বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ২য় খণ্ডের ৭২১-২৩ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ১৮৮ নং দলিল থেকে বলছি…
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
‘শেখ মুজিবের সঙ্গে এক হয়ে সর্বাত্মক সংগ্রাম করবো’:
পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানী |
দৈনিক পাকিস্তান | ১০ মার্চ, ১৯৭১ |
মুজিব–ভাসানী এক হবে
(স্টাফ রিপোর্টার)
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গতকাল মঙ্গলবার পল্টনের এক জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এবং এ ব্যাপারে কোন প্রকার আপোসও সম্ভব নয়। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এই দাবীর মর্যাদা রক্ষা করে অবিলম্বে ৭ কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতা দানের আহবান জানান। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি ঘোষণা করেন, আগামী ২৫শে মার্চের মধ্যে এই দাবী মেনে না নিলে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এক হয়ে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করবেন।
বর্তমান সংগ্রামের উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ কেউ বলেছে যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলে শেখ মুজিবুর রহমান তার সাথে আপোস করবে। তিনি বলেন, এই সন্দেহ অমূলক। শেখ মুজিব বা মাওলানা ভাসানী বা যে কোন নেতা যদি এ ব্যাপারে আপোস করতে যায়, জনতা তাকে আস্ত রাখবে না। আপোসের সময় চলে গেছে এখন আপোসের আর কোন পথ খোলা নেই। মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আস্থা রাখার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাকে আপনারা অবিশ্বাস করবেন না।
শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে বাংলার সংগ্রামী বীর হওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ১৩ বছর আগে কাগমারী সম্মেলনে আমি আসসালামু-আলাইকুম বলেছিলাম। মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও সেদিন আমার কথা অনুধাবন করতে পারেন নি। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, দুই অংশ যদি একত্রে থাকে তাহলে কালব্যাধি যক্ষ্মার বীজাণু যেমন দেহের হৃৎপিণ্ডের দু’অংশকে নিঃশেষ করে দেয়, তেমনি পাকিস্তানের দু’অংশই বিনষ্ট হবে। তাই বলেছিলাম যে, তোমরা তোমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কর এবং আমার আমাদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করি। ‘লাকুম দীনুকুম ওলিয়াদীন’, শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।
তিনি বলেন, আমি ৭ কোটি বাঙালিকে আজ মোবারকবাদ জানাই এ জন্য যে, তারা এই বৃদ্ধের ১৩ বছর আগের কথা এতদিন পরে অনুধাবন করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিঃসহায় মানুষের ওপর বেপরোয়া গুলীবর্ষণের নিন্দা করে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ইতিহাস হতে শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অত্যাচারী শাসক ও জালিম কখনও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। তার পতন অনিবার্য। তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ, মুসলিম লীগ সরকার ও আইয়ুব খানের পতনের ইতিহাস বর্ণনা করে বলেন, এরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছিল।
তিনি বলেন, বৃটিশ জাতি বুদ্ধিমান ছিল। তাই তারা এদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন মতো পর্যায়ে পৌঁছার আগেই স্বাধীনতা দিয়ে যায়। তেমনিভাবে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বাংলার ৭ কোটি মানুষকেও তিনি অবিলম্বে স্বাধীনতা প্রদানের দাবী জানান।
তিনি এ ব্যাপারে ইয়াহিয়াকে জনাব দেওলতানা, জনাব ভুট্টো ও জনাব খুরোসহ বিভিন্ন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন ।
অহিংস আন্দোলন প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী বলেন, আমি কোনদিন অহিংসায় বিশ্বাস করি না। রসূল (দঃ) অহিংসায় বিশ্বাস করতে বলেন নি। জুলুমের প্রতিশোধ নিতে বলেছেন। জালিমের অত্যাচার যে সহ্য করে এবং যে অত্যাচার করে তারা উভয়ই মহাপাপী। তিনি বলেন, অহিংসা পন্থা অবাস্তব।
দেশে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তিনি প্রেসিডেন্টকে দায়ী করেন। পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের যুক্তি একজন নিরক্ষর নাগরিকের নিকটও গ্রহণযোগ্য নয় বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার নামে প্রেসিডেন্টের ভূমিকার নিন্দা করে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতি কোন মর্যাদা না দিয়ে তার আইনগত কাঠামোর কথা জোর গলায় প্রচার করছেন। তিনি আইনগত কাঠামো আদেশের বলে সবকিছু করবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন। এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র? গণতন্ত্রে এরূপ আদেশের কোন নজির কোন দেশে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি এলএফও’র কঠোর নিন্দা করেন ।
তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের গণতন্ত্র শুধুই মুখের কথা। কোন দেশে পার্লামেন্টকে কেউ বাঁধা দেয় না। এটা গণতন্ত্রের নিয়ম বহির্ভূত।
