সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরতঃ দেশব্যাপী আন্দোলন

<2.171.687- 690>

 

     শিরোনাম      সুত্র     তারিখ
সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরতঃ দেশব্যাপী আন্দোলন দ্যা ডন ৬ মার্চ, ১৯৭১

 

 

সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত- পূর্বাঞ্চলে প্রতিবাদ চলমান- টঙ্গী ও রাজশাহীতে গুলিবর্ষণ।

মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষের ঘোষণা- ৫ ই মার্চ, ১৯৭১।

 

 

মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ আজ সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটি ঘোষণানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর বলা হয়েছে যে- বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কারফিউ ওঠানোর পর থেকে বেআইনি কোন কার্যক্রম হয়নি।

 

এই ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে যে- শেখ মুজিবুর রহমানের শান্তি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিগত ২৪ ঘণ্টায় সাধারণ আইন ও পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।

 

এটি মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে বুধবার পল্টন ময়দানের জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তব্যে শহর থেকে তাৎক্ষণিক সেনা উত্তোলনের  দাবি জানান এবং ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করতে বলেন। ঠিক তখন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সেনাত্তোলনের দাবি জানাচ্ছে।

 

অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে শহরে তো বটেই অন্যান্য স্থানেও হরতাল পরিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে। আজ ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় হরতালের চতুর্থ দিন এবং এ অঞ্চলে হরতালের তৃতীয় দিন পালিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের প্রধান ঘোষণা দিয়েই রেখেছিলেন যে এই হরতাল আগামীকাল পর্যন্ত বলবত থাকবে।

 

আজ যদিও ব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিকেলে ২ ঘণ্টার জন্য খোলা রাখা হয়েছে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধের জন্য । শেখ মুজিবুর রহমান গতকালই নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে প্রতিষ্ঠানগুলো আজ আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত এ কারণে খোলা রাখা যাবে। তিনি আরও কিছু প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনকে হরতালের আওতার বাইরে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

 

 

 

                                                            টঙ্গীতে গুলিবর্ষণ

 

সকালে টঙ্গীতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের কারণে মৃতের সংখ্যা আরও বেড়েছে আজই ঢাকা মেডিকেল কলেজে দুজনের মৃত্যু হওয়ায়।

 

টঙ্গীর টেলিফোন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ওপর নিরাপত্তা কর্মীদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণের কারণে ইতিপূর্বে একজন নিহত ও ১৫ জন আহতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আশা হয়েছিল। এর মাঝে একজন হাসপাতালে ভর্তির পরপরই মারা যায় ও দ্বিতীয়জন অপারেশনের পর চোটের কাছে হার মেনে।

 

 

 

                                                        রাজশাহীতে গুলিবর্ষণ

 

রাজশাহীতে বুধবার মিছিল চলাকালীন সময়ে গুলিবর্ষণে একজন নিহত ও চারজন আহত হয়েছে।

 

 

 

জেলা প্রশাসনের একজন বক্তা পিপিআইকে আজ বিকেলে বলেছেন যে দুটি জায়গায় ঝামেলা হয়েছে। একবার মালোপাড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে এবং পরে একইদিনে মেডিকেল কলেজের সামনে।

 

তিনি বলেছেন এই ঘটনার পর শহরে সকাল ৭ টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১১ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়েছে স্থানীয় মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ দ্বারা। তিনি বলেন, তিন ঘণ্টার একটি বিরতি দিয়ে গতকাল সকাল ১০ টা থেকে আজ সকাল ৭ টা পর্যন্ত আবার কারফিউ জারি করা হয়েছে।

 

আজ এখানে আসা তথ্যানুযায়ী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকা হরতাল তেসরা মার্চ থেকে শান্তিপূর্ণভাবেই পালিত হচ্ছে এখানে।

 

 

 

                                                                    কারফিউ

 

রংপুর শহরে ১০ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়েছে আজ সন্ধ্যা থেকে। এখানে আসা তথ্যানুযায়ী ২১ ঘণ্টার কারফিউ যেটি গতকাল বিকেল ৫ টা থেকে শুরু হয়েছিল তা আজ সকালে ১১ টায় তুলে দেয়া হয়েছে।

