স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত গান

শিরোনাম সুত্র তারিখ
১৯। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

প্রচারিত গান

…১৯৭১

.

(এক)

জয় বাংলা বাংলার জয়।।

হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়

কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধরাতে

নতুন সূর্য উঠার এই তো সময় ।।

বাংলার প্রতিঘর ভরে দিতে

চাই মোরা অন্নে।

আমাদের রক্ত টকবক দুলছে

মুক্তির রিক্ত তারুণ্যে ।।

নেই—ভয়

হয় হউক রক্তের প্রখ্যাত ক্ষয়

আমি করি না করি না করি না ভয়।

অশোকের ছায়া যেন রাখালের বাঁশরী

হয়ে গেছে একেবারে স্তব্ধ।

চারিদিকে শুনি আজ নিদারুণ হাহাকার

আর ঐ কান্নার শব্দ ।।

শাসনের নামে চলে শোষণের

সুকঠিন যন্ত্র।

বজ্রের হুংকারে শৃংখল ভাংতে

সংগ্রামী জনতা অতন্দ্র।

আর—নয়

তিলে তিলে মানুষের এই পরাজয়

আমি করি না করি না করি না ভয়।

                                                জয় বাংলা বাংলার জয় ।।

(কথা-গাজী মজহারুল আনোয়ার)

(দুই)

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি

মোরা একটি সুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি ।।

যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা

যার নদী জলে ফুলে ফলে মোর স্বপ্ন আকা

যে নদীর নীল অম্বরে মোর মেলেছে পাখা

সারাটি জীবন সে মাটির গানে অস্ত্র ধরি ।।

নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি-

মোরা নতুন একটি গানের জন্য যুদ্ধ করি

মোরা একখানা ভালো ছবির জন্য যুদ্ধ করি

মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি ।।

যে নারীর মধু প্রেমেতে আমার রক্ত দোলে

যে শিশুর মায়া হাসিতে আমার বিশ্ব ভুলে

যে গৃহকপোত সুখ স্বর্গের দুয়ার খুলে

সেই শান্তির শিবির বাঁচাতে শপথ করি ।।

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি

মোরা একটি সুখের হাসির জন্য আজি অস্ত্র ধরি।

(কথা-গোবিন্দ হালদার)

(তিন)

আমি এক বাংলার মুক্তি সেনা

মৃত্যুর পথ চলিতে

কভু করি না ভয় করি না।

মৃত্যুরে পায়ে দলে চলি হাসিতে।

দুঃসহ জীবনের রাহু মুক্তি

প্রাণে মেখে সূর্যের নবশক্তি

বজ্রশপথে নেমেছি যুদ্ধে

বাঙ্গালীর জয় হবে নিশ্চয়

চলেছে এ দুর্জয় মুক্তির পথে।

বাংলার তরে আমি সঁপেছি এ মন

নেই জালা হাহাকার নেই হুতাশন৷

রক্তে রাঙা আজ বিপ্লবী মন

ক্ষমা নেই বাংলার গণদুশমন

বজ্রের তূর্যের মন্ত্রে

মারবো এবার মরবো না আর

চলেছি যে শত্রুকে পায়ে দলিতে।

(কথা-নেওয়াজিস হোসেন)

(চার)

বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা

আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা ।।

তোমার গুলির, তোমা ফাঁসির,

তোমার কারাগারের পেষণ শোধবে তারা

ও জনতা এই জনতা এই জনতা ।।

তোমার সভায় আমীর যারা,

ফাঁসির কাঠে ঝুলবে তারা ।।

করজোড়ে মাগবে বিচার।

ঠিক যেন তা এই জনতা ।।

তারা নতুন প্রাতে প্রাণ পেয়েছে, প্রাণ পেয়েছে।

তারা ক্ষুদিরামের রক্তে ভিজে প্রাণ পেয়েছে ।।

তারা জালিয়ানের রক্তমানে প্রাণ পেয়েছে।

তারা ফাঁসির কাঠে জীবন দিয়ে

প্রাণ পেয়েছে প্রাণ পেয়েছে।

তারা গুলির ঘায়ে কলজে ছিড়ে প্রাঁণ পেয়েছে,

প্রাণ পেয়েছে এই জনতা।

নিঃস্ব যারা সর্বহারা তোমার বিচারে।

সেই নিপীড়িত জনগণের পায়ের ধারে ।।

ক্ষমা তোমায় চাইতে হবে

নামিয়ে মাথা হে বিধাতা ।

রক্ত দিয়ে শোধতে হবে

নামিয়ে মাথা হে বিধাতা।

ঠিক যেন তা এই জনতা।

বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা

আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা ।।

(কথা- সলিল চৌধুরী)

(পাঁচ)

সোনা সোনা সোনা

লোকে বলে সোনা

সোনা নয় ততো খাঁটি

বলো যতো খাঁটি

তার চেয়ে খাঁটি বাংলাদেশের মাটিরে

আমার জন্মভূমির মাটি।

ধন জন মন যত ধন দুনিয়াতে

হয় কি তুলনা বাংলার কারো সাথে।

কত মার ধন মানিক রতন

কত জ্ঞানীগুণী কত মহাজন।

এনেছে আলোয় সূর্য এখানে

আঁধারের পথ পাতি রে

আমার বাংলা … … … ।।

এই মাটির তলে ঘুমায়েছে অবিরাম

রফিক, শফিক, বরকত কত নাম

কত তিতুমীর, কত ঈশা খান

দিয়েছে জীবন, দেয়নি তো মান।

রক্ত শয্যা পাতিয়া এখানে

ঘুমায়েছে পরিপাটি রে

আমার বাংলাদেশের মাটি

আমার জন্মভূমির মাটি।

(কথা-আবদুল লতিফ)

(ছয়)

ছোটদের বড়দের সকলের

গরীবের নিঃস্বের ফকিরের

আমার এ দেশ, সব মানুষের, সব মানুষের ।।

নেই ভেদাভেদ হেতা চাষা আর চামারে,

নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে।

হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান দেশ মাতা এক সকলের

লাঙ্গলেরা সাথে আজ চাকা ঘুরে এক তালে

এক হয়ে মিশে গেছি আমরা সে যে কোন প্ৰাণে

বাণী শুনি একই সুরের ।।

চাষাদের মজুরের ফকিরের

ফকিরের নিঃশ্বের গরিবের

আমার এ দেশ , সব মানুষের , সব মানুষের ।

বড়দের ছোট দের সকলের

ছোটদের বড়দের সকলের

আমার এদেশ সব মানুষের … ।।

(কথা ও শিল্পী-রথীন্দ্রনাথ রায়)

(সাত)

জনতার সংগ্রাম চলবেই,

আমাদের সংগ্রাম চলবেই

জনতার সংগ্রাম চলবেই।

হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে

বাঁচবার অধিকার কাড়তে

দাসের নির্মোক কাড়তে

অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ

চলবেই চলবেই,

জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।।

প্রতারণা প্রলোভন প্রলোপ

হোক না আধার নিশিছদ্র

আমরা ত সময়ের সারথী

নিশিদিন কাটাবো বিনিদ্র।

দিয়েছি ত শান্তি আরও দেবো স্বস্তি

দিয়েছি ত সন্ত্রম আরো দেবো অস্থি

প্রয়োজন হলে দেবো এক নদী রক্ত

হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত

অবিরাম যাত্রা চির সংঘর্ষে

একদিন সে পাহাড় টলবেই

চলবেই চলবেই

জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই ।।

হতে পারি পথভ্রম আরও বিধ্বস্ত

ধিকৃত নয় তবু চিত্ত

আশায় ত সুস্থির লক্ষ্যের যাত্রী

চলবার আবেগেই তৃপ্ত।

আমাদের পথরেখা দুর্গম দুস্তর

সাথে তবু অগণিত সঙ্গী

বেদনার কোটি কোটি অংশী

আমাদের চোখে চোখে লেলিহান অগ্নি

সকল বিরোধ বিধ্বংসী।

এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল

কোনদিন আমরা যে ভাঙবোই

মুক্ত প্রাণের সাড়া আনবোই।

আমাদের শপথের প্রদীপ্ত স্বাক্ষরে

নূতন অগ্নিশিখা জলবেই

চলবেই চলবেই

জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।

(কথা-সিকান্দার আবু জাফর)

