<02.116.527-529>
শিরোনাম– আইনগত কাঠামো আদেশের প্রতিবাদ ও সার্বভৌম পার্লামেন্টের দাবী
সূত্র– পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন
তারিখ– ১২ এপ্রিল,১৯৭০
সার্বভৌম পার্লামেন্টের দাবীতে এবং ইয়াহিয়ার নির্বাচনী আইনগত কাঠামো ও শাসনতন্ত্রের মূলনীতি ঘোষণার প্রতিবাদে –
সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা,
বিগত গণ-অভ্যুত্থানের ফলে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের অবসান ঘটিয়েছি।সারা দেশের মানুষ গভীরভাবে আশা করিয়াছিল যে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যে জাতীয় পরিষদ গঠিত হইতে যাইতেছে ঐ পরিষদের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিতে পারিবেন।এবং এইভাবে দেশের শাসনতান্ত্রিক সংকট ও সমস্যার প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাধান হইবে।সামরিক প্রধান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসিয়া একটি সার্বভৌম জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করিয়াছিলেন।কিন্তু সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের যে আইনগত কাঠামোর আদেশ ঘোষণা করিয়া দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরূদ্ধে এক রূঢ় আঘাত হানিয়াছেন।
ঘোষিত নির্বাচনী আইনগত কাঠামো আদেশ দ্বারা নির্বাচনী জাতীয় পরিষদকে কার্যতঃ পুরোপুরিভাবে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ করণের তথাকথিত পরিষদে পরিণত করা হইয়াছে। ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ করিলে এই পরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্র গৃহীত হইলেও উহাকে বাতিল করিবার নিরংকুশ ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতেই রাখিবার পাকাপাকি আইনও প্রণয়ন করা হইয়াছে।শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য নির্ধারিত পরিষদের সার্বভৌমত্ব বলিতে কিছুই নাই।জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ কর্তৃক জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার তথা ১১ দফা ও ৬ দফার দাবীগুলোর ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সকল স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করা হইয়াছে। এই অবস্থায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অবাধ গণতন্ত্র,পূর্ব বাংলাসহ সকল ভাষা-ভাষী মানুষের স্বায়ত্তশাসন,মৌলিক অধিকার প্রভৃতির স্বীকৃতি প্রদানকারী কোন শাসনই জনগণের দ্বারা রচনা করা সম্ভব হইবে না। ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দেশের শাসনতান্ত্রিক সংকট সমাধান করা সম্ভব হইবে না।শুধু তাহাই নহে,নির্বাচনের আইনগত কাঠামো আদেশ দ্বারা দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের প্রায় সকল মৌলিক প্রশ্নই প্রেসিডেন্ট স্ব্যং নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন।শাসনতন্ত্রের মূলনীতি সম্পর্কে যে পাঁচটি ধারা আইন হিসাবে বাধ্যতামূলকভাবে পালনের নির্দেশ ঘোষিত হইয়াছে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করিতে গিয়া কেন্দ্র ও প্রদেশসমূহের মধ্যে বিষয় বন্টনের যে নীতি নির্ধারিত হইয়াছে তাহাতে ৬-দফা ও ১১-দফা কার্যকরী করা সম্ভব নয়।উপরন্তু ধর্মভিত্তিতে জনগণকে বিভক্ত করার পুরাতন সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা বলবৎ করা হইয়াছে। এইভাবে প্রত্যক্ষ ভোটের অধিকার স্বীকার করা হইলেও মহিলাদের সংরক্ষিত আসনের ক্ষেত্রে পুরাতন আইয়ুবী ব্যবস্থাই চালু করা হইয়াছে।এইভাবে জনগণের ইচ্ছার বিরূদ্ধে পাকিস্তানে আরেকটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া উহা গণতন্ত্রের নামে চাপাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা এবং উহাতে প্রকৃতপক্ষে জনগণ কর্তৃক বাতিলকৃত ১৯৫৬ সালের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনতন্ত্রের মূলনীতিগুলো চাপাইবার ব্যবস্থা হইয়াছে এবং এইভাবে সরকার এককভাবে দেশবাসীর উপর শাসনতন্ত্র চাপাইয়া দিয়াছিল।আর বর্তমান সরকার শাসনতন্ত্রের কাঠামো নির্ধারণ করিয়া তার ভিত্তিতেই কেবল উহার বিস্তারিতভাবে লেখার দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর ছাড়িয়া দিতেছেন।এই দিক হইতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি পূর্বের মত বহাল থাকিতেছে।
