বিশ্ব জনমত

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-

এর নিয়মিত কথিকামালা (অংশ)

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-এর

দালিলপত্র

৩০মে-২৬ নভেম্বর, ১৯৭১

 

বিশ্ব জনমত

৩০ মে, ১৯৭১

বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া সরকার ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র জনতার উপর যে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছে- ইতিহাসে তার তুলনা নেই। আর সে রতের পর থেকেই শুরু হয়েছে বিশ শতকের ইয়াজিদ ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর ঔপনিবেশিক শোষণ অব্যাহত রাখার যে চক্রান্ত সাবেক পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শুরু হয়েছিলো একাত্তরের মার্চ মাসে ঘটলো তারই নগ্ন প্রকাশ। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা তাই আর কোনকিছু রেখেঢেকে রাখতে চায় না। এজন্য তারা কামান-বন্দুক-মেশিনগান-বোমারু বিমান মায় যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বাংগালীদের সামনে একটি মাত্র পথ-সে পথ স্বাধীনতা রক্ষার সশস্ত্র লড়াই। বাংলার বীর জনতা সে দায়িত্ব পালন করেছে। আজ তাই স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য। এ সত্য বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতার প্রাণের মন্ত্র- বাংলাদেশের বাঁচার শপথ।

বিগত ২৪ বছর বাংলাদেশ শোষিত হয়েছে ধর্ম আর সংহতির নামে। পশ্চিম পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠী লুণ্ঠন করেছে বাংলার সম্পদ-ধ্বংস করেছে বাংলাদেশের আর্থিক মেরুদণ্ড পাট প্রধান অর্থকরী ফসল। আর এ পাট রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা। কিন্তু পাটচাষীরা তাতে কোনো উপকৃত হয়নি। বাংলার গরীব চাষী-শ্রমিকেরা আরো গরীব হয়েছে- তাদের উপর নেমে এসেছে নির্যাতনের চরম দণ্ড।

বাংলাদেশ এবং বাংলার জনগণকে বাঁচাবার জন্যই আজ তাই শুরু হয়েছে মরণপথ স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ সংগ্রামে শরীক বাংলার বুদ্ধিজীবি, বাংলার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা সবাই।

বাঙালীরা এ সংগ্রামকে আজ নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছে সারা দুনিয়ার মানুষের বিবেক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের অধিকাংশ সদস্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন বাংলার জনগণের প্রতি তাঁদের সমর্থন। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সিনেটর ফুলব্রাইট এবং আরো কয়েকজন প্রভাবশালী সিনেটর দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন- পাকিস্তানের জংগী সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাকে সমর্থন করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সিনেটের বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত কমিটি পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেবার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। ইসলামাবাদের খুনী সরকারের বিশেষ দূত এম, এম, আহমদ হয়েছেন প্রত্যাখ্যাত। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তাঁর সাথে দেখা করার সকল আবেদন-নিবেদন নাকচ করে দিয়েছেন।

বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী ঘাতকেরা অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দেউলিয়াতৃ তুরান্বিত করেছে। যুদ্ধের খরচ দৈনিক দেড় কোটি টাকা। অতএব-চাই-চাই-সাহায্য চাই। সাহায্যের জন্য ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দেশ পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন ইয়াহিয়ার দোসর এম,এম, আহমদ কিন্তু সবখানেই ব্যর্থ হয়েছেন- তিনি শূন্য হাতেই ফিরেছেন।

অন্যদিকে যতই দিন যাচ্ছে বাংলা মুক্তিবাহিনীর আঘাত দুর্বার হয়ে উঠেছে। হানাদার শত্রুরা গেরিলা আক্রমণে হয়ে উঠেছে দিশাহারা। সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এগিয়ে আসছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাহায্যে কয়েকদিন আগে বুদাপেষ্টে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বশান্তি কংগ্রেসের অধিবেশন। পৃথিবীর বহু দেশের প্রতিনিধিরা সেখানে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব নিয়েছেন- বিশ্বশান্তি কংগ্রেস সর্বাত্মক সাহায্য করবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে।

সুইডেনের সকল রাজনৈতিক দল যুক্তভাবে ঘোষণা করেছেন- বাংলাদেশে ইসলামাবাদের লেলিয়ে দেয়া জল্লাদদের নির্বিচার হত্যালীলা বন্ধ করতেই হবে বাংলার নির্যাতিত জনগণকে। তাদের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে তাঁরা জানিয়েছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। সুইডেনের ইতিহাসে এই প্রথমবার দল-মত নির্বিশেষে সবাই এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বের শুভ বিবেকের এই কণ্ঠস্বরকে জানাচ্ছে অকুণ্ঠ অভিনন্দন। লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতাকামী জনতা উদ্দীপিত হয়ে উঠেছে- স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে আমাদের লড়াই আজ তাই সুনিশ্চিত বিজয়ের পথে।

ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও ইন্দোনেশীয় পার্লামেন্টের স্পীকার মিঃ জাইচেক বিশ্ব মুসলিম সমাজের কাছে বাংলাদেশের সপক্ষে আবেদন জানিয়েছেন। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার হানাদার সেনারা বর্বরতা ও নৃশংসতার যে বীভৎস ইতিহাস রচনা করছে- তার তিনি তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর উপর অকারণে ইয়াহিয়ার সেনারা যে নির্যাতন চালাচ্ছে তার প্রতিবাদে আওয়াজ তোলার জন্যে তিনি আহবান জানিয়েছেন বিশ্বের সকল মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি। তিনি বলেছেন, বিশ্বের অন্যতম প্রধান মুসলিম রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে- শাসকগোষ্ঠীর এই অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের সমর্থন কোন বিবেকসম্পন্ন মানুষই করতে পারে না।

দেশে দেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হচ্ছে। বিবেকের কণ্ঠস্বর আজ বহু দেশে উচ্চকিত। বৃটেনের শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্ণসও বিশ্ববিবেকের সাথে ঘোষণা করেছেন একাত্মতা। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নিরস্ত্র অসহায় জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে যে কোন রকম সাহায্য দান বন্ধ রাখুন।”

বাংলাদেশের যে সমস্ত লোক পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি স্বচক্ষে তাদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। মিঃ মাইকেল বার্নস বলেছেন, বৃটেনের জনগণ বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পূর্ণ সমর্থন করে।

১০ জুন, ১৯৭১

হংকং-এর ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছেঃ

দৈনিক ডন এবং দৈনিক পাকিস্তান টাইমসসহ পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা স্বীকার করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান ও মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আলোচনা চলাকালে একটা সমঝোতায় এসেছিলেন। ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ একথা প্রচারও করেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী

লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের চারটি যুক্তিসঙ্গত দাবী মেনে নিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের এই চারটি দাবী হলোঃ

 

এক – সামরিক শাসন তুলে নেয়া

দুই – সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া

তিন – নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয়া

চার – সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র জনসাধারণ হত্যার তদন্ত করা।

 

এই দাবীগুলো মেনে নেয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার আগেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিতান্ত গোপনে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বিমানযোগে করাচী ফিরে গেলেন। এবং আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘোষণা করে ও পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র সৈন্য লেলিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। এর কোনো যুক্তসঙ্গত ব্যাখ্যাও প্রেসিডেন্ট দিতে পারলেন না। এতে পরিষ্কারভাবে বোঝা গেলো যে, আলোচনার নামে সময় নিয়ে ইয়াহিয়া খান পূর্ববাংলায় সৈন্য আমদানী করলেন- যাতে বাংলাদেশের অধিকার-সচেতন মানুষ ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর সামনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এ সকল কারণে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর প্রতি সকলে সন্দেহ পোষণ করলো।

কানাডার দৈনিক মন্ট্রিল স্ট্রিট পত্রিকায় বলা হয়েছেঃ

 

ঢাকার ব্যাপক গণহত্যা পরিকল্পনায় স্বয়ং ইয়াহিয়া খানসহ পাক-সেনাবাহিনীর সব জেনারেল জড়িত ছিলো। মূলত গৃহযুদ্ধ দমনের পরিকল্পনা, তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় এই জেনারেলরা পুরোপুরি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এই হত্যাযজ্ঞ কেবলমাত্র টিক্কা খানের নিজস্ব ও একক উদ্যোগ নয়- এটা আসলে খুব সতর্কতা ও সাবধানতার সঙ্গে সংঘটিত একটি মিলিটারী অভিযান। বাঙালী হত্যার সামরিক আদেশ সেনাবাহিনীর সকল ইউনিট কমাণ্ডারের কাছে যাতে প্রত্যক্ষভাবে এবং লিখিতভাবে পৌছে সেজন্য প্রেসিডেন্ট ২৫শে মার্চ বিকেল দুটো পর্যন্ত নিজেই খোঁজখবর নিয়েছেন। সন্ধ্যে সাতটায় প্রেসিডেন্ট বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বাসভবন ত্যাগ করেন। রাত ১১টায় ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টার গানসহ ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ শুরু হয়।

জাপানের ডেলী জাপান টাইমস এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছেনঃ পূর্ববাংলায় পাক-সেনাবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণেই এই রক্তক্ষয়ী অভিযান চলছে। জাপানের আসাহি শিমবুন পত্রিকা বলেছেন, বাংলাদেশে নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও সেখানে যে নির্বিচারে গণহত্যা চলছে, তা নজীরবিহীন।

পূর্ববাংলায় যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে এবং গণজীবনকে দুৰ্বিসহ করে তুলেছে তাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষের প্রতি বিশ্ববাসী সহানুভূতি দেখিয়েছেন। মুক্তিকামী জনতাকে এভাবে হত্যার ফলে পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ক চিরতরে তিক্ত হয়ে গেল। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর কাণ্ডকারখানার দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, পূর্ববাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে পারে এবং তারা প্রাণ দিচ্ছেও।

তুরস্কের ডি ডেলী জুনাইদিন পত্রিকা মন্তব্য করেছেন যে, একদিকে প্রায় এক লক্ষ সুসংগঠিত, সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য, অপরদিকে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সকল বাঙ্গালীকে কখনো কতল করতে পারবে না। বাঙালীর মুক্তি অবধারিত।

১৭ জুন, ১৯৭১

বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতা ও ব্যাপক গণহত্যা অপরাধকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র এক ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করেছে। বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের গণহত্যার ঘৃণ্য অপরাধ ঢাকা দিতে তারা “ইসলাম বিপন্ন, ইসলামী দেশ বিপন্ন” বলে ধুয়ো তুলেছে। এই ধুয়ো তুলে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশসমূহের জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করছে। “ইসলাম বিপন্ন, ইসলামী দেশ বিপন্ন’ বলে তারা ওইসব দেশের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানের কবরে শোয়া অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে। কিন্তু সবরকমের সাবধানতা সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার সামরিক চক্রের এই হীন দুরভিসন্ধি ঢাকা পড়েনি। বাংলাদেশে গণহত্যার রক্তাক্ত হাত তারা লুকোতে পারেনি। গোপন করতে পারেনি তাদের জঘন্যতম অপরাধ।

বিভিন্ন আরব দেশের পাঁচটি প্রভাবশালী যুব সংস্থা এক যুক্ত বিবৃতিতে জানিয়েছে যে ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র ধর্মের দোহাই দিয়ে আরব জনগণকে প্রতারিত করার যে চেষ্টা করেছিলো তা ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশের জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যার প্রতিবাদে আরব দুনিয়া থেকে এটাই হলো সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিবৃতি ও প্রতিবাদ। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো আবার।

পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তথা বাঙালীদের বিপুল বিজয়ের বর্ণনা করে বিবৃত্তিতে বলা হয়েছে যে, গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দেবার এবং জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে ইয়াহিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করেছে। বাংলাদেশের জনগণের উপর গণহত্যা ও পাকবাহিনীর বর্বরতা ঐক্যের ওপর প্রচণ্ডতম আঘাত হেনেছে।

আরব দুনিয়ার এই পাঁচটি প্রভাবশালী যুব সংস্থা বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করেছে। বাঙালী মুক্তিসেনাদের বীরোচিত লড়াইয়ের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করেছে। বাঙালী মুক্তিসেনাদের বীরোচিত লড়াইয়ের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ও সাহায্যদানের জন্যে সংহতিমূলক প্রচার সংগঠিত করার এবং ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনীর গণহত্যার মুখোশ খুলে ধরার জন্য আরব জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছে।

বিবৃতিতে আরব যুব সংস্থাগুলি দাবী করেছেন যে, বাংলাদেশে গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গীচক্রকে বাধ্য করে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

বিবৃতিতে সিরিয়ার ডেমোক্রাটিক ইউনিয়ন অব ইউথ, ইরাকের ডেমোক্রাটিক ইউথ ইউনিয়ন, ইয়েমেন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আসসালাফি যুব আন্দোলন, সুদানের ইউথ ইউনিয়ন,ও লেবানন ডেমোক্রাটিক ইউথ ইউনিয়ন ও লেবানন ডেমোক্রেটিক ইউথ ইউনিয়নে নেতৃবৃন্দ স্বাক্ষর করেছেন। বৃটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলের ১২০ জনের বেশী সদস্য বাংলাদেশে গণহত্যার জন্যে ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারকে এককভাবে দায়ী করে এক প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন।

বৃটেনের ক্যাবিনেট মন্ত্রী জন ষ্টোনহাউজ এই প্রস্তাব রচনা করেন। এই প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বাংলাদেশে আক্রমণের ফলে উদ্ভূত পরিস্তিতিকে আন্তর্জাতিক শান্তির পথে মারাত্মক হুমকি ও জেনেভা কনভেনশনের পরিপন্থি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রস্তাবে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আহবান

জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে দাবী করা হয় যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকেই প্রকৃত সরকার বলে মর্যাদা দিতে হবে।

মার্কিন প্রতিনিধি সভার এশিয়া বিষয়ক সাবকমিটির চেয়াম্যান মিঃ কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার পাকিস্তানকে সবরকম সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্যে গতকাল একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন। মার্কিন সিনেটের এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে।

এদিকে ইউরোপের বহু দেশ সুস্পষ্টভাবে একথা জানিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশে এক তরফা সামাধান চাপিয়ে দিতে পারে না।

সুইডেন, হল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরী সমেত ইউরোপীয় দেশগুলি এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর একতরফাভাবে কোন সমাধান চাপিয়া দিতে পারে না। ইউরোপের এইসব দেশগুলি তাদের মিত্রদেশসমূহের সঙ্গে একত্রে মিলে ইয়াহিয়া সরকারকে তাদের এই মনোভাব জানিয়ে দেবে।

১৯ জুন, ১৯৭১

…. বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত জনাব আবদুস সামাদ আজাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ এক মাস ধরে সফরের পর মাত্র কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে ফিরে এসেছেন। জনাব আবদুস সামাদ আজাদ গিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী মানুষ ও সরকারের কাছে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারদের ব্যাপক গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও বর্বরতার করুণ চিত্রটি তুলে ধরতে এবং দেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের উৎখাতের জন্যে বাংলাদেশের মানুষ আজ যে মরণপণ যুদ্ধে নেমেছে তার প্রতি সক্রিয় সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে।