(আট)

মুক্তির একই পথ সংগ্রাম

অনাচার অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে

বিদ্রোহ-বিক্ষোভ-ঝংকার-হুংকার

আমরণ সংঘাত, প্রচণ্ড উদ্দাম

সংগ্রাম-সংগ্রাম-সংগ্রাম!

ক্ষমতার দম্ভ লোভ সালসায় যারা

জনতার অধিকার খর্ব

ঘরে ঘরে গড়েছি দুর্জয় প্রতিরোধ দুর্গ

তাদের আজ প্রতিহত করবোই করবো ।

যারা মানুষের রক্ত চোষে,

মানুষের মাঝে আনে ব্যবধান

যারা পৃথিবীর কলঙ্ক কালিমা,

কেড়ে নেয় মা-বোনের সম্মান

এসো রক্তশপথে আজ আঘাতে আঘাতে

তাদের করি খান খান –

বাঁচার জন্য ভয় সংশয় রেখে

প্রতিজ্ঞা করেছি আজ মোরা লড়বো

কাটিয়ে জীবনের দুঃখ ঝরা রাত্রি

নতুন এক পৃথিবী গড়বোই গড়বো।

(কথা-শহীদুল ইসলাম)

(নয়)

তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর

পারি দিবরে

আমরা ক’জন নবীন মাঝি

হাল ধরেছি শক্ত করে রে ।।

জীবন কাটি যুদ্ধ করি প্রাণের মায়া সঙ্গ

করি জীবনের সাধ নাহি পাই।

ঘর-বাড়ির ঠিকানা নাই

দিন রাত্রি জানা নাই

চলার ঠিকানা সঠিক নাই ।।

জানি শুধু চলতে হবে এ

তরী বাইতে হবে

আমি যে সাগর মাঝি রে ।।

জীবনের রঙে মনকে টানে না

ফুলের ঐ গন্ধ কেমন জানি না

জ্যোৎস্নার দৃশ্য চোখে পড়ে না

তারাও তো ভুলে কভু ডাকে না ।।

বৈশাখের ওই রৌদ্র ঝড়ে

আকাশ যখন ভেঙে পড়ে

ছেঁড়া পাল আরও ছিঁড়ে যায় ।।

হাতছানি দেয় বিদ্যুৎ আমায়

হঠাৎ কে যে শান্ত সোনার

দেখি ঐ ভোরের পাখী গায় ।।

তবু তরী বাইতে হবে

খেয়া পারে নিতে হবে

যতই ঝড় উঠুক সাগরে।

তীরহারা এই ঢেউয়ের

সাগর পারি দিব রে ।।

(শিল্পীঃ আপেল মাহমুদ ও সঙ্গীরা)

(দশ)

অবাক পৃথিবী দেখো

রূপসী বাংলা রুদ্র মূর্তি আজ ।।

তোমরা চিনতে মায়াভরা সেই বাংলাকে

তোমরা জানতে শস্য শ্যামলা বাংলাকে

সেই সে বাংলা আজ হয়েছে ক্ষুধার রাজ ।।

যে দেশ ছিল সোনার ফসলে ভরা

যে দেশ ছিল নীল নভঃনীলে ঘেরা

আঘাতে আঘাতে সেই পলিমাটি চৌচির হলো আজ ।।

যে মায়াকুঞ্জ একদিন ছিল পাখীর কুজনে ভরা

যে সহজ মন একদিন ছিল স্নেহ প্রীতি মায়া ঘেরা

সে হৃদয় যন্ত্রে আজ গরজে উঠেছে বাজ।।

(কথাঃ নূরে আলম সিদ্দিকী)

