শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৯১। পূর্ব পাকিস্তানের বীভৎস অবস্থা সব আশা ধ্বংস করেছে | নিউইয়র্ক টাইমস | ১১ অক্টোবর, ১৯৭১ |
<১৪, ৯১, ২১৯–২২৩>
নিউইয়র্ক টাইমস, ১১ অক্টোবর, ১৯৭১
ভীতি এবং হতাশায় নিমজ্জিত পূর্ব পাকিস্তানের আশার আলো
ম্যালকম এম. ব্রাউনি
ঢাকা, ১০ অক্টোবর – পূর্ব পাকিস্তানের জনজীবনে আতঙ্ক স্থায়ী রূপ ধারণের সকল সংকেতই দেখাচ্ছে, এবং সবাই না হলেও বেশির ভাগ ভিনদেশী নাগরিকগণ যারা তাদের সাহায্য করার আশায় এখানে এসেছেন তারাও প্রায় হতাশাগ্রস্ত।
বিশেষ করে ভারতের অবস্থানরত লাখ লাখ নিঃস্ব শরনার্থীর স্রোত পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা বেশ দূরবর্তী বলেই মনে হচ্ছে। বেশির ভাগ সরকার এই শরনার্থী সমস্যাকেই এই উপমহাদেশে বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
ভারত দাবী করেছে , ২৫শে মার্চ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিচ্ছিন্নতাকামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে বিদ্যমান সামরিক আতংকের কারণে তার সীমান্ত জুড়ে প্রায় নয় লক্ষ শরনার্থীর স্রোত নেমেছে। ভারতীয়দের মতে এই জনস্রোত ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং এর কারণে হয়তো রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
নয়া দিল্লি সরকার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে শরনার্থী সমস্যার জের ধরে শেষ চেষ্টা হিসাবে তারা বলপ্রয়োগে শরণার্থীদের, যাদের সংখ্যাকে পাকিস্তান ভারতীয় সংখ্যার একতৃতীয়াংশ বলে দাবি করেছে, বল প্রয়োগে ভারত ত্যাগে বাধ্য করে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারে। পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য ত্বরিত গতিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে ব্যাপক সৈন্য সমাগমের খবর এখানে এবং ভারতে প্রচারিত হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ এই বিষয়ে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাজ করছে জনদুর্ভোগ কমানো যায় এবং বিশেষত যাতে একটি যুদ্ধ প্রতিহত করা যায়।
ডজনখানেক সরকার তাদের বিশেষজ্ঞ , টেকনিশিয়ান এবং কুটনৈতিকদের নিয়ে পূর্ব –পাকিস্তানের ওপর কাজ করছে। ত্রানকার্য পরিচালনার জন্য কেবল জাতিসংঘেরই ৭৫ জন কর্মকর্তা এখানে আছেন।
শরনার্থীদের পুনরায় দেশে পুনর্বাসনের কৌশল নিয়ে শতাধিক বিদেশী কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুটা মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে সকলে একটি বিষয়ে একমত যে, পূর্ব-পাকিস্তানকে তার এই সীমাহীন দুর্ভোগ এবং ভীতিকর পরিস্থিতি হতে অবশ্যই উত্তরণ ঘটাতে হবে।
এর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ইসলামাবাদে পূর্ব-পাকিস্তানে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আনতে পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। সেসবের মধ্যে অন্যতম –
হাজার হাজার রাজনৈতিক সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এবং লাখ লাখ অমুসলিম জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পুলিশ এবং সামরিক আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।
ঢাকায় একটি যৌক্তিক ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যারা ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের ওপর পূর্ব-পাকিস্তানের আস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সম্ভব হবে।
বিশেষ করে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালী জনগোষ্ঠী বন্যা, সাইক্লোন এবং যুদ্ধের কারণে গত বছর সামগ্রিকভাবে দৃশ্যত যে সমস্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেটি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় সরকারের আরও অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।
এখানে কর্মরত অধিকাংশ বিদেশী কর্মকর্তারা এ বিষয়ে একমত যে এইসব বিষয়ে বাস্তবিকপক্ষে কোন উন্নতিই হয়নি।
