১৭ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের রক্তক্ষরণের মাঝে নিক্সনের পিকিংযাত্রা
.
থলির বিড়াল বেরিয়েই এল। চীনই চরম প্রাচ্য আর যুক্তরাষ্ট্র চরম পাশ্চাত্য নয় এরা মিলতেও পারে। এ মুহুর্তে পিকিঙের আমন্ত্রনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সফরের সিদ্ধান্ত আমাদের অনেকের উপলব্ধির চেয়ে বেশী তাতপর্যপুর্ন। বাংলাদেশের জনগণের উপর গণহত্যার এই যুদ্ধের আগে কে ভাবতে পেরেছিল এরকম মোলাকাত এ শতাব্দীত শেষের আগেই সম্ভব?
ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পিকিং রেডিওর তীব্র প্রচারনা এখনো কানে বেজে অবিশ্বাসে চোখ কচলাতে বাধ্য করে। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ ধাপ যাকে লেনিন সাম্রাজ্যবাদ বলে অভিহিত করেছেন তার সাথে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের বোঝাপড়া অসম্ভব বলে পিকিঙের নিজেদেরই প্রচার করা তত্বকে তারা এভাবে ভুল প্রমাণিত করে। এখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ডানপন্থী প্রেসিডেন্টকে পিকিং কর্তৃপক্কের আমন্ত্রন জানান থেকে বোঝা যায় পিকিঙ্গের নিও-সোস্যালিজম এবং যুক্তরাষ্ট্রে নির্দয় সাম্রাজ্যবাদের মাঝে শুধু সহাবস্থানই নয় বরং বেশ ঘনিষ্টতাও সম্ভব। এ বিষয়ে তেমন কোন সন্দেহই নেই যে চৌ এন লাইয়ের চীন সুযোগ পাওয়া মাত্রই জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই ঐক্যে তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চিয়াঙ্গের ফরমোসা। আর দীর্ঘমেয়াদে ভুক্তভোগী হবে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
ফরমোসার পরেই এই চীন-মার্কিন দাম্পত্য নিয়ে সবচেয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। যতই তথ্য-উপাত্ত আলোয় আসছিল ততই বোঝা যাচ্ছিল এযাবৎ অচিন্তীয় এই দাম্পত্য সংঘটনে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রেখেছে। দুপক্ষই শয্যাসঙ্গী হতে বেশ কয়েকমাস ধরে তৈরি ছিল কিন্তু তাদের মাঝে ২৩ বছরের বরফ গলাতে উভয় পক্ষের বিশ্বস্ত একটি তৃতীয় পক্ষ দরকার ছিল এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এক্ষেত্রে উপযুক্ত ছিল। ভারত সম্পর্কে অসুস্থ বিরক্তিকর ঘোর চীনকে পাকিস্তানের কাছাকাছি এনেছিল এবং বিশ্বাস করিয়েছিল যে পাকিস্তান তার বন্ধু এবং তাদের মধ্যে অনেক মিল আছে। অন্য দিকে গোড়া থেকেই পাকিস্তান আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে অনুচরের ভুমিকা পালন করে আসছিল এবং বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের সক্রিয় সহযোগী ছিল। সুয়েজ সংকটের সময় পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতার কথা কারোরই ভোলা উচিত না। পাকিস্তান দুই পক্ষের ঘটকালি করতে রাজি হয়েছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হত্যযজ্ঞের পরিকল্পনায় সমর্থনের বিনিময়ে। পাকিস্তানকে কথা দিয়েছিল যে তার অপরাধে কেউ হস্তক্ষেপ কর হবে না। বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর হত্যাযজ্ঞে ব্যাবহার হবে জেনেও চীন হাল্কা ও মাঝারি ধরনের অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিল। এমনকি বাংলাদেশের গ্রীষ্মপ্রধান ছোট শহরগুলোর উপযুক্ত করে ৩জনের ছোট ট্যাঙ্কও বানিয়েছিল । ঢাকা নারায়ণগঞ্জ, চট্রগ্রাম,খুলনা যশোর আর কুমিল্লাতে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে এই ট্যাঙ্কগুলোই ব্যাবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে নিক্সন প্রশাসন বিশেষত সিআইএ পাকিস্তানের গণহত্যার পরিকল্পনা আগে থেকেই জানত এরকমটাও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারন রয়েছে।
