গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত সাক্ষাৎকার

ঢাকা বিভাগ (পৃষ্ঠা ১২-৬৬)
রাজশাহী বিভাগ (পৃষ্ঠা ৬৭-১৮২)
খুলনা বিভাগ (পৃষ্ঠা ১৮৩-২৬৯)
চট্টগ্রাম বিভাগ (পৃষ্ঠা ২৭০-৩২৪)

হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের বিবরণ

।। খুলনা বিভাগ ।।

।। ১২১ ।।
নীলিমা রাণী দাস
সাউথ সেন্ট্রাল রোড, খুলনা

যুদ্ধ বাধলে আমরা সবাই খুলনাতেই আছি। সান্ধ্য আইন চলছে, ঘরের বের হবার উপায় নেই। ৩রা চৈত্র রাত ১০-৩০ টায় ৬ জন পাক সেনা আমাদের বাড়ী ঢোকে। আমরা তখন আকাশবণীর খবর শুনছি। পাকসেনারা ঢুকে আমার স্বামীকে ডাকে, তারপরে ঘরে ঢুকে আমার সকল গহনা খুলে দিতে বলে। আমি সকল গহনা খুলে দিই আর যা টাকা-পয়সা ছিল সব নিয়ে আমার স্বামীকে নিয়ে চলে যায়। রাত ১১-৩০ টায় গুলির আওয়াজ পেলাম। পরে শুনলাম আলতাফ গলির মোড়ে ৮ জনকে গুলি করে, ৬ জন মারা যায়, ২ জন বেঁচে যায়-একজন চিত্ত, অপরজন রবি। আমার স্বামী ঐ দিন মারা যায় পাকসেনাদের গুলিতে।
তারপর আমি আমার ৪ মাসের বাচ্চা নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে আমার গ্রামের বাড়ী যাই। ওখান থেকে কয়েকদিন হেঁটে বহু লাঞ্ছনা সয়ে ভারতে যেতে পারি। দেশ স্বাধীন হলে দেশে আসি, আমার কেউ দেখার নেই, বাড়ীঘর নেই।
সম্পূর্ণ অসহায় নিঃসহায়, শুধু ভাবছি এমনি যন্ত্রণা নিয়ে আর ক’দিন বাঁচবো।

স্বাক্ষর/-
নীলিমা রাণী দাস
৭/৭/৭৩
।। ১২২ ।।
কাজী আব্দুল খালেক
খুলনা সদর
খুলনা

২৮ শে মার্চ দুপুর তিনটার সময় আমি ভাত খেতে যাচ্ছিলাম তখন দেখতে পাই যে আমার বাড়ীর চারিদিকে খানসেনা ও বিহারী ঘিরে ফেলেছে এবং দরজায় দমাদম লাথি মারছে। তারা দরজা ভেঙ্গে ঘরের ভিতর প্রবেশ করে এবং একজন খান সেনা একটা অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেল আমার বুকের উপর চেপে ধরে এবং প্রথম প্রশ্ন আমাকে করে যে, ‘তোম বাঙ্গালী হ্যায়, না বিহারী হ্যায়” এর জবাবে আমি জানাই যে আমি পাকিস্তানি মোহাজির হ্যায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, “তোম আওয়ামী লীগমে হ্যায়। তোম আওয়ামী লীগমে ভোট দিয়া।“
৯৯% লোকনে আওয়ামী লীগমে ভোট দিয়া তো হামভী দিয়া, মাগার ম্যাই আওয়ামী লীগের ইলেকটেড মেম্বর নেহি হ্যায়’।

তখন তারা আমাকে বাড়ীর বাইরে নিয়ে আসে এবং একটা ট্রাকে তোলে। ঐ ট্রাকের ভিতর আরও ৭/৮ জন লোককে দেখতে পাই। তার মধ্যে খালিসপুর শহরের ডি,এস,পি ও ওয়াপদার একজন অফিসারকে দেখতে পাই। ডি,এস,পির সারা শরীরে রক্ত এবং কপালের উপর বড় একটা গর্তের মত দেখতে পাই আর ওয়াপদার অফিসারটির মুখের এক পাটির দাঁত ভাঙা দেখতে পাই। আমাদেরকে ট্রাকের উপর বসান হয় এবং দুই পাশে দুইটা মেশিনগানধারী শাস্ত্রী দাঁড়িয়ে থাকে। এই সময় একটা মিলিটারী এম,পি এসে আমাকে পুনরায় প্রশ্ন করে যে “তুম বাঙ্গালী হ্যা না বিহারী হ্যায়”।
আমি বলি যে “আমি পাকিস্তান কা মোহাজের হ্যায়”।
তখন এম,পি বলে, “তোমহারা আইডিন্টিটি কার্ড হ্যায়?”
তার উত্তরে আমি আমার অফিসের আইডিন্টিটি কার্ড তাকে দেখাই। তখন সে আমাকে ছেড়ে দেয় কিন্তু আর সবাইকে ধরে নিয়ে যায়। আমি ছাড়া পবার আরও একটা কারণ নিখুঁতভাবে উর্দু বলতে পারতাম।

