অভিযোগ

অভিযোগ*

 

……১৯৭১

বাঙালীর মনোবল ভাঙতে ত্রাস সৃষ্টির জন্যে ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম ক’দিন হাজার হাজার বাঙালীর লাশ ওরা পথে-ঘাটে ছড়িয়ে রাখলো। সংসার-নিম্পূহ ডক্টর গোবিন্দ দেব, আমার বন্ধু অধ্যাপক জ্যোতির্ময়, ডক্টর মনিরুজ্জামান, সপ্ততিবষী আইনজীবী ধীরেন্দ্র দত্ত, নব্বই বৎসরের ভিষগাচার্য যোগেশ ঘোষ, মিউনিসিপ্যালিটির মেথর, ষ্টেশনের কুলি, নৌকার মাঝি, ক্ষেতের চাষী, নদীর জেলে, গায়ের তাঁতী, ঘাটের ধোপা, পথের নাপিত, হাটের পশারী, গঞ্জের মহাজন, মসজিদের ইমাম, গীর্জার পাদ্রী, মন্দিরের পুরোহিতসাধারণ থেকে অসাধারণ সকল শ্রেণী-ধর্মের নিরীহ বাঙালীর শবদেহ অসনাক্তভাবে কুকুর-শকুনের ভক্ষ্য হল সকলের চোখের সমানে। মনুষত্বের এতবড় অবমাননা ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও সম্ভব হতো বলে আমি বিশ্বাস করি না। আর সেই জন্যেই বোধ করি এই অমানুষিক বর্বরতা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তবু বলব, দুস্কৃতি দমনের নামে যারা বাঙালীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুট করল, জাহাজ ভর্তি নতুন নতুন গাড়ী, টেলিভিশন, রেডিও, রিফ্রিজারেটর, এয়ারকুলার ব্যক্তিগত মালিকানায় পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করল, কোটি কোটি টাকার অর্থ, অলংকার প্রকাশ্য মানি অর্ডার, পার্সেল অথবা পি-আই-এ কার্গো মারফত নিজের নিজের এলাকায় পাঠিয়ে দিলো, হাজার হাজার অবাঙ্গালীর হাতে মারণাস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাঙালীর শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের পরিমণ্ডল থেকে চিরনির্বাসনের সড়ক তাঁরা নিজেরাই প্রশস্ত করে নিলেন।


* কবি সিকান্দার আবু জাফর ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই একটি অভিযোগ-ইশতেহার প্রকাশ করেন। এটি পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয়। এখানে তার অংশবিশেষ সংকলিত।

.

