স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার আহবান

<2.183.712-714>
                            শত্রু বাহিনীকে মোকাবেলায় প্রস্তুত হউন      

                    গণস্বার্থে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন  

ভাইসব ,

বাংলাদেশের জনগণ আজ গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখানে একটা পৃথক ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করিতে বদ্ধ পরিকর হইয়াছেন ও এই জন্য এক গৌরবময় সংগ্রাম চালাইতেছেন। এই সংগ্রামে জনগণ সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে অসম সাহসিকতার সহিত মোকাবেলা করিতেছেন এবং নিজেদের  আশা – আকাঙ্খা পূরণের জন্য বুকের রক্ত ঢালিতেও দ্বিধা করিতেছেন না । কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব বাংলার সংগ্রামী বীর জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাইতেছে । পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট রা  দীর্ঘকাল হইতেই বাঙালী সহ পাকিস্তানের সকল ভাষাভাষী জাতির বিচ্ছিন্ন হইয়া পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দাবী করিয়া আসিতেছে । পূর্ব বাংলার জনগণ আজ অনেক ঘটনার ঘাত – প্রতিঘাতের ভিতর দিয়া পূর্ব বাংলায় একটি পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যে দাবী উত্থাপন করিয়াছেন , আমরা উহাকে ন্যায্য মনে করি , তাই পূর্ব বাংলার জনগনের বর্তমান সংগ্রামে আমরাও সর্বশক্তি লইয়া শরিক হইয়াছি ।

 

জনগনের দুশমন কাহারা?

 

বাংলাদেশে পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের এই সংগ্রামে জনগনের দুশমন হইল পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ও বর্তমান সামরিক সরকার । পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বড় বড় জোতদার – জায়গিরদার – মহাজন ও একচেটিয়া পুঁজির মালিক ২২ টি পরিবারের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্য গত ২৩ বছর বাংলাদেশের শ্রমিক – কৃষক , মধ্যবিত্ত – ছাত্র প্রভৃতি জনগনকে  শোষন এবং নিপীড়ন করিয়াছেন সাম্রাজ্যবাদ , সমাজবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণকে জাতীয় অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হইতে আগাগোড়া বঞ্চিত করিয়াছে । আজও উহাদের স্বার্থেই ইয়াহিয়া সরকার প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীসমূহের নয়া নেতা ভুট্টোর সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নস্যাৎ করে ও গনতন্ত্র , জাতীয় অধিকার এবং শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে লিপ্ত রহিয়াছে এবং সেনাবাহিনীকে জনগনের বিরুদ্ধে নিয়োগ করিয়াছে । সেনাবাহিনীকে জনগনের বিরুদ্ধে নিয়োগ করিয়াছে । সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় ইতিমধ্যেই গণহত্যা ঘটাইয়াছে ও রক্তের বন্যায় পূর্ব বাংলায় জনতার সংগ্রামকে স্তব্ধ করিবার জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে ।

 

তাই বাংলাদেশের দুশমন হইল সাম্রাজ্যবাদ – সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী সরকার ও উহাদের সেনাবাহিনী । পশ্চিম পাকিস্তানের পাঠান , বেলুচ , সিন্ধি , পাঞ্জাবী জাতিসমূহের মেহনতি জনতা পূর্ব বাংলার জনগনের শত্রু নয় । বরং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের গণতন্ত্র ও বিভিন্ন জাতি – গোষ্ঠীর  জাতীয় অধিকারকেও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীই নস্যাৎ করিয়া রাখিয়াছে । পূর্ব বাঙলার উর্দু ভাষাভাষী মেহনতি জনগণকেও ঐ শাসকগোষ্ঠী শোষণ ও নিপীড়ন করিতেছে । তাই ঐ দুশমন দের পরাজিত করিয়া বাংলাদেশের জনগনের দাবী কায়েম করার জন্য আজ এখানে গড়িয়া তুলিতে হইবে বাঙালী – অবাঙালী , হিন্দু – মুসলমান জনগনের দুর্ভেদ্য একতা। ঐ দুশমনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণ কে বেলুচ – পাঠান – সিন্ধি – পাঞ্জাবী মেহনতি জনগণকে মিত্র বলিয়া মনে করিতে হইবে এবং পূর্ব বাংলার সংগ্রামে তাহাদের সাহায্য পাইতে সর্বদাই সচেষ্ট থাকিতে হইবে । এই সংগ্রামে এখানকার জনগনের সুদৃঢ় ঐক্য ও বেলুচ – পাঠান প্রভৃতির সমর্থন যত বেশি গড়িয়া উঠিবে গণদুশমনদের পরাজয়ও ততই নিশ্চিত হইবে ।