বাঙ্গালীদের সাথে গোপনে আলাপে জানা গেছে যে দখলদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যারা অংশ নিয়েছে তাদের বেশির ভাগই পশ্চিম-পাকিস্তানি এবং তাদেরকে সিংহভাগ জনগণ ঘৃণা করে।
বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত একটি প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে ৫৬৩ জন নারীকে সেনাবাহিনী মার্চ এবং এপ্রিল মাসে অপহরণ করে এবং সামরিক বাহিনীর পতিতালয়ে তাদের রাখা হয়। কিন্তু তারা প্রত্যেকে গর্ভবতী হওয়ায় এবং গর্ভধারণের এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় যখন আর গর্ভপাত সম্ভব নয়, তাদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না।
সরকারের একজন মুখপাত্র এই ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করেন এবং যে স্থানে মহিলাদের রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে সে স্থানের নাম প্রকাশ করতে অভিযোগকারীদের চ্যালেঞ্জ জানান। অপরদিকে জানা গেছে অনেক বাংগালী প্রসূতিবিদ এরকম অনেক মেয়ের গর্ভপাত করিয়েছেন যারা পাক হানাদার বাহিনী দ্বারা অপহৃত হয়েছিল এবং তাদের পরে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তিপ্রাপ্ত- দুইজন নাকি তিনজন
উক্ত সংবাদ প্রতিনিধিকে একটি গোপন বৈঠকে একজন কৃষক এমন একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানায়। সামরিক নজরদারি এড়াতে বৈঠকটি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে অনুষ্ঠিত হয়। গভীর অস্বস্তির সাথে, পুলিশের ফাঁদে তাকে ফেলা হয়েছে কিনা এই ভয়ে চারদিকে বারবার তাকাতে তাকাতে কৃষকটি জানায়,
“সেনাবাহিনী ১১ এপ্রিল রাতে গ্রামে প্রবেশ করে। একটা টহল দল আমাকে আমার বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে যায় কিছু একটা সনাক্তকরণের জন্য, কিন্তু যখন আমি ঘরে ফিরে আসি, তখন দেখলাম যে আমার বোন নিখোঁজ। আমার প্রতিবেশীর কন্য্, অন্য আরেকজন মেয়েও নিখোঁজ ছিল, এবং সেখানে অন্য একটি হিন্দু পরিবারও ছিল যাদের মেয়েও নিখোঁজ হয়”।
“ মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা আমার বোন এবং প্রতিবেশীর কন্যাকে মুক্ত করে দেয় কিন্তু সেই হিন্দু মেয়েটি আর ফিরে আসেনি। যে দুজন মেয়ে ফিরে এসেছে তারা গর্ভবতী ছিল এবং তাদের সন্তান প্রসব হবে। যে খোলা জায়গায় তাদের রাখা হয়েছিল যেখানে সর্বমোট ২০০ বা ৩০০ মেয়ে ছিল তাদের প্রত্যেকেরই একই পরিণতি হয়েছিল। তারা কাপড় ধোয়ার কাজ করতো এবং দিনে দুই থেকে তিনবার সৈন্যদের মনোরঞ্জন করতে হত”।
কৃষকটি আরো জানায় যে –“ আমার বোনকে কোথায় রাখা হয়েছে সে জানতো না”।
ভিনদেশী নাগরিকরা এবং ঢাকা নিবাসী অনেকে জানিয়েছে যে, তারা স্বচক্ষে দেখেছেন , কোনরকম সনাক্তকরণ ছাড়াই হানাদার বাহিনীর পুলিশেরা যুবতী মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে।
অন্যন্য লোকজনকে গণহারে নির্বিচারে গ্রেফতার করা হচ্ছে যদিও গত মাসে রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করেছেন রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য। পাকিস্তানে রাজনৈতিক আস্রয় প্রত্যাশী বিদেশী কূটনৈতিকগণ তার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। যেসব কূটনৈতিকগণ এখন বলছেন সর্বসাধারনের জন্য যে সাধারণক্ষমা তা নিতান্তই লোকদেখানো, তারা আরও জানিয়েছেন, সরকার শুধু গুরুত্বপূর্ণ বন্দীদের মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়নি কেবল, বরং রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, আইনজীবীসহ আরো অনেকের গ্রেফতার প্রক্রিয়া জারী রেখেছে।
একাধিক প্রতিবেদন এবং বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজক্ষমার আওতায় থাকার পরেও অনেককে গ্রেফতারের পর হত্যা করা হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজবন্দী
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজবন্দী, যিনি বিশ্বস্বীকৃত পূর্ব- বাংলার শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা, তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের আওামী লীগ গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন এবং তাঁরই সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা।
