কে আমাদের রুখবে?

কে আমাদের রুখবে ?

৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

(মুক্তিবাহিনীর শিবির। গেরিলাদল হানাদারদের আক্রমণ করার পূর্বমুহুর্তে প্রস্তুত। গেরিলা অধিনায়ক নিয়াজ তাঁর বক্তব্য পেশ করছেন)।

নিয়াজ ঃ     তবু বন্ধুগণ লড়াই আমাদের করতেই হবে। সমস্ত প্রতিকূলতা এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করে এগিয়ে যেতে হবে। আজ আমাদের

সমস্ত দুঃখ-কষ্ট বিপদ-আপদকে বরণ করে নিয়ে শত্রুধ্বংসের জন্য নিজেকের নিয়োজিত করতে হবে। আমাদের এক

উদ্দেশ্য, এক লক্ষ্য-বাংলার মাটিতে যারা রক্ত ঝরিয়েছে, বাংলার বুকে যারা আগুন জ্বালিয়েছে, বাংলাকে যারা শ্মশান

করেছে, তাদের ক্ষমা নেই। তাদের আমরা সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করব, বাংলার মাটি মুক্ত করব শয়তানদের কবল থেকে।

আর এমনই শিক্ষা আমরা দেবো যেন ভবিষ্যতে কেউ আবার বাংলার মাটিতে পা রাখতে জায়গা না পায়। বন্ধুগণ প্রস্তুত !

সমস্বরে        ঃ     প্রস্তুত কমরেড।

নিয়াজ ঃ     তবে এগিয়ে যাও-নির্ভয়, নির্ভীক। ভয়ংকর ঈগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে কাপুরুষ হানাদারদের উপর। ওদের নিঃশেষ করে

দেবে। প্রভাত আলোর মতো তোমাদের গতি হবে সম্মুখে। এগিয়ে যাও।…মানিক, তুমি স্বপনাকে ডেকে নিয়ে এসো।

মানিক         ঃ     নিয়াজ ভাই আসতে পারি?

নিয়াজ ঃ     এসো মানিক, স্বপন কোথায়? ও এসেছ, শোন তোমাদের উপর একটা কাজের ভার দেবো, এর সফলতার ওপর নির্ভর

করছে আমাদের পরবর্তী আক্রমণ। যেমনই করেই হোক এ কাজ তোমাদের করতেই হবে।

স্বপন   ঃ     প্রাণ থাকতে পিছিয়ে আসবো না নিয়াজ ভাই। হয় সাফল্য, না হয় মৃত্যু।

নিয়াজ ঃ     সাবাস। এই হচ্ছে বাংলার সন্তানের, বাংলার মুক্তিযোদ্ধার কথা। এই তো চাই।

মানিক         ঃ     আমরা নিয়েছি এগিয়ে চলার শপথ-চলাই আমাদের গতি, চলাই আমাদের জীবন।

নিয়াজ ঃ     হ্যাঁ, চলাই আমাদের জীবন।

(জনান্তিকেঃ হল্ট, হু কামস দেয়ার) (মহিলা কণ্ঠঃ ফ্রেণ্ড)

রেখা এসে গেছে ও তোমাদের সংগে যাবে। দিনের বেলায় যেতে হবে। বিপদসংকুল যদিও, তোমাদের উপর আমার বিশ্বাস

আছে।

রেখা   ঃ     জীবনমৃত্যু পায়ের ভূত্য চিত্ত ভাবনাহীন। বিপদের কথা শুনলে মন আমার আনন্দে নেচে ওঠে। বিপদহীন, শংকাহীন জীবন

বড্ড সুনকো লাগে কমরেড। আমি চাই মৃত্যুর মাঝে জীবনের গান গাইতে।

স্বপন   ঃ     আর সে গান রক্তরাঙ্গা নির্ভীক জীবনের গান।

মানিক         ঃ     রোদ্রোজ্জ্বল সংগ্রামী জীবনের গান।

নিয়াজ ঃ     নির্ভয় নিঃশঙ্ক চলার শপথ যে নিয়েছে তার কাছে কোন বাধাই বাধা নয়। দুস্তর সমুদ্র বা দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় কিছুই তার পথ রোধ

করতে পারে না।

(বিস্ফোরণের শব্দ দূর থেকে)

শুনলেন তো, ফরহাদপুরের ব্রিজ উড়ে গেলো। হানাদারদের পথ আজ থেকে রুদ্ধ হয়ে গেল।

রেখা   ঃ     এবার আমরা বাকী পথটুকুও বন্ধ করে দেবো। আজ ওরা গ্রামে-গ্রামে দলবদ্ধ পাগলা জানোয়ারের মতো হামলা চালাচ্ছে।

ঘর-বাড়ি আগুন লাগিয়ে পোড়াচ্ছে। মানুষকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে হত্যা করছে।

নিয়াজ ঃ     আর মা-বোনদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র বাংলাদেশে শয়তানরা ১০০টা বন্দীশিবির করেছে। আর সেখানে হাজার হাজার

মানুষকে বন্দী করে অকথ্য নির্যাতন করছে। মা-বোনদের ইজ্জত নিয়ে ছেলেখেলা করছে। এ নির্যাতন বন্ধ করব,

নির্যাতনকারীর মৃতদেহের স্তুপে লেখা হবে হানাদারের গ্লানিকর পরাজয়।

মানিক         ঃ     নিয়াজ ভাই, আমাদের কি কাজের ভার দেবেন বলেছিলেন না?

