৭৭। ‘ইত্তেফাক’-এর সাংবাদিকের লেখায় ২৫ শে মার্চের রাতের সামরিক হামলার প্রত্যক্ষ বিবরণ (৪৮৫-৪৮৮)
‘ইত্তেফাক’-এর সাংবাদিকের লেখায় ২৫ শে মার্চের রাতের সামরিক হামলার প্রত্যক্ষ বিবরণ
সুত্র-‘বাংলাদেশে গণহত্যা, বাংলার বাণী, বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২।।
মৃত্যুতে বিস্মিত হবার কিছু নেই,
বেঁচে থাকাটাই পরম বিষ্ময়।
মৃত্যুতে বিস্মিত হবার কিছু নেই, বেঁচে থাকাটাই পরম বিষ্ময়। কথাটা যে কে বলেছিলেন, ঠিক এই মুহূর্তে আমি তা স্মরণ করতে পারছি না। তবে কথাটা যে অসত্য বা অতিরঞ্জিত কিছু নয় নিজ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। আর না করেই বা উপায় কি। সাক্ষাৎ মৃতুর মুখ থেকে বেচেঁ যাওয়া সে যে কত বড় বিষ্ময় তা অনুমানের পর অনুভূতির ব্যপার, সে বিভীষিকাময় স্মৃতি যখন মনে করি , তখন প্রকৃতই নিজের জিজ্ঞেস করতে প্রবৃত্তি হয় , আমি বেচেঁ আছি তো।
এর জবাব দেয়ার জন্য আমাকে ফিরে যেতে হবে পচিঁশে মার্চের সেই ভয়ংকর রাতে। যে রাতে আমরা আটটি প্রাণী প্রাণান্তকর অবস্থার ভিতর দিয়ে অনুভব করেছি প্রতিপক্ষের মৃত্যু যন্ত্রণা। লক্ষ্য করেছি একদল মানুষ জন্তুর হু – হুংকার্। আর শ্মশানের শেষ প্রান্ত চরদের মানুষের জীবন নিয়ে কানামাছি খেলার নিদারুণ উপহাস।
দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পাদকীয় বিভাগের একজন সদস্য হিসাবে সাধারণত রাতের বেলা অফিসে থাকার কথা আমার ছিল না। কিন্তু স্বভাব যায় না মলে। আড্ডা মেরে যার অভ্যাস , সকাল সকাল সে বাসায় ফিরে কেমন করে। সকাল দশটার দিকে অফিসে আসতেই এডিটর সাব ডেকে বললেন , শেষ পরিনতি মোটামুটি ভালোর দিকেই মনে হচ্ছে। আপনাকে একটা এডিটরিয়াল লিখতে হবে। এডিটরিয়ালটার বক্তব্য বিষয় হবে মোটামুটি এরকম।
সাড়ে বারটার মধ্যেই আমার লেখা শেষ হয়ে গেল। গেলাম প্রেসক্লাবে এবং তারপর সেখান থেকে সবুজ শ্যামল ছাওয়া রমনা পার্কের পূর্বদিকস্থ সাবেক প্রেসিডেন্ট ভবনের( গণভবন) কাছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ভবনের পশ্চিম দিকের ফুটপাথের উপর একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু পুলিশ আর পুলিশ এবং সে সাথে উর্দিপরা ও সাদা পোশাক পরিহিত সামরিক সেনারা। এদের গর্হিত পদক্ষেপ আর শ্যেন দৃষ্টি কালা পাহাড়ের চিত্তকেও ভীতিবিহবল করে তোলে। সেখানে অধিক্ষণ দাঁড়ানো তাই স্বস্তিকর বোধ হল না। ফিরে এলাম প্রেসক্লাবে। কথাবার্তা এবং বাতাসে ভেসে আসা গন্ধে যেন অনুভব করলাম একটা দ্রুত পরিবর্তনের সুর্। প্রভাত সূর্য যে আশা ও সম্ভাবনার বাণী নিয়ে উদিত হয়েছিল , পড়ন্ত বেলায় যেন তা রাহুগ্রস্ত প্রায়। এ অবস্থায় বাসায় ফিরব মনে করে পথে নামতেই সিরাজ ভাই( শহীদ) ডেকে বললেন “মিলন, চল অফিসে যেতে হবে।” কেন জিজ্ঞেস না করেই রিকশায় তার পাশে যেয়ে বসলাম। তিনি বলতে লাগলেন,”সবকিছু উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা ভীষণ পরিনতির দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।” এমনি বেশি কথা বলার অভ্যাস আমার নেই , তদুপরি বক্তব্যটির কোন সদুত্তর খুজে পেলাম না। পুনর্বার যখন অফিসে ফিরে এলাম রাত তখন ন ‘ টা। তাড়াতাড়ি প্রেস থেকে এডিটরিয়াল টা আনিয়ে আপাদমস্তক সংশোধন করলাম। তখন কে জানতো কাল প্রভাতে কেন কোন দিনই এ সম্পাদকীয় আর আলোর মুখ দেখবে না।
রাত দশটার দিকে সিরাজ ভাই কে বললাম ‘ ভাব -সাব ভারী খারাপ মনে হচ্ছে , ছলুন বাসায় ফিরে যাই। ”
তিনি জবাব দিলেন , “কেমন করে যাব, কাগজ বের করতে হবে না?”
