শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত রণাঙ্গন সম্পর্কিত কয়েকটি কথিকা | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র- এর দলিলপত্র | সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭১ |
দখলীকৃত এলাকা ঘুরে এলাম
২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
এক
মুজিবনগরে এসেছিলাম প্রায় দু’মাস আগে। তাই এ দু’মাস শুধু পরের মুখেই শুনেছি দেশের দখলীকৃত এলাকার কথা শুনেছি পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনীর গণহত্যা, নির্মম অত্যাচার, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের লোমহর্ষক কাহিনী। তাই, মনে মনে ভাবছিলাম একবার বাড়ি যাব। স্বচক্ষে দেখে আসব দেশের ও দশের অবস্থা। পারলে ওদেরকে একটু প্ৰবোধও দিয়ে আসব। আর বলে আসব তোমাদের মুক্তির দিন আগত প্রায়।’
কিন্তু যাবো বললেই ত যাওয়া হয় না। প্রথমত, আমি যে দায়িত্বে ন্যস্ত তা কার হাতে দিয়ে যাই। তার ব্যবস্থাও যখন করলাম তখন দেখা দিল নতুন ফ্যাসাদ। বন্ধু-বান্ধব ও হিতাকাংক্ষীদের দু’একজন ছাড়া সবাই নিষেধ করে বললেন, ‘গেলে আর ফিরে আসতে পারবেন না। ওরা পেলে আপনাকে গুলি করে মারবে।’
তবু সব উপেক্ষা করে একদিন রওয়ানা দিলাম, অতি ভোরে। হাঁটতে হাঁটতে সকাল ১১টা নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। বন-জঙ্গল ও গাছপালার ঘেরা একটা ছোট্ট গ্রাম। তারই মধ্যে একটা পোড়ো বাড়িতে এই ক্যাম্প। বাড়িটার চারদিকে এক মাইলের মধ্যে নেই আর কোন বাড়িঘর। তবে এলাকাটা এমন জনমানবহীন সব সময় ছিল না। সোনার বাংলাকে দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণে যারা শাশানে পরিণত করেছে, তাদেরই লেলিয়ে দেওয়া খুনী সৈন্যরা গত এপ্রিল মাসে সমগ্র এলাকাটিকে উজাড় করে দিয়েছে। বহু লোককে ওরা গুলি করে মেরেছে, প্রায় সমস্ত বাড়িঘর ওরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই এসবের পরও যারা বেঁচে ছিল তারা সীমান্ত আতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
ক্যাম্পের কাছে যেতেই কে একজন হল্ট’ বলে চেচিয়ে উঠল। ডানে তাকিয়ে দেখি রাইফেল হাতে একজন তরণ। সম্ভবত কয়েক মাস আগে সে কোন কলেজে পড়ত। কাছে এসেই জিজ্ঞেস করল, আমি কে এবং কি জন্য ওখানে গিয়েছি। বললাম, আপনাদের কম্যাণ্ডার সাহেবের সাথে দেখা করব, ব্যক্তিগত প্রয়োজন আছে।
সৈনিক আমাকে দাঁড়িয়ে রেখে আরেকজনকে ডেকে আনতে গেল, কয়েক কদম আগে। মধ্য-বয়সের দ্বিতীয় লোকটি কাছে এসে অতি বিনয়ের সাথে জানতে চাইলেন আমার পরিচয় এবং কম্যাণ্ডার সাহেবের সাথে আমার সাক্ষাতের কি প্রয়োজন। তার প্রশ্নের যথাযথ জবাব দানের পর তিনি আমাকে একটা গাছের গোড়ায় বাঁশের চটায় তৈরী একটা বেঞ্চিতে বসতে বলে ভেতরে গেলেন। তারপর মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরে এসে আমাকে কম্যাণ্ডার সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন।
র্যাঙ্ক তার ক্যাপ্টেন বটে, কিন্তু তিনি হলেন ঐ ক্যাম্পের সর্বাধিনায়ক। আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে যুদ্ধ করছেন তারই নির্দেশে। সারাদিন সারারাত বসে বসে তিনি খবরাখবর নেন শত্রুর
গতিবিধির। তারপর স্ট্রাটেজী ঠিক করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠান এ্যাকশনে, মাঝে মাঝে তিনি নিজেও এ্যাকশনে যান, তবে তা নির্ভর করে এ্যাকশনের গুরুত্বের উপর।
দোহারা চেহারার লোক এই ক্যাপ্টেন বা কম্যাণ্ডার। তাকে আগে কোথায় দেখেছি বলে আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল। কিন্তু স্মরণ করতে পারলাম না। তবে তিনি আমাকে দেখেই বলে ফেললেন। বললেন, রহমতের খবর কি? বললাম, ২৩শে মার্চ পর্যন্ত তার খবর জানতাম। বিজলীদের দেশে পাঠিয়ে দিয়ে সে সময় রহমত ঢাকায় ছিল। তারপর আর কিছু জানি না। সাথে সাথে মনে পড়ল এ ক্যাপ্টেনকে ঢাকা মেডিক্যাল পুরোভাগে। তাছাড়া, তাকে দেখেছি সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের টেবিলে। কলেজ ছাত্র সংসদের খবর নিয়ে তিনি যেতেন রিপোর্টারদের কাছে।
বললাম, আপনি ত ডাক্তার হয়েছেন, শুনেছি আর্মি মেডিক্যাল কোরে গিয়েছেন। আর এখন দেখছি কম্যাণ্ডারগিরি করছেন। হেসে বললেন, ‘এখন দরকার এ্যাকশনের, যুদ্ধের। তাই জল্লাদের আর্মি মেডিক্যাল কোর থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছি।”…….
