‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ১৯০৫ থেকে ১৯৫৮ সালের সময়সীমার অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের দলিলপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার-এর আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু এর পূর্বেকার স্বাধীনতার ঘোষণাসমূহ এবং বিভিন্ন আবেদনগুলিও গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের ভাষণগুলি যথাসম্ভব সংযোজিত হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করার উদ্দেশ্যে মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের অধীনে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সে-সম্পর্কিত দলিলপত্র এই খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ৫ম খন্ডের দলিলপত্রের অধিকাংশই প্রাথমিক সূত্র থেকে আহৃত। প্রাথমিক সূত্র থেকে পাওয়া যায়নি এমন কিছু কিছু দলিল শহীদুল ইসলাম সম্পাদিত শব্দসৈনিক এবং রেডিও বাংলাদেশের পাক্ষিক মুখপত্র বেতার বাংলা’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্নিবেশিত গানসমূহের কয়েকটি উৎস শামসুল হুদা চৌধুরী সম্পাদিত অনেক রক্ত একটি জাতি নামক সাময়িকী এবং তার রচিত একাত্তরের রণাঙ্গন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের একটি খণ্ড হিশেবেএটি পাঠের সময় অবশ্যই মনেরাখা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার বা পাকিস্তানী পক্ষ কখনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্বীকার করেনি। তাই তারা ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ ও ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ কে ‘রাষ্ট্রদ্রোহীতা’ , ‘সমাজ বিরোধী ও নাশকতা মূলক তৎপরতা ’মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ‘দুস্কৃতিকারী’, ‘ভারতেরচর’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ ; নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ সদস্যদেরকে ‘ভারতের দালাল’ ও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, শরনার্থীদেরকে ‘উদ্বাস্তু’; স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি বিদেশী রাষ্ট্র ও সংগঠনের সমর্থনকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ রূপে আখ্যায়িত করেছে।
২৫ শে মার্চের রাতে আকস্মিকভাবে ঢাকার বেসামরিক জনসাধারণের উপর পাক হানাদার বাহিনীর সামরিক হামলার পর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তাঁদের আত্মসমর্পণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের যে ব্যাপক ক্রিয়াকলাপ চালায় সে সম্পর্কিত দলিলপত্র এই খন্ডে গ্রন্থিত হয়েছে। দলিলাদির প্রকৃতি অনুযায়ী এগুলো কয়েকটি ভাগে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
এই খণ্ড সশস্ত্র সংগ্রাম-(১) প্রণীত হয়েছে প্রতিরোধযুদ্ধের ঘটনাবলী নিয়ে। প্রতিরোধ যুদ্ধ যেহেতু সারা দেশে বিস্তৃত ছিলো সেহেতু এ সংক্রান্ত যাবতীয় বিবরণ জেলাভিত্তিক ভাগে ভাগে বিন্যস্ত হয়েছে।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ এবং আক্রমণের তৎপরতা সংক্রান্ত তথ্য ও প্রতিবেদনভিত্তিক দলিলপত্র বর্তমান খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ভারতের সরকারী ও বেসরকারি প্রতিক্রিয়া এবং ভূমিকা সম্পর্কিত দলিলপত্র বর্তমান খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের সরকারী প্রতিক্রিয়া’, ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও বিধানসভা সমূহ’, ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের বেসরকারি প্রতিক্রিয়া’, ‘ভারতীয় রাজ্যসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ’ এবং ‘ভারতীয় লোকসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ’- এই ৫ টি শিরোনামে দলিলসমূহকে বিন্যাস করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ত্রয়োদশ খন্ডে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত উক্ত বিষয়ের উপর বিভিন্ন বিতর্ক ও প্রস্তাব এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত দলিলসমূহ অন্তভূক্ত করা হয়েছে।
চতুর্দশ খণ্ডের বিষয়বস্তু হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ঘটনাবলি বিভিন্ন দেশের পত্র পত্রিকা এবং বেতার প্রচারে ব্যাপকভাবে স্থান পায়। বস্তুতপক্ষে প্রায় প্রতিদিনের খবরের কাগজে বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনার রিপোর্ট বা সম্পাদকীয় মুদ্রিত হয়। এখানে উল্যেখ্য যে, প্রায় সব প্রকাশনাই ছিল বাংলাদেশে আন্দোলনের পক্ষে অথবা সেই সময় এই দেশের মানুষের অবর্ননীয় দুঃখ কষ্টের ওপর রচিত নিবন্ধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুদ্রিত দলিলপত্র-খণ্ডসমূহের সম্পূরক হিসেবে এই খণ্ডটির পরিকল্পনা করা হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের প্রায় এক দশক পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস সংকলনের গুরুদায়িত্বে এই প্রকল্পের সামনে একটি প্রধান সমস্যা ছিল পর্যাপ্ত দলিল ও তথ্য হাতে পাওয়া ।এই প্রসঙ্গে ভূমিকায় বিশদভাবে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কিত বিপুল সংখ্যক দলিলপত্র প্রকল্পে সংগৃহীত হয়েছে এবং সেগুলো থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রথম থেকে চর্তুদশ খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোর কোন লিখিত দলিল নেই । আবার প্রাপ্ত দলিল ও তথ্যাদি কোনো ঘটনাদির ব্যাখ্যা অপর্যাপ্ত রয়ে গেছে যেসব ক্ষেত্রে ঐ সকল ঘটনার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিংবা যারা সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁদের মৌখিক বিবরণই সম্যক ধারণা দিতে পারে। এছাড়া নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিত্ব -যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের তৎপরতার নানা কথা একমাত্র সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। অতএব এই খণ্ডটি স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্পের দলিলপত্র খণ্ড সমূহের অন্তর্ভূক্ত হয়।