আবু সাঈদ চৌধুরী, বিচারপতিউপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;বহির্বিশ্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি এবংলন্ডনে বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ৪২ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ০৮ নং দলিল থেকে বলছি…

আবু সাঈদ চৌধুরী, বিচারপতি

মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আমি জেনেভায় উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার সদস্য। এই সম্মেলন চলাকালে ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ সালে বিবিসি’র মাধ্যমে আমি জানতে পারি যে, বাংলাদেশের অবস্থা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ঢাকায় সাংঘাতিক কিছু হয়েছে কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে সঠিক কিছু জানা যাচ্ছে না। এই খবর শুনে অত্যন্ত মর্মাহত, চিন্তিত এবং ব্যাকুল হয়ে উঠি। অধিবেশন চলা অবস্থায় মানবাধিকার সংস্থারতৎকালীন সভাপতি আঁদ্রে আগিলাকে আমি জানাই যে আমার দেশ সংক্রান্ত গভীর দুঃখজনক সংবাদ আমি জানতে পেরেছি এবং এ সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে অধিবেশনে অংশগ্রহণ আর সম্ভব নয়। আমি মধ্যাহ্নে জেনেভা ত্যাগ করি এবং বিকেলের দিকে লন্ডন এসে পৌঁছি।

আমি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দুজন কর্মকর্তাকে চিনতাম। একজন হচ্ছেন ইয়ান সাদারল্যান্ড, তিনি ছিলেন দঃ এশিয়া বিভাগের প্রধান এবং অপরজন হচ্ছেন এন, জে, ব্যারিংটন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড হিউমের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

পরের দিন যদিও ছুটির দিন ছিলো তবুও আমি উভয়কে তাদের অফিসে আসতে অনুরোধ জানাই। এবং দুজনেই তা রক্ষা করেন। পররাষ্ট্র ভবনে উপস্থিত হলে তারা আমাকে জানান, ঢাকা থেকে এখনো সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ সময় আমাকে কফি খেতে অনুরোধ করা হয়। আমরা কফি খাচ্ছি এমন সময় মিঃ সাদারল্যান্ডের একান্ত সচিব খবর দেন যে ঢাকা থেকে একটি টেলেক্স এসেছে। মিঃ সাদারল্যান্ড তথ্য সম্পূর্ণ হলে সেটি নিয়ে আসতে বলেন। সচিব একটি বিশাল টেলেক্স নিয়ে আসেন এবং সাদারল্যান্ড গোটা জিনিসটা পাওয়ার পর আমাকে বলেন জাষ্টিস চৌধুরী, আমি অত্যান্ত দুঃখিত, ঢাকার সংবাদ খুবই খারাপ। বহু ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে এবং আমরা ভীত যে, শিক্ষকরাও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বাদ পড়েনি। নগরে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই বেশী।

আমি আরো জানতে পারি যে, বৃটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার জানিয়েছেন তার পক্ষে আর টেলেক্স করা সম্ভব নয় এবং তিনি বৃটিশ নাগরিকদের ফেরত নেবার অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই মুহুর্তে আমার মনে হলো যে, গোটা বাংলাদেশ একটি বধ্যভুমিতে পরিনত হয়েছে। এ অবস্থায় আমার পক্ষে পাকিস্তান সরকারের সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখা অপমানজনক। যারা আমার ছাত্রদের মেরে ফেলেছে আমি কিভাবে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারি। আমার মনে পড়ল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের কথা। আমি তখনই লর্ড হিউমের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সে সময় তিনি স্কটল্যান্ডে তার দেশের বাড়ীতে ছিলেন। আমি অবিলম্বে কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সাধারণ সম্পাদক আর্নল্ড স্মিথের সঙ্গে দেখা করি এবং ঢাকায় হত্যা বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির চেষ্টা করতে বলি। এখানে একজনের নাম বিশেষ করে বলতে হয়, তিনি হচ্ছেন উইলিয়াম পিটার’স। এই ভদ্রলোক একাত্তর সালে কমনওয়েলথ সচিবালয়ে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি আমাদের আশা আকাংখার প্রতি অত্যন্ত সহানুভুতিশীল ছিলেন। এবং তার সাথে আমি সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করি।

জেনেভা থেকে লন্ডনে আসার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেখানে বসবাসরত বাঙালিদের সাথে আমার দেখা হয় এবং মিঃ সাদারল্যান্ডের সাথে টেলিফোনে কথা বলি। আমি আগেই বলেছি, পরের দিন তার সাথে দেখা করি এবং ঢাকা থেকে পাঠানো টেলেক্স-এ খবর পাই। হাবিবুর রহমান, সুলতান শরিফ এবং অন্য কয়েকজন আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। মিঃ হাবিবুর রহমান আমাকে পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়ে যান। পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ফিরে এসে আমার স্ত্রীকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাই। সে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে আমার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

ইতিমধ্যে বহু বাঙালি জড় হতে থাকে। সবার নাম মনে রাখা সম্ভব নয়। তবে বিশেষভাবে আমি কয়েকজন ডাক্তারের কথা বলতে চাই যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছেন। নয় মাস ধরে যে আন্দোলন চলেতাতে কিছু কিছু কর্মীর কাছ থেকে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় কিন্তু ডাক্তার কর্মীরা কোনোদিন কোনো অসুবিধা করেননি বরং তাদের ত্যাগ কর্মনিষ্ঠা এবং কষ্টসহিষ্ণুতা অন্যদের জন্য আদর্শ হিসেবে প্রজ্বলিত ছিলো। ডাঃ আব্দুল হাকিম, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং মোশারফ হোসেন জোয়ারদার সারাক্ষন পরিশ্রম করতেন।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমগ্র বৃটেনে বাঙালিদের মধ্যে আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রায় প্রতিটি বাঙালি এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় এবং বিভিন্ন এলাকায় কমিটি গঠন করে। কিন্তু একটি সংগঠনের সাথে আরেকটি সংগঠনের যোগাযোগ ছিলো কম যার ফলে নেতৃত্বের প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেয়, এবং নিজেদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক দলই আমাকে তাদের দলে যোগ দেয়ার জন্য চাপ দেয় কিন্তু আমি একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত না হলে কোনো দলেই যোগ দেব না বলে জানাই।

