মৃত্যুঞ্জয়ী কাফেলা

মৃত্যুঞ্জয়ী কাফেলা

যদিও কোন করুন দৃশ্য আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়তাম এবং আমার উপরে প্রভাব ছিল ভয়ানক প্রবল, তবুও নৃশংস পাক-হানাদার বাহিনীর অত্যাচার আমার মনে জমা হতে লাগলো চরম প্রতিহিংসা ও জিয়াংসার আগুন। বর্বর পশুগুলো হাজার নিরীহ নিরপরাধ বাঙ্গালীকে গরু-ছাগলের মত ঘরছাড়া করে নিক্ষেপ করেছে দুঃখের অর্থে সাগরে। এক মুহুতে সময় নষ্ট না করে আমাদের যা কিছু সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল, তাই নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে হিংগলগঞ্জে একটা আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য নির্দেশ দিলাম।

হিংগলগঞ্জ হাসনাবাদ থেকে বারো মাইল দক্ষিণে পথের মাঝখানে দুটো নদী। ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন হুদা ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২০টি রাইফেল নিয়ে হিংগলগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। হাসনাবাদ ও হিংগলগঞ্জ এর মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল তিন চাকা বিশিষ্ট টেম্পো নামে এক প্রকার গাড়ী আর নৌকা। ইছামতী নদী নৌকায় করে পার হতে হতো। কিন্তু এই নদীটা পার হওয়া খুব একটা নিরাপদ ছিল না। কারণ ওপারে নদীর তীর বরাবর পাকবাহিনী অসংখ্য বাস্কার ও ট্রেঞ্চ খনন করে ওদের ঘাঁটি সুদৃঢ় করে নিয়েছিল। এই ঘাঁটিগুলো ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে একজন পথিকেরও চোখে পড়তো। হিংগলগঞ্জএ ভারতের ৭২ নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটা স্থায়ী ফাঁড়ি আছে। ক্যাপ্টেন পান্ডে এর অধিনায়ক তিনি তার ফাঁড়ির এক মাইল দক্ষিণে একটি ঘাঁটি বানাতে ক্যাপ্টেন হুদাকে সবরকম সাহায্য করলেন। এ ঘাঁটিটা ইছামতী নদীর তীর থেকে আধ মাইল ভিতরে। এর ঠিক উল্টো পারে পাক-হানাদারের সুদৃঢ় পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি। এখানে ঘাঁটি স্থাপন করা কত কষ্টসাধ্য ক্যাপ্টেন হুদার তা ভালভাবেই জানা ছিল। আমারও ভাবনার অন্ত ছিল না। কেননা, অধিনায়ক হিসাবে তার চাহিদা মত তাঁবু, খাদ্য, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকা-পয়সা এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যবাহিনীর মঙ্গলামঙ্গল ও অগ্রগতির জন্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কারণ তাদের জন্য গভীর সহানুভূতি ছাড়া আমার কাছে তহবিল ছিল না। এর জন্য দুয়ারে দুয়ারে আমি পাগলের মত ঘুরেছি। শীগগীরই আমরা জীবনকে কঠিনভাবে উপলদ্ধি করতে শিখলাম এবং গভীর পারস্পরি সমঝোতার মাধ্যমে সব বিপদ, সব প্রতিকূল অবস্থাকে রুখে দাঁড়াবার নতুন শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলাম।

বসন্তপুর ইছামতী নদীর পূব তীরে। কেউ শুনে বা বইয়ে পড়ে দুঃখের কাহিনী হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। ভারতের সীমান্তে হিংগলগঞ্জে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি মেলে দিলে দেখা যাবে ওপারে বসন্তপুর। মাঝখানে ছোট্ট ইছামতী। দুর্নিবার ইচ্ছা, ভাবাসা ও অসক্তি সত্ত্বেও ওই রূপসী বাংলার কোলে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে ভয়ানক কষ্টসাধ্য। কেননা, ওপারে মারণাস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল মানবতার জঘন্যতম শত্রু। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ওই অসভ্য বর্বরদের হাত থেকে আমার মা-বোনদের বাঁচিয়ে আনার উদগ্র বাসনায় উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু কি দিয়ে আমি তাদের বাঁচাবো? মাত্র ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আর ২০টা রাইফেল নিয়ে? হ্যাঁ, এই অসম্ভব কাজেও আমরা জীবনকে বাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এবং সফল হয়েছিলাম।

১৯৭১ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ। সকাল থেকে ভয়ানক ঝড়। ভিতরে আমার ভয়ানক অস্বস্তি। কারণ, আমি জানতাম যে, ক্যাপ্টেন হুদার সাথের ছেলেরা এই ঝড়ের মধ্যে ছেঁড়া তাঁবুতে বসে বৃষ্টির জলে অসহায়ের মত ভিজছে। তা ছাড়াও আমি ভাবলাম শত্রুর উপর অতর্কিত আঘাত আনার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। বলিষ্ঠ যুবক ডাক্তার শাহজাহানকে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আমার সাথে আসতে বললাম। প্রাণ-প্রাচুর্যের জীবন্ত এই ডাক্তার সাহেব। সকাল ৮টায় আমরা দু’জনে দুটো ওভারকোট নিয়ে হাসনাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ইছামতী পার হতে পুরো এক ঘন্টা সময় লাগলো হিংলগঞ্জে যাওয়ার পথে এটাই প্রথম নদী। বাত্যাবিক্ষুব্ধ ছোট্ট ইছামতী আজ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এছাড়া খেয়ার মাঝি এই দুর্যোগময় মুহুর্তে খেয়া ছাড়তেও অস্বিকার করলো। টাকায় সবকিছু সম্ভব। তাই সেই হাড্ডিসার রোগা খেয়াঘাটের মাঝি টাকার লোভ সংবরণ করে আমাদের প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারলো না। খুব কষ্টে নদী পার হলাম। কিন্তু বড় বিপদে পড়লাম। কেননা, কোনো টেম্পো গাড়ীওয়ালা এই দুর্যোগ ঝড়ের মধ্যে গাড়ী ছারতে সাহস পেল না। এই দুঃসাহসিক কাজে ওদের রাজী করাবার জন্য বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনগুণ ভাড়ায় পৌছে দিতে ওরা সম্মত হলো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমরা বরুনহাট নামক একটা জায়গায় নদীর পাড়ে পৌছলাম। খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার সাথে দুটো প্রধান স্থলপথে বসন্তপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা- একটা পারুলিয়া হতে কালিগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জ হয়ে, অন্যটা সাতক্ষীরা- শ্যামনগর রোড। পারুলিয়া থেকে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটা বেশ প্রশস্ত। সিএ-বি’র রাস্তা। ভারী সামরিক যানবাহন এর উপর দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু পরেরটা বিশেষ সুবিধাজনক নয়। তবুও পাকিস্তানী শত্রুবাহিনী প্রায়ই এই রাস্তায় চলাফেরা করতো। তাই সৈন্য চরাচল ও আক্রমণ পরিচালনার জন্য সামরিক দিক দিয়ে বসন্তপুর ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ। বসন্তপুর অধিকার করে উপরোক্ত রাস্তা দুটোর উপর প্রভাব বিস্তার করার অর্থ একশ’ বর্গমাইল মুক্ত এলাকা হাতের মধ্যে আসা এবং এই সংকটময় দিগুলোতে এটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।

