Indian Moslems Misled

২৪ ও ২৮ জুলাই,১৯৭১

ভারতীয় মুসলামানরা বিভ্রান্ত(?)

.

নির্ভুলভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে ভারতীয় মুসলমানদের একটা অংশ লক্ষাধিক দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশীদের প্রতি কোন সহানুভুতিবোধ করছে না। তারা বরং তাদের মাঝে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চর এবং চক্রান্তকারীদের মিথ্যাকেই বেশি বিশ্বাস করছে। আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, পাকিস্তানিরা এজেন্টরা গোপনে প্রকাশিত কিছু উর্দু লিফলেট ছড়াচ্ছে যেখানে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচার করা হয়েছে। এবং সবচেয়ে আশংকাজনক ব্যাপার হচ্ছে ভারতীয় উর্দু গনমাধ্যমগুলোর এক অংশে শুধু এসব লিফলেটই প্রকাশ করা হচ্ছিল না বরং কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন সম্পাদক অত্যুৎসাহী হয়ে ইয়াহিয়ার গনহত্যার যুদ্ধ শুরুর আগে দিয়ে মার্চ মাসে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের হাতে উর্দুভাষী শরনার্থীদের নির্বিচারে হত্যার কাল্পনিক গালগল্পও ছাপা হচ্ছিল। এগুলোতে দাবি করা হচ্ছিল ১লা মার্চ থেকে শেখ মুজিবর রহমানের শুরু করা অহিংস আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা চট্রগ্রাম খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় লাখ লাখ বিহারি শরনার্থীদের হত্যা করা হয়েছে। তারা আরো দাবি করছিল ইয়াহিয়া বাঙ্গালিদের উপর পালটা গনহত্যা শুরু না করলে সম্পুর্ণ উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হত।

বাংলাদেশে গণহত্যার পক্ষে ইয়াহিয়ার কি চমৎকার কৈফিয়ত আর এটা সামরিক জান্তার দাবির সাথে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় যেখানে তাদের আগের একই ধরনের দাবিগুলো দুনিয়াকে ধোঁকা দিতে ব্যার্থ হয়েছে। এই রিপোর্টগুলোতে এত নিখুঁতভাবে সত্যকে বিকৃত করা হয়েছে যে তার পালটা জবাব দেয়াটাও বিব্রতকর। কিন্তু জবাব দিতেই হবে।

বঙ্গবন্ধুর ডাকা শান্তিপুর্ণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ২৫ দিনেও বাংলাদেশের কোথাও কোন অবাঙ্গালী হত্যার খবর পাওয়া যায়নি। শুধু কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি, যারা ঢাকা থেকে বিপুল পরিমানে অর্থসম্পদ এবং সোনাদানা নিয়ে পালাচ্ছিল তাদেরকে কিছু স্বেচ্ছাসেবী ছাত্ররা আটকে দিয়েছিল। যদিও সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে হত্যা জখম করে প্ররোচিত করার চেষ্টা করছিল তবু পশ্চিম পাকিস্তানি হত্যার কোন ঘটনাই ঘটেনি। থমথমে পরিস্তিতি দেখে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ছাত্রদেরকে পিছিয়ে আসতে বলেছিলেন।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অবাঙ্গালী শরনার্থীদের একটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি গোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়েছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যেয়ে। এই অংশটিই ২৫ মার্চে লেলিয়ে দেয়া ইয়াহিয়ার খুনী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিল। সেনাবাহিনী প্রথমে এদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষন দেয়। তারপর তাদের পূর্ণ সামরিক নিরাপত্তা দেয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চিটাগং, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন যায়গায় বাঙ্গালী বিরোধী দাঙ্গা বাধানোর জন্য। শতশত নিরীহ বাঙ্গালিদের হত্যা করে তাদের ঘরবাড়ি সহায় সম্পত্তি লুটপাট করা হয়েছিল। এমনকি নারী ও শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ স্মরন করিয়ে দেয় ২০-২৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততাকে। তবুও বাঙ্গালীরা সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখিয়েছিল। প্রচন্ড আবেগতাড়িত হয়েও মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারেরা মুক্তাঞ্চলগুলোর উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুক্তিবাহিনী কৌশল্গত পশ্চাদপসরণ করলে সেই একই জনগোষ্ঠীর অংশবিশেষ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিল।