লর্ড হিউমের সাথে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। এই মধ্যবর্তী সময়ে আমি বিভিন্ন একাডেমিসীয়ান এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকি। এ ছাড়া বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার এ্যালেন বুলক এবং ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লর্ড জেমসের সঙ্গে দেখা করি। তারা আমাকে স্যার হিউ স্প্রিংগারের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তিনি ছিলেন কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মুখপাত্র।

ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড জেমস একটি মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করেন এবং প্রায় বিশজন বিভাগীয় প্রধানকে ঐ ভোজে দাওয়াত করেন। আমি তাদের কাছে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করি এবং তারা গভীর সহানুভুতির সঙ্গে তা শোনেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে লর্ড জেমস ঢাকায় গিয়েছিলেন। তিনি ভবিষ্যতবাণী করেন যে, ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনী হিসেবে ব্যবহার করা আর সম্ভব হবে না। এরপর আমি স্যার হিউ স্প্রিং-এর সাথে দেখা করি। তিনি বলেন, “হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা আমার নৈতিক দ্বায়িত্ব” । তিনি আরো বলেন, তিনি তখনি ইয়াহিয়া খানকে একটি টেলিগ্রাম করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য।

তারপর আমি ঢাকা আন্তর্জাতিক জুরিষ্ট কমিশনের সাধারণ সম্পাদককে টেলিফোন করে সমস্ত ব্যাপার জানাই। তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশ আন্দোলনে তৎপর বিভিন্ন সংগঠন একত্রীকরণ করার জন্য আমরা সকলেই চেষ্টা করি। এই কাজটি ছিলও অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। রাত দুটা তিনটা পর্যন্ত মিটিং চলতো এবং বাড়ী ফিরে নিজের কাছে শপথ করতাম যে পরদিন আর যাবো না। কে কোন দলের নেতা হবেন তা নিয়ে মতবিরোধ ছিলো। কিন্তু পরদিন আবার ঠিকই যেতাম।

১০ই এপ্রিল লর্ড হিউমের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। সাদারল্যান্ড এবং ব্যারিংটন আমাকে তার কাছে নিয়ে যান। লর্ড হিউম আমাকে দেখার সাথে সাথেই বলেন যে তিনি পাকিস্তানের হাই কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন। অবস্থা ঠিকই আছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি বলি শুধুমাত্র একজনের কথাতেই প্রমাণ হয় না যে অবস্থা ঠিক আছে। আমি আমার সম্পূর্ণ বক্তব্য পেশ করি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাঁচানোর জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট খবর আছে শেখ মুজিব ভালোই আছেন। এই সাক্ষাৎকারে লর্ড হিউমকে আমি জানাই, আমরা শান্তি এ শৃঙ্খলার সাথে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। সেদিনই আমি চারটার সময় বিবিসি’তে যাই। মিঃ ট্রার গিল সেখানে আমার একটা একক সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন। এই সাক্ষাৎকারে আমি পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষনা করি। বিবিসিতে কর্মরত দুজন বাঙালি সিরাজুর রহমান ও শ্যামল লোধ আমার বিবৃতি নেন এবং প্রচার করেন।

আমি বিবিসি’তে বিবৃতি দিয়ে বের হবার সময় পাকিস্তানী হাই কমিশনের মিঃ মহিউদ্দিন আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কি করবেন। আমি তাকে বলি যথাসময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবো। কেননা তখনো মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়নি। এ অবস্থায় আমার পক্ষে এক সরকারী কর্মচারীকে সেই মুহুর্তে পদত্যাগ করতে বলা উচিত হত না। পরে অবশ্য আমরা মিঃ মহিউদ্দিনকে পদত্যাগ করতে বলি এবং তিনি তা করেন।

আমি যে জায়গায় থাকতাম সেখানে পাকিস্তান হাই কমিশন থেকে বার বার টেলিফোন করে আমাকে হাইকমিশনারের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তা প্রত্যাখান করি। অতঃপর আমি বাসা পাল্টাবার সিদ্ধান্ত নেই। কয়েকদিন পরে গোছগাছ করে যখন আমি রওয়ানা হচ্ছি তখনই একটা টেলিফোন আসে। জানতে পারি টেলিফোনটি কলকাতা থেকে করা হয়েছে এবং অপরাপর কথা বলেছেন টাংগাইল থেকে সাংসদ জনাব আব্দুল মান্নান এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম। এই টেলিফোন সরকার গঠনের কয়েকদিন আগে আসে। তারা আমাকে জানান যে, তারা আমার সিদ্ধান্তে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন এবং তারা চান যে, সরকার গঠনের পর আমি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করি।