ইছামতি নদীর চাইতে বরুনহাটের এই নদীটি পাশে ছোট। কিন্তু দেখতে ভয়ংকর দৈত্যের মতো। এই অবস্থায় খেয়া পার হওয়া সাংঘাতিক বিপজ্জনক। অযথা সময় নষ্ট না করে সুযোগসন্ধানী এক নৌকার মাঝিকে বেশী টাকা দিয়ে নদী পার হলাম। কোন যানবাহন ছিল না। দীর্ঘ পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে হিংগলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার আস্তানায় পৌছতে হবে। ভায়নক শীত। তার উপরে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে গিয়েছিল। হাঁটু পরিমাণ কাদা ভেঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদার ঘাঁটিতে পৌছলাম। সামান্য একটু উচু জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা আস্তানা গেড়েছিল। তাঁবু ভেদ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। ক্যাপ্টেন হুদাকে বড় বিষন্ন মনে হলো। উঁচু জায়গাটার চারদিকে বৃষ্টির পানি জমে সমুদ্রের মত মনে হলো। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আমাকে আসতে দেখা হুদা যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। মুখ তার দৃঢ়প্রত্যয়ের হাসি। কাছে গিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। ‘জয় বাংলা’ বলতেই সবাই বৃষ্টি মধ্যে লাফিয়ে পড়ে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তুলে আমাদের স্বাগত জানালো। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। ইত প্রাণচাঞ্চল্য আমি আর আগে কখনও দেখিনি। ওদের সেই প্রাণচাঞ্চল্যে খুঁজে পেলাম আগামী দিনের বিজয়োৎসবের গোপন সংকেত। ওদের মনেভাবের উত্তপ্ততা লক্ষ্য করে আমি চিৎকার করে প্রশ্ন করলামঃ ‘আজ রাতেই তোমরা কি সবাই যুদ্ধ করতে রাজী আছো?’ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৩৫ শত লোকের মত চিৎকার দিয়ে উত্তর দিলঃ ‘হ্যা স্যার, আমরা সবাই প্রস্তু।” ওদের উচু মানসিক শক্তির পরিচয় পেয়ে আমি খুব ভরসা পেলাম। আগ্রহী কন্ঠ বললাম, ওকে। এই বলে ওদের বিদায় দিয়ে হুদার তাঁবুতে ফিরে গেলাম এবং আমরা ম্যাপের উপর ঝুঁকি পড়ে কোথায় আক্রমণ চালাতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম। এ ব্যাপারে সোবহান নামে একজন হাবিলদার অনেক সাহায্য করেছিল। পাকিস্তানী আক্রমণের আগে সোবহান বসন্তপুর গোয়েন্দার কাজ করেছে। কাজেই সেখানকার সব খবরই তার জানা ছিল। ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালনার ব্যাপেরে সে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছিল।

রাত একটায় শত্রুপক্ষের বাষ্কারে ঝাটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা। উদ্দেশ্যে, ওদের বাষ্কারে নিক্ষেপ করে কাবু করা এবং পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসা। পরিকল্পাটার শুনতে মধুর ও উত্তেজনাকর লাগলেও-এই ঝড়ের রাতে এই দুঃসাহসিক কাজটা সমাধান করা ছেলেখেলা নয় তবু তারা, বা প্রথম অভিজানের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদা, মোটেই দমলো না। খুব জেরে ঝর বইছিল। একবার ভালাম ঝড়ের রাতে এই বিক্ষুব্দ নদীটা পার হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু মন থেকে এই নৈরাশ্যকে দূরীভূত করলাম। করলাম কেননা আমাদের বিজয় সম্বন্ধে আমি খুবই আশাবাদী ছিলাম। জানতাম সবাইকে বিস্মিত করে অভিযান সফল হবেই। ব্যাস্তসমস্ত হয়ে সবাই সামান্য খাবার খেয়ে নিলাম। শৌখিন পাচকেরা এসব পাক করেছিল। তারাও অভিযানে শরিক হলো। যখন আমি হুদার কাছে আমার উদ্দেশ্যের কারণ ব্যাখ্যা করছিলাম, তখন হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা ধারণা এলো যে, একই সঙ্গে টাউন শ্রীপুরে পাক হানাদারদের অপর একটি ঘাঁটি আক্রমন করব। ভারতের সীমান্তবর্তী শহর ‘টাকি’র অপর দিকেই টাউন শ্রীপুর। সেখানে শাজাহান নামে একটা স্কুল শিক্ষকের অধীনে অনেট ট্রে- মোজাহিদ আছে। মিঃ শাজাহান বুদ্ধিমান, হাসিখুশী এবং উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তিনি টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা ছিলেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে হালকা অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটি মোজাহিদ বাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন। তারা টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা হওয়ায় ওখানকার পাকিস্তানী ঘাঁটির সঠিক অবস্থান, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য খুটিনাটি সম্বন্ধে বেশ ওয়াকেবহাল ছিল। সুতরাং দুর্যোগময় রাতটার তাৎপর্য আমার কাছে দ্বিগুণ হয়ে উঠলো।

ক্যাপ্টেন হুদাকে বিদায় জানিয়ে আমি ও ডাক্তার শাহজাহান দু’মাইল রাস্তা হেঁটে ‘টাকি’ এলাম এবং মিঃ শাজাহানের সাথে আলাপ-আলোচনা করলাম। তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে আমার অধীনে কাজ করতে রাজী হলেন। মিঃ শাজাহানের অধীনে লেঃ মুখার্জী নামে একজন অসম সাহসী যুবক কাজ করতো। সে পূর্বে যশোরের অধিবাসী ছিল এবং দাবী করতো যে, সে ভারতীয় সামরীক বাহিনীর একজন ভূতপূর্ব অফিসার। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। বেশ শক্তিশালী। অন্য দু’দজন মোজাহি সেকশন লিডার মিঃ ম-ল ও সোবহানের সাথে লেঃ মুখার্জী একত্রে ট্রেনিং নিয়েছ। টাউন শ্রীপুরে পাক-হানাদারদের ঘাঁটি আক্রমণ করবো শুনে মুখার্জী উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বসন্তপুর অভিযানের মতো এখানেও এদের ইছামতী পার হয়ে যেতে হবে। ইছামতী আরও উত্তরে গোজাডাঙ্গা পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গায় পড়েছে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলোর ঠিক অপর দিকে পাকিস্তানী পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি। আমার সেক্টরে ইছামতী নদীর তীর বারবার দু’তিন মাইল অন্তর পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলোর অবস্থান। সর্ব উত্তরে ‘শংকরা’। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে টাউন শ্রীপুর, দেবহাটা, খানজী, বসন্তপুর, উখসা ও সর্বশেষ কৈখালি। এসমস্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলোর শক্ষি বিভিন্ন রকমের। ভাবলাম, আমার প্রথম কাজ হলো, রাতের অন্ধকারে এবং গোপনে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে এই বিক্ষিপ্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো আবিষ্কার করা। এতে করে গেরিলাদের জন্য কতকগুলো গোপন অবস্থানের পরিকল্পনা করা আমার পক্ষে সুবিধাজনক হবে। যার ফলে একটা মুক্তাঞ্চলে গড়ে তোলা যায়। বাস্তবিক পক্ষে প্রথম অবস্থায় আমার পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় সীমান্তে টাকি, হিংগলগঞ্জ ও শসমেরনগর এই তিন জায়গায় আক্রমণ ঘাঁটি করে এর ঠিক বিপরিত দিকে পাকিস্তানী ঘাঁটি টাউন শ্রীপুর, বসন্ত পুর ও কৈখালি অধিকার করা। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অপ্রতুলতা হেতু আমার আশা সফল হয়নি। তবুও আমার কল্পনার উদ্দাম গতি থামেনি। যারা নিজেদের ভাগ্য গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সাহাযোগ্য এগিয়ে আসেন। এ কথার সত্যতা প্রমাণীত হলো ১৩ই জুন-যখন ক্যাপ্টেন গুদা বাগকের মারফত খবর পাঠালো যে, সেই দুর্যোগময় রাত্রে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী ঘাঁটি আক্রমণ করে ২০ জন হানাদারকে খতম এবং ৫০টি রাইফেল, দু’টি এল-এম-জি, অনেক অসশস্ত্র, গোলাবরুদ, গ্রেনেড ও বিষ্ফোরক দ্রব্য হস্তগত করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমন্ত শত্রুদের উপর হামলা চালিয়েছিল। শত্রুপক্ষের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে আমাদের একজন যুবক সামান্য আহত হয় মাত্র। শত দুঃখের মাঝেও বিজয়গর্বে বুক ফুলে উঠলো। লেঃ মুখার্জি, মিঃ ম-ল, সোবহান ও মিঃ শাহজাহান আমার সদর দপ্তরে এসে খবর দিল যে, তাদের আক্রমণও সফল হয়েছে। ওদের সবার মুখেই বিজয়ের হাসি। বিজয়োল্লাসে মিঃ শাজাহান আমাকে অভিনন্দন জানালো। আমিও আন্তরিকভাবে ওদেরকে স্বাগত জানালাম। আমার সুন্দরবনের ব্যর্থতার গ্লানি আজ যেন কিছুটা লাঘব হলো। পরক্ষণেই প্রতিহিংসার দাবানল আমার ভেতর আবার দ্বিগুণভাবে জ্বলে উঠলো। মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা ৩৫টি রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র অধিকার করেছিল। এই বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র হাতে আসায় আমার আক্রমণ পরিচালনা ঘাঁটির পরিধি আরও প্রসারিত করতে মনস্থ করলাম। ওই দিনই মিঃ শাজাহানের সহায়তায় টাকিতে আমার অন্তর্বর্তীকালীন ঘাঁটি স্থাপিত হলো। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী দক্ষ সৈন্যর উপর দুর্যোগের মধ্যে হামলা চালিয়ে এই বিরাট সফলতা অর্জন করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন হুদা, মিঃ শাজাহান, লেঃ মুখার্জী ও মিঃ মণ্ডলকে অভিনন্দন জানালাম। একই সঙ্গে খুব অল্প সময়ের ভেতর সীমান্তবর্তী সমস্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করার ইচ্ছা ওদের কাছে প্রকাশ করলাম। এছাড়াও আর একটা জিনিসের উপর জোর দিলাম যে, সীমান্তের ওপারের ছেলেদের জোগাড় করে এই মুহূর্তেই ওদের ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এই জন্য টাকি থেকে দুই মাইল দুরে ‘টকিপুরে’ একটি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা নিলাম। সীমান্তের ওপার থেকে ছেলে জোগাড় করার দায়িত্ব মিঃ শাজাহনকে দিলাম। বসন্তপুর ও টাউন শ্রীপুরে আমাদের সফলতার খবর সর্বাধিনায়কের কানে শিগগিরই পৌঁছে গেল। ভবিষ্যতে আরও এরকম সফলতা আশা করে তিনি স্বাগত জানালেন।

ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনীর অনেক লোক ও স্কুল-কলেজের ছাত্র সীমান্ত পার হয়ে এপারে চলে এলো। ছাত্রদের টাকিপুর যুবকেন্দ্রে ট্রেনিং-এর জন্য এবং সামরিক বাহিনীর লোকদের হুদায় ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দিলাম। ওদের সাথে বরিশাল থেকে এম, এ, বেগ নামে একজন লোক এসে পৌঁছলো। যুবক, শিক্ষিতও চটপটে। গায়ের রং কালো, সারা মুখমণ্ডলে প্রতিভা ও চাঞ্চল্যের স্বাক্ষর ও সে পাকিস্তান সৈনাবাহিনীতে একজন দক্ষ প্যারাসুট সৈনিক ও একজন ফ্রগম্যান হিসেবে অনেক দুঃসাহসিক কাজে নিযুক্ত ছিল। এই কাজে ওর সমতুল্য বড় একটা কেউ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের চেরাটে’ দীর্ঘ আট বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে ‘মিডশীপম্যান’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়। ওখান থেকে ১৯৭১ সারের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সে বাংলাদেশ পালিয়ে আসে। এ রোমঞ্চকর জীব ছেড়ে পালিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে উত্তর দিল – ‘বাংলাদেশ’।

আরোও দুটো সাহসী ছেলেকে সাথে নিয়ে বেগ জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে হাসনাবাদ পৌঁছলো। বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি থানার কুড়িগ্রাম নামক একটা গ্রামে পাক হানাদারদের সাথে সংঘর্ষের এক চমকপ্রদ কাহিনী শুনালো সে। জায়গাটা স্বরূপকাঠি থানার অনেক ভেতরে। এখানে সারি সারি অনেক পেয়ারা বাগান আছে। দুটো সারির মাঝখানটা নালার মত। সেখানে যে কেউ অনায়াসে আত্মগোপন করে থাকতে পারে। বেগ প্রায় একশ’ ঝানু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দিনের বেলায় এই নালার মধ্যে লুকিয়ে থাকতো এবং রাতের অন্ধকারে ওখান থেকে বেরিয়ে এসে হানাদারদের উপর আঘাত হানতো। সবার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। কারো কারো কাছে মান্ধাতায় আমলের তীর-ধনুক, বর্শা ইত্যাদী থাকতো। বেগ-এর বাহিনীর অবিরাম আক্রমণে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত পাক-হানাদার একদিন, এক দালালের কাছে খবর পেয়ে দিনের বেলায়াই ওদের উপর আক্রমণ চালাবার জন্য অগ্রসর হলো। বেগও ঠিক সময়মত বাহকের মারফত হানাদারদের অগ্রসর হবার সংবাদ জেনে গেল এবং হাতের কাছে যে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও পুরনো আমলের তীর-ধনুক পাওয়া গেল-তাই নিয়েই ওর লোকজনদের প্রধান প্রধান জায়গায় বসিয়ে দিল। একদিকে নগণ্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত বাংলার দুর্জয় মুক্তিবাহিনী, অন্যদিকে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ পাকিস্তানী সৈন্য। সবাই প্রস্তুত। কিন্তু প্রাচিন রোন নগরী বা অন্য কোন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যুদ্ধের মত এখানে বেজে উঠলো না কোন রণদামামা। উত্তেজনা চরমে উঠলো যখন দালালরা প্রায় ৫০ জন হানাদারকে সাথে নিয়ে এস পেয়ারা বাগানের ভেতর তল্লাশী চালাতে বললো। হানাদাররা বাগানে ঢুকে খুব সর্তকতার সাথে বাগানের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। দক্ষ শিকারীর মত বেগ তার দুঃসাহসিক মুক্তিবাহিনী নিয়ে অসম্ভব রকমের চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই। ওরা অপেক্ষায় ছিল কতক্ষণে শত্রুপক্ষ বন্দুকের নলের আওতায় আসবে। পাক হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মুক্তি’ বলে ডাকতো। অনেক তল্লাশী চালিয়ে কোন ‘মুক্তির’ খোজ না পেয়ে হানাদাররা পাক পেয়ারায় ভর্তি একটা গাছের উপর বিশ্রাম নিতে লাগলো। আর কি! চতুর্দিক থেকে আচমকা ছুটে আসতে লাগলো বন্দুকে গুলি, তীর, বর্শা ইত্যাদি। হতভম্ব হয়ে হানাদাররা চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক ছুট দিল। ঘটনাস্থলেই ২০ জন হানাদার খতম হলো। বাদবাকিগুলো জীবনের মায়ায় পেয়ারা গাছের ভেতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। ওদের পলায়নের পালাটাও খুব আরামে কাটলো না। বাগানের বোলতা ও মৌমাছি ভয়ানকভাবে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতেমুখে হুল ফুটাতে লাগলো।

পরে শুনেছি, পেয়ারা বাগানের এই পরাজয় হানাদারদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। এই বোকাগুলো শেষ পর্যন্ত স্থানীয় লোকজন দ্বারা সম্পূর্ণ পেয়ারা বাজান কেটে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয় যাতে করে ভবিষ্যতে ওরা নিরাপদ হতে পারে। এই ঘটনার পর বেগ তার গোপন আড্ডা দিয়ে অন্য আর একটি জায়গায় গিয়ে ‘যাদু’ দেখাবার আয়োজন করছিল। ঠিক এই সময় গোলাগুলির অভাব দেখা দিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের গোপন পথ ধরে হাসনাবাদ আসতে হয়েছে। এই সময় বেগের মত একজন দক্ষ লোকের সাহায্য ও সহযোগিতার খুবই প্রয়োজন ছিল। কেননা, সে নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা পদ্ধতি ও কলাকৌশল সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। তার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে শত্রুদের উপর আঘাত হানবে। কিন্তু ওকে আমি যেতে দিলাম না। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ওকে ক্যাপ্টেন হুদার কাছে পাঠালাম। বেগকে পেয়ে ক্যাপ্টেন হুদা ওর কাঁধেও কিছুটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিল।

