২৮ নভেম্বর, ১৯৭১
লন্ডনের দা ডেইলি এক্সপ্রেস ইয়াহিয়াকে অবিহিত করেছে একজন ধর্ষকামী জেনারেল হিসেবে, যার বুদ্ধিমত্তা সার্জেন্ট-মেজরের পর্যায়ের। এটাই যদি তার বসের ‘আই কিউ’ হয়, তাহলে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় ইয়াহিয়ার খুনি-সহযোগী লে. জে. নিয়াজির বুদ্ধিমত্তা কোন পর্যায়ের হতে পারে? এটির একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় দখলকৃত এলাকায় নিউজউইকের সিনিয়র সম্পাদক আর্নড বোর্চগ্রেভের ঘটনাস্থল থেকে করা প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, এই নির্বোধ জেনারেলের বুদ্ধিমত্তা একটি অতিভোজী মহিষের পর্যায়ের। কাজেই মানুষের বেশির ভাগ সংবেদনশীলতা ও বাস্তবতা নিয়ে সে পুরোপুরিই নি:সাড়। গেরিলাদের সে যেভাবে হত্যা করছে, সেটা নিয়ে ফালতু দম্ভের একমাত্র ব্যখ্যা সম্ভবত এটিই। শোনা যাচ্ছে সে নাকি গর্জন করেছে, “ওহ..গেরিলাদের নিয়ে আমার ভয় নেই। ওদের তো আমি মাছির মত মারছি!” তার আত্মতৃষ্টির মজার দিক হলো, মাছি মারা যে আসলে কতটা কঠিন, সেটা বোঝার মত অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধিমত্তা, কোনোটাই তার নেই। তাছাড়াও যারা বুঝবে, তাদের কাছে তুলনাটা একদমই মিলিয়ে যাবে। কারণ মুক্তি বাহিনী যেভাবে বিষাক্ত মাকড়ষার মতো হানাদার বাহিনীর জীবনী রক্ত শুষে নিচ্ছে, মাছি সেভাবে কখনোই কামড়ায় না। আরও ব্যাপার হলো, নিয়াজির ভান্ডারে যত ধরণের কীট আছে, তাদের কেউই এই বিষাক্ত মাকড়শার হাত থেকে নিরাপদ নয়। নির্বোদেল মত আত্মতৃপ্ত বলেই এমনকি লড়াইয়ের এই পর্যায়েও সে সশব্দে ঘেউ ঘেউ করছে। শিগগিরই এই হাসি রূপ নেবে শোকে। নিয়াজি-তোমার কাছে এটা আমাদের পরম প্রতিজ্ঞা। চেষ্টা করো শেষ বাজনা শোনার জন্য-আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, লজ্জাজনক পতন দেখার জন্য বেঁচে থাকতে!
ইয়াহিয়া ও তার নির্বোধ জেনারেলরা হয়ত বুঝতে পারছে না কি হয়ে যাচ্ছে-তবে বুড়োটা (the good old lago, ল্যাগো বলে কোনো শব্দ বা কাছাকাছি কিছু পেলাম না) মনে হয় মৃত্যুর গন্ধ ইতিমধ্যেই পেয়েছে। লারকানার স্বঘোষিত শাসক জুলফি ভুট্টো নাকি করাচিতে বলেছে যে ‘আগের পাকিস্তান এখন মৃত এবং বিপর্যয় এড়াতে নতুন পাকিস্তান গঠন করা জরুরী।” অন্যদিকে, এই ধূর্ত প্রতারক ও চূড়ান্ত মিথ্যাবাদি লোকটি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছে এবং পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের কৃত্রিম জোটের বিভাজন রক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই অনুনয় শুরু করেছে। যদিও, সাত মাস আগে, সুনির্দিষ্ট করে বললে গত ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের মানুষকে গণহত্যার পর ইয়াহিয়ার প্রচারণাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে এই লোকটিই বড়াই করে বলেছিল, “আমি পাকিস্তানকে রক্ষা করেছি।” সত্যিকার অর্থে একজন বেহায়াই কেবল এভাবে ডিগবাজি খেতে পারে, সেটাও আবার প্রকাশ্যে। অবশ্য এটা করে সে অন্তত বোঝাতে পেরেছে যে, জেনারেলের উর্দি পড়া ওই পশুগুলোর চেয়ে তার রাজনৈতিক বোধ খানিকটা উচ্চস্তরের। সে জানে পরিসিাথতি এখন কতটা খারাপ এবং কত দ্রুত পাকিস্তান ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান যে শেষ, সেটা সে জানে। মুখ রক্ষার জন্য এখন সে চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছে। এখন আর সে ক্ষমতার পরিবর্তন দাবী করছে না। কৃত্রিম ভাবে সে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাঙ্ক সৃষ্টি করেছে যা তাকে অনেক সহায়তা করেছে। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করায় ধীরে ধীরে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। তারপরও ধূর্ত ভুট্টো চুপচাপ। পাকিস্তানকে যখন সঙ্কট ঘিরে ধরছে, সে সন্দেহজনক ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে ইয়াহিয়া একই ছড়ি ঘোড়াচ্ছে সিন্ধি, বেলচিজ ও পাঠানদের ওপর। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অজুহাত দেখানো হয়েছে, সেই একই অজুহাতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ওয়াল খান ও মৌলানা ভাসানির ন্যাশলনাল আওয়ামী পার্টি উভয়কেই। এবং অনুমিতভাবে, প্রতিক্রিয়াও একই।
পৃথিবী থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙ্গন ছিলো অবশ্যম্ভাবী। ভুট্টো ধূর্ততার সাথে দৃশ্যপট থেকে সরে যাচ্ছেন যেনো তার উপর দোষারোপ করা না হয়। যদিও বাস্তবতা হলো এই জঘন্য ঘটনায় ইয়াহিয়া এবং তার সহযোগীদের তুলনায় ভুট্টো অনেক সক্রিয় ছিলেন। যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছিলো। হয়তো আর কয়েক সপ্তাহ বাকি রয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধের শেষ দৃশ্য মাঝপথের ও বেশি অতিক্রম করেছে যেখানে পর্দা নামানো হচ্ছে স্থিরতা এবং দ্রুততার সাথে। এরমধ্যেই পরবর্তী দৃশ্য শুরু হয়ে গিয়েছে- শুধুমাত্র ভারত-পাকিস্তান বর্ডারে নয়, স্বয়ং পাকিস্তানেও। সর্বশক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া ভারতের সাথে যুদ্ধ চালাতে পারেন না। যার অর্থ হবে তিনি তার দেশবাসীর মধ্যে উগ্র দেশপ্রেম জাগাতে সফল হবেন না । তিনি অবশ্যই ব্যর্থ হবেন অভ্যন্তরীণ সমস্যা হতে অন্য দিকে দৃষ্টি সরাতে যা কিনা টাইম বম্বের মতো অপেক্ষা করছে তার জন্য। এটি অবশ্যই বিস্ফোরিত হবে, এবং ফ্যাসিস্ট জেনারেল, রাজনীতিবিদগণ এবং কূটনীতিকগণ- যারা দায়ী ছিলেন তাদের মাঝেই বিস্ফোরিত হবে।