জনাব আবদুস সামাদ আজাদ বিশ্বশান্তি সম্মেলনের বুদাপেস্ট অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। জনাব আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে এই সম্মেলন সার্থক হয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য সমর্থনে এই সম্মেলনে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। পরিশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আইনসঙ্গত ও ন্যায্য সংগ্রাম ও তাঁদের বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মেলনের পক্ষ থেকে ‘ল্যামব্রাকীস’ পদক উপহার দেয়া হয়েছে।

জনাব আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, বিশ্ব এটাও বুঝতে পেরেছে যে বাংলাদেশে এই বিস্ফোরক পরিস্থিতির সমাধান না হলে সমগ্র বিশ্বে এর বিস্ফোরণ ছড়িয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইয়াহিয়াশাহীর অবসান ঘটবে। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নির্মুল হবে এবং তাদের ধবংসস্তুপের ওপর একটি নতুন জাতির অভ্যুত্থান ঘটবে- এই মূল সত্যটি বিশ্ববাসী আজ উপলব্ধি করেছেন।

 

২০ জুন, ১৯১৭

…পাক সেনারা বাংলাদেশে যে অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ, লুঠতরাজ ও নারী নির্যাতন চালিয়েছে তাকে কতিপয় দুষ্কৃতকারীরা কার্যকলাপ বলে বিভ্রান্তকর খবর রটিয়েছিলো। কিন্তু বিশ্বের মানুষ তাদের এই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত

হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত সাংবাদিক, কূটনীতিক, শান্তি ও সমাজসেবী সংস্থাসমূহ এবং পর্যটক প্রকৃত ঘটনাবলী স্বচক্ষে দেখেছেন। তারা দেখেছেন বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর লোমহর্ষক নৃশংসতার চিহ্ন। ভারতের সীমান্তে যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে ইয়াহিয়া সরকার ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী বলে বর্ণনা করেছিলো তারা সকলেই যে প্রকৃতই বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত এবং ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর অত্যাচারেই যে তারা বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছে এটা তারা প্রত্যক্ষ করেছে। পৃথিবীর সকল দেশের পত্র-পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনে এর প্রামাণ্য তথ্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের কোন মানুষই ইয়াহিয়া সরকারের জঘন্য প্রচারে ভ্রান্ত হয়নি।

জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বললেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে তা মানব ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায়- মানব ইতিহাসের এই কলঙ্ক মুছে দেয়া সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের এই মন্তব্যের কয়েক দিন পরেই জাতিসংঘ ত্রাণ ও সাহায্য দফতরের হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খাঁ ভারত সীমান্তে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর শিবিরগুলি পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন।

ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবির সফর করার পর সদরুদ্দীন আগা খাঁ নিজেই বললেনঃ বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীরা নিজেদের জীবন সম্পর্ক কোনোরকম নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত স্বদেশে ফিরতে পারে না। বাংলাদেশের শরণার্থীরা তাঁর কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। এই স্মারকলিপিটিতে বাংলাদেশের শরণার্থীরা বলেছেন যে, যতদিন পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে থাকবে ততদিন স্বদেশে ফেরা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেন, পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ আজও সর্বস্ব হারিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আজও সেখানে গণহত্যা চালাচ্ছে, আজও তারা সেখানকার সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘর সহায়-সম্পদ ধ্বংস করছে- নারীর ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাচ্ছে। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারদের এই বর্বরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করা ও এর অবসান ঘটানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হবার জন্য সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ রিচার্ড নিক্সন ও মার্কিন পরারট্র সচিব মিঃ রজার্সের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সিনেটর কেনেডী বলেন, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের সৃষ্ট এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মার্কিন সরকারের নীরবতা মানব ইতিহাসের এক করুন ট্রাজেডি ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যেসব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছে ইয়াহিয়া সরকার তা সবই বাংলার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। সিনেটর কেনেডী বলেন, আর কালবিলম্ব না করে ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। বর্তমান জরুরী অবস্থাই ইয়াহিয়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রকৃত সময় বলে তিনি উল্লেখ করেন। ২১ জুন, ১৯৭১ … সম্প্রতি হেলসিঙ্কিতে বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর এক বৈঠকে বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী সামরিক তৎপরতার জন্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে পাক

হানাদার বাহিনীর হত্যা, ধ্বংস ও লুণ্ঠন বন্ধ করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি বৈঠকে আহবান জানান হয়। বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও অন্যান্য রাষ্ট্রবর্গের প্রতি এই মর্মে দাবী জানান যে তারা যেন পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য দান একেবারে বন্ধ করে দেন।

বাংলাদেশের শরণার্থী প্রসঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে এক আবেদনে বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী বলেন, যারা মানবিকতার নীতিকে অস্বীকার করে, যারা মানবতাকে হত্যা করে- বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র, সভ্যতা ও মানবতাকে একসঙ্গে খুন করেছে তাদের ক্ষমা নেই।

বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “শান্তি ও মানবতার প্রতি আজও যারা শ্রদ্ধাশীল তাদের প্রক্যেকেরই উচিত পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে এমন অনুকূল অবস্থা সৃষ্টির দাবী করা, যাতে বাংলাদেশের শরণার্থীরা তাদের স্বদেশে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবন বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলী পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে জনগণ কর্তৃক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী করেছেন। বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে বাংলাদেশের সংগ্রামকে সাহায্য করার ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্যে বিশ্বের সকল শান্তি সংস্থার প্রতি আহবান জানানো হয়।

বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহবানের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বহু দেশ থেকে বহু মানবদরদী ও শান্তি সংস্থা সেক্রেটারী জেনারেল উত্থান্টের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। এইসব তারবার্তায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলী যেহেতু ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায় সেই কারণেই বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনার জন্যে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। অথচ কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ইয়াহিয়া সরকার তার বেতার, টেলিভিশন ও কূটনৈতিক মিশনসমূহের মাধ্যমে এই ঘটনাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে প্রচার করছিলো। বাংলাদেশে তাদের সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যাতে তারা বাঙ্গালী-অবাঙ্গালীর মধ্যে সংঘর্ষ ও কমিপয় দুস্তৃকারীর কার্যকলাপ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাদের সে অপকীর্তি বিশ্ববিবেকের চোখে এখন পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। জানি না ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার এই কেলেঙ্কারির পর আবার কোন ছেদো কাহিনীর আশ্রয় নেবেন- তবে সত্য ঢাকতে গিয়ে, অপরাধ গোপণ করতে গিয়ে তারা যে কৌশলই অবলম্বন করুন না কেন পরিণতি তাদের একই হবে। কারণ, খোঁড়ার পা গর্তেই পড়ে।

২৭ জুন, ১৯৭১

সম্প্রতি বার্লিন থেকে প্রকাশিত জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সরকারের এক ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ব্যাপক গণহত্যা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী আর যাতে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য না হয় এবং ইতিমধ্যেই যে ৬০ লক্ষ বাঙালী দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে তারা যাতে অবিলম্বে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে এবং বাংলাদেশে যাতে তাদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হয় তার জন্য কালবিলম্ব না করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যাতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তার জন্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এইসব কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যেই বাস্তবসম্মত, উপযুক্ত এবং স্বায়ী সমাধানের পথ নিহিত আছে।

জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই ইশতেহারে আরও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা এবং সেখানকার গণনির্বাচিত নেতৃবর্গের পরামর্শ ও পরিকল্পনার ভিত্তিতেই মৌলিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের এক সঠিক ও সহজ পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।

জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই ইশতেহারকে বিশ্বের সকল দেশের রাজনৈতিক মহল দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। তাঁরা বলেন, এই ইশতেহারে বাংলাদেশ থেকে যেসব শরণার্থী ভারতে চলে গেছে তাদের সমস্যাকে শুধু যে কেবল আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছে তা নয়। এই ইশতেহারে দাবী করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর

প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতার মুক্তি, আওয়ামী লীগের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রভৃতি।

ইউরোপ ও আমেরিকার পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনসমূহের প্রকাশিত ও প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ ও মন্তব্যে বলা হয়ঃ গত ২৫ শে মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে বর্বরতা চালিয়েছে তাতে বাংলাদেশ থেকে আরও লক্ষ লক্ষ নরনারী দেশছাড়া হতে বাধ্য হবে।

গত ১৯৭০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে যে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিলো তাতে অনুমানিক ১৮ থেকে ২০ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছে এবং এই ব্যাপক প্রাণহানির মূল্যেও পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রচ্ছন্ন কারসাজি ছিলো। যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করলে ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছাসে মৃত্যুর হাত থেকে শতকরা ৯৫ জন অব্যাহতি পেতে পারতো, পশ্চিম পাকিস্তানীরা তথা ইয়াহিয়া সরকার ইচ্ছা করেই সেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমন কি ব্যাপক প্রাণহানির খবরটুকু পর্যন্ত চেপে গেছে। বাইরের জগত যেটুকু জেনেছে তা বাংলাদেশের বেসরকারী কতগুলো পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের খবর থেকে। গত ২৫শে মার্চ থেকে ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চাললো, এর খবরও তারা চেপে গেছে। ইয়াহিয়ার জঙ্গী বাহিনী ১০ লাখ নরনারীকে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে।

লণ্ডনে কমনওয়েলথ প্রেস সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা থেকে এই তথ্য উদ্ধৃত করা হয়। অনেকগুলো পত্র-পত্রিকায় একরম মন্তব্য করা হয়েছে যে, পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে বর্ণিত মুসার (আঃ) যুগে মিশরের উপর পর পর যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় এসেছিলো তাতেও এত প্রাণহানি ঘটেনি। পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ পর্যন্ত যত বাঙালী খুন করেছে তার দ্বিতীয় কোন দৃষ্টান্ত নেই। এত নরহত্যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ পর্যন্ত কখনও ঘটেনি।

 

২৮ জুন, ১৯৭১

 

বিশ্বব্যাঙ্ক পাকিস্তানকে আর কোন আর্থিক সাহায্য দেবে না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক “ওয়াশিংটন পোষ্ট’-এ প্রকাশিত এক খবরে উল্লেখ করা হয় যে, সম্প্রতি প্যারিস পাকিস্তানকে সাহায্য দানকারী কনসর্টিয়ামভুক্ত ১১টি দেশের প্রতিনিধিদের এক বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কনসর্টিয়ামভুক্ত দেশসমূহের প্রতিনিধিগণ স্থির করেছেন যে, বাংলাদেশে সবদিক থেকে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত পাকিস্তানকে নতুন করে কোন রকম আর্থিক সাহায্যদানের প্রশ্নই উঠতে পারে না। বরং পাকিস্তান এ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব ঋণ নিয়েছে সেগুলোই সুদে-আসলে আদায় করা হবে। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে যে, আর্থিক সাহায্য লাভের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্যে পাকিস্তান যত কান্নাকাটিই করুক না কেন, এ ব্যাপারে কনসর্টিয়ামের আর কোন বৈঠক বসবে না।

‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’-এর প্যারিসস্থ সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে উক্ত বৈঠকে বেলজিয়াম, কানাডা ও বৃটেন একথা খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তানীরা বাংলাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে তাদের জনমত প্রবল আকার ধারণ করেছে এবং পাকিস্তানকে কোন রকম সাহায্য দানের তারা ঘোরবিরোধী। অতএব নিজেদের দেশের জনমতকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানকে সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশে সামরিক বর্বরতা চালানোর সহযোগিতা করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। -অর্থাৎ পাকিস্তানকে সাহায্যদানকারী কনসর্টিয়ামভুক্ত দেশসমূহের অভিমত হলোঃ ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গী সরকার যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে গণহত্যা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন বন্ধ না করবে, বাংলাদেশ থেকে যতদিন পর্যন্ত তাদের রক্তভেজা লোমশ হাতগুলো গুটিয়ে না ফেলবে এবং যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসবে ততদিন আমরা কেউই পাকিস্তানকে একটি কানাকড়ি পর্যন্ত দিচ্ছি না।

হল্যাণ্ড সরকারও এই একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। হল্যাণ্ডের উন্নয়ন সাহায্য সংক্রান্ত মন্ত্রী মিঃ জে, বি, উডনিক হেগস্থ পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতকে তাঁর সরকারের এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেহেতু পাকিস্তানের সরকার তার নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে বর্বর বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ চালিয়ে ও শহর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশছাড়া করেছে এবং যেহেতু পাক সরকার নিজেই নিজের দেশের অর্থনীতির মূল বুনিয়াদটিকেই বুলেট-বেয়োনেটের আঘাতে শেষ করে দিয়েছে, সেই কারণেই পাকিস্তানকে নতুন কোন সাহায্য দানের কথা বিবেচনা করা যায় না।

মিঃ উডনিক বলেন, পাকিস্তানকে সাহায্যদানকারী কনসর্টিয়ামভুক্ত দেশসমূহের সিদ্ধান্তের সাথে অমত হয়েই তার সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, যেসব সাহায্য দেওয়ার কথা ইতিপূর্বেই হয়েছিলো তা এখন পুনর্বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে।…

 

৪ জুলাই, ১৯৭১ …

ভাটিকানের মহামান্য পোপ পল থেতে শুরু করে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলে উথান্ট এবং পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, ধিক্কার আর ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার একদিকে যেমন বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা ও অবর্ণনীয় বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছে অন্যদিকে তারা বাংলাদেশ থেকে বাইরে সংবাদ যাওয়ার সকল পথ রুদ্ধ করে চরম অপপ্রচার ও ভুয়ো কল্পকাহিনী ছড়িয়েছে। এইসব পরস্পরবিরোধী চিত্র ও প্রচারণার জন্যেই সম্প্রতি বৃটিশ পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধিদল পাক-অধিকৃত এলাকাসমূহ এবং বাংলাদেশের মুক্ত এলাকা সফরের এসেছিলেন। এই বৃটিশ পার্লামেন্টার প্রতিনিধিদলে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল ও শ্রমিক উভয় দলের সদস্যই ছিলেন। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেছিলেন দলের প্রভাবশালী সদস্য মিঃ আর্থার বটমলি।

মিঃ আৰ্থার বটমলি ছিলেন বৃটিশ কমনওয়েলথ সচিব। এখন তিনি পার্লামেন্টে শ্রমিকদলের একজন প্রভাবশালী সদস্য।

বাংলাদেশ সফর করে গিয়ে মিঃ বটমলি সাংবাদিকদের বলেছেনঃ ইয়াহিয়া তার সাম্প্রতিক বেতার বক্তৃতায় যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন তা স্রেফ ধাপ্পা মাত্ৰ। ইয়াহিয়ার ওই বেতার বক্তৃতায় রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তা ছুড়ে ফেলে দেবেন। ও ধরনের প্রস্তাব বাংলাদেশে মানুষ গ্রহণ করতে পারেন না।

মিঃ বটমলি বলেনঃ আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে সমাধানের দ্বিতীয় কোন পথ নেই। বৃটিশ পার্লামেন্টার দলের অন্যতম সদস্য মিঃ টোবি জেসেল ও বিশিষ্ট সদস্য মিঃ আর্নেষ্ট প্রিন্টিসও এ ব্যাপারে মিঃ বটমলির সঙ্গে একমত।