 

রাজশাহীতেও আজ সন্ধ্যা ৭ টা থেকে ১০ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়েছে।

 

 

                                                              হরতাল

 

জাতীয় সংসদ অধিবেশন হঠাৎ পেছানোর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকা হরতালে সমর্থন দিয়ে ঢাকা শহর ও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে আজ আট ঘণ্টার হরতাল পালিত হচ্ছে।

 

ঢাকা শহর ও এর আশপাশের এলাকায় চতুর্থ দিনের মতো শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে তৃতীয় দিনের মতো।

 

আট ঘণ্টার হরতাল আজ সকাল ৬ টা থেকে শুরু হয়ে কাল পর্যন্ত বলবত থাকবে। শহরের কোন অংশ থেকেই অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনার খবর পাওয়া যায় নি কিন্তু শহর থেকে দশ মেইল দূরে টঙ্গীতে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে।

 

সকল সরকারি ও বেসরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, মিল ও ফ্যাক্টরি, ব্যাংক, ইন্সুরেন্স কোম্পানি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত ও অন্যান্য স্থাপনা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল হরতাল চলাকালীন সময়ে। সবধরনের যানবাহন (কেবল কিছু ডাক্তারি, সংবাদপত্র, শান্তি কমিটির গাড়ি ও এম্বুলেন্স ছাড়া) রাস্তায় চলাচল বন্ধ ছিল।  ট্রেন, স্টিমার, লঞ্চ ও স্থানীয় উড়োজাহাজ চলাচলও হরতালে বন্ধ ছিল।

 

আওয়ামী লীগ প্রধান ব্যাংকদের নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন যে বেতন পরিশোধের খাতিরে চেক গ্রহণ করে টাকা প্রদান করতে এমনকি সে টাকার পরিমান ১,৫০০/- টাকার মাত্রা ছাড়ালেও। তবে সেক্ষেত্রে বেতন খাতায় মোট টাকা উত্তোলনের পরিমাণ ও চেকের সামঞ্জস্য থাকতে হবে।

 

দলের একটি প্রেস রিলিজ মোতাবেক ব্যাঙ্কদের যেকোনো ধরণের বিল পরিশোধ করতেও বাঁধা নেই তবে সে প্রতিষ্ঠানের বিলকে অবশ্যই ট্রেড ইউনিয়ন কর্তৃক পাশকৃত হতে হবে।

 

আগের একটি নির্দেশনানুযায়ী ব্যাংকদের চেকের ক্ষেত্রে ১,৫০০/- টাকার বেশি পেমেন্ট করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

 

 

 

 

খাবার মজুতদারদেরও ডেলিভারি শেষ করার জন্য অনুমতি দেয়া হয় সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত দোকান খুলে রাখার।

 

আজকের এই হরতালের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে অনেক ওষুধের দোকান হরতাল চলাকালীন সময় খোলা ছিল এবং অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন দেয়ার জন্য দু ঘণ্টা খোলা ছিল।

 

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং অন্যান্য ব্যাংকগুলোও দুই ঘণ্টার জন্য বিকেলে খোলা রাখা হয়েছে বেতন উত্তোলন ও রেশন দোকানিদের সুবিধার জন্য।

 

 

                                                                   ব্যাংকের কাজ

 

রেশনের দোকান ও অন্যান্য খাদ্য সরবরাহকারীরা আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটার মাঝের সময়টুকুকে কাজে লাগিয়েছে।

 

শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় আট ঘণ্টার সাধারণ হরতাল পালনের পর পরিতৃপ্তির জন্য জনগণের সুবিধার্থে বেতন উত্তোলন ও প্রতিদিনের খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা করার সুযোগ করে দেয়া হয়।

 

সবগুলো ব্যাংকেই আড়াইটা বাজার ঢের আগে অনাকাঙ্ক্ষিত তাড়া লক্ষ্য করা যায় সবার মাঝে। মানুষদের অনেক সময় ধরেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে টাকা তোলার জন্য, প্রধানত বেতন।

 

