সুন্দরবনে প্রেতাত্মা
কোন কোন লোকের কতলগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন আমি দেখেছি যখনই তারা তাদের ইপ্সিত কোন কিছু সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই বশ্যতা স্বীকার বা মাথা নোয়াবার পরিবর্তে ওই কাজটাকে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য দ্বিগুন উৎসাহে বার বার চেষ্টা করেছে। নিরাশ হয়নি বা আশা ছেড়ে দেয়নি। এইসব লোকদের আমি ঈর্ষা করতাম, তাদের পদাংক অনুসরণ করার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হতাম। একবার দূঢ় আত্মপ্রত্যায়ে বলীয়ান হলে পরাজয়ের গ্লানিটুকু অকিঞ্চিতকর মনে হয়। বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে যখন আমি ভারতে আসি, তখন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে এ রকম একটা অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলাম। শেষবারের মতো আমি ৭২ নং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর বাসভবনে থামলাম। অস্ত্রশস্ত্র যোগাতে তিনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। নৈশভোজের পর তিনি আমাদের গাড়ীতে করে কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মিঃ মজুমদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁকে জানালেন যে, অধিনায়ক হিসেবে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য আমি অনেক কাজ করতে পারবো। আমার কি কি অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন মিঃ মজুমদারকে জানালাম। তিনি বেশ ধৈর্যের সাথে কথাগুলো শুনে আমাকে আশ্বাস দিয়ে ভদ্রভাবে বললেন যে, তাঁর সামর্থ্যমত প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। মিঃ মজুমদারের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। বেশী আশ্চর্য হলাম তাঁর সুন্দর ভদ্রতাবোধ দেখে এবং আশ্বাস বাণী শুনে।
ওই দিনই সন্ধ্যায় কোলকাতার আসাম হাউজে নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিঃ রুস্তমজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে হলো। মিঃ মুখার্জীকে নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলাম। আমার প্রতি যে আন্তরিকতা ও ভদ্রতা দেখিয়ে তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তাতে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। বেশ আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী সিনিয়র অফিসার। তার সাথে কথাবার্তায় আমার দূঢ় বিশ্বাস হলো যে, বেশ অল্পদিনের ভেতরেই আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাব। অস্ত্র যোগাড় করাটাই আমার আসল উদ্দেশ্য। আমার চলাফেরার সময় মিঃ মুখার্জী ও তার অফিসের কর্মচারীরা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। তাদের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক ও বন্ধুসুলভ।
১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল মিঃ মুখার্জীর গাড়ীতে করে আমাকে মেজর উসমানের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি মুক্তিসংগ্রামের আর একজন অধিনায়ক। পাক দখলদার বাহিনীর সাথে তাঁর ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে পর পর কয়েকটা যুদ্ধ করে উত্তর বাংলার পট্রাপোলে তিনি ঘাঁটি গেড়েছেন। মেজর উসমান পাক আমলে ইপিআর-এ চাকরি করতেন। তিনি অনেক হালকা অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে রেখেছিলেন তাঁর ঘাঁটিতে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জমা