বসন্তপুর ঘাঁটি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করার দায়িত্ব ওদের একলার উপর ছেড়ে দিয়ে আমার দৃষ্টি আরও দক্ষিণে শমসেরনগরে দিকে নিবদ্ধ করলাম। হাসনাবাদ থেকে শমসেরনগরের দূরত্ব চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল। আক্রমণ পরিচালনার জন্য কৌশলগত কতকগুলো মূল অসুবিধা ছিল। প্রথমতঃ জায়গাটা আমাদের আওতা থেকে অনেক দূরে। যাতায়াত ব্যবস্থা একমাত্র নদীপথ। দ্বিতীয়তঃ যদিও ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়িতে একটা বেতার ব্যবস্থা ছিল, তবুও আমাদের নিজস্ব কোন বেতারযন্ত্র না থাকায় এতদূর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তাছাড়াও নতুন আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করার আগে জনশক্তিও প্রয়োজন উপকরণ সামগ্রীর স্বল্পতার কথা চিন্তা করতে হবে। এই সমস্ত সমস্যা বিদ্যমান থাকা জনশক্তিও প্রয়োজন উপকরণ সামগ্রীর স্বল্পতার কথা চিন্তা করতে হবে। এই সমস্ত সমস্যা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নতুন করে কোন কিছু করতে যাব কিনা এ বিষয়ে নিজে নিজে ভাবছিলাম। সৌভাগ্যবশতঃ একদিন ভোরে ২০০ ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বিহার প্রদেশের ‘চাকুলিয়া’ থেকে এসে হাজির হলো। এইসব যুবক মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘ক্রাশ প্রোগ্রামে’ ট্রেনিং লাভ করে। প্রয়োজনের সময় ওদের প্রেয়ে খুব স্বস্তি অনুভব করলাম। সংবাদ বাহকে মাধ্যমে আমাদের সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে একখানা চিঠি পেয়ে আরও খুশি হলাম। তাতে লেখা ছিলঃ “ব্যারাকপুরে চার্লি সেক্টর থেকে এই দু‘শো’ মুক্তিযোদ্ধারা জন্য শীগগীরই অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাবেন।” সংবাদটা দ্বিগুণ জোরে আমার কানে বাজতে লাগলো দু‘শা’ রাইফেল।

সংবাদটা পাওয়ার পরেই মোজাহিদ ক্যাপ্টেন মিঃ শাজাহানকে ডেকে টাকির কাছাকাছি কোথাও একটা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য স্থান নির্বাচন করতে বললাম। নিরাপত্তার খাতিরে আমি চাইনে যে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা অদক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে টাকিপুর যুদ্ধক্ষেত্রে এক হয়ে মিশে থাক। আমার দপ্তরে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে মিঃ খুরশীদকে নিয়ে জীপে চাপলাম। খুরশীদ তথাকথিত আগরতলা মামলার একজন আসামীও ছিলো। সে সাধারণতঃ লেঃ খুরশীদ নামেই পরিচিত। জীবনের মূল্যবান অংশটা সে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কাটিয়েছে। একথা সে আমাকে প্রায়ই সম্মরণ করিয়ে দিত। মিঃ খুরশীদ খুব সরল, সৎ ও দেশপ্রেমিক। মুখে সবসময় হাসি। এই ভদ্রলোকটি বন্ধুবান্ধবের জন্য যে কোন সময় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারতো। একমুখ দাড়ি-প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গী। খুরশীদকে একজন পাক্কা গোয়েন্দার মত লাগতো। জন্ম থেকেই সে আশাবাদী। ভয়ানক দুঃসময়ে ওকে আমি হাসতে দেখেছি। তার সাহচর্য পেয়ে খুব আশ্বস্ত হলাম এবং তাকে নিয়ে আমাদের সর্বাধিনায়কের সাথে দেখা করার জন্য তাঁর সদর দপ্তরে রওনা হলাম। কি আর বলবো- তিনি এমন একটা জায়গায় সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন, যার নাম নিরাপত্তার (!) খাতিরে প্রকাশ করা যায় না। যা হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশী কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশী কথাবার্তা পছন্দ করতন না। কোলকাতাতেই মিঃ খুরশীদ, সুলতান আহমেদ নামে চটপটে এক ভদ্রলোককে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আলাপ পরিচয়ে বুঝতে পারলাম মিঃ সুলতান আহমেদ বেগের একজন প্রশিক্ষণ-গুরু। এই সংবাদে শুধু সাহসই পেলাম না, রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কেনা, এতে করে আমার নতুন আখড়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেদের আরও উন্নত প্রণালীতে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ এস গেল। আর এ জন্য মিঃ সুলতানের তত্ত্বাবধানে কাজ কার জন্য বেগকে নির্দেশও দিলাম।

সুলতান ও খুরশীদকে সংগে করে কর্মচঞ্চল কোলকাতার রাস্তা দিয়ে ব্যারাকপুরের দিকে ছুটলাম। চার্লি সেক্টর খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগে গেল। কেননা, এটা একটা নতুন সংস্থা। আমার ও মেজর ওসমানের সেক্টও থেকে আক্রমণ পরিচালনায় সমন্বয় সাধনের জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই সংস্থা স্থাপন করেছে। সংক্ষেপে চার্লি সেক্টরের পরিচয় হলো- এর অধিনায়ক একজন ব্রিগেডিয়ার, তাঁর অধীনে দু’জন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন এবং কয়েকজন কেরানী। ব্রিগেডিয়ার জানালেন যে, ভবিষ্যৎ আক্রমণ পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্যের জন্য তিনিই দায়ী। সব সময় তাঁর ও ষ্টাফেল সক্রিয় সহযোগিতা পাব বলে আশ্বাস দিলেন। দুর্যোগময় চারটি মাসের ব্যথা-বেদনা, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মাঝে এই প্রথমবারের মত সক্রিয় আশ্বাসের বাণী শুনলাম। এই প্রতিশ্রুতি আমাকে ভরসা দিল, সাহস যোগালো। আমর ঝিমিয়ে পড়া মনটাকে আবার আশা- আনন্দের নতুন উদ্দীপনায় সজীব করে আরও কঠিনভাবে শত্রুপক্ষের উপর আঘাত হানার জন্য ফিরে এলাম আমার সদর দপ্তরে হাসানাবাদে।

এক এক দলে ছ’জন করে মোট ষাটজন মুক্তিযোদ্ধাকে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে খুলনা পাঠিয়ে দিলাম। উদ্দেশ্য, শহরের ভেতরে ও চতুর্দিকে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের বলে দিলাম, প্রাথমিক কাজ সমাধা করার পর যারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, তাদেরকে আমার ঘাঁটিতে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতে- যাতে করে ওরা চেনা গোপন পথ ধরে পরপর গেরিলা দলকে বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে যেতে পারে। এই গিরিলা পদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রথম উদ্দেশ্য হলো বিকল্প গোপন পথ খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়তঃ নির্ভরযোগ্য স্থানীয় লোকদের সহায়তায় শহরের ভেতরে ও তার চতুর্দিকে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করা। তৃতীয়তঃ পথপ্রদর্শকদের ফেরত পাঠিয়ে খবরাখবর আদান-প্রদান কর। তখনকার দিনে এই কাজগুলো সমাধা করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। কেননা, পাকিস্তানী পশুগুলোর হিংস থাবা গ্রামবাংলার সব জায়গায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে। তবুও অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা কঠিন আত্মবিশ্বাসের দুটো কারন হতে পারে। প্রথমতঃ খুলনার অধিবাসী দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানী হানাদাররা নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলেও ভেতরের জনসাধারণের আওয়ামীলীগের উপর আস্থা ছিল। গেরিলাদের কাছে ছিল ষ্টেনগান গ্রেনেড ও চাকু। ওদের নিরাপত্তা ও পথে যদি ওরা হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অথবা শত্রুর সামনে পড়ে তাহলে ওদের মোকাবেলা করার জন্য কিছু হালকা ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্যও সাথে দিয়ে দিলাম। প্রাণঢালা আশীর্বাদ করে আগের নির্দেশানুযায়ী ওদের বিভিন্ন রাস্তায় পাঠিয়ে দিলাম।