(এগার)

রক্তেই যদি ফোটে

জীবনের ফুল

ফুটুক না, ফুটুক না, ফুটুক না ।।

আঘাতেই যদি বাজে

প্রভাতের সুর

বাজুক না, বাজুক না, বাজুক না ।।

গান গান গান বেজেছে অগ্নি গান

দূর সব ব্যবধান সাত কোটি প্রাণ বিসর্জনে

বাংলার গ্লানি ঘুচুক না, ঘুচুক না ।।

এক এক এক

হয়েছি সবাই এক

আসুক দুর্বিপাক

ক্ষুব্ধ মিছিল চলবেই চলবে

প্ৰলয়-ঝঞ্চা উঠুক না, উঠুক না ।।

(কথাঃ সৈয়দ শামসুল হক)

(বারো)

নোঙর তোল সময় যে হোল হোল

হাওয়ার বুক নৌকা এবার

জোয়ারে ভাসিয়ে দাও

শক্ত মুঠি বাঁধবে বজ্র বাঁধিয়া নাও

সমুখে এবার দৃষ্টি তোমার পেছনের কথা ভোল

দূর দিগন্তে সূর্য রথে

দৃষ্টি রেখেছ স্থির

সবুজ আশার স্বপ্নেরা আজ

আলোর দুয়ার খোল।

(কথাঃ নঈম গওহর)

(তেরো)

অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা

দেবো যে আরো, এ জীবন পণ

আকাশে বাতাসে জেগেছে কাঁপন

আয়রে বাঙালী ডাকিছে রণ ।।

ঘরে ঘরে ঔ জ্বলছে অগ্নিশিখা

শহীদের খুনে লিখতে রক্ত লেখা

আঘাতে আঘাতে ভেঙ্গেছে পাহাড়

ভেঙ্গেছে ওরে বন্ধুগণ ।।

দিকা দিকা তোরা আয়রে সার্বহারা,

মুক্তি শপথ ভেঙ্গেছে বন্দী কারা ।

ভেঙ্গেছে ভেঙ্গেছে পথের বাঁধন

ওরে ও বাঙ্গালী শোনরে শোন ।।

অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা

দেবো যে আরো এর জীবন পণ।

(কথাঃ টি, এইচ, শিকদার)

(চৌদ্দ)

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে

রক্ত লা রক্ত লা রক্ত লাল

জোয়ার এসেছে পরশ মনে

রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল ।।

বাঁধন ছেড়ার হয়েছে কাল,

হয়েছে কাল, হয়েছে কাল ।।

শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে

অত্যাচারীরা কাপে আজ ত্ৰাসে

রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে

নয়া বাংলার নয়া শাশান, নয়া শ্মশান ।

আর দেরী নয় উড়াও নিশান

রক্তে বাজুক প্রলয় বিষাণ

বিদ্যুৎ গতি হউক অভিযান।

ছিড়ে ফেলো সব শত্রুজাল, শত্ৰজাল।

(কথা-গোবিন্দ হালদার, সুর-সময় দাস)

(পনেরো)

এক সাগর রক্তে বিনিময়ে

বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা

আমরা তোমাদের ভুলব না ।।

দুঃসহ এ বেদনার কণ্টক পথ বেয়ে

শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা

আমরা তোমাদের ভুলব না।

যুগের নিষ্ঠুর বন্ধন হতে

মুক্তির এবারতা আনলে যারা

আমরা তোমাদের ভুলব না ।।

কিষান কিষাণীর গানে গানে

পদ্মা মেঘনার কলতান

বাউলের একতারাতে

আনন্দ ঝংকারে

তোমাদের নাম ঝংকৃত হবে।

নতুন স্বদেশ গড়ার পথে

তোমরা চিরদিন দিশারী রবে

আমরা তোমাদের ভুলব না ।।

(কথা-গোবিন্দ হালদার, সুর ও শিল্পী-স্বপ্না রায়)