৭ই জুলাই দৌলতপুর থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ আমাকে হাতে হাতকড়া দিয়ে খুলনাতে এস,ডি, ও কোর্টে নিয়ে যায়। কিন্তু আমি কোর্টে পৌছার আগেই কোর্ট বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমাকে খুলনা জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে এই সময় দুইদিন আমাকে কিছু খেতে দেয় নাই। আমি যখন জেল হাজতে গিয়ে পৌছালাম তখন সেখানে বহু আওয়ামী লীগের নেতা, প্রফেসর এবং পুলিশের অফিসারদের দেখতে পাই। তাদের প্রত্যেকের অবস্থাই খুব শোচনীয় দেখতে পাই। তাদের কারো গায়ে চুলকানী, পাচড়া হয়ে বোঝাই হয়ে গিয়েছে আবার কেউ বা ভীষণভাবে অসুস্থ। এই সময় আমি সেখানে একজন প্রফেসরকে দেখতে পাই তাকে নাকি যশোর থেকে ধরা হয়েছিল এবং যশোর ক্যান্টনমেন্টে তাকে ভীষণভাবে অত্যাচার করা হয় যার ফলে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে ভদ্রলোককে খান সেনারা মুক্তিবাহিনীর স্পাই হিসাবে ধরে। এই ভদ্রলোক এই সময় শুধু শুধু লেকচার দিয়ে চলেছেন।

আমাকে রাত্রিতে যে ঘরে থাকতে হত সে ঘরটা ছিল খুব ছোট। সে ঘরে ভালভাবে বড়জোর ৫০ জন থাকতে পারে। সেখানে ৪ শত জন কয়েদীকে রাত্রিতে থাকতে দিত। প্রত্যেককে ‘কাত’ হয়ে শুয়ে থাকতে হত। কোনরকম নড়াচড়া করার উপায় এই সময় থাকত না।

আমি জেল হাজতে থাকা অবস্থায় দেখতে পেতাম যে প্রত্যেক দিন রাত্রিতে খান সেনারা জেল হাজত থেকে অনেক কয়েদীকে জোর করে ধরে নিয়ে যেত। তাদের আর কোন খবর আমরা পেতাম না বা আর ফিরে আসতো না।

খান সেনারা প্রত্যেক দিন বা আশেপাশে থেকে যে সব লোককে ধরে আনতো তাদের প্রথমে খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে ভীষণভাবে টর্চারিং করত এবং যাদের মারা হত তাদেরকে জেল হাজতের মাঠে দিয়ে আসতো এবং নদীর পাড়ে ‘জবাই’ করা হত। তাদের কাকুতি, মিনতি বা কান্নাকাটি অনেক সময় আমরা শুনতে পেতাম। বাদ বাকীগুলিকে জেল হাজতে নিয়ে আসতো। তাদের কাছে আমরা জানাতে পরতাম খান সেনাদের অমানুষিক নির্যাতনের কতা। মানুষ হয়ে মানুষের উপর যে কত বড় নির্দয় হতে পারে তা আমার আগে জানা ছিল না। এই সময় আমাদের দিনে একবার খেতে দিত- ভাত ও ডাল, যা দেখলেই বমি হয়ে যেত, খাবার কথা তো দূরে থাক। তবুও জীবন ধারণের জন্য তাই খেতে হত।

আমরা যে চারশত লোক রাত্রিতে এক রুমে থাকতাম। পায়খানা প্রস্রাব ঐ রুমের ভিতরের এক কোনায় করতে হত, যার ফলে দুর্গন্ধে রুমের ভিতর থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়তো।

৯ ই জুলাই আমার আত্নীয়-স্বজনের ধরপাকড়ের ফলে এস,ডি, ও কোর্ট থেকে ৫০০ টাকা সিকিউরিটির বদলে জামিন মঞ্জুর করে। এই সময় কয়েকজন লোক জেল হাজতে আসে এবং আমাকে বলে যে তোমার জামিন হয়ে গিয়েছে। তারা আমাকে জেল হাজত থেকে বের করে চালনা লাইটড্রাস-এর অফিসে নিয়ে গিয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হয় যে আমি কতজন বিহারীকে হত্যা করেছি। আমাকে খালিসপুর “নেভাল বেস”-এর হাতে হ্যান্ডওভার করে। এই নেভাল বেস-এর কমান্ডিং অফিসার ছিল কর্নেল গুলজারী।

