“ফিনান্সিয়াল টাইমের মুল শিরোনাম ছিল “বাঙালি গেরিলারা চাপ প্রয়োগ করছে।“।
করাচি থেকে এদের প্রতিনিধিদের পাঠানো কাগজপত্রের ভিত্তিতে এই সংবাদপত্র লিখেছে, “ মুক্তিবাহিনী গেরিলারা সামরিক প্রশাসনের উপর চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত রাখছে…… সামরিক শাসনতন্ত্রের গেরিলাদের তাদের কার্যাবলির বৃদ্ধি রোধ করার জন্য বিগত কয়েক সপ্তাহে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত অন্তর্ঘাতী কার্যাবলির তীব্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে এবং কঠিন করা হচ্ছে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, “ গেরিলাদের বেছে নেয়া লক্ষ্যের মধ্যে শিল্প স্থাপনা, যোগাযোগ ব্যহত করা এবং সরকারের সাথে সহায়তা করা শান্তি কমিটির সদস্যদের গুলি করে হত্যা করা এই উদ্দেশ্যে যে, চারিদিকে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং এই মাত্রা পর্যন্ত নাগরিক জীবন ও প্রশাসনকে অচল করে দেয়া যাতে তারা স্বাভাবিক পরিস্থিতে ফেরার আশা পরিত্যাগ করে।
নভেম্বর ২২ এ ব্রিটেন এর স্কটসম্যান পত্রিকার শিরোনাম ছিল, “ রাজাকারেরা বাংলাদেশী শক্তিকে সহায়তা করছে”। এখানে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজাকারেরা পুর্বের মত বর্তমানে সেই গোষ্ঠী নয়। তারা অন্ততপক্ষে গেরিলাদের কিছু অংশের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে। সুত্রমতে, সম্প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়োগ দেয়া রাজাকারেরা গেরিলাদের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে গুরুত্ত্বপুর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে। রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমনের পরিকল্পনার পুর্বেই স্থান ত্যাগ অথবা প্রতিরক্ষামুলক অবস্থান নেয়ার জন্য খবর প্রদান করছে। এখানে আরও উল্লেখ করা হয় যে, মুক্তিবাহিনীর সাম্প্রতিক অনেক সাফল্যের পেছনে রাজাকারদের প্রাথমিকভাবে দেয়া তথ্যের ভুমিকা রয়েছে। রাযাকারেরা মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরক্ষামুলক সুরক্ষাও প্রদান করছে।
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ব্রিটেনের সমস্ত অংশে এবং অন্যান্য জায়গায় বাঙালিরা বাংলাদেশ সরকারকে ভারত কর্তৃক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। ইয়ান রোডী, ডেইলি এক্সপ্রেসের বিশেষ সংবাদদাতা, প্রথম পৃষ্ঠার বিশেষ সংবাদে বলেন যে, সুদিঘের বিষণ্ণ ও নিশ্চুপ গ্রামবাসীরা আনন্দে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত।
জন পিলগার, ডেইলি মিরর যার এক দিনে প্রায় পনের কোটি কপি প্রকাশিত হয় তার প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক ছিলেন প্রথম একজন আগন্তুক যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ১৯৬৭ এর ইসরায়েল এর ছয় দিন ব্যাপী যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় এবং কর্মক্ষম একটি সফল ঘটনা। একজন বাংলাদেশী বৃদ্ধ পিলগারকে বলেন যে, “ আমার বন্ধু, তুমি দেরি করে ফেলেছ। তারা আমাদের অনেক নারী এবং মেয়েদের এবং অনেক তরুনকেও মেরে ফেলেছে। কিন্তু তবুও আমরা আনন্দিত যে আমরা জয় বাংলা পেয়েছি”।
এখানে এবং পশ্চিমের বিভিন্ন অংশে যে প্রতিক্রিয়া পুর্ব বাংলার বিভিন্ন অংশে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনার কারণে সৃষ্টি হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয় যে, এটিকে যুদ্ধের কার্যক্রমের প্রচেষ্টার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। দ্য টাইমস অফ লন্ডনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবসম্মত নীতিমালা অনুসরণ করার জন্য এবং এই পরিক্ষায় শক্তি প্রদর্শনের জন্য ভারতকে দোষারোপ করা ভুল হবে। দীর্ঘ ৮ মাস যাবত পাকিস্তানী সরকার পুর্ব অংশের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখানে আরও বলা হয়েছে যে, তারা এখন নিজেদেরকে বিনা উস্কানিমূলক আক্রমনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক সাহায্য নিজেদের দিকে আনতে পারার আশা করতে পারে না। এবং ইন্ডিয়া যদি হিসেব করে দেখে যে তাদের নেয়া সত্ত্বর পদক্ষেপের কারণে মানব দুর্দশা কমে আসবে, তবে তাদেরকে কেউ ঢালাওভাবে ভুল বিবেচনার দোষ সহজে দিতে পারবে না। টাইমস অফ লন্ডন একই অনুচ্ছেদে বলেছে যে, যাইহোক, সেই মুহুর্তের জন্য পাকিস্তান সরকার তীব্রভাবে তার আরোপের প্রাপ্তি স্বীকারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
অপরপক্ষে, পশ্চিম জার্মান এবং ফ্রান্সের পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত মন্তব্য সাধারনত একই সংবাদের প্রতি ইঙ্গিত করে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য লক্ষ্য ছিল ইন্ডিয়াকে রণকৌশলে হারানোর জন্য বাঙালিদের সাথে নিয়ে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু টা ব্যর্থ হয়েছে।