স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বানে বাংলা ছাত্রলীগ

<02.158.649-651>

 

 

  শিরোনাম          সূত্র    তারিখ
স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আহবানে বাংলা ছাত্রলীগ  বাংলা ছাত্রলীগ  ২১ ফেব্রুয়ারী,১৯৭১

‘স্বাধীন সার্বভৌম গণ-বাংলা’ কায়েম করো

মহান ৮ই ফাল্গুন(২১শে ফেব্রুয়ারী) উপলক্ষে

বাংলা ছাত্রলীগ এর ডাক

 

অতীতের সংগ্রামী প্রতিশ্রুতি নিয়ে মহান ৮ই ফাল্গুন আবার আমাদের দ্বারা সমাগত।৮ই ফাল্গুন আমাদের জাতীয় জীবন ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ক্রান্তিলগ্ন।বরকত,সালাম,রফিক,জব্বার,রফিক,সালাউদ্দিন এমনি একদল অমিততেজা দুঃসাহসী যুবক বুকের তাজা খুনের বদলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করেছেন,আজ থেকে ১৯ বছর আগে এমনি এক রক্তক্ষরা ফাল্গুনে।সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে এমনি আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত আর নেই।

সেই সুমহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ প্রতি বছরই এক স্মরণীয় দিনটিতে সবাক হয়ে ওঠে।শপথ নেয় দুঃসাহসের ।বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করে,আমরা বরকতের ভাই-আমরা সালামের ভাই।

কিন্তু মায়ের ভাষা বাংলাকে সেই ইপ্সিত মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে পেরেছি কি আমরা?৮ই ফাল্গুনের আনুষ্ঠানিক আতিশয্যের আড়ালে আমাদের অক্ষমতার,আমাদের ব্যর্থতার,আমাদের হীনমন্যতার যে কুৎসিত চিত্র মুখাবাদান করছে,তাকে উপেক্ষা করে এই আত্মপ্রবঞ্চনা আর কতকাল আমরা চালিয়ে যাবো?

ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ের দুই দুইটি দশকেও আমরা আজো জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে পারি নি।এর চিতে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে?

কিন্তু তার চাইতেও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে,ভাষা আন্দোলনকে আমরা যেন কেবল বাংলা হরফে ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি।আমরা ভুলে গেছি যে, বাংলা ভাষার উপর কায়েমী স্বার্থের হামলা ছিল মূলতঃ বাংলার সংস্কৃতি ও বাংগালী জাতির স্বাধীকার বিলুপ্তির বৃহত্তর ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ।

’৬৯ এর গণআন্দোলন ও  ’৭০ এর নির্বাচনের আলোকে আজ সমগ্র জগতের কাছে বাংগালী জাতির স্বাতন্ত্র্য এবং স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার চিরন্তন আকুতি পরিষ্কার হয়ে পড়েছে।এই পটভূমিতে ৮ই ফাল্গুন আজ বাঙালীর সামগ্রিক অধিকার তথা ‘জাতীয়তাবাদী, স্বাধীন, সার্বভৌম গণ-বাংলা’ গঠনের নবতর সংগ্রামের ডাক দিচ্ছে।

বাংলা ছাত্রলীগ সেই সংগ্রামেরই দৃপ্ত সারথী।বাংলার প্রতিতি ছাত্রছাত্রি সেই সংগ্রামের নিরভীক সোইনিক।তাই এবারকার ৮ই ফাল্গুনে আমাদের কন্ঠের তূর্যে ধ্বনিত হোক সেই অভয় মন্ত্রঃ জয় স্বাধীন বাংলা।

বরকত,সালাম,রফিক,জব্বার,সালাউদ্দীনের আত্মাকে সাক্ষী রেখে আমাদের দ্যর্থহীন ঘোষণা-

(১)অবিলম্বে সরকারী অফিস-আদালতে বাংলার মাধ্যমে কার্যনির্বাহের ব্যবস্থা কর,অন্যথায় বিদেশী ভাষা সংরক্ষণের যাদুঘরে,সরকারি অফিস-আদালতগুলো আমরা নিশ্চিহ্ন করে দেবো।

(২)ব্যবসায়ীক ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির নিকট আমাদের দাবী,কেবল সাইনবোর্ড পালটে গেলেই চলবে না,পরিপূর্ণভাবে বাংলার ব্যবহারে মন দিতে হবে; অন্যথায় তাদের এই মনোভাবকে আমরা বাংলার জনগণকে প্রতারণার প্রচেষ্টা হিসাবে ধরে নেবো।