প্রত্যুত্তরে আমি আর কিছু বলা সমীচীন বোধ করলাম না। জানতাম ইত্তেফাক সিরাজ ভাইর প্রাণ , সিরাজ ভাইর ধমনীতে এর স্রোত প্রবাহিত , সুতরাং বলে কয়ে লাভ নেই। আরো কিছুক্ষণ আলাপ করার পর তিনি বললেন ” তুই বরং চলে যা”. কিন্তু আমার জানি কেন অফিস ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কি ঘটে না ঘটে তা দেখার ও জানার কৌতুহলে পেয়ে বসেছিল আমাকে। তবু রাত এগারোটার দিকে আমি , আমির হোসেন আর নজরুল অফিসের পিকআপ কারে রওয়ানা হলাম মগবাজারের দিকে। কিন্তু যাওয়া আর হল না। তদানীন্তন গভর্নমেন্ট হাউস ( বঙ্গভবন ) এর কাছাকাছি যেয়ে থেমে গেল পিকআপের চাকা। প্রসারিত দৃষ্টির সম্মুখে ইট , কাঠ , লোহা – লক্কড়ের ব্যারিকেড .দশ হাত অন্তর সমস্ত পথ জুড়ে এ অবস্থা। আর ইত:স্তত চঞ্চল চরণের ভীড়। কারো হাতে লোহার ডান্ডা, কারো বা বাঁশের লাঠি। এ ডান্ডা আর লাঠি দিয়েই মানুষ জঙ্গিশাহীর দানবদের রোধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মনে মনে ভাবলাম এ কি সম্ভব? আধুনিক মরণাস্ত্রের সম্মুখে লাঠি সম্বল করে তিষ্টে থাকা কি অকল্পনীয় নয়? তবু মনে মনে আনন্দিত হলাম এই ভেবে যে, সত্যি বাঙ্গালী আজ জেগেছে।
সেখান থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে এলাম অফিসে কিন্তু আমির হোসেন আর নজরুল ফিরলেন না। শ্রীচরণে ভরসা করে তারা চলে গেলেন যে যার গন্তব্যস্থলে। অফিসে ফিরে সিরাজ ভাইর নিচের তলার ঘরটিতে যেয়ে দেখি ঘর শূন্য। তিনি চলে গেছেন উপরে বার্তা বিভাগীয় কক্ষে। সেখানে তখন অস্বাভাবিক অবস্থা। সকলেই কলম তুলে বসে আছেন। দলে দলে লোক আসছে – যাচ্ছে। বেশিরভাগই তরুণ। তাদের চোখে মুখে ভীতি মিশ্রিত জিজ্ঞাসা। খবর পেলাম মহাখালীর দিকে নাকি মিলিটারী এগিয়ে যাচ্ছে। আর একজন তরুণ প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এসে বললেন , এই মাত্র খবর পেলাম, মিলিটারী ইকবাল হল ঘিরে ফেলেছে। সেখানে গোলাগুলি চলছে। আপনারা কিছু জানেন কি?