সময়টা ছিল ১৪ই জুলাইয়ের রাত্রি। শত্রুপক্ষের সামরিক যন্ত্রটাকে শুদ্ধ করার জন্য শিল্প এলাকায় আমার দ্বিতীয় পর্বের আক্রমণ শুরু হলো। শিল্প এলাকাগুলোর কার্যক্ষমতা অচল করে দিতে পারলে সামরিক যন্ত্রটাকে বাঁচিয়ে রাখার মত হানাদারদের অর্থের অনটন ঘটবে। এই কাজটা খুবই মর্মান্তিক। কেউই চায় না তার নিজের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিসাধন বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক। এছাড়া কোন উপায় ছিল না। কেননা, আমাদের সামগ্রিক সাফল্য অর্জনের জন্য এ কাজটা ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করবে এবং সেই সঙ্গে শত্রুপক্ষের আক্রমণধারাও পংশু করে দেবে। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন হুদাও তার ঘাঁটি থেকে আক্রমণের গতি বেশ সন্তোষজনকভাবে বাড়িয়ে দিল। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ ৩৫ জনের ছোট্ট বাহিনীটি বাড়তে বাড়তে ৩৩০ জনে এসে দাঁড়ালো। শত্রুপক্ষের উপর রীতিমত আক্রমণ চালিয়ে তারা বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জন করলো। বেগের অক্লান্ত সহযোগিতায় হুদা পাকবাহিনীর তিনটি সীমান্ত ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। এর ভেতর ছিল দক্ষিণে উকসা, বসন্তপুরের উত্তরে দেবহাটা ও খানজী সীমান্ত ফাঁড়ি। মাইন, ডিনামাইট ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে ওই ফাঁড়িগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। উকসা অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যরা পাহারায় বেরুলে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে ওদের কাবু করেছিল, সে সম্বন্ধে হুদা আমাকে একটি চমপ্রদ কাহিনী শোনালো। ওঁৎ পেতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর আঘাত হানার জন্য জুলাই মাসের ২৮ তারিখ ক্যাপ্টেন হুদা ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধারা একটি দল নিয়ে ইছামতি পার হলো। পাকিস্তানী সৈন্যরা উকসা ঘাঁটিতে খুব ভোরে পাহারায় বেরুতো। হুদা ও তার সাথের লোকের একটা খুঁটির সাথে ‘জয় বাংলা’ পতাকা লটকিয়ে তারা চারিদিকে ‘এন্টিপার সনাল’ মাই পুঁতে রেখে নিকটবর্তী একটা ধানক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে ওরা ফিস ফিস শব্দে শুনতে পেল। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তখনও গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু আবছা অন্ধকার। হুদা ও তার সাথের লোকন জলভর্তি ধানক্ষেতের মধ্যে চুপচাপ প্রস্তুত হয়ে রইলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হানাদাররা এদিকে আসলো না। উড়ন্ত ‘জয় বাংলা’ পতাকাটা চোখে পড়তেই মাথাভারী কুত্তার দল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং ওটাকে নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলার জন্য বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে ছুট আসলো। আর যায় কোথায়? গমস্ত পৃথিবীটাকে কাঁপিয়ে প্রচ- বিস্ফোরণ। হাতির মত পাকিস্তানী দৈত্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়লো এবং হুদা তার লোকজন ও শত্রুদের পরিত্রক্ত অস্ত্র নিয়ে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে এলো।

আমার মনে পড়ে, ‘ভট্টাচার্য’ নামক দশ বছরের একটি ছেলে বেগের বিশেষ ‘বাহিনীতে’ যোগ দেয়। এই বিশেষ বাহিনীটির নাম ‘হার্ড কোর অব সার্জেন্টস’। এর বিশেষত্ব ছিল বারো বছরের ঊর্দ্ধে কোন বালককে এই বাহিনীতে নেয়া হতো না। নতুন এসেও, ভট্টাচার্য কঠিন পরিশ্রমের বলে সার্জেন্ট মেজরের পদে উন্নতী হলো। সে নিজের অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। উপরন্ত, চারদিকে শত্রুথাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান, শক্তি, সাতক্ষীরা- কালিগঞ্জ রাস্তায় পারূলিয়া ব্রীজের খুঁটিনাটি-সব মূল্যবান সংবাদ সংগ্রহের জন্য তার ক্ষুদে বাহিনীকে যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করেছি। পারুলিয়া ব্রীজটা লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট। এই ব্রীজের উপর দিয়েই হানাদাররা তাদের রসদসম্ভার, অস্ত্রশস্ত্র কালিগঞ্জ ও বসন্তপুরের নিয়ে যেত। ব্রীজটার উপর হামলা চালানোর দিন ভট্টাচার্য রাতের অন্ধকারের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ব্রীজের এক প্রান্তে পাহারারত সান্ত্রীদের কয়েক গজের মধ্যে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আর এদিকে বেগ ব্রীজের নিচে বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে দিল। সংকেত দিতেই এই দশ বছরের সার্জেন্ট মেজরটি ঝোপের আডাল থেকে শত্রুর দিকে গ্রেনেড ছুড়ে মারলে কোনদিক থেকে গ্রেনেড ছুঁড়েছে টের পাবার আগে সান্ত্রীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তারপর সার্জেন্ট মেজরটি তার ছোট্ট কনুইয়ের উপর ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে বেগের সাথে এসে মিলিত হলো এবং নীরব অপেক্ষা করতে লাগলো কখনো বিস্ফোরণের ভয়ানক গর্জনটা কানে ভেসে আসবে। দীর্ঘমেয়াদী বিস্ফোরক দ্রব্য বুকে নিয়ে ব্রীজটা অসম্ভব সকমের নীরব ও শান্ত। মগজহীন হানাদার সান্ত্রীরা ভারী বুট পায়ে ব্রীজের অপর প্রান্তে পায়াচারি করছিলো। বেগ হাতঘড়িটার দিকে তাকালো। সময় আসন্ন। উহ কি ভয়ানক উত্তেজনা। প্রচ- শব্দ করে ব্রীজের বেশীর ভাগ অংশ উড়ে গেল। আর পোশাক পর পাকিস্তানী পশগুলো চিরদিনের জন্য ভেসে গেল স্রোতের জলে।

আমাদের উপর্যুপরি সাফল্যে একদিন যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল উন্নত হলো, অন্যদিকে অনেকগুলো অসুবিধাও দেখা দিল। কেননা, মুক্তিযোদ্ধারা ঘন ঘন আক্রমণ করায় পাক হানাদাররা ক্ষেপে গিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের লোকজনের উপর চরম অত্যাচার আরম্ভ করলো। ওদের অকথ্য অত্যাচারের ফলে স্থানীয় লোকজন আমাদের উপর কিছুটা বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠলো। এর ফলে আমাদের গেরিলা কৈৗশল অনেকটা ব্যাহত হলো। বেসামরিক জনসাধারণ আমাদেরকে শত্রুমনে করতো না। কোন অঞ্চল মুক্ত হলে সেখানে আমরা অবস্থান করি, এটা তারা মনে মনে সব সময় কামনা করতো। কিন্তু নানান অসুবিধার জন্য আমরা মুক্তাঞ্চলে থাকতাম না। প্রথমতঃ প্রকৃতপক্ষে কোন জায়গা দখলে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না, দ্বিতীয়তঃ আমাদের ছেলেরা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নয়। তৃতীয়তঃ লোকসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে ওরা আমাদের চাইতে অনেক উন্নত। খ-যুদ্ধ চালাবার মত শক্তি আমাদের ছিল না। সুতরাং একমাত্র কৌশল আমাদের সামনে যা খোলা ছিল, সেটা হলো সেই পুরানো কায়দা-‘আক্রমণ করো এবং পালিয়ে এসো।’ এই কৌশল আবলম্বন করায় যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকের নিরীহ লোকদের জীবনে নেমে আসলো অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। কিন্তু আমাদের কোন বিকল্প পন্থাও ছিল না।

শাসনকার্য পরিচালনার জন্য কিছু লোক হিংগলগঞ্জ রেখে ক্যাপ্টেন হুদা ইতিমধ্যেই তার দপ্তর উকসা নিয়ে এসেছে। উকসায় তাঁকে পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কেননা, নদীর তীর বরাবর উঁচু বাধ ছাড়া আর কোন জায়গা ছিল না, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে। বঁধের নীচে যতদূর চোখ যায় শুধু কর্দমাক্ত ধানক্ষেত। অন্য কোন উপায় না থাকায় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মাথা গুঁজতে হতো। তাড়াতাড়িতে খোঁড়া এই ব্যূহগুলো প্রবল বৃষ্টির ঝাপটা সহ্য করতে পারতো না। এই মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজতো। বেশীর ভাগ সময় আধপেটা খেয়ে দিন কাটাতো। কেননা, রান্নাবান্না কার অনেক অসুবিধাও ছিল। যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে হুদা ওদের মনোবল বাঁচিয়ে রেখেছিল। ভাবতে অবাক লাগে, মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার চাইতে যুদ্ধের দিকে আসক্তি ছিল বেশী। শত্রুর উপর হামলা করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদা ও সহ-অধিনায়ক বেগ দুশো মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একদিন রাতে শ্যামনগরের দিকে অগ্রসর হলো। সময়টা এমনভাবে নির্ধারিত করা হয়েছিল যে রাত্রে রওনা হয়ে ভোর হওয়ার কিছু আগেই শ্যমনগর পৌঁছে যায়-যাতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়া যায়।

ছোট ছোট ছেলেদের পক্ষে ধানক্ষেতের মধ্যে এই দীর্ঘ পথ হেঁটে যাওয়া খুব আরমদায়ক ছিল না। নিচে পায়ে কাঁটার আঘাত, উপরে ঠাণ্ডা বাতাস আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওরা অন্ধকারের ভেতর এগিয়ে চললো শ্যামগরের দিকে। পথের সাময়িক বাধাকে ওরা ভ্রক্ষেপই করলো না। কেননা ওদের অন্তরে ছিল বাংলার সোনালী ভবিষ্যৎ আর শ্রত্রুর প্রতি হিংসার চরম আগুন। সারাদিন তীব্র সংঘর্ষের পর সন্ধ্যা নামতেই শত্রুপক্ষের কামান, মর্টার, মেশিনগান স্তব্ধ হয়ে গেল এবং হানাদাররা চরম পরাজয় বরণ করলো। যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু পেছনে শত্রুপক্ষের পঞ্চাশজনের একটা দল বেতারযন্ত্র ও ভারি অস্ত্রপাতি নিয়ে অবস্থান করছিল। ওদের মর্টার ও কামানের গুলি শ্যামল-শস্যক্ষেত পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। কিন্তু আমাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারলো না। শত্রুপক্ষের লোকজন পালিয়ে যাবার সময় পথে গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকা আমাদের ছেলেরা অতর্কিত ওদের উপর হামলা চালিয়ে খতম করে দেয়।

শ্যামনগর থেকে পালাবার দুটো মাত্র পথ খোলা ছিল। একটা ভেটখালির দিকে, অন্যটা বসন্তপুরের দিকে। এই দুটো রাস্তাতেই হাবিলদার সোবহান ও মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকতের অধীনে আমাদের ছেলেরা ওঁৎ পেতে বসে ছিল। লিয়াকত দুর্দান্ত সাহসী। নভেম্বর মাসের কোন সময়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে অফিসার পদের প্রশিক্ষণের জন্য চলে যায়। শ্যামনগরের উপরে এই আক্রমণ আমার সেক্টরে একটা বিরাট বিজয়। এই বিজয়ে জনসাধারণেরও মনোবল অনেকাংশে বেড়ে গেল। শত্রুপক্ষের ক্ষতির তুলনায় আমাদের তেমন বিশেষ ক্ষতি হয়নি। ওদের অনেক লোকজন মারা যায়। আমাদের চারটি ছেলের মধ্যে মারাত্মকভাবে দু’জন জখম হয়। আর দু’জন সামান্য আঘাত পায়।

শ্যামনগর মুক্ত হওয়ায় জনগণের চক্ষু খুলে গেল। ওরা এই প্রথমবারে মত মুক্তিবাহিনীর শক্তির পরিচয় পেল। হুদার কাছে খবর পাঠালাম, যেভাবেই হোক একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শ্যামনগর আমাদের দখলে রাখতেই হবে। কেনন, আমার ইচ্ছা দখলক্রত রাস্তা ধরে খুলনা, মংলা ও চালনা পোর্টে মুক্তিবাহিনী পাঠিয়ে দিয়ে শত্রুর উপর আঘাত হানবো। আমার নির্দেশমত হুদা ও বেগের উপর শ্যামনগরের সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কালিগঞ্জ-বসন্তপুর অঞ্চওে শত্রুপক্ষের উপর হামলা জোরতার করার জন্যা সে নিজেই হিংগলগঞ্জে ছুটে এলো।

পদাতিক বাহিনীর দ্বারা সাহায্যযুষ্ট শত্রুপক্ষের একদল সৈন্য এই অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। ওরা নদীপথে ইছামতী দিয়ে যাতায়াত করতে পারতো না। কিন্তু ওদের গানবোটগুলো কালিগঞ্জ বরাবর যমুনা নদী দিয়ে দক্ষিণে পাইকগাছা পর্যন্ত পাহারা দিত। যাতায়াত ও সরবরাহ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার এটাই প্রধান রাস্তা। শত্রুদের সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার জন্য উত্তর-পূর্বদিকে যমুনার তীর বরাবর গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদাকে একটা পরিকল্পনা তৈরী করে দিলাম। যখন খবর পাওয়া গেল যে, পাকিস্তানী গানবোটগুলো যমুনায় পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা দল ‘রিকয়েললেস’ রাইফেল নিয়ে হিংলগঞ্জ এসে ঘাঁটি গাড়লো। এই দূরপাল্লার রাইফেল দিয়ে গানবোটগুলোকে সহজেই আঘাত করা যায়। সেন বর্মা নামে একজন অল্পবয়স্ক লেফটেন্যান্ট এই বাহিনীর অধিনায়ক। ভারতের প্রধান নির্বাচনী কমিশনার মিঃ সে বার্মার পুত্র। পূর্বে বরিশাল জেলার অধিবাসি ছিলেন। এ সময় ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরী মুক্তিযুদ্ধে অংশহগ্রহণ করতো না। প্রয়োজনবোধে মুক্তিযোদ্ধারা কোন সাহায্য চাইলে ভারতীয় সৈন্যরা পিছন থেকে শত্রুপক্ষের উপর গোলাবর্ষণ করতো। কিন্তু প্রতিভাদীপ্ত যুবক এই সেন বর্মাকে বাধা দেবে? সে ক্যাপ্টেন হুদার ইছামতী পার হয়ে হানাদারদের উপর ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ চালিয়ে আবার এপারে ফিরে আসতো। ক্যাপ্টেন হুদা লেঃ সেন বর্মাকে সহযোগী হিসাবে পেয়ে খুবই খুশী হলো।

