বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ২য় খণ্ডের ৭৬০-৬৩ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ২০৩ নং দলিল থেকে বলছি…
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
আন্দোলন চলবেঃ ইয়াহিয়ার সাথে প্রথম দিনের আলোচনার পর শেখ মুজিবের ঘোষণা
|
দৈনিক পূর্বদেশ | ১৮ মার্চ ১৯৭১ |
ইয়াহিয়া-মুজিব দ্বিতীয় দফা আলোচনা সমাপ্ত
আন্দোলন চলবেঃ মুজিব
(স্টাফরিপোর্টার)
প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে দ্বিতীয় দফা আলোচনা গতকাল বুধবার শেষ হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) অপরাহ্নে তৃতীয় দফা মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা হতে পারে।
আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে কোন তথ্য প্রকাশ করা হয় নি। শেখ সাহেব বলেছেন, আলোচনা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং আমাদের মধ্যে আরও আলোচনা হতে পারে। তবে সময় নির্ধারিত হয় নি।
আওয়ামী লীগ প্রধান তাঁর ধানমন্ডি বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে এবং লক্ষ্যে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।” তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “আমি কি আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি?”
নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল কালো পতাকা সজ্জিত একটি সাদা টয়োটা গাড়িতে করে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রবেশ করেন এবং এক ঘণ্টা পর বেরিয়ে আসেন। প্রেসিডেন্ট ভবন ফটকে বিপুল সংখ্যক দেশী ও বিদেশী সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরে আলোচনার অগ্রগতি এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে থাকেন। উত্তরে শেখ সাহেব বিমর্ষ চিত্তে বলেন, ”আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে, আমার কিছু বলার নেই।”
শেখ মুজিব অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, তাঁরা উভয়ে কারো সাহায্য ছাড়াই এক ঘণ্টা আলোচনা করেন।
প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে নিজের বাসভবনে প্রত্যাবর্তন করে শেখ মুজিব তাঁর দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে এক ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন।
প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়ার সাথে এক ঘণ্টা অসমাপ্ত আলোচনার পর সগৃহে প্রত্যাবর্তন করে এক সময়ে শেখ মুজিব দেশী ও বিদেশী সাংবাদিকদের ঘরোয়াভাবে সাক্ষাৎদান করেন।
আলোচনা ভেঙে গেছে কিনা শেখ সাহবেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “না, আলোচনা অব্যাহত থাকবে।”
প্রশ্নঃ আপনি কি আপনার চার দফা দাবী নিয়ে আলোচনা করেছেন?
উত্তরঃ যখন আমি প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনা বৈঠকে মিলিত হয়েছি তখন অবশ্যই রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আমার দাবী নিয়ে আলোচনা করেছি।
প্রশ্নঃ মঙ্গলবার আলোচনার সময় নির্ধারিত হয়েছিল, আজ তা কেন হয় নি?
উত্তরঃ এটা আমাদের উপর ছেড়ে দিন।
প্রশ্নঃ আপনাদের মধ্যকার আলোচনা কি সফল হয়েছে?
উত্তরঃ সফল হয়েছে কি বিফল হয়েছে তা আমি বলতে পারব না। আমি শুধু এইটুকু জানি যে, সংলাপ অব্যাহত রয়েছে।
প্রশ্নঃ পরবর্তী আলোচনা কবে হবে?
উত্তরঃ আজ রাতে (বুধবার) অথবা বৃহস্পতিবার পরবর্তী আলোচনার কর্মসূচী ধার্য হতে পারে।
প্রশ্নঃ পরবর্তী আলোচনায় আপনি কি আপনার দলীয় নেতৃবৃন্দকেও নিয়ে যাবেন?
উত্তরঃ আমি এখন তা বলতে পারছি না।
সাংবাদিকদের সাথে আলোচনার শেষ পর্যায়ে শেখ সাহেবকে খুব প্রফুল্ল দেখা যায়। এ সময়ে জনৈক বিদেশী সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন যে, এ হাসি থেকে কি আমরা কোন কিছু ধরে নিতে পারি? শেখ সাহেব তখন সহাস্যে বলেন, “আমি সব সময়ই হাসতে পারি এবং এমনকি জাহান্নামেও হাসতে পারি।”
জন্মদিন
বিদেশী সাংবাদিকরা এ পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ৫২ তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানালে তিনি বলেন, “১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ আমার জন্মদিন। আমি জীবনে কখনও আমার জন্মদিন পালন করি নি। আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। যখন কেউ ভাবতেও পারে না মরার কথা তখনও তারা মরে। যখন কেউ ইচ্ছে করে তখনও তাদের মরতে হয়।”
গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে শেখ মুজিব আরও বলেন, “আমার আবার জন্মদিন কী, মৃত্যু দিবসইবা কী? আমার জীবনই বা কী? মৃত্যুদিন আর জন্মদিবস অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।”
পরে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকের সাথে এক ঘরোয়া সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব বলেন, সাত কোটি মানুষ যখন পাহাড়ের মতো আমার এবং আমার দলের পশ্চাতে একতাবদ্ধ হয়েছে, তখন আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কে হতে পারে?
প্রেসিডেন্টের সাথে আলাপ-আলোচনার ধারায় তাঁর (শেখ মুজিব) মন ভার হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে শেখ মুজিব উপর্যুক্ত জবাব দেন। তিনি বলেন, আমার মন ভার হতেই পারে না। জনসাধারণের কারও মন ভার হয় নি। তারা লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
গতকাল প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনার সময়ের স্বল্পতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শেখ মুজিব বলেন, “এক ঘণ্টা খুব অল্প সময় নয়।”
সব বাড়িই আমার
আলাপ-আলোচনার জন্য মুজিবের বাড়িতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আগমনের সম্ভাবনা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে, আওয়ামী লীগ প্রধান উল্টা প্রশ্ন করেন, প্রেসিডেন্ট ভবন কি ঢাকায় অবস্থিত নয়? তারপর তিনি বলেন যে বাংলাদেশের সব বাড়ীই আমার বাড়ী।
বিদেশী সাহায্য
পরিস্থিতি সম্পর্কে বিদেশী মিশনদের সাথে যোগাযোগ করেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে শেখ মুজিব নেতিবাচক (না) জবাব দেন এবং বলেন যে, তারা এখানেই আছেন এবং সমস্ত ঘটনা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছেন।
বিদেশী সাহায্য চেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “আমার প্রয়োজন নেই।”
এই পর্যায়ে শেখ মুজিব বলেন, পাট, চা ইত্যাদিসহ আমাদের যা প্রয়োজন বাংলাদেশে তা আছে।
কী নাই, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে শেখ মুজিব বলেন, “স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার শুধু বাঙালিদের নেই।”