বেশীরভাগ কুটনৈতিক এবং বিদেশীদের মতে , যদি শেখ মুজিবের হাতে পূর্ব-পাকিস্তানের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় যার জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছেন তাহলেই পূর্ব-পাকিস্তানের সমস্যাসমূহের জন্য স্থায়ী সমাধানে আসা সম্ভব। কিন্তু তিনি রাজবন্দী অবস্থায় সামরিক বিচারাধীন আছেন যেখানে হয়তো তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
তাঁর পরিবারবর্গ যাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ কার্যক্রমের অভিযোগ নেই তাদেরকেও এখানে একরকম অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
এই ধরনের রাজনৈতিক দমন-নীপিড়ন শুধু আওামী লীগের উপরই কেবল না, অন্যান্য রাজনীতিবিদ বা দল যারা সামরিক জান্তার জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে তাদের উপরও বিস্তার করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে অবসরপ্রাপ্ত একজন বিমান বাহিনীর প্রধান কর্তৃক এটি নাটকীয়ভাবে সবার সামনে এসেছে যে তিনি সরকারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হবার উদ্দেশ্য বিষয়ক ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রতিনিধি হবার জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন।
অফিসারটি হলেন আসগর খান নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল, যিনি পাকিস্তানের একজন দেশ প্রেমিক এবং রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৫ সালে ভারত- পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত কিন্তু রক্তাক্ত যুদ্ধের সময় তিনি বিমান বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন এবং তিনি সবসময় অবিভক্ত পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন।
কর্মসূচি রদ
জনাব আসগর খান , যিনি পশ্চিম-পাকিস্তানি এবং ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আইয়ূব খান সরকারের প্রায় পতনের পেছনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক উন্নয়ন এবং এর জনগণের প্রকৃত রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য একটি শান্তি প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন, কিন্তু তার এই প্রস্তাবনা পুরোপুরিভাবে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার তিনি ঘোষণা দিয়েছেন কোন প্রার্থীর পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব না যদি না তিনি গণমাধ্যমের সহায়তা নিয়ে সর্বসাধারনের কাছে পৌঁছাতে পারেন , তাই তিনি তার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
“আজ পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য একটি কালো দিবস”- তিনি বলেন। “যখন এমনকি আমাকেও একটি সামান্য কর্মসূচীর জন্য মার্শাল ল ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।”।
যখন সামরিক বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তান দখল করে এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে, তখনই নির্বাচন প্রকৃতপক্ষে অকার্যকর হয়ে যায়। কয়েকজন নির্বাচিত সাংসদ সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সংসদসদস্য পদ ধারণ করেন কিন্তু বেশির ভাগই ভারতে পালিয়ে যান বা গেরিলা যুদ্ধে যোগদান করেন।
জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ঘোষনা দেন যে শুন্য আসনসমূহের জন্য পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকার যোগ্য দল এবং প্রার্থীদের অনুমোদন দিয়েছে যাদের বেশীরভাগ ডানপন্থী এবং মৌলবাদী। পূর্ব –পাকিস্তানে ইতোমধ্যে মুসলমানরা এবং সৈন্যসহ সজ্জিত নানা দল বক্তৃতা প্রদান শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রিত প্রেস রিপোর্টে এটাও বলা হয় যে তারা দুষ্কৃতিকারী এবং ভারতীয় এজেন্টদের ধ্বংস করার জন্য তাদের বক্তৃতায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, এই শব্দগুলো সরকার সাধারণত বাঙ্গালী গেরিলা যোদ্ধাদের বোঝাতে ব্যবহার করে থাকে।