মিঃ টোবি জেসেল বলেনঃ রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থা বিপজ্জনক। অবিলম্বে এ সমস্যার সমাধান যদি না করা হয়, তাহলে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ হতে বাধ্য। তিনি বলেন, পাকিস্তান এখন এ শতাব্দীর সবচে বড়ো দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে।

বাংলাদেশে ব্যাপক ধ্বংসের পিছনে ভারতীয় দুষ্কৃতকারীরা রয়েছে বলে পাকিস্তান যে ডাহা মিথ্যা কাহিনী ফেঁদেছিল বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্যগণ সকলেই তার সত্যতা অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেন, রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে ধ্বংসের যে বীভৎস চিত্র আমরা দেখে এসেছি তা কোনক্রমেই ভারতীয়দের দ্বারা সংঘটিত হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়।…

বৃটিশ  পার্লামেন্টারী দলের অপর সদস্য প্রাক্তন বৃটিশ সমর সচিব মিঃ জেমস র‍্যামসডেন বলেনঃ বাংলাদেশে পাক সামরিক বাহিনী যা করছে তা বীভৎস। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার কোন সম্ভবনা নেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতই বিপজ্জনক ও দুর্বিষহ যে সেখান থেকে আরও অধিক সংখ্যায় শরণার্থী ভারতে বা প্রতিবেশী দেশে চলে যেতে পারে। এর ফলে শরণার্থী সমস্যা আরও গুরুতর আকারে দেখা দিতে পারে। আর তা দেখা দিলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। পাকিস্তানের পক্ষে আসবে এক দারুণ মরণ আঘাত। সে আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা পাকিস্তানের নেই।

যে পাকিস্তান বর্তমানে এ শতাব্দীর সবচে বড়ো দুর্যোগের মাঝ দিয়ে চলেছে। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের ওপর জঙ্গী শাসন চাপিয়ে রেখে এর সুরাহা হবে না, হতে পারে না। মিঃ আর্থার বটমলি বলেনঃ পাক বাহিনী কেন, পৃথিবীর কোন শক্তির পক্ষেই সাড়ে সাত কোটি মুক্তি-সচেতন মানুষকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। …

 

৯ জুলাই, ১৯৭১

গতকাল বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে মার্কিন সাময়িকী নিউজউইক’-এ প্রকাশিত বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কিত একটি মর্মস্পশী রিপোর্টের অংশবিশেষ আমরা উল্লেখ করেছিলাম। দ্য টেরিবল ব্লাড বাথ অব টিক্কা খান” বা “টিক্কা খানের বীভৎস রক্তস্নান’ শিরোনামের এই রিপোটে নিউজউইক’ সংবাদদাতা টনি ক্লিফটন বাংলাদেশে পাক বর্বরতার একটি আংশিক চিত্র তুলে ধরেছেন। রিপোর্টে তিনি বাংলাদেশে যে মর্মান্তিক ঘটনাবলীর কথা বলেছেন সে সম্পর্কে কোন রকম মন্তব্য না করে আমরা শুধু তার বাকী অংশটুকু তুলে ধরছি।

টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে লিখেছেনঃ পাক বর্বরতার যেসব বীভৎস স্বাক্ষর আমি প্রত্যক্ষ করেছি ও পাক-হানাদারদের পৈশাচিকতার যেসব লোমহর্ষক কাহিনী আমি শুনেছি তাতে আমার শুধু একথাই মনে হয়েছে যে বাংলাদেশে কয়েক হাজার মাইলাই ও কয়েক হাজার লিডিসেস সংঘটিত হয়ে গেছে। আমার আজ আর কোন সন্দেহ নেই যে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ পর্যন্ত এমন বর্বরতা কখনও সংঘটিত হয়নি। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবং এমন কি গত দুটো বিশ্বযুদ্ধেও একখানি বিপর্যয় কখনও ঘটেনি। আমার মনে হয়, পাক বর্বর বাহিনী বাংলাদেশে যে হাজার হাজার মাইলাই আর লিডিসেস করেছে তার শেষ এখানে নয়-বাংলাদেশে আরও অনেক মাইলাই, আরও অনেক লিডিসেস অচিরেই সংঘটিত হতে যাচ্ছে।

টনি ক্লিফটন বলেনঃ এইসব দেখে-শুনে আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া যা হয়েছে তা যদি বলতে হয় তাহলে আমি বলবো- আমি হতবাক, স্তব্ধ হয়ে গেছি। আমি যা দেখেছি যা শুনেছি তাতে ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে

যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি হতবাক হয়ে গেছি- বার বার বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি- এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড আর এই প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতায় একজন মানুষের কোন চেতনা থাকা কি সম্ভব?

টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে বাংলাদেশে পাক-হানাদারদের হত্যা, নির্যাতন ও ব্যাভিচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের একটি সর্বহারা বালিকার এক মর্মান্তিক কাহিনী তুলে ধরেছেন।

তিনি বলেনঃ লালফুল ও সবুজ লতাপাতা আকা গোলাপী রঙের একটা ছেড়া ফ্রকের আট-ন বছরের বালিকা ইসমত আরার মুখে আমি এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করেছি। আমি তাকে দেখলাম শরণার্থী শিবিরের অনতিদূরে একটি হাসপাতালে। শত শত আহতদের ভিড়ের একপ্রান্তে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। দিশেহারা দুটি ভিরু চোখ দিয়ে চারিদিকে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। সে যে আহত আমি তা দূর থেকেই লক্ষ্য করলাম। মনে হলো শীর্ণ আলোর একটি রেখার মতো এই মেয়েটি তো কারও বিপদের কারণ হতে পারে না? এই ছোট্ট মেয়েটি ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে কি এমন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যার জন্য তারা এভাবে আঘাত করেছে? একজন পাকিস্তানী সৈন্য বেয়োনেট দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে। তার শ্বাসনালি কেটে দিয়েছে। সে তার গলার ব্যাণ্ডেজের ওপর একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি বললোঃ আমার নাম ইসমত আরা আমার বাবার নাম মরহুম ইশাক আলী। কুষ্টিয়ায় আমার বাবার দোকান ছিলো। দু’মাস আগে বাবা কুষ্টিয়ায় রওয়ানা হয়েছিলেন সেই রাতে আমি ঘুমোবার আগে বাইরে কোলাহল আর ভারী ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখতে যাওয়ার আগেই দেখতে পেলাম অনেকগুলো পাক সৈন্য আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারা আমাদের ঘরে ঢুকেই আমার দাদাকে গুলি করে। আমার দাদা বি-এসসি পাস করেছিলো। তারপর তারা আমার মা ও বোনদের ওপর অত্যাচার চালায় এবং তাদের শেষ পর্যন্ত বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। একজন সৈন্য লাফ দিয়ে এসে আমাকে আঘাত করে। তারা বেয়োনেট দিয়ে আমার গলায় আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়ে যাইে এবং মৃতের ভান করি। তারপর সৈন্যরা চলে গেলে পরের দিন একজন লোক দিয়ে আমাকে অচেতন অবস্থায় তুলে নিয়ে আসে। এই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন কেমন হয়ে পড়েছিলো। সেই বীভৎস দৃশ্য যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। সে তা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ সরে গেল আমার কাছ থেকে। আর তাকে দেখতে পেলাম না। আমি তার ওয়ার্ডের ডাক্তারের সংগে আলাপ করলাম। ডাক্তার আমায় জানালেন, একদিন এক ভদ্রলোক তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসে। এরপর হাসপাতালে আহত শরণার্থীদের ভিড় ঠেলে আমি যখন বাইরে বের হচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় ইসমত আরা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার দুচোখের কোণায় জল টলমল করছিলো। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে সে আমায় জিজ্ঞেস করলোঃ বলুন না এখন আমি কি করবো? জানেন আমরা পাঁচ বোন ছিলাম, আমার ভাই ছিলো, মা-বাবা ছিলো। কতো সুন্দর আমাদের ঘরবাড়ি ছিলো। আজ আমার কেউ নেই, কিছু নেই। আজ আমি এতিম। বলুন না, আমি কোথায় যাবো? আমার কি হবে? আমি তাকে বললাম, আর তো কোন ভয় নেই। তুমি এখানে চলে এসেছ, এখন তোমার ভয়ের কিছু নেই। কপট এক নির্বোধের মতো আমি তাকে সান্তনার কথাগুলো বললাম- কিন্তু ইসমত আরার কি হবে? কি হবে আরও হাজার হাজার ইসমত আরার?

টনি ক্লিফটন তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, আমেরিকার নিউজার্সির কংগ্রেস সদস্য মিঃ কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার আমায় বলেছেন যে, পাক বাহিনীর বর্বরতার খবর অতিরিক্ত বলে আমি প্রথমে মনে করেছিলাম এবং প্রকৃত সত্য যাচাইয়ের জন্যেই আমি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম কিন্তু আমি যা দেখেছি তা অবর্ণনীয়। মিঃ গ্যালাঘার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর একজন বিখ্যাত সামরিক অফিসার ছিলেন। তিনি বলেছেনঃ দ্বিতীয় বিশ্ব মহাসমরের সময় ফ্রান্সের বিধ্বস্ত এলাকাগুলো আমি দেখিছি- মর্মান্তিক বধ্যভূমিগুলোও আমি দেখেছি, কিন্তু আমি এমনটি কখনও দেখিনি। এ বীভৎসতা, এ বর্বরতার কোন তুলনা হয় না।

টনি ক্লিফটন বলেন, গত তিন মাসে পশ্চিম হানাদাররা বাংলাদেশে যে নারকীয় বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছে তাতে এটা আজ অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে পাকিস্তান ভেঙ্গে দুটি স্বতন্ত্র দেশ হয়ে যাচ্ছে। সেটা ঠিক কবে হচ্ছে সেটাই শুধু প্রশ্ন, হচ্ছে কিনা সেটা আজ আর কোন প্রশ্ন নয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব ঘটনা।

১০ জুলাই, ১৯৭১

 

বেশী দিনের কথা নয়। মাত্র কয়েক দিন আগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ পশ্চিম পাকিস্তানের সংগে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রসঙ্গে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন“বাংলাদেশের লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানের কবর হয়ে গেছে।” প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীনের এই উক্তির কদিন পরেই লণ্ডনের প্রভাবশালী দৈনিক ডেলী মিরর-এ প্রকাশিত A DEATH OF A NATION শিরোনামের একটি মর্মস্পর্শী রিপোটে বাংলাদেশে পাক বর্বরতার লোমহর্ষক বিবরণ দিয়ে এই একই মন্তব্য করা হয়। এর আগে লেবানিজ দৈনিক “আল সাব’ পত্রিকায় প্রকাশিত ARTIFICIALLLY CREATED PAKISTAN IS UNFIT TO CONTINUE শিরোনামের রিপোর্টটিতেও এই একই মন্তব্য করা হয়। তারপর গত সপ্তায় প্রকাশিত প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী NEWSWEEK- এ প্রকাশিত THE TERRIBLE BLOOD BATH OF TIKKA KHAN শিরোনামের রিপোর্টে পাকিস্তানীদের বীভৎস হত্যাযজ্ঞ, ব্যাভিচার, নির্যাতন ও ধ্বংসলীলার বিবরণ দিয়ে মন্তব্য করা হয় যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের কবর হয়ে গেছে। পাকিস্তান ভেঙে দু টুকরো হয়ে যাচ্ছে। এ ভাঙ্গন জোড়া দেয়ার নয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব ঘটনা। চলতি সপ্তাহে নিউজউইক লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তান যেদিন বাংলাদেশে সৈন্য পাঠিয়েছে সেই দিনই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে।

সম্প্রতি কানাডীয় পার্লামেন্টের তিনজন প্রভাবশালী সদস্য বাংলাদেশ থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া সর্বহারা শরণার্থীদের অবস্থা এবং বাংলাদেশে পাক বর্বরতার নমুনা দেখার জন্যে শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।

শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শন করে গিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা বলেছেনঃ “পূর্ব পাকিস্তান’- এই নামে কোন রাষ্ট্র-রাষ্ট্রাংশের অস্তিত্ব আর নেই। বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য।

সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ এ কথা জোর দিয়ে বলেন, আমরা একটি গণতান্তিক দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধি। নির্বাচন ও গণতন্ত্রের উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আর এই আস্থা বলেই আমরা মনে করি বাংলাদেশের গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। কানাডীয় পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের নেতা, কানাডার ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির মিঃ জর্জের লাচসি সাংবাদিকদের বলেনঃ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার দাবী জানিয়ে অন্যায় কিছু করেননি। তিনি বলেন, কানাডার অনেক পরিষদ সদস্যই তো কুইবেক-এর বিছিন্ন হওয়ার দাবী তুলেছেন। এটা গণতান্ত্রিক অধিকার। অতএব এই গণতান্ত্রিক অধিকার তোলার জন্যে কাউকে অপরাধী বলে গণ্য করা উচিত নয়।

শরণার্থী শিবিরগুলি পরিদর্শনের পর কানাডীয় প্রতিনিধিগণ বলেনঃ এটা এখন পরিষ্কার যে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বলেন, এটা এই শতাব্দীর সবচে কলঙ্কজনক অধ্যায়। শুধু কানাডার জনসাধারণের নয়, বিশ্ববাসী বিশেষ করে কমনওয়েলথ দেশসমূহের মানুষের যা কিছু করণীয় আছে আমরা তা অবশ্যই তুলে ধরবো।

তাঁরা বলেন, পাকিস্তান, ভারত ও কানাডা সকলেই কমনওয়েলথের সদস্য। কমনওয়েলথের একটি সদস্যরাষ্ট্রের সমরনায়করা বাংলাদেশকে ও বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করবে তা কোনমতেই সহ্য করা যায় না।

কানাডীয় পরিষদের এই তিনজন সদস্য হলেন ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির মিঃ জর্জেস লাচসি, মিঃ এ বিউইন ও মিঃ হিথ নেলসন। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার কারাকাস থেকে প্রকাশিত খৃষ্টীয় বিশ্বের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য রিলিজিয়ন’ পত্রিকায় বলা হয়ঃ পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশে যে নারকীয় বর্বরতায় লিপ্ত হয়েছে তা দেখলে যীশুখৃষ্ট নিজেও ভয়ে শিউরে উঠতেন।

পাক হানাদারদের এই পৈশাচিকতার কঠোর সমালোচনা করে ‘দ্য রিলিজিয়ন’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলামে বলা হয়ঃ পাক সামরিক সরকার বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে ঘরোয়া ব্যাপার বলে চালাতে চেষ্টা করে বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদেরই চূড়ান্ত অপমান করেছে। বস্তুতঃ এই সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং মানববিবেকের প্রতি এটা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।

১৪ জুলাই, ১৯৭১

… গত ১২ই জুলাইয়ে প্রকাশিত মার্কিন সাময়িকী নিউজইউক-এ বলা হয়ঃ পাকিস্তান যেদিন বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালানোর জন্যে সৈন্য পাঠায় সেই দিনই পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে।

নিউজউইক’ পত্রিকায় বলা হয়ঃ ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযান চালানোর জন্যে বাংলাদেশে যখন সৈন্য ও সমরসম্ভার পাঠানোর কাজে ব্যস্ত ছিলো ঠিক সেই সময় পাকিস্তানের ঘরে-বাইরে সবদিক থেকেই রাজনৈতিক সমাধানের দাবী উঠছিলো। ইয়াহিয়ার সামরিক প্রস্তুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠছিলো। দাবী উঠছিলো- পাকিস্তানের যে সঙ্কট তার সমাধান সমরসজ্জা বা সামরিক অভিযানে সম্ভব নয়। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। কোন রকম শর্ত আরোপ না করে গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই সমাধান নিহিত রয়েছে। বুলেট-বেয়োনেটে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র ঘরে-বাইরের এই দাবী উপেক্ষা করে পাকিস্তানের গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল করে বাংলাদেশের ওপর সামরিক অভিযান চালালো৷….