(ষোল)

সালাম সালাম হাজার সালাম

সকল শহীদ স্মরণে,

আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই

তাদের স্মৃতির চরণে ।।

মায়ের ভাষায় কথা বলাতে

স্বাধীন আশায় পথচলাতে

হাসি মুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ

সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান

তাদের বিজয় মরণে।।

ভাইয়ের বুকের রক্তে আজিকে

রক্ত মশাল জ্বলে দিকে দিকে

সংগ্রামী আজ মহা জনতা

কণ্ঠে তাদের নব বারতা

শহীদ ভাইয়ের স্মরণে ।।

বাংলাদেশের লাখো বাঙালী

জয়ের নেশায় চলে রক্ত ঢালি

আলোর দেয়ালী ঘরে ঘরে জ্বালী

ঘুচিয়ে মনের আধার কালি-

শহীদ স্মৃতি বরণে ।।

(কথা-ফজল-এ খোদা)

(সতেরো)

সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের

শ্মশান করেছে কে?

পৃথিবী তোমার আসামীর মত

জবাব দিতে হবে ।।

শ্যামল বরণী সোনালী ফসলে

ছিল যে সেদিন ভরা

নদী নিবার সদা ব’য়ে যেত

পূর্ত অমৃত ধারা

অগ্নিদাহনে সে সুখ স্বপ্ন

দগ্ধ করেছে কে?

আমরা চেয়েছি ক্ষুধার অন্ন

একটি স্নেহের নীড়

নগদ পাওনা হিসেব কষিতে

ছিল না লোভের ভীড়।

দেশের মাটিতে আমরা ফলাবো

ফসলের কাঁচা সোনা

চিরদিন তুমি নিয়ে যাবে কেড়ে

হায়রে উন্মাদনা

এই বাঙালীর বুকের রক্তে

বন্যা বহালো কে?

পৃথিবী তোমায় আসামীর মত

জবাব দিতে হবে ।।

(কথা, সুর ও শিল্পী-মকসুদ আলী খান সাই)

(আঠারো)

সাত কোটি আজ প্রহরী প্রদীপ

বাংলার ঘরে জ্বলছে,

বন্ধুগো এসো হয়েছে সময়,

পথ যে তোমায় ডাকছে।

বন্ধুগো আজ চেয়ো না পিছে,

আজকে শঙ্কা করো না, মিছে,

বাংলার মাটি, বাংলার তৃণ,

তোমাদেরই কথা বলছে ।।

বন্ধু অনেক বেদনা সয়েছি,

অনেক হয়েছি কাতর,

বন্ধু ভুলেছি বেদনা এবার

হৃদয় করেছি পাথর ।।

রক্তের দাম চাইনাকো আর

আজকে দেখুক বিশ্ব আবার,

বাংলার প্রাণে, বাংলার গানে

আগুনের শিখা জ্বলছে।

(কথা-সারওয়ার জাহান)

(উনিশ)

ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল

পাকে পাকে তড়পায় সমকাল

মারীভয় সংশয় ত্রাসে

অতিকায় অজগর গ্রাসে

মানুষের কলিজা

ছেঁড়া খোড়ে খাবলায়

খাবলায় নরপাল ।।

ঘুম নয় এই খাঁটি ক্রান্তি

ভাঙো ভাই খোয়ারির ক্লান্তি

হালখাতা বৈশাখে

শিষ দেয় সৈনিক হরিয়াল ।।

দুর্বার বন্যার তোড়জোড়

মুখরিত করে এই রাঙা ভোর

নায়ে ঠেলা মারো হেই এইবার

তোলো পাল তোলো পাল ধরো হাল ।।

কড়া হাতে ধরে আছি কবিতার

হাতিয়ার কলমের তলোয়ার

সংগ্রামী ব্যালাডে

ডাক দেয় কমরেড কবিয়াল ।।

 (আবু বকর সিদ্দিক)

