শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৪। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত কয়েকটি কবিতা | …………. | জুন-ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
৮ জুন, ১৯৭১
শব্দের তারতম্যে
শিকদার ইবনে নূর
শব্দকে আমার বড় ভয় ছিল
পৃথিবীর নানা রকম শব্দকে,
বিশেষ বয়সে এসে অতর্কিত
বাবার পায়ের শব্দ, সেকেলে
খড়ম পড়া মায়ের চলার শব্দ
প্রিয়তমার কাঁকন নিক্কন; ট্রেনের
চাকার শব্দ, মোটরের বিস্ফোরণ,
প্রাচীন ইটের স্তুপে টায়ারে
আর্তনাদ- অকারণ ট্রাফিক হুইসিল,
এবং বিদগ্ধ দিনে রাজ পথে
রোদ্রের বিলাপ- ইত্যাদি অনেক শব্দে
শব্দময় পৃথিবীকে আমার ভীষণ ভয় ছিল।
অথচ অবাক হই, ইদানীং
আমি এক অত্যাশ্চর্য শব্দের মিছিল।
আমার আত্মায় শব্দ, শব্দ নাচে
প্রতি লোমকূপে, ধমনীতে, ফেনায়িত
রক্তের কণায়, জাগরণে, বিলম্বিত
ঘুমের সত্তায়।
শব্দ বাজে-সোনামুখি ধানের
শীষের মত, চতুর্দশী কৃষাণী
মেয়ের চুলে রক্ত লাল
শাপলার খোপার মত;
আমার সমস্ত দেহে, হৃৎপিণ্ডের
রক্তের ধারায়-শব্দ বাজে।
বাংলার শ্যামল মাঠে, আঙ্গিনায়
পৈশাচিক পদশব্দ, নিসর্গের
বুক চিরে কামান গোলার শব্দ
বিধ্বস্ত মায়ের চোখে দুগ্ধপোষ্য
শিশুদের কচিকণ্ঠে শব্দের আগুন,
আমার পৃথিবী জুড়ে শব্দ শব্দ শব্দ শুধু;
কাজেই, এখন আর শব্দকে, ভয় নেই,
আমিও নিজেই এক অত্যাশ্চর্য
শব্দের মিছিল।
(শব্দ সৈনিক’-ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে সংকলিত)
.
৯ জুন ১৯৭১
আবার দেখবো *
আবার দেখবো বাংলার পথে-ঘাটে
কৃষাণের লাঙ্গল জোয়াল-
সোনালী ধানের ক্ষেতে শালিকের আনাগোনা –
পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ের ঝড় তোলা পানসী-নৌকা দেখবো।
ভিজে দেহ, হিজল-বট-আমের বনে
দোয়েল-শালিকের মেলা। দেখবো ডানপিঠে ছেলের
দুরন্তপনা। বাড়াভাত নিয়ে বসে থাকা মায়ের
উদ্বিগ্ন মুখ আবার দেখবো।
আবার দেখবো রমনার কৃষ্ণচূড়ায়
থোকা থোকা লাল ফুল।
পল্টনের বাতাসে অনেক শপথী কণ্ঠ।
দেয়ালে দেয়ালে চোখ মেলে চেয়ে থাকা
সবুজ ইচ্ছে দেখবো। দেখবো-
ভার্সিটির চতুরে অনেক উন্মুখ স্বপ্নের
চঞ্চলতা শহীদ মিনারে নতুন শপথের
বজ্ৰমুষ্ঠি আবার দেখবো-
রেসকোর্সে মুজিবের দৃপ্ত কণ্ঠ। ক্লান্ত দুপুরে
বৈরাগীর সুরেলা কন্ঠ- সন্ধ্যায় ঘরফেরা
মানুষের তালহীন কণ্ঠস্বর অবিশ্রান্ত শুনে যাবো-
আবার। আবার দেখবো- আমার চিরপরিচিতা ।
রূপসী বাংলাকে।
* স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত। লেখকের নাম জানা যায়নি।
.
——–জুলাই, ১৯৭১
আমার প্রতিদিনের শব্দ
সৈয়দ আলী আহসান
(১)
আমার সমস্ত চেতনা যদি
শব্দে তুলে ধরতে পারতাম
জোবনের নৈমিত্তিক আচার
অকুণ্ঠ অভিবাদন,
কখনও রহস্যের অস্পষ্টতা
আবার কখনও সূর্যের তাপ
এবং রাত্রিকালে সমস্ত সুন্দর
গাছের পাতার নিদ্রা
তমসার অবগাহন যখন
সময়কে গ্রাশ করেছে
যখন নিঃশ্বাসের ছায়া
স্বচ্ছ কাচে কুয়াশা ফেলেছে
তখন আমার ভাষার শরীরে
প্রকাশের যে যন্ত্রণা
তা আমি প্রতিবার কবিতা লিখতে যেয়ে
অনুভব করেছি-
তার কেশে সমস্ত আকাশের মেঘ
তার নয়নে চিরকালের নদীর উদবেলতা
এবং বাহুতে প্রান্তরের বিস্তীর্ণ আশ্রয়।
সে আমার প্রতিদিনের শব্দ।
(২)
বিষণ্ণ নির্জনতা যেখানে চিরদিন রাজত্ব করে
এবং লম্বা ঘাস বসে থাকে সিড়ির ফাটলে
চাঁদ, সূর্য, শীত, গ্রীষ্ম এবং তুষার
যেখানে দেয়ালের রং মুছে দেয়
কয়েকটি ইঁদুর যখন ছুটোছুটি করে
তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয় –
এ-পরিত্যক্ত অট্রালিকায় কে বাস করতো?