অন্যদিকে ছাত্রসমাজ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত শিক্ষানীতিকে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হইয়াছে।তাই স্বাধীনতার পর হইতেই বৈজ্ঞানিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ,সার্বজনীন ও সহজলভ্য শিক্ষা হইতে ছাত্রসমাজ বঞ্চিত হইতেছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগ,সমাজবিজ্ঞান বিভাফ,আই.ই.আর., প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়,মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ,সমাজকল্যাণ কলেজ,জগন্নাথ কলেজ,পলিটেকনিক কলেজ,কৃষি কলেজ,এন.ডি.টি.আই. গ্রাফিক ইন্সটিটিউট,টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট,প্যারা মেডিকেল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীদের দাবী আজও মানিয়া লওয়া হইতেছে না।হলে এবং হোস্টেলে খাদ্যের নিম্নমান ও সিট সমস্যা চরম আকার ধারণ করিয়াছে।ছাত্রনেতা হায়দার আলী,মাহবুবউল্লাহ,বিধান,নির্মল, হিমাংশু বণিক,শূকদেব ঘোষ ও জননেতা মণি সিং, অজয় রায়, হাবিবুর রহমান,দেবেন শিকদার,শহীদুল্লাহ চৌধুরী সহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ,মামলা,গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচন্ড দমননীতির শিকারে পরিণত করা হইয়াছে।
দ্বিতীয়বারের জন্য সামরিক সরকারের শাসন কায়েম হইবার পর হইতেই আমরা দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্য বজায় রাখার আবেদন জানাইয়াছিলাম।বিশেষত,গত ১ জানুয়ারি হইতে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সীমিত অধিকার ফিরিয়া পাওয়ার পর গণতান্ত্রিক শক্তি ও রাজনৈতিক দল গুলির ঐক্যজোট কায়েমের অতীব গুরুত্ব আমরা ব্যাখ্যা করিয়াছিলাম কিন্তু সকলেই জানেন,আমাদের এই আবেদনে কেহ কেহ সাড়া না দিয়া বরং গণতান্ত্রিক শক্তি ও দলগুলির মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করেন।খুবই দুঃখজনক যে ১১ দফা উত্থাপনকারী ছাত্রসমাজের মধ্যেও বিভেদ তীব্র হইয়া ওঠে।অপরদিকে দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলি তাহাদের প্রতিক্রিয়াশীল লক্ষ্য অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির বিরূদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে যেন জাতীয় পরিষদ সার্বভৌম হইতে না পারে।উপরন্তু ইহা জানা আছে যে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নীতিগতভাবেই,গণতন্ত্র,স্বায়ত্তশাসন ও শ্রমিক কৃষকের স্বার্থের বিরূদ্ধে। এই পটভূমিতেই প্রেসিডেন্ট যে নির্বাচনী আইনগত কাঠামো ঘোষণা করিয়াছেন উহা দেশের ব্যাপক জনগণের স্বার্থের বিরূদ্ধে গিয়াছে।এক বৎসর আগে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের জোরে যতগুলি দাবী আদায় করা সম্ভব হইয়াছিল এবং সার্বভৌম জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন আজ গণতান্ত্রিক শক্তির বিভেদের ফলেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই প্রতিশ্রুতি অবজ্ঞা করিতে পারিতেছেন।শাসকগোষ্ঠী আজ কৌশলে বীর শহীদদের রক্ত ও জীবনের মূল্য অর্থহীন করিতে প্রয়াস পাইতেছে।কিন্তু পূর্ব বাংলা তথা সারা পাকিস্তানের সংগ্রামী ছাত্র-সমাজ ও জনগণ শাসকগোষ্ঠীর এই অপচেষ্টা ব্যর্থ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রহিয়াছে।
দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি ও নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রসমাজসহ কৃষক,শ্রমিক,মধ্যবিত্ত,বুদ্ধিজীবী সকলের প্রতি আমাদের আবেদন যে সময় থাকিতে ঐক্যবদ্ধ হউন ও ১১ দফা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য লইয়া সার্বভৌম জাতীয় পরিষদ কায়েমের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠার পথে আগাইয়া আসুন।দাবী তুলুন – ‘প্রতিক্রিয়াশীল আইনগত কাঠামো সংশোধন কর’। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং ইতিহাস হইতে এই শিক্ষা গ্রহণ করিয়াছি যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিলে বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।কিন্তু বিভেদ আনিবে সর্বনাশ। সরকারের কাছে দাবী- দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা এভাবে সমাধান করার জন্য নির্বাচনী আইনগত কাঠামো সংশোধন করিয়া সার্বভৌম জাতীয় পরিষদ কায়েমের পথ প্রশস্ত করুন।অন্যথায় দেশের রাজনৈতিক স্থিতি সুদূর পরাহত হইবে।
বন্ধুগণ,
দেশের এই পরিস্থিতিতে আমরা পূর্ব বাংলার সংগ্রামী ছাত্রসমাজকে প্রতিক্রিয়াশীল ঘোষণা সমূহের প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখিয়া দাঁড়াইবার জন্য আহবান জানাইতেছি।সাথে সাথে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনকারী শক্তিকে বিশেষত,সহযোগী গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনগুলিকে দলীয় সংকীর্ণতা ভুলিয়া ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহবান জানাইতেছি।
আসুন আগামী ১৩ এপ্রিল প্রতিবাদ দিবস সাফল্যমন্ডিত করার মাধ্যমে আওয়াজ তুলি-
* সার্বভৌম পার্লামেন্ট দিতে হইবে।
* নির্বাচনী কাঠামো সংশোধন কর।
* শাসনতন্ত্রের মূলনীতি বাতিল কর।
*সামরিক আইন বাতিল কর।
* সামরিক সরকারের শিক্ষানীতি মানি না।
* ছাত্র সহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।
* দমননীতি বন্ধ কর।
* ১১ – দফার সংগ্রাম চলবেই।
ঢাকার কর্মসূচীঃ
* ১৩ এপ্রিল,সোমবার,সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন।
* বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সাধারণ ছাত্র সভা ও বিক্ষোভ মিছিল।
শামসুদ্দোহা নূরুল ইসলাম
সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন