মৃত্যুহীণ প্রাণ
মাকে গল্প বলতে বললে মা গড়িমসি করতেন।
পরে আমাদের আগ্রহ দেখে শুরু করতেন। এক দেশে ছিল এক রাজা। আর রাণী। তাঁর হাতীশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া। সেপাই লস্করে জনে মানুষে মম করে রাজপুরী, আমলায় পইলায়, উজিরে নাজিরে রাজদরবারের কী রবরবা! কিন্তু আজ গল্পের ধরন পাল্টে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিখিয়ে দিয়েছেন রাজা একটি নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রত্যেকেই এক একটি রাজা। আমরা সবাই রাজা। শুধু স্বাধীনতা বন্দী নয়, জালেমের কারাগারে ন্যায়বিচার মানবাধিকার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ২৪ বছর ধরে মাথা কুটে মরছে। বন্দী আমার বাংলা। আমার রূপসী বাংলা আমরা ধর্ষিতা বাংলা। আমার জননী বাংলা।
রাজপুত্র একটি নয়। হাজার হাজার, লাখ লাখ রাজপুত্ৰ-মাতৃ অপমানের তীব্র প্রতিশোধ কামনায় ছায়াহীন, বৃক্ষহীন ধুধু তেপান্তরে ধূসর পথ অতিক্রম করে চলছে বন্দিনী মাকে উদ্ধার করতে।
আমার মা রাজপুত্রের যে বর্ণনা দিতেন তার সঙ্গে এর কত তফাৎ সেই রাজপুত্রের পোশাকে জরীর কারুকাজ, সূর্য এসে চুমু দিলেই সাত রং খেলা করে তার দেহে রূপোর খাপে কারুকাজ করা তলোয়ার। মাথায় মণিমুক্তা খচিত উষ্ণীষ। গলায় গজমতি হার কানে কানপাশা। চন্দন চর্চিত কপালে জয়-তিলক। চরণে চটকদার বাহারী জুতো। ঘোড়াটাই বা কম কী দুধের মতো সাদা ধবধবে চোখ জুড়ানো ঘোড়া। তার উপর মখমলের জীন। আর আমার রাজপুত্র! পায়ে তার জুতো নেই। না বর্ষায়, না শীতে। পরনে একটি মাত্র লুঙ্গি। ভাগ্য প্রসন্ন হলে একটা গেঞ্জি, নইলে গামছাই সার। চন্দন চর্চিত অঙ্গ নয়, ক্রলিং করে করে সারা গায়ে মেখেছে বাংলার মাটি। তলোয়ার তো নেই। হাতে লাঠি, নয় বর্শা। রাজাকার বা হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা থ্রি-নট-খ্রি। আমার রাজপুত্র বলে, না না ছিনিয়ে আনা নয়, ওটা তো রোজগার। রোজগারটা যদি এল-এম-জি হয়। ব্যাস আহার-নিদ্রা মাথায় উঠল, তেল দাও, সাফ কর, শোবার সময় বুকে জড়িয়ে ধরে শোও- স্বপ্নও ঐ এল-এম-জি নিয়ে না, রাজকন্যা-টন্যা নয়, এমন কি পরীটর কাছে ঘেষতে পারে না তার, সে স্বপ্ন দেখে বিশাল এক প্রান্তরে সে দাঁড়িয়ে আছে, এল-এম-জি একটানা গর্জন করে চলেছে, আর শত্রু সেনারা, তাগড়া ছোট চাচা প্রবল ঝাঁকুনী দিলে কুলগাছের কুলগুলো যেমন ঝুপ ঝুপ করে শিশিরের উপর ঝরে পড়ত, তেমনি
রাক্ষসগুলো ঝুপ ঝুপ করে পড়ছে তো পড়ছেই। এক সময় একটা বুলেট এসে তাকে থামিয়ে দেয়। সে দ্যাখে, তার প্রিয় পতাকা দিয়ে গোটা শরীর জড়িয়ে রাখা হয়েছে। আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
গান শুনতে শুনতেই তার ঘুম ভাঙে। আহা স্বপ্নটা যদি সত্য হয়! ধীরে ধীরে নতুন রাখা দীর্ঘ দাড়িতে হাত বুলায় সে।
আচ্ছা, আমার এই রাজপুত্রের কাছে আমার মায়ের রাজপুত্ত্বরটাকে একটু পানসে পানসে মনে হয় না! ঐ রাজপুত্রটা যেন যাত্রা-থিয়েটারের। কেমন যেন ন্যাকা ন্যাকা। না? নিজের কোন বুদ্ধিসুদ্ধি নেই, কোন কাজ নিজের করার মুরোদ নেই, হয় ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী নয় পরটরী এসে করে দেয়। না হলেই চিত্তির।
আমার মায়ের কিসসা শেষ হতো এভাবে-তারপর? তারপর আর কি, রাজপুত্র রাজকন্যাকে নিয়ে সুখেশান্তিতে বাস করতে লাগল। আর আমার রাজপুত্র?
না। না, না এমন রাজপুত্র পৃথিবী কোনদিন দেখেনি, কোন কবি কল্পনা করতে পারে না এর রূপের পৃথিবীতে এর কথা কেউ কোনদিন বলে নি। বীর প্রসবিনী বাংলাদেশের গর্ভেই এমন রত্ন জন্মগ্রহণ করে। খালি হাতে যারা বীরের মতো লড়াই করতে পারে। যারা হাসতে হাসতে মারতে পারে, হাসতে হাসতে বীরের মতো মরতে জানে। আমার রাজপুত্র জানে মৃত্যু কত তুচ্ছ জানে, মানুষ মরে। মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। কেউ রোগে মরে, কেউ হাসপাতালে মরে, কিন্তু প্রাণ দিতে জানে না। আমার রাজপুত্র শুধু মারতেই নয়, প্রাণ দিতেও জানে। যে প্রাণ মানুষের কল্যাণের জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবাইকে মর্যাদা দেয়ার জন্য, দেশের জন্য নিবেদিত, তার জন্য মৃত্যুবরণ করার মতো সৌভাগ্য আর কিছুতেই নয়। সকল জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দেশের জন্য প্রাণ দিতে জানা। এ প্রাণ মরে না, চিরকাল বেঁচে থাকে। মেয়েরা ঘাটে চাল ধুতে ধুতে তারই গল্প করে, পাল তুলে দিয়ে বৈঠায় ক্লান্ত হাত রেখে মাঝি তারই গান গায়, কবিরা আসরে।
সাধ্য আছে কোন নুরুল আমীনের কোন নতুন অস্ত্র দিয়ে, বুলেট দিয়ে, স্যাবরজেট দিয়ে বা শ্যাকে ট্যাঙ্ক দিয়ে বাংলার বুক থেকে রফিক, জব্বার, বরকত, সালামকে হত্যা করতে পারে? না । কেন? আমার রাজপুত্র মৃত্যুহীন প্রাণ দিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। কিসসার রাজপুত্র রাজা হয়, তারপর এক সময় মারাও যায়। এই রাজপুত্রের মৃত্যু নেই। এরা মৃত্যুহীন প্রাণ।
(আসাদ চৌধুরী রচিত)