মার্চ-এপ্রিলের মত আজ আর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আনাড়ী যোদ্ধা নয়। তারা আজ পুরাপুরি ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তারা আজ মেশিনগান চালাতে পারে, মর্টার চালাতে পারে এবং গ্রেনেড ও ডিনামাইট ব্যবহার করতে পারে। প্রয়েজনীয় অস্ত্র হাতে থাকলে এদের দশজন অন্তত একশো-দুশো শত্রুসেনাকে ঘায়েল করতে পারে।
ক্যাপ্টেন ও তাদের কয়েকজনের সাথে আলাপ করে দেখলাম ওরা নির্ভয়, মৃত্যুকে ওরা আজ পরোয়া করে না। মৃত্যুর সাথে ওরা আজ পাঞ্জা লড়তে প্রস্তুত। কথাটা ক্যাপ্টেন নিজেও আমাকে এক পর্যায়ে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওদের নিয়ে আমাকে অসুবিধায়ও পড়তে হয় অনেক বাঘ যেমন নরমাংসের গন্ধ পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তেমনি ওরাও কোনস্থানে শত্রুপক্ষের উপস্থিতির খবর পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শত্রুর কাছে কি অস্ত্র আছে আর ওদের কাছে কি আছে তার বাছবিচার ওরা করতে চায় না।’
ক্যাম্প থেকে ফিরে আসছি, এমন অতি পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মতিন ভাই, আমাদের মুজিব ভাই কি বেঁচে আছেন? ওনাকে কি ফিরে পাব?”
এ প্রশ্নে নতুনত্বের কিছু ছিল না। এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিদিন অসংখ্যবার। তবু তাকে বললাম, তিনি ত বলে গেছেন, তিনি হকুম দিতে না পারলেও যেন আমরা নিজ নিজ কৰ্তব্য করে যাই। সুতরাং বর্তমান সময় ওসব বিচার না করে তিনি যা চেয়েছিলেন তা সমাধা করায় আত্মনিয়োগ করাই কি শ্রেয় নয়?
