১৬ সেপ্টেম্বার, ১৯৭১
ইরানের সাথে গোপন আঁতাত
.
ইয়াহিয়ার তড়িঘড়ি করে তেহরান সফর কোন বিস্ময় ছিল না। বাংলাদেশে দ্রুত এগিয়ে আসা সামরিক পরাজয়ের জন্য, তিনি অন্য পথ খুজছেন। তিনি এখনই জয়ের আশা ছেড়ে দিতে চান না। তার সামরিক অবস্থান যতই হাস্যকর হোক না কেন, তিনি অনিষ্টকর ধারণা উপস্থাপন শুরু করলেন।
শাহ্ র ভবন হতে আসা যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রথমবার ইরানী সম্রাট পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান জানান। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে ইয়াহিয়ার এজেন্টরা (ভুট্টো সহ) তাদের অপরাধের পক্ষে আনতে ব্যর্থ হওয়ার পর ইয়াহিয়াকে House of Pahalvis এ যেতে হয়েছে। কিন্ত এর পরও ইয়াহিয়া যা চেয়েছিল তা পায় নি। শাহ্ বাংলাদেশের ব্যাপারে তার আগের অবস্থানে অনড় থাকে, কোন যোগাযোগ করেননি। যৌথ বিবৃতিতে এটা বলা হই নি যে, ইরানের বিবেচনায়, বাংলাদেশ ইস্যু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার ।
কিন্তু অন্য দিক থেকে ইয়াহিয়ার অর্জন উল্লেখ করার মত। জাতিসংঘের শরনার্থী হাই কমিশনার প্রিন্স সাদ্রুদ্দিন আগা খানের সময় থেকে প্রথমবারের মত ইয়াহিয়া এই যুদ্ধ নিয়ে তার নিজের আইডিয়া বেচতে পারল। কোন কারণ ছাড়াই তিনি জোর দিয়ে বলছিলেন বাংলাদেশের মানুষ ও তার জান্তার মধ্যে এই যুদ্ধ আসলে ইন্দো-পাকিস্তান দ্বন্ধ। আমরা বিস্মিত যে শাহ তার এই বড়ি গিলেছেন এবং তার সরকারের ভাল দপ্তরগুলোকে ভারত এবং পাকিস্তানের সংঘাত নিরসনের জন্য প্রস্তাব করেছেন।
নতুন দিল্লী এই সন্দেহজনক কাজেও ঠান্ডা থাকল। এমনকি ভারত পাকিস্তানি খেলায় এই ইরানি চালে বিস্মিত হয় নি।
১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার যুদ্ধের সময় যুদ্ধে অংশ না নেয়া দেশ হিসেবে ইরান সব ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়ম লংঘন করে। তারা পাকিস্তানি বিমান বাহিনীকে প্লেন, প্লেনের জ্বালানী এবং প্রচুর অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার সময় তারা পাকিস্তানের বোয়িংকে আশ্রয় দেয়। অতি তড়িঘড়ি করতে যেয়ে ইয়াহিয়া ভুলে গিয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধে এরুপ রেকর্ডধারীকে মধ্যস্তাকারী হিসেবে ভারতের কাছে গ্রহনযোগ্যতা খুবই সামান্য।
ইয়াহিয়ার তেহরান সফর এবং ইন্দো-পাকিস্তান সম্পর্ককে “স্বাভাবিক” করতে চাওয়া ছিল ইয়াহিয়ার একটি পাবলিসিটি চমক, তাহলে তার আসল পদক্ষেপ কি ছিল? ইয়াহিয়া কি বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছে যে তিনি ভারতের শান্তি স্থাপনে উদগ্রীব, কিন্তু দরজার পেছন দিয়ে ভারতকে আকস্মিক হামলা করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আসন্ন পরাজয় এড়াতে চায়? এগুলোই ইয়াহিয়ার সাথে মানায়। শুধুমাত্র ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধিয়েই বাংলাদেশের সাথে দ্বন্ধে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের আশা করা যায়। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ তার পক্ষেই যাবে এবং এভাবেই আসন্ন ভয়ংকর পরাজয় তিনি এড়াতে পারেন। এটাই যদি তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হয় তাহলে ইরানের শাহ পাকিস্তানি কোলাবোরেটরের ভুমিকায় নেমে ভয়ংকর খেলা খেলছেন যা দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় আন্তর্জাতিক উত্তাপের সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক শক্তিরা, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্যই পাকিস্তান ইরানের এই ভয়ংকর পদক্ষেপ সম্পর্কে সচেতন। গতকাল মস্কোয় সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পডগর্নির বাংলাদেশ সমস্যার আশু সমাধান চাওয়া সম্ভবত পাক-ইরানিয়ান পরিকল্পনার প্রতি হুশিয়ারি।
প্রেসিডেন্ট পডগর্নির ভাষণ নিশ্চিতভাবেই ইয়াহিয়া ও তার মিত্রদের সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। পর্দার আড়ালের বড় ভিলেন যিনি সেই পঞ্চাশের দশক থেকে সতর্কতার সাথে পাকিস্তান ধ্বংসের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি হলেন এম এম আহমদ। তিনি ইয়াহিয়া ও তার খুনি মিত্রদের বড় বন্ধুও। দৃশ্যপট থেকে তার সরে যাওয়া, ধারালো অস্ত্রের আঘাতের জন্য সাময়িক ভাবে হলেও, ইয়াহিয়াকে গাইডেন্স ক্রাইসিসে ফেলবে। মনে হয় ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পরবর্তী হুমকির ব্যাপারে ভুট্টোকে শান্ত করেছে। ইয়াহিয়ার এই ক্রাইসিসে ভুট্টো সুযোগ নিতে পারে। ভীতিকর শহর ইসলামাবাদের এলিটদের এলাকাগুলো সামনের কয়েকদিন ঘটনাবহুল হতে যাচ্ছে।