শিরোনম | সূত্র | তারিখ |
২২। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী প্রতিবেদনমালা | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র | জুন-নভেম্বর ১৯৭১ |
১৫ জুন, ১৯৭১
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী প্রতিবেদনমালা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র, জুন-নভেম্বর’ ১৯৭১
(প্রতিবেদনগুলী আলমগীর কবির রচিত)
পশ্চিমাদের উদাসীনতা দুঃখজনকঃ বাংলাদেশ বায়াফ্রা বা ইন্দোনেশিয়া না।
বাংলাদেশ বিয়োগাত্মক ঘটনার ব্যাপারে পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে খুবই মন্থর গতিতে। এই বিষয়টা লন্ডন, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ভিত্তিক পত্রিকাগুলোর বরাতে তথ্য উপাত্তসহ একাধিকবার গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। তবে শীতল অভ্যর্থনার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের প্রতিক্রিয়া খুবই প্রবল। কারণ আমরা জানি হাজার হাজার নিরপরাধ জীবন রক্ষা করা যেতো যদি পশ্চিমা জনগণ ও সরকার বাংলাদেশের জনগণের উপর অযৌক্তিক গণহত্যা বন্ধ করতে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ইয়াহিয়া শাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করতো। এটাই হতো বাস্তবতা। আমরা বিশ্বাস করতে পারি না বিংশ শতাব্দির সভ্যতা একটি নারকীয় তান্ডবলীলার নীরব দর্শক হতে পারে যা অকার্যকর ও চূর্ণ করেছে সকল লালিত আদর্শকে। তারা আশায় এবং প্রতিক্ষায় ছিলো। আশা না থাকলেও তারা আশায় ছিল, প্রতিক্ষায় ছিল। দীর্ঘ দিনগুলো একে একে সপ্তাহ হয়েছে, সপ্তাহ মিলে মাস হয়ে গেছে কিন্তু ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই মেলেনি।
এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিরাগের কারণ কী? ইতোমধ্যে বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম বলছে, বাংলাদেশ ট্র্যাজেডি ভিয়েতনামের চেয়েও মর্মান্তিক। এখন কোথায় সেই হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিরা, ছাত্ররা আর শান্তিকামীরা যারা দঃ আফ্রিকা ও ভিয়েতনামের যেকোন ঘটনায় উন্মত্ত হয়ে যেতে পারে? মিলিট্যান্ট ব্ল্যাক পাওয়ার মুভমেন্ট এবং নারীমুক্তি আন্দোলন নিশ্চুপ কেনো?
বাংলাদেশের বিরূদ্ধে ইয়াহিয়ার গণহত্যা বর্ণবাদীও, সাম্প্রদায়িকও। তর্জন গর্জন করা সেই বর্ণবাদবিরোধী ক্রুসেডারগণ এখন কোথায়? পশ্চিমাদের এই সামগ্রিক বেদনাবোধহীনতা দেখে মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে নিবে যে প্রযুক্তিগত সভ্যতার অগ্রগতি স্বত্বেও বিশ্ব আত্মিকভাবে উপনিবেশবাদ বা দাসপ্রথার যুগেই রয়ে গেছে। এটা জাতীয়তার বিভক্তি নয় বরং দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চলের সংখ্যাগুরুদের সাথে শ্বেতাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যে সহজাতভাবে বিভক্তি হিসেবে বিশ্বাস করতে চাই। শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থিরা কেবল তখনি বিবেকের তাড়নায় ভোগে যখন তাঁরা অশেতাঙ্গদের কাছাকাছি আসে। কিন্তু অশ্বেতাঙ্গরা যখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে গণহত্যা চালায় তখন তাঁরা (শ্বেতাঙ্গরা) নিজেরা একত্রিত থাকার প্রয়াস চালায় এবং গোপন আনন্দ উপভোগ করে। আমি আশা করি আমার বিশদ ব্যাখ্যা ভুল নয়।