দেখে আমার লোভ হলো। কারণ, পৃথিবীর যে কোন জিনিসের চাইতে এই প্রয়োজনের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিকের কাছে একটি মাত্র রাইফেল সবচেয়ে বেশী মূল্যবান। কেননা, অস্ত্র ছাড়া একজন সৈনিকের গর্ব ভূলুণ্ঠিত হতে বাধ্য। যাহোক অনেক কষ্টে অনেক বলা-কওয়ার পর মেজর উসমানকে বুঝতে সক্ষম হলাম যে আমিও তাঁর মত দেশের জন্য যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেজর উসমান রাজী হলেন। অন্ধকারের ভিতর আশার আলো দেখতে পেলাম। সমস্ত কৃতিত্বই অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর। তিনি নিজে মেজর উসমানকে ব্যাপারটা গুরুত্ব বুঝিয়ে রাজী করিয়েছিলেন। সুতরাং এক ট্রাক বোঝাই হালকা অস্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে আমি হাসনাবাদ ফিরে এলাম। এখানে এগুলো লঞ্চে বোঝাই করার বন্দোবস্ত করতে হবে। মেজর উসমানের সাথে আলাপ-আলোচনার সময় আমার সহকারী ক্যাপ্টেন হুদা বেশ ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তার উপরে প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি মিঃ মুখার্জীর সাথে ফোর্ট উইলিয়াম ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
প্রথমে ইস্টার্ন কমান্ডের ইনটেলিজেন্স অফিসার কর্নেল খেরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেনঃ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন আমি কোথায় কোথায় ছিলাম। কি কি করেছি ইত্যাদি। তিনি যা প্রশ্ন করলেন সবগুলোরই উত্তর দিতে হলো আমাকে। একটা লোক তাঁর কানে কানে কি বলতেই আমাকে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সাক্ষাৎ পেলাম। তাঁর স্মিত হাসি ও আন্তরিক ভদ্রতা আমাদের ভেতর ‘পদের’ বাধা মুছে ফেললো। আমার মনে ভরসা এলো। তাই কোন সংশয় না করে বা কোন কথা গোপন না করে তার কাছে মনের কথা সব কিছু খুলে বললাম। এর ফলে আমার উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হলো। একটা মানচিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের কোথায় আমার গেরিলা ঘাঁটি আছে তাঁকে দেখালাম। দেখে মৃদু হাসলেন এবং বললেন, খুব ভাল। সাথে কর্নেল খেরাকে নির্দেশ দিলেন আমাকে প্রয়োজনীয় সবরকম সাহায্য করতে। এখানে কর্নেল খেরার সাথে আমাকে পুরো তিনটা দিন থাকতে হয়। সামরিক বাহিনীতে অন্যান্য গোয়েন্দা অফিসারের মত তার অনুসন্ধিৎসু মনটা আমার সম্বন্ধে খুব উৎসুক হয়ে উঠলো। বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগের লোক হিসেবে খুব সতর্কতার সাথে কথা বললেন, নানা রকম প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চাইলেন যে, আমি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা কিনা। আমার পরিকল্পিত কাজের বিলম্ব হওয়াতে এই কয়টা দিন আমি ভয়ানক অস্থিরতার ভেতর কাটিয়েছিলাম। যাহোক, আমার বিরক্তি সত্ত্বেও তার ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা ও দেশের জন্য নিরাপত্তা বোধের আন্তরিক প্রশংসা না করে পারছি না। এখানেই তার কাছে প্রথম শুনলাম, ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানী দস্যুদের হাতে বরিশাল-ফরিদপুরের পতন হয়েছে। হতাশায় মনটা ভেঙ্গে পড়লো। এই জিলাগুলিকে রক্ষা করার পূর্ব পরিকল্পনা আমার সাময়িকভাবে ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও কঠিন সংকল্প নিলাম যে, যেভাবেই হোক এইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই হবে। অস্ত্র তুলে দিতে হবে মুক্তিসংগ্রামীদের হাতে। আমার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা। আমার বিলম্ব হবার আরও একটা কারণ হলোঃ সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম যে, কর্নেল এম এ জি ওসমানী যেভাবেই হোক আমার সাথে কোলকাতায় সাক্ষাৎ করতে চান।
