<১০, ১৩.২, ৩৪২-৩৪৭>
রাজশাহীতে সৈন্যসমাবেশ
(ব্রিগেডিয়ার গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী, বি বি , পি এস সি (অবঃ)
তৎকালীন মেজর গিয়াস; কমান্ডার – রাজশাহী সাব-সেক্টর – এর ডায়রি থেকে)
২২শে এপ্রিল আমি একটি মেসেজ পাই কর্ণেল ওসমানীর (পরবর্তীতে জেনারেল) কাছ থেকে। রাজশাহীর পাতি তলার উল্টোপাশে তিনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন। ২৫শে এপ্রিল ১৯৭১, বিএসএফ ব্যাটালিয়নের একটি জিপে করে ভারত হয়ে আমি সেখানে যাই। সকাল ৯টার দিকে সেখানে একটি রেস্টহাউজে কর্নেল ওসমানীর সাথে সাক্ষাত করি। সেখানে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) সাথেও দেখা হয়। ৩ নং ইস্ট বেঙ্গলের একটি অংশের তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যেখানে সায়েদপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিচ্যুত হওয়া একটি অংশও তার সাথে যোগ দেয়।
আমি সাথে একটা ম্যাপ এনেছিলাম এবং তাঁকে (কর্ণেল ওসমানী) আমার শেষ অপারেশন সম্পর্কে বলছিলাম। এর পরও যে আমার কাছে আরও অস্ত্র ছিল সেব্যাপারে তার কোন ধারনাই ছিলোনা। সেগুলোর মধ্যে ছিল – ৩০০০ রাইফেল, ৯৮ টি বেরেটা গান, ৬টি মাঝারি মর্টার, ৩লাখ ৩০৩ এম্মুনিশন, ১৪০০ মর্টার শেল ইত্যাদি। তিনি খুবই চমকিত হলেন এবং সেগুলো নেবার জন্য তার আদেশের অপেক্ষা করার অনুরোধ করলেন। তিনি আমাকে রাজশাহী জেলা এবং কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি সেক্টরের ইন-চার্জ করলেন। এছাড়াও ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সমবেত করারও আদেশ দিলেন।
মে এবং জুনে স্বাধীনতার ব্যাপারে খুবই হতাশা কাজ করছিল। শুরুতে আমি ৩টি ক্যাম্প গঠন করি। একটি হল ফরিদপুর বিওপি র মুক্ত এলাকা এবং পদ্মা ও মহানন্দার মাঝামাঝি কিছু চর এলাকা। সেখানে মূলত বিডিআর এর ট্রেনিং প্রাপ্ত সৈন্য, সেনা, আনসার ও মুজাহিদদের নিযুক্ত করি। মেজর রশিদের নেতৃত্বে সেনা ট্রেনিং প্রাপ্তদের নিয়ে আরেকটি ক্যাম্প করি। সেটা ছিল সারদা পুলিস একাডেমীর উল্টোপাশে বাংলাদেশ অংশের কিছু চর এলাকা। তৃতীয়টি ছিল ঐতিহাসিক লাল গোলা এলাকায়। ক্যাম্পগুলো গঠিত হয়েছিল যারা স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চায় তাদেরকে সমবেত করা। খুব অল্প দিনেই প্রচুর সংখ্যক যুবকেরা ক্যাম্পে যোগ দিল – যাদের বেশীর ভাগই ছিল ছাত্র। তারা এত দ্রুততার সাথে গেরিলা ট্রেনিং এ দক্ষতা অর্জন করছিল যে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। ২-৩ সপ্তাহেই এই ছেলেগুলোকে ফরিদপুর এবং চারঘাট/সারদাহ ডিফেন্স অপারেশন ক্যাম্পে যুক্ত করি।
প্রাথমিক সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের যথেষ্ট খাদ্য ও গোলাবারুদ ছিল।
জুনের মাঝামাঝিতে লেঃ জেনারেল অরোরা জিওসি (সি ইস্টার্ণ কমান্ড) মুর্শিদাবাদ জেলা সদরে অবস্থিত বহরমপুরে ১৯ মারাঠা রেজিমেন্ট পরিদর্শনে আসেন। আগেই এই ব্যাটালিয়নটিকে ইলেকশন ডিউটির জন্য পাঠানো হয়। রাজশাহীতে আমাদের সফলতার কথা শুনে ১৯ মারাঠা রেজিমেন্টের একজন অফিসার মারফত তিনি আমাকে তার সাথে দেখা করতে বলেন। সিজে-৫ মডেলের একটি খোলা জিপ চালাচ্ছিলাম আমি আর মেজর রশিদ (পরবর্তীতে কর্নেল) আমার পাশে বসা ছিলেন। লালগোলা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। তাই একটু তাড়া ছিল। পথে একটি গরু হঠাত রাস্তার মাঝখানে এসে পড়ায় আমি জিপটি নিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যাই এবং আমার চোয়ালের (ম্যান্ডিবল) হাড়টি ভেঙ্গে যায়। ফলে ১০ সপ্তাহ আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয় এবং এই সময়ে মেজর রশিদ আমার দায়িত্ব পালন করেন।