নিউজউইক উল্লেখ করেঃ গত সপ্তাহে ঢাকায় কয়েকজন বিদেশী কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন, আপোষ আলোচনার আর কোন পথই খোলা রইলো না। ইয়াহিয়ার গোঁয়াতুমির জন্যে আলোচনার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। আলোচনা এখন আর সম্ভব নয়। পাকিস্তান মরে গেছে এবং ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্রই পাকিস্তানকে ধ্বংস করেছে।

 

১৫ জুলাই, ১৯৭১

… পাকিস্তানকে উন্নয়ন সাহায্য দেওয়ার মত আদৌ কোন অবস্থা রয়েছে কিনা তা সরেজমিনে তদন্ত করার জন্যে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফলকরে ফিরে গিয়ে তাঁরা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন।

এই রিপোর্টে বলা হয়েছেঃ বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে এসে বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রতিনিধিদল তাঁদের রিপোর্টে এই একমাত্র সিদ্ধান্ত করেছেন যে, পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করা

হোক। কারণ, এখন পাকিস্তানে যে কোন আন্তর্জাতিক সাহায্যই দেয়া হোক না কেন তা সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে।

রিপোর্টে তারা বলেছেনঃ বর্তমানে পাকিস্তানকে কোন রকম আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া যাবে না। এমন কি পাকবাহিনী বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্যে যদি কোন আন্তর্জাতিক সাহায্য পাঠানো হয় তাহলে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার সেই সাহায্যকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোন সাহায্যই গিয়ে পৌঁছুবে না। বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানকে কোন রকমের আন্তর্জাতিক সাহায্য দিলে ইয়াহিয়া সরকার তা পশ্চিম পাকিস্তানেই পাচার করবে। অতএব পাকিস্তানকে কোন রকম আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া যেতে পারে না। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফরকারী বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রতিনিধিদলের GREİ Mr. I. P. M. CARGILL এই রিপোর্ট প্রস্তুত করেছেন Mr. I. P. M. CARGILL বিশ্ব ব্যাঙ্কের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের ডিরেক্টর।

Mr. CARGILL তাঁর রিপোর্টে লিখেছেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের ব্যাপকতা এত বেশি হয়েছে যে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক জীবনধারা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এখন এক ভয়াবহ আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

Mr. CARGILL তাঁর রিপোটে লিখেছেনঃ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের বিরুদ্ধে যে এখনও সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে, সেখানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে তাঁরা যে এখনও চরম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, হত্যা, লুণ্ঠন ও ব্যাভিচারে তারা যে এখনও সমান তৎপর রয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধেই হোক অথবা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধেই হোক, সামরিক গভীর আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। মুক্তিসেনাদের হাতে প্রচণ্ড মার খাচ্ছে পাক সেনারা, আর তারই প্রতিশোধ তারা গ্রহণ করছে সাধারণ মানুষের ওপর।

সংক্ষেপে, বাংলাদেশের প্ররিস্থিতি এখন দারুণ উদ্বেগজনক। স্বাভাবিকতার নাম-গন্ধ নেই। বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে পাকিস্তানী সামরিক সরকার যে দাবী করছে Mr. CARGILL তাঁর রিপোর্টে তার কঠোর সমালোচনা করে বলেনঃ সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা, সৈন্য প্রত্যাহার করা ও বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে না।

১৮ জুলাই, ১৯৭১

কিছুটা বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বজনমত আজ এক নতুন ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে বর্বর সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন ও পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি স্বার্থান্বেষী মহল ও ইয়াহিয়া চক্র সর্বাত্মক মিথ্যা ও অপপ্রচার ছড়িয়ে যে বিভ্রান্তির কালো ধোঁয়া ছড়িয়েছিলো বিশ্বমানবতা ও বিশ্ববিবেকের নবতর অভু্যদয়ের আলোকচ্ছটায় তা দ্রুত কেটে যাচ্ছে। বিশ্বের দেশে দেশে আজ ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও অমানুষিক নির্যাতনের খবর পৌছে গেছে। বাংলাদেশে পাক বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার পেছনে কোন দুরভিসন্ধি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করেছে বিশ্বের মানুষের কাছে তা আজ অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বের বহু দেশ আজ আমাদের প্রকাশ্যভাবে সমর্থন জানাচ্ছে। কানাডা, পশ্চিম জার্মানী, সুইডেন, স্ক্যাণ্ডিনেভীয় দেশসমূহ এবং আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সংক্রান্ত প্রশ্নটি জাতিসংঘে তোলার জন্যে

উদ্যোগী হয়েছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রশ্নটি জাতিসংঘে উত্থাপনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও গণহত্যার অপরাধ সম্পর্কে পাকিস্তানের কোন বক্তব্য যে থাকতে পারে না তা ধরে নেয়া হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, সমাজসেবী, কূটনীতিক, পর্যটক ও বিশ্বসংস্থাসমূহের যেসব প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন তাদের রিপোর্ট ও প্রামাণ্য তথ্যাদি থেকে এটা আজ অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, পাক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা ও বর্বরতার অপরাধে অপরাধী। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠলে পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যার অপরাধে অপরাধী হানাদার বলে চিহ্নিত হবে এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশও বিশ্ব সংস্থার সমর্থন এবং স্বীকৃতি লাভ করবে।

সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ফ্রান্স এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে যে, সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে কোন অবস্থাতেই তারা পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করবে না। অর্থাৎ, ফ্রান্স ও ব্যাঙ্কের যে প্রতিনিধিদলটি গত ৩রা জুন থেকে ২১ শে জুন পর্যন্ত উনিশ দিন ধরে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন তারা বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনাবলী ফাঁস করে দিয়েছেন। তারা বলেছেন পরিস্থিতি আদৌ স্বাভাবিক নয়। সেখানে সর্বত্রই ধ্বংসের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে, পাক হানাদার সৈন্যরা এখনও বাংলাদেশের ওপর হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ছাড়া এইড কনসর্টিয়ামভুক্ত সব দেশই পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সফর করে গিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতনিধিদলের নেতা তাঁর দলের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে একমত হয়ে একথা তো স্পষ্টই ঘোষণা করেছেন যে, পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া অর্থহীন হবে এবং পাকিস্তানকে এখন যে কোন সাহায্যই দেয়া হোক, ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার তা সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে, ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীকে সমর সম্ভার ও অর্থ সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করলেও আমেরিকান জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার-টেলিভিশ ও বহু জননায়ক বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনাবলী প্রকাশ করে বাংলার জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। মার্কিন সংবাদপত্রসমূহ খোলাখুলিভাবেই বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকারী নীতির কঠোর সমালোচনা করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’, ‘ইভিনিং ষ্টার প্রভৃতি প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকাগুলিতে মার্কিন সরকারী নীতির কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ঋণদানকারী রাষ্ট্রগুলির উচিত পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য বন্ধ করে দেয়া। ভারতে নিযুক্ত প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত Mr. Chester Bowles পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য প্রেরণের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, মার্কিন সরকারের এ ভুলের কোন তুলনা হয় না। মার্কিন সরকারের এটা শুধু ভুল নয়, এটা একটি ক্ষমাহীন অপরাধ- ইতিহাস এ অপরাধ কোন দিনই ক্ষমা করবে না।

২০ জুলাই, ১৯৭১

… ডাবলিন থেকে প্রকাশিত “আইরিশ টাইমস’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ ইয়াহিয়া তার বেতার ভাষণে যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের বা যে রাজনৈতিক রদবদলের প্রস্তাব করেছে তা জঘন্য। ইয়াহিয়া তার বেয়োনেট-উদ্যত সেনাবাহিনী দিয়ে আটক দেশবাসীর উদ্দেশে যে বক্তৃতা করেছে তাতে তার দেশ গোল্লায় যাবে। বাংলাদেশ থেকে যে সকল নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সেনাবাহিনীর অত্যাচারে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে তারা কেউই এ প্রস্তাবে দেশে ফিরে আসতে পারে না। ক্ষমতা হস্তান্তরের যে পদ্ধতির কথা ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছে তা দুরভিসন্ধিমূলক। দশ লক্ষ বাঙালীকে নির্বিচারে হত্যা করে গোটা বাংলাদেশটাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়ে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের কিছু অংশের ওপর তথাকথিত দখল রেখেছে সত্যি, কিন্তু এই দখল

রাখতে গিয়ে তাদের যে কী পরিমাণ দিতে হচ্ছে তা একমাত্র তারাই জানে। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশে সরকারের অধীনে নিয়মিত সেনাবাহিনী গড়ে উঠছে। সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছেন। বাংলাদেশের সর্বত্রই এখন গেরিলা যুদ্ধ চলছে- শুধুমাত্র তাই নয়, ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীতেও গণ্ডগোল শুরু হয়েছে।

‘আইরিশ টাইমস’ পত্রিকায় আরও বলা হয় যে, বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে সামরিক সমাধানের পথ বেছে নিয়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে। বর্তমানের এই দারুণ সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে পারে না। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী ও সরকার যেখানে আজও হত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতন সমানে চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। এখনও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। ভারতে এভাবে লাখ লাখ শরণার্থ ঠেলে দিয়ে ইয়াহিয়া সরকার প্রকৃতপক্ষে ভারতের অর্থনীতিকে দুর্বল করতে চাইছে। পত্রিকায় বলা হয়ঃ বাংলাদেশ সমস্যার প্রকৃত সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ অবনতির দিকেই যাবে এবং তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।

স্টকহোম থেকে প্রকাশিত সুইডিশ দৈনিক, DOGENS NYHETER-এর এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে পাকিস্তানকে বাংলাদেশে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করে বাংলাদেশের জনগণের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বলা হয়।

‘ডগেনস নিহিতের পত্রিকার এই সম্পাদকীয় নিবন্ধটিতে ইয়াহিয়ার সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়ঃ বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা বর্তমানে চরমে পৌছেছে। এখনও বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ শরণার্থী সৈন্যদের তাড়া খেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

পত্রিকায় বলা হয়ঃ বাংলাদেশে সামকি বর্বরতা সবকিছুর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে গিয়ে কিছু সময় দাঁড়ালেই ইয়াহিয়ার স্বাভাবিক পরিস্থিতির দাবীর অসারতা সহজেই ধরা পড়েবোঝা যায় ইয়াহিয়া সরকারের মিথ্যা প্রচারণার বহর।

২৩ জুলাই, ১৯৭১

… সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন থেকে প্রকাশিত ‘মেইল পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে এক দীর্ঘ রিপোর্ট বেরিয়েছে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ফ্রিটাউন দৈনিকের সংবদদাতা Mr. SOM SHORT প্রশ্ন করেছেনঃ বাংলাদেশে যা ঘটেছে তার চেয়ে বেশি কিছু কি ঘটতে পারতো?

তিনি লিখেছেনঃ বাংলাদেশে যে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে, তা বোঝার জন্যে বা তা বিশ্বাস করার জন্য এর চেয়ে বেশী প্রমাণের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের ঘটনাবলী স্বচক্ষে দেখে ফ্রিটাউন দৈনিক মেইল-এর সংবাদদাতা Mr. SOM SHORT বলেন, পাকিস্তান সরকারের নীতি ও কার্যকলাপের পশ্চাতে যে একটা ভীষণ ষড়যন্ত্র বা ভয়াবহ একটা কিছু আছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। তিনি লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানীদের বর্বরতা ক্রমে বেড়েই চলেছে, যুদ্ধ যতো দীর্ঘস্থায়ী হবে বাংলাদেশে ধ্বংস ও মৃত্যু ততো বেড়ে যাবে। পৃথিবীর সকল দেশের মানুষই তো এখন এখানকার ঘটনাবলীর অল্পবিস্তর জানতে পেরেছে কিন্তু তবু আমরা আমাদের নিজ নিজ দেশের সরকারকে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বাধ্য করতে পারছি না কেন?- এই রক্তমানের কি কোন শেষ নেই?

