ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষঃ লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ

<02.081.415>

শিরোনাম সূত্র তারিখ
ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষঃ লাটিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ দৈনিক পাকিস্থান ১৯ই জানুয়ারী, ১৯৬৯

 

ছাত্রপুলিশ সংঘর্ষঃ লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ

(ষ্টাফ প্রতিবেদক)

 

            গতকাল শনিবার পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ছাত্রদের উপর কয়েক দফা লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ধর্মঘটী ছাত্ররা মিছিল বের করার ছেষ্টা করলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। ফলে ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি এক পরযায়ে এমন আকার ধারণ করে যে, যখন ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে এক ঘন্টারও অধিক সময় ধরে কাঁদুনে গ্যাস ও ঢিল ছোঁড়া ছুড়ি করতে দেখা যায়। ছাত্ররা শুক্রবার পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস বর্ষণের প্রতিবাদে গতকাল শনিবার ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই ধর্মঘটে যোগ দেয়। ছাত্ররা ই পি আর টিসির একটি ডাবল ডেকার বাসে অগ্নিসংযোগ করে।

            সন্ধ্যার পর ইকবাল হল ও জিন্নাহ হলে ইপি আর বাহিনী ঢুকে ছাত্রদের মারধর করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

            পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের ফলে কয়েকজন ছাত্র আহত হয়েছে। শতকরা ঢাকা শহরে ৩৪ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মঘটী ছাত্র-ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সভা অনুষ্ঠানের পর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাঁদের বাঁধা দেয়। ফলে ছাত্ররা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

            ছাত্রদের শোভাযাত্রা বন্ধ করার জন্য পুলিশ বাহিনী প্রথমে কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগ করে। এর জবাবে ছাত্ররা ইটের ঢিল বর্ষণ শুরু করে। পুলিশের রায়টকার বারংবার রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াতে থাকে এবং ছাত্রদের উপর লাল পানি নিক্ষেপ করতে থাকে। ছাত্রদের ইটে রায়টকারের একদিকের কাঁচ ভেঙে যায়। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সড়কের উপর বেঞ্চ, টেবিল ও চেয়ার ইত্যাদি জমা করে ব্যারিকেট তৈরী করে।

            গতকাল এন এস এফ-সহ ছাত্র প্রতিষ্ঠান একযোগে ধর্মঘতে যোগ দেয়। গতকাল প্রথম থেকেই বহুসংখ্যক ছাত্রকে বাঁশ ও লাঠি দ্বারা সুসজ্জিত অবস্থায় দেখা যায়। বেলা ১২-১০ মিনিট থেকে প্রায় সোয়া দ’টো পর্যন্ত ছাত্র -পুলিশ খন্ডযুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এই সময়ে কাঁদুনে গ্যাসের তীব্রতায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। মাঝখানে পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস ষ্টক শেষ হয়ে যাওয়ায় পুনরায় তা সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। প্রবল কাঁদুনে গ্যাসে অসুস্থ হলে প্রায় ২৫ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

            রোকেয়া হলের সামনে যে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয় তাঁদের উদ্দেশ্যে হলের ভিতর থেকে ছাত্রীরাও ইটের ঢিল ছুঁড়ে মারতে থাকলে পুলিশ সেখানেও কয়েক রাউন্ড কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপে করে। এখানে ছাত্রীদের প্রতি পুলিশ বাহিনীর অশোভন আচরণ করতে দেখা যায়। পুলিশের অশোভন গালি-গালাজ থেকে রোকেয়া হলের শিক্ষকেরাও রেহাই পাননি।

 

            বেলা দু’টোর পর ছাত্রদের একটি মিছিল জিন্নাহ এভন্যুতে চলে যায় এবং গুলিস্থানের সম্মুখস্থ মীরজুমলার কামানের চারদিকে ছাত্র জমায়েত হয়ে জনসভা শুরু করে দেয়। ছাত্র নেতারা কামানের উপর দাঁড়িয়ে উপস্থিতি ছাত্র ও পথচারীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন।

 