অস্থায়ী বাসস্থানে যাবার পর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে একটি ফোন পাই। কিভাবে তারা আমার নতুন ঠিকানার খবর জানলো ঠিক বুঝতে পারিনি। তারা আমার সঙ্গে দেখা করে জানান যে, পাকিস্তান সরকার আমাকে অপহরণ করার জন্য কিছু পাকিস্তানী লোক নিয়োগ করেছে এবং আমাকে অনুরোধ করেন অত্যন্ত সতর্কভাবে চলাফেরা করতে। তারা আরো জানান সরকারী পর্যায়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে যুক্তরাজ্যে থাকাকালে আমার জন্য ছদ্মবেশী কর্মচারী দ্বারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। তারা বিশেষভাবে চলাফেরার ব্যপারে আমাকে সতর্ক করে দেন এবং ভূগর্ভস্থ রেলে ভ্রমন করতে বারণ করেন। কেননা এগুলি বিদ্যুৎচালিত এবং ধাক্কা দিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার সম্ভাবনা বেশী, বাসে চলা অধিক নিরাপদ এবং পায়ে হেটে চলা আরো নিরাপদ। কারন এতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের পক্ষে চোখ রাখা সহজ। তারা বলেন যে, যদিও সময় আমার উপর তাদের নজর থাকবে তবু যে কোনো বিপদে একটি বিশেষ টেলিফোন নাম্বারে যেন যোগাযোগ করি। সবশেষে তারা বলেন যে, এইসব নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থন হিসেবে নয়। তারা চান যে, যুক্তরাজ্যের মাটিতে এমন কিছু না ঘটুক যাতে যুক্তরাজ্য সরকারের সম্মান ক্ষুন্ন হয়। এই ঘটনার কিছু পরে বৃটেনে বসবাসরত বাঙালিরা কাভেন্ট্রিতে একটি সভার আয়োজন করে। প্রকৃতপক্ষে এই অনুষ্ঠানে যাবার আমার খুব একটা উৎসাহ ছিলো না। কারণ, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহ এতো বেশী হত যে আমি খুবই বিমর্ষ বোধ করতাম। এছাড়া আমি অনুভব করেছিলাম যে আমার কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতাও ছিলো না। কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তেই জনাব রকিবউদ্দিন আমাকে মুজিবনগর সরকারের নিয়োগপত্রটি দেন এবং আমি কাভেনট্রিতে উপস্থিত হই। সভায় তুমুল হট্টগোল চলছিলো। আমরা বেগম লুলু বিলকিস বানুকে অনুষ্ঠানের সভাপতি করে কাজ শুরু করি। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে এই সভা পরিচালনা করেন। এই অনুষ্ঠান চলাকালে জনাব রকিব আমার নিয়োগপত্রটি পড়ে শোনান। কিন্তু আঞ্চলিক নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল থাকায় আমি মর্মাহত অবস্থায় হল ত্যাগ করতে উদ্যত হই। এ সময় জনাব মিনহাজ উদ্দিন নামে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলেন যে বহু কলহ হয়েছে, এই কলহে আমাদের অনেক ক্ষতিও হয়েছে। আমরা আর কলহ চাই না। আপনি যাবেন না। এরপর আরো আধঘন্টা ধরে আলাপ আলোচনা হয়। এবং গউস খান প্রস্তাব করেন যে, পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি ষ্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হোক। এর নামকরণ করা হয় ‘ষ্টিয়ারিং কমিটি অব পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’। আমি সভাপতির পদ গ্রহন করতে দ্বিধাবোধ করি। কারন আমার ভয় ছিলো এই সংগঠন আবার ভেঙ্গে যাবে। দ্বিতীয়তঃ আমি ভাবছিলাম, আমার মূল দ্বায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ব জনমত গঠন করা এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। যাহোক শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে, ষ্টিয়ারিং কমিটি তার কর্মকান্ড চালাবে আমার উপদেশ মতো।

১১ নম্বর গোরিং ষ্ট্রীটে এই কমিটির জন্য অফিস নেওয়া হয়। অফিস ঘরটি ছিলো জনাব হারুনুর রশীদের। তার পাটের ব্যবসা ছিলো। কমিটির সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ আব্দুল মান্নান, শামসুর রহমান, মিঃ কবীর চৌধুরী। আর মিঃ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন আহবায়ক। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য নির্ধারিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করা এবং অস্র সরবরাহ ও সাংগঠনিক কাজের জন্য মূলতঃ বাঙালিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ। পরে যখন দেখা গেল অস্র সরবরাহে নানা বাঁধা তখন আর অর্থ সংগ্রহের জন্য তেমন প্রচারণা চালানো হয়নি।

মুজিবনগর সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি বোর্ড অব ট্রাষ্টি গঠন করা হয়। এই বোর্ডের সদস্য ছিলেন মিঃ ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ, প্রাক্তন মন্ত্রী মিঃ ষ্টোন হাউস এবং আমি। এ কমিটিতে কয়েকজন বাঙালির সদস্য হবার কথা ছিলো। কিন্তু কোন কোন বাঙালি নিয়ে ফান্ড হবে তা ঠিক করতে না পারায় আপাতত এই তিনজনকে নিয়ে বোর্ড গঠিত হয়। পরে আরো নেবার কথা ছিলো। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ায় সংগৃহিত অর্থ বাংলাদেশ সরকারের নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং বোর্ডের বিলুপ্তি ঘোষনা করা হয়।

পাকিস্তানি দূতাবাস এই অর্থ সংগ্রহ অভিযানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালাতে থাকে এবং বহুলাংশে সফল হয়। কোনো ব্যাংকই একাউন্ট খুলতে দিতে রাজী হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত হ্যামব্রোজ ব্যাংক রাজী হয় এবং সেখানে একাউন্ট খোলা হয়।

কিন্তু পাকিস্তান হাই কমিশন চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে যার ফলে হঠাৎ করে একদিন হ্যামব্রোজ ব্যাংক আমাদের জানায় তারা এই একাউন্ট চালাতে দেবে না এবং আমাদের সমুদয় অর্থ উঠিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ বলে কোনো দেশ নেই। অথচ ফান্ডের নাম বাংলাদেশ ফান্ড। এই ঘটনাটি ঘটে জুন মাসে। তখন আমাদের একাউন্টে এক লক্ষ পাউন্ড সংগৃহিত হয়েছিলো। ব্যাঙ্কের এই সিদ্ধান্তে আমরা অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত হই এবং বিচলিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন জন ষ্টোন হাউস(এমপি) এবং তিনি ন্যাশনাল ওয়েষ্ট মিনিষ্টার ব্যাংকে একাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে দেন। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, এই ব্যাংক পূর্বে আমাদের একাউন্ট খুলতে দিতে রাজী হয়নি। অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে এমন ব্যবস্থা করা হয় যাতে করে সরাসরি ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া যায়। ইংল্যান্ডের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো ব্যক্তি সরাসরি ব্যাংকে টাকা জমা দিতে পারেন। অর্থ সংগ্রহ এবং আন্দোলন পরিচালনার জন্য নানা প্রান্তে একশটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রথম থেকেই আমি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকি এবং কনসারভেটিভ পার্টির প্রফেসর জিনকিন’স এর সাথে যোগাযোগ করি। তিনি একজন প্রাক্তন আই, সি, এসঅফিসার ছিলেন। কনসারভেটিভ পার্টির অফিসে একটি সভার আয়োজন করি এবং তাদের কাছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের কারন তুলে ধরি।

