(১) সশস্ত্র প্রতিরোধে কুমিল্লা: সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া

<৯, ৩.৭, ১৪৮-১৪৯>

সশস্ত্র প্রতিরোধে কুমিল্লা

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া

(বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

২০-০৭-১৯৭৬

২৬শে মার্চ সকাল বেলা আখাউড়া কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে একজন নায়েক অপারেটর সিঙ্গারবিলে আসে এবং বলে যে, ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। কুমিল্লাতেও লোকজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ খবর পাবার পর আমি আমার লোকজনকে গোপনে ডাকি। কমাণ্ড আমি আমার হাতে নেই, আর কেউ সিনিয়র না থাকাতে। সিদ্ধান্ত হলো ৬টা বিওপিতে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআর’কে আজ রাতের মধ্যে শেষ করতে হবে। পরদিন সকালে খবর পাঠানো হলো, সকল বিওপি ছেড়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আখাউড়া সিনেমা হলের সামনে সমবেত হওয়ার জন্য। ২৮শে মার্চ সবাই আখাউড়াতে গিয়ে একত্রিত হয়।

২৯শে মার্চ সমস্ত বাঙালি ইপিআর আখাউড়ার জনসাধারণের সাহায্য ও সমর্থনপুষ্ট হয়ে আখাউড়া কোম্পানী হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর ডব্লিউপিআর’রা রাতের অন্ধকারে দুটি লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। আখাউড়া থেকে চার মাইল দক্ষিণে জনসাধারণ তাদেরকে ঘিরে ফেলে। দুইজন লোককে পশ্চিম পাকিস্তানীরা রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিলো। তারপর আমার এক প্লাটুন ইপিআর সেখানে যাওয়াতে তারা স্থানীয় মসজিদে ঢুকে পড়ে। শত্রুর এক সুবেদার ও এক নায়েক সুবেদার সহ ১৪ জনকে সেখানে হত্যা করা হয়।

কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, অয়ারলেস সেট ও রেশন সরিয়ে আমরা সিনেমা হলের সামনের স্কুলে নিয়ে আসি। দুইজন হাবিলদারকে নায়েক সুবেদার দিয়ে ৩টা প্লাটুন খাড়া করি এবং আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনসহ ঐ এলাকায় ডিফেন্স তৈরি করি।

২রা এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে টেলিফোনে আমার সাথে কথা বলেন। তিনি আমাকে একটা প্লাটুন দিয়ে উজানিসার ও আরেকটা প্লাটুন দিয়ে গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশনে ডিফেন্স করার নির্দেশ দেন। ৪ঠা এপ্রিল দুটি প্লাটুন উল্লেখিত জায়গায় মোতায়েন করা হয়। ৫ই এপ্রিল আমি নিজেও উজানিসার চলে যাই।

১২ই এপ্রিল উজানিসার ও গঙ্গাসাগর ব্রীজ আংশিক নষ্ট করে দেয়া হয়-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য যাতে তাঁরা কুমিল্লা থেকে সরাসরি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় আসতে না পারে।

১৪ই এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা ব্রিগেড কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। উজানিসার ব্রীজের হাজার গজ দূর থেকে একটা কোম্পানী থেকে নেমে রাস্তার দু’পাশে নালা দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ব্রীজের নিচে আমাদের বাংকার ছিল। শত্রুরা কাছাকাছি আসার পর তাদের উপর ফায়ার ওপেন করা হয়। আমাদের এই আচমকা আক্রমণে তাদের অনেকেই হতাহত হয়। নৌকাতে তারা সমস্ত লাশ বোঝাই করে নিয়ে গিয়েছিলো। ঐ নৌকার মাঝি পরে আমাদেরকে বলেছিলো যে, একজন অফিসারসহ ১৭৩ জন সৈন্য ওদের নিহত হয়েছিলো।

তারপর পাকিস্তানী সৈন্যরা পিছনে গিয়ে আর্টিলারী ও মর্টারের সাহায্যে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের কাছে কোনো আর্টিলারী বা মর্টার ছিলো না। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের কাছে খবর পাঠানো হয়েছিলো আমাদের সাহায্য করার জন্য। আমাদের লোক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে ৪র্থ বেঙ্গলের কাউকে পায়নি। জনসাধারণ বলেছে তারা নাকি আখাউড়ার দিকে চলে গেছে। পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আমরা (আমাদের দুই প্লাটুন সৈন্য) উইথড্র করে আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে চলে আসি। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও আমাদের কোনো ডিফেন্স নাই। তাই বাধ্য হয়ে আমরা উইথড্র করি।