 

প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে অবিচল থাকুন

 

ঐক্যবদ্ধ গণশক্তি ও জনতার সংগ্রামের জোরে গণদুশমনদের ও উহাদের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করিয়া এখানে জনগণের দাবী মতে ‘ স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলা ‘ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রসর করিয়া লইতে হইবে । কিন্তু স্বাধীন বাংলা যাহাতে সাম্রাজ্যবাদীদের ডলারের শৃংখলে বাঁধা না পড়ে , স্বাধীন বাংলার কৃষক সমাজের উপর যাহাতে জোরদার মহাজনদের শোষন না থাকে , স্বাধীন বাংলায় যাহাতে শ্রমিক ও জনসাধারণকে পুনরায় পুঁজিপাতিদের শোষণ ও নিপীড়নে ধুঁকিয়া ধুঁকিয়া মরিতে না হয় , সেজন্যও সংগ্রামকে দৃঢ় ভাবে আগাইয়া লওয়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক – কৃষক – ছাত্র মধ্যবিত্ত জনতাকে তাহাদের সংগ্রাম আগাইয়া লওয়ার আহবান জানাইতেছে ।

 

কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশে এমন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র – গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের আহবান জানাইতেছে যেখানে সাম্রাজ্যবাদ , সামন্তবাদ , উৎখাত করিয়া ও পুঁজিবাদী বিকাশের পথ পরিহার করিয়া জনগণের স্বার্থে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করা ও সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হইবার বিপ্লবী পথ উন্মুক্ত হইতে পারে ।

 

বিভ্রান্ত হইবেন না

 

কতকগুলি তথাকথিত ‘ কমিউনিস্ট পার্টি ‘ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ‘ ধর্মঘট , অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতির প্রয়োজন নাই’, ‘ গ্রামে গ্রামে কৃষি বিপ্লব শুরু কর ‘, জোতদারদে গলা কাট ‘ প্রভৃতি আওয়াজ তুলিতেছে ।  কোন কোন নেতা স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা হইয়া গিয়াছে বলিয়া ধ্বনি তুলিয়া আজিকার গণসংগ্রামের উদ্দীপনা সংকল্প ও প্রস্তুতিতে ভাটা আনিয়া দিতে চাহিতেছেন । মার্কিনী এজেন্টরা এই সংগ্রামে অনুপ্রবেশ করিয়া সংগ্রামকে বিপথগামী করার প্রচেষ্টা করিতে পারে। শাসকগোষ্ঠীর ও প্রতিক্রিয়াশীল দের উস্কানিতে সমাজবিরোধী দুস্কৃতিকারীরা দাঙ্গা – হাঙ্গামা , লুটতরাজ প্রভৃতি বাধাইয়া সংগ্রামকে বিনষ্ট করিতে তৎপর হইতে পারে ।এই সকল বিষয়ে হুঁশিয়ার ও সজাগ থাকার জন্য আমরা জনগণের প্রতি আহবান জানাইতেছি ।

 

দৃঢ় সংকল্প বজায় রাখুন

 

