২৭শে জুলাই ১৯৭১
পাকিস্তান রক্ষায় জাতিসংঘ
জাতিসংঘের কাঁচ ঘর থেকে একটি অত্যন্ত অশুভ পদক্ষেপের খবর পাওয়া গেল। বলা বাহুল্য যে এর মুল পরিকল্পনাকারী আর কেউ নন, জাতিসঙ্ঘের শরনার্থী কমিশনার প্রিন্স সদরউদ্দিন আগা খান। প্রিন্স আগা খানের ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশ আর পাকিস্তানিদের অত্যাচারে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ৬০ লক্ষ শরনার্থীর রিফ্যুজি ক্যাম্প গুলো পরিদর্শনের পরও পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি তার সমবেদনা লুকাতেই এই প্রচেষ্টা। গণমাধ্যমে দেয়া তার সতর্ক ও গতানুগতিক কুটনৈতিক বক্তব্যে বাংলাদেশের মানুষের ভয়ানক দুর্দশার প্রতি তার নির্মম উদাসীনতাই প্রকাশ পেল।বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ৫০ জন ইউ.এন. সদস্যকে পরিদর্শক হিসেবে বাংলাদেশে পাঠানোর তার নতুন পরিকল্পনা মুল উদ্দেশ্য ছিল নিক্সন প্রশাসন কে সম্পুর্ন সমর্থন দেওয়া। এটা শুধুমাত্র তিনি এবং তার পরামর্শদাতারা জানতেন। নিক্সন প্রশাসন, যারা পরিষ্কার ভাবেই এই ইস্যুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং বাংলাদেশে ঘৃণ্য পাকিস্তানি কলোনীস্টদের একটি পুতুল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।এই পরিকল্পনাটি আমেরিকার দক্ষিন ভিয়েতনামে Ngo Din Diem শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টার থেকেও জঘন্য।নিশঃন্দেহে হত্যাকারী জান্তাকে উপর্যপুরি অশ্র সরবরাহের পর এটি ছিল নিক্সন সরকারের বাংলাদেশি জনগনের বিরুদ্ধে প্রথম কুটনৈতিক আক্রমন।
এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই প্রস্তাবিত ইউ.এন. পরিদর্শক দল নিয়ে আমাদের মাঝে বিভ্রান্তির কোন অবকাশই ছিল না। এর উদ্দেশ্য পরিষ্কার ভাবেই বাংলাদেশি জনগণের বর্তমান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধি ছিল।গত চার মাসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লক্ষাধিক নিরপরাধ মানুষের পৈচাশিক হত্যা আর সমগ্র বাঙ্গালী জাতির ওপর তাদের নারকীয় ও অন্ধ হিংস্র আক্রমন জাতিসঙ্ঘকে খুব সামান্যই বিচলিত করেছিল।এর সাধারন সচিব এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান সম্পাদক হিসেবে সম্পুর্ন ব্যার্থ যা এক সময় বিশ্ব মানবতার রক্ষক হিসেবে বিবেচিত হত।যদিও তিনি জনসম্মুখে এই দুঃখজনক ঘটনায় তার ব্যক্তিগতভাবে মর্মাহত হওয়া কথা জানিয়েছেন।সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাংলাদেশের বিধস্ত মানবতা বৃথাই অপেক্ষা করেছে এই আশায় যে, জাতিসংঘ তাদের ওপর কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া এই ধংসাত্মক যুদ্ধের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য কিছু করবে।কিন্তু কিছুই হয়নি।জাতিসংঘ অত্যন্ত আপত্তিকর ভাবে একটি হৃদয়হীন নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করেছে।যখন এরকম একটি প্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে এত সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন সেটা সাভাবিক ভাবেই উদ্যেগের সৃষ্টি করে।এরকম একটি তথাকথিত পরিদর্শক পাঠানোর প্রস্তাব শুধুমাত্র অসৎ