তিনি বললেন, “তা ত ঠিক। আমরা তাই করছি এবং করে যাব। প্রয়োজনবোধে প্রাণ দেব। কিন্তু মুজিব ভাইকে ছাড়া যে বাংলাদেশের অস্তিত্বই চিন্তা করতে পারি না! জানেন, আমার বাবা ও দুই ভাইকে ঘাতকরা হত্যা করেছে। তবু বেঁচে আছি। কিন্তু মুজিব ভাইকে হারালে যে বাঁচতে পারব না।’
দুই
* * * * * সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ক্যাম্পে কিছু সময় কাটানোর পর ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে ফিরে আসলাম। তিনি আমাকে একজন সুবেদার মেজরের হাওলা করে দিয়ে বললেনঃ ‘ওনার সাথে কথা বলুন, আমরা শিকারে যাচ্ছি।’
সুবেদার মেজর ৩৮ থেকে ৪০ বছর বয়সের একজন লোক। কয়েক বছর আগে বাঙালীর গৌরব বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঢুকেছিলেন একজন সৈনিক হিসাবে। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ছিলেন যশোর ক্যান্টমেন্টে। তারপর থেকে বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, বনে-জঙ্গলে যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছেন দখলকার সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি জানেন না, তাঁর পরিবারের কে আজ বেঁচে আছে আর কে বেঁচে নেই। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন “পরাধীন জাতি হিসাবে বাঙালীদের বেঁচে থেকেই বা লাভ কি? পশ্চিমারা যেভাবে জাতি হিসাবে আমাদের অপমান করেছে, সর্বনাশ করেছে- তার প্রতিশোধ নিতেই হবে। আর সব কথার সেরা কথা বাংলাদেশকে শত্রুকবলমুক্ত করতেই হবে। তারপর বাপ-ভাই-এর অভাব হবে না বাংলাদেশে।”
অবাক হয়ে ভাবলেন এই আধশিক্ষিত লোকটির কথা। কি অসীম দৃঢ়তা! কি গভীর আত্মপ্রত্যয় বিরাজ করছে তার মাঝে! বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বাঙালীর অপমানের প্রতিশোধই আজ তার কাছে বড়। নিজের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-পুত্রদের বেঁচে থাকা না থাকার প্রশ্নটি আজ তার কাছে গৌণ।
এতদিন পরে বুঝতে পারলাম কি করে যশোর ক্যান্টনমেন্টে মাত্র দুই কোম্পানী বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের অন্ততঃ ৫/৭ গুণ শত্রুসৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েও যুদ্ধ করতে করতে পথ করে নিতে পেয়েছিলেন। সেদিন তাদের পাঞ্জাবী-অধিকর্তা লেঃ কর্নেল বেঈমানী করেছিল। ষড়যন্ত্র করে সন্ধ্যার সময় অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবু এরা বাঙালীর জাতশত্রুদের হুকুম মোতাবেক আত্মসমর্পণ করেনি। অন্যান্য বাঙালী অফিসারদের নেতৃত্বে তারা যুদ্ধ করেছে। একজনের প্রাণের বদলে ১০ জনের প্রাণ নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে।
সুবেদার মেজরের কাছে শুনলাম ক্যাপ্টেনের পশু-শিকারে যাওয়ার কাহিনী। তিনি বললেন, ‘একটু আগেই খবর এসেছে ৪০-৫০ জন খানসেনা এসে আস্তানা গেড়েছে। গত রাতেও তারা নাকি ওখানে ছিল। আজ রাতে ওদেরকে দলবলে খতম করতে হবে। স্থানটাও এখান থেকে বেশ দূরে। তাই ক্যাপ্টেন জন পনেরো মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এখনই রওয়ানা হতে যাচ্ছেন।”
বললাম, ৪০-৫০ জন সুদক্ষ শত্রুসৈন্যের মোকাবেলায় আমাদের ত আরও বেশী মুক্তিযোদ্ধা যাওয়া দরকার।’
তিনি হেসে দিয়ে বললেন, ‘না, না, তা মোটেই নয়। আমাদের ১৫ জনই ওদের ৫০ জনের মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট। ইনশাআল্লাহ, ঐ ১৫ জনের হাতেই ওদের অন্ততঃ ৩০ জন খতম হবে এবং অন্যরা কুকুরের মত পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করবে।’
কথা প্রসঙ্গে আমি তার কাছে জানতে চাইলাম উভয় পক্ষের হতাহতের তুলনামূলক হার। তিনি একটা রেকর্ড বের করে বললেনঃ হতাহতের হার হচ্ছে ১:৫০- অর্থাৎ গড়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার বদলে ৫০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে।
আমি বললাম, এমনটা কি করে সম্ভব? যুদ্ধে দু’পক্ষের হতাহতের এমনতর অনুপাতের কথা ত কোনদিন শুনিনি।’ জবাবে তিনি বললেনঃ “আমরাও আগে শুনিনি।
জবাবে তিনি বললেনঃ “আমরাও আগে শুনিনি।কিন্তু এখন নিজের চোখে দেখছি। আসলে ব্যাপারটা কি জানেন? আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ওদের খতম করা। আর ওদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাণে বাঁচা। তাই, প্রাণের বাঁচার তাগিদে ওরা এখন আর আমাদের সাথে যুদ্ধই করতে পারছে না, আর কোনদিন পারবেও না………
সুবেদার মেজরের সাথে কথা বলার সময় সেখানে এসে হাজির হলেন একজন তরুণ পূর্বতন সি-এস-পি অফিসার। কয়েক মাস আগেও তিনি ছিলেন কোন এক মহকুমার প্রশাসক।
পরনে লুঙ্গি, গায়ে একটা হাফশার্ট, পায়ে একজোড়া সাধারণ স্যাণ্ডেল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এ অবস্থা কেন? জবাবে জানালেন, ‘এর চেয়ে বেশী যোগাড় করাও সম্ভব নয়। তদুপরি, আমার সহমুক্তিযোদ্ধারা যেখানে এক-কাপড়, এক-জামায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানে কারো পক্ষে কি বিলাসিতা শোভা পায়?”