পশ্চিমা বিরাগের দ্বিতীয় কারণ হতে পারে এই যে, ইয়াহিয়া সরকার কিছু দ্বায়িত্বহীন পশ্চিমা সাংবাদিকদের দ্বারা বিদ্বেষপরায়ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ট্র্যাজেডির সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে কিছু শ্বেতাঙ্গদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে বাংলাদেশর স্বাধীনতা আন্দোলন আসোলে বায়াফ্রার মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যা শেষ পর্যন্ত পরাজয় ছাড়া আর কিছুর দেখা মিলবে না। একটি পশ্চিমা রেডিও এখনো আমাদের যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা বলে অভিহিত করে যাচ্ছে। ইয়াহিয়ার কৈফিয়ত দাতারা উদাহরণ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোকে তুলে ধরে এবং বলে যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতিয়তাবাদী নেতা সুকর্নকে সফলতার সাথে অপসারন করেছে সাবলীলভাবে অর্ধ মিলিয়ন পিকেআই মেম্বারদের হত্যা করে। জোর দিয়ে বলা যায় যে, ইয়াহিয়াও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং পাকিস্তানকে একত্রিত রাখতে আওয়ামী লীগ ও বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে চাইছে। গণহত্যা শুরুর আগে জুলফিকার আলী ভুট্টোর করাচি সাপ্তাহিক কম্ব্যাটে এই পরিনতির ইঙ্গিত দিয়েছে এবং সতর্ক ছয় দফার মাধ্যমে অতিমাত্রায় স্বায়ত্বশাসনের দাবি না করতে বাংলাদেশের জনগণকে সাবধান করে দিয়েছে।
বলাই বাহুল্য যে, টেরা ফ্যাসিস্টরা রাজনৈতিক দূরবীক্ষণের ভুল দিক দিয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করছে। তারা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয় এবং সংকটাপন্ন বিষয়গুলো মূলতঃ ঐসব বায়াফ্রা অথবা ইন্দোনেশিয়ার ইস্যূগুলো থেকে ভিন্ন। ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো সফল হয়েছিলো কারণ সে গণহত্যা চালায়নি এবং লক্ষ্য ছিলো শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির বিলোপ ঘটানো যে দলটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সিকিভাগ জনপ্রিয়তার আস্বাদও পায়নি। আর বায়াফ্রার ইস্যূটি ছিলো মূলতঃ উপজাতীয় প্রকৃতির এবং এটা ছিলো অপ্রতিরোধ্য একটি বৃহৎ অংশের সাথে একটি ছোট সংখ্যালঘু বিদ্রোহ। যা ছিলো আগা গোড়া সশস্ত্র ভুমিকার এবং যার ফলে শুরুতেই অবধারিত ভাগ্য নিরূপিত হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে এটা একেবারে পরিষ্কার যে বাংলাদেশের বিষয়টা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা স্বাধীনতা আন্দোলন কেন্দ্রিক। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে একটি ফ্যাসিস্ট আর্মির সহায়তায় পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের দ্বারা অন্যায্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষনের বিরুদ্ধে এই ভূখন্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন আজ জেগে ওঠার সিদ্বান্ত নিয়েছে। একত্রিত থাকা তাদের জন্য অসম্ভব ছিলো যেখানে পারস্পরিক আস্থা বিশ্বাস ব্যতিরেকে শুধুমাত্র একটি ধর্ম ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে। আরো যোগ হয়েছে অনন্য ভৌগলিক ও জাতিগত বাস্তবতার অস্তিত্ব।
যুদ্ধটা বস্তুতঃ সামরিক জান্তার একটি উন্মত্ত দুঃসাহসিক অভিযান অথচ এই মাথামোটা জান্তা এখনো তাঁদের বোকামির মাত্রা উপলব্দি করতে পারেনি। ইহা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে পশ্চিমা বিশ্বও এই অদূরদৃষ্টির শিকার হতে পারে।