উদ্দেশ্য প্রনিতই নয় বরং এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি অশনি সংকেতের পুর্বাভাস।দলটির উপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ অধিকৃত এলাকায় পাকিস্তানি জান্তার অবস্থান সুসংহত করার উদ্দেশ্যে ছিল।মুক্তিযদ্ধাদের আক্রমনে মারাত্মকভাবে হয়রানির শিকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাময়িক বিশ্রামের খুব প্রয়োজন ছিল।জাতিসংঘ শুধুমাত্র তাদের সে সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করছিল।তাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানো।
পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের জনগনের সাথে গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরু করেছিলো ,যে যুদ্ধ জন্ম দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য এক আপোষহীন যুদ্ধের। এটাই প্রধান কারন এবং পাকিস্তান তার অশুভ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ভারতকে টেনে আনছে যাতে বাংলাদেশের মানুষের উপর চালানো অমানবিক নির্যাতন থেকে বিশ্বের মনযোগ অন্যদিকে ঘোরানো যায়। একদা মহান সংগঠন জাতিসংঘ এখন নিক্সনের আন্তর্জাতিক কৌশলের স্বার্থে সরাসরি বাংলাদেশের জনগনের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভূমিকা পালন করেছে । মনে হচ্ছে যেন সভ্য পৃথিবী শেষ ,সমস্ত মানবিক মুল্যবোধ ডিগবাজি খেয়ে গেছে ।
পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট রেডিও জাতিসংঘের স্বার্থে এর সন্দেহজনক বিজয়ে উল্লাস না করে পারছিলো না । সর্বশেষ সংবাদে এটি প্রিন্স সদরুদ্দীনের গোপন উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানায় । এটা দাবী করে পর্যবেক্ষকরা ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তে তদন্ত করে পাকিস্তানের দাবীমতো এটাই প্রতিষ্ঠা করবে যে ,ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে আসছে এবং বাংলাদেশের কোন স্বাধীন কোন অঞ্চল নেই । বিখ্যাত পশ্চিমা সাংবাদিক যারা স্বাধীন অঞ্চল গুলো ঘুরে রিপোর্ট করেছে তাদেরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জাতিসংঘ পাকিস্তানের মিথ্যার কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । আর ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করে । তবুও ভারত তার সীমান্তে জাতিসংঘের তদন্তকারী দলের উপস্থিতিকে অনুমোদন দিবে ,যা বোঝা খুব একটা কঠিন নয় ।
জাতিসংঘ বাংলাদেশের একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারতো যদি বৃহত্তর শক্তিগুলোর সন্দেহজনক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের চেয়ে বিবেচনা দিয়ে সক্রিয় হতো ।এটা গভীর পরিতাপের বিষয় যে , উ সান্টের অদূরদর্শী উপদেষ্টারা পাকিস্তানি ফ্যাসিস্ট জান্তার অশুভ উদ্দেশ্যকে সাহায্য করছে এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ । এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে একটি পুতুল সরকার বসিয়ে পাকিস্তানি উপনিবেশ ধরে রাখতে সাহায্য করছে ।
বাংলাদেশের জনগন এবং সরকার জাতিসংঘের এই সর্বশেষ পদক্ষেপকে শুধুমাত্র বেআইনী হিসেবেই নয়, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর ক্ষমার অযোগ্য হস্তক্ষেপ এবং স্থুল অবমাননা হিসাবে বিবেচনা করছে ।এই দল তাই গুরুত্বপুর্ন পরিনিতির ব্যাপারে সতর্ক ছিলো ।এই তথাকথিত পর্যবেক্ষকরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শত্রুদের ই বেশি আমলে নিবে ।বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাদের অবিশ্বাসী সহযোগির সাথে যে আচরণ করতে হয় ঠিক তাই করবে ।কিন্তু জাতিসংঘকে যে ভূমিকা পালন করতে বলা হয়েছে তা করার খুব একটা প্রয়োজনীয়তা নেই ।