একটি সাপ তখন কোনো উত্তর না দিয়ে
সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়-
আমার ভাষার শব্দ
সময়ের অন্ধকারকে প্রকাশ করার জন্য
আহত শরীর নিয়ে উদ্ভ্রান্ত
রবীন্দ্রনাথের প্রাচুর্য, সৌভাগ্য এবং আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত
হৃতশ্রী আমার শব্দ আজ সমস্ত ক্ষুব্ধ ইচ্ছার
উপমা হতে চাচ্ছে-
আমার প্রতিদিনের শব্দ।
(৩)
দ্বিখণ্ডিত শিশুর মৃতদেহ নিয়ে
অট্টহাস্যে যারা রাত্রির নীরবতাকে ভয়াল করলো,
যারা আমার কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করবে ভেবে
সকাল বেলার শিশিরকে রক্তিম করলো
(মাতৃদুগ্ধের মতো স্রোতস্বিনী
অজস্র শবের আর্ত দৃষ্টি নিয়ে প্রবাহিত)
মধ্যযুগের অন্ধকারকে লজ্জিত করে
যে-সব সারমেয় তাদের করাল
দ্রষ্টাংশরেখায় আমাকে
আতুর করতে চাচ্ছে
আমার প্রতিদিনের শব্দে তাদের
ধ্বংস উচ্চারিত হোক,
মাতৃভূমি আমার, আমার সপ্রেম
অনুরাগকে যারা কলঙ্কিত করতে চাচ্ছে
আমার অজেয় শব্দে-
তাদের সর্বনাশ চিহ্নিত হোক-
আমার প্রতিদিনের শব্দ।
(8)
ভয় থেকে উন্মাদ উদ্দেশ্যহীন পলায়ন
যখন আর সম্ভবপর হচ্ছে না
যখন রুদ্ধশ্বাস জীবনে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা নিয়ে
আমরা হতভাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
আর রাত্রির অন্ধকার দেখেছি
আকাশ থেকে এক একটি তারা খসে পড়ছে
এবং অসহ্য একটি স্তব্ধতায়
আবেগের সমস্ত তরঙ্গগুলো
অশ্রুতে হারিয়ে যাচ্ছে,
তখন আমার শব্দে নতুন বিস্ময়ের উন্মোচন ঘটুক-
আমার প্রতিদিনের শব্দ।
লেখকের নিকট থেকে প্রাপ্ত)
.
১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
অশুভ শক্তির চ্যালেঞ্জ আমি
নেওয়াজিস হোসেন
রক্তে আখরে লেখা
পঁচিশের মর্মন্তুদ রাত্রির
ভয়াল পরিধি- নীল-স্বপ্নের
সাত কোটি রজনী জলের
সমুদ্রে কান্না শব্দে তরঙ্গ শিহরিত।
বাংলাদেশ-
কুচক্রী শক্তিসমুহের লালসার
পাদপীঠ কখনো নয়;
এ নির্ভুল শাশ্বত সত্য যোজনার জবাব
প্রস্তুত রণাঙ্গণে –
সাড়ে সাত কোটি সুদৃঢ় বজ্ৰমুষ্ঠি।
ক্ষমার অযোগ্য পশুশক্তির
নির্মম শাস্তি দিচ্ছিঃ
নিঃস্নেহে জীবনের শত্রুকে আহবান করে
মৃত্যুর খোলা দরজা।
শব্দ দেয় উৎফুল্ল উপহার আমায়
বিপুল বিপ্লবী সাড়া।
স্বজন হারানোর বেদন বিক্ষোভের সবটুকু বহ্নি
আজ প্রাণ মনে উত্থিত।
নির্মেঘ আকাশে অযথা মেঘাবির্ভাবকারীর
তাহলে চ্যালেঞ্জের জন্যে প্রস্তুতঃ
অগ্নিমূর্তি এক আমি সত্তা।
(শব্দসৈনিক- ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ থেকে সংকলিত)
.
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
কমাণ্ডার
নাসিম চৌধুরী
কমাণ্ডার
আমরা প্রস্তুত কামান,মর্টার,রকেটে, গোলায়,
যুদ্ধের কড়া সাজে, বেল্টে-বুটে
আমরা সেজেছি যথারীতি।
এবার তোমার অর্ডার দেবার, পালা-
দাও অর্ডার
কমাণ্ডার।
দেখ, চারদিকে প্রস্তুতির আয়োজন শেষ,
কী ভয়াল সুন্দর অন্ধকার ঘনিয়েছে চারদিকে
এতক্ষণ যে মুমূর্য আলো ছড়াচ্ছিল
কৃষ্ণপক্ষের অসুস্থ চাঁদ,
সেটাও টুপ করে খসে গ্যাছে কোন রহস্যলোকে
এখন শুধু অন্ধকার-
কি বিশ্বাসী বন্ধুর মত ঘিরে আছে চারিদিক
আর দেখ কী লোমহর্ষক নীরবতা!