৫ই মে পর্যন্ত আমি তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু তাঁর ফিরে আসার কোন লক্ষণই দেখলাম না। কেউ বলতে পারলো না কখন তিনি ফিরে আসবেন। তিনি তখন সীমান্তবর্তী অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কঠোর চেষ্টা করেছিলেন। এই বিলম্বে ভয়ানক চিন্তাম্বিত হয়ে স্থির করলাম আবদ্ধ কাজ সমাধান করার জন্য আমাকে এখনই রওয়ানা হয়ে যেতে হবে। ঠিক এই সময় মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদা পরিবার-পরিজন নিয়ে হাসনাবাদে পৌছলো। বরিশালের পতন হওয়াতে তারা চলে এসেছে।
ক্যাপ্টেন হুদাকে নির্দেশ দিলাম যে, যখন আমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকবো, তখন যেন বাহকের মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরিস্থিতি অনুকূল মনে হলে সরবরাহ ব্যবস্থা যেন অব্যাহত রাখে। আমাদের ক্যাম্পের দিকেও লক্ষ্য রাখতে বললাম। এই ক্যাম্পে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদার পরিবার-পরিজনও থাকতো।
সবাই মিলে মোট চল্লিশজন লোক দুটো লঞ্চে করে যাত্রা করলাম। আমাদের ভেতর চারজন নিয়মিত সেনাবাহিনীর লোক ছিল। বাকী সব ছাত্র। আমাদের গন্তব্যস্থানের রাস্তাঘাট আমার নিজেরও জানা ছিল না। লঞ্চে এরকম একটা দুঃসাহসিক যাত্রায় মোটেই ভরসা পাচ্ছিলাম না। যে কোন সময় বিপর্যয় আসতে পারে। যেহেতু যাওয়ার পথে শত্রুরা চারদিকে ওঁৎ পেতে বসেছিল, আমরা সবাই লঞ্চের পাইলটের উপর নির্ভর করলাম। পাইলটরা তাদের অনেক বছরে অভিজ্ঞতার বড়াই করে আশ্বাস দিল যে, তারা আমাদের নিরাপদে পৌছে দেবে। ওদের দুঃসাহসিক কথাবার্তা ও আত্মবিশ্বাসের জোর দেখে স্বভাবতই আমি আদেশ করা থেকে বিরত রইলাম, যেহেতু যাওয়ার প্রকৃত রাস্তাঘাট সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত। রাস্তা সম্পর্কে আমার ম্যাপ দেখা অস্পষ্ট ধারণা ছিল মাত্র। তৎসত্ত্বেও একটা সংক্ষিপ্ত ‘অপারেশন প্ল্যান’ তৈরী করলাম। প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝিয়ে বললাম কিভাবে দুটো লঞ্চে অস্ত্রশস্ত্র ভাগাভাগি করে নিতে হবে এবং শত্রুর সাক্ষাৎ পেলে নাগরিকরা কি করবে।
যাত্রা শুরু করার হুকুম দিলাম। একটা লঞ্চে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের এবং আরও কয়েকজন লোক আগে আগে চললো। আমার লঞ্চটা আগেরটার পিছু পিছু রওয়ানা হলো। কারণ, আমার লঞ্চে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অনেক অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ছিল। সামনের লঞ্চটায় মিঃ মঞ্জু ও লেঃ নাসেরকে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার ভার দিলাম। পথের নিরাপত্তা সম্বন্ধে তাঁরা দু’জনেই বেশ আশ্বস্ত ছিলেন। কারণ মাত্র দু’দিন আগেই তাঁরা এই পথে হাসনাবাদ এসেছেন। ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর পেট্রোল বোট ‘চিত্রাঙ্গদা’ আমাদেরকে শামশেরনগর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। এখান থেকেই আমরা যাত্রা শুরু করব। শামশেরনগর ভারতের শেষ সীমান্ত ঘাঁটি। রাত ৯টা। শুরু হলো যাত্রা। আশা-নিরাশার দোদুল দোলায় সারা দেহ -মনে চাপা উত্তেজনা। যাত্রার লগ্নে দূরে বহু দূরে দেখতে পেলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছাড়াও রাত্রের গুমোট অন্ধকার। গত কয়েক দিনের ক্লান্তিতে আমার চোখ দুটো জড়িয়ে এলো। গুম পেল আমার। ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দের মাঝেও আমি গভীর ঘুমে গা এলিয়েদিলাম। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখি কে যেন চাপা গলায় ডাকছেঃ ‘গানবোট, গানবোট স্যার’।