আমরা তাদের মতই উড়া খবরের কথা বললাম। সিরাজ ভাই তাদের যার যার ঘরে চলে যেতে পরামর্শ দিলেন। মুহুর্মুহু টেলিফোন আর সংবাদ সংগ্রহেচ্ছুক লোকজনের আগমনে ইত্তেফাক অফিস চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু সে মাত্র স্বল্পক্ষণের জন্য , রাত বারোটা বাজতেই বহির্জগতের সাথে আমরা সম্পূর্ণ যোগাযোগ হারিয়ে ফেললাম। এতক্ষণ যে টেলিপ্রিন্টারের শব্দ হচ্ছিল তা স্তব্ধ হয়ে পড়ল, ছিন্ন করে দেয়া হল টেলিফোন যোগাযোগ। আমরা তখন আটটি প্রানী অপেক্ষা করছি চরম মুহুর্তের জন্য।
রাত গভীর হতে শুরু করল। আর সে গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে নিকট থেকে নিকটতর হতে লাগল মেশিনগানের কর্ণবিদারী শো শো গর্জন, অসহায় মানুষের প্রাণফাটা আর্তনাদ,মাতা,ভগ্নী ,জায়ার সকরুণ বিলাপধ্বনী। ঢাকার বুকে শুরু হল নারকীয় তান্ডবের উন্মত্ত লীলা। এরই মধ্যে আমরা নীচের ক্যান্টিন থেকে এক টিন টোস্ট বিস্কুট আর অফিস পিয়ন আমিরের দোকান থেকে আনিয়ে নিলাম কয়েক প্যাকেট সিগারেট। মৃত্যু যতক্ষণ না তার হিমশীতল বক্ষে টেনে নিচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত একটা কিছু খেতে হবে। এমনি প্রাণান্তকর উতকন্ঠা আর মেশিনগান ও স্টেনগানের গর্জনের ভেতর দিয়ে রাত শেষ হয়ে এল। আবছা অন্ধকারে ঢাকা রাজধানীর রাজপথের চেহারাটা দেখার জন্য সিরাজ ভাই আর রেজা ভাই যেয়ে দাড়ালেন ইত্তেফাক অফিসের পশ্চিম প্রান্তস্থ দ্বিতলের জানালার পাশে। প্রভাত রজনীর অবস্থা অন্ধকারে অবগুন্ঠনে ঢাকা সাবেক
গভর্নমেন্ট হাউসের দিক থেকে তখন ছুটে আসছে একটি সামরিক জীপ। সিরাজ ভাই আর রেজা ভাই ভাবলেন , জীপটা বোধকরি ইত্তেফাকের মোড় দিয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু নিমিষে তাদের সে ধারণা টুটে গেল। সম্বিত ফিরে পেতে দেখলেন সিরাজ ভাই দ্বিতলে মেঝেতে পড়ে গেছেন। আর তারই পাশে রক্তাক্ত দেহ শামছু, আমাদের ক্যান্টিন বয়। মেশিনগানের শিশার বুলেট ডান কানের নীচে গন্ডদেশ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু জীবন তখনও স্পন্দনহীন হয়ে পড়েনি। কে যাবে ডাক্তার ডাকতে? কোন ডাক্তার আসবে এ সময়? আমরা কয়টি প্রাণী অশ্রুহীন অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলাম নিরপরাধ শামছুর মৃত্যু। কিন্তু এখানে রুদ্ধবাক বিষ্ময়ের শেষ নয়। একজন ছুটে এসে বললেন নীচে আমাদের গেইটের সামনে একটি প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। সুযোগ বুঝে এক সময় আমরা অজ্ঞাত পরিচয় সে ব্যক্তির মৃতদেহ নিয়ে এলাম অফিসের আঙ্গিনায়। সে একজন হকার্। তার পকেটে তখন আশিটি টাকা, হাতে হাতঘড়ি, আর একটা সাইকেল। কে জানে এই আশিটি টাকাই তার পরিবার – পরিজনের অন্নবস্ত্র সংগ্রহের মূলধন কি না।
