সংহতি বিরোধী তৎফরতার উপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতা

<2.173.693>

 

রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সম্প্রচারের মূলপাঠ
৬ মার্চ, ১৯৭১
নিন্মোক্ত মূলপাঠটি রাষ্ট্রপতি জেনারেল এ.এম. ইয়াহিয়া খানের জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ, যা রেডিও পাকিস্তান নেটওয়ার্কে আজ সম্প্রচার করা হয় :

 

“আমার প্রিয় দেশবাসী,

“আসসালাম-ও-আলাইকুম,

আমার ১ মার্চের বিবৃতিতে আমি আমার পদক্ষেপ আপনাদের কাছে বর্ণনা করেছিলাম যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে আমি সম্মত হয়েছি। একই বিবৃতিতে আমি বলেছি, আমাদের সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের দিকে চলতেও আমাদের নির্বাচিত নেতাদের সাহায্য করতে আমার পক্ষ থেকে যা কিছু সম্ভব সবকিছু করবো, যা একটি গণতান্ত্রিক জীবনের পথে একটি মসৃণ পরিবর্তনের দিকে ছিল এবং চলতে থাকবে।

 

আপনি স্মরণ করে থাকবেন, আমার সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে ১০ মার্চ ঢাকায় আমার সঙ্গে দেখা করতে সকল সংসদীয় দলের নেতাদের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে । দুর্ভাগ্যবশত, যেভাবেই হোক, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ফাঁকা স্থানগুলোর সেতুবন্ধন তৈরিতে আমার অকৃত্রিম ও আন্তরিক প্রচেষ্টার মাঝেও কিছু অবহেলার কারণে আমার আহ্বানে সাড়া দেয়ার  ব্যাপারে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাই বরং বিশেষভাবে নিরুৎসাহিত হয়েছেন, যিনি রেডিওতে ঘোষণার আগে আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এমন একটি সম্মেলনের ধারণায় তিনি নিস্পৃহ হবেন না। তাঁর এভাবে সরাসরি প্রত্যাখ্যান একইসাথে বিস্ময়কর এবং হতাশাজনক। আপনি অবগত আছেন যে, জনাব নুরুল আমিনও অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কার্যত এর অর্থ এই যে, প্রস্তাবিত সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোন প্রতিনিধি থাকবেনা।

 

আপনি দেখে থাকবেন যে, নির্বাচন যে সময় থেকে কার্যত ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হয়েছে ও আমি ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পাদন করছি, তখন থেকেই যেকোন ভাবে হোক আমাদের কিছু নেতাদের দ্বারা তা ব্যাহত হয়েছে। আমি এই পর্যায়ে এটাও উল্লেখ করতে পারি, ১৭ জানুয়ারী নির্বাচন সমাপ্তির পরে, এবং প্রধান দুই বিরোধীদলের নেতাদের সাথে আমি দেখা করার পর, এবং নেতাদের নিজেদের মধ্যে ঢাকায় দেখা হওয়ার পর একটি গ্রহণযোগ্য অগ্রগামী পদ্ধতিতে কাজ করার লক্ষ্যে আমার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে আমি তাদের একাধিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। আমি দুঃখের সাথে বলছি, আমার আমন্ত্রণে সাড়া দেয়াটা আওয়ামী লীগের সভাপতি উচিত মনে করেননি, এবং এজন্য আমাদের মাঝের ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো এবং একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার সুযোগ হারিয়েছি।

 

“পরবর্তী পরিবেশ সংবিধানের সহায়ক ছিল না বলে ৩ মার্চের পরিষদ অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের একটি বড় অংশ যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল,

 

 

<2.173.694>

 

যদিও আমি এই পরিস্থিতি রুখার চেষ্টা করেছিলাম অধিবেশনের তারিখ পিছিয়ে দিয়ে, বরং তার আগে আমি দু’টো কাজ করার চেষ্টা করেছিলাম, প্রথমত, সংসদ এবং সকল জাতীয় প্রচেষ্টাকে রক্ষা করা এবং দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওয়ার সময় প্রদান করা যাতে একটা ফলপ্রসু আলোচনার দুয়ার খোলা থাকে। কিন্তু, আমার সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ এমনভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হলেন যে তা জনগণের জান মালের ক্ষয়ক্ষতিপূর্ণ ধ্বংসাত্নক দিকে মোড় নিল। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কোন সরকারই এরকম সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। বরঞ্চ এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল চরমপন্থীদের হাত থেকে নিষ্পাপ শান্তিকামী আইন মেনে চলা নাগরিকের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যাহোক, আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলতে বাধ্য হচ্ছি আইন না থাকাটাই পূর্ব পাকিস্তানের আইন।