উজানিসারে প্রচণ্ড মার খেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য গঙ্গাসাগর হয়ে আখাউড়া আসার চেষ্টা করে। আমাদের এক প্লাটুন ইপিআর হাবিলদার আসদ্দর আলীর নেতৃত্বে গঙ্গাসাগর ব্রীজে ডিফেন্স বানিয়েছিলো। পাকিস্তানী সৈন্যরা সেখানে পৌঁছুলে এক প্লাটুন ইপিআর তাদের উপর ফায়ার ওপেন করে। এই অতর্কিত আক্রমণে (১৫ই:এপ্রিল) পাকিস্তানীদের তিনজন অফিসার সহ আনুমানিক ৭০/৭৫ জন সৈন্য নিহত হয়েছিলো। তিনজন অফিসার ও সৈন্যদের কবর সেখানে পাওয়া গিয়েছিলো। প্লাটুন’টির ডিফেন্স দুদিন থাকে সেখানে। পাকিস্তানী সৈন্যরাও তাদের ডিফেন্স মজবুত করে। পাকিস্তানী ব্রিগেড কমান্ডার ঐ ব্যাটালিয়নকে উইথড্র করে নতুন আরেকটা ব্যাটালিয়নকে গঙ্গাসাগর পাঠায় এবং দুই দিনের মধ্যে গঙ্গাসাগরে মুক্তিফৌজের ডিফেন্স ধ্বংস করে আখাউড়া পৌঁছার নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমাদের ডিফেন্সে চলে আসে। আর্টিলারী ও ৩” মর্টার দিয়ে তারা ওভারহেড ফায়ার অব্যাহত রেখেছিলো। ইপিআর সূফি মিয়া তখনো গুলি ছুঁড়ে চলছিলো। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংকারে ঢুকে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। ল্যান্স নায়েক মোবাশ্বের আলীকেও বাংকারে ঢুকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়। সাত জনকে গুরুতররূপে আহত অবস্থায় আগরতলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৮ই প্লাটুনের অন্যান্য সৈন্য উইথড্র করে আখাউড়া চলে আসে।

১৯শে এপ্রিল পুরো ইপিআর কোম্পানীকে ক্লোজ করে আখাউড়ায় একত্রিত করা হয়। এখানে ৪র্থ বেঙ্গলের ১টা কোম্পানীও এসেছিলো ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে।

২১শে এপ্রিল ঘয়েরকোট ও ইটনা গ্রামে আমরা মিলিতভাবে ডিফেন্স করি।

২২শে এপ্রিল গঙ্গাসাগরে এক এ্যামবুশে আমরা ৬ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করি ও বাইশ হাজার চায়না এ্যামুনিশন উদ্ধার করি ৫টা রাইফেল ও একটা স্টেনগানসহ।

২৮শে এপ্রিল আমাদের দুটি প্লাটুনকে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দীন আজমপুরে আসার নির্দেশ দেন।

১১ই মে আজমপুরে আমরা এক এ্যামবুশ তৈরি করি। পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি কোম্পানী সিলেটের মুকুন্দপুর থেকে আজমপুরের দিকে আসছিলো। আমাদের দুটি প্লাটুন নরসিঙ্গর নামক জায়গায় ওদেরকে এ্যামবুশ করি। এই এ্যামবুশে ওদের ৬৩ জন নিহত হয়।

১৩ই মে সিঙ্গারবিল এলাকায় এক এ্যামবুশে ৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।

১৮ই মে এই এলাকায় এক রেইডে ৬ জন পাকিস্তানী নিহত হয়। একজন আহত সৈন্যকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিলো।

২৭শে মে রাজাপুর এলাকায় এই রেইডে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।

২৯শে মে সিঙ্গারবিল এলাকায় এক এ্যামবুশে ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৩১শে মে সিঙ্গারবিলে আরেক এ্যামবুশে ১৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৪ঠা জুন দুটি এ্যামবুশে ৯ জন পাকসেনা নিহত হয় সিঙ্গারবিল এলাকায়।

Scroll to Top