না, মেয়েটি বলল। আসলে হিন্দুরাই মেরে ফেলছে মুসলমানদের। একটু নীরবতা। তারপর মেয়েটি বলল, আচ্ছা তুই হিন্দু দেখেছিস?
ছেলেটি বলল, নাতো! তা তুই মুসলমান দেখেসনি? মেয়েটি উত্তর করল, না রে! দরকার নেই বাবা ওসব হিন্দু-মুসলমান দেখে।
ছোট্ট ছেলেমেয়ে দুটি খুবই আশ্বস্ত বোধ করল এই ভেবে যে, ওদের কাছাকাছি কোন হিন্দু’ বা “মুসলমান নেই।
গল্পটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কি হাস্যকর এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, যার নিরর্থকতা ছোট্ট দুটি ছেলেমেয়েও তাদের সহজাত বুদ্ধিতে বুঝতে পেরেছে।
উগ্র ধর্মান্ধতা অনেক দেখেছি আমরা, বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছি তার বিষাক্ত নখরে। তাই বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে এই কুৎসিৎ বিষবৃক্ষটিকে ঠাই দিতে আর প্রস্তুত নই আমরা।
(অসিত রায় চৌধুরী রচিত)