<১০, ১৪.৬, ৩৬৪–৩৬৬>
অনুবাদ
অপারেশন অভয়া ব্রিজঃ জনাব বদিউজ্জামান
১৪-১৫ আগস্ট রাতে রাজশাহী-নবাবগঞ্জ রোডের সফল অপারেশনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিলো এবং মেজর গিয়াসের তত্ত্বাবধায়নে কাছাকাছি এলাকায় আরেকটি অপারেশন করার জন্য তারা বেশ উত্তেজিত ছিল। ১৪-১৫ আগস্ট রাতে ‘হরিপুর ব্রিজ’ নামক একটি অতি গুরুত্বপূর্ন একটি ব্রিজ আমরা দখল করি এবং ১২ জন পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার আটক করি। এর ফলে রাজশাহী এবং নবাবগঞ্জের মধ্যকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। একই সময় আমাদের আরেকদল নবাবগঞ্জ শহরে ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে প্রায় ঘন্টা ধরে গোলাবর্ষণ করে; তাতে পাকিস্তানি আর্মিদের স্থানীয়ভাবে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে বাঁধা পরে।
উপরোক্ত অপারেশনের পর মেজর গিয়াস একদিন বিশ্রাম নিয়ে পরবর্তী অপারেশনের প্রিপারেশন নেন। স্টাফ অফিসার হওয়ায় তার সাথে খুব কাছে থেকে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। শত্রুর ঘাঁটি থেকে তথ্য বেড় করে আনার জন্য তিনি আমায় ইনফরমার গ্রুপ থেকে ৬ জন কে প্রস্তুত করতে বললেন। আমাদের কিছু মুক্তিযোদ্ধা এই ব্যাপারে আগেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। তিনি সবাইকে আলাদা আলাদা করে ব্রিফ করলেন এবং তারা সেই মোতাবেক যথেস্ট তথ্য নিয়ে ২০ তারিখে ফিরে এলো। ঐদিনই আমি জানতে পারলাম যে মেজর গিয়াস ‘অভয়া ব্রিজ’ নামক সোনামসজিদ-নবাবগঞ্জ-রাজশাহী মুখী খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্রিজে অপারেশনের প্লান করছেন। কারন হিসাবে তিনি বললেন, ‘হারিপুর ব্রিজ’ ধ্বংসের পর শত্রুবাহিনী এখনো সেটি মেরামত করে সারতে পারেনি; এখন যদি অভয়া ব্রিজ ধ্বংস করে দেওয়া যায় তাহলে নবাবগঞ্জ শহরে অবস্থিত প্রায় ২ ব্যাটেলিয়ান আর্মি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাতে, রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসবে। ইতোমধ্যে, মহানন্দা আর পাডিল্লা নদীর চারপাশের প্রায় ২০০ স্কয়ার মাইল এলাকা মেজর গিয়াসের তত্ত্বাবধায়নে মক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল।
নিয়মিত বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে মেজর গিয়াস ৪৫ জনকে বাছাই করলেন এবং তার নিজেস্ব টেকনিক অনুযায়ী আগস্টের ২২ তারিখে পুরো এলাকার একটি স্কেচ করে একটি কাপড়ের তৈরী বিশাল মডেলের সামনে সবাইকে নিয়ে বসলেন। আমি, ডঃ আলম, এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের একজন ছত্র ছিলো ভাগ্যবানদের মধ্যে কয়েকজন যাদের কাছে মেজর গিয়াস এই অপারেশন সম্পর্কে সম্পূর্ন ব্রিফ করেছিলেন। ঐ সময় রাজশাহী-নবাবগঞ্জ এলাকা বন্যা কবলিত ছিল। উল্লেখিত ব্রিজটি রাজশাহী শহর থেকে ১৯ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। সকাল ১১টার দিকে তিনটা গ্রুপে ভাগ হয়ে ৩ টি বড় নৌকায় করে রওনা দিলাম। ভারী অস্ত্র বলতে আমাদের কাছে একটি ২ ইঞ্চি ভিকার মেশিন গান, ২টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ৮টি এলএমজি, ৮টি স্টেনগান, প্রত্যেকের সাথে একটি করে গ্রেনেড ছাড়াও আরো ৪৫০ কেজি বিস্ফোরক ছিলো। যেহেতু আমাদের বিষ্ফোরকের অভাব ছিলো, আমাদের লিডার ২৫০ কেজি জেলেটিন এক্সপ্লোসিভ, এবং প্রতিটিতে ১০ পাউন্ড করে এক্সপ্লোসিভ সমৃদ্ধ ২০ টি এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন সাথে নিলেন। ঠিক একই কম্বিনেশনের বিষ্ফোরক হরিপুর ব্রিজ ধ্বংসের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