কুলায় ফিরে গ্যাছে সর্বশেষ পাখী
শুধু একটানা ঝিল্লীর ঝংকার।
এটাইতো শক্রনিশ্চিহ্নের মাহেন্দ্রক্ষণ
কমাণ্ডার
আর দেরী নয়, শুধু অর্ডার।
কমাণ্ডার
শুধু তোমার একটি অর্ডার
দেখবে কী দুর্জয় করে তোলে আমাদের।
কী প্রচণ্ড সাড়া জেগে ওঠে রক্তের ধারায়
কী প্রখর জ্বলে ওঠে চোখের তারা
কী অট্টশব্দে গর্জন করে ওঠে প্রতিটি অস্ত্র
শত্রুর আর্তরব।
কমাণ্ডার, এবার শুধু অর্ডার করো, অর্ডার
তোমার অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে
ছুটে যাব আমরা
ঐ দূরে যেখানে শত্রুরা ফেলেছে ক্যাম্প
যেখানে প্রতিটি বাঙ্কারে শুয়ে আছে
হিংস ঘাতকের দল
আর পেন্টাগনের জেনারেলদের মত
কুটিল বক্র ট্রেঞ্চগুলি লুকিয়ে রেখেছে যে
হিংস্র হায়েনাদের
সেখানে ছুটে যাব কী তুমুল প্রাণের আবেগে
গর্জে উঠবে আমাদের মুষ্টিচ্যুত গ্রেনেড
সেই ধ্বংস উৎসবের আশায় বসে আছি
কমাণ্ডার
শুধু আদেশ দাও এবার।
কমাণ্ডার
আমরা প্রস্তুত
কামান মর্টার গানে, রকেটে গোলায়
যুদ্ধের কড়া সাজে, বেল্টে-বুটে
আমরা সেজেছি যথারীতি
এবার তোমার অর্ডার দেবার পালা
দাও অর্ডার
কমাণ্ডার।
কমাণ্ডার
এখনো কী সময় হয়নি তোমার?
এখনো কী দৃষ্টি রাখবে ঘড়ির কাঁটায়?
উৎকর্ণ হবে ঘাসের প্রতিটি শিহরে?
দায়িত্ব কী পালন করবে তুমি
সংসারী কৃষাণীর মত
ভেবে-দেখে, কম্পনে-ত্রাসে?
দায়িত্ব গ্রহণ কী তবে বৃদ্ধত্ব গ্রহণেরই নামান্তর শুধু।
নইলে হিসাবের প্রয়োজন কী
ঘড়ি আর আঁধারের গাঢ়তা নিয়ে?
জানি তা আনবে আরো সুচারু সফলতা
কিন্তু আমাদের কাম্য তা নয়।
আমরা চাই বিশৃঙ্খল বেঠিকের মাঝে
ভয়াল বিজয়।
আমাদের যাত্রা হবে হঠাৎ আচম্বিতে
মনের তাড়ায়।
নিমেষে উগড়াবো যতগুলি জ্বালা আছে মনে
চকিতে ছুড়ে দেবো যতগুলি গোলা পাবো চোখে
আনবো না বিজ্ঞান অংকের মাপ
শুধু যাবার আবেগে চলে যাব।
কমাণ্ডার
যদি ঐ বিদেশী পদবীটার সাথে জড়তা ওতপ্রোত থাকে
তবে তা ছুড়ে ফেলো বিষাক্ত ঘৃণায়
ভুলে যাও সময়ের নির্দিষ্টতা
চলো এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ি
শত্রুগুলোর ওপর
তাদের নিশ্চিহ্ন করে দি
আমাদের বেহিসাবী উচ্ছঙ্খলতায়।
তারপর ক্ষতি হয়ে পড়ে থাকি
বে-নিয়ম পৃথিবীর পরে।
____________
(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)
.
৫ অক্টোবর, ১৯৭১
রিপোর্ট ১৯৭১
আসাদ চৌধুরী
প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মত স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায় –
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন
দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী ।
অথচ যোহরা ছিল নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা।
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গ্যাছে-
আমি তার সরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীরেব চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালেমে শান্তি খুঁজেছিল,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকে-বাঁকে পবিত্র হরফ
বোবা হয়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গালের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝরে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়েত মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে পড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শুকুন মৈত্রী মৈতী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।
পা-টিপে পা-টিপে জ্যোতির্ময়
স্যারের কেলাস থেকে চ’লে গ্যালো।
কাচের গ্লাসের মতো ভেঙ্গে গ্যালো ছাত্রাবাস।
পৃথিবীর সব চিন্তা কাগজের চেয়েও দ্রুত পুড়ে গ্যালো,
বারুদের গন্ধে ধন্য গ্রন্থাগার ব্যাণ্ডেজে সুন্দর।
জনাব উ থান্ট,
জাতিসংঘ ভবনের মেরামত অনিবার্য আজ।
আমাকে দেবেন, গুরু, দয়া ক’রে তার ঠিকাদারী?