লেবার পার্টির সদস্যদের সাথেও আমার যোগাযোগ হয়। তারা আমাদের এই আন্দোলনের প্রতি অত্যন্ত সহানুভুতিশীল ছিলেন। তারা একটি সভার ব্যবস্থা করেন। এ সভা পার্লামেন্ট ভবনেই অনুষ্ঠিত হয়। আমার কাছে মনে হয়েছে এটি ছিলো আমাদের আন্দোলনের প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা এবং স্বীকৃতির ইঙ্গিত। মে মাসে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আমার আনুষ্ঠানিক কর্মের অংশ হিসেবে মে মাসে নিউইয়র্ক যাই। ওখানকার বাঙালি কুটনীতিক জনাব মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে প্রায় দুশো বাঙালি আমার সাথে বিমানবন্দরে মিলিত হয়। এই দৃশ্য অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলো। কারন এতে করে আমাদের আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক সমর্থনের লক্ষণ দেখা যায়। যেদিন আমি নিউইয়র্কে পৌঁছি আরো কয়েকজন বাঙালি উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী যথা- জনাব এ, এম, এ মুহিত, জনাব খোরশেদ আলম, জনাব হারুন রশীদ এবং আরো অনেকে আমার সাথে দেখা করেন। এবং আমি তাদের সাথে মিলিত হই এবং প্রকৃত অবস্থা তাদের সামনে তুলে ধরি। একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারের কথা আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত জনাব বারুদী যিনি খৃষ্টান ছিলেন, রোকেয়া হলের ঘটনা শুনে তিনি এতো বেশী আলোড়িত ছিলেন যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন যে, তিনি সৌদী বাদশাহকে সমস্ত কথা জানাবেন এবং সর্বতোভাবে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালাবেন।

জাতিসংঘের বিভিন্ন কুটনৈতিক সদস্যের সঙ্গেও দেখা করি এবং বক্তব্য রাখি। জাতিসংঘের তৎকালীন অধিবেশনের সভাপতি নরওয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। তার সাথেও আমার সাক্ষাৎ হয়। আমরা প্রচারপত্র বিলি করি এবং বিভিন্ন সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই।

জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের সাথে দেখা করার চেষ্টা করি। তিনি আমাদের জানান যে তার সাথে সরাসরি দেখা করা আমাদের বিপক্ষে যাবে। কেননা তিনি নীরবে আমাদের জন্য কাজ করে যেতে চান। দেখা না করলে পাকিস্তানে চাপ প্রয়োগের সুযোগ অনেক বেশী থাকবে। তিনি আরো বলেন যে, এ সিদ্ধান্ত আমাদের কল্যাণের জন্য এবং আমাদের বক্তব্য শোনার জন্য তিনি জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে পাঠান।

আমি যখন ইংল্যান্ডের বাইরে যেতাম তখন শেখ মান্নানকে দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিতাম। কারন তিনি ইংল্যান্ডে থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে তার দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। বৃটেনের বিভিন্ন জায়গায় আমরা সভা করি এবং আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারন করে।

এরই মাঝে ফ্রান্সের সাথে আমরা যোগাযোগ করি এপ্রিলের শেষের দিকে। আমি সেখান গিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করি। সেখানে থাকতে একজনের সাথে আমার গুরত্বপূর্ণ যোগাযোগ হয়, তিনি হচ্ছেন মরিসাসের প্রধানমন্ত্রী জনাব সিউ সাগর রামগোলাম। তাকে আমি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনুরোধ জানাই। বিভিন্ন অবস্থার কারনে তার পক্ষে এটা সম্ভব হয়নি কিন্তু অন্য সব ধরনের সাহায়্য তিনি আমাদের করেন। আমি প্যারিসে তার সাথে একদিন আমাদের আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। তিনি তার দেশের লন্ডনস্থ দূতাবাসকে আমাদের সব ধরনের সাহায্য করার জন্য নির্দেশ দেন। এ ছাড়া আমরা কিছু বাঙালি ছাত্রকে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে ফ্রান্সে পাঠাই। আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারী ইউনিয়নের সভায়ও আমরা প্রতিনিধি প্রেরণ করি।

বৃটেনে অবস্থিত “সোস্যালিষ্ট ইন্টারন্যাশনালের” সাধারণ সম্পাদক হ্যান্স ইয়ানিতশেক আমাদেরকে সর্বতোভাবে সহযোগীতা করেন। তিনি বলেন আমার অফিস তোমাদেরই অফিস, তোমরা এটা সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারো। এখানে বলা উচিত যে, কিছুদিন আমরা এই প্রস্তাবের সদ্ব্যবহার করি।

লন্ডনে জার্মানীর প্রাক্ত চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের সাথে আমি সাক্ষাৎ করি এবং তাকে জানাই যে স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের পক্ষে অন্য কোনো পথ সম্ভব নয়। তিনিও আমাদের সাহায্যর প্রতিশ্রুতি দেন। এখানে বলা যায় যে, যেখানেই গিয়েছি সেখানেই আমরা অত্যন্ত সহানুভুশীল অভ্যর্থনা এবং সাহায্যর আশ্বাস পেয়েছি। এর একটি কারণ হচ্ছে যে, বৃটেনের প্রেস আমাদের খবর এমনভাবে প্রকাশ করে যাচ্ছিল যে, জনমত আমাদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিলো। জুন-জুলাইয়ের দিকে একটি গুঞ্জন ওঠে যে, আমাদের ইসরাইলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। আমি অনুসন্ধান করে দেখি যে এ সংবাদ একেবারে ভিত্তিহীন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। জুলাই মাসে বৃটেনে অবস্থিত বাঙালিদের আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী এবং জোরদার হয়ে ওঠে। আগষ্ট মাসের প্রথম তারিখে আমরা ট্রাফলগার্ড স্কোয়ারে একটি বিরাট জনসভা করি। এটি ছিল লন্ডনে অনুষ্ঠিত আমার জানামতে সাম্প্রতিক কালের সর্ববৃহৎ জনসমাবেশ। প্রায় চল্লিশ হাজার লোক এই সমাবেশে উপস্থিত হন। এলাকার চারিদিকে সমস্ত বাড়ীঘরের ছাদে লোকজন ভর্তি হয়ে যায়। এই সভাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের মহিউদ্দিন বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্যের কথা ঘোষনা করেন।

