Not Separatism : A War of Liberation

১২ ও ২২ জুলাই, ১৯৭১

“বিচ্ছিন্নতাবাদ” নয়ঃ স্বাধীনতার যুদ্ধ

বাংলাদেশের জনগনের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিশ্বের একটি অংশ “বিচ্ছিন্নতাবাদ” বা “বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন” বলে উল্লেখ করছে। এটা নিঃসন্দেহে কানাডার ফরাসী ভাষী মানুষের বা বেলজিয়ামের ফ্লেমিশ ভাষী মানুষের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মত প্রভাব ফেলবে। এটা ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও একটা প্রতিচ্ছবি তৈরি করবে- কঙ্গোর কাতাঙ্গা বা ইদানিং কালের বায়াফ্রার মতন একটি ভবিষ্যৎ। সাধারণ মানুষের বাংলাদেশের আন্দোলনের খুঁটিনাটি বঝার সময় খুব কম, তাই তারা বুঝতে পারছে না যে এই আন্দোলনটি একেবারেই আলাদা।যদিও পাকিস্তানের শুরু করা গণহত্যার যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সহানুভূতি ছিল তবুও খুব কম পত্রিকাই, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রেরগুলো পার্থক্যগুলো তুলে ধরেছিল এবং বুঝিয়েছিল যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জয়ই অবশ্যাম্ভাবী, কাটাঙ্গা বা বিয়াফ্রার পরিনতি নয়।এই বিশাল অমিলের একটা অংশ আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে সংবাদদাতাদের নিজেদের অজ্ঞতার কারনে তৈরি। কিন্তু এটা বড় পরিমানে ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামকে হেয় করার প্রচেষ্টা- সেই সব শক্তির অপচেষ্টা যারা উপমহাদেশে একটা স্থির রাজনৈতিক অবস্থা সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল।

সম্ভবত এখন আবার বিশ্বের কাছে সম্ভাব্য সব দিক থেকে ব্যাখ্যা করার সময় এসেছে যে, একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম যেটার জন্য বাংলাদেশের মানুষ একটা বিদেশী সামরিক বাহিনীর হাতে প্রান দিচ্ছে, দুটির মধ্যে আমূল পার্থক্য রয়েছে। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল কারন উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতীয়তার মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা হিন্দুদের অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য এড়াতে চেয়েছিল। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে তারা পাকিস্তানের জন্য এই শর্তে রাজি হয় যে, নতুন সৃষ্ট প্রত্যেক প্রদেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্ব প্রদান করা হবে। ঐতিহাসিক লাহোর সমাধান একটা শিথিল যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ থেকে বোঝা যায় তৎকালীন মুসলিম লীগ এই বিশাল উপমহাদেশে একই ধর্মানুসারী দেড় মধ্যে নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মেনে নিয়েছিল। মুসলিম লীগ যে কারনে সংগ্রাম করছিল তা হল একটা নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা, যেখানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার যুক্তিসঙ্গত বণ্টনের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতীয়তার মধ্যে একটা দীর্ঘস্থায়ী ঐক্য অর্জিত হবে। বস্তত, নতুন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নিরভর করছিল মৌলিক প্রতিজ্ঞা অনুধাবনের উপর- যে প্রতিজ্ঞার ভিত্তি ছিল পারস্পারিক বিশ্বাস ও সম্মান- যে প্রতিজ্ঞা ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হয় তখন ছিল না।

দুশো বছরের কঠোর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির উচ্ছ্বাসের মধ্যে বিভক্ত বাংলার মুসলিমরা ক্ষমতা হস্তান্তরের আসল স্বরূপ বুঝে উঠতে পারে নি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তাদের হাতেই ক্ষমতা ছেড়েছিল যাদের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছিল। আমরা ক্ষমতার মসনদে পেয়েছি পুঁজিবাদী, আমলা আর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের এক দলকে যারা স্বাধীনতার আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা ও গণমানুষের বিপক্ষে ভূমিকা রাখছিল। ব্রিটিশ রাজদের তৈরি এই গনবিরোধীরা যারা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সেবা করে এসেছে তারা হঠাৎ করে নতুন রাষ্ট্রের, ধর্মের রাষ্ট্রর ও ধর্মের অখণ্ডতার রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। বলাই বাহুল্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের মনমতো ব্যাখ্যা নতুন রাষ্ট্রের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাদের দখল ধরে রাখতে সাহায্য করছিল। তাদের কোন ইচ্ছাই ছিলোনা এই ক্রিত্তিম ইউনিয়নের জন্য পরিশ্রম করার। আমি এই ইউনিয়নকে কৃত্তিম বলছি কারন শুধুমাত্র ধর্মের মিল আন্তর্জাতিক ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে না। কারন তাহলে এতগুলো আরব রাষ্ট্রের কিংবা একই ধর্মের পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মাঝে এত বড় দেয়ালের দরকার হত না। অর্থনোইতিক সম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমেই পাকিস্তান একটি সত্যিকারের গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে যাকে আম্লা,পুজিবাদী,সেনাশাসকের দল সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।

আর এভাবেই শুরু হয় ইতিহাসে পাশবিক ঔপনিবেশিক শোষনের এক হীন অধ্যায়। দুই এলাকার বিশাল দুরত্ব এই দলের বেশ কাজেই লাগে। তার উপর রাজনিতির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের নিঃস্পৃহতাও তাদের একটা বাড়তি সুবিধা হওয়া দেখা দেয়। বাঙ্গালীরা থামানোর জন্য আর্তচিতকার করে ওঠার আগ পর্যন্ত নির্লজ্জ শোষনকে টিকিয়ে রেখেছিল  ফ্যাসিস্ট দমন-পীড়ন। ফ্যাসিস্ট সামরিক জান্তার নেতৃত্বাধীন এই গোষ্ঠী জানত তাদের এই শোষন চিরকাল চলতে পারে না। একথা মাথায় রেখে সশস্ত্র বাহিনীতে তারা সবসময় খেয়াল রাখছিল যেন শতকরা দশ ভাগের বেশি যেন বাঙ্গালী না হয়। তারা ভেবেছিল এভাবেই তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস তাদের হতবাক করে দিয়েছিল। বাকি কাহিনী আমাদের অনেক পরিচিত। মানব ইতিহাসে সবচে কালো অধ্যায়ের অংশ এই কাহিনী। পাকিস্তান জন্ম থেকেই বিভক্ত এবং ক্ষমতা দখল করে বসে থাকা গোষ্ঠী কখনো চেষ্টাও করেনি বাঙ্গালির সাথে ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করার। বাঙ্গালির স্বাভাবিক ধৈর্যের জন্যেই এই অভিশপ্ত ইউনিয়ন ২৩ বছর টিকে ছিল। বাংলার মানুষ যে সাংস্কৃতিক,জাতিগত এবং ভাষার দিক দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য জাতিগুলার থেকে আলাদা এটা পাকিস্তানি জান্তার শুরু করা গণহত্যার এই যুদ্ধে পরিষ্কারভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে।

নিষ্পাপ নারী,পুরুষ এবং শিশুদের তারা নির্বিচারে হত্যা করেছিল। করেছিল বাঙ্গালী নারীদের ওপর ধর্ষনসহ এত অমানবিক এবং বর্বর নির্যাতন তারা চালিয়েছিল যে হিটলারের বর্নবাদী উন্মত্ততার সাথেই শুধু তার তুলনা করা যায়। উন্মত্ততা বা আত্মঅহমিকা যত বড়ই হোক না কেন নিজের জাতি বা বর্নের ওপর এধরনের বর্বরতা কখনোই দেখা যায়নি। বিচ্ছিন্নতাবাদ বা আলাদা হতে চাওয়া আসলে অন্তঃজাতিক প্রকৃতির। জাতির একাংশ অন্য অংশ থেকে আলাদা হতা চায় আঞ্চলিক স্বার্থের জন্য।কিন্তু যখনি কোন জাতি এরকমের কৃত্তিম ইউনিয়ন যে ইউনিয়ন আদতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের মত তা ভেঙ্গে বের হতে চায় তখন তা জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম হয়ে ওঠে। উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির লড়াই হয়ে ওঠে। মানুষের ইতিহাস এরকম অসংখ্য ঘটনায় পরিপুর্ন। যুক্তরাষ্ট্র,চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন সবাইকেই বিদেশী পরাশক্তির শাসন থেকে জাতীয় মুক্তির এমন অনিবর্তনীয় অবশ্যাম্ভাবী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আজ যদি সেই একি রাষ্ট্রগুলো বিরোধিতা করে বা নিরব দর্শকে পরিণত হয় তবে তা হবে তাদের একসময়ের লালিত লক্ষের সাথে বিশ্বাসঘতকতা যে লক্ষ্যের জন্য তারা লাখে লাখে জীবন বিসর্জন দিয়েছে।

কিন্তু যখনি কোন জাতি এরকমের কৃত্তিম ইউনিয়ন যে ইউনিয়ন আদতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের মত তা ভেঙ্গে বের হতে চায় তখন তা জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম হয়ে ওঠে। উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির লড়াই হয়ে ওঠে। মানুষের ইতিহাস এরকম অসংখ্য ঘটনায় পরিপুর্ন। যুক্তরাষ্ট্র,চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন সবাইকেই বিদেশী পরাশক্তির শাসন থেকে জাতীয় মুক্তির এমন অনিবর্তনীয় অবশ্যাম্ভাবী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আজ যদি সেই একি রাষ্ট্রগুলো বিরোধিতা করে বা নিরব দর্শকে পরিণত হয় তবে তা হবে তাদের একসময়ের লালিত লক্ষের সাথে বিশ্বাসঘতকতা যে লক্ষ্যের জন্য তারা লাখে লাখে জীবন বিসর্জন দিয়েছে।

Scroll to Top