বিশ্বাস করুন রক্তমাখা ইটের যোগান
পৃথিবীর সর্বনিন্মহারে আমি দিত পারি
যদি চান শিশুর গলিত খুলি, দেওয়ালে দেওয়ালে শিশুদের রক্তের আল্পনা
প্লিজ, আমাকে কন্ট্রাক্ট দিন।
দশ লক্ষ মৃতদেহ থেকে
দুর্গন্ধের দুর্বোধ্য জবান শিখে রিপোর্ট লিখেছি- পড়, পাঠ কর।
কুড়ি লক্ষ আহতের আর্তনাদ থেকে
ঘৃণাকে জেনেছি-পড়, পাঠ কর।
চল্লিশ হাজার ধর্ষিতা নারীর কাছে
জুলুমের সবক নিয়েছি – পড়
দুঃখের স্মৃতিতে ডোবা আশি লক্ষ শরণার্থী
শিখিয়েছে দীর্ঘশ্বাসে কতোটুকু ক্রোধ লেখা থাকে।
কোলকাতার কবির মতো কে পারে শোনাতে
‘আমি তোর জন্ম সহোদর?’
অনাহুত বিবেকের ভ্রাম্যমাণ স্থায়ী প্রতিনিধি হয়ে
ক্লান্তিহীন, বিশ্রামবিহীন আমি ছুটে যাই শান্তির সভায়
কখনো দিল্লীতে, মস্কো, লন্ডন প্যারীর
জনাকীর্ণ সমাবেশে আমি খুঁজি একজন রাসেলের মুখ,
প্রেমের লিপিকা পড়ি জেনেভার জুরীদের কাছে-
পৃথিবীর ইতিহাস থেকে কলঙ্কিত পৃষ্ঠাগুলো রেখে
চ’লে আমি ক্যানাডার বিশাল মিছিলে শ্লোগান শোনাতে।
মানুষের জয় হোক, নিপীড়িত জনগণ জয়ী হোক অন্তিম সমরে।
পলাতক শান্তি যেন ফিরে আসে আহত বাংলার ঘরে ঘরে।
(শব্দসৈনিক’-ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ থেকে সংকলিত)
.
কোন এক নিবেদিতাকে
টি, এইচ, শিকদার
নিবেদিতা,
তোমাকে দেখেছি আমি আগেও অনেক
দেখেছি পথের ভিড়ে, একুশের
সুকান্ত মিছিলে।
এবং কখনো কোন-জলসায়
ভার্সিটির তর্কের আসরে, পাঠাগারে
মেটেরিয়া মেডিকার স্তুপীকৃত
জ্ঞানের সমুদ্রে।
নিবেদিতা,
তোমাকে দেখেছি আমি আগেও অনেক
বঙ্গোপসাগর তীরে, কিংবা কোন সবুজাভ
হিলট্র্যাক্ট জুড়ে সাঁওতালী ছেলের হাতে,
মুক্তোময়ী ঝিনুকের খোলের ভেতরে।
তখনো তোমার চুল ভার্জিনিয়া
তামাকের দেশে, মূৰ্ছিত নেশার মত
তীব্রতর সুবাস ছড়ায়;
তোমার ভুরুতে আঁকা সমুদ্র-কাজল
বৃষ্টির নূপুর হয়ে সঙ্গীত শোনায়।
সুরচিতা,
আজকে তোমাকে আমি দেখেছি আবার –
রক্তাক্ত বাংলাদেশে, খুলনা, কুমিল্লা, ঢাকা,
রংপুর, সিলেট আর কুষ্টিয়ার বিষগ্ন সেক্টরে:-
আহত আত্মার পাশে, টাংকের
ভয়াল-চোখ গর্জনের মুখে,
প্রসন্ন ফুলের মত উৎসর্গের তরে।
কি আশ্চর্য! এখন তোমার মন
অন্যভাবে অনন্য ইচ্ছায়
নিবেদিত, সাত কোটি রক্তের সত্তায়ঃ
সহস্র ধ্বংসের বাজ, মেশিনগান, মর্টারের স্তুপে
অক্টোপাশ-ডানা দেখি অনির্বাণ ভিসুভিয়েসের;
এবং তোমাকে দেখে, সমৰ্পিতা,
যদি আমি হতে পারি অন্য এক নিবেদিত প্ৰাণ।।
(বেতার বাংলা’-মার্চ ১৯৭২ থেকে সংকলিত। কবিতাটি প্রচারের তারিখ জানা যায়নি
.
নামফলক
অনু ইসলাম
মহান শহীদানের স্মরণে লেখা
প্রস্তর ফলকে বন্ধু তোমাদের নাম ।
আমি হাঁটছি ২৫শে মার্চ থেকে
আমি হাঁটছি কালো-লাল এবং
সবুজ থেকে ঝলসানো স্বাধীনতা
পর্যন্ত।
এখন বন্ধুরা
স্থির হয়ে তাকিয়ে দেখ্যো
কেমন করে ঢেকে রেখেছি
তোমাদের স্মৃতিগাঁথা আমার বুকের মর্মরে।
জানো এখন আমার চোখ থেকে
সব আলো ফুরিয়ে গ্যাছে ।
দ্যাখো আমার চোখ দুটি কেমন করে
ঢেকে রেখেছি
রাশ রাশ জানা অজানা নামে।
আমি তবুও পড়তে পারি
(শিশু শিক্ষায় যেমন পড়তাম)
মানুষের হৃদয়ের পটে পটে
লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম।
(ওরা মানুষ নয় বীর)
সালাম,
বরকত,
মুক্তিযোদ্ধা
এবং শেখ
যে একটি মানচিত্র।
আমার বুকের নীচে
রক্তের ঝরণা-
ঝরণার গানে গানে
শুধু শুনি লক্ষ নাম-
সালাম
রফিক
মুক্তিযোদ্ধা।
(শব্দসৈনিক’-ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে সংকলিত। কবিতাটি প্রচারের তারিখ জানা যায়নি)
.