আগষ্ট মাসের শেষের দিকে মুজিবনগর সরকারের সম্মতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মিশন চালু হয়। ২৪ নম্বর প্রেমরিজ গার্ডেনে মিশনের অফিস খোলা হয় এবং এই ভবনটি ব্যবস্থা করেন ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ। আগষ্টের শেষে পুরোদমে এই মিশনের কাজ শুরু হয়। এই সময় ডঃ মোশারফ হোসেন জোয়ার্দারের মাধ্যমে প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জহরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ হয়। তিনি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি সুবেদ আলী নাম নিয়ে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এবং বৃটেনে এই ২৪নং প্রেমরিজ গার্ডেনে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের সমস্ত খরচ বহন করতেন। মিশন হওয়ার পর আমি এর প্রধান হিসেবে যোগদান করি। বহির্বিশ্বে এটাই বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস।

আমার বিদেশ ভ্রমণ সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করা যেতে পারে। আমার দ্বায়িত্ব ছিলো আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করা। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে আন্দোলন বেশ শক্তিশালী আকার ধারণ করে।

নেদারল্যান্ডেও একটি শক্তিশালী সংগঠন ছিলো। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন জনাব জহির উদ্দিন এবং আমীর আলী। জুন মাসের দিকে ঠিক হয় যে, আমি এ্যামষ্টেডামে যাবো। একদিন পূর্বেই হঠাৎ করে আমার বাসায় এ্যামষ্টেডামের টেলিভিশনের একটি দল উপস্থিত হয় এবং আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এতে আমাদের আন্দোলন ব্যাপক প্রচার লাভ করে। বলা যেতে পারে অন্য দেশ থেকে এসে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা আমাদের আন্দোলনকে এক ধরনের স্বীকৃতি প্রদানের শামিল।

ডাচ পার্লামেন্ট ভবনে বৈদেশিক বিষয়ক উপ পরিষদে তিন ঘন্টা আলোচনা করি। যাদের সঙ্গে আলোচনা হয় তারা ছিলেন মিঃ টারবিক, জ্যাঁ প্রাংক, মোমেসত্যাগ, স্বাধীকার, ভ্যান উস্তেন। তারা প্রায় সবাই বুঝতে পারেন কেন আমরা স্বাধীনতা দাবী করেছি। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর সহানুভুতি প্রকাশ করেন এবং আমাদের বিজয় কামনা করেন। পার্লামেন্টে আমাদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। আমাদের প্রেস কনফারেন্সটি অত্যন্ত সফল হয়েছিলো। ডাচ সরকার আমাদের পক্ষে একটি বিবৃতি দান করেন এবং সরাসরিভাবে পাকিস্তান সরকারের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠান। ডেনমার্কেও আমাদের সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল। আগষ্ট মাসের দিকে আমরা সেখানে যাই। ডেনিশ পার্লামেন্টের স্পীকারের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং আমাদের বক্তব্য পেশ করি। তিনি আমাদের সব ধরনের সাহায্যের আশ্বাস প্রদান করেন। এখানে এক ভদ্রমহিলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, তার নাম কিনটেন ওয়াট বার্গে। তার গৃহ আমাদের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। তিনি বাসায় একটি সম্বর্ধনার আয়োজন করেন। সেখানে অনেক বাঙালিও উপস্থিত হন। ওই ভদ্রমহিলাকে কেন্দ্র করে কমিটি গঠন করা হয়। আমরা সেখানেও ব্যাপক প্রচারকার্যে সফল হই। ডাচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস, এ, ডামের সঙ্গেও দেখা করি। আরেকজন যিনি আমাদের ব্যাপকভাবে সাহায্য করেন তিনি ছিলেন ‘পলিটিকেন’ পত্রিকার সম্পাদক জন ডেনষ্ট্যাম্প। তিনি শুধু আমাদের পক্ষে পত্রিকাতেই লিখেননি, বরং সাথে সাথে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রচারের ব্যবস্থাও করেন। ডেনিশ টিভি সাক্ষাৎকারের সময় আমাদের আন্দোলনের পক্ষে একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনা ঘটে। যিনি আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন, তিনি সাক্ষাৎকার শুরু হবার পূর্বেই আমাকে জানান যে, তিনি খবর পেয়েছেন একটি ডেনিশ কোম্পানী পাকিস্তান সরকারের কাছে অস্র বিক্রয় করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন যে, আমাকে এমনভাবে প্রশ্ন করা হবে যাতে আমি এই বিষয়টি উত্থাপন করতে পারি। সাক্ষাৎকার শুরু হবার সাথে সাথে আমি তথ্যটি জানাতে সক্ষম হই এবং সমস্ত বিষয়টির প্রতিবাদ ও ডেনমার্ক সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তারা আমাকে আশ্বাস দেন যে এই অস্ত্র কিছুতেই পাঠাতে দেয়া হবে না। এই ঘটনাটি থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের আন্দোলনের প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের কি ধরনের সমর্থন ছিল। এছাড়া আমি বিরোধী দলের নেতা পল হার্টলিংকের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করি।