শুধুমাত্র পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রবল জনমতের জন্যেই হোয়াইট হাউস স্বীকার করতে দেরি করছিল যে তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করে যাচ্ছে স্টেট ডিপার্ট্মেন্টের বিপরীত সুপারিশ সত্ত্বেও। পাকিস্তান সারা যুক্তরাষ্ট্রে একটাও সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল বা রেডিও নেটওয়ার্ক খুঁজে পায়নি যেখানে সে বাংলাদেশের সাথে করা তার ঘৃণ্য অপরাধের সাফাই গাইবে। এটা লক্ষণীয় যে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানে অর্থ ও অস্ত্রসাহায্য অব্যাহত রাখার ঘোষনার পরেই শুধু নিক্সনের উপদেষ্টা কিসিঞ্জারকে পাকিস্তানে চীনা নেতাদের সাথে সাক্ষাতের গোপন সফরে আসতে দেয়া হয়েছিল। এটা একধরনের ব্ল্যাকমেইল ছিল যা সম্ভবত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিক্সনকে মেনে নিতে হয়েছিল। তিনি এমনিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত পদ্ধতি, মানে সবই করেও কিছুই স্বীকার না করার পথে হাটতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই নিরবতা সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীন ক্ষমতার লড়াইয়ে ইয়াহিয়া এবং তার খুনি সঙ্গীদের জন্য সঙ্কটপুর্ণ হয়ে ঊঠেছিল। কিন্তু জনসমক্ষে এই অপরাধের স্বীকারোক্তিতে নিক্সনের প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটরা রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে যায়।কিন্তু তিনি লাভের হিসাবও করে রেখেছিলেন। নিক্সন আশা করছিলেন চীনের সাথে স্থায়ী বন্ধুত্ব করা গেলে কোনরকম রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন না হারিয়েই ইন্দোচীন থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়া যাবে এবং তাতে ডেমোক্রেটদের ব্যার্থ করে দেয়ার ভাল সুযোগ থাকবে।
আর এভাবেই চীন আর আমেরিকা নিজেদের মধ্যে অভিসার শুরু করল দশ লক্ষ বাঙ্গালীর জীবন এবং ষাট লক্ষ বাঙ্গালীর ভারতে উদ্বাস্তু হওয়ার বিনিময়ে। সুবিধাবাদের রাজনীতিতে এমন আত্মকেন্দ্রিক পদক্ষেপ মানব ইতিহাসের কিছু কালো অধ্যায় রচনা করে যাবে। নিপীড়িত জনতার অধিকারের স্বঘোষিত রক্ষক চীন বৈশ্বিক রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে সুবিধা আদায়ের জন্য এই অপরাধগুলো মেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আটকানোর এই যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আরো বড় রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে চায়। চীন এখনো পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারেনি কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এখনই পরাশক্তি । ের প্রভাবকে ক্ষুন্ন করতে এটা খুব চতুর একটা চাল। এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তাতে চীনের রাশিয়ার মত রাজনৈতিক শক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কিন্তু আমাদের কি হবে? আমরা, বাংলাদেশের জনগণ কি এই চীন-মার্কিন বন্ধুত্বে বলি হয়ে যাব? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের ধারনা করছেন চীন-মার্কিন মধুচন্দ্রিমা দিনশেষে আমাদের জন্য ভালোই হবে। নতুন এই বোঝাপড়া ভারত সম্পর্কে চীনকে নমনীয় করে তুলবে। এছাড়াও দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া শেষেও তারা পাকিস্তানকে খুশি করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে এমনটা ভাবার কোন কারন নেই। বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান অর্থাৎ সম্পুর্ন স্বাধীনতা তরান্বিত হতে পারে শুধু যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো সক্রিয়ভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
আরো একটা প্রশ্ন বাকি থেকে যায়, ওয়াশিংটন কি সাম্যবাদের দিকে ঝুকছে নাকি পিকিং পুঁজিবাদের দিকে?