৫ নভেম্বর, ১৯৭১
হে স্বদেশ হে আমার বাংলাদেশ
মোহাম্মদ রফিক
তোমার দেহের মতো খর-কৃপাণের মতো
দীর্ঘ ও উদ্যত ঋজু
সারি সারি
শাল-তরু-শ্রেণী
দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই পাশে;
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চুমু খেলে
ভয়ে ও বিহবলতায়
যেমন কম্পন জাগে
তোমার দু’গালে ঠোঁটে, আজকে রাত্রেও তেমনি
উদগ্রীব অপেক্ষার
রুদ্ধ শিহরন সাড়া
শাখে শাখে, শকুনের ডানার ঝাপটে যেন
ঢেউ ওঠে ভয়াল সাগরে;
তোমার ত্বকের রং যেন
তপ্ত কাঞ্চনের মতো
লেগে আচে সড়কের প্রতি ধূলিকণা সাথে,
চোখের মণির মতো সজল নিবিড় কালো
জমছে খণ্ড খণ্ড মেঘ
সারাটা আকাশময়
হয়তো নামবে বৃষ্টি একটু পরে,
যেমন শোনিত চুঁয়ে চুঁয়ে
পড়ছে তোমার পথে পথে
তাল ও তমাল শাখে
শত্রুর বেয়নেটে
তোমার প্রাণের মতো
উষ্ণ লাল রক্ত
যেমন ঝরছে
মাঠে মাঠে গঞ্জে বাটে;
ক’জন চলেছি আমরা
সড়কের, পর দিয়ে এই
একটি ট্রাকে ঠাসাঠাসি
উচিয়ে সঙীন দৃপ্ত
আমরা চলেছি এই
নিরন্ধ রাতের মাঝামাঝি
তোমার প্রেমের ঋণ
রক্ত ঋণ
রক্ত দিয়ে শোধ করে দিতে;
শুধু আলো হাওয়া চাঁদ
বা সূর্যাকরণ নয়
তোমার শরীরে মাগো
বিকট দুর্গন্ধ আছে,
ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন সব
কচি কচি যোদ্ধাদের
ঘামে ভেজা ছেড়া গেঞ্জি
ময়লা বিছানা হতে
বিবমিষা ছুটে আসে;
তোমার দেহের সাথে
এ দুর্গন্ধে মাগো
আমাদের ভবিষ্যৎ যেন
নবজাতকের মত
হাত পা বাতাসে ছুড়ে খেলা করছে;
শুধু খালে বিলে মাঠে
নদীতে নালায় জলে
বা সীতাকুণ্ডর
পর্বতমালায় নয়,
এইসব বৃষ্টিভেজা
কাদামাখা তাঁবুতে তাঁবুতে যেন
তোমার মানচিত্ৰখানি
কতগুলি
ছোট ছোট জারুলের চারার মতো
উষ্ণ তাজা
হৃদয়ের সাথে লেপ্টে আছে।
বিভিণ্ণ টিলায় ট্রেঞ্চে
রাইফেলে ট্রিগারে হাত চেপে
দেখছি প্রতিদিন
হাজার হাজার জীর্ণ অবসন্ন ধর্ষিতা নারীও
পুরুষের সাথে
শত্রুর সন্ত্রস্ত গুলি বেয়নেট বেড়াজাল
কি করে এড়িয়ে মা আমার
হেঁটে চলেছে দল থেকে দলে
দৃপ্ত পায়ে
কুয়াশার আস্তরণ ছিড়ে
ভেঙে পড়া
প্রথম সূর্যের ক্ষীণ
আলোর রেখার মত
কম্পমান সম্ভবার দিকে !
বহু পরে
অনেক রাতের শেষে
আধারের আস্তরণ ভেঙে
নির্দয় নিশ্চিত সূর্য
জরাজীর্ণ
দেয়াল ফাটলে বট
বৃক্ষের চারার মতো
যখন বেরিয়ে আসবে
ফেটে পড়বে
বহু প্রতীক্ষিত
সেই আনন্দিত ক্ষণে
হয়তো দেখবে
তোমার ঘরের পাশে
উজ্জ্বল পৈঠার, পর
দু’একটি ফোঁটা
মলিন রক্ত
লেগে আছে,
তখন কি
মনে পড়বে
প্রিয়তমা
আমরা ক’জন মিলে
অবিচল প্রত্যাশায়
তোমার প্রেমের ঋণ
রক্ত-ঋণ
সহস্ৰ সহস্ৰ কোটি
হায়েনার চীৎকারের মতো
সেই এক
পৈশাচিক অন্ধকার রাতে
চলে গেছি
রক্ত দিয়ে
শোধ করে।
(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)
.