বেলা অনুমান ১০ টার দিকে (২৬ শে মার্চ) এ বাড়ি ও বাড়ির উপর দিয়ে শামছুর মৃতদেহ পাঠানো হল গোপীবাগ মসজিদে। কিন্তু নাম না জানা হকার ভাইটির মৃতদেহ পাঠানো সম্ভব হল না। শামছুর মরদেহ মসজিদে অপসারণের পর আমরা আবার বার্তা বিভাগের কক্ষে যেয়ে আশ্রয় নিলাম। জীবনাভূতি বলতে যা বুঝায় কিছুই তখন নেই। সিরাজ ভাই তখন শুধু মাঝে মাঝে আক্ষেপ করছেন , ‘হায়’ বাচ্চাকাচ্চাদের দেখে যেতে পারবো কি না কে জানে। সাড়ে দশটার দিকে একটা বিশেষ শব্দে আমরা চমকিত হয়ে উঠলাম। রেজা ভাই বললেন: ‘এটা ট্যাঙ্কের শব্দ ‘. পূর্ব দিকের জানালার ফাক দিয়ে উকি মেরে দেখলাম- হ্যা তাই।তিনটি ট্যাঙ্ক মতিঝিল রোড হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গন্তব্যস্থল সম্ভবত : রাজারবাগ। সেখানে কি হত্যাযজ্ঞ চলছে? হানাদার পশুর দল কোন কোন এলাকাকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করেছে কিছুই তার জানার বা বুঝার উপায় নেই। শুধু অভিসার সিনেমা হল আর গোপীবাগের মোড়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে মানুষজন ভর্তি ডজন ডজন সামরিক যানের ভীড়। দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে অভিসার সিনেমা হলের দিকে তাকাতে নজরে পড়ল তিন চারটি পশু সিনেমা হলের পশ্চিম দিকের একটি প্রাচীর ঘেরা বাসার প্রাচীরের উপর উঠে ভেতরে মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করছে। রেজা ভাই সাবধান করে বললেন , খবরদার কেউ বাইরে তাকাবে না। বাইরে থেকে দেখতে পেলে আর রক্ষা নেই। রক্ষা প্রকৃতই ছিল না। কারণ লক্ষ্য করেছিলাম রাজপথে কোন বেরিকেড কিংবা কাক পাখির চিহ্ন না থাকলেও কতক্ষণ পর পরই মেশিনগান থেকে ইত্তেফাকের উপর গুলী বর্ষণ করা হচ্ছিল। এ যেন নিষ্প্রাণ জড় পদার্থের উপর জাত ক্রোধ মেটানো। মেশিনগানের গুলির চোটে ইত্তেফাকের পশ্চিম দিকের জানালার শার্শী ঝন-ঝন করে ছিটিয়ে পড়েছিল। আর সে সাথে আমরা ক ‘জন কখনো আশ্রয় নিচ্ছিলাম টেবিলের তলায় , আবার কখনো বা আলমারী-টালমারীর তলায়। জীবন মৃত্যুর এই লুকোচুরি খেলায় জঠর জ্বালার কথা স্বভাবতই মনে থাকার কথা নয় কিন্তু মনে করিয়ে দিলেন প্রেসের কয়েকজন সহকর্মী বন্ধু। হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠে এসে বললেন পাশের বাসা থেকে কিছু ভাত আনার ব্যবস্থা হয়েছে। কে জানে আরো কতকাল এমনিভাবে থাকতে হবে। আপনারাও দুমুঠো খেয়ে নিন। কিছুক্ষণ পর উক্ত কর্মী বন্ধুটি একটি এলুমিনিয়ামের পাত্রে করে ভাত দিয়ে গেলেন তরকারি আনতে। কিন্তু সে যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হল। তিনি আর তরকারি নিয়ে ফিরে আসতে পারলেন না। নীচে থেকে ভেসে আসল সুপারী ঠুকলে যে বিশেষ ধরনের শব্দ হয় তেমনি শব্দ। পরে বুঝেছি সে শব্দটা আর কিছুই না, তালা ভাঙ্গার শব্দ। সে শব্দ শেষ না হতেই আবার ভেসে আসলো সে পরিচিত আওয়াজ। দেখলাম