১৪ অক্টোবর, ১৯৭১
ইয়াহিয়া এবং তার উপনির্বাচন
.
গজদন্তের তৈরি দুর্গে বসবাস করার সুবিধা হল তার অধিবাসীরা অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে থাকে- লজ্জা কিংবা বিবেক অথবা ন্যায়ের কোন ভূমিকাই তাদের কর্মকান্ডে থাকে না। বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলে ইয়াহিয়ার তথাকথিত পুনঃনির্বাচনের ঘোষণা এটাই নিশ্চিত করে, যেখানে সে মাত্র দশ মাস আগেই সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছিল। সবসময় জনগণ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে এবং সর্বশেষ সাড়ে ছয় মাস শুধুমাত্র তার অপরাধসমূহের নিকটতম সহযোগীদের মাঝে থেকে অন্যান্য মানুষ বা অন্যান্য দেশসমূহ তার ক্রমান্বয়ে সংঘটিত অপকর্ম এবং অপরাধের ব্যাপারে কি বলবে এসকল বিষয়ে সম্ভবত সে তার হুঁশজ্ঞানের পাতলা আবরণটিও হারিয়ে ফেলেছিল।
অন্যথায় কিভাবে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কথা বলতে পারে যখন সে তার কলমের এক খোঁচাতেই (অবশ্যই মানুষের গণহত্যার অনুষঙ্গী) নির্বাচনে জেতা দলকে অবৈধ ঘোষণা করে, ৭৯জন বৈধভাবে নির্বাচিত সদস্যকে বাতিল বলে মনে করে এবং এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যাতে বাকি ৮৮ জন আওয়ামীলিগের সদস্যদের মধ্যে মাত্র ১৫-১৬ জন বিশ্বাসঘাতক সদস্য আসন্ন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রহসনের জাতীয় মহাপরিষদের সভায় অংশগ্রহণ করে, যেখানে একটি নতুন সংবিধানের রূপরেখা তৈরি করা হবে-যেটি হবে তার সংবিধান। একজন মানুষ যে কিনা বাকি দুনিয়াকে যথেষ্ট বোকা বলে মনে করে, সে নিজের এ সমস্ত শিশুসুলভ তামাশা নিজের চোখে দেখতে পায় না যা কিনা “দেশের সেরা গাধা” খেতাব পাওয়ার জন্য সুনিশ্চিত যোগ্যতা। এটা বুঝতে কোন রাজনৈতিক বোদ্ধা হতে হয়না যে সে আসলে আগে থেকেই কি চায়- জনপ্রতিনিধি নয় বরং একদল খুনি যারা তাদের প্রভুকে সন্তুষ্ট করতে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে এবং তাদের রক্ত ঝরাতে কোনরূপ দ্বিধাবোধ করবে না।
কিন্তু বাস্তবে এই তথাকথিত উপনির্বাচনে তার মনোনীত সন্ত্রাসীদের নির্বাচিত করার জন্য ইয়াহিয়ার কাছে শুধু তার রাজাকারেরাই ছিল, যেটা ছিল একটা আন্তর্জাতিক ঐক্য সৃষ্টি করার জন্য তার সর্বশেষ আপ্রাণ চেষ্টা। বেচারা! সার্বক্ষণিক তার পেশাদার মিথ্যাবাদীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে, যারা তার উর্দিপরা খুনীদের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে ক্রমাগত নানাবিধ রুপকথা এবং বিশ্বের সরকারসমূহের গোপন সহানুভূতির কথা শোনাত, সে আসল দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা অনুধাবন করতে পারেনি। বাংলাদেশে যুদ্ধটি পরাজয়েরই ছিল। ভারতের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের তর্জন-গর্জন কেউই শুনছিল না। এমনকি তার সাম্রাজ্যবাদী বন্ধুরাও এটা অনুধাবন করছিল যে দিন দিনই এই লোক একটু একটু করে নুয়ে পড়ছে।
কিন্তু সর্বশেষ মুহূর্ত না আসা পর্যন্ত সে ভাঙবে না। তার সামগ্রিক খারাপ জন্মবৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে এটিই ছিল একমাত্র ইতিবাচক দিক। এমনকি ছয় মাস ধরে ক্রমাগত মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেয়ে এবং তার সেরা সৈন্য এবং অফিসারদের প্রায় ৪০,০০০ জন হারিয়েও সে অবিচলিত থাকার অভিনয় করতে চাইত। সামনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এক অবিস্মরণীয় আঘাত পেতে যাচ্ছে। কিন্তু সে যদি তখনো সেখানে থেকে থাকে, তার এই অসুস্থ দাম্ভিকতা প্রত্যাশিতই থাকবে।
বাংলাদেশের এই আত্মঘাতী যুদ্ধ পাকিস্তানের গত চব্বিশ বছরের অন্যায়লব্ধ অর্থনীতিকে ধবংস করে ফেলেছে। কিন্তু এই টিনের সেপাই নড়বে না। সে এখনো তার চুপসে যাওয়া অস্তিত্বহীন প্রতিপত্তির বেলুনে ফুঁ দিয়েই যাচ্ছে। সে দেখাতে চায় যে বিশ্ব তার আস্পর্ধাকে যে নজরেই দেখুক না কেন, সে তাতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না। শেখ মুজিবুর রহমানের অবৈধ ও বিবেকবর্জিত বিচারের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বয়ে গেলেও নির্লজ্জের মত গণমানুষের নেতাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার ধৃষ্টতা তার ছিল। শেখের চরম সাহসের বিপরীতে কী কাপুরুষের মত প্রতিক্রিয়া! শেখ যদি চাইতেন, নিরাপদে ই তিনি পালাতে পারতেন। কিন্তু মনেপ্রাণে একজন গণতন্ত্রবাদী হয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হন। এখন এই অপরাধী তার স্পর্ধায় মনের কথা জানান দেয় যে, সে মুজিবকে মৃত্যুদন্ড না-ও দিতে পারে বরং তাঁকে সারাজীবনের জন্য পাকিস্তানের জেলে পচানোর জন্য রেখে দিতে পারে। সে ভেবেছে, এটা করার মাধ্যমে সে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে পারবে। কিন্তু তার অন্যান্য চিন্তার মত সে এখানেও অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলে। শেখ এক ঝুড়িতে সবগুলো ডিম রেখে যাননি। তিনি বাইরে ছিলেন কিন্তু তার সকল সেনানায়কদের বিজয় লাভ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ করতে তিনি নির্দেশ দিয়ে যান। তার জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল মুক্ত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করা। এবং সেটা অর্জিত হয়েছে। এখন যেটা বাকি সেটা হল একটা দেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ঝাড়া অপারেশনের, সেটিও ক্রমবর্ধমান গতি এবং দক্ষতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে প্রতিটি অস্ত্রধারী কিংবা অস্ত্রবিহীন মুক্তিযোদ্ধা তার আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত, সেখানে আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহহমানের শারীরিক উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লক্ষ মুজিবকে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন। এমন নেতৃত্বের স্বাদ আস্বাদনের জন্য ইয়াহিয়াকে সবসময় স্বাগতম।