২৯ জুলাই, ১৯৭১

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করার যতো অপচেষ্টাই পাকিস্তানী সামরিক চক্র করুক, কিন্তু যা সত্য তাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতই বাংলাদেশের ঘটনাবলীর খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে।

আমেরিকান বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক নিউজউইক’ ও লণ্ডনের প্রভাবশালী দৈনিক দি টাইমস’-এ বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের মোকাবিলায় মুক্তি বাহিনীর সাফল্যজনক অভিযান পরিচালনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এবং তথাকথিত দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীদের নির্মুল করা হয়েছে বলে যে দাবী করেছেন, সে প্রসঙ্গে ‘The Bengalis Strike Back’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে নিউজউইক’ পত্রিকা বলেঃ ইয়াহিয়ার জন্যে দুঃখ হয়, কেননা তিনি যা দাবী করেছেন প্রকৃত ঘটনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। পত্রিকায় বলা হয় যে, সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধ অভিযান ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এ অভিযান গোড়া থেকেই পরিচালিত হচ্ছে এবং উন্নত সমরসজ্জায় সজ্জিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চরমভাবে ঘায়েল হচ্ছে।

‘নিউজউইক’ বলেঃ বাংলাদেশের বহু কলকারখানা ধ্বংস করা হয়েছে, ডিনামাইট দিয়ে প্রধান প্রধান ব্রীজসমুহ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, মাইন বসিয়ে বহু রেল সড়কের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে

পত্রিকায় বলা হয়, সামরিক বাহিনী অধিকৃত ঢাকা শহরেও নিয়মিত গোলাগুলি চলছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জাগ্রত মুক্তি সংগ্রামীদের অভিযান বাংলাদেশের সর্বত্রই অব্যাহত রয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল সফরকারী নিউজউইকের সংবাদদাতা মিঃ লোরেন জেনকিনস এখানে মুক্তিবাহিনীর হাতে খুলনার দু’জন দালালের ‘লালরঙা চিঠি’ প্রাপ্তি এবং কড়া সামরিক পাহারাধীন থেকেও শোচনীয় মৃত্যুর খবর জানান।

লণ্ডন টাইমসের রিপোর্টার মাইকেল হর্নসবী জানান যে, বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অহরহ মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা রাস্তা, রেলওয়ে ব্রীজ, রেললাইন এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার ক্ষতিসাধন করে পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

লণ্ডন টাইমসের সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশের সকল শহর বিশেষ করে ঢাকা শহরে গেরিলাদের পাক বাহিনীর ওপর বোমা নিক্ষেপ করছে।

হর্নসবী জানান যে, গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ পাক বাহিনী আশপাশের এলাকার বেসামরিক বাসিন্দাদের ওপর উৎপীড়ন করে থাকে।

বস্তুতঃ বাংলাদেশের পাক বাহিনী অধিকৃত এলাকায় এমনি প্রশাসনিক অচলাবস্থাই বিরাজ করছে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণে পাক সেনারা এখানে-ওখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দিন দিনই হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে।

এই বাস্তব সত্যকে গোপন করার মতো অপচেষ্টাই পাকিস্তানী জঙ্গী সরকার করুক, বিশ্বের চোখে ধরা পড়বেই। আর এভাবে বাংলার সার্বিক মুক্তিকামী মানুষের সপক্ষে গড়ে উঠবে বিশ্বজনমত।

১ আগষ্ট, ১৯৭১

… বর্তমানে ক্ষমতার লোভে উন্মত্ত ইয়াহিয়ার সৈন্যদের অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার ও দাপট যতই বাড়ছে এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা যতই জোরদার হচ্ছে ততই বিশ্ববাসী আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের সপক্ষে ততই গড়ে উঠছে বিশ্বজনমত।

ইতিমধ্যে জঙ্গীশাহীর অনেক বাধাবিপত্তি সত্বেও বহু বিদেশী সাংবাদিক, সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ যুদ্ধক্ষত বাংলাদেশ সফর করেছেন।

আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির প্রতিনিধি কর্নেল আ্যালা সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে তাঁর সফর অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন বায়াফ্রার মর্মান্তিক ঘটনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। দখলকৃত এলাকায় হানাদার সৈন্যরা যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড ও পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তার কোন নজির নেই। নরওয়ে রেডক্রসের একজন প্রতিনিধি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে বলেছেন, বর্তমান শরণার্থী সমস্যার সাথে বিশ্ব ইতিহাসের অন্য কোন ঘটনার তুলনা করা যায় না।

একটি স্বাধীন দেশে দখলদার সৈন্যরা কতো বেশি নির্যাতন চালিয়ে গেলে ৮০ লাখ মানুষকে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তি ফেলে দেশত্যাগ করতে হয় তা সকলেই বোধগম্য।

এহেন অবস্থায় বাংলাদেশে যখন মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই- মানবতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা যখন বিপর্যস্ত, সে ক্ষেত্রে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দুটি বৃহৎ শক্তি একনাগাড়ে পাকিস্তানের সামরিকশাহীকে অস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য করে গণহত্যার উস্কানি দিচ্ছে।

মার্কিন জনগণ ও সেখানকার পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন জঙ্গীশাহীকে অস্ত্র সাহায্যের নীতিতে অবিচল রয়েছেন। তাঁরা সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গী সরকারকে সাহায্য দেয়ার মানেই হচ্ছে গণহত্যায় অংশ গ্রহণ করা। তা ছাড়া যুদ্ধের ফলে যেক্ষেত্রে বাংলাদেশে তিন কোটিরও রীতিমত যুদ্ধাপরাধ।

এদিকে ওয়াশিংটনের ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের আণ্ডার সেক্রেটারী জন আরউইন সিনেটের এক সাব-কমিটির বৈঠকে বলেছেন যে, বাংলাদেশে দারুণ দুর্ভিক্ষের খবর তাঁরা পেয়েছেন। অথচ পাকিস্তানের দখলদার সমরকর্তারা দুর্ভিক্ষ রোধের কোনো চেষ্টা চালাচ্ছে না। এতে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, দেশ থেকে ৮০ লাখ মানুষকে তাড়িয়ে এবং ১০-১২ লাখ মানুষকে হত্যা করেও এদের কসাই বনোবৃক্তির এখনো খায়েশ মেটেনি।

এমনি মর্মান্তিক অবস্থায় জাতিসংঘ আবার বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক নিয়োগের পাঁয়তারা করছে। অথচ গত চারমাস যাবৎ জাতিসংঘ বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারও বাংলাদেশ-সমস্যাটিকে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ হিসাবে দেখাবার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মুজিবনগরে প্রদত্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ জঙ্গশাহীর এ ধরনের নির্লজ্জ অপকৌশলকে পাকিস্তানের ভ্রান্ত পদক্ষেপ” বলে আখ্যায়িত করেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ বলে সহানুভূতিশীল বিশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চরম মার খেয়ে পাকিস্তানের অপরিণামদশী জঙ্গী কর্মকর্তারা আজকাল জাতিসংঘের ভিতরে ও বাইরে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে বাংলাদেশে তাদের কৃতকর্মের কালিমা মোচনের ব্যর্থ চেষ্টা করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কাজেই বাংলাদেশ সমস্যাটি হচ্ছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বিরোধ। এ বিরোধ যত শ্ৰীঘ্ৰ মিটমাট হবে ততই সাড়ে সাত কোটি মানুষের কল্যাণ তুরান্বিত হবেবাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের মনে ফিরে আসবে শান্তি ও আস্থার মনোভাব।

বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশন সংস্থাও সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জীবনের নিরাপত্তার জন্যে বাংলাদেশ সমস্যার আশু সমাধানের উপর জোর দিয়েছেন। এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, বাংলাদেশের প্রকৃত গণপ্রতিনিধিরাই দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে এবং লাখ লাখ শরণার্থীকে

১৫ আগস্ট, ১৯৭১

… গত ২৫শে মার্চ থেকে ইয়াহিয়ার বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশে যা করেছে সমস্ত বিশ্ব তাতেই হতবাক হয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বর্ণিত মানব ইতিহাসের সেই সর্বাধিক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনার পর এবং মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বর্ণিত মানব ইতিহাসের বৃহত্তম বিপর্যয় সৃষ্টির এনে সামরিক আদালতে বিচার প্রহসন শুরু করেছে। এই বিচার প্রহসনের পিছনে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের যে ঘৃণ্য উদ্দেশ্য ও দুরভিসন্ধি রয়েছে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলাদেশে পাক সামরিক চক্রের বর্বরতা ও বীভৎসতার দৃষ্টান্তে এটাই মনে হয় যে, ইয়াহিয়া ও তার নয়া নাৎসী বাহিনী করতে পারে না এহেন কিছু নেই।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী মিঃ ট্রুডো পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে এক তারবার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এর পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও অন্যান্য দেশের পত্র-পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনেও পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারে দারুণ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

লণ্ডনের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলিতে মন্তব্য করা হয়েছে যে, যেভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু হয়েছে তাতে পাক সামরিক চক্রের ওপর আদৌ ভরসা করা যায় না। লণ্ডনের টাইমস’ ইয়র্কশায়ার পোষ্ট ও অন্যান্য সংবাদপত্রে এই তথাকথিত বিচারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। বৃটেনের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীগণ এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক আইনজীবী সংস্থাও শেখ মুজিবুরের বিচার প্রহসনের জন্যে ইয়াহিয়ার বর্বর সামরিক চক্রের কঠোর সমালোচোনা করেছেন।

টাইমস’ পত্রিকায় প্রখ্যাত বৃটিশ আইনজীবী মিঃ ডব্ৰু টি, উইলিয়ামের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। এই চিঠিতে মিঃ উইলিয়াম বলেছেনঃ যেভাবে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গোপন বিচার প্রহসন শুরু হয়েছে তাতে তিনি ও বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন সকল মানুষ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, যেভাবে এই তথাকথিত বিচার চলছে তাতে কোনক্রমেই শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যায় বিচার আশা করা যেতে পারে না। তিনি বলেন, একমাত্র প্রাণের ঝুঁকি ও বহু ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি ছাড়া কোন বাঙালী কৌশুলিই শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থনে যাবেন না। মিঃ উইলিয়াম বলেন, আইয়ুবের আমলে সুপ্রিম কোর্টের রায় লঙ্ঘন করে সামরিক সরকার শেখ মুজিবুর

রহমানের বিচার শুরু করেছিলো। ভয়ঙ্কর ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র সেই একই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিচারে প্রহসন শুরু করেছে। তিনি বলেন, পাক সামরিক চক্ৰ মূঢ়তার বশে মিথ্যা অভিযোগ শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি কোনরকম দণ্ড দেয় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।

গত শুক্রবারে ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ মিথ্যা অভিযোগ তুলে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা এক মারাত্মক ভুল করেছে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যদি এই তথাকথিত বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড দেয় তাহলে সেটাই হবে সবচে মারাত্মক ভুল আর সেই ভুলের কোন সংশোধনের পথ থাকবে না।

১৬ আগষ্ট, ১৯৭১

… পৃথিবীর দেশে দেশে শানিকামী মানুষ দেশবরেন্য জননেতা, বুদ্ধিজীবী সমাজ, বেতার টেলিভিশন ও সংবাদপত্র পাকিস্তানী নরঘাতী তস্করদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে।…

জাতিসংঘের জনৈক মুখপাত্র গত শুক্রবারে বলেছেন যে, পাকিস্তানী সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার প্রহসনের ব্যাপারে সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন এবং এ ব্যাপারে তিনি আলোচনা চালাচ্ছেন।

গত শুক্রবারে ‘ওয়াশিংটন ষ্টার’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের মূঢ় সামরিক চক্র এক প্রচণ্ড ভুল করে বসেছে। ইয়াহিয়া আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের একথা বোঝা উচিত যে নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা প্রশ্নাতীত।

ক্রীশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা। আজও তিনি বাংলার নয়নমণি। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর হৃদয়ে আজও তিনি সদ্য প্রস্ফুটিত রক্তপদ্ম। পাকিস্তানের জঙ্গী সামরিক চক্র বিচার প্রহসনের দ্বারা যদি তার কিছু করে, তাহলে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে যে চিরতরে বিদায় হবে তা নয় বরং মূল পাকিস্তানটাই চূর্ণ হয়ে যাবে।

যুগোশ্লাভ বৈনিক “বলগ্রেড বোরবা” পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের  বিচার প্রহসন করতে গিয়ে ইয়াহিয়া তার নিজের সমস্যার সমাধানের সকল পথই রুদ্ধ করেছে। এখন অন্ধকারে মাথা কুটে মরা ছাড়া তার আর দ্বিতীয় কোন পথ নেই।

জেনেভার ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস’-এর সদর দফতর থেকে ইসলামাবাদে একটি তারবার্তা পাঠানো হয়েছে। এই তারবার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

‘জাকার্তা টাইমস’-এ বলা হয়ঃ শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় নেতা। তার বিচার ভুল ঘোড়ায় বাজি ধরেছে।

১৮ আগষ্ট, ১৯৭১

বিশ্ব জোড়া প্রতিবাদ, ঘৃণা ও কোটি ধিক্কার উপেক্ষা করে পাক সামরিক চক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন অব্যাহত রেখেছে …..

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঝানু আণ্ডার সেক্রেটারী ও প্রাক্তন রাষ্টদূত মিঃ চেষ্টার বোলস শেখ মুজিবুর আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের যে গোপন বিচার চালাচ্ছে তা আগাগোড়া একটি প্রহসন মাত্র। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার এটা একটা চরম ধৃষ্টতা। এ বিচার সকল রীতিনীতি ও আইন-কানুনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

মিঃ চেষ্টার বোলস পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বর্তমান নীতির কঠোরতম সমালোচনা করেন। মার্কিন সরকার পাকিস্তান সরকারকে যে সামরিক সাহায্য অব্যাহতভাবে দিয়ে চলেছে, মিঃ চেষ্টার বোলস তাকে “চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও নীতিবিগর্হিত” বলে বর্ণনা করেছেন।

সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোষ্ট’-এ তাঁর একটি তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধে মিঃ চেষ্টার বোলস বলেনঃ পাকিস্তানের ফ্যাসিবাদী সরকারকে সাহায্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক চরম ভুল করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে অতীতের সব ভুলত্রটি সংশোধন করে পাকিস্তানের কাছে সামরিক অস্ত্র ও সমরসম্ভার বিক্রয় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা এবং পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক সাহায্য দান একেবারে বন্ধ করে দেবার আহবান জানান।

পরলোকগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডীর সহোদর সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনী সৃষ্ট মানব ইতিহাসের চরম বিপর্যয় ও মানব ইতিহাসের সবচে কলঙ্কজনক অধ্যায় নিজের চোখে দেখে যাবার জন্যে বাংলাদেশের শরণার্থীদের শিবিরগুলো পরিদর্শন করে গেছেন। তিনি পাক অধিকৃত বাংলাদেশেও যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পাক বাহিনীর বর্বরতা পাছে পুরোপুরি ফাঁস হয়ে যায় সেজন্যে পাকিস্তানী সামরিক সরকার তাঁকে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশে যাবার অনুমতি দেয়নি। শুধুমাত্র সীমান্তে দাঁড়িয়ে ও শরণার্থীদের শিবিরগুলো পরিদর্শন করে তিনি যা দেখেছেন এবং যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয়েছে তা থেকেই তিনি বলেছেনঃ পাকিস্তানী সৈন্যরা যে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু বিষয়ক কমিটির সভাপতি সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেনঃ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র অপরাধ হলো তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। তাঁর বিচার আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে বিচারের ব্যাভিচার এবং ন্যায়বিচারের প্রহসন মাত্র।

আদ্দিস আবাবা বেতার থেকে প্রচারিত এক খবরে বলা হয়ঃ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্যে সারাবিশ্বে এক প্রচার অভিযান শুরু করবে।

বিশ্ব জোড়া এই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তা শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার প্রহসন অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এই প্রহসন মেনে নেয়নি। আজ বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার সর্বত্রই চলছে পাক হানাদার নিধনের দুর্বার অভিযান। মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধারা বাংলাদেশের পুণ্যভূমি থেকে হানাদারদের সমানে উৎখাত করে চলেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ হানাদার উৎখাতে বদ্ধপরিকর।

১৯ আগষ্ট, ১৯৭১

… পাকিস্তানের সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের তীব্র নিন্দে করেছেন। এই বিচার প্রহসনের কঠোর সমালোচনা করে তিনি পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে এই বলে হুশিয়ার করেছেন যে, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশে যা করছে এবং বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনে মেতে যা করতে যাচ্ছে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং এর ফলে পাকিস্তানটাই তাসের ঘরের মতো এক মুহুর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।

এয়ার মার্শাল আসগর খান এ নিয়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে পরপর দুবার হুশিয়ার করে দিলেন। এয়ার মার্শাল আসগর খানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানের আরও কয়েকজন নেতার চৈতন্যোদয় ঘটেছে। সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের কয়েকটি পত্র-পত্রিকাতেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সর্বনাশা তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।

পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর খোদ মুখপত্র ‘পাকিস্তান টাইমস’-এও শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের সমালোচনা করা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি শান্তিকামী মানুষের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে সমরাস্ত্র, সমরসম্ভার ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে এলেও মার্কিন বুদ্ধিজীবী মহল, রাজনীতিক ও শান্তিকামী মার্কিন জনগণ পাক জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে আজ প্রতিবাদমুখর। গত সপ্তাহে পাকিস্তানী জাহাজ আল-আহমদী মার্কিন সমরাস্ত্র বহনের জন্যে ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার চেষ্টা করছিলো কিন্তু সেখানে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় এবং বিক্ষোভকারীরা ছোট ছোট নৌযান দিয়ে পাকিস্তানী জাহাজের সম্মুখে অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে পাকিস্তানী জাহাজটিকে ফিলাডেলফিয়া বন্দরে ভেড়ার সংকল্প পরিত্যাগ করে বাল্টিমোরের দিকে এগুতে হয়।

শুধু ফিলাডেলফিয়া বন্দর নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই পাকিস্তানী সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ধিক্কার উঠেছে। পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী সর্বত্র লাঞ্ছিত। যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মদদ পেয়ে পাকিস্তানের গোঁয়ার সামরিক চক্র এখনও আস্ফালন করছে সত্যি কিন্তু এর শোচনীয় পরিসমাপ্তি অত্যাসন্ন।

২০ আগষ্ট, ১৯৭১

… পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান খান আবদুল ওয়ালী খান পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে এসে তাঁর বাবা খান আবদুল গফফার খানের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। কাবুলে পৌছে তিনি সেখানকার একটি ইংরেজী পত্রিকা ‘নিউ ওয়েভ’-এর সাংবাদিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেনঃ পাকিস্তানের রাজনীতি এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়পাকিস্তান ছিন্নভিন্ন টুকরো টুকরো হয়ে যাবেই। পাকিস্তানের রাজনীতি এখন যেভাবে চলছে তাতে সমূলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করার আর কোন উপায় নেই।

তিনি বলেনঃ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যা করছে তা প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতাকেও হার মানায়। তবে পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষে বাংলাদেশকে দখলে রাখা আদৌ সম্ভব নয়। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যদি মনে করে থাকে যে, চরম অত্যাচার চালিয়ে, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রেখে বাংলাদেশের বীর জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারবে তাহলে তারা চরম ভুল করবে। খান আবদুল ওয়ালী খান বলেনঃ তুচ্ছাতিতুচ্ছ পুঁচকে পাকিস্তানের পক্ষে বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশকে কব্জায় রাখা কি করে সম্ভব? পাকিস্তানের আর্থিক ও সামরিক বাজেট এখনও যেখানে বাংলাদেশের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল, সেখানে জয়লাভের কথা চিন্তাও করা যায় না।

পশ্চিম পাকিস্তানী ন্যাপ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান বলেনঃ ধৰ্ম যে ভিন্ন সংস্কৃতির দুটি জাতির রাষ্ট্ৰীয় বন্ধন হতে পারে না, তা চিরকালের মত প্রমাণিত হয়ে গেল। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় বন্ধন বলে যারা ভাবতো এবার তাদের মোহমুক্তি চিরদিনের মতো ঘটে গেল। তিনি বলেনঃ আমার কাছে বাঙালীদের প্রতিরোধ আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই।

বাংলাদেশে ইয়াহিয়া আর তার বর্বর সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান শুরু হবার দুদিন আগে পর্যন্ত খান আবদুল ওয়ালী খান ঢাকায় ছিলেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠনের একমাত্র অধিকারী তিনিই ছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক চক্র তাঁর আইনসঙ্গত অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখার যে ক্ষীণতম সম্ভবনা ছিলো, পাকিস্তানী সামরিক চক্র তাকেও বেয়োনেট বিদ্ধ করেছে। পাকিস্তান টুকরো টুকরো হবেই- তাকে কেউ রোধ করতে পারবে না। অথচ এমনটি হয়তো এতো তাড়াতাড়ি ঘটতো না। পাকিস্তানী সামরিক চক্রের মাথায় গোবর বোঝাই না হলে খুব সহজে এমনটি ঘটতো না। তারা যদি জনগণের রায়কে মনে নিত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে স্বীকার করে নেয়া হতো তাহলে পাকিস্তানকে আরও কয়েকটা দিন টিকিয়ে রাখা যেতো। কিন্তু তা এখন আর কিছুতেই সম্ভব নয়। গত ২৫শে মার্চের রাতেই ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী সেই সম্ভাবনাকে খুন করেছে।

পিণ্ডির বর্তমান পরিস্থিতির উল্লেখ করতে গিয়ে খান আবদুল ওয়ালী খান একটি উপমা দিয়ে বলেনঃ ‘দুধের কলসী ভেঙ্গে গেছে। দুধ চারদিকে গড়িয়ে পড়ছে। আর তার চারপাশে বসে তারা কাঁদছে।”

পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ যে কেবল অন্ধকারাচ্ছন্ন তা নয়, বিপজ্জনক।

২১ আগষ্ট, ১৯৭১

… বাংলাদেশের শহরে নগরে বাজারে বন্দরে প্রতিটি পল্লীতে আজ শত্রু হননের দুর্বার লড়াই চলছে। আর এই লড়াইয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সামরিক চক্র নতুন এক ফন্দি আটলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তারা ভারত-পাকিস্তান সমস্যা বলে চিহ্নিত করে কাজ হাসিল করতে চেয়েছিলো। তারা ভেবেছিলো আমাদের দেশের এই মুক্তিযুদ্ধকে তারা যদি ভারত-পাকিস্তান বিরোধ বলে চিহ্নিত করতে পারে তাহলে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি আজ যে বিশ্ব জনমত গঠিত হয়েছে তাকে বিভ্রান্ত এবং বাংলাদেশে আজ যে দুর্বার লড়াই চলছে, তাকে কিছুটা প্রশমিত করা যাবে। পাকিস্তানী সামরিক চক্র এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার সীমান্তে এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উস্কানিমূলক তৎপরতা শুরু করলো। কিন্তু বিশ্বের সচতেন মানুষ পাকিস্তানী সামরিক চক্রের এই দুরভিসন্ধিটা বুঝে নিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে এমন কি প্রয়োজন হলে সংঘর্ষ একটা বাধিয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করার যে দুরভিসন্ধি তারা করেছিলো তা ভন্ডুল হয়ে গেছে।

সোভিয়েত প্রধানমন্ত্ৰী মিঃ আলেক্সী কোসিগিন পাকিস্তানী ফ্যাসীবাদী সামরিক চক্রের এই ঘৃণ্য দুরভিসন্ধির কথা জানতে পেরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের নায়ক পাকিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেনঃ সাবধান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো পাকিস্তানের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল হবে।

গত ১৭ই আগষ্ট ইসলামাবাদস্থ সোভিয়েট রাষ্ট্রদূত মিঃ এ, এ, রদিনভ জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মিঃ কোসিগিনের একটি চিঠি পৌঁছে দেন। ওই চিঠিতেই সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানী সামরিক চক্রের গোপন দুরভিসন্ধি ঔদ্ধত্যের বিষয়ে জেনারেল ইয়াহিয়াকে হুশিয়ারী প্রধান করেন। চিঠিতে তিনি ইয়াহিয়া ও তার বর্বর সামরিক চক্রকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় এই বলে হুশিয়ার করেছেন যে, তারা যেন গোঁয়ারের মতো ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আস্ফালন বা দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি না করে। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী আলেক্সী কোসিগিন ইয়াহিয়া আর তার জঙ্গী সামরিক চক্রকে বাংলাদেশে গণহত্যা ও উৎপীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে আর একপা অগ্রসর না হওয়ার জন্যে উপদেশ দিয়েছেন।

২৭ আগষ্ট, ১৯৭১

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণরক্ষার জন্য অবিলম্বে সক্রিয় ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশ্বের সকল সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বিশ্বের সকল সরকারের কাছে পাঠানো এক বার্তায় তাঁরা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেনঃ বাংলাদেশে আজ যা ঘটেছে এবং যা ঘটতে যাচ্ছে, তাকে বিশ্বশান্তি আজ দারুণ এক হুমকির সম্মুখীন। পাকিস্তানের জঙ্গশাহীকে কোনরকম সামরিক অথবা অর্থনৈতিক সাহায্যদান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্যেও তাঁরা বিশ্বের সরকারবর্গের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। হংকং-এর একটি প্রভাবশালী দৈনিক হংকং স্ট্যাণ্ডার্ড-এ শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের জন্যে পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। এই পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়ঃ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যা করতে যাচ্ছে তা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বিচার প্রহসনের পেছনে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার যে গোপন দুরভিসন্ধি রয়েছে তা বীভৎস। পত্রিকায় বলা হয়ঃ সম্প্রতি পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী ঘোষণা করেছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে একজন কৌঁসুলি নিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে কো কোঁসুলি থাক আর না-ই থাক এটা স্রেফ একটা ধাপ্পা ও প্রসহন ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ইয়াহিয়া আর জঙ্গ সরকার ইতিপূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাকতার অভিযোগ এনেছে। তারা যে ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানকে আগেভাবেই দোষী বলে ঘোষণা করছে সেখানে এই বিচার স্রেফ একটি প্রহসন ছাড়া আর কি হতে পারে? আইরিশ আইনজীবী সমিতির অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য ও রাজনৈতিক বন্দী মার্জনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার চেয়াম্যান মিঃ সিয়ান ম্যাকব্রাইড জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে লেখা এক চিঠিতে বঙ্গবন্ধু তিনি সেখানে গিয়ে তখন কিছুই করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বিচার গোপনে সামরিক আদালতে না করে প্রকাশ্যে বেসামরিক আদালতে করার দাবী জানিয়ে মিঃ ম্যাকব্রাইড বলেনঃ কোন বিদেশী আইনজীবীকে পাকিস্তানের আদালতে শেখের পক্ষ সমর্থনের অনুমতি যদি না দেয়া হয় তাহলে শেখ মুজিবুর রহমান যাতে তাঁর ইচ্ছেমতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করতে পারেন তার ব্যবস্থা যেন করা হয়। মিঃ ম্যাকব্রাইড গত মাসে তাঁর পশ্চিম পাকিস্তান সফরের উল্লেখ করে বলেনঃ শেখ মুজিবুর রহমানের লণ্ডন সলিসিটরদের অনুরোধে তিনি বাংলাদেশের নেতার পক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্য নিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানে দেখা করে শেখের বিচার যেভাবে চলছে সে সম্পর্কে দারুণ উদ্বেগ ও সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেনঃ রাজনৈতিক বন্দীদের মার্জনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান হিসাবে তিনি বিচারের কতগুলো উদ্বেগপূর্ণ দিক সম্পর্ক উল্লেখ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেনঃ সামরিক আদালতে গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানের যে বিচার চলছে তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রকাশ করা হয়নি। এর মধ্যে শুধু একটাই বলা হয়েছে যে, অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যদি তার ইচ্ছামতো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়া হয় তাহলে সে বিচার বলে গণ্য হতে পারে না।

২১ আগষ্ট, ১৯৭১

… আজ বাংলাদেশ সমস্যা একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানী শাসক চক্র শত প্রচেষ্টাতেও বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে মৃত পাকিস্তানের পচা গলিত লাশের তলায় ঢাকা দিয়ে রাখতে পারেনি। বিশ্বের সকল চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবর্গের কাছেও এই তথ্যটি আজ অজানা নয়। আর ঠিক এই কারণেই মার্কিন সিনেটের আরও একজন প্রভাবশালী সদস্য রিপাবলিকান দলের মিঃ চার্লস পার্সি মন্তব্য করলেনঃ পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। আর কোন অবস্থাতেই দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানে জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। রিপাবলিকান সিনেটর পার্সি সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা নিজের চোখে দেখে গেছেন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিম বঙ্গের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোর তিনি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি ভারতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের হোমড়া-চোমড়াদের সঙ্গেও কথা বলে দেখেছেন এবং দেখেশুনেই তিনি বলেছেনঃ এখন আর যাই হোক, একথা কল্পনাও করা যায় না যে পাকিস্তান আবার বেঁচে উঠবে। আগের অবস্থা ফিরে আসবে এ কথা চিন্তা করাও অসম্ভব। পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রত্যেক বাঙালীর মনোভাব একই রকম। বাঙালীদের কাছে পাকিস্তানীরা বিদেশী হানাদার ছাড়া আর কিছুই নয়। সিনেটর চার্লস পার্সি বলেনঃ বাঙালী জাতি আজ যে ইস্পাতকঠিন সংকল্প নিয়ে লড়াই করবে তা একটি বিরাট ও মহৎ সংকল্প। আমি আশা করি পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর নায়করা এটা উপলব্ধি করবে এবং ই উপলব্ধির উপরেই তাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে। সিনেটর চার্লস পার্সি বলেনঃ আমি পাকিস্তানী সামরিক সরকারের নেতাদের এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে, বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনে তারা যদি আর এক পা অগ্রসর হয় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। তারা যদি তথাকথিত বিচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড দেয় তাহলে পৃথিবীর কেউ-ই তাদের ক্ষমা করবে না।

২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

… বাংলাদেশ পরিস্থিতির এই ক্রমাবনতিতে পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় মানুষ আজ দারুণ উদ্বিগ্ন। বিশ্বজনতার এই উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের সাম্প্রতিক একটি বিবৃতিতে। গত ১৯শে সেপ্টেম্বরে এক বিবৃতিতে তিনি বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি এক দারুণ হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেনঃ বাংলাদেশের ঘটনাবলী বর্তমানে যেভাবে জটিল হয়ে পড়ছে সেখানকার পরিস্থিতি বর্তমানে যেভাবে দ্রুত অবনতির দিকে গড়িয়ে চলেছে এবং এর ফলে প্রতিনিয়ত যেভাবে জটিল থেকে জটিলতর সমস্যাদির উদ্ভব ঘটছে তাতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষে দারুণ উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে।… তিনি বলেনঃ বাংলাদেশ পরিস্থিতি এখন এত দ্রুত অবনতির দিকে এগিয়ে চলেছে যে, এ ব্যাপারে বিলম্ব হলে যে কোন রকমের মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে এবং তা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সীমার মধ্যে সীমিত থাকবে না। তিনি বলেনঃ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষে এটা দারুণ এক উদ্বেগের ব্যাপার। বাংলাদেশের মূল সমস্যার সমাধান আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে অবিলম্বে এগিয়ে আসবে হবে। সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বলেনঃ গত ১৯৭০ সালের নভেম্বরের সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি ঘটেছে। তারপর সেখানে শুরু হয়েছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান এবং তাতেও লক্ষ

লক্ষ মানুষের জীবনহানি ও ব্যাপক ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়েছে। তিনি বলেন, আজও বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক চক্র বাংলাদেশের তাঁবেদার সরকার খাড়া করেছে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া শরণার্থীদের দেশে ফেরার আহবান জানিয়েছে- কিন্তু এসব সত্ত্বেও সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে না, বরং প্রতিদিনই জঙ্গী সরকার যতই গলাবাজী করুক না কেন তারা সেখানে তাদের গণবিরোধী নীতি এখনও সামনে চালিয়ে যাচ্ছে।

সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট বলেনঃ বাংলাদেশ বর্তমানে দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের ফলেই এই দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকসমূহের মানুষ আজ দারুণ এক শোচনীয় অবস্থার মুখে পড়েছে। অবিলম্বে সেখানে বড় রকমের ত্রান ব্যাবস্থা চালু করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই।

৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

গত ২৮শে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদাররা যা করেছে যা করেছে এবং আজও যা করে চলেছে তার এক মর্মান্তিক বিবরণ দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিগণ পাকিস্তানের জঙ্গশাহীর কঠোর সমালোচনা করেন।

অধিবেশনের শুরুতে সোভিয়েট উইনিয়ন, সুইডেন ও ফ্রান্সের প্রতিনিধিগণ কঠোরতম ভাষায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের সমালোচনা করে বলেনঃ পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশে যা করছে এবং আজও যা করে চলেছে তা কল্পনাও করা যায় না। তাঁরা দাবী করেন, অবিলম্বে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বরতার অবসান ঘটাতে হবে। তাঁরা বলেছেনঃ বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে পাকিস্তানী সরকারী প্রচারযন্ত্র যতই বিভ্রান্তির জাল বুনুক সেখানকার প্রকৃত ঘটনাবলী আজ আর কারও অজানা নয়। পাকিস্তানী সামরিক সরকার বা সেখানকার জান্তা যা-ই বলুক না কেন সেখানে যা ঘটেছিলো তা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ বা বিশেষ কোনো দাবীভিত্তিক আন্দোলন নয়। তা ছিলো বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন-মরণের আন্দোলন। আর অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই বাংলাদেশের মানুষ তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী নিও-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনই শুরু করেছিলো। গত ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ যে অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করেছিলো পাকিস্তানী হানাদাররা তা মেনে নিতে পারেনি। তাদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র অপরাধ হলো নির্বাচনে তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের ঔপনিবেশিক স্বার্থে আঘাত লাগার জন্যেই তারা বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সুইডেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েট প্রতিনিধিগণ গভীর আশংকা প্রকাশ করে বলেন যে, অবিলম্বে বাংলাদেশ সংকটের সমাধান না করা হলে তা এক মহাপ্লাবী দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে এবং তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।

সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ ক্রিসটার ভিকম্যান বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী যা চালাচ্ছে তা কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। দেশমাতৃকার বুক থেকে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে হটিয়ে দেবার জন্যে বাংলাদেশের মানুষ আজ পাল্টা আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশের পাক অধিকৃত এলাকার সর্বত্রই দুর্বার লড়াই চলছে এবং এ লড়াইয়ের পরিণতি বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে দারুণ বিপজ্জনক। মিঃ ক্রিসটার ভিকম্যান এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশে মান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এবং বাংলাদশের মানুষের পূর্ব নিরাপত্তার ব্যাপারে অবিলম্বে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সচেষ্ট না হলে এ সংকট বহু দূর গড়াবে।

ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস সু্যম্যান বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী বাংলাদেশ সংকটের সমাধান করতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশের সংকট আরও বিস্তার লাভ করবে।

২ অক্টোবর, ১৯৭১

বাংলাদেশে সাধারন মানুষের উপর পাকিস্তানী হানাদারদের অমানুষিক অত্যাচার ও বর্বরতার মর্মান্তিক দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে ঢাকায় বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধি মিঃ টাইগারম্যান পদত্যাগ করেছেন।

মিঃ টাইগারম্যান গত ছ’বছর ধরে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাঙ্কের একজন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তিনি গত ডিসেম্বর মাসে শিকাগো গিয়েছিলেন। মিঃ টাইগারম্যান একজন মার্কিন নাগরিক। তিনি শিকাগো থেকে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন।

মিঃ টাইগারম্যান বলেনঃ বাংলাদেশ অত্যন্ত পরিচিত দেশ। এদেশে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধি হিসাবে যোগদানের পর এখানকার প্রতিটি জিলা প্রতিটি শহর-বন্দরে গ্রামে-গঞ্জে আমি ঘুরেছি। ঘুরেছি একবার নয়, বার বার। বাংলাদেশের জেলাগুলোয় তিনি এ পর্যন্ত ঘুরেছেন ১৮ বার।

গত ৮ই সেপ্টেম্বরে আবার তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন তখন তিনি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বলেনঃ বিমান থেকে নেমেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার সেই পরিচিত ঢাকা বিমানবন্দর এ যেন নয়। এ যেন বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কোন বিমান ঘাঁটি। বিমান বন্দরে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলোকে প্রস্তুত হয়ে থাকতে দেখলাম। দেখলাম বিমানবন্দরের চারিদিকে অসংখ্য বিমানবিধ্বংসী কামান। টার্মিনাল ভবনের ছাদে, জানালায় আর চিলতে ছাদ বা বারান্দাগুলোয় দেখলাম বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার করা হয়েছে এবং সেখানে সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্যরা বিমানবিধ্বংসী কামান, মেশিনগান ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেল তাক করে আছে যেন এখুনি কিছু ঘটবে বা ঘটতে যাচ্ছে। আগে যেখানে বিমানবন্দরের পূর্বপাশে রাস্তায় প্রাচীরের ধারে এবং ডমেষ্টিক ও ইন্টারন্যাশনাল উইংসের টার্মিনাল ভবনে হাজার হাজার দর্শনার্থীকে দেখতাম লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে এখন সেক্ষেত্রে একজন অসামরিক ব্যক্তিকেও দেখলাম না। আগে বিমানবন্দরে যেসব অসামরিক কাষ্টম ও ইমিগ্রেশন বিভাগের কর্মচারীদের দেখতাম, তাদের কাউকেই দেখলাম না। হয় তাদের সবাইকে গুলি করে মারা হয়েছে, অথবা তারা প্রাণভয়ে এ শহর ছেড়ে পালিয়েছে। বিমানবন্দরে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরাই সবকিছু করছে। বিমানবন্দরে যেসব বিদেশী নাগরিক যাওয়া-আসা করছে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের নানাভাবে নাজেহাল করছে। পিআইএ বা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের যে সাজ-সরঞ্জাম, গোলাবারুদ ও সৈন্যদের পরিবহণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিঃ টাইগারম্যান বলেন, ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে একজন বাঙালীকেও আমি খুঁজে পেলাম না। অথচ দেশটা একান্তভাবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর দেশ।

বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধি মিঃ টাইগারম্যান বলেনঃ বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আমি দেখলাম এয়ারপোর্ট রোডের দু’পাশে বহু ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে এবং রাস্তার দুধারের বাড়িগুলি জনশূন্য। আর এইসব জনশূন্য বাড়িগুলির ছাদে, বারান্দায় ও জানালায় বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার বানানো হয়েছে। রাস্তায় দু’হাত ছাড়া চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। এইসব চেকপোষ্টে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে কথিত যে দু-একটা অসামরিক গাড়ী চলাচল করছে সৈন্যরা সেগুলো তন্নতন্ন করে তল্লাশী করছে। পথচারীদেরও তল্লাশী করা হচ্ছে। পথচারীদের বেশভূষা ও চেহারায় বাঙালীত্বের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া গেলে সৈন্যরা তাদের ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টর দিকে যাচ্ছে। বাঙালী বুদ্ধিজীবী তরুণ হলে তো আর কথাই নেই। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় যুদ্ধক্ষেত্র সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। সারি সারি বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চে সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। জায়গায় জায়গায় রাস্তার দুপাশে দেয়াল তুলে দিয়ে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। শহরের প্রধান প্রধান সরকারী ভবনগুলোর চারপাশে ১৫

থেকে ২৫ ফুট উচু দেয়াল তোলা হয়েছে। ঢাকা রেডিওকে বর্তমানে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর ঢাকার রাস্তায় কেউ হাঁটে না। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শহরের রাস্তায় কেবল পাকিস্তানী সৈন্য, পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও কুকুর ছাড়া আর কেউ চলাচল করে না। মানুষ সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচার এতই ভীবসন্ত্রস্ত যে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। বিদেশীদের সঙ্গে কথা বলতে তারা ভীষণ ভয় পায়। কারণ আজও প্রতিদিন শহরে ধরপাকড় চলছে। কখন কোন মুহুর্তে সেখানে কার জীবনে মৃত্যু নেমে আসবে না কেউ জানে না। প্রায় প্রতিরাতেই বোমা বিস্ফোরণ ও খণ্ড লড়াইয়ের শব্দ শোনা যায়। গোটা শহরটা এখন বদ্ধভূমিতে পরিণত।

বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধি বলেনঃ এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সেখানে থেকে কাজ করা আমার পক্ষে যুক্তিগতভাবে, নীতিগতভাবে কিংবা নৈতিকতার দিক থেকে কোনভাবেই সম্ভব নয়। তিনি বলেন , পাকিস্তানে আমি আর কোনদিন ফিরে যাবো না। বাংলাদেশ থেকে হানাদার পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হলে আমি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে যাবো। আমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে কাজ করবো। দীর্ঘ ছ’বছর থাকার পর আমি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবেসেছি। তাদের সঙ্গে আমার হৃদয়ের বন্ধন অনেক গভীর।

৫ অক্টোবর, ১৯৭১

…বৃটিশ কমন্সসভার অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য মিঃ ফ্রেভ ইভান্স বলেছেনঃ বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। জাতিগতভাবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ভাষা ও সামাজিকতার দিক থেকে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র- সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জাতি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও বাঁচার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই বাঙালীরা আজ হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। তারা আজ যে লড়াই করছে তা হলো এ দেশকে মুক্ত করার লড়াই- শত্রু মুক্তির লড়াই। দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালী যে যুদ্ধ করছে তা তাদের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। আর এই অধিকার প্রকৃতপক্ষে মানুষের জন্মগত অধিকার।

বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, লুণ্ঠন ও নারী-নির্যাতনের ফলে যে দুই লক্ষাধিক শরণার্থী সীমান্তের ওপারে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের অবস্থা নিজের চোখে দেখে যাবার জন্যে এবং কি নারকীয় নির্যাতনের ফলে তারা তাদের সাতপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটাচ্ছে তা জানার জন্যে বৃটিশ কমন্সসভার বিশিষ্ট সদস্য মিঃ ফ্রেড ইভান্স লণ্ডন থেকে পশ্চিম বাংলায় গিয়েছিলেন। একাধিক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতায় ফিরে গিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি এই মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের অসহনীয় নিস্ক্রিয়তার সমালোচনা করে তিনি বলেনঃ বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেরই এগিয়ে আসা উচিত।

মিঃ ফ্রেড ইভান্স বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তৃতায় বৃটিশ সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেনঃ অবিলম্বে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান না হলে এশিয়ার এই অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হবে। অবিলম্বে এর সমাধান করতেই হবে। মিঃ ফ্রেড ইভান্স বলেনঃ বাংলাদেশের মূল সমস্যা মানবিক চেতনা ও মানবাধিকারের সমস্যা। তিনি বলেনঃ একজন গণতন্ত্রী হিসাবে বুলেটের বদলে ব্যালটের মাধ্যমেই যে কোন সমস্যার সমাধানে আমি পক্ষপাতী। বাংলাদেশ সঙ্কটের শুরুতে বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সকল মানুষের এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মতো আমিও এটাই আশা করেছিলাম কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক শক্তি সে সম্ভাবনাকে গোঁয়ারের মতো গুড়িয়ে দিয়েছে।

মিঃ ফ্রেড ইভান্স বলেনঃ আমরা বৃটেনবাসী ১৯৩৯ সালে ফ্যাসিষ্ট জার্মানীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমেচিলাম, প্রয়োজন নয়া ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে আমরা প্রস্তুত।…

২৯ অক্টোবর, ১৯৭১

…গত বাইশে অক্টোবর থেকে পচিশে অক্টোবরে মধ্যে নয়াদিল্লীতে ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে আলোচনা হয় তাতে এই উপমহাদেশের পরিস্থিতি এবং পাকিস্তান ভারতের সীমান্তে যে গুণ্ডামি ও তস্করবৃত্তির দেশের মধ্যে চারদিনব্যাপী আলোচনার পর প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়ঃ পাকিস্তান ভারত সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করে এবং যুদ্ধপ্রস্তুতি ও সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে এই উপমহাদেশে যে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে তাতে এ অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হবার দারুণ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে ভারত যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সোভিয়েট ইউনিয়নের তাতে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। সুতরাং ভারত আক্রমণ করে বাংলাদেশ প্রশ্নকে ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নে রূপান্তরিত করার সপক্ষে এবং পরে জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে ত্রাণ পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছে তাও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। আজ ভারত আক্রমণের অর্থ হবে পাকিস্তানের আত্মহত্যা, ভারত আক্রমণ করতে গেলে গোটা পাকিস্তানটাই কবর হয়ে যাবে।

গত ছাব্বিশে অক্টোবর মস্কো ও অটোয়ায় যুগপৎভাবে প্রকাশিত সোভিয়েট-কানাডা যুক্ত ইশতাহারে বাংলাদেশ সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানানো হয়।

সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং কানাডার এই যুক্ত ইশতাহারে বলা হয়ঃ বাংলাদেশ পরিস্থিতির এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান আনতে হবে যাতে বাংলাদেশের জনগণের আইনসম্মত অধিকার ও স্বার্থ সম্পূর্ণ রক্ষিত এবং ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা পূর্ণ আস্থায় ও মর্যাদায় দেশে ফিরে আসতে পারবেন। কানাডায় সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মিঃ আলেক্সী কোসিগিনের আটদিনব্যাপী সরকারী সফরশেষে এই ইশতাহার প্রচারিত হয়।

১ নভেম্বর ১৯৭১

…যুগোশ্লাভিয়া সর্বোতোভাবেই গোষ্ঠীনিরপেক্ষ একটি শান্তিকামী দেশ বলে বিশ্ববাসির কাছে পরিচিত। পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রীবাদী উভয় ব্লকেই এই সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছেই জোটনিরপেক্ষ যুগোশ্লাভিয়া সমানভাবে সমাদৃত।

গোষ্ঠীনিরপেক্ষ যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটোও আজ বাংলাদেশের পাকিস্তানী বর্বরতার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট টিটো বলেছেনঃ বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যা করেছে এবং আজও তারা সেখানে যা করে চলেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন দৃষ্টান্ত নেই। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এবং নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সেখানকার নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার ও বর্বরতা চালিয়েছে তার ফলেই বাংলাদেশ থেকে নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থী তাদের ঘরবাড়ি সহায়-সম্বল ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

অথচ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াসহ গোটা সরকারী প্রচারযন্ত্র এতদিন প্রচার করে এসেছিলেন যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালী মুষ্টিমেয় অবাঙালীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলো, আর তাকেই থামাতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করে জনগণতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করে বাংলাদেশের মানুষ আজ দেশ থেকে হানাদার নিশ্চিহ্ন করার যে দুর্বার অভিযান চালিয়েছে তাকে দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় অনুচরদের কার্যকলাপ বলে ইয়াহিয়া সরকার কতদিন যাবৎ প্রচার করে এসেছে।