বাংলাদেশের জনগণ আজ অভূতপূর্ব দৃড়তার ও একতার সাথে অফিস – আদালতে হরতাল , খাজনা – ট্যাক্স বন্ধ প্রভৃতির যে সংগ্রাম চালাইতেছেন , সে সংগ্রাম ইতিমধ্যেই ইতিহাসে এক নূতন নজির স্থাপন করিয়াছেন । সামরিক সরকারের হুমকি , দমননীতি , অভাব – অনটন প্রভৃতির মধ্যেও সে সংগ্রাম শিথিল বা দমিত হইবে না এবং শত্রুর নিকট আমরা কখনও নতি স্বীকার করিব না – এই দৃঢ় সংকল্প আজ বাংলার ঘরে জাগিয়া উঠুক ।

 

ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করুন

 

নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর , সামরিক শাসন প্রত্যাহার প্রভৃতি যে দাবীগুলি আওয়ামী লীগ প্রধান উত্থাপন করিয়াছেন , সেগুলি আদায় করতে পারলে স্বাধীন বাংলা কায়েমের সংগ্রামের অগ্রগতির সুবিধা হইবে – ইহা উপলদ্ধি করিয়া ঐ দাবীগুলির পিছনে কোটি কোটি জনগণকে সমাবেত করা এবং ঐ দাবীগুলি পূরণে ইয়াহিয়া সরকারকে বাধ্য করা – ইহা হইল এই মূহুর্তে জরুরী কর্তব্য।

 

সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করুন

 

বস্তুতঃ হরতাল , লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশ , মিছিল , সরকারী অফিস – আদালত ও   সামরিক বাহিনীর সহিত অসহযোগ প্রভৃতি শান্তিপূর্ণ পন্থায় বর্তমান পর্যায়ে জনগণের আকাংখিত স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে চালাইতে হইবে ।

কিন্তু জনগণকে আজ সংগ্রাম করিতে হইতেছে প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে । তাই শান্তিপূর্ণ পন্থায় শেষ পর্যন্ত জনগনের সংগ্রাম বিজয়ী হইবে এইরূপ মনে করিবার কারণ নাই । প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর আজ্ঞাবাহী সেনাবাহিনী জনগণের উপর সশস্ত্র হামলা শুরু করিতে পারে । তাই আত্মতুষ্টির কোন কারন নাই । সংগ্রাম যে কোন সময় সুতীব্র  রূপ ধারণ করিতে পারে । এই স্বতঃস্ফূর্ততার উপর নির্ভর না করিয়া সুশৃংখল্ভাবে সংগ্রামের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহন করা দরকার । সেনাবাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা , উহা প্রতিরোধ করার জন্য শহর – গ্রাম সর্বত্র জনগণকে সংগঠিত ভাবে প্রস্তুত হইবার জন্য আমরা জনগণের প্রতি আহবান জানাইতেছি ।

এই জন্য পাড়ায়,  মহল্লায় , গ্রামে কল – কারখানায় সর্বত্র দলমত নির্বিশেষে সমস্ত শক্তি নিয়া গড়িয়া তুলুন স্থানীয় সংগ্রাম কমিটি ও গণবাহিনী । সেনাবাহিনী আক্রমণ করিলে উহা প্রতিরোধের জন্য ব্যারিকেড গঠন করুন , যাহা আছে উহা দিয়েই শত্রুকে প্রতিহত করুন ।

 

শ্রমিক – কৃষক ভাইরা এগিয়ে আসুন

 

আজিকার সংগ্রাম জনগণের ন্যায্য সংগ্রাম । পশুশক্তির বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে বিজয়ের বজ্রকঠিন শপথ ও সংকল্প নিয়া আগুয়ান হওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আজ নারী – পুরুষ , জাতি – ধর্ম – নির্বিশেষে বাংলাদেশের সমস্ত জনগণকে বিশেষতঃ শ্রমিক , শহরে গরীব বস্তিবাসী , কৃষক ও ছাত্রসমাজের প্রতি আহবান জানাইতেছে । সাহসের সহিত শত্রুর বিরুদ্ধে সঠিকভাবে সংগ্রাম চালাইতে পারিলে আমাদের জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত ।

 

                                                                                                                 কেন্দ্রীয় কমিটি

ঢাকা                                                                                                পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট  পার্টি

তাং ৯ -৩ -১৯৭১

Scroll to Top