ভদ্রলোক চলে গেলে সুবেদার মেজরের কাছে সব শুনতে পেলাম। সাবেক মহকুমা প্রশাসক আজ একজন মুক্তিসেনা হিসাবে কাজ করছেন। আর দশজন যেখানে থাকেন, যা খান- তিনিও সেভাবে থাকেন, খান।
এসব শুনে ভাবতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পরলাম। সুবেদার মেজর কিছুক্ষণ পর বললেনঃ এত কি ভাবছেন? সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম, ভাবছিলাম ওই ভদ্রলোকের কথা।
একটি মহকুমার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন তিনি মাত্র সেদিনও। আমরা যারা যুদ্ধ করি, সাংবাদিকতা করি অথবা যারা রাজনীতি করেন তারা ত বিপদ-আপদের ঝুঁকি নিয়েই ওসব পেশা গ্রহণ করেছিলাম। শেখ সাহেবের যে বিচার প্রহসন হতে পারে তা তিনি নিজেও জানতেন। কিন্তু এরা? এরা ত ছিলেন পাকিস্তান সরকারের সর্বাপেক্ষা অনুগৃহীত কর্মচারী। রাজনীতি ছিল এদের জন্য নিষিদ্ধ। এরা ইচ্ছে করলে মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকতে পারতেন। কিন্তু এরা নিজেদের আলাদাভাবে ভাবতে পারেননি। ভেবেছেন জাতির একজন হিসাবে। তাই জাতীয় দায়িত্ব হিসাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মুক্তিসংগ্রামে। সত্য বলতে কি, এই দায়িত্ববোধের আদর্শই বর্তমান মুক্তিসংগ্রামের সবচেয়ে মূল্যবান পাথেয়।
তিন
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প থেকে বের হয়ে পড়লাম গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। বেলা তখন সাড়ে ১২টা। পথ রয়েছে ২২ মাইল। অথচ সোজাপথে গেলে এ দূরত্ব অর্ধেকে হ্রাস করা সম্ভব ছিল।
যাত্রার সময় সুবেদার মেজর আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন সামনের কতিপয় এলাকা সম্পর্কে। কেননা ঐ এলাকায় মুক্তিবাহিনী ও শত্রুপক্ষ তখন সক্রিয় ছিল। তবে তিনি আমার সাথে একজন গাইডও দিয়েছিলেন যাতে আমার কোন অসুবিধা না হয়।
মাঠ-ঘাট পেরিয়ে মাইল তিনেক যাওয়ার পর আমরা একটা জঙ্গলে গিয়ে হাজির হলাম। চারদিকে তাকিয়ে আমি জঙ্গল আর জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। মাত্র মিনিট তিনেক সময়ের ব্যবধান। তারপরই ১৮-১৯ বছরের এক যুবককে সাথে নিয়ে আসলেন। আমাকে নিয়ে রওনা হলো সেই তরুণ সঙ্গী।
আমরা দুজন চলছি। তরুণ চললো আগে আগে, আমি তার পেছনে পেছনে। তরুণকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র। এখন মুক্তিবাহিনীতে কাজ করছে। যশোর জেলায় তার বাড়ি। বহু আগেই বাবা মারা গেছেন। বাড়িতে ছিলো বিধবা মা আর ভাইবোন। গত এপ্রিল মাসে পাকিস্তানী সৈন্যরা তার কলেজে পড়া বোনকে ধরে নিয়ে যায়। ছোটভাই তাতে বাধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যা করে। অবশ্য পরে ছোট বোনটিকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, বাড়ি থেকে দূরে। এই খবর পেয়ে সে যখন বাড়ি গিয়েছিলো তার
শোকাহতা মা নাকি তাকে বলেছিলেনঃ বাবা তুই যদি আমার সন্তান হোস, তাহলে এই ঘৃণ্য অপরাধের যোগ্য প্রতিশোধ তুই নিবি৷ যা, এক্ষুনি বের হয়ে পড়- মা-বোনদের অপমানের প্রতিশোধ তোকে নিতেই হবে।
মায়ের দোয়া মাথায় নিয়ে সেই সে তরুণ ছাত্রটি বেরিয়ে এসেছে, আর ঘরে ফেরেনি। এরপর মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে। ছোট ভাইবোনের হত্যার প্রতিশোধ সে নিয়েছে। নিজের হাতে হত্যা করেছে পাঁচজন খান সেনাকে। তবু তার শান্তি নেই, বিশ্রাম নেই। যেদিন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ মুক্ত হবে, বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে-গ্রামে উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা, সেদিনই হবে তার সত্যিকারের প্রতিশোধ নেওয়া।
মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধের সেই বীর সৈনিকের নিষ্ঠা ও অবিচলতার প্রমাণ তার কথা থেকেই। অমিততেজ বাঙালী তরুণ আমাকে বললঃ দেখুন, যারা আমার বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছিলো, আমিও পেয়েছিলাম তাদের মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করার সুযোগ; কিন্তু তা আমি করিনি। তা আমি করতে পারি না। সহকর্মীদেরও এমন অপকর্ম থেকে নিবৃত করেছিলাম- কেননা আমরা যে পাশবিকতার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করছি। ওরা পশু, ওরাই পারে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করতে- আমরা তা করতে পারি না।
আমরা একটা বিস্তৃত মাঠের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঠের এখানে সেখানে লোকজন কাজ করছে। কেউ ধান কাটছে, কেউ ঘাস তুলছে ক্ষেত থেকে। একটা পাটক্ষেতের আড়ালে কজন ক্ষেতচাষী ধানখেত থেকে ঘাস তুলছে। তাদের দিকে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে তরুণ আমাকে বললো, ওরা আমাদেরই লোক। আরো বললোবাংলাদেশের মুক্তিসেনারা এমনি করে ছড়িয়ে আছে গ্রাম-গ্রামান্তরে বাংলার মাঠে-ঘাটে সর্বত্র। ঐ যে সামনে নদীটা দেখছেন তার ওপারেই রয়েছে একটা বাজার। বাজারে আগে পাকিস্তানী সৈন্যের ঘাটি ছিলো। তাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশীরভাগ খানসেনা মারা পড়েছে। আর যারা বেঁচে ছিলো তারা সবাই প্রাণ নিয়ে কোনমতে পালিয়েছে। তারপর বহুদিন এদিক আর ওরা আসেনি। কিন্তু গতকাল নাকি একটা দল এসেছিলো। শুনেছি আজো আবার আসতে পারে। তাই আমাদের মুক্তিসেনারা পশুদের যোগ্য শিক্ষা দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।
খানিকটা সামনেই ছিলো নদী পারাপারের খেয়া। খেয়াঘাটে গিয়ে পাটনীর সাথে কীছু কথা বলে তরুণ বিদায় নিলো। অতপর তীরে গিয়ে আমি নেমে পড়লাম। পাটনীও আমার পেছনে পেছনে নেমে পড়লো। সে আমাকে নির্দিষ্ট একটা রাস্তা এড়িয়ে যেতে বললো। আমি যখন সেই বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম, আনন্দে তখন আমার বুকটা ভরে উঠলো। সেখানে সবগুলো দোকানেই উড়ছিলো স্বাধীন বাংলার পতাকা নিজের মনেই খানিক দাঁড়িয়ে গেলাম। সেখানে শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে এলো। বললাম : সালাম, আমার স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা, তোমাকে সালাম।
আরো মাইল তিনেক এগিয়ে গেলাম। চোখের সামনে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের পাশবিকতার চিহ্ন। চারদিক ধ্বংসের ছাপ লেগে আছে। সবকিছু লণ্ডভণ্ড, আগুনে জুলিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম লণ্ডভণ্ড করেছে কতো সুখের সংসার। খুব পিপাসা পেয়েছিলো। বারান্দায় এক বৃদ্ধকে দেখে এগিয়ে গেলাম। বললাম, বুড়িমা পানি খাবো। বৃদ্ধার বয়স ৭০/৭৫ হবে। একটা ছেলেকে পানি আনতে বলে তার দুঃখের কথা শুরু করলেন। বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি। বলাম মুজিবনগর থেকে। বাড়ি যাবো।
বাড়ি যাবো এ কথাটা শুনেই বৃদ্ধ আত্ক উঠলেন, বললেন- বাড়ি যেয়োনা, পাঞ্জাবীরা মেরে ফেলবে, ওরা মানুষ নয়, ওরা পশু। দেখছো না, আমার ঘর খালি। আমার সোনার ছেলেদের ওরা হত্যা করেছে। আমার আর কেউ নেই বাবা। তবু আমি কেনো যে বেঁচে রইলাম। বলতে বলতে বৃদ্ধা আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