নরওয়েতে দশ বারো জনের বেশী বাঙালি ছিলো না কিন্তু আন্দোলন ছিলো ব্যাপক। এর কারণ, নরওয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী ছাত্রনেতা মিঃ বুল আমাদের আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। তিনি আমাদের জন্য জনমতের জোয়ার সৃষ্টি করেন। তাদের প্রচেষ্টায় জাতীয় টেলিভিশনে আমার বক্তৃতা প্রচার করা হয়। এক সন্ধ্যায় আমি ছাত্র পরিষদের কার্যকরী কমিটির উদ্দেশে ভাষণ দেই। অসলো বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি বহু ছাত্র সমাবেশে একটি ভাষণ দেউ। আমি লক্ষ্য করি নরওয়ের ছাত্ররা আমাদের আন্দোলনকে তাদের নিজেদের আন্দোলন বলে মনে করে। একজন ছাত্র(শিল্পি) ইয়াহিয়া খানের একটি ছবি আঁকেন। তাকে একজন হত্যাকারী হিসেবে চিত্রিত করে। কয়েকজন পাকিস্তানী ছবিটি ছিঁড়ে ফেলে ফলে পাকিস্তানীদের প্রতি তাদের মনোভাব আরো বিরূপ হয়ে ওঠে।

অসলোর মেয়র আমাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানান এবং একটি গ্রন্থে আমাকে সরাসরিভাবে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করেন।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং আইন বিষয়ের প্রধানের সাথে একটি কমিটি গঠনের ব্যাপারে আলোচনা করি।

নরওয়ের প্রধান বিচারপতি পিয়ের ওল্ড আমাকে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে অন্যান্য বিচারপতিরাও ছিলেন। তিনি আমার পুরানো বন্ধু। এছাড়া আমি রোটারি ক্লাবে বক্তব্য রাখি। সাধারণত এই ফোরামে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে দেয়া হয় না। কিন্তু আমার বেলায় ব্যতিক্রম হয়। আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আমাদের সমস্ত বক্তব্য পেশ করি এবং উপস্থিত সুধীমন্ডলীর কাছ থেকে প্রচুর সাড়া পাই। সম্ভবতঃ নরওয়ে রোটারি ক্লাবে এই ধরনের ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেনি।
সুইডেনে জনাব রাজ্জাক যিনি পূর্ব পাকিস্তান পররাষ্ট্র বিভাগে কর্মরত ছিলেন আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তিনি আমার সাথে এয়ারপোর্টে দেখা করেন এবং বলেন যে, বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিহিদ গুনার মিরডালের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করে আমি খুবই আনন্দিত হই। তিনি আমাদের আন্দোলনের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশ এ্যাকশান কমিটির সুইডেন শাখারও প্রধান হিসেবে কাজ করতে রাজী হন এবং তার অফিস সেই দিন থেকে এ্যাকশান কমিটি অফিসে পরিণত হয়। তার বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাজ পরিয়ে দেই। এ সময় তার মাধ্যমেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সম্পাদকদের সাথে আমার যোগাযোগ হয় এবং তারা আমাদের সব ধরনের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তৎকালীন ক্ষমতাসীন পার্টির সাধারণ সম্পাদকের সাথেও আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে বলেন যে, মৌখিক সমর্থন যথেষ্ট নয়, তারা এর চেয়ে বেশী করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন যে, সরাসরিভাবে তারা মুক্তিবাহিনীকে অস্র দিয়ে সাহায্য করবেন। যা হোক যদিও এর পরপরই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার জন্য অস্রের আর প্রয়োজন হয়নি তবুও তাদের সদিচ্ছার তুলনা বিরল।

আমি যখন হেলসিংকি বিমানবন্দরে অবতরণ করি আমাকে প্রথমে অভ্যর্থনা করেন সেখানকার বৃটিশ কনসাল জেনারেল মিঃ রয় ফক্স। আমি খুবই আশ্চর্য হই এবং তাকে আমার সফরের উদ্দেশ্য জানাই। একজন বিদেশি কুটনীতিক হিসেবে আমার সঙ্গে মেলামেশায় বিপদের সম্ভাবনার কথা তাকে জানাই। ফক্স আমাকে বলেন, আমি তার ব্যক্তিগত বন্ধ এবং বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কোনো অধিকার নাই তার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার। তিনি আমাকে তার বাসায় নিয়ে যান এবং তার অতিথি হবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। যা হোক বহু কষ্টে তাকে বুঝিয়ে আমি সন্ধ্যা বেলায় তার বাসা থেকে হোটেলে উঠে আসি। টিভিতে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। এছাড়া আমি পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে সংসদ সদস্যদের সাথে দেখা করি এবং আমার বক্তব্য প্রচার করি।
বিশ্ব শান্তি পরিষদের সদর দফতর এখানে অবস্থিত এবং এর সাধারণ সম্পাদক রুমেশ চন্দ্রের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি জানান যে তার সংগঠন বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছে। এরপর আমি লন্ডনে ফিরে আসি।

প্রবাসে আন্দোলনের ঘটনা বর্ননা করতে গিয়ে আমি একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ্য করতে চাই। সেপ্টেম্বর মাসের কোন একদিন লন্ডনে এ্যানথনি মাসকারেনহাস রচিত “রেইপ অব বাংলাদেশ” বইটির প্রকাশনা উৎসবে আমি উপস্থিত হই। তার পরদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লন্ডনে উপস্থিত হবার কথা। এই সভায় একজন ভারতীয় সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞেস করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করবো কিনা! আমি তাকে জানাই যে, আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য কোনো সময় চাইনি।

(বিচারপতি চৌধুরী তাঁর সাক্ষাৎকারের এই অংশটি নিজেই ইংরেজিতে যেভাবে লিখে দিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই মুদ্রিত হলো)