গেরিলারা স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যদের হত্যা করছে, যে কমিটিগুলো মূলত অবাঙ্গালীদের সমন্বয়ে গঠিত এবং যাদের দখলকৃত এলাকার সামরিক প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় রিপোর্টে বলা হয়েছে যে যখন হানাদার বাহিনী কিংবা শান্তিবাহিনীরা আক্রমণের শিকার হয়েছে, সেনাবাহিনী এর প্রতিশোধ হিসাবে সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে, এবং স্থানীয় রিপোর্টে বেশির ভাগ সময় ব্যাপক প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বেশীরভাগ বিদেশী পর্যবেক্ষক এই অভিমত দেন যে, শরনার্থী সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যা সমূহহের কোন সমাধানে আসা যাচ্ছে না এরপরেও প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য এখানে দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে এই সম্ভাবনা খুবই কম যে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘু যারা মার্চ এর ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ হবে, তারা আদৌ ফিরে আসবে।
হানাদার বাহিনীর মূল লক্ষ্য মূলত হিন্দুরা। সেনাদের জ্বালিয়ে দেওয়া হিন্দু পাড়া এবং দোকানপাট গুলো জনশুন্য অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের মন্দিরগুলোও বিধ্বস্ত হয়েছে।
সরকার এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যে, হিন্দুত্বকে আর বেশীদিন পূর্ব-পাকিস্তানে সহ্য করা হবে না। এবং এই সিদ্ধান্তকে আরও পাকাপোক্ত করতে ডঃ এ এম মালিক তার অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রীসভায় কোন হিন্দুকে নিয়োগ প্রদান করেননি।
কেন্দ্রও পরিদর্শন করেননি।
একজন বিদেশী ত্রাণ কর্মী সরকারের সাধারণ ক্ষমার ব্যার্থতার বিষয়ে বলেন যে , “আমরা সরকারের প্রায় ৬০ টির মত উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে আর আগ্রহী নই। এটা স্পষ্ট যে তারা কিছু কিছু এলাকায় অত্যন্ত অল্প সংখ্যায় ফিরে আসছে”।
তিনি আরো যুক্ত করেন “ এক জায়গায় আমরা আবিষ্কার করলাম , উদ্ববাস্তদের মধ্যে সরকারের লোক আছে যারা কি ঘটছে সে সম্পর্কে জানতে যখনি কোন পরিদর্শক আসেন তারা সামনে এসে বাধা প্রদান করে”।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, সামরিক কর্তৃপক্ষ হয়তো আপনাকে বলবে যে ক্যাম্পে ২০০০ উদ্বাস্তু আছে, তারপর আপনি ক্যাম্পে গেলেন এবং দেখা যাবে যে প্রকৃতপক্ষে সে সংখ্যা হয়তো এতোই নগণ্য যে, যদি কর্তৃপক্ষকে উপর্যুপরি প্রশ্ন করা হয় তবে এক পর্যায়ে তারা স্বীকার করবে যে এই সংখ্যা ২০০ এর বেশি নয়।
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সার্বজনীন অভিযোগ যে তারা সকল ট্রাক, মোটরগাড়ি , মোটর–লঞ্চ এবং নৌকা দখল করে নিয়েছে যেগুলো খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিদেশী ত্রাণসামগ্রী পরিবহনের যানবাহন না আনা হচ্ছে।
দোষ চাপানো হলো ভারতের উপর
সরকার দাবী করেছে যে সব অথবা বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান হবে যদি ভারতীয়রা পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে আর উস্কানি না দেয় এবং অস্ত্র এবং সৈন্যের অনুপ্রবেশ বন্ধ করে।
পাকিস্তান দাবী করেছে যে, ভারতের যুদ্ধের মনোভাব এই আচরণেই স্পষ্ট যে তারা জাতিসংঘকে পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে একটি শান্তি রক্ষা বাহিনী স্থাপন করতে দিতে আগ্রহী নয় যে বাহিনির মাধ্যমে শরনার্থীরা তাদের ইচ্ছানুযায়ি ভ্রমণ করতে পারে। দুটো দেশ এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
বিদেশী পর্যবেক্ষকগণের মধ্যে বিরাজমান হতাশা অত্যন্ত ভীতিকর।
একজন ত্রাণকার্য্য পরিচালনা বিষেশজ্ঞ অভিমত দেন যে, “পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আসলে কোনভাবেই কারো পক্ষে যে কোন পরিমাণ অর্থ দিয়েই কিছু করা সম্ভব নয়।“ “এই উপমহাদেশের জনসংখ্যা প্রতি প্রজন্মেই দ্বিগুণ হচ্ছে এবং এই পরিস্থিতি দিনদিন খারাপই হবে।“
“এটা আমার একান্ত অনুভূতি”- তিনি আরো যোগ করলেন “আমি জানি আমাদের অনেকেই এমন ভাবেন যে বহির্বিশ্বের এখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া উচিত এবং এখানকার সবকিছুকে তার অনিবার্য পথেই চলতে দেওয়া উচিত”।