বললাম-বুড়িমা কাঁদবেন না। আপনার ছেলে গেছে, আমরা রয়েছি তো আপনার সন্তান- আপনার আরো কতো সোনার ছেলে দেশের জন্যে যুদ্ধ করছে, তাদের দোয়া করুন
।পানি খেয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম, বৃদ্ধা বললেন- আচ্ছা বাবা বল তো, ঐ যে আমরা ভোট দিয়েছিলাম, সেই মুজিবর ভালো আছে তো? সে বেঁচে থাকলে এর শোধ নেবেই।
দেখলাম গ্রামের সাধারণ বৃদ্ধাও বঙ্গবন্ধুর খবর রাখে- তার হৃদয়ে রয়েছে তার জন্যে অফুরন্ত দরদ। আরো অবাক হলাম এ ভেবে, যে দেশে এমন বৃদ্ধা রয়েছে সে দেশের ছেলেরা বীর সৈনিক না হয়েই পারে না।
এরপর যেখানে গেলাম সেটি যশোরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মশিউর রহমানের নির্বচনী এলাকা। চারদিকে থমথমে ভাব। কোথাও কোনো মানুষ দেখা গোল না। এই জনশূন্য পথে চলতে চলতে হঠাৎ রাস্তার উপর একটি লোকের সাথে দেখা। ২৭/২৮ বছরের লোকটির মুখে দাড়ি। পরনে পাঞ্জাবি। দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে লোকটি সম্ভবত জামাতপন্থী কেউ হবেন। দু’জন পাশাপাশি চলছি, কারো মুখে কোনো কথা নেই। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে নিতান্ত কৌতুহল ও উদ্বেগ বশেই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই, মশিউর রহমান সাহেবের খবর কি?” প্রশ্ন করেই নিজের মনেই শংকিত হলাম কি জানি কি হয়। কিন্তু প্রশ্ন শুনে লোকটি আমার দিকে এমন বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন যে তাকে দেখে মনে হবে তিনি যেন কোন ভাবনার সাগরে ডুবে আছেন। সারা চোখ-মুখে তার উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। হয়তো এক্ষুনি দু’চোখ বেয়ে নামবে অশ্রুর বন্যা।
ভরসা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এমন বিচলিত হলেন কেনো? তাকিয়ে দেখি পাঞ্জাবি পরা সেই অপরিচিত লোকটির চোখ বেয়ে তখন অশ্রু পড়াতে শুরু করেছে। তারই মধ্যে আমাকে বললেনঃ দেখুন, শেখ সাহেব কিংবা মশিউর রহমানের কথা তো কেউ এমন প্রকাশ্যে বলাবলি করতে সাহস করে না। তাই আপনার কথা শুনে আমার অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আপনি বোধ হয় এ এলাকায় নতুন এসেছেন?
পরে আলাপে জানতে পারলাম লোকটি স্থানীয় একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্যে প্রাণপণ খেটেছেন। মাইল খানেক একসাথে গিয়ে তিনি ভিন্ন রাস্তায় চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আমাকে সাবধান করে দিয়ে গেলেন যেন প্রকাশ্যে এমন কথা আর কাউকে আমি জিজ্ঞেস না করি।
মশিউর রহমানের পৈত্রিক গ্রাম সিংহঝুলি। সেখানে গড়ে উঠেছে ছোটখাটো একটা উপশহর। তার উপর দিয়ে চলে গেছে যশোর-চৌগাছা সি এণ্ড বি রোড। রোড থেকে মাত্র এক মাইল দূরে আছি। সি এণ্ড বি রোড পার হবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছি-হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে এলো একটি লোক। বললো, বসে পড়ুন সাহেব, বসে পড়ুন। ঐ যে মিলিটারীর গাড়ি আসছে যশোরের দিক থেকে। লোকটি একরকম জোর করে আমাকে রাস্তার একপাশে বসিয়ে দেয়।
দেখতে দেখতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই তিনখানা গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাজারের উপর। গাড়ির গতি থামলো মাত্র মিনিট খানেকের জন্যে। চারদিকে একবার নজর করে ভোঁ করে চৌগাছার দিকে ছুটে চললো তারা।
লোকটির কাছেই শুনলাম, ঐ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর হাতে বারবার প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজকাল এদিকে বড়ো একটা এগুতে সাহস করে না। যদিওবা আসে একদণ্ড অপেক্ষা করার ভরসা পায় না।