আরভি এর যেখান থেকে আমরা রওনা হই সেটা ছিল এক্স বি ডি আর এর ফরিদপুর বি ও পি। এখানে বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর রেগুলার ফোর্স ছিল। পুরো সময় এটা মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে ছিল। পদ্মা ও মহানন্দা নদীর পাশ দিয়ে এরকম আরম ৬ টি বি ও পি ছিল আমাদের নেতৃত্বে। পাল তোলা নৌকায় আমাদের ১২ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবার কথা ছিল। আমাদের সাথে হ্যাভারস্যাক লঞ্চ ছিল। ১২ ঘন্টার মধ্যে আমাদের গন্তব্যে পৌছে যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা গন্তব্যের কাছা কাছই এসে পথ হারিয়ে ফেলি। কারণ চারপাশের স্বমত এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছিল এবং অন্ধকার হয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে একজন স্থানীয় লোকের সহযোগিতায় নির্ধারিত সময়ের ২ ঘন্টা পরে ১২টা ১০ মিনিটে গন্তব্যে পৌছাই। এবং ১০০০ গজ দূরে নৌকা থেকে নেমে যাই। সেখান থেকে ২০০ গজ আগানোর পর দেখতে পেলাম যে রাস্তা অভয় ব্রিজের দিকে যায়, সেটা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। হাটু পানিতে আমরা খুব ধীরে ধীরে আগাতে লাগলাম। ১০০ গজ আগানোর পর চাঁদের উজ্জ্বল আলোতে আমরা ব্রিজ দেখতে পেলাম। তখন রাত ১টা। ইতিমধ্যে নৌকা থেকে নামার ৫০ মিনিট পার হয়ে গেছে। আমরা এগোতে থাকি এবং আমাদের ছেলেরা মানসিকভাবে প্রচন্ড উদ্দীপ্ত ছিলো। যখন আমরা ব্রিজ থেকে মাত্র ৪০/৫০ গজ দূরে তখন ৫/৬ টা এলএমজি থেকে আমাদের দিকে ওপেন ফায়ার শুরু হোলো। এক পশলা গুলি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। এরকম কোন কিছু আমরা আশা করছিলাম না। হঠাত শুনলাম, মেজর গিয়াস চিৎকার করে বলছেন, “আলাদা আলাদা হয়ে যাও এবং পজিশন নাও।” আমাদের বেশীরবভাগ লোক মেইন রাস্তা থেকে সরে যেতে চাইছিল, কিন্তু হাটু পানিতে তারা বেশিদূর আগাতে পারছিলো না। বেশিরভাগই গলা পানিতে ডুবন্ত ঘরগুলোর পাশে আড়াল নীল। প্রথম ৪/৫ মিনিট যখন মেশিঙ্গানের গুলি বর্ষিত হচ্ছিল, আমরা একেবারেই হতভম্ব অবস্থায় ছিলাম। আমি আর মেজর গিয়াস রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি এবং ঐ সময়, পজিশন নেওয়ার ওর্ডার দেওয়ার প্রথম দুই মিনিটের মধ্যে তিনি তার প্রিয় চাইনিজ সাব-মেশিনগান থেকে ফায়ার শুরু করে দিয়েছিলেন, যেটি তিনি যুদ্ধের পুরোটা সময় নিজের সাথে রেখেছিলেন। তিনি আরো দুইটা মেগাজিন খালি করে ফেললেন। এরমাঝে, ভিকার মেশিনগান থেকেও ফায়ার শুরু হয়ে গেছে।