“The Deputy High Commissioner of India in London rang up in the morning and told me that the Indian Prime Minister Mrs. Indira Gandhi would meet the British Prime Minister Mr. Edward Heath in the afternoon at his official residence at Chequers. She would therefore like to have a meeting with me before that. She wanted to know the attitude of the countries I visited recently. In response to the request, I arrived at Claridges Hotel at 11. A. M. It so happened that the officer of the Scotland Yard who met me at Claridges saw me more than once about my security. I was at once taken by the Dy. High commissioner to the drawing room of Mrs. Gandhi’s suite. Mrs. Gandhi came in a minute’s time. This was first meeting with her (I met her second time at Dhaka after independence). After she exchanged the greetings, she asked me about the reaction in the countries I visited recently about the demand for independence of Bangladesh. To that I told her that I received assurances of support from the people and the Govt. of these countries for our independence movement but to my request for recognition by the governments of those countries the uniform answer was that even the neighboring country of India did not recognize our govt. That would show that even India does not consider that our government was really an effective government. I told her that was a disappointing situation. Then I also said that although we felt very grateful to the people of India for giving shelter to those who had left Bangladesh, we really expected recognition of that government. I said I really did not know if pundit Jawaharlal Nehru could have remained satisfied by giving shelter only to the people who went over to India Mrs. Gandhi said that although she did not give formal recognition she was giving all facilities to the provisional government to function formal announcement would create certain situation. Pakistan would never take it quietly. She said they would attack India. It is true that Pakistan would ultimately be defeated but we have developed infrastructure of industries throughout the country. By initial air bombing they might be able to destroy all our ears of struggle in this field. Therefore although we have decided to help Bangladesh on humanitarian ground, my primary responsibilities is to the people of India as their Prime Minister has also to be borne in mind. I have therefore tried to do both and give recognition to Bangladesh at an appropriate time. I told her of course that we have nothing to offer except friendship on the basis of sovereign equality.

Referring to friendship of Bangladesh with India she said that it should be left to the people of Bangladesh to decide after the independence. As far as she was concerned her only expectation was that a democracy would be functioning in a neighboring country.”
(অনুবাদ)
সকালে ইন্ডিয়ান ডেপুটি হাই কমিশনার (লন্ডন) ফোন করে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বললেন যে ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিস্টার এডওয়ার্ড হিথের সাথে আজ বিকেলে চেকারসে তার নিজ অফিসে দেখা করবেন। সে কারণে তিনি (ইন্দিরা গান্ধি) আমার সাথে ঐ মিটিঙের পূর্বে দেখা করতে চান। আমি সম্প্রতি যে সকল দেশ ভ্রমণ করেছি সে সকল দেশের মনোভাব তিনি জানতে আগ্রহী। এই অনুরোধের পড়িপ্রেক্ষিতে আমি সকাল ১১টা সময় ক্লারিজেস হোটেলে উপস্থিত হই। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের যে অফিসার আমার সাথে ক্ল্যারিজেসে দেখা করেছিলেন, তিনি একাধিকবার আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলেন। ডেপুটি হাই কমিশনার আমাকে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর স্যুইটের ড্রইং রুমে নিয়ে যান। কয়েক মিনিট পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এসে উপস্থিত হন। এটা ছিল তাঁর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ (স্বাধীনের পর ঢাকাতে উনার সাথে আমার ২য় বার সাক্ষাৎ হয়)। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সম্প্রতি আমি যে দেশগুলো ভ্রমণ করেছি সেগুলোর মনোভাব জানতে চাইলেন। এই প্রসঙ্গে আমি তাকে বলেছিলাম, ঐ সকল দেশের মানুষ এবং জনগণের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থনের নিশ্চয়তা পেয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধের জবাবে তাঁদের সকলের জবাব ছিল একটাই যে, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইন্ডিয়া এখনো আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেয় নি। এটা প্রতীয়মান করছে যে এমনকি ইন্ডিয়াও আমাদের সরকারকে কার্যকর হিসেবে গণ্য করছে না। আমি তাকে জানিয়েছিলাম যে সেটা একটা হতাশাজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তারপর আমি তাকে বলেছিলাম যদিও বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষদের আশ্রয়দানের জন্য ইন্ডিয়ার মানুষের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, তথাপি আমরা সত্যিকার অর্থেই ইন্ডিয়ান সরকারে স্বীকৃতি আশা করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, “আমি ঠিক জানি না এমন পরিস্থিতিতে পণ্ডিত জহরলাল নেহরু শুধু বাস্তুহারা মানুষকে আশ্রয় প্রদান করলেই সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন কিনা।“ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন যে, যদিও তিনি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন নি তথাপি তিনি অস্থায়ী সরকারকে সবরকম সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি কিছু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। পাকিস্তান ব্যাপারটাকে শান্তভাবে নেবে না। তিনি বলেন, ওরা ইন্ডিয়াকে আক্রমণ করবে। এটা সত্য যে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান পরাজিত হবে, কিন্তু আমরা দেশ জুড়ে শিল্পানুকূল অবকাঠামো তৈরি করেছি। প্রাথমিক বিমান হামলায় ওরা এই খাতে আমাদের বহু বছরের সাধনা ধ্বংস করে দিতে পারে। যদিও আমরা মানবিক কারণে বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার মূল দায়বদ্ধতা ইন্ডিয়ার মানুষের প্রতি, এই ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। এ কারণে আমি দুটোই একসাথে করার চেষ্টা করছি এবং উপযুক্ত সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব।

আমি উনাকে বলতে ভুলি নাই যে সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব ছাড়া উনাকে দেওয়ার মত আমাদের আর কিছুই নেই।

বাংলাদেশ এবং ভারতের বন্ধুত্বের প্রসঙ্গে উনি বলেছিলেন, এটি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। উনি শুধু আশা করছিলেন যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা হোক।