মিলিটারীর গাড়িগুলো চলে যাওয়ার সংগে সংগে আমি তাড়াতাড়ি সি এণ্ড বি সড়ক পাড়ি দিলাম। যাবার সময় দু’পাশে তাকিয়ে দেখলাম ধ্বংসস্তুপের সীমাহীন চিহ্নরাশি। সারা বাজারের প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িই হার্মাদ
দস্যুরা ধ্বংস করে দিয়েছে। আর জনাব মশিউর রহমান সাহেবের বাড়ি তো ছিলো এই দস্যদের প্রধান লক্ষ্যস্থল। সুতরাং সে বাড়ির যে কিছুই অক্ষত থাকবে না তা বলাই বাহুল্য।
রাত তখন সাড়ে আটটার মতো হবে। কোথায় রাত কাটাবো ঠিক করে উঠতে পারছি না। একজনকে রাত কাটানোর অনুরোধ জানালে দেখিয়ে দিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যের বাড়ি। তবে একথাও শুনলাম ঐ সদস্য আগে জামাতে ইসলামীর লোক ছিলেন। সোজা গেলাম তার বাড়িতে। ডেকে বললাম, আমি আপনার এখানে রাত কাটাতে চাই, আমাকে থাকতে দিতে হবে। আর যদি আমাকে মিলিটারীর বা রাজাকারের হাতে তুলে দিতে চান, তাও করতে পারেন। তবে তার আগে খেতে দিতে হবে। বুঝতেই পারছেন বড়ো বেশি ক্ষুধার্তা
ভদ্রলোক ছোট ভাইকে ডেকে আমার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমি আগে জামাতপন্থী ছিলাম। কিন্তু গতকাল থেকে আমি বাঙালী এবং এখন এটাই আমার একমাত্র পরিচয়। জানেন, গতকাল মিলিটারী আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি এসে তাকে ২০টি যুবক ও কয়েকটা মেয়ে সংগ্রহ করে দিতে বলে। তিনি দুইদিনের সময় চেয়েছিলেন মাত্র। তারপর সৈন্যরা তার বাড়িতে ঢুকে চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রবধু ও যুবতী মেয়েকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে বুঝতেই পারছেন। বলতে বলতে মুহুর্তে ভদ্রলোকের মুখ-চোখের লক্ষণ পরিবর্তিত হয়ে গেলো। দেখলাম, তার সারা মুখে ঘৃণা ও গ্লানির চিহ্ন পরিস্ফুট। বাঙালী কি আর ভাইয়ের অপমান সইতে পারে?
চার
৩ অক্টোবর, ১৯৭১
মেম্বার সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয়ে গেল। তথাকথিত ইসলাম-দরদীদের বর্বর মানবতাবিরোধী কাজই যে জামাতপন্থী এ মানুষটিকে সত্যিকারের বাঙালীতে পরিণত করেছে তার কথাবার্তায় তা পরিস্ফুট হয়ে উঠল। স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে অভিজ্ঞ মানুষটির কথাবার্তা থেকে আরো বুঝতে পারলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রতিটি গুলি, প্রতিটি অত্যাচার বাঙালীর ঐক্যকে দিন দিন সুদৃঢ় করে তুলেছে।
গালগল্প শেষ করে যখন শুয়ে পড়লাম তখন রাত প্রায় ১টা। চোখে তন্দ্রার ভাব আসলেও পুরোপুরি ঘুম বলতে যা বুঝায় তা তখনও আসেনি। এমনি সময়ে গগনবিদারী একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চমকে উঠলাম। এটা যে মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের কাজ তা বুঝতে বাকী থাকল না। তবে কোথায় তারা এ বিস্ফোরণ দ্বারা কি নষ্ট করেছে তা তখনও জানতে পারলাম না। এরই কয়েক মিনিট পরে রেললাইনের দিকে আরেকটি প্রচণ্ড শব্দ হল। পরের দিন ভোরে জানতে পারলাম গেরিলারা সিংহঝুলির কাছে জোড়াপুলটি উড়িয়ে দিয়েছে। যশোর থেকে চৌগাছায় সৈন্য আনা-নেওয়ার জন্য এ পুলটির গুরুত্ব ছিল অনেক। আর দ্বিতীয় বিস্ফোরণ সম্পর্কে জানা গেল যে তা দিয়ে গেরিলারা একটি মালগাড়িসহ রেললাইন উড়িয়ে দিয়েছে। মালগাড়ির পাহারাদার কয়েকজন রাজাকার প্রাণ হারিয়েছে।