একটা ট্যাঙ্ক এসেছে। দাড়িয়েছে ইত্তেফাক অফিসের পশ্চিম দিকের মোড়ে। তারপর আর দেখতে হল না। বিকট এক বোমার আওয়াজের সাথে সাথে থর থর করে কেপেঁ উঠল ইত্তেফাক ভবন। মাটির পুতুলের মত ঝরে পড়ল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কক্ষটি। আমরা উন্মাদের মত লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে। এ ভাবে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। মনে হল রেজা ভাইর হাক ডাকে , চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বললেন , দেখতো ধুয়া দেখা যাচ্ছে কি না। সঙ্গে সঙ্গে একজন পশ্চিম দিকে সরে এসে তাকালেন নীচে এবং জানালেন মেশিনঘরে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। অন্যের মনে তখন কি ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল তা অন্তর্যামী জানেন। তবে আমার মনে কেন জানি অপার্থিব একটা ভরসা এসে দানা বেধেছিল। মনে হচ্ছিল, নিশ্চয় বাঁচবো। ওরা আমাকে মারতে পারবে না। মুহূর্তে আমরা প্রস্তুত হয়ে নিলাম , স্থির করলাম , যেমন করে হোক প্রাণে বাচার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কি ভাবে? বার্তা বিভাগ আর হিসাব রক্ষা বিভাগের মাঝখানে একটা ছয় – সাত ফুট উচু পার্টিশান ওয়াল। স্থির হল পার্টিশান টা ডিঙ্গিয়ে হিসাব রক্ষা বিভাগে প্রবেশ করতে হবে। তারপর সেখানে লিফটের জন্য সংরক্ষিত গর্ত পথে নামতে হবে দেড় তলায় অবস্থিত জব সেকশনে। এবং জব সেকশন থেকে পেছন সিড়ি দিয়ে নেমে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে পাশের বাড়িতে। আমার জানি তখন কেমন মনে হল যে , স্যান্ডেল পায়ে এভাবে যাওয়া সম্ভব নয়। সঙ্গে সঙ্গে স্যান্ডেল গুলো বার্তা বিভাগে রেখে দিয়ে একে একে আমরা গেলাম হিসাব বিভাগে। আগুনের লেলিহান শিখার তাপ তখন আমাদের গায়ে লাগছে। কিন্তু সেদিকে আমাদের কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। হিসাব রক্ষা বিভাগে এসে আমি আর ইয়াহিয়া বখত লিফটের গর্ত দিয়ে লাফিয়ে পড়লাম নিচে। কিন্তু বিধি বাম। জব সেকশানের দরজা জানালা বন্ধ। প্রাণপণ শক্তিতে টানাটানি করেও যখন খোলা সম্ভব হল না আবার দেয়াল বেয়ে সেই গর্ত পথে উঠে এলাম হিসাব রক্ষা বিভাগে। আজ ভাবি কেমন করে এটা সম্ভব হয়েছে? এখন কি আমার দ্বারা সম্ভব! পেছনের দরজা দিয়ে পালাবার চেস্টা ব্যর্থ হবার পর আমাদের সামনে রইল দুইটি বিকল্প, এক আগুনে আত্মাহুতি দান এবং দুই , জীবন বাজি রেখে ভেতরের সিড়ি পথে পালানোর চেষ্টা। উকি মেরে দেখলাম , মেশিনগান হাতে দুটি মানুষ জন্তু সাক্ষাৎ যমদূতের মত ইত্তেফাকের সামনের দিকের ছোট্ট খোলা আঙ্গিনায় পায়চারী করছে। তবু কি আর করা যায়। হামাগুড়ি দিয়ে আমরা আটজন হিসাব রক্ষা বিভাগ থেকে আসলাম ঢাকা টাইমস এর অফিসে এবং তারপর সেখান থেকে হামাগুড়ি দিতে দিতে ভেতরের সিড়ি দিয়ে নামলাম নীচে।