যখন পিপিআইয়ের একজন সাংবাদিক সাড়ে ৪ টার সময় মতিঝিলে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে গমন করে (বন্ধ হবার সময়ে), তখন কয়েকশ মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সময়ের মাঝে কাজ সারার খাতিরে। রেশন দোকানি ও খাদ্য সরবরাহকারীদের ভিড়ই ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের কাউন্টারগুলোতে।

 

কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পরিষদের একজন জনাব এস.ই কবিরকে এসময় ব্যস্ত অবস্থায় কাউন্টারগুলোর সামনে দেখা যায়।

 

এটা এখানে বলা বাঞ্ছনীয় যে, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক এই বিকেলে ক্যাশ টাকা উত্তোলনের নতুন রেকর্ডই গড়েছে।

 

 

                                                                        সমাবেশ

 

এই দিনে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে অসংখ্য সংখ্যক সমাবেশ অনুষ্ঠিত ও মিছিল বের করা হয়।

 

দুপুর দুটোর পর শহুরে জীবন স্বাভাবিক হয়ে যায়। এক কঙ্কালস্বরূপ বাসকে এসময় রাস্তায় দেখা যায়। কিছু দোকান ও ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানকে হরতালের সময়ে খোলা থাকতে দেখা যায়।

 

ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ বাইতুল মোকাররম থেকে ‘বাঁশের মিছিল’ বের করে এবং শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। তারা বাইতুল মোকাররমের সামনে একটি সমাবেশেরও আয়োজন করে।

 

পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জাতীয় সংসদ অধিবেশন পেছানোর ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের হত্যার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমাবেশের আয়োজন করে। পরে মিছিল নিয়ে রাস্তা প্রদক্ষিণও করে।

 

ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) এবং বাংলা ছাত্র লীগ বিদেহী আত্মাদের জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। তারা জনমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য দুর্দশার চলমান প্রক্রিয়ায়ও আলোকপাত করে।

 

 

 

কিছু শপিং সেন্টার যেমন জিন্নাহ এভিনিউ, বাইতুল মোকাররম, স্টেডিয়াম ও নিউমার্কেটে হরতালের পরও দোকান বন্ধ রাখা হয়।

 

পাকিস্তানের সচেতন লেখক সমাজও একটি সমাবেশের আয়োজন করে সেখানে জাতীয় অধিবেশন পেছানো নিয়ে নিজেদের শঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা শহরের রাস্তায় মিছিল বের করেন এবং রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন।

 

খিলগাঁও ভূমিসরবরাহকারী কমিটিও সন্ধ্যায় বাইতুল মোকাররমে একটি র‍্যালির আয়োজন করে।

 

গৃহিণী, ছাত্রি ও নারায়ণগঞ্জের শিক্ষকরাও প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করেন এবং মার্শাল ল’ তুলে নেবার দাবী জানিয়ে স্লোগান গেয়ে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাধারণ মানুষের আন্দোলনে নিজেদের একাত্মতা প্রকাশ করেন।

 

পূর্ব পাকিস্তান সরকারি কলেজ শিক্ষক এসোসিয়েশনও নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন জাতীয় অধিবেশনের সময় পেছানো নিয়ে। আজকের একটি সমাবেশে এসোসিয়েশন বলেছে যে এটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যার প্রতিবাদও করেছেন। এই মিটিং এ আওয়ামী লীগ প্রধানের প্রতি সমর্থনও জানানো হয়েছে।

 

জাতীয় শ্রমিক লীগের মতে লীগের এই সিদ্ধান্তের কারণে কিছু ফ্যাক্টরি এবং মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

 

পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক জোটের (এপিইউজে) সদস্যরা কাল বিকেলে জনগণের আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে সমাবেশের আয়োজন করবে।

 

এপিইউজের সভাপতি জনাব কামাল লোহানী সকল সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন প্রেস ক্লাবে দুপুর ৩ টার সময় উপস্থিত থাকার জন্য যেখান থেকে একটি মিছিল বের হবে। মিছিলটি পরে গিয়ে বাইতুল মোকাররমে একটি জনর‍্যালিতে পরিণত হবে।

Scroll to Top