সকাল তখন প্রায় ৮টা। আমি মেম্বার সাহেবের বাড়ি ছেড়ে নিজের পথে বের হয়ে পড়বো ঠিক এ সময়ে ঐখান থেকে মাইল চারেক দূরে শুরু হল মর্টার ও মেশিনগানের গোলা বর্ষণ। গোলা বর্ষণ চলছে তো চলছেই। থামার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তাই ব্যাপারটা না জানা পর্যন্ত মেম্বার সাহেব আমাকে ঘরের বাইরে পা দিতে নিষেধ করলেন। ইত্যবসরে একটা সাহসী তরুণকে পাঠান হল ব্যাপারটা জেনে আসতে। ঘন্টা দু’এক পরে তরুণ এসে যা জানাল তা হচ্ছেঃ প্রত্যুষের দিকে কে বা কারা যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তার এক জায়গায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে গেছে। স্থানীয় রাজাকাররা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে খবর দিলে তারা পতাকা থেকে মাইল তিনেক দূরে এসে অবস্থান নেয় এবং সেখান থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করে। পতাকা যেখানে উড়ান
হয়েছে তার আশেপাশে কোথাও হয়তো মুক্তিবাহিনী লুকিয়ে আছে- এ ভয়েই পাঞ্জাবী সৈন্যরা ঘটনাস্থলের তিন মাইল দূর থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে।
যাহোক, সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তারা অবিরাম গোলাবর্ষণ করে কম্পিত শত্রুর উদ্দেশে। তারপর রাস্তার দু’পাশে ও সামনে গোলাগুলি ছড়তে ছুড়তে তারা এগিয়ে এল ঘটনাস্থলে। এতে প্রায় আরও ১ ঘণ্টা সময়। পতাকাটা তখনও সগৌরবে দাঁড়িয়ে থেকে পতপত করে করে মুক্তির গান গাইছিল। কিন্তু মানবতার দুশসন পাঞ্জাবী সৈন্যরা তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুজি করেও কোন মুক্তিসেনাকে জীবন্ত বা মৃত খুঁজে পেলনা। কিন্তু তবুও ক্যান্টানমেন্ট গিয়ে যে নিজেদের বীরত্বের কাহিনী ঢাকায় নিয়াজীর কাছে পাঠাতে হবে- তাই তারা কয়েকজন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে।
সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৪ঘন্টা সময়ে শুধু মাত্র কল্পিত শত্রুর উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যে কত হাজার রাউণ্ড গোলা-গুলি অপচয় করেছে এবং তার মূল্যই বা কত হাজার বা কত লাখ টাকা তা কেবল সামরিক বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারেন। কিন্তু আমার মনে যে প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে তা হল নিজেদের টাকায় কিনতে হলে অথবা অন্যের কাছ থেকে না পেলে কি পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এমনভাবে গোলাগুলির অপচয় করতে পারত?
জবাবও আমি নিজের কাছ থেকে পেয়েছি। নিশ্চয়ই তারা এমনটা পারত না।
আমি আরো ভেবে দেখেছি, পশ্চিম পাকিস্তান বিভিন্ন সামরিক জান্তা এ পর্যন্ত বিদেশ তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ করেছে। বাংলাদেশ থেকে তাদেরকে দুদিন আগে বা পরে তল্পীতলপা গুটিয়ে যেতে হবে। সেদিন হয়ত বর্তমান জান্তা ক্ষমতায় থাকবে না- যেমন নাই আইয়ুব ভুট্টোর চক্র। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে যে এ টাকা সুদে আসলেই শোধ করতে হবে। বাংলাদেশের সোনালী সূত্র-পাট বেচা টাকা ছাড়া যে এ কাজ কত দুঃ সাধ্য হবে তা আমরা যেমন জানি, তারাও তেমনি জানে। তার প্রমাণ ইতি মধ্যেই মিলেছে। যুদ্ধের তিন মাস অতিক্রান্ত হতে না হতেই সামরিক জান্তাকে সমস্ত লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ঋণের কিস্তি পারিশোধের ব্যাপারে নিজেদের অপারগতার কথা ঘোষণা করতে হয়েছে। নতুন ঋণের জন্য নাকে খৎ দিতে হয়েছে বিভিন্ন দেশে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ধর্ণা দিতে হয়েছে রাজধানীতে রাজধানীতে। সুতরাং যুদ্ধ বেশী দিন স্থায়ী হলে তাদের পক্ষ নিজেদের সগৌরবে দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।…
(মতিন আহমেদ চৌধুরী রচিত)