ভুল বোঝাবুঝি

কিছু কারণে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘটনা সম্পূর্ণ ভুল ভাবে বোঝা হয়েছিল। এটা ইচ্ছাকৃতবা যাই হোক না কেন এটা নিশ্চিত যে এই ভুল বোঝাবুঝিটাই গোলযোগকারী বাহিনীর আন্দোলনের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। যখন এ ধরণের শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন সবথেকে বেশি ভোগান্তিটা যায় সাধারন নিরীহ মানুষের উপর দিয়ে, তাদের দৈনন্দিন জীবনে চরম বিশৃংখলা দেখা যায় এবং তারা সবসময় শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যুর ঝুকির মধ্যে থাকে।পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়োগ করে কার্যকরভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনা যাবে এটা উপলধ্বি করে আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেই যাতে করে ন্যুনতম প্রয়োজনীয় বল প্রয়োগ করে আইন-ভঙ্গকারীদেরকে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যাকান্ড থেকে বিরত রাখা যায়।

দেখা যায় যে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার পিছনে আমার কারণগুলোর মাত্র একটি অর্জিত হয়েছে। একই রকম গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য কারণ যেমন একটি সফল সংলাপ আয়োজন করা, সেগুলো অর্জিত হয় নি। এর মধ্যে অনেক নিরীহ লোক মারা যাচ্ছে যাদের পরিবারের প্রতি আমার পূর্ণ সমবেদনা আছে তাও আবার এমন এক পরিস্থিতিতে যেটা মোটেই আমার সৃষ্টি নয়।

জাতীয় সংসদ অধিবেশন শুরু করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দিন নির্ধারনের লক্ষ্যে রাজনীতিবিদদের সাথে আমার আলোচনা হতাশাজনক ভাবে ব্যর্থ হয়, যেমনটি আগেই বলেছিলাম।

একারণে আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক প্রশাসক হওয়ার সুবাদে এই দুর্ভাগ্যজনক অচলাবস্থা নিরসনে নিজের দায়িত্ব অনুভব করি এবং নিজেই একটি সিদ্ধান্ত নেই। অনির্দিষ্টকালের জন্য আমি অপেক্ষা করতে পারি না। ফলস্বরূপ, আমি ঠিক করি যে জাতীয় সংসদের প্রারম্ভিক অধিবেশন ২৫ শে মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। আমার আন্তরিক আশা যে সকল রাজনৈতিক নেতাদের নিকট থেকে আমি দেশপ্রেম এবং গঠন্মূলক সাড়া পাব। যেহেতু সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক নেতাদেরকে একটি সম্মতিতে আনতে আমার প্রচেষ্টা সফল হয় নি, তাই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধানের প্রাপ্যতা নিয়ে যে সকল রাজনৈতিক দলের সন্দেহ আছে, তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই যে এ ক্ষেত্রে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার থেকে আর বড় কোন বিধানের প্রয়োজন নেই।

সবশেষে পরিষ্কারভাবে এটা বলে দেই যে যাই ঘটুক না কেন, যতদিন পর্যন্ত আমি সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে এবং রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে আছি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরম অখন্ডতা আমি পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করব।

<2.173.695>

 

এই বিষয়ে কোন ভুল বা সন্দেহ না থাকুক। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ জনতার কাছে এই দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। তারা আমার কাছ থেকে এটা আশা করে এবং আমি কোনভাবেই তাদের নিরাশ করব না।লক্ষ লক্ষ নিরীহ লোকের মাতৃভূমিকে আমি মুষ্টিমেয় কিছু লোককে ধ্বংস করতে দেব না। পাকিস্তানের অখন্ডতা, সংহতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এ দায়িত্ব পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর, যে কাজে তারা কখনো ব্যর্থ হয় নি।

আমরা নিজেদের উপর পূর্ণ আস্থা এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাই,যে লক্ষ্য একটি গণতান্ত্রিক জীবন পদ্ধতি এবং জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যাতে করে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সমাধা করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে আমরাই বেছে নিয়েছি।

আল্লাহ আপনাদের সবার মঙ্গল করুন।

পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।