শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালিদের লিখিত চিঠি

<৪,১৫৬,৩০২-৩০৪>

অনুবাদকঃ সুদীপ্ত কুমার সাহা, মাহিয়া হাসান মীম

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৫৬। শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালিদের লিখিত চিঠি

 

বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার দলিলপত্র আগস্ট ১৯৭১

এএলওবি থেকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠানো চিঠির প্রতিলিপি

সম্পাদকঃ

আমাদের কাছে যথেষ্ঠ প্রমান আছে এটা বিশ্বাস করার জন্য যে শেখ মুজিবুর রহমান,বাংলাদেশের(সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) বাঙালি নেতা,যিনি গত ডিসেম্বরে ঘটে যাওয়া সর্বপ্রথম সাধারন নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন,তিনি মৃত এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দ্বারা হত্যার শিকার হন ৩১শে মার্চ ১৯৭১ এর আগে যদি না পাকিস্তানি সামরিক সরকার তার জীবিত থাকার যথেষ্ঠ প্রমান প্রদান না করতে পারে।পাকিস্তান সরকার দ্বারা প্রকাশকৃত একমাত্র আলোকচিত্রটিও ছিল নকল যেটি তোলা হয়েছিল শেখ মুজিবের পূর্বের বহু গ্রেপ্তারের যেকোনো একটির সময় এবং যা খুজে বের করা হয় বৃহদাকার নথিপত্র থেকে যা ছিল পূর্বের খাতাপত্রে।

পাকিস্তান সরকার দ্বারা প্রচারিত শেখ মুজিবের “বিদ্রুপাত্মক বিচার” হল খুবই হিসাবকৃত পরিকল্পনা সেই সকল লোকদের বোকা বানানোর জন্য যারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক উন্নতির ব্যপারে অবগত নন।বিশেষ সামরিক আদালত দ্বারা কৃত সেই রুদ্ধদ্বার “বিচার” শুরু হবে বুধবার,আগস্ট ১১,তার “বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ” এর প্রত্যাশিত রায় এর পরবর্তী “মৃত্যুদণ্ড” এবং বিশ্বাসঘাতকের চুড়ান্ত ফাঁসি  অধিকাংশ বৈধবিশ্বের জনগনের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে এবং এইসব ঘটনার বাস্তবতা সম্বন্ধে।

আরেকটি প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে যেখানে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ভালভাবেই অবগতঃ

একজন ইচ্ছাপূর্বক নির্বাচিত “শেখ মুজিবুর রহমানকে” খুবই ছোট সামরিক আদালত কক্ষে নিয়ে আসা হবে যাতে কিছু অল্পসংখ্যক “ক্ষমতাশীল” ব্যাক্তি,তাকে দেখা যাবে তার প্রচলিত পোশাকে কিন্তু অত্যন্ত সুরক্ষিত ও পরিবেষ্টিত সামরিক কর্মীবৃন্দ দ্বারা তার নিজের “নিরাপত্তার” জন্য যাতে কোনো পাকিস্তানি বা বাঙালি “জ্যাক রুবি” তাকে আদালত কক্ষের ভিতর তাকে হত্যা না করতে পারে, যাতে তারা আদালত কক্ষে ”শেখ মুজিবের” বাস্তব উপস্থিতি সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারে কারন তারা মুজিবের শরীরের সামান্য অংশ দেখতে পাবে কিন্তু তারা কখনোই রক্ষীদের অপর পার্শ্বে তার চেহারা দেখতে পারেনি যারা পুরো বিচারজুড়ে তাকে রক্ষা করছে।

বিচার স্থায়ী হয় এক সপ্তাহের কম সময় জুড়ে।শেখ মুজিবের জঘন্য “অপরাধ” প্রমান করার জন্য সকল “প্রমান” সামরিক শাসকদের(যারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান দ্বারা নিযুক্ত যিনি ইতিমধ্যে শেখ মুজিবের “বিশ্বাসঘাতকতার” ব্যপারে নিজের অভিমত ঘোষনা করেন ১৯৭১ সালের ২১ মার্চে) প্রদান করা হবে।পরিশেষে সামরিক আদালত তার “অপরাধ” সম্পর্কে নিশ্চিত হবে এবং তাকে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করবে এবং তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করবে।এরপর একটি সামরিক পর্যালোচনা প্যানেল তাৎক্ষনিকভাবে দন্ডাদেশ অনুমোদন করবে এবং পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক,এই ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খান নিজে,এটা নিশ্চিত করবেন কেননা তিনি ইতিমধ্যে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ঘোষনা করেছেন।

 