এখানে যাবার পর প্রথম আমাকে কর্নেল গুলজারী প্রশ্ন করে যে, তোম কালপ্রিট হ্যায়, আমি তখন বলি যে আমি এমন কোন কাজ করি নাই যার জন্য আমি কালপ্রিট হতে পারি।
তখন সে আমাকে প্রশ্ন করে যে তুমি কত বিহারীকে কেটেছো বা নির্যাতন করেছো।
তখন আমি বলি যে আমার জীবনে আমি কোনদিন কোন বিহারীকে মারি নাই বা তাদের উপর অত্যাচার করি নাই।
তখন সে আমাকে বলে যে ঠিক হ্যায়। তোম জঙ্গোল সাভ কর।
আমি তখন নেভাল বেস এর সম্মুখের সমস্ত জায়গায় জঙ্গল সাফ করতে থাকি। এই সময় কাচিঁতে আমার আঙ্গুল কেটে দুইভাগ হয়ে যায়। তিন দিন আমাকে এইভাবে কাজ করতে হয়। প্রত্যেক দিন সকাল ৬ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত, তারপর ১ টা রুটি খেতে দিত এবং ২ টা থেকে আবার ৬ টা পর্যন্ত ঘাস কাটতে হত। কারণ তারা নেভাল বেস এ আশেপাশে সমস্ত জায়গা পরিস্কার করছে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে।

২য় দিন আমি যখন ঘাস কাটছিলাম তখন একটা শিয়াল ঘাসের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল যার ফলে ঘাস নড়ছিল। তখন সমস্ত খান সেনারা পজিশনে চলে যায় এবং বলে যে মুক্তিবাহিনী আগিয়া।

৩য় দিনে আমি যখন ঘাস কাটছিলাম তখন সেখান দিয়ে ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন যাচ্ছিল। সে আমাকে দেখে সিপাইদেরকে বলে আমাকে তার চেম্বারে পৌছে দিতে। তার চেম্বারে গেলে সে আমাকে প্রথমেই রোলার দিয়ে একটা বাম কাঁধে আঘাত করে এবং বলে যে তোম শালা বহুত বাহিরীকো খতম কর দিয়া আওর বহুত বিহারীকো আওয়াতকে ইজ্জত লিয়া। এই সময় আমাকে সে কোন কথা বলার সুযোগ দেয় না। সে আমাকে রোলার দিতে আঘাতে পর আঘাত করতে থাকে। এই সময় সে তার সহযোগীকে বলে আমাকে পায়ে শিকল বেঁধে টাঙ্গিয়ে দিতে। আমাকে নিয়ে পায়ে শিখল বেধেঁ উল্টো দিকে বুলিয়ে দেয়। এই সময় ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিন পুনরায় এসে আমাকে বলে “শালা তোমকো খতম করে দেগা”-এই বলে সে আমাকে মোটা রোলার দিয়ে আঘাতের পর আঘাত ও অশ্রাব্য গালিাগালি দিতে থাকে। কিছুক্ষণ মারার পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তারপর তারা আমাকে আর মেরেছে কিনা আমি জানি না। আমার যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন আমি দেখতে পাই যে আমি একটা কম্বলের উপর শুয়ে আছি, আমার সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা। এই সময় কর্নেল গুলজারী সেখানে আসে এবং আমার এই অবস্থা দেখে সে ভীষণবাবে রেগে যায় ক্যাপ্টেন সাহাবের উপর। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে এবং পরে জানতে পারি যে ২ দিন পর কর্নেল গুলজারী ক্যাপ্টেন সাহাব উদ্দিনকে চিটাগাং নেভাল বেস-এ বদলী করে দেয়।

খালিশপুর নেভাল বেসে একজন পাঞ্জাবী ইমাম ছিল। সে বাঙ্গালীর প্রতি ভাল ব্যবহার করতো, সে আমাকে খাবার দিত, আমার প্রতি ভাল ব্যবহার করতো। এবং আমি যখন সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে আসি তখন সে আমার হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নেয়।

৯ দিন পর কর্নেল গুলজারী আমাকে রিলিজ করে দেয়। এই সময় কর্নেল গুলজারী আমাকে বলে দেয় যে তুমি কোন সময়ই বিহারীদের সম্মুখে যাবে না। এবং বিহারীরা যেন তোমাকে কোন জায়গায় না দেখতে পায়। তুমি সব