১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
আমার স্বর্গের নামে
মযহারুল ইসলাম
(এক)
সব কথা সব অনুভূতি যেন কোন এক বিষন্ন উদ্বেগে
হতবাক হয়ে আসে, ক্ষোভাচ্ছন্ন চেতনার উদ্দাম আবেগে
বাংলার মাঠে ঘাটে শহরে বন্দরে গ্রামে গ্রামে
রক্তঝরা মুহুর্তের তিমিরাঞ্চল-ছায়া নামে
শ্মশানের ভস্মে আর দুর্দীনের ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাসে
আমাদের কাল শুধু বেদনায় স্নান হয়ে আসে।
(দুই)
বাংলা দেখেছে তার সন্তানের মৃতদেহে
কেমন ভরেছে মাঠ নদী
বাংলা দেখেছে তার সন্তানের রক্তে রক্তে
হিমসিক্ত স্রোতের প্রবাহ
বাংলা জেনেছে তার অপমানে লাঞ্ছনায়
অন্ধকার নামে নিরবধি
বাংলা বুঝেছে তার নির্যাতন নিপীড়নে
কি দুঃসহ যাতনা-প্রদাহ।
ইতিহাস তবু কথা বলে
মুক্তির সোনাসূর্য প্রভাতের প্রতীক্ষায় জাগে পূর্বাচলে।
(তিন)
চারিদিকে শুধু সংগ্রাম আর যুদ্ধ
হাতিয়ার হাতে চলে মহা জয় যাত্রী
বাংলার গ্রাম প্রান্তরে ঘাট প্রতিরোধ বিক্ষুব্ধ
পূর্বগগনে কাটে অভিশাপ-রাত্রি।
অযুত মৃত্যু, অনেক রক্ত সীমাহীন নিগ্ৰহ
পেরিয়ে এসেছে আজকের দিন অগ্নিশপথে স্নাত
দিকে দিকে জাগে মহা অভিযান বিপ্লব বিদ্রোহ
বিজয়ের দিন মুক্তির দিন সম্মুখে প্রতিভাত।
(চার)
বাংলা আমার, স্বদেশ আমার, আমার বাংলাদেশ
রূপে রূপময়ী, চিরমধুময়ী স্বৰ্গ আমার বিশ্বে
সুজলা তটিনী আকাশ চেয়ে দেখি অনিমেষ
সবুজে শ্যামলে নৃত্যে ও গানে নবীনা দৃশ্যে দৃশ্যে।
বিশ্বে আমার স্বর্গ বাংলাদেশ
জাগ্রত আমি সেই স্বর্গের নামে
তার প্রেমে নব-চেতনার উন্মেষ
তারই অনুরাগে নামি মহাসংগ্রামে ।।
(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)
.
১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
বাংলাদেশ
মিজানুর রহমান চৌধুরী
গুরুদেব,
তোমার সোনার বাংলা আজ
শ্মশান হয়ে গেছে।
ফাগুনের আমের বনে
মুকুলের গন্ধ আজ আর নেই
বারুদের গন্ধে ভরেছে ফাগুনের বাতাস।
অবারিত মাঠ গগন ললাট আজ উত্তপ্ত।
বাংলার শ্যামল রূপ বিপর্যস্ত ।
মেশিন গান, মর্টার আর বোমার আঘাতে
বাংলার আকাশ বাতাস ভরে গেছে ।
হে রবীন্দ্রনাথ
তোমার সোনার বাংলা
আজ শ্মশান হয়ে গেছে।
হে বিদ্রোহী
ওরা সাত কোটির মুখের গ্রাস
কেড়ে নিতে চায়।
ওরা বুলেটের আঘাতে বাঙালীকে
নিশ্চিহ্ন করতে চায়।
ওই শোনো আকাশে বাতাসে
নিপীড়িত মানুষের ক্ৰন্দন রোল
ওই দেখ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
রক্তের হোলি খেলায় মেতে গেছে।
এস বন্ধু সেই শমসের নিয়ে
আর একবার পদ্মর জলে মোরা
লালে লাল হয়ে মরি।
বাংলার পথ-প্রান্তর রক্তলেখায় পূর্ণ
এস বন্ধু আজ মোদের রক্তলেখায়
ওদের নিশ্চিহ্ন করে দিই।
জীবনানন্দ
তুমি দেখেছিলে রূপসী বাংলার
রূপ মনোহর।
পাখীর নীড়ের মত চোখ দেখেছিলে-
নাটোরে বনলতা সেনের।
বাংলার ভাটফুল কদম্বের ডালে
ধানসিঁড়ি নদীটির পারে
ফিরে আসতে চেয়েছিলে
এই বাংলায়।
কিন্তু বন্ধু রূপসী বাংলার রূপ আজ বিবর্ণ
পশ্চিমা হানাদারের নির্মমতায়
বাংলার মাঠে ঘাটে হাহাকার ধ্বনি
প্রিয়া আজ দানবের হাতে বন্দিনী
ধর্ষিতা তরুণীর দিগন্ত বিদারী কান্না
আজ বাতাসে কেদে মরছে।
আশীৰ্বাদ করো বন্ধু
প্রিয়ার দৃষ্টির অগ্নিশিখায় যেন
শত্রুর মুখ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সুকান্ত
নবজাতকের কাছে অঙ্গীকার করে বলেছিলে
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবে
কিন্তু নরদানবের পৈশাচিকতায়
অসংখ্য শিশু আজ অধিকার হারা।
বুভুক্ষু জনতার অসহায় ক্ৰন্দন
লাঞ্ছিত বঞ্চিত মানুষের ম্লান মুখ
গভীর জিজ্ঞাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
এসো আজ সিগারেটের মত জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে,
এসো আজ দিয়াশলাইয়ের কাঠির মত মুখে বারুদ নিয়ে
এসো এই সংগ্রাম মাঝে
নতুন আলোর মন্ত্র নিয়ে।
ঠিকানা তোমার পেয়েছি বন্ধু
ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভ, কম্বোডিয়া নয়
আলজিরিয়া, কেনিয়া, ভিয়েতনাম নয়
স্নেহ মায়া মাখা, মমতা ঘেরা এই বাংলায়।
(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)
.