এরপর আমি অস্ত্র পাঠানোর জন্য আমাদের অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে কথা উঠাই। আমি বলি যে, আমরা টাকা সংগ্রহ করলেও অস্র কিনতে পারছি না। ভারত যদি কিনে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারে তবে আমরা টাকাটা তাদের হাতে দিতে পারি। মিসেস গান্ধী তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা কত টাকা সংগ্রহ করেছি। আমি উত্তর দেই প্রায় চার লক্ষ পাউন্ড। তিনি বলেন যে, একটি মুক্তিযুদ্ধে যে পরিমান অস্রের দরকার সে পরিমান অস্র এই টাকায় কেনা সম্ভব না। এছাড়া অনির্ধারিতভাবে অস্র পৌঁছালে তা বিরোধী শক্তির হাতেও পড়তে পারে। মুজিবনগর সরকারের সাথে তিনি যোগাযোগ করছেন এবং তাদের মাধ্যমে অস্র বিতরন করছেন। বিচ্ছিন্নভাবে অস্ত্র পৌঁছালে আইনগত সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তিনি আমাকে বলেন যে, এই বৈদেশিক মুদ্রা পরবর্তীকালে একটি স্বাধীন দেশের জন্য খুবই প্রয়োজনে আসবে। আমি তাকে জানাই যে, বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর আমাকে বলেছে, একজন বিচারক হিসেবে নিশ্চয়ই অস্র পাঠাবার সাথে জড়িত হবো না এই তারা পাকিস্তান সরকারকে দিয়েছেন। এটি এক ধরনের চাপ। অতএব কোনকিছু করতে হলে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমেই করতে হবে। আমার এই কথা শুনে মিসেস গান্ধী উঠে পাশের কক্ষে যান এবং পাশের কক্ষ থেকে ভারতীয় হাইকমিশনারকে নিয়ে আসেন। তিনি হাইকমিশনারকে বলেন যে, বিচারপতি চৌধুরী যা পাঠাতে চান, অস্ত্রই হোক বা অন্য কিছু হোক, তিনি যেন তৎক্ষনাৎ ব্যবস্থা করেন। এরপর তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের শুভকামনা করে আমাদের সাক্ষাৎকারের ইতি টানেন।

কয়েকদিন পরেই মুজিবনগর সরকারের তরফ থেকে টেলিগ্রাম আসে যে, আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে আমাকে নিউইয়র্ক যেতে হবে। ষোলজন সদস্যের একটি দল নির্বাচিত হয়। এরা হলেন
(১) আব্দুস সামাদ আজাদ
(২) ফণিভূষন মজুমদার
(৩) এম, আর সিদ্দিকী
(৪) সৈয়দ আব্দুস সুলতান
(৫) ডঃ মফিজ চৌধুরী
(৬) প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ
(৭) ফকির শাহবুদ্দীন
(৮) এ্যাডভোকেট সিরাজুল হক
(৯) ডঃ এ, আর, মল্লিক
(১০) খুররম খান পন্নী
(১১) এস, এ, করিম
(১২) আব্দুল মুহিত
(১৩) রেহমান সোবহান
(১৪) মাহমুদ আলী
(১৫) আবুল ফাতহ।

আমরা বেলমন প্লাজা নামে একটি সাধারণ হোটেলে আমাদের অফিস স্থাপন করি এবং বিভিন্ন দেশের সদস্যদের সাথে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য প্রচার করতে থাকি। আমার বিশ্বাস প্রায় সবগুলো দেশের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। এছাড়া আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রচার কাজ চালাতে থাকি। আমি হারভার্ড, এম, আই, টি, ইয়েল, কলম্বিয়া, নিউইয়র্ক সিটি এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষকদের কাছে বক্তৃতা করি। শত শত শিক্ষক ও ছাত্রদের সমাবেশে বক্তৃতা করি। প্রতিটি শ্রোতা ছিলেন আমাদের পক্ষে। এসময় আমাকে সাহায্য করতেন কাজী রেজাউল হাসান। তিনি ইঞ্জিনিয়ার। তিনি অনেকগুলি ওয়াকিটকি পাঠান মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য। আমরা হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি হিসেবে বোষ্টনে ছিলাম। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান ইথিয়েল ডি সোলাপুল একটি ভোজসভার আয়োজন করেন যেখানে প্রায় ২৫ জন অধ্যাপক উপস্থিত ছিলেন। এই অধ্যাপকগণ ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী যেহেতু আমেরিকান ষ্টেইট ডিপার্টমেন্টের পরামর্শদাতা হিসেবে সকলেই কার্যরত ছিলেন। তারা নিজেরাও আগ্রহী ছিলেন যেহেতু সরাসরিভাবে বাংলাদেশের অবস্থা জানার এটি একটি সুযোগ ছিল। হারভার্ড ল-স্কুলে আমি একটি বক্তৃতা দেই। আমি বলি যে, বাংলাদেশ স্বাধীন, কেবলমাত্র স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে। এম, আই, টি অডিটোরিয়ামে আমি প্রায় দেড় ঘন্টা বক্তৃতা দেই এবং আমাদের পক্ষে তুমুল জনমতের লক্ষন দেখতে পাই। আমি বারবার বলি যে, আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। কিন্তু আমার জন্মভূমির উপর যা ঘটেছে তারপর আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। একটি আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন জাতি হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষনা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না। আমার পক্ষে একটি বড় সুবিধা ছিল যে, আমি যখন বাংলাদেশের পক্ষে আমার আনুগত্য প্রকাশ করি তখন আমি ছিলাম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অতএব তারা আমাকে সেইভাবে সম্মান দেখায়।

নিউইয়র্কে ফিরে এসে আবার লবিং-এ ব্যস্ত হই। এ সময় বাংলাদেশের সীমান্তে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে মিত্র বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতির জন্য প্রচার চালায়। আমরা বাধা দেই। আমরা বলি একটা নির্যাতিত জাতি যখন জয়লাভ করতে যাচ্ছে তখন বিরতি অসম্ভব। কিন্তু আজ যখন দেশ শত্রুমুক্ত হতে যাচ্ছে তখন যুদ্ধবিরতির প্রশ্ন উঠে কেনো? আমি নিউইয়র্কের জাতিসংঘের দফতরে রয়টার অফিসে বেশীরভাগ সময় থাকতাম। যেহেতু অবস্থা সম্পর্কিত শেষ খবর ওখানেই পাওয়া যেতো। এমন সময় ১৬ই ডিসেম্বর টেলেক্স দেখলাম, খবর এলো যে, নিয়াজী আত্মসমর্পন করেছে। ঢাকা মুক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন। এই খবর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। আমি ধীর চিত্তে, শান্ত মনে এই সংবাদ গ্রহন করলাম এবং পরম করুনাময় আল্লাহর হাজার শুকরিয়া আদায় করলাম।

-আবু সাঈদ চৌধুরী
ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৪।

Scroll to Top