এখন পর্যন্ত আমি বলে আসছি অবাঙ্গালীদের একটি অংশ। এটা আমি বলে আসছি শুধু বোঝানোর জন্য যে অবাঙ্গালীদের আরেকটি অংশ ছিল যারা শেখ মুজিবের আশ্বাসে বিশ্বাস করত যে তারা বাঙ্গালিদের সাথেই সমান অধিকার পাবে। এটা সাহায্য করেছিল তাদেরকে যেখানে তারা স্থায়ীভাবে থাকতে চায় সেখানকার মানুষের মাঝে পরিচয় লাভ করতে। সাম্রাজ্যবাদী পাকসেনাবাহিনী যারা তাদের সাবেক প্রভুদের কাছ থেকে জনগণের এক অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার কৌশল শিখেছে , তাদের প্রলোভন সত্ত্বেও।

ভারতীয় মুসলমানদের এক অংশের স্মৃতিকাতর অনুরাগ ছিল পাকিস্তানের প্রতি  যে রাষ্ট্রের জন্য চল্লিশের দশকে আমরা সবাই অনেক কষ্ট করেছি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য উন্নততর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভূমি হয়ে উঠবে এই আশায়। কিন্তু এই আশা মিলিয়ে যেতে কোন সময়ই লাগেনি। এক অশুভ গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে বসে এবং নিজেদের স্বার্থে জনগনকে নির্মমভাবে শোষন করা শুরু করে। সহসাই বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারল শোষকদের সাথে শুধু ধর্মের মিল থাকলেই কোন লাভ হয়না বরং তা বাঁধা হয়েই দাঁড়ায়। কারন শোষনের যেকোন রকম বিরোধীতাকে এই গোষ্ঠী ইসলাম ও একতার নামে আক্রমন করছে। আর যখন মানুষ এইসব ছলনায় প্রতারিত ও নিগৃহীত হচ্ছে না তখনই এরা ঠান্ডা মাথায় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠছে।

কিভাবে কোন সুস্থ বুদ্ধির মানুষ এদের পক্ষ নিতে পারে?এমনকি যারা এদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে তারাও বুঝতে পারছে না তাদেরকে কেবল মাত্র ব্যাবহার করা হচ্ছে । পাকিস্তানি জান্তা তাদের প্রকৃত রুপ গোপন করতে বর্তমান সমস্যাকে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ হিসেবে তুলে ধরছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে. হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল যে, তাহলে এই মুসলমানরা কিভাবে লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা করেছিল? তাহলে কেমন করে এই ভারতীয় মুসলিমরা সহকর্মী ধর্মবাদীদের এই হত্যাযজ্ঞের “জিহাদের” এমনকি একটি পাকিস্তান-কল্পনানুসারে ইসলামী রাষ্ট্র রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিতে পারে।

ভারতীয় মুসলিমরা ঐ চিনি-লেপা রক্ত ​​জমাট বেঁধে পাকিস্তানি উপ-মানুষের দ্বারা বন্টিত হচ্ছে। তাদের একবার হলেও উপলব্ধি করতে হবে যে,তাদের স্বপ্নের পাকিস্তান রাষ্ট্র একবার নিরস্ত হয়েছিল।

তারা ভাগ্যবান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করে যেখানে তারা অবাধে শত্রু রাষ্ট্রের জন্য তাদের সমর্থন প্রদর্শন করতে পারেন মনে হবে. তারা যথার্থই পাকিস্তানের পঞ্চম স্তম্ভ এবং সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। তারা নিশ্চয়ই এই সুযোগের অপ বা খারাপ ব্যবহার যেটি প্রতিটা পাকিস্তানি করেছিল ১৯৪৭ সালে।

Scroll to Top