২৪ নভেম্বর, ১৯৭১
অবৈধ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল
মুসা সাদেক
মহামান্য বিচারকমণ্ডলীঃ
এখন থেকে দুই দশক পূর্বে
পবিত্র ধর্ম এবং আইনের দোহাই সাজিয়ে
বিশ্ববিবেক, বিশ্বমানবতার ধ্বজা উঁচিয়ে
আপনাদের আদালতে যাঁদের বিচার করেছিলেন
আদালতে শেষতম শাস্তির বিধান দিয়েছিলেন
ঈশ্বর-দণ্ড-প্রাণ রক্ষার অধিকার কেড়েছিলেন
তারা প্রত্যেকেই নিরপরাধী এবং প্রত্যেকেই পুণ্যবান
এবং পবিত্র আইনের শ্লীলতাহানির অভিযোগে
মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে আপনারা অভিযুক্ত।
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না- দুই দশক বিলম্বে
আসামীর কাঠগড়ায় আপনারা দাঁড়িয়ে
তার খাসা একখানা প্রমাণ নির্মাণ করলেন অন্তত।
বিশ্ববিবেকের যেসব মহানতম ব্যক্তিত্বকে
আপনারা সেদিন মানব সত্তা এবং সভ্যতা হন্তা হিসেবে
চিহ্নিত করেছেন, তার জন্য আমাদের দারুণ বিলাপ
এবং বিশ্বব্যাপী শোক সভার ঘটা অচিরেই শুরু হবে।
মহামান্য আদালতঃ
আমি অবশ্য কোটি কোটি মানুষের দুর্দশা এবং দুর্ভাগ্যের জনক
ফুয়েরারের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করছি
আমি অবশ্যই ফুয়েরার দোসর বেনিটো মুসোলিনীর কথা ভাবছি
ষাট লক্ষ ইহুদী নিধনের পুরোহিত মহাত্মা আইখম্যানের নামও উল্লেখ করছি।
আমি অবশ্যই কূটনীতিক হের হেস, প্রচারবিদ গোয়েবলস, সমরবিদ তেজো
প্রভৃতি পুণ্যাত্মাদের নামও উপস্থাপন করছিঃ
যাঁদেরকে আপনারা অবৈধ আইনের সত্তা অনুসরণ করে
ধর্মের দোহাই পেড়ে পাপাত্মা বলে চরম দণ্ড দিয়েছেন।
এই সব মহাপ্রাণদের ন্যুরেমবার্গ-ট্রায়াল-প্রহসনের মাধ্যমে দণ্ড দিয়ে
সমগ্র বিশ্ব সভ্যতার যে অপূরণীয় ক্ষতি আপনারা করেছেন
আজ তার হিসাব হবে, আজ তার বিচার হবে
না হলে মানব সভ্যতার বুকে মহা অভিশাপ ধার্য হবে।
হে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিচারমণ্ডলীঃ
ঈশ্বরের অসীম করুণা যে সত্য, ন্যায়, ধর্ম এবং বিচার
অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে- তোমরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছ
অবৈধ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের তোমরা আসামী
ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের আসামীদের উত্তরসূরিরা আজ বিচারপতিদের আসনে।
ভিয়েৎনামের লক্ষ লক্ষ হত্যাযজ্ঞের পুরোহিত মহাত্মা রিচার্ড নিক্সন
বাংলাদেশের পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষ হত্যার যোগ্য জনক পুণ্যাত্মা এহিয়া
এবং অসংখ্য মাইলাই- ঐতিহ্যধারী পুণ্যাত্মারা।
আজকের মহামান্য আদালতের মহিমান্বিত বিচারকমণ্ডলী ।
আজকে বিচার হবে অবৈধ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিচারকদের
আজকে বিচার হবে ভিয়েৎনাম যুদ্ধ অপরাধে হোচিমিনের
আজকের বিচার হবে বাংলাদেশ অপরাধে শেখ মুজিবের।
(শব্দসৈনিক -ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে সংকলিত)
.