(কুড়ি)

শোনন, একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি

আকাশে বাতাসে উঠে রণি।

বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।

সেই সবুজের বুক চেরা মেঠো পথে,

আবার এসে ফিরে যাবো আমার

হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো।

শিলেপ কাব্যে কোথায় আছে হায়রে

এমন সোনার দেশ ।।

বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,

জীবনানন্দের রূপসী বাংলা

রূপের যে তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ।

‘জয় বাংলা’ বলতে মনরে আমার এখনো কেন ভাবো,

আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো,

অন্ধকারে পুবাকাশে উঠবে আবার দিন মণি।

(কথা-গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর ও শিল্পী-অংশুমান রায়)

(একুশ)

অত্যাচারীর পাষাণ কারা জ্বালিয়ে দাও।

সভ্যতার ওই বধ্যভূমি জ্বালিয়ে দাও।

শত্রুহনন চলছে দিকে দিকে

সকল যুগের নিপীড়িতের পক্ষ থেকে

আপোষহীন সংগ্রামের

শেষ কথাটি জানিয়ে দাও

অসূরের হাড়কাঠে

তোর পায়ের ধূলিঝড়

ওরে লাগুক,

লাগুক ভয়ঙ্কর-

খুনের বদলা খুন নেবো

খুন নেবো আজ

রক্ত লোভীর খুনী পাজর ভেঙ্গে

হানাদারের কলজে ছিঁড়ে

খুনের আগুন জ্বালিয়ে দাও।

(কথা-আল মুজাহিদী)

(বাইশ)

আমার নেতা শেখ মুজিব,

তোমার নেতা শেখ মুজিব,

দেশের নেতা শেখ মুজিব,

দশের নেতা শেখ মুজিব,

আহা বাংলা মা’র কোল কইরাছে উজল।

ওরে মনের আশা আল্লায় তাঁরে কইরা দিক সফল রে

আশার আলো করতাছে ঝলমল ।।

ও দ্যাখো আশার আলো করতাছে ঝলমল

আমার নেতা শেখ মুজিব,

দিশার নেতা সেখ মুজিব,

যুগের নেতা শেখ মুজিব,

সবার নেতা শেখ মুজিব,

ওরে সাবাস ব্যাটার বুকের পাটা, যেমন বিজলী ঠাটা রে

চুকবে যত সমস্যার ল্যাটা,

এবার চুকবে যত সমস্যার ল্যাটা ।।

হাইলার বন্ধু শেখ মুজিব,

জাইলার বন্ধু শেখ মুজিব,

কুলির বন্ধু শেখ মুজিব,

ঢুলির বন্ধু শেখ মুজিব,

আহা এমন বন্ধুর তুলনা আর নাই।

ওরে নিজের প্রাণ বিলাইয়া করে দ্যাশেরি ভালাই রে,

আইসো ভাই তাঁর কাতারে দাঁড়াই ।।

ও এবার আইসো ভাই তাঁর কাতারে দাঁড়াই ।।

 (কথা ও সুর-হাফিজুর রহমান)

(তেইশ)

ও বগিলারে,

কেন বা আলু বাংলাদেশের মাছের আশা নিয়া।।

ও বগিলারে, …………।

শিয়াল কান্দে, কুত্তা কান্দে, কান্দে ইয়াহিয়া হায়রে ।।

দুপুর রাইতে ডুপরি কান্দে, ভুট্টো বড় মিয়া, কান্দে।

ও বগিলারে,………।

আপন ফাঁদে আপনি বন্দী টিক্কার চৌখত পানি, ঐ দেখ।

আন্ধার দেখে মাইরের চোটে মিছাই বন্দুক তানি।

বগিলারে,…………. |

বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ বাংলার মাটি ঠুকরি ভাংলু কার।