জনাব ভুট্টোর পরিষদ বর্জনের হুমকি প্রসঙ্গে ন্যাপ প্রধান বলেন, এটাও নজিরবিহীন ঘটনা। আজাদীপূর্বকালে ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পার্লামেন্টে যোগ দেব না এরূপ কথা বলে নি। আইন পাসের ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের বিরুদ্ধে সংখ্যাবলিষ্ঠ দল পরিষদে বাঁধা প্রদান করেছে, যুক্তিতর্ক, ন্যায়বিচার ও ইনসাফের দোহাই দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত ওয়াকউট করেছে। ভুট্টোর উচিত ছিল সেই গণতন্ত্রসম্মত পথ অনুসরণ করা। পশ্চিম পাকিস্তানি গরীব জনগণের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যদি কোন আইন পাস করতো বা তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবার চেষ্টা করতো এবং একথা যদি ভুট্টোর দল প্রমাণ করতে পারতো, তাহলে জনমত তার দলের পক্ষে যেত।
তিনি ইন্দোনেশিয়ার মার্কিন ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করে বলেন, সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই হত্যার প্রতিশোধ ইন্দোনেশিয়ার জনগণ নেবেই।
নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে গুলি করে হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের মা-বোনদের আজ গুলি করে মারা হচ্ছে। গত পরশু আমি চলে গিয়েছিলাম। এক মহিলা কেঁদে লুটিয়ে পড়লেন। তাঁর ছেলে রাজশাহীতে পড়তো, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেই মহিলা চিৎকার করে কাঁদছে। বাংলা মা’র কোল এমনি করেই খালি করে বাংলাকে ক্রন্দসী বাংলা করছে।
তিনি বলেন, সন্তানের জন্য মায়ের যে বেদনা তা ইয়াহিয়া বুঝবেন না। সন্তানহারা মায়ের অভিশাপ বিফলে যাবে না। বিভিন্ন দ্রব্যাদির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্য তিনি গ্রামে গ্রামে সর্বদীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সিমেন্টের দাম ইতোমধ্যেই প্রতি বস্তা এগার টাকা হতে পনের টাকায় ও ঢেউটিন প্রতি বান একাশি টাকা হতে দু’শো ৪২ টাকায় উঠেছে।
তিনি বলেন পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবেই। এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এখন হতে প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ব্যাপারে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। চরিত্র গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ হতে একটি কানাকড়িও যেন বাইরে পাচার না হয় তৎপ্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
মওলানা ভাসানী বাঙালি, অবাঙালি, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ইত্যাদি ভেদাভেদ ভুলে সকলকে মিলেমিশে থাকার আহবান জানান।
তিনি বলেন, বিহারীদের আমি বড় ভালোবাসি। ওরা অত্যাচারিত হয়ে এদেশে এসেছে। ওরা পশ্চিম পাকিস্তানি নয়, হিন্দুস্তানের অধিবাসী ছিল। তাদের ওপর বহু নির্যাতন হয়েছে।
তিনি বলেন, এদের সকলের সম্পত্তি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। কারণ এগুলো আমাদের দেশের সম্পদ।
সভার শুরুতেই গণআন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের জন্য মওলানা ভাসানীর ইমামতীতে গায়েবী জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
আতাউর রহমান
পল্টন ময়দানের জনসভায় বক্তৃতাকালে জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান কালবিলম্ব না করে বাংলায় জাতীয় সরকার ঘোষণা করার জন্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহ্বান জানান।
জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, আজ আর আমাদের মধ্যে কোন কোন্দাল নেই। বাংলার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাঙালি জজ, সিএসপি ও সরকারী কর্মচারীরাও আজ জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ। তাঁরা রক্ত দিচ্ছেন এবং প্রয়োজন হলে আরো রক্ত দেবেন। তাই এই মুহূর্তে শেখ মুজিব জাতীয় সরকার গঠন করলে সবাই তাঁর হুকুম মেনে নেবে। আজকের এই মুহুর্তে আর বারবার ফিরে আসবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জাতীয় লীগ নেতার বলেন, বাংলার আজ মহা দুর্দিন। বাঙালি জাতির আজ চরম পরীক্ষা। বাঙালি এখন জীবন্মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে স্বাধীনতার যে ওয়াদা করা হয়েছিল তা পূরণ করা হয় নি।
বাঙালিদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শোষকদের ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, তাঁরা বাঙালিদের শাসন ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব করতে চায় না। শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীকেও তারা বিশ্বাস করে নি। আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁরা ক্ষমতা দিতে চাচ্ছে না। তাই একবার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে আবার তা বন্ধ করে দেয় এবং পরে আবার তারিখ ঘোষণা করে। শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ভানুমতির খেলা শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল ফেলা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করতে হবে। কাজেই আপনি পরিষদের কথা ভুলে যান এবং জাতীয় সরকার ঘোষণা করুন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, বাঙালি জাতি আজ মৃত্যুকে উপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের ৭ কোটি মুক্তিপাগল মানুষকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।
ইতিপূর্বে জনসভার প্রস্তাব পাঠকালে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় ন্যাপ সম্পাদক জনাব মশিহুর রহমান বলেন, আজ রাজনৈতিক কোন্দালের দিন নয়। ন্যাপ কোন্দালে বিশ্বাস করে না। তাই আজ আমরা ঐক্যবন্ধ।