সুত্র – বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, ২ মার্চ ১৯৭২।
স্বাধীনতার বেদীমূলে পিতা- পুত্র
|| আবুল কাসেম ||
পিতা তফিজউদ্দিনের বহু স্বপ্ন লুকায়িত ছিল তাঁর তৃতীয় পুত্র আয়নাল হককে কেন্দ্র করে। শৈশব থেকে মায়ের মায়া মমতা থেকে ছিল সে পুরোপুরি বঞ্চিত। তাই বাবাকে সেই স্নেহ পূরণের জন্য এই মাতৃহীন সন্তানের সব আবদারই নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। এমনি করে ক্রমশ কেটে যায় আয়নালের ছাত্র জীবন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করে।
পিতার ‘মা মরা’ ছেলের শেষ আবদারে তার বিয়ে হলো ফেব্রুয়ারিতে। পাবনা দখলের পর পাকসেনারা অগ্রসর হলো দাসুরিয়ার দিকে। সেটা কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী ও রাজশাহীর রাস্তায় সংযোগস্থল। কয়েকজন ছেলের সাথে আয়নালও অস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে ছিল দাসুরিয়াতে এক গোপন জায়গায় সেই সময়। ওদের মধ্যে একজন হানাদারদের হত্যা করার আক্রোশ সম্বরণ না করতে পেরে গুলি ছুড়লো ভুল করে। নিমিষেই বিরাট বহর দেখে তাঁরা ভীত সন্ত্রস্ত হলো। যেদিকে তাঁরা পা বাড়ায় সেদিকেই গুলি। সমস্ত দাসুরিয়া ঘিরে ফেললো সেনারা। বের করলো লুকায়িত মুক্তি সংগ্রামীদের।
৯ই এপ্রিলের ঘটনা। এ অমানুষিক অত্যাচারের ইতিহাস প্রকাশ করা যায় না। এসিড ঢেলে দিল তাদের চোখে মুখে তারপর বেয়োনেটের অত্যাচারে জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল তাদের। দস্যুদের কার্যকলাপ দেখলেন অদূরে দাঁড়িয়ে এক বুড়ি- যার থাকবার শেষ সম্বল কুঁড়ে ঘরখানা জ্বালিয়েছে, কিন্তু তাকে হয়তো মারেনি খুবই বৃদ্ধ বলে।
পিতা পরের দিন দেখতে পেলেন তাঁর আশা- আকাঙ্ক্ষার মানিক আয়নালের দেহ যা কোন রকমে পরের ভোররাতে চুরি করে সরিয়ে আনা হয়েছিল। এত বড় আঘাত পিতা সইবেন কেমন করে। তিনি হতবাক হয়ে পড়লেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন “তুমি এর বিচার করো”। খোদাপাক বোধহয় নিজ কানে শুনেছিলেন তাঁর এই আকুল আর্তনাদ। তাঁদের আশা পূর্ণ হয়েছে। এরূপ লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ আজ স্বাধীন, কিন্তু দুঃখ হয় এই বুড়ো বাবাও দেখে যেতে পারেননি তাঁর সাধের স্বপ্ন।
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ইতিমধ্যেই পিতা তফিজউদ্দিন আহমদের ছোট ভাই মহিউদ্দিন, ঈশ্বরদী আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ও তাঁর ছেলে পরিবার পরিজন ছেড়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। সেখানে গিয়ে প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষন নিয়ে আবার শত্রু উৎখাতের সংগ্রাম শুরু করার জন্য।
প্রায় সাড়ে চারমাস এখানে-ওখানে লুকিয়ে থাকার পর তাঁর পক্ষে আর আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ভাইদের পরিবার পরিজন নিজের ছেলে মেয়ে, জামাই ইত্যাদি নিয়ে প্রায় ৪০ জোনের খোরাকের চিন্তায় তিনি শহরের দিকে ছুটলেন। ইতিমধ্যে কুচক্রী ইয়াহিয়া জোর গলায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে জেনে শহীদ আয়নালের বাবা মনের মধ্যে কিছুটা আশার সঞ্চারও পেয়েছেন। শহরেও দু’এক বার গেলেন। ঈশ্বরদীর অবাঙ্গালী ও দালালরা দেখে ফেলল তাকে। এই সময় রাত কাটাতেন তিনি তার দাসুরিয়াতে অবস্থিত ফার্মের মধ্যকার চাকরের একটি কুটিরে। এটাকেই তিনি সব থেকে নিরাপদ স্থান ভেবেছিলেন। কিন্তু তাবেদার ও অবাঙ্গালীরা মিলে ঘিরে ফেললো তাঁর এই আশ্রয় তাঁদের আশা- আকাঙ্ক্ষার বড় শিকার দাসুরিয়া আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও কর্মী শেষ করতে।
১৪ই জুনের মাঝরাতে তাঁদের আজস্র গুলির আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। বিলীন হয়ে গেল একটি সুখী বাঙ্গালী পরিবার।