পাকিস্তানের মাথামোটা গোঁয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর তার জঙ্গী সরকারের অপপ্রচামুখর মুখে বিরাট একটা চপেটাঘাত মারার মতো জওয়াব শোনা গেল গোষ্ঠীনিরপেক্ষ যুগোশ্লাভীয় প্রেসিডেন্টের দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে। তিনি বলেনঃ বাংলাদেশ প্রশ্নটি ভারত-পাকিস্তান প্রশ্ন নয়। এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার কোন বিষয় নয়। তিনি বলেনঃ এটি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারও নয়।

সপ্তাহব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে গত সপ্তাহে মার্কিন টেলিভিশন সংস্থা সি, বি, এস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট টিটো অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বিশ্বাবাসীকে এই সত্যটি জানিয়ে দিয়েছেন।…

 

৬ নভেম্বর, ১৯৭১

সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি তথা বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলী ও প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্টে পাক হানাদার বাহিনী অধিকৃত ঢাকা নগরীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অধিকৃত এলাকার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টার ঢাকা থেকে পাঠানো এর রিপোটে বলেছেনঃ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক অভিযান শুরুর পর সাত মাস কেটে গেছে কিন্তু এখনও কোথাও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। বাংলাদেশের প্রত্যেক শহর-বন্দরের জনসংখ্যা বিগত ২৫ শে মার্চের আগে যা ছিলো এখন তার শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ হাস পেয়েছে। এই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের কিছু অংশ সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে, কিছু লোক নিখোঁজ হয়েছে এবং বাকী সকলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে লড়াই করছে।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টে বলা হয়ঃ পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তি বাহিনীকে খতম করবে বলে যে দুরাশা পোষণ করেছিলো তা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বরং ফল উল্টো ফলতে শুরু করেছে- বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর হাতে দারুণ মার খাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণাত্মক পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। লড়াইয়ে তারা তারা কোনোক্রমেই সুবিধে করে উঠতে পারছে না। জলে-স্থলে সর্বত্রই তারা মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের এখন একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো কয়েকটি ক্যান্টমেন্ট।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর রিপোর্টার লিখেছেনঃ বাংলাদশের বহু বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অধিকার ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফরিদপর, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ওই রিপোর্টার লিখেছেনঃ বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকাগুলোয় ব্যাপক হত্যা, লুটতরাজ, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসের দ্বারা পাকিস্তানী সৈন্যরা যে বিভীষিকা ও ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো তা এখন হ্রাস পেয়েছে। মুক্তিসেনারা এখন দেশের শহরে বন্দরে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বর্তমানে বাঙালীদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর ঘৃণা দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের পর প্রথমদিকেও এতখানি ঘৃণা ছিল না। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী অসামরিক প্রশাসনে নিযুক্ত বাঙালী এবং সাধারণ বাঙালীদের ওপর এখনও চরম নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। একজন বাঙালী একজন বিদেশী সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছিলো-শুধু এই অপরাধেই পাকিস্তানী সৈন্যরা ওই বাঙালী ভদ্রলোকের পরিবারের সকলকে নির্মমভাবে প্রহার করেছে। কিন্তু এত করেও তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠছে না।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা লিখেছেনঃ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ প্রশ্নটিকে অন্যদিকে ঘোরানোর উদ্দেশ্যে ভারত সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে। ভারতীয়

বাহিনীর সঙ্গে একটা সংঘর্ষের মাধ্যমে তারা বিষয়টিকে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ বলে চালাবার চেষ্টায় আছে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে। ফলে বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতা, সন্ত্রাস ও দৌরাত্ম্য কমে গেছে।…

 

১২ নভেম্বর, ১৯৭১

… সম্প্রতি সোভিয়েট ইউনিয়নের সুপ্রীম সোভিয়েটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মিঃ ভি, কুদরিয়াভেৎসেভ বাংলাদেশের এই যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন-বাংলাদেশে আজ যে লড়াই চলেছে তা খাঁটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার তথা বর্বর সমর নায়করা বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর চরমসন্ত্রাসের নীতির দ্বারা বাঙালীদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে তুরান্বিত করেছে। তিনি বলেনঃ আমি আশা করি এই বাস্তব ঘটনা যত তিক্ত ও যতো কঠোরই হোক না কেন পাকিস্তান এটা উপলব্ধি করে সুবুদ্ধির পরিচয় দেবে। সম্প্রতি সোভিয়েট পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে ভারত সফরে গিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মিঃ কুদরিয়াভেৎসেভ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে এই মন্তব্য করেন।

বিশিষ্ট সোভিয়েট নেতার এই উক্তিরই আরও স্পষ্ট প্রতিধ্বনি উঠেছে ফরাসী দেশে। ফ্রান্সের লোকবরেণ্য নেতৃবর্গ আজ মনে করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ এক অবশ্যম্ভাবী সত্য। এ সত্যকে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাবার কোনো পথ নেই, পন্থাও নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জেস পপিদু নিজেই বলেছেনঃ বাংলাদেশ সংকটের মূল হচ্ছে রাজনৈতিক, অতএব বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছানুযায়ী এ সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। তা না হলে সমগ্র উপমহাদেশে বিপর্যয়ের ঝড় নেমে আসবে এবং যার পরিণতি ভাবা দারুণ কঠিন ব্যাপার। বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ ও পৈশাচিকতার ফলেই বাংলাদেশ থেকে ৯৬ লক্ষ অসহায় নরনারী-শিশু বৃদ্ধ তাদের বাড়িঘর-সহায় সম্পদ হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশকে একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিলো। বাংলাদেশে এই ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির জন্যে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী তথা জঙ্গী সমরনায়করাই দায়ী। আর ঠিক এই কারণেই সোভিয়েট কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা’য় পাকিস্তানী জঙ্গী সরকার ও সামরিকজান্তাকে হুশিয়ার করে বলা হয়েছেঃ বাংলাদেশের যে নব্বই লক্ষাধিক শরণার্থী তাদের সহায়-সম্পদ ঘরবাড়ি এবং স্বদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, তারা যাতে পূর্ণ মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে স্বদেশে ফিরে আসতে পারে তার উপযুক্ত অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে। পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে তারা যাতে স্বদেশে ফিরে আসতে পারে তেমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে। প্রাভদায় বলা হয়, ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহীই শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এ সমস্যা আজ এক জটিল আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিনত হয়েছে। পাকিস্তানের মাথাগরম জঙ্গীচক্র যুক্তিতর্ক বিসর্জন দিয়ে তাদেরই সৃষ্ট সমস্যার জন্যে গোঁয়ারের মতো ভারতের ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করছে।

 

২৪ নভেম্বর, ১৯৭১

… গত রাতে বিবিস’র এক বিশেষ সংবাদ বুলেটিনে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও সাংবাদিকদের পাঠানো রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়ঃ মুক্তি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে গত ৪৮ ঘন্টায় পাকিস্তান তার দশটি সামরিক ঘাঁটি হারিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা পশ্চিম খণ্ডে মোট বাইশটি সীমান্ত চৌকির মধ্যে একুশটি দখল করেছে।

গত রাতে ঢাকা থেকে বিবিসি’র বিশেষ সংবাদদাতা মিঃ রোনাল্ড রোবসন জানাচ্ছেনঃ মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা এখন যশোরের চৌগাছা থেকে যশোর বিমান বন্দরের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর

আক্রমণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অধিকৃত যশোর বিমানবন্দরে রানওয়ে ও কন্ট্রোল টাওয়ারটি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে করতে পাকিস্তানী বাহিনী এখন দ্রুত পিছু হটে যেতে শুরু করেছে।

বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অস্ট্রেলীয় বেতার থেকে প্রচারিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়ঃ বাংলাদেশের সর্বত্রই বীর মুক্তিসেনারা সর্বাত্মক অভিযান চালিয়ে শত্রু সেনাদের একের পর এক ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত করে দুর্বার বেগে এগিয়ে চলেছে। পাকিস্তানী হানাদারদের শিবিরে শিবিরে এখন ত্ৰাহি ত্ৰাহি হাঁক উঠেছে।

ঢাকা থেকে AFP সংবাদদাতা এক তারবার্তায় জানাচ্ছেনঃ শত্রু বাহিনী অধিকৃত ঢাকার সঙ্গে গত সোমবার থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঢাকা-যশোর, ঢাকাইশ্বরদী, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কুমিল্লা এক কথায় বাংলাদেশের সকল আভ্যন্তরীণ রুটে পি-আই এ’র সকল সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। গত মার্চের পর ঢাকার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার একমাত্র যোগাযোগ ছিলো পাকিস্তানী বাহিনী নিয়ন্ত্রিত পি-আই-এ সার্ভিস। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণের মুখে তাও বিনষ্ট হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিসেনারা বর্তমানে চারদিক থেকে শক্রবাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তার শত্রু বাহিনীকে সমূলে নিধন করে চলেছে। সর্বত্রই চলেছে মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা। ঢাকার মাত্র আঠারো মাইল দূরে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা মুন্সীগঞ্জ শহর আক্রমণ করে। মুন্সীগঞ্জ থানার পুলিশের ওপর আক্রমণ করলে থানার একজন পুলিশ অফিসার ও বহু পুলিশ নিহত হয়। মুক্তিসেনারা বিজয় দৰ্পে সারা শহরে কুচকাওয়াজ করেন। মুক্তিসেনারা মুন্সিগঞ্জ মহকুমার লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী থানা দুটিও পুড়িয়ে দিয়ে ঢাকার এক বিশাল এলাকাকে শত্রুমুক্ত করে।

এদিকে মুক্তিসেনারা বর্তমানে উত্তরে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ সিলেট শহরের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে বলে বিবিসির বিশেষ সংবাদদাতা মিঃ ডোনাল্ড রোবসন উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, সিলেটের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা হটে যাচ্ছে। তিনি তার বার্তায় জানিয়েছেন মুক্তিসেনারা কুমিল্লার ওপরেও এক ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে।

গত রাতে অষ্ট্রেলীয় বেতারের এক সংবাদদাতা বুলেটিনে বলা হয়ঃ বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী যে দুর্বার আক্রমণ চালিয়েছে তার সঙ্গে একমাত্র বাংলাদেশের গত ঘূর্ণিঝড়েরই তুলনা করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আমরা উল্লেখ করবোঃ গত সপ্তাহে NEWSWEEK-এর সিনিয়র এডিটর মিঃ বোচগ্রেভ তাঁর An unwinnable Guerilla war শীর্ষক রিপোটে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেনঃ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এখন এমন এক দুর্জয় গেরিলা যুদ্ধের ফাঁদে পড়েছে যেখান থেকে তাদের মুক্তির কোন সম্ভাবনা নেই।

 

২৬ নভেম্বর, ১৯৭১

… গত ২২ শে নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক দীর্ঘ রিপোর্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক রূপরেখা প্রকাশিত হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর করাচীস্থ সংবাদদাতা গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করে God is not with the big battalions শিরোনামের এক দীর্ঘ রিপোর্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেনঃ গেরিলা যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কিত মাও সেতুঙ এর একটি বিখ্যাত উক্তি ভিয়েৎনাম তথা সমগ্র ইন্দোচীন, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসেনাদের দারুণ প্রেরণা দিয়ে চলেছে। উক্তিটি হলোঃ মাছ

যেমন করে সমুদ্রের অগাধ জলের মধ্যে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে, মুক্তিসেনাকেও সেভাবে জনসমুদ্রে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে হবে।

Mr. Malcom Browne তাঁর এই রিপোটে বলেনঃ বাংলাদেশের বীর মুক্তিসেনারাও আজ বাংলাদেশের বিশাল জনসমুদ্রে মাছের মতোই সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছে।

নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা বলেনঃ গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করে আমার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অধিকৃত বিভিন্ন এলাকা এবং মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বিশাল এলাকা সফল করে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে আমি কোনদিন তা কল্পনাও করিনি। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে একটা দেশের সমগ্র জনগণ মুক্তিসেনানী হয়ে উঠবে একথা ভাবাও যায় না। কিন্তু ভাবনা-চিন্তা নয় বাংলাদেশে গিয়ে আমাকে তো স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। আজ বাংলাদেশের যে কোন পর্যটক যেকোন সাংবাদিক যান না কেন তিনিও আমার মতোই বিস্ময়ে মুগ্ধ হবেন।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশের সর্বত্র শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হতে দেখে আমার শুধু বার বার একটা কথাই মনে হয়েছে যে ভিয়েৎনাম যুদ্ধ থেকে এইসব হতভাগ্য পাকিস্তানী সৈন্য ও সমর নায়করা কিছুই শেখেনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অধিকৃত এলাকায় আমি যেসব পাকিস্তানী সামরিক অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছি, জিজ্ঞাসাবাদ করেছি তাদের সবাইকেও মনে হয়েছে এক একটি আস্তো উজবুক।

পাকিস্তানের মাথামোটা সমরনায়করা বাংলাদেশে বড়ো বড়ো রেজিমেন্ট ও ব্যাটেলিয়ন নিযুক্ত করেছে বাঙালীদের মুক্তি সংগ্রামকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু God is not with the big battalions –অর্থাৎ আল্লাহ তাদের সহায় নন। বাংলাদেশের গণগেরিলাদের হাতে তারা চূড়ান্তভাবে মার খাচ্ছে। পাকিস্তানের ব্যাটেলিয়নগুলো এখন কেবল প্রাণরক্ষার জন্যেই লড়াই করছে। বাংলাদেশের নদী-মাঠ-প্রান্তরে আর জলাভূমিগুলোয় পাকিস্তানী যুদ্ধজয়ের স্বপ্নের কবর দিয়েছে বাঙালী গেরিলারা। যে কোন বিদেশীর পক্ষে বাংলাদেশের এই বাস্তব পরিস্থিতিটুকু উপলব্ধি করা আদৌ কঠিন ব্যাপার নয়। কারণ শুধু গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চল বলে নয়- বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকাসমূহের প্রতিটি শহর-বন্দরের সর্বত্রই মুক্তিবাহিনীর দেখা পাওয়া আদৌ কষ্টসাধ্য নয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ব্যাংক, দোকান, বিদেশী ফার্ম, কনসুলেট অফিস থেকে শুরু করে সরকারী অফিস আদালতের প্রত্যেকটি দফতরে তারা সক্রিয়। বাংলাদেশের আমি যেখানে গেছি, যার সঙ্গে কথা বলেছি সবখানে সবার মুখে একই কথা শুনেছি পাকিস্তানী হানাদারগুলোকে আমরা নিশ্চিহ্ন করবোই। আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে পাকিস্তানী হানাদারমুক্ত না করা পর্যন্ত লড়াই চলবেই।

পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা এখন এমন অবিশ্বাস্যরূপে কমতে শুরু করেছে যা বিশ্বাস করাও কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে আজ এটাই কঠোর বাস্তব।

Scroll to Top