আক্রমণ পরিচালনায় হুদার যোগ্যতার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে আমি ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহকে নিয়ে শমসেরনগরে যুদ্ধ পরিচালনা ঘাঁটি স্থাপন করার পাকাপোক্ত সিধান্ত নিলাম। সলিমুল্লাহ শক্তিশালী ও সাহসী। তখনকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তাকেই উপযুক্ত মনে করলাম। হাসানাবাদে আমার যে লঞ্চটি ছিল তাকে করে ত্রিশজন মুক্তিযোদ্ধাকে সলিমুল্লাহর অধীনে শমসেনগর পাঠিয়ে দিলাম। শমসেরনগর অনেক দূরে রায়মংগল নদীর তীরে অবস্থিত। এই জায়গাটার অনেক রকমের অসুবিধা ছিল। কিন্তু আমার সার্বিক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্থানটার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রথমতঃ আমি চাচ্ছিলাম সমগ্র সুন্দও বনাঞ্চলে আধিপত্র বিস্তার করে বাংলাদেশের অভ্যান্তরে গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের জন্য একটা নিরাপদ রাস্তা। দ্বিতীয়তঃ আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশের অভ্যান্তরে একটা আক্রমলকারী দল পাঠিয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও গোপালগঞ্জে যেসব বিক্ষিপ্ত মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের সাথে একটা সুষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তাঁবু, রেশন ও পোশাক না থাকা সত্ত্বেও সলিমুল্লাহ হৃষ্টচিত্তে শুধুমাত্র সাহসের উপর ভর করে আগষ্ট মাসের শেষদিকে শমসেরনগরে ঘাঁটি স্থাপন করতে উঠে পড়ে লেগে গেলা। বর্ষা ঋতুতেই সে ঘাঁটি বানাবার মনস্থ করলো। শমসেরনগরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়ির আধ মাইল দক্ষিণে নদীর তীরে বাঁশ দিয়ে একটা ঘাঁটির মত তৈরী করা হলো। এর চতুর্দিকে কাদাপানি। ওকে যে কাজের ঘাঁটিটার চারদিক জলকাদা। আসওে সলিমুল্লাহ সাহেব একজন কেতাদুরস্ত লোক। বর্ষা ও কাদামাটির ভেতর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তো, তখন ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহকে খুবই খুশী মনে করত। বিশেষভাবে তাগিদ দেয়ায় তার ছেলেদের জন্য বর্ষাতি পাঠিয়ে দিলাম। সপ্তাহ শেষে প্রয়োজনীয় রেশনপত্র পাঠিয়ে দিতাম। সলিমুল্লাহর তেমন আর কোন অভিযোগ ছিল না। শুধু প্রধান লঞ্চচালক মোশাররফ মিযা মাঝে মাঝে অস্ত্রশস্ত্রের একটা বড় তালিকা নিয়ে হাজির হতো।

শমসেরনগর যাবার কিছুদিন পরেই কৈখালিতে পাক বাহিনীর উপর উপর্যুপরি কয়েকবার হামলা চালিয়ে সীমান্তবর্তী ঘাঁটিটা অধিকার করি এবং সরাসরি এপারে সলিমুল্লাহ আর একটা ঘাঁটি স্থাপন করে। ইতমধ্যে সুন্দরবনের ‘রাজা’ নওয়াবদীর সাথে পরিচয় হয়। সুন্দরবন এলাকায় এই নওয়াবদী রূপকথার সেই কালো দৈত্যটার মত। বেশ বড় মুখম-ল। সারামুখ ভর্তি দার্ড়ি। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। দেহগঠন অত্যান্ত সুদৃঢ়। সারা সুন্দরবন এলাকায় সে একটা ভয়ানক ত্রাস। তার একমাত্র ব্যবসা চোরাচালানি। পূর্বের কুকীর্তি সত্ত্বেও, যখন আমি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তার সাথে দেখা করলাম তখন আমার কাছে সে অত্যান্ত লাজুক, ভদ্র ও অতিথিপরায়ণ বলে মনে হলো। হ্যাঁ, মনে পড়ছে, তারিখটা ৩রা সেপ্টেম্বর।

আমার সেক্টরের একটা লঞ্চে করে যাচ্ছিলাম। আমার অধীনস্থ লঞ্চগুলো শীগগীরই ‘বাংলাদেশ নেভি’ নামে পরিচিত হলো। সেপ্টেম্বরের শেষদিক আমার নৌ-বাহিনীতে ৬টা মটর লঞ্চ যোগাড় করা হয়। এগুলো শত্রুবাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য নিয়োজিত রাখার চাইতে আমি ভাবলাম, এগুলোকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে গানবোটের কায়দায় ব্যবহার করা ভাল। সর্বধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর কাছে আমি আমার পরিকল্পনার কথা জানাতেই তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলেন। তারপর অধিনায়ক মুখার্জীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় বাহিনীকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমার ছ’টি লঞ্চের জন্য ৫০টি ব্রাউনিং বিমানধ্বিংসী মেশিনগান নিয়ে এলাম। হালকা মেনিগান ও ছোট ধরনের অস্ত্রশস্ত্র চালাবার জন্য এক একটি লঞ্চে দশজন করে নাবিক মোতায়েন করলাম। আমার ভাগ্য ভাল যে, আমি সব নৌ-বাহিনীর লোকজন পেয়ে গিয়েছিলাম। আগে তার পাকিস্তান নৈৗ-বাহিনীতে চাকরিরত ছিল। বদরে আলম নামে একজন বেশ অভিজ্ঞ লোকের অধীনে নৌ-বাহিনীর এইসব লোকজনকে একত্র করলাম। যুদ্ধের সময় বদরে আলমকে সম্মানসূক লেফটেন্যান্ট পদে ভূষিত করা হয়। লেঃ খুরশীদ এই নৌ-বাহিনী গড়তে আমাকে সাহায্যে করেছে। এইসব লোকেদের যোগাড় করার জন্য সে একসেক্টর থেকে আর এক সেক্টরে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেরিয়েছে। ছেলেরা মানের মত কাজ পাওয়ায় ওর উপর খুব কৃতজ্ঞ হলো। আমার এই সংস্থাটি পরে ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনী’ নামে পরিচিত হয়ে ভয়ানক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। এই বাহিনীর উপর প্রথম কাজ দেয়া হলো, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রীতিমত সরবরাহ করা। দ্বিতীয়তঃ নদীতে আক্রমণাত্বক পাহার দেয়া। তৃতীয়তঃ নৌ-সংক্রান্ত কাজকর্ম সুসমাধা করা। নৌ-সংক্রান্ত কাজকর্ম বলতে বুঝায়-মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্দিষ্ট ঘাঁটিতে নামিয়ে দেয়া। তারপর কাজ সমাধা হলে আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ রাত্রে যার সাথে দেখা হয়েছিল, সুন্দরবনের ‘রাজা’ সেই নওয়াবদী প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হাসনাবাদ থেকে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা লঞ্চে থাকার পর শমসেরনগর পৌছলাম। তখন রাত গাঢ় অন্ধকার। মূষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এত অন্ধকার যে দু’গজ সামনে পর্যন্ত দেখা যায় না। চালকের পক্ষে লঞ্চ চালনা করা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠলো। সার্চলাইটের আলোতে বেশীদুর দেখা যায় না। প্রমত্তা রায়মঙ্গল এর উপর ভেসে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ তীর থেকে আমাদের উপর টর্চলাইটের আলো এসে পড়লো। অনুসন্ধানে জানতে পারলাম যে, ওটা ভরতের সীমান্ত ফাঁড়ির আলো। ওই ফাঁড়ির লোকেরা সলিমুল্লাহার আস্তানায় পৌছতে আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করলো। এই সময় বৃষ্টির মধ্যে দেখতে পেয়ে সলিমুল্লাহ আনন্দে আত্মহারা। ওখানকার সব ছেলের সাথে আমি দেখা করলাম। বৃষ্টির ঝাপটা এসে বাঁশের ঘরের মধ্যে ঢুকছিল। এই বর্ষার রাত্রেই সুন্দরবনের ‘রাজা’ নওয়াবদীর সাথে আমার দেখা হয়। পাক-বর্বরদের নৃশংস অত্যাচারে টিকতে না পেরে সুন্দরবনের হরিনগর গ্রামে তার পৈতৃক ভিটামাটির মায়া ত্যাগ করে ঝড়ের মধ্যেই পরিবারের সবাইকে তিনটি নৌকায় নিয়ে নওয়াবদী বেরিয়ে পড়ে। সুন্দরবনের রাজার চোখে জল। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, তার জীবন এমন দুঃখের দিন কখনো আসবে এবং পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে। হারিকেনের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম তার চোখে প্রতিহিংসার আগুন। চপলমতি ছোট্ট বালকের মত হঠাৎ সেই শক্ত মানুষটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে আমাকে জানালো যে মাত্র চারটা রাইফেল পেলে আজ রাত্রেই তার পরিবারের লোকজন নিয়ে সে গ্রামে ফিরে যাবে। তক্ষুনি তাকে চারটা রাইফেল দিয়ে দিলাম। নিকষ কালো লোকটা প্রচ- উল্লাসে সাদা দাঁতগুলো বের করে দুরন্ত বাতাসের সাথে দৈত্যের মত অন্তর্হিত হলো। এর ফলে শীগগীরই সে সুন্দরবনের গভীরে আমাদের গেরিলা ঘাঁটি প্রসারিত করতে নিষ্ঠার সাহে সাহায্য করেছিল।