পাকিস্তানী হানাদারদের তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সংহতির পরিকল্পনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তারা শহীদ মিনারগুলো ধ্বংস করে নিজেদের পদলেহী কিছুসংখ্যক গরুচোর দিয়ে সেখানে নামাজ পড়াচ্ছে। অর্থাৎ ওইসব জায়গার এক-একটা মসজিদের দাবী খাড়া করানো হচ্ছে। মজার ব্যাপার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছটিকেও তারা নির্মুল করে উপড়ে ফেলেছে। যেন ওই বটগাছের ডালগুলোতেই বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা ট্রাপীজ খেলতো। বাংলাদেশে হিন্দুর অস্তিত্ব পাকিস্তানী সংহতির পরিপন্থী। কাজেই তাবৎ হিন্দুকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা পালিয়ে বেঁচেছে তারা এখানে ওখানে লুকিয়ে থাকছে কিন্তু একজনেরও সম্পত্তি নিজেদের দখলে নেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাঙালী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের পেশাদার বাঙালী গুপ্তারা সেগুলো দখল করে বসে আছে। তাই যখন ইয়াহিয়া খান বাঙালী হিন্দুদের নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তথা অতি দুঃখেও হাসি পাচ্ছে এই ভেবে যে, হিন্দুরা তো আসবে কিন্তু উঠবে কোথায়? নিজের নিজের বাড়ি বলতে যা বেঝাতো সে তো পুড়ে-জুলে খাক। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা-ও কি আর খালি আছে?… হিন্দুর মন্দির ভেঙ্গে মাটির বরাবর করা হচ্ছে তা-ও দেখছি চোখের সামনে। বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন এলাকার লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলমানদের সম্পত্তি এখন অবাঙালীদের দখলে। ঢাকার মীরপুরমোহাম্মদপুর থেকে বাঙালী খেদানো এবং নির্বিচারে বাঙালী নিধন শুরু হয়েছে ২৩ শে মার্চ থেকে। ওই দুটি অঞ্চলের তাবৎ বাঙালীর সম্পত্তি লুষ্ঠিত এবং অবাঙালীদের অধিকৃত। ভারতে শরণার্থী বাঙালী মুসলমানেরা ফিরে এলে যথাসময়ে ওইসব অবাঙালীদের অস্ত্রের শিকার হবে। আঠারো থেকে তিরিশ বছর বয়সের হাজার হাজার বাঙালী ছাত্র যুবককে পাকিস্তানী ঘাতকরা ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং তাদের অধিকাংশকেই মেরে ফেলেছে। এখনও ধরে নিয়ে যাচ্ছে, হয়তো মেরেও ফেলেছে। উদ্দেশ্য, সক্ষম বাঙালী যুবকদের খতম করে বাঙালীদের বাহুবল ভেঙ্গে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথের দেয়া ভারতীয় সংহতির চোহারা- “শক হুনদল পাঠান মোগল এবং দেহের হলো লীন”- আমরা দেখলাম, পাকিস্তানী সংহতি কসরতে হানাদার সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবী পাঠান বিহারী বালুচ অফিসার জওয়ান পাইকার হারে অপহৃতা বাঙালী নারীদেহে লীন হচ্ছে। দূরপ্রসারী অভিসন্ধি হয়তো একটি মিশ্র জেনারেশন সৃষ্টি করা। সেটা রোধ করতে গেলে আমার আশঙ্কা, যে পরিমাণ গর্ভপাতের প্রয়োজ হবে তাতে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় মেটারনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিদেশ থেকে শত শত বিশেষজ্ঞ ধাত্রী আমদানি অপরিহার্য। আজ এদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ আমদানি হচ্ছে। বাঙালী অফিসার অবাঞ্ছিত তাদের মেরে ফেলা এবং আধা-বাঞ্ছিতদের বিষদাঁত ভাঙ্গার জন্যে জেলে পোরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেই একই ব্যবস্থা হবে শিক্ষক, সংস্কৃতিবিদ এবং সাহিত্যকদের ক্ষেত্রেও। ফলে গড়ে উঠছে অবাঙালী তাঁবেদার গোষ্ঠী এবং সুবিধাভোগী বাঙালী মীরজাফর শ্রেণী। বাংলা ভাষার মর্যাদা এবং গুরুত্ব হাস করা হচ্ছে শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁবেদার গোষ্ঠীর প্রতিপত্তি বাড়িয়ে। এই সংহতি অভিযানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে কোন ফললাভের সুযোগ আমাদের নেই। কারণ এসবই পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত বাঙালী আজ হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে মুক্তি সংগ্রামের দুর্জয় অঙ্গীকারে। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক বাংলার বাছাই করা বীর সন্তানেরা তাদের সঙ্গে নিজেদের বন্ধু-আত্মজনের রক্তস্নাত তৎখালীন ই-পি-আর, পুলিশ, আনসার বাহিনী আর মুক্তি- মাতাল বাঙালী তরুণ কিশোর ছাত্র এবং ছাত্রীরাও। রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেছিলেন “বাঙলার মাটি বাঙলার জল বাঙলার বায়ু বাঙলার ফল পুণ্য হউক।”- আজ এতদিনে শ্রেণী বর্ণ-গোত্র-ধর্ম নির্বিশেষে নিরীহ বাঙালী নরনারীর রক্তধৌত বাংলার মাটি মহাপুন্যাস্নাত হয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার ঘাতকেরা ইতিহাসের একটি সহজ সত্য আবিষ্কার করতে পারেনি যে, সার্বিক মৃত্যু ছিটিয়ে একটি জাতিকে আর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে চিরকালের জন্যে বঞ্চিত রাখা যায় না।