নিয়াজ ঃ     ও হ্যাঁ, শোন, নগরপুরে দুশমনদের একটা শক্ত ঘাঁটি আছে। এ ঘাঁটিটা আমাদের নষ্ট করতে হবে। এ ঘাঁটিটা নষ্ট হলে আমরা

নদীপথ এবং সড়ক উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। শহরে আঘাত হানার পক্ষেও সুবিধা হবে।

স্বপন   ঃ     এ আক্রমণে আমি নেতৃত্ব দেবো নিয়াজ ভাই, আমাকে শুধু পাঁচটা ছেলে দেন। আমি শয়তানদের ঘাঁটি উড়িয়ে দিয়ে আসবো

রেখা   ঃ     নেতৃত্ব তুমি দাও ক্ষতি নেই, কিন্তু এভাবে এতো অল্প ছেলে নিয়ে গেলে কতখানি সফল হবে ভেবে দেখেছ?

স্বপন   ঃ     এখন এতো ভেবে দেখার সময় নেই। এখন জানি শুধু শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ো ।

নিয়াজ ঃ     না, স্বপন বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েই তোমরা এগিয়ে যাবে। আমরা ত্রিমুখী আক্রমণ চালাবো। তিনটে দল থাকবে, তার একটার

নেতৃত্ব নেবে তুমি।

মানিক         ঃ     আমার কাজ কি নিয়াজ ভাই?

 নিয়াজ        ঃ     তোমারও কাজ আছে। তুমি থাকবে রক্ষণভাগে। আক্রমণ শুরু হলে, শহর থেকে শয়তানদের সাহায্য আসতে পারে। তুমি

এই সাহায্য আসার পথে বাধা সৃষ্টি করবে। কোনভাবেই যেন তারা সাহায্য নিয়ে আসতে না পারে।

রেখা   ঃ     আর আমি? আমি কি করব?

নিয়াজ ঃ     তুমি আমার সংগে ওষুধের ব্যাণ্ডেজ সব নিয়ে থাকবে। প্রয়োজন হতে পারে। একটা ষ্ট্রেচার নিয়ে নিয়ো। মানিক নায়েক

কাসেম, বাবলা, রশিদ, কালু, স্বপন তোমার সংগে থাকবে। নায়েক মোহর আলী রফিক, বিজন, মনি এবং আমি নায়ক

নিযামুদ্দিনকে নিয়ে নেবো। নাও প্রস্তুত হয়ে নাও, অস্ত্রশস্ত্র সব নিয়ে নাও। শয়তানদের গুলির জবাব দিবে-বেশী গুলি অহেতুক

খরচ করো না।

(ক্ষণ বিরতি)

প্রস্তুত, এগিয়ে যাও, কিন্তু সাবধান কেউ অহেতুক উত্তেজিত হয়ে উঠবে না। বিপদের মুখে যে ধীরমস্তিষ্কে, শান্ত মাথায়

কাজ করতে পারে সে-ই কামিয়াব হয়। যাও, এগিয়ে যাও।

(মেশিনগান ও রাইফেলের গুলি)

মানিক         ঃ     কাসেম ভাই, ডাইনে চেপে যান, বাঁদিকের মেশিনগানটা বন্ধ করতে হবে। (গুলি চলতেই থাকবে)

স্বপন   ঃ     রফিক-বিজন বায়ের খাঁড়ি দিয়ে উঠে যাও, পাশের বাংকারের মেশিনগানটা স্তব্ধ করে দাও।

মানিক         ঃ     বাবলা, কাসেম ভাই কোথায়?

(মটারের শব্দ ও মেশিনগানের গুলি)

নিয়াজ ঃ     মিনিটে ৫টা করে সেল করো, ডাইনে, আর একটু ডাইনে। ঠিক হয়েছে, বাছাধনদের ট্রাকটা একেবারে গেছে। মর্টার থামাও।

স্বপন   ঃ     রফিক চার্জ।

(গ্রেনেডের বিস্ফোরণ)

মানিক         ঃ     বাবলা চার্জ (গ্রেনেডের বিস্ফোরণ) এবার জয় বাংলা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ো।

(সমস্বরে-জয় বাংলা)

হ্যাণ্ডস আপ ঐ দেখ একটা শয়তান পালাচ্ছে, (গুলির শব্দ) যাক মরেছে। স্বপন ভালই হয়েছে, নাও ভাই অস্ত্রশস্ত্র

গোলাবারুদগুলো নিয়ে নাও।

(কাতরানোর শব্দ)

স্বপন   ঃ     কে কাতরাচ্ছে!…বিজন দেখ তো ভাই। …আরে এ কি কাসেম ভাই…কাসেম ভাই (আর্তনাদ করে ওঠে)

কাশেম         ঃ     আমাকে নিয়াজ ভাইয়ের কাছে নিয়ে চলো।

মানিক         ঃ     নে, ধরাধরি করে ওঠা। চল চল।

স্বপন   ঃ     তার আগে ক্ষতস্থানটা বেঁধে নে।

নিয়াজ ঃ     কি, কি হয়েছে স্বপন?

স্বপন   ঃ     কাসেম ভাইয়ের গুলি লেগেছে।

নিয়াজ ঃ     কাসেম।

মানিক         ঃ     কাসেম ভাই!

কাসেম         ঃ     কেদো না ভাই। কেউই বেঁচে থাকার জন্য আসে না। একদিন তাকে যেতেই হয়। আমার দুঃখ নেই, আমি আমার

জন্মভূমির জন্য প্রাণ দিয়েছি। এ মৃত্যু আমার অনেক গৌরবের। দুঃখ করো না।

(মুস্তাফিজুর রহমান রচিত)

Scroll to Top