বেগের একটি ‘যুদ্ধবাহিনী’ ছিল। তারা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় যে কোন ঝুঁকি নিতে তারা সর্বদা প্রস্তুত থাকেতো। সংখ্যায় সব মিলিয়ে দুশো হবে। সবাই যুদ্ধ করার মত উপযুক্ত। যা কল্পনা করেছিলাম- সেই প্রস্তুতি, সেই উৎকর্ষতা ওদের মাঝে দেখতে পেয়ে আমি সুন্দরবনের গভীরে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করার লোভ সামলাতে পারলাম না। সুন্দরবনটা দেখতে প্রায় ভিয়েতনামের হো চি মিন সড়কের মতো। কোন কারণে যুদ্ধ বিলম্বিত হলে, প্রাকৃতিক গুপ্তস্থানে ভরপুর এই সুন্দও বনাঞ্চল ছাড়া বাংলার আর কোন জায়গা এতটা সুবিধাজনক নয়। ব্যূহ রচনার কৌশলাদি ঠিকমত নিরূপণ করে এই অঞ্চলে যদি ঘাঁটি স্থাপন করা যায় তাহলে মুক্তিযুদ্ধ যে কোনভাবে যে কোন সময়সীমা পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। এই পরিকল্পনা মনে রেখে কৈখালিতে সলিমুল্লাহর জায়গায় বেগকে বসিয়ে দেয়ায় আমি তাকে শ্যামনগর থেকে নিয় এলাম। কাজ শুরু করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে বেগকে বুড়ি গোয়ালিনী, হরিনগর ও মুন্সিগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপন করার দায়িত্ব দিলাম। ফ্লাই সার্জেন্ট সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে রাতের বেলায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে দু’জন পাকিস্তানী সৈন্য কয়েকজন রাজাকার খতম করে এক সপ্তাহ আগে এই ‘বুড়ি গোয়ালিনী’ অধিকার করা হয়। বুড় গোয়ালিনীতি বন বিভাগের অফিস ও একটা শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ছিলো।

দুঃসাহসিক কাজের জন্য সলিমুল্লাহকে সম্মানসূচক লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত করা হয়। এই বুড়ি গোয়ালিনী অধিকার করা আমাদের পক্ষে একটা বিরাট সফলতা। কেননা, এখান থেকেই পাক সৈন্যরা সুন্দরবনের ভেতরে ও অগ্রভাগে আমাদের চলাচলের উপর নজর রাখতো এবং খবর সংগ্রহ করতো। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই ট্রান্সমিটারটাই আমার যাত্রার উদ্দেশ্যটা ব্যর্থতার পর্যবসিত করেছিল। সলিমুল্লার কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেগ ও তার বাহিনী শত্রুপক্ষের হামলা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। গানবোটগুলির উপর আঘাত করার জন্য বেগ সবসময় ওঁৎ পেতে প্রস্তুত হয়ে থাকতো। বুড়ি গোয়ালিনি পতনের পর পাক হানাদাররা মাঝে মাঝে আমাদের ঘাঁটির নিম্নাঞ্চল গানবোট নিয়ে পাহারায় বেরুতো। অক্লান্ত পরিশ্রম করে উপর্যুপুরি কয়েকবার আক্রমণ চালিয়ে হরিনগর ও মুন্সিগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী বিতাড়িত করে বেগ সেখানে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করলো। এইসব ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত হবার পর পাক হানাদাররা সহসা পাল্টা আক্রমণ করতো না। কোন কারণে তারা যেন নরম হয়ে গেল। আমরা কখনও আক্রমণ করলে হানাদাররা খুবই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠতো। বোধ হয় ওদের ভয় ধরেছিল যে, আমরা ওদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছি। কেননা একদিকে সুন্দরবনের উপরিভাগ থেকে বেগ ও তার দুঃসাহসী যোদ্ধারা শত্রুদের উপর ক্রমাগত আক্রমণ চালাচ্ছি, আর অন্যদিকে দক্ষিণ শরণখোলা থেকে কঠিন আঘাত হানছিল ক্যাপ্টন জিয়া।

মাত্র সীমান্ত পরিধির ভেতর সীমাবদ্ধ এই যুদ্ধে আমি খুশী ছিলাম না। কেননা, সীমান্ত এলাকা থেকে মাত্র কয়েক মাইল জুড়ে আমাদের মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছে এবং পাকিস্তানের সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সার্বিক বিজয় অর্জন করতে আমাদের বহু বছর লাগতে পারে। কারন ওরা বৃত্তাকারে সুদৃঢ় ব্যূহ রচনা করে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করছে এবং যতই সময় যাচ্ছে, ওরা নিজেদের অবস্থার খুবই মজবুত করে নিচ্ছে। যদিও পাকিস্তানী হানাদাররা বৃত্তাকার যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তবুও তারা মানসিক দিক দিয়ে একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। তৎসত্ত্বেও ওদের উপর বড় রকমের আঘাত হানার মত অবস্থান আমাদের ছিল না। তাছাড়া, মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি সম্বন্ধেও খুব বেশী পারদর্শী নয়। তাড়াতাড়িতে যেটুকু প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, তাতে কোন কোন খন্ডযুদ্ধে সবাইকে একত্রে জড় হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে দেখা গেছে। এটা আমাদের পক্ষে আত্মঘাতী স্বরূপ। যখনই আমাদের বড় রকমের একটা বিপর্যয় এসেছে, তখনই দেখা গেছে যে, এটা ওদের একত্রে জড় হবার চিরাচরিত অভ্যাসের পরিণত। যা হোক, সময়ে যুদ্ধ করে সফলতা আমরা অর্জন করেছি, তা থেকে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, যুদ্ধকৌশল নয়-আক্রমণের গতিধারা ও আক্রমণাত্মক মনোভাবটাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সফলতা আসবেই।

এই রুপরেখাটা মনে রেখে বিশদভাবে পরিকল্পনা তৈরী করলাম যে, দেশের প্রতি আনাচে-কানাচে মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়িয়ে দিতে হবে ও আক্রমণের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে প্রতি থানায়। থানা থেকে গ্রামে। গ্রাম থেকে ঘরে ঘরে-যেন শত্রুরা পিছনে দেখতে ‘আজরাইল’ ওদের সামনে। যে হারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা আমার নতুন ক্যাম্প ‘বাকুনদিয়া’ এসে জড় হচ্ছিল, তাতে ওদের জন্য যদি প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করা যায়, তাহলে এই পরিকল্পনার রূপায়ণ মোটেই কষ্টকর নয়। বাকুদিয়া বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যস্ততম ও বৃহত্তম পাদপীঠ-যেখানে মুক্তিগামী মানুষের এই মৃত্যুঞ্জীয় কাফেলা প্রবল প্রাণোদ্দামে ভরপুর হয়ে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে উল্কার মতো ছুটে গিয়েছিল ঐ মানুষখেকো বাঘ ও হিংস্র জন্তুর অবাধ লীলাক্ষেত্র সুন্দরবনের গভীর অভ্যন্তরে এবং বাংলার মাঠে-ঘাটে, প্রতিটি গ্রামে ও গঞ্জে।

Scroll to Top