সুস্থ হয়ে আমি মুজিবনগরে কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা করতে যাই। তিনি আমাকে ডাক্তারের কথামত ২ মাস বিশ্রাম নিতে বলেন যেহেতু তখনো আমার মুখের একটি অংশ প্যারালাইজড। আমার জায়গায় ইতোমধ্যে তিনি সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব দিয়েছেন মেজর জামান (পরবর্তীতে কর্ণেল) কে – ৭নং সেক্টরের প্রধান হিসাবে। আমি বললাম যে আমি বরং নিজস্ব হেডকোয়ার্টার ফরিদপুর বিওপি তে ফিরে যাই এবং রাজশাহী অংশের অপারেশনের দেখভাল করি। কারণ আমি বিশ্রাম নিতে চাচ্ছিলাম না। অপারেশনের দিকে মনোযোগ দেয়ার ব্যাপারেই তাগিদ অনুভব করলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। এর আরেকটি কারণ ছিল তৎকালীন মন্ত্রী রাজশাহীর কামরুজ্জামান আমাকে তার এলাকায় চাচ্ছিলেন। আমাকে একটি স্বাধীন সাব-সেক্টরের (৪নং) চার্জ দেয়া হল। প্রশাসনিক সাপোর্ট লেঃ কর্নেল মঞ্জুরের কাছ থেকে এবং অপারেশন কো-অর্ডিনেট করবে ৭নং সেক্টরের লেঃ কর্নেল জামানের সাথে। আমি পুনরায় ট্রেনিং কার্যক্রম, সংগঠিতকরন এবং অপারেশন প্ল্যান ইত্যাদি শুরু করি। সাথে ছিলেন মেজর রশিদ। আরও কিছু ইয়াং অফিসার আমার নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত হয়।
আমার নেতৃত্বে নিম্নোক্ত মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন।
১) নিয়মিত বাহিনী :
ক) ফরিদপুর বিওপির নবাবগঞ্জ টাউনের নাইমিতা বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন
খ) মেজর রশিদের নেতৃত্বে সারদা পুলিশ স্টেশনের এক ব্যাটালিয়নের কিছু কম সংখ্যক
২) গেরিলা বাহিনী :
ক) প্রায় ৬০০০। তারা অবস্থান করবে লালগোলা/ভগবানগোলা এলাকার উল্টো দিকে। তাদের গ্রুপ লিডার, থানার লিডার এবং স্পেশাল টাস্ক ফোর্স লিডার ছিল। তারা সাধারণত ভিতরে যেত এবং স্যাবোটাজ করে ফিরে আসত। এর ১৫ দিন বা ১ মাস পরে মুক্ত অঞ্চল দিয়ে মুল ডিফেন্সে যেত। আম্যুনিশন অথবা বিশ্রামের পর তারা নিজস্ব অপারেশন এলাকায় ফিরে যেত যেখান থেকে তারা এসেছিল।
৩) তথ্য প্রদানকারি/মোটিভেটর : আমরা অনেক যুবকদের তথ্য জোগাড়ের ট্রেনিং দেই। তাদের দায়িত্ব ছিল ভেতর থেকে শত্রুদের পরিমাণ, প্রতিরক্ষা পদ্ধতি, গতিবিধি এবং মানসিক অবস্থা ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে আমাদেরকে জানানো। এছাড়াও স্থানীয় গেরিলাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং আম্যুনিশন সহায়তা সহ গাইড হিসাবে কাজ করাও তাদের দায়িত্ব। তাছাড়া স্থানীয় জনগণকে শত্রুদের অসহযোগিতা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করাও তাদের দায়িত্ব।
একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে এবং কৌশলে আমি আমার নিয়মিত বাহিনী নিয়ে অপারেশনের আয়োজন করি। আমার অপারেশন এলাকার একটি নির্দিস্ট অংশের দিকে আমি মনোযোগ দেই। সামনে থেকে শত্রুপক্ষকে ব্যাস্ত রেখে আমরা অন্য দিক দিয়ে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা শুরু করি – যেমন ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া, বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া, সাব-স্টেশন ধ্বংস করা, টেলিফোন লাইন অচল করা ইত্যাদি।
কিছুক্ষণ শত্রুদের ব্যাস্ত রেখে আমরা এর মধ্যে সর্বত্র অ্যামবুশ তৈরি করি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সফল হই। সপ্তাহে এক দুইবার আমরা তাদের সাথে মুখোমুখি পিচ ব্যাটেলে যুক্ত হতাম এবং পিছু হটে যেতাম। এভাবে তাদের মনোবল নিয়ে খেলা করতাম। অনেক ছোট ছোট অপারেশন চালাই যার সবগুলো এখানে বলা সম্ভব নয়। তবে আমার নেতৃত্বে দুটি খুব সফল অপারেশন সম্পর্কে বলতে চাই। যদিও ম্যাপে যে জায়গাগুলো চিহ্নিত করা ছিল সবগুলোর নাম দেয়া অসম্ভব।