৬২| পীর দরবেশরাও রেহাই পায়নি (৪৬১)
সুত্র – দৈনিক আজাদ, ১১ই মার্চ, ১৯৭২
পীর-দরবেশরাও কসাইদের হাত থেকে রেহাই পায়নি
কইবুল্লা সাহেব। উত্তর বাংলার আনাচে-কানাচে তার হাজার হাজার মুরীদ, সাগরেদ। তার মাঝারি ধরনের বাড়িটায় সর্বদা গমগম করতো শত শত দর্শনার্থী। কোরান পাঠ, মিলাদ, মহফিলে, ওয়াজ নসিহত আর ওয়াক্তে ওয়াক্তে নামাজ – এক স্বর্গীয় পবিত্রতায় সারাক্ষন ভরে থাকতো এই পীর বাড়ী। পীর সাহেবের ছোট আরো ৩ ভাইও ছিলেন পীর।
প্রগ্রেসিভ মনোভাবের পীর সাহেব মনে প্রানে ঘৃনা করতেন সামরিক জান্তাদের ধর্মের ধোহাই দিয়ে লাখো মানুষ খুন এবং ধর্ষনকে। মুখ ফুটে কিছু না বলতে পারলেও তিনি নিরাপরাধ মানুষের প্রাণ এবং মা-বোনদের ইজ্জত ভিক্ষা চেয়ে সৃষ্টির্তার কাছে প্রার্থনা করতেন। ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতিকে সর্বগ্রাসী ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা, জয় হয়েছে মানবতার। কিন্তু পীরসাহেব তা দেখে যেতে পারেননি। এর আগেই কসাই খানসেনাদের হাতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে।
পীর পরিবারের এক ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২৫ মার্চের পর তিনি পালিয়ে যান এবং ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন। এই খবর পেয়ে মিলিটারীরা রমজান মাসের একদিন শেষরাতে হঠাত তাদের গ্রাম ঘেরাও করে। সেহেরী শেষ করে এবাদতে বসেছিলেন পীর সাহেব… তার এক ভাই ভাত খাচ্ছিলেন, অন্য একজন মসজিদে কোরআন তেলোয়াত করছিলেন। এই অবস্থায় বাড়ী ঘিরে ফেলে সামরিক জান্তারা একে একে ৪ ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। সাথে খুন করে আরো ১১ জন সাগরেদকে।
হাতে তসবীহ ধরা অবস্থাতেই বড় পীর সাহেব মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আরেক ভাই ভাতমাখা হাতে মৃত। একজন পড়েছিলেন ওজুর ঘটির উপর। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। এখানে কশাইরা পীর বংশের এক শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাচ্চাটা দোলনায় ঘুমাচ্ছিল। পাকবাহিনী কয়েকবার গুলি চালায় এই ঘুমন্ত শিশুটির উপর।
পরেরদিন সকালের দৃশ্য আরো মর্মান্তিক ছিলো। শোকে বিহ্বল শত শত ভক্তরা লুটিয়ে পড়ছিলেন আঙ্গিনায়।
গোকুল গ্রামের তসিম পাড়ের জনৈক এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে ছিলো। কালো বোরখা পরে, মেয়ে সেজে সে মিলিটারিদের সাথে এসে পীরবাড়ি সনাক্ত করে দেয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সে আদেশ নির্দেশও দিয়েছিল বলে জানা যায়, যা মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাকেও হার মানায়।