সদ্য আমদানীকৃত ইত্তেফাকের মেশিনঘর থেকে আগুন তখন ছড়িয়ে পড়েছে অস্থায়ী ঘরগুলোর মেশিন ঘরে। তারই ভেতর দিয়ে প্রায় উন্মাদের মত আমরা ছুটে গেলাম দেওয়ালের দিকে। তারপর সে ছয়ফুট দেয়াল পলকে অতিক্রম করে প্রবেশ করলাম পাশের বাড়িতে। দেখলাম, প্রেসের কর্মী ভাইয়েরা আগেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। পাশের বাড়ির ছোট ছোট মেয়ে ছেলেগুলো তখন প্রানফাটা চিতকার করছে। গৃহকর্তা পশ্চিমের ঘরটার বাশের বেড়া খুলে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কারণ আগুন তখন ইত্তেফাক অফিসের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ঠিক মনে নেই কে একজন যেন বললেন, আপনারা এখান থেকে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ওদিকে চলে যান। বুঝলাম ইত্তেফাক কর্মী ও সাংবাদিক আমরা , তাই এত ভয় তারপর আবার শুরু হল দেয়াল টপকানোর পালা। একের পর এক দেয়াল টপকিয়ে আমরা চারজন এলাম পূর্বদিকে আর অবশিষ্ট চারজন অন্যদিকে। সিরাজ ভাই হাটুতে প্রচন্ড ব্যথা পেলেন. আমার ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল থেকে তখন অঝোর ধারায় রক্তপাত হচ্ছে। ইত্তেফাকের তদানীন্তন ড্রাইভার করিম আমাদের দেখতে পেয়ে তার সাথে আরও কিছুটা নিয়ে গেল। রেজা ভাই বললেন ব্রাক্ষ্মন চিরণের কাছে আমার ছোট ভাই বেনু থাকে। সেখানে যেতে পারলে রাত কাটানো যাবে। বলা বাহূল্য তখন ২৬ শে মার্চের সন্ধ্যা। সব পথ আমাদের জানা ছিল না, করিম এগিয়ে এল আমাদের সাহায্যার্থে। এ বাড়ী ও বাড়ী এ গলি ও গলির ভেতর দিয়ে আমরা এসে পৌছালাম গোপীবাগের পূর্বদিকস্থ রেল লাইনের ধারে। দূর থেকে তখন ভেসে আসছে মুহুর্মুহু মেশিনগানের গুলির আওয়াজ। রেল স্টেশনের নির্মানাধীন ওভার ব্রীজের উপর দন্ডায়মান জল্লাদ ইয়াহিয়ার মানুষ জন্তুর বাহীনির দুজন রোজ গার্ডেনের দিকে অবিরাম গুলি ছুড়ছে। ঝন ঝন করে উঠছে টিনের ঘড়গুলো।তারই ভেতর দিয়ে ময়লা ও বিস্টায় সংকীর্ণ রেলের লাইনের ঢালু দিয়ে রাতের আবছা আধারে হামাগুড়ি দিতে দিতে যেয়ে উঠলাম ব্রাক্ষ্মন চিরনের বেনু সাবের রাস্তায়। রাতে ঘুম হল না। এদিকে গুলীর আওয়াজ, মানুষের আর্ত চিতকারে অন্যদিকে বাসার চিন্তা।
২৭ তারিখে আটটায় ঢাকা বেতার থেকে ঘোষিত হল “সকাল সাতটা থেকে সান্ধ্য আইন তুলে নেয়া হয়েছে। ” আমরা বেরিয়ে এলাম। চলে গেলাম যে যার বাসার দিকে। সেদিনই সিরাজ ভাইর সাথে আবার দেখা করেছি। দেখতে এসেছি ইত্তেফাক – এর ধ্বংসস্তূপ আর বিধ্বস্ত নগরীর অবস্থা। পথে পথে লক্ষ্য করেছি – শত শত নিরীহ নিরপরাধ মানুষের মৃতদেহ। সিরাজ ভাইর বড় আশা ছিল তার নোট বইয়ে তুলে রাখা এসব ঘটনা তিনি একদিন না একদিন ব্যক্ত করবেন। কিন্তু কে জানত সে আশা তার পূর্ণ হবার নয়।“