১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
লাল গৌরবে আসে স্বাধীনতা
রফিক নওশাদ
বন্ধু তোমার শহীদ মিনার রক্তে আমার রাঙিয়ে দেবো
স্বাধীনতার জয় পতাকা এই মিনারেই উড়িয়ে যাবো।
বাংলার বুকে বেদনার ছায়া- হাসে না বাংলা সহজ গানে
হিংস্র শ্বাপদ তীক্ষ্ণ নখরে সবুজ কুঁড়িয়ে মৃত্যু আনে।
ঘন কালো রাত কালো শৃঙ্খল দুর্গম আজ পথের রেখা
তবুও রক্তে বান ডাকে জানি মুক্তি পথের মিলবে দেখা।
যুদ্ধক্লান্ত বন্ধু আমার, ঘুমাও শহীদ- মুক্তি সেনা-
তোমার রক্তে শপথ নিলাম শত্রুকে আজ হয়েছে চেনা।
গণ-শত্রুর কলজে ছিড়ে পিষবো পায়ে কসম ভাই-
আমার ভায়ের রক্তের ঋণ শুধতে হবে আপোষ নাই।
সব শোষণের হিম কারাগার পদাঘাতে জানি পড়বে ধসে
গণ-যুদ্ধের রক্ত-ফসল তুলবো এবার যুদ্ধশেষে।
এদেশ আমার, কোটি জনতার- পরাধীনতার লগ্নশেষ
কৃষ্ণচূড়ার লাল গৌরবে আসে স্বাধীনতা- হাসে স্বদেশ।
(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)
.
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
অন্বিষ্ট রাজ্যঃ আমার বাংলা
প্রণব চৌধুরী
আমি পেয়েছি খুঁজে এক বাস্তবিক মানোরম রাজ্য।
এ রাজ্যের কোথাও নির্ধারিত কোন সামরিক শাসনের নেই
কড়া বিধি, খাঁচাবন্ধের ভয়।
এখানে সবার নির্বিকার বাধাহীন চলাফেরা,
মা’র কোলে দোল খাওয়া নিগৃঢ় নিশ্চিন্ত ঘুম,
নিরপরাধ আঁচলে মাথা ঝুঁকানো স্বামীর সোহাগ
পুত্তলি … …
এ রজ্যের সবচেয়ে বড়ো কথা, মুলত,
এখানে চিরায়ীত নিয়মে সব পথঘাট, প্রান্তর, জলাশয় নদী
ছায়ান্ধ অন্ধকারে কতোকাল ঢেকেছিল ভয়াবহ জঙ্গল।
অতঃপর একদিন এ রাজ্যের আবালবৃদ্ধ হাত বুলিয়ে গভীর প্রেম,
একে একে সব আধারের পাষাণ পাহাড়, সারি সারি
সভয় জঙল কেটে ভয়াল বাঘের চামড়ায়
শুতে দিল আজীবন ভীরু হরিণী;
মায়ের অনিঃশেষ স্নেহের মতো বাড়ালো সূর্য মুখ
এ সূর্য আর ভুবলো না কোনদিন
ডুবে আবার প্রাত্যহিক বিশাল কালো নদীতে
মাথা বাসানোর বুক ফুলালো না,
এ রাজ্যে সেই থেকে অন্ধকার নেই, প্রতি মুহূর্ত সূর্য
সূর্য আর ডোবে না প্রত্যহ
শুধু ‘আলোয় ভুবন ভরা আলোর স্রোতে পাল তুলেছে
হাজার প্রজাপতি ।। *
(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত)
.
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
দিন এলো
আবুল কাসেম সন্দ্বীপ
রাত্রির শেষ-তমসার শেষ- পূর্ব দিগন্ত লাল
বন্দরে শুনি গর্জন আর সমুদ্রে উত্তাল
দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে গেছে- শংকার রাত শেষ
ধ্বংসের স্তুপে শিহরণ জাগে- জীবন্ত উদ্দাম।
গর্জন-ভীতি শংকিত বুকে দুর্জয় সংগ্রাম।
নবতর আজ চেতনার ধ্বনি- জীবনের ধ্বনি
কাল শেষ হয়ে গেলো- রাত্রির শেষ- দিগন্ত আজ লাল।
বেদনার দিন, শোষণের দিন, জালিমের কাল শেষ
শাদ্দাদ কাঁপে ভীত-শংকিত। সব নমরুদ মুহ্যমান।
দুর্গের দ্বার ভেঙেছি ওদের কঠিন কঠোর প্রতিজ্ঞায়-
আমাদের আজ দুবার গতি- দুর্জয় হলো বাংলাদেশ
দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে গেলো- শংকার রাত হয়েছে শেষ।
দিন এলো আজ বিজয়ের দিন- উল্লাস-ধ্বনি দেশে।
বেদনার কথা মিলনের বাণী বিরহবিধুর মন
সচেতন সব বঞ্চিতগণ- বিবেকের জাগরণ
নব উত্থান- নতুন জাতির হৃদয়ে সূর্যোদয়।
চঞ্চল চোখে উদাম আশা মৃত্যুর পরাজয়।
[‘শব্দসৈনিক’- ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে সংকলিত ]