            এই সময় পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠিচার্জের ফলে বহুসংখ্যক নিরীহ পথচারী আহত হন। অতঃপর কয়েক ঘন্টাব্যাপী ছাত্র পুলিশের মুখোমুখি সংঘর্ষের অবসান ঘতে।

 

            বেলা সাড়ে তিনটা থেকে প্রায় সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ইপিআর বাহিনী জিন্নাহ হল ও ইকবাল হলে প্রবেশ করে ছাত্রদের ওপর চড়াও হয় এবং মারপিট করে বলে হলের ছাত্ররা অভিযোগ করেন। তাঁরা জানান জিন্নাহ হল থেকে ১১জন ও ইকবাল হল হেকে ৯ জন ছাত্রকে ইপিআর বাহিনী গ্রেফতার করে।

 

            বেলা প্রায় সাড়ে ১২তার সময় পুলিশ নীলক্ষেতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কোয়ার্টারে সাইত্রিশ নম্বর বিল্ডিঙয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং রাঙ্গু মিয়াঁ নামক একজন খবরের কাগজ হকারকে ধরে এনে বেদম প্রহার ও গ্রেফতার করে। এ ছাড়া নীলক্ষেতের রাস্তায় আব্দুল হান্নান নামে একজন রিক্সা চালককে পুলিশ প্রহার ও গ্রেফতার করে।

 

            ছাত্রদের ইটের ঢিলের বর্ষনে একজন আইবি ফটোগ্রাফার দু পায়ে আঘাত পান। একজন পুলিশ সিপাইও গুরুতর জখম হয়।

 

            সাংবাদিক বিভাগের অধ্যক্ষ ডক্টর আতিকুজ্জামান খানকেও পুলিশ অপমান এবং অশোভন আচরণ করে। দুপুরে ছাত্রদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ওকাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ডঃ মফিজউদ্দিন আহমদ কলাভবনের প্রাঙ্গণে এসে ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি পুলিশী হামলার নিন্দা করেন।

 

            মহসীন হলের প্রভোষ্ট ডঃ ইন্নাস আলীও সংক্ষিপ্ত ভাষণে পুলিশী হামলার নিন্দা করেন।

 

সোমবার প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট

 

গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিভিন্ন হলে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রার উপর লাঠিচার্জ এবং বহু ছাত্রকে গ্রেফতার, ইকবাল হল ও জিন্নাহলের অভ্যন্তরে ইপি আর বাহিনীর মারপিট ও গ্রেফতার ইত্যাদি সরকারী নির্যাতনের নিন্দা করে ঢাকার বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের ২৫ জন কর্মকর্তা এক যুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন।

 

            বিবৃতিতে তাঁরা সরকারী নির্যাওতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদ, গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবীতে এবং ছাত্রদের ১১-দফা দাবির সমর্থনে আগামীকাল সোমবার প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করেছেন।

 

এন এস এফএর বিবৃতি

 

            এন এস এফ-এর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি জনাব সাইফুল্লাহ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক জনাব মজীর আলী এক বিবৃতিতে গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইপি আর বাহিনীর তৎপরতার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা আবাসিক হলে ছাত্রদের উপর অত্যাচ্যারের নিন্দা করেন। তাঁরা গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি দাবী করেন।

 

 

 

 

আওয়ামী লীগের বিবৃতি

 

            ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসগুলিতে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ইপি আর বাহিনীর প্রবেশ ও ছাত্রদের উপর মারপিট করার তীব্র নিন্দা করে গতকাল শনিবার ৬-দফা পন্থী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়েছেন।

 

            তিনি বিবৃতিতে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর লাঠিচার্জ ও কা৬দুনে গ্যাস নিক্ষেপেরও নিন্দা জ্ঞাপন করেন।

 

            তিনি পুলিশের এই বাড়াবাড়ির তীব্র নিন্দা করে শহর থেকে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার ও আটক ছাত্রদের অবিলম্বে মুক্তিদানের আহ্বান জানান।

Scroll to Top