দুইদিক থেকেই সমানতালে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। আমি দেখলাম আমাদের লিডার এম্বুশ সাইটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এবং সকল মুক্তিযোদ্ধারা তাকে অন্ধের মত ফলো করছে। ব্রিজ দখল করতে আমরা হাটু থেকে গলা পর্যন্ত পানির মধ্যে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলাম। অপরদিকে, শত্রুপক্ষও সকল শক্তি দিয়ে আমাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। দীর্ঘ ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর আমরা দেখলাম, শত্রুপক্ষ পিছু হাঁটছে এবং ব্রিজের পাশে বাঁধা ৩টা নৌকায় করে পালাচ্ছে। পরে বুঝতে পেরেছি যে, ব্রিজের ঐপারের রাস্তাও বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিলো এবং পালানোর জন্য শত্রুপক্ষকে নৌকার ব্যাবস্থা করতে হয়েছিল।
শত্রুরা পালাচ্ছে বুঝতে পেরে আমরা গোলাগুলি চালু রাখি। ব্রিজের ওপাশ থেকে এক এলএমজি ছাড়া গোলাগুলি প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের গোলাগুলির মাঝেই শত্রুপক্ষের নৌকার থেকে আমরা ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। জ্যোৎস্নার আলোয় দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের গোলগুলিতে একটা নৌকা ডুবে গেলো। যখন আমরা ব্রিজ দখল করলাম তখন ভোর ৪.৩০ মিনিট। আমাদের গোলাবারুদ শেষের পথে ছিলো এবং মনবল তুঙ্গে থাকা সত্বেও আমাদের যোদ্ধারা খুবই ক্লান্ত ছিল। এবার ব্রিজ উড়িয়ে দেবার প্রসঙ্গ এলো। কিন্তু, আমরা চিন্তিত ছিলাম এই নিয়ে যে, সকালে যে কোন মুহুর্তে শত্রুপক্ষ আবার আক্রমন করে বসতে পারে। তাই আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার মনস্থির করলাম। এছাড়াও, ব্রিজের গোড়ায় মাইন বসাতে ২ ঘন্টার মত সময় লাগতো; অন্যদিকে, বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় করডাইট এবং ডেটনেটর যুদ্ধের মধ্যে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়াও, যুদ্ধে আমাদের সাহসী যোদ্ধা ল্যান্স নায়েক মোহর আলী বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।এছাড়াও আমাদের আরো দুই যোদ্ধা মারাত্বকভাবে আহত হয়েছিলেন, তাদের জরুরীভিত্তিতে সার্জারি করার দরকার ছিল।
স্বীকার না করে উপায় নেই যে আমাদের মিশন আংশিকভাবে সফল হয়েছিলো। আমরা ব্রিজ উড়াতে না পারলেও যুদ্ধে ২ জন পাকিস্তানি আর্মি এবং ৬ জন রাজাকার মারা গিয়েছিল। তাদের মৃতদেহ দুইদিন পর নদীর তীর হতে উদ্ধার করা হয়েছিলো। আমরা পরবর্তীতে নিশ্চিত হয়েছিলাম, অন্তত এক ডজন পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার যুদ্ধে মারাত্বকভাবে আহত হয়েছিল। এই যুদ্ধ সত্যিকারভাবে পাকিস্তানি আর্মিদের মনোবল গুড়িয়ে দিয়েছিল।
আগস্ট মাসে আমাদের দুইটা সফল অভিযানের কারনে পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাফেরা সীমিত হয়ে গেল; তখন তারা শুধু দিনেরবেলাতেই কমপক্ষে দুইটি গাড়িবহর নিয়ে চলাফেরা করত। তারা বাধ্য হলো বেশী সংখ্যক সৈন্য ব্রিজ এবং কালভার্ট পাহারা দেওয়ার কাজে নিয়জিত করতে, তাতে যুদ্ধ করার মত সৈন্য কমে গেলো। প্যারামিলিশিয়া দিয়ে যেখানে কাজ চলত, সেখানে এই ঘটনার পর তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রেগুলার আর্মি দিয়ে রাজশাহী-নবাবগঞ্জ রাস্তা পাহারা দিতে লাগল। দক্ষ একটা নেতৃত্ব থাকলে কিভাবে ছোট একটা দল নিয়েও সকল প্রতিকূলতা দূরে ঠেলে জয় ছিনিয়ে আনা যায়, তা আমি শিখলাম এই অপারেশন থেকে।