জাতীয়তাবাদ কোন একটা নির্ভরযোগ্য নীতি নয়। আমার মানসিক প্রস্তুতি আন্তর্জাতিকতাবাদ গ্রহণ করারই সপক্ষে। কিন্তু পাকিস্তানের কালে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমার বিভিন্ন কবিতায় বাঙালী

জাতীয়তাবাদকেই আমি বলিষ্ঠ আকৃতি দেবার চেষ্টা করেছি। এর কারণ, প্রথম থেকেই বাঙালীর সমস্যা স্বাক্ষরিত, বাঙালী জাতীয়তাবাদ বর্জনের তাগিত। এই তাগিদ এসেছে প্রধানতঃ দ্বিজাতিতত্বের প্রবক্তা এবং তাদের অনুগামী গোষ্ঠীর কাছ থেকে, পাকিস্তান যাদের মুষ্টিমেয় কয়েকজনের স্বার্থে এক উজ্জ্বল সূর্যসম্ভাবনায় পরিণত হয়েছে। এদের প্রায় অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পতি এবং পাকিস্তানী জঙ্গীযন্ত্রের পরিচালক। দেশ-বিভাগের প্রথম দিন থেকেই এরা বাংলাদেশকে চিরস্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করার চক্রান্তে বাঙালী জাতীয়তাবাদ সমূলে উৎখাত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে এবং সেই একই দিন থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতা উপলব্ধি করে বাঙালী যতই লুষ্ঠিত, নিগৃহীত এবং অপমানিত হয়েছে ততই হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জাতীয়তাবোধ তার কাছে উজ্বল হতে উজ্জ্বলতর দীপ্তিলাভ করেছে। বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্রের একমাত্র উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য-নরহত্যা, লুণ্ঠন এবং নারীধর্ষণের অভিজ্ঞতা আর স্বাধীনতা লাভের আগে দীর্ঘ দুই শতাব্দী শৃঙ্খলিত শিকারী কুকুরের মত ঔপনিবেশিক প্রভুর পদলেহনের কৃতিত্ব। বাঙালীর আত্মমর্যাদা এই চক্রের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে কোনদিনই তাকে আত্মহননের উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানী ঘাতকেরা আজ বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার পরিকল্পনা সূচীত হয়েছে স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিনটি থেকে।

আর সার্বিক অবলুপ্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালীর পক্ষে আত্মসংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। শিক্ষক হিসেবে যাদের প্রতিষ্ঠা এবং প্রশ্নাতীত মর্যাদা, তারা আজ শুধুমাত্র পেশাদার চাকুরে। ডাক্তার কিম্বা ইঞ্জিনিয়ার, বিচারপতি কিম্বা আইনজ্ঞ হিসেবে নিজের নিজের কৃতিত্বে যারা গোটা দেশের জন্যে অপরিহার্য তারা আজ অনিশ্চয়তা এবং বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় আত্মবিস্তৃত, চাষী-মজুর বাস্তুহারা, দিশাহারা। সরকারী কর্মচারী আজ নিরক্ষর সিপাই প্রভুর ভ্ৰকুটিলাঞ্ছিত মর্যাদাহীন হুকুমের নফর। ব্যবসায়ী-শিল্পপতি আজ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় নিস্পিষ্ট নিরূপায় সরীসৃপ। ছাত্রছাত্রীরা আজ উদ্দেশ্যহীন আকাংক্ষাহীন। এমন সামগ্রিক মৃত্যুর আবর্তে কোন জাতি নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে না। তাই বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন আজ অগণিত আত্মপরিজনের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন লাশের সামনে দাঁড়িয়ে এক বেদনায় একাত্ম হয়েছে, এক প্রতিজ্ঞায় বাহুবদ্ধ হয়েছে- মৃত্যুর বিনিময়-মূল্যেই তারা মৃত্যুকে রোধ করবে। বাংলার মাটিরে পূণ্য-পীযুষধারায় সঞ্জীবিত প্রাণ একটি বাঙালী বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের এই মুক্তি-সংগ্রাম শেষ হবে না।

(সিকান্দার আবু জাফর রচিত)

Scroll to Top