আষাঢ় মাসোত কাদোয় পরি

হলু নাজেহাল, ও তুই হলু নাজেহাল।

শাওন মাসোত ফালগুন ছাড়ি

নেংটি করলো ছাড়ি

বৈঠার গুঁতায় বাপরে মরে

জান বাঁচে না আর

ও তোর জান বাঁচে না আর।

মরদ মরদ কাওয়ার শালি

কেমন তোর মরদানি ঐ।।

বন্দুক ছাড়ি ঘর উদাসী, ও তুই ।।

গাইলের চোটে কোমড় ভাংগী ভাত বাড়িৰু গিয়া

হাত বাড়াইয়া কান্দে এখন ভুট্টো-ইয়াহিয়া, টিক্কা-ইয়াহিয়া

ও বগিলারে,

কেন বা আলু বাংলাদেশে মাছের আশা নিয়া।

(কথা-হরলাল রায়, শিল্পী-রথীন্দ্রনাথ রায়)

(চব্বিশ)

ওরে আমার দেশের মানিক সোনা।।

তোরা হাসিয়া জীবন দিতেছিস

শেখ মুজিবের সব জানা।

তোমাদের মত কে আর আছে,

তোদের মারতে বসেছেরে।

তোরা দুরাচারী ধ্বংস কর

সহায় আছে রাব্বানা।।

কত দিন করবে শয়তানী

উড়িয়ে দেবে তার জীবন খান।

তোরা শেষ কর তাদের দুশমনি

গুলিকে ভয় কইর না।

যত শয়তান আছেরে দেশে,

বেশীদিন রবে না,

একটিও পাবি না।

তোদের কাছে সবাই নত,

শেষ করে দাও শত শত।।

এখন হইছে বাঘে হত হত

প্রাণ ভয়ে আর বাঁচে না।

(কথা, সুর ও শিল্পী-শাহ আলী সরকার)

(পচিশ)

মোদের ফসল কেরে নিলরে,

যারা মারলো জাতি-কুলরে,

তোরা ভাই শেষ কর তাদের।

তাদের পাঠাইয়া দেরে তোরা,

ঐ না যমের ঘরে।।

তোদের খাইয়া মানুষ হইলো,

তাই বাঘেরা বেঁচে রইলরে।।

এবার বুঝিয়ে দে ভাই সকল

        কেমনে সে যাবে সে পার ।।

 হানাদারীর পাঞ্জেগানা

ভিতরে শয়তানী

এবার বুঝক বাঙ্গালীদের

সিংহ বিক্রমণি।।

তোরা সব জয়ধ্বনি কর… বাঙ্গালী

জোরছে কষে গুলি মাররে।

 এই ভব সংসারে।

(কথা, সুর ও শিল্পী-শাহ আলী সরকার)

(ছাব্বিশ)

ওরে ও বাঙ্গালীরে,

দুশমনদেরে, দেশে রাইখ না।

                                যারা তোদের খাইয়া তোদের মারে

তারে ক্ষমা কইর না।

                                খানের ঘরের ইয়াহিয়া-

মানব পশু গেছেরে হইয়া।।

কি আজব এ ঘটনা।

কতদিন আর ঘুমাও ঘরে:

চাইয়া দেখ আজ বাহিরে,

ওরে অবোধ নয়ন মেললি না ।।

ও বাঙ্গালী-

মরুভুমির বাঘে ঘুরে

এবার মার ধইরে ধইরে ।।

চালাও গুলি বুদ্ধির জোরে

একটিরও প্রাণ রাইখ না ।।

(কথা, সুর ও শিল্পী-শাহ আলী সরকার)


১-৪ গান শামসুল হুদা চৌধুরী সম্পাদিত সাময়িকী অনেক রক্ত একটি জাতি’, ৫-১৬ গান বেতার বাংলা ডিসেম্বর ১৯৭৯, ১৭-২৩ গান শামসুল হুদা চৌধুরী রচিত গ্রন্থ ‘একাত্তরের রণাঙ্গন এবং ২৪-২৬ গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র থেকে সংকলিত।”

Scroll to Top