(৩)শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র,সার্টিফিকেট ইত্যাদি এ বছর থেকেই বাংলা ব্যবহার করতে হবে।প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষাও বাংলায় নিতে হবে।আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এ ব্যপারে যে কোন প্রকার শৈথিল্যের পরিণতি হবে ভয়াবহ।

(৪)আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অটুট রেখে বাংলার সহজাত সংস্কৃতির বিকাশে মন দিতে হবে,বিদেশী ও পশ্চিম পাকিস্তানী পর্ণগ্রাফিক পুস্তক ও সিনেমার আমদানী বন্ধ করতে হবে।বাংলার মানুষ এ ব্যাপারে আর কোন দ্বিতীয় চিন্তার সুযোগ দিতে রাজী নয়।

(৫)আমাদের সর্বশেষ, কিন্তু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দাবী-

শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের ও বিভিন্ন মানের বিদ্যায়তনগুলোকে একই মানে আনতে হবে।অর্থাৎ কিন্ডারগারটেন,মিশনারী,মন্টেশ্বরী,পাবলিক স্কুল,মডেল স্কুল ইত্যাদি সুবিধাভোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিলোপ ঘটিয়ে সারা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সমপর্যায়ে এনে শ্রেণীহীন,সার্বজনীন ও গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশেষ সুবিধাভোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়ার ব্যাপারে জাগ্রত ছাত্র সমাজকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ঘোষণা করতে হবে।

 

       আল মুজাহিদ                                                        মোশাররফ হোসেন

       সভাপতি                                                             সাধারণ সম্পাদক

                                বাংলা ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ

এবারের ৮ই ফাল্গুন উপলক্ষে বাংলা ছাত্রলীগের কর্মসূচীঃ-

    ১৮ই মাঘ(১লা ফেব্রুয়ারী)ঃ বস্তী এলাকায় নিরক্ষর ছেলেমেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার জন্য বই,খাতা,পেন্সিল,শ্লেট বিতরণ।

    ২০ই মাঘ(৩রা ফেব্রুয়ারী)ঃ দেয়াললিপি,পোস্টার ও প্রচারপত্র বিলি।

    ২২ই মাঘ(৫ই ফেব্রুয়ারী)ঃ  নিরক্ষর নাগরিকদের মধ্যে ভ্রাময়মাণ অবস্থায় অক্ষরজ্ঞান প্রদান।

    ২৬শে মাঘ(৯ই ফেব্রুয়ারী)ঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামফলক বাংলায় করার প্রচার অভিযান।

    ২৭শে মাঘ(১০ই ফেব্রুয়ারী)ঃ এবছর থেকেই শিক্ষার মাধ্যম বাংলায় করার জন্য শিক্ষা বিভাগীয় প্রধান কর্মকর্তাদের কাছে স্মারকলিপি পেশ।    

    ৩০শে মাঘ(১৩ই ফেব্রুয়ারী)ঃঅফিস আদালতের নথিপত্র বাংলায় প্রবর্তন করার অভিযান।

    ১লা ফাল্গুন(১৪ই ফেব্রুয়ারী)ঃ বিকেল ৪ টায় রমনা পার্কে আলোচনা সভা ও গণমুখী সাহিত্যানুষ্ঠান ও গণসংগীতের আসর।

     ৩রা ফাল্গুন(১৮ই ফেব্রুয়ারী)ঃরাস্তার মোড়ে মোড়ে শিক্ষামূলক দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ।

     ৪ঠা ফাল্গুন(১৭ই ফেব্রুয়ারী)ঃ খন্ড মিছিল ও পথসভা।

     ৫ই ফাল্গুন(১৮ই ফেব্রুয়ারী)ঃমধুর ক্যান্টিনে সংগীত মিছিল।

     ৬ই ফাল্গুন(১৯ই ফেব্রুয়ারী)ঃ সন্ধ্যায় সংগীত মিছিল।

     ৭ই ফাল্গুন(২০শে ফেব্রুয়ারী)ঃ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে বিকাল ৩-৩০ মিনিটে ছাত্র গণজমায়েত।

      ৮ই ফাল্গুন(২১শে ফেব্রুয়ারী)ঃ ভোর পাঁচটায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারী ও বেসরকারী ভবন এবং সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন,প্রভাত ফেরী,ভোর ৬ টায় শহীদানদের মাজার জিয়ারত এবং কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও শপথ গ্রহণ।বিকাল ৩ টায় ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে বিরাট ছাত্রজনসভা ও সন্ধ্যায় গণ-সংগীতের আসর।