শেখ মুজিবের “মৃত্যুদণ্ড” সম্পন্ন করা হবে কোনো এক শনিবারে এবং রবিবারে সংবাদ প্রতিবেদনগুলো যথেষ্ট পরিমান আলোড়ন ও উত্তাপ সৃষ্টি করতে পারবেনা কারন সকল দফতর ও ব্যবসা ওইদিন বন্ধ থাকে।

পরবর্তী সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রেস রিলিজ হবে অনেকটা এরকমঃ

“শেখ মুজিবুর রহমান”,নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের তথাকথিত নেতা,যাকে পূর্বে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বিশেষ সামরিক ট্রাইবুনাল যা গঠিত হয় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বারা,তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ফায়ারিং স্কোয়াড দ্বারা শনিবার সকালে রাওয়ালপিন্ডি ক্যান্টনমেন্ট(দুর্গ) এর ভেতর।

“গতকাল তার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান।”
“ইসলামিক অনুশাসন অনুসারে শেখ মুজিবুর রহমানকে তৎক্ষণাৎ সকল ইসলামিক আচার অনুসারে রাওয়ালপিন্ডি ক্যান্টনমেন্টের ভেতর একতি সমাধিতে কবর দেয়া হয় কারন রাওয়ালপিন্ডির সকল খোলা সরকারি ও বেসরকারি কবরস্থানের ব্যবস্থাপনা সমিতি তাকে কবর দিতে অস্বীকৃতি জানায় কারন তারা তাকে পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচনা করে।”

“গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরম(১১০̊ ফারেনহাইট) এর কারনে মৃতদেহকে কবর প্রদানে কোন বিলম্ব করা সম্ভব ছিল না কারন মৃতদেহ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খারাপভাবে পচে যেত।”

“পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকায় মৃতের পরিবারে কোন সদস্যের সাথেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি কারন তাদের অধিকাংশই শহর ছেড়ে চলে গেছে সম্ভবত ভারতে চলে গেছে।”

“শেখ মুজিবর রহমানের মৃতদেহ পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনব্যবস্থার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো সম্ভব হয়নি অতিরিক্ত খরচের কারনে তাই ঢাকা বা ফরিদপুরে তার গ্রামে তাকে সমাহিত করা সম্ভব হয়নি।”

“পাকিস্তান সরকার এ নিয়ে দুঃখিত যে মৃতের দেহ তার স্ত্রী বা নিকট আত্মীয়দের কাছে পাঠানো সম্ভব হয়নি।”

এভাবে ইয়হিয়া খানের সামরিক সরকার পুরো পৃথিবীকেএকটি  বৈধ “মৃত্যুদন্ডের” ব্যপারে “সন্তষ্ট” করতে পারত।

এবং এ সমস্ত নাটকে বিশ্বাসী সমগ্র বিশ্বের মানুষ নিশ্চিত হত যা পাকিস্তানের বাইরের মানুষ জানে নাঃ

এই একই শেখ মুজিবুর রহমান পুর্বে বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং প্রায় ১২ বছরের মত হাজতবাস করেছেন।

পাকিস্তনের সাবেক সামরিক শক্তিমানব মার্শাল আইয়ুবও শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে(১৯৬৭ সালের কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দ্বারা নিযুক্ত  একটি শক্তিশালী সামরিক ট্রাইবুনাল ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে শেখ মুজিবকে হত্যা করার চেষ্টা করছিলো।

এই বিশেষ সামরিক “বিচার” পূর্ব পাকিস্তানে এত আকস্মিক সহিংসতা সৃষ্টি করে যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারীর এক রাতে শত শত মানুষ মেশিন গান দিয়ে হত্যা করতে বাধ্য হয়,যখন তারা কারফিউ লঙ্ঘন করে(তখন সিজেএস রাষ্ট্রদূত ছিলেন জনাব বেঞ্জামিন ওলেহার্ট,কোকা-কোলা প্রেসিডেন্ট;ইউ.এস. রাষ্ট্রবিভাগ সকল খুঁটিনাটি জানে কারন তারা জানতে পেরেছিল ভিয়েতনামে ডায়েম এর বিপর্যয় সম্বন্ধে)।

    অবশেষে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে থাকা সকল রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ও চার্জ তুলে নেন এবং তাকে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তি দেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি আইয়ুব তাকে আমন্ত্রণও জানাতে চেয়েছিলেন (যদিও কিছুদিন আগে যে হুমকি বলে বিবেচিত ছিল) রাওয়াল্পিন্ডিতে একটি গোল টেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য।

    কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য ছিল। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে থাকা “রাষ্ট্রদ্রোহিতার ষড়যন্ত্র মামলা” আইয়ুব খানের ১৯৬৯ পতন হতে বাধ্য করে।

    কে না বলতে পারে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে থাকা “রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা” ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া ও তার দেশের দিকে চালিত করেছিল।

Scroll to Top