হ্যাঁ, সত্যিই তো গানবোট। ভূত দেখার মত উপরতলার ক্যাবিন থেকে ঝড়ের বেগে চীনা ‘কার্বাইনটা’ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ইঞ্জিন কক্ষে ঢোকা মাত্রই দু’দিক থেকে প্রচণ্ড সার্চলাইটের আলো আর মেশিনগানের গুলি আসতে লাগলো। ভেতরটা আমার অসম্ভব রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানী গানবোট ওঁৎ পেতে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। রাতটা ভয়ানক বিক্ষুদ্ধ। ঝড়ের দাপাদাপি। তার উপর চারদিক সূচীভেদ্য অন্ধকার আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণ। সার্চলাইট দিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে হানাদাররা তন্নতন্ন করে আমাদেরকে খোঁজ করতে লাগলো। একটা গুলি এসে লঞ্চের পিছন দিকটায় আঘাত করলো। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমার সাথের চার জন সৈনিক সিদ্দিক, হাবিলদার জব্বার মোখছেদ ও ইউসুফকে প্রথমে রাইফেলের গুলি করতে বললাম। যেন শ্ত্রুপক্ষ মনে করে আমাদের শক্তি খুব কম। আশ্চর্যজনকভাবে আমার এই পরিকল্পনাটা কাজে এলো। দেখতে পেলাম আমাদের বাঁ দিকের গানবোটটা পুরো সার্চলাইট জ্বালিয়ে বৃষ্টি ও বিক্ষিপ্ত ঢেউগুলোর ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের লঞ্চটার পিছন দিকটায় আরও কয়েকটি গুলি এসে লাগলো। বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত ও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে গুলির আওয়াজ অস্পষ্টভাবে আসছিল। সার্চলাইটের আলোকিত পথটুকুই শুধু চোখে পড়লো। পৃথিবীর আর সব কিছুই দৃষ্টির বাইরে। কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সমস্ত ব্যাপারটা এলোমেলো হওয়া সত্ত্বেও অল্প সময়ের ভেতর পাল্টা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিলাম। ইতিমধ্যে যে গানবোট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। সেটা প্রায় লঞ্চের কাছাকাছি এসে গেল। বলতে ভুলে গিয়েছি যে, আমাদের লঞ্চটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এটা নদীর তীরে, না মাঝখানে অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
দু’জনকে মেশিনগান, দু’জনকে ‘এনারগা গ্রেনেড’ সজ্জিত রাইফেল দিয়ে বাম দিকে বসিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটা মেশিনগান ডানদিকের গানবোটটাকে লক্ষ্য করে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথেই চারজনে ওই গানবোটটাকে লক্ষ্য করে প্রচন্ডভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করলো। এই সময় গানবোটটা আমাদের বেশ আওতার মধ্যে এসে গিয়েছিল। এই অতর্কিত আক্রমণে শত্রুরা ভয়ানক ঘাবড়ে গেল এবং ওদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। ওদের হৈ চৈ শুরু হলে এবং গানবোট থেকে বিরাঠ একটা আগুনের গোলা ছিটকে পড়লে বুঝতে পারলাম, আমাদের নিক্ষিপ্ত রকেট ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে। বামদিকের গানবোটটাকে চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ করে দিয়ে ডানদিকের গানবোটটাকে আক্রমণের জন্য ঘুরে বসলাম। কিন্তু ওটা বিপদের আশংকা করে মেশিনগানের আওতার বাইরে পালিয়ে গেল। যাহোক, শত্রুপক্ষকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার জন্য গুলিবর্ষণ অব্যাহত রইলো। এই সুযোগ অন্য দু’জন লোককে আমাদের আগের লঞ্চটার খোঁজ নিতে বললাম। কিন্তু মনটা ভীষণভাবে দমে গেল যখন দেখলাম আগের লঞ্চটা ঠিক আমাদের বামদিকে চড়ার উপর বিধ্ধস্ত অবস্থায় পড়ে আছে এবং ওর ভেতরের লোকজন আগেই পালিয়ে গিয়েছে।
সাথের বেশীর ভাগ লোকজন পালিয়ে গিয়েছে দেখে মনটা ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়লো। এমন সময় পালিয়ে গেল যখন তাদের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশী। অযথা চিন্তায় সময় নষ্ট না করে আমাদের সাথের চারজনের প্রত্যেককে এক-একটা ডাল, আমরা তীরের কাছাকাছি ছিলাম। অনিশ্চয়তা, নিরাশা ও ভয়ের আশংকা। আমরা তাড়াতাড়ি লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়লাম। পায়ের নিচে আঠালো কাদা। কোমর পরিমাণ জলের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে নদীর তীরে পৌছালাম। তীরটা আমার কাছে উঁচু বাঁধের মত লাগলো। নদী থেকে অনেক উঁচুতে বাঁধের উপর তাড়াতাড়ি ঘাঁটি গেড়ে বসলাম। সামনে থেকে যত আক্রমণই করা হোক না কেন আমরা এখানে পুরোপুরি নিরাপদ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অচেনা, অজানা পথ। জীবনে কোনদিন এখানে আসিনি। এসব চিন্তা করে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। শত্রুর উপস্থিতি, ঝড়ের বিলাপ , কুচকুচে কালো আঁধার-সব মিলে রাতটাকে একটা প্রেতাত্মার ছায়ার মত মনে হলো। হঠাৎ দেখতে পেলাম বাঁধের পিছন দিকে মানুষের একটা অস্পষ্ট ছায়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। শংকিত পদে ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে দেখলাম একটা লোক পালাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এত ভীত যে মনে হলো পৃথিবীটা খুঁড়ে তার ভেতর গিয়ে লুকাবে। মৃদুভাবে তাঁকে স্পর্শ করতেই এমন জোরে চিৎকার করতেই জোরে চিৎকার শুরু করলো যে, ভয়ে আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। তাকে সান্ত্বনা দেয়া সত্ত্বেও সে এমন বিলাপ করে চিৎকার আরম্ভ করলো যে, উপর দিকে একবারও চাইবার সাহস পেল না। গরীব বেচারা। প্রায় বিকারগ্রস্ত। অনেক চেষ্টার পর সে শান্ত হলো। এই লোকটা হচ্ছে সেইসব পাইলটদের একজন যারা লম্বা লম্বা গালভরা কথা বলেছিল। অবশ্য তার কোন দোষ নেই। কারণ সে কোনদিন গুলির শব্দ শোনেনি। যাহোক এই লোকটা আমার অনেক উপকার এলো। আমি কোন জায়গায় আছি এটা সে নির্ভুলভাবে বলে দিল। এসব ব্যাপার এই ক্ষুদে ‘সাহসী’ লোকটির বেশ জোর আছে। এই জায়গাটার নাম ‘গাবুরা’। জায়গাটার পরিবেশ ও অবস্থানের কথা চিন্তা করে সংশয় জাগলো যে, ভোর হওয়া পর্যন্ত যদি আমরা এখানে থাকি তাহলে শত্রুপক্ষ হয়তো বা আমাদের মত লোভনীয় বস্তুগুলোর উপর হাওয়াই হামলা চালিয়ে ওদের করেই বসে তাহলে কিছুতেই রুখতে পারব না। এই অত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, কোন রকমে ‘ক্রলিং’ করে গ্রামের অভ্যন্তরে চলে যাওয়া।
আমাদের পিছন দিকে এই গ্রামগুলো প্রায় এক মাইল দূরে। ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষের গানবোটটা অনেক দূরে পিছিয়ে গিয়ে বাঁধের উপর আমাদের অবস্থান ও নদীর তীরে পরিত্যক্ত লঞ্চ দুটোকে লক্ষ্য করে ভীষণভাবে মেশিনগান ও রকেটের গোলাবর্ষণ শুরু করলো। ওদের অবিরাম গোলাবর্ষণে আমাদের দুটো লঞ্চেই আগুন ধরে গেল। বর্তমান অবস্থানে থাকাটা অযৌক্তিক ভেবে আমরা ক্রুলিং করে কোন রকমে বাঁধের নিচের দিকে চলে গেলাম আর খোদাকে স্মরণ করতে লাগলাম। কারণ এ দুঃসময়ে এক খোদা ছাড়া আর কেউ শত্রুর হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিল না। ঠিক এই সময় আমার সঙ্গের চারজন সৈনিক এদিক-ওদিক সরে পড়লো। সম্ভবত তারা গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। পাইলট ছাড়া আর কাউকে আমার চারপাশে দেখলাম না। মেশিনগানের গর্জন আর রকেটের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনে পাইলট আধমরার মতো আমার কাছে পড়ে রইল। গোলার ভয়ংকর আগুনে আমাদের লঞ্চ দুটোকে নির্দয়ভাবে গ্রাস করলো। পরাজিত মন ও ক্লান্ত দেহটা বাঁধের পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে হতাশার গ্লানি নিয়ে চেয়ে রইলাম লেলিহান বহ্নিশিখার দিকে। গোলার প্রচণ্ড শব্দ, রকেট বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। উৎকট গন্ধে ভরপুর সমস্ত আকাশটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন- পরাজয়ের কালিমায় কিছুটা মলিন। পূর্ব দিকটা সামান্য হালকা হতেই পাইলটকে টেনে নিয়ে কোন রকমে গ্রামের ভিতর ঢুকে সাহস করে সেখানে এক হাজী সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। আমাদের প্রতি সহৃদয় হবার জন্য ইঙ্গিতে তাকে অনুরোধ জানালাম। যখন তাকে খোদার চাইতেও জেনারেল ইয়াহিয়ার উপর বেশী অনুগত দেখলাম তখন যুগপৎ ভয় ও বিস্ময়ে মনটা বিচলিত হলো। গ্রামের অধিকাংশ লোককেই দেখলাম বর্বর ইয়াহিয়ার প্রতি অনুগত ও ভক্ত। আমাদের প্রতি ভয়ানক বিরুপ মনোভাবাপন্ন মনে হলো। প্রকৃতপক্ষে এখানকার স্থানীয় লোকজনই আমাদের সাথের লেঃ নাসের, গণপরিষদ সদস্য মিঃ মহিউদ্দিন ও আরো ছাব্বিশজন লোককে ধরে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় এবং সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আমিও এই রকম একটা গন্ধ পেলাম যে হাজী সাহেব আমাদেরকে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে তুলে দেবার জন্য গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের চারদিকে অনেক লোকের ভীর। তারা আমাদেরকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে। আমরা দু’টি যেন অদ্ভুত জীব। আমাদের এরকম দুরবস্থা দেখে ওদের মধ্যে কেউ কেউ দুঃখও প্রকাশ করলো। এ অবস্থা দেখে হাজী সাহেবেরও বোধ হয় দয়া হলো। তিনি আমাদের কিছু ভাত ও মধু দিলেন। এটা সুন্দর বনাঞ্চলের লোকদের একটা বিশেষ খাদ্য। খাবার দেখা মাত্র আমার চোখ দুটো বড় হতে লাগলো। কেননা আমি ও আমার সঙ্গের পাইলট উভয়েই ভয়ানক ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ছিলাম। গত রাতের ভয়ংকর পরিবেশ আমি ওর সাথে বড্ড একাত্ম ও আপন হয়ে গিয়েছিলাম। যখনই এই অনির্ধারিত খাবার শেষ করে ফেলেছি, ঠিক সেই সময় হাজী সাহেব হাতে করে রাইফেলের ‘ছেরেফ’ একটা ‘বোল্ট’ নিয়ে হাজির হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, এটা কি ? কেননা তার ধারণা ছিলো এটা কোন কাজে আসে না। তার চোখের কোণে ভীতির চিহ্ন।
এই দালাল শিরোমণিকে নিয়ে কিছু মজা করবো স্থির করলাম। তার হাতে বোল্টটা দেখেই ভীতিজড়িত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলাম এবং হাজী সাহেবকে বললাম যে, তাঁর হাতের জিনিসটা খুব মারাত্নক ডিনামাইট। মাটিতে যেন কোনরকমে না পড়ে তাহলে সবাই মারা যাবে। শুনে হাজী সাহেব ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। এইবার হাজী সাহেবকে হাতের মুঠোয় পেলাম। আমার কথায় তার কাঁপন শুরু হলো। তার চক্ষু স্থির, রক্তহীনের মত বিবর্ণ। আপাদমস্তক ভয়ে কাঁপতে লাগলো। আমার হুঁশিয়ারি স্মরণ করে তিনি বোল্টটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মত সৎ সাহসও দেখাতে পারছিলেন না। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে আমি বললাম যে, ডিনামাইটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ওটাকে পানির মধ্যে ফেলে দেয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমার কথা খুব আস্তে আস্তে আঙ্গুল টিপে টিপে বোল্টটার দিকে অপলক দৃষ্টি মেলে হাজী সাহেব পুকুরের দিকে রওনা হলেন। এই দুরবস্থার মধ্যেও আমার ভয়ানক হাসি পেল। যখনই এই মজার ব্যাপারটা ঘটছিল তখন হঠাৎ গানবোট থেকে হাজী সাহেবের বাড়ির দিকে আবার গোলাবর্ষণ শুরু হলো। হাজী সাহেবের বাড়ীটা বড় একটা দালান। বহু দূর থেকে দেখা যায়। এই আকস্মিক ঘটনায় গ্রামের লোকজন যে যেদিকে পারলো ছিটকে পড়লো। এটা আমাদের পালানোর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ দেখা দিল। আমার সাথের পাইলটটি মাত্র নদীর পথ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। সে সাহচর্য ছাড়া আর কোন প্রয়োজন আসলো না। যাহোক, একটা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দিনটা কোন রকমে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার সাথে সাথে আরম্ভ হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের প্রতি খুব সদয় ছিল। হাজী সাহবের ব্যবহারে আশ্বাস ও স্বস্তির রেশটুকু খুঁজে না পেলেও আমাদের প্রতি তার ছেলের মমত্ববোধ দেখে এই দুঃসময়েও বাঁচার ক্ষীণ আশায় বুক বাঁধলাম। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের খুঁজে বের করলো। তাকে দেখে ভরসা পেলাম। সে আমাদের আশ্বাস দিল যে, খুব ভোরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছে দিবে। তাঁর সহানুভূতিশীল মনের পরিচয় পেয়ে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম- আবার সেখানে ফিরে গিয়ে সযত্নে প্রহরায় নির্বিঘ্নে রাত কাটিয়ে দিলাম। প্রতিশ্রুতিমত হাজী সাহেবের ছেলে রাস্তার সব খবরাখবর আমাদেরকে খুলে বললো এবং খুব ভোরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দিয়ে গেল। খেয়া পার হবার জন্য সে আমাদের কিছু টাকা-পয়সাও দিল। কেননা রাস্তায় অনেক নদী ও খাল পার হতে হবে। পথটা অত্যন্ত বিপদসংকুল। তাছাড়া সমস্ত অঞ্চলটা পাক দালালে ভর্তি। প্রাণটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে আমরা প্রায় আধ মাইল পথ অতিক্রম করলাম। কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায় এইভাবে ভারতে সীমান্তবর্তী ঘাঁটি হিংগলগঞ্জ এসে পৌছালাম। হিংগলগঞ্জের ঠিক উল্টো দিকে পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটি বসন্তপুর। পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের ফেরার খবর আগে থেকেই পেয়ে ওঁৎ পেতে আমাদের ধরার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু ওদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা নিরাপদ জায়গায় পৌছে গেলাম। ২৬ জন ছাড়া সঙ্গের অন্যান্য সবাইও পৌছে গেল।
আমরা যে বেঁচে গিয়েছিলাম এটা ভাগ্য নয়। এটা একটা চরম পরাজয়। আর এজন্য আমি দায়ী। কেননা অধিনায়ক হিসেবে রাস্তাঘাটের সাথে পরিচিত ছিলাম না। তারপর অধীনস্থ লোকদের উপর নির্ভরশীল হয়ে নিজের বিবেককে করেছিলাম খর্ব, তাই হারিয়ে ফেলেছিলাম নির্দেশ দেওয়ার শক্তি। কিন্তু এক অর্থে এই পরাজয়ের গ্লানি একটা বিরাঠ বিজয়। কেননা, এটা একটা সাহসী পদক্ষেপ মাত্র। ভবিষ্যত যাতে চরমভাবে আঘাত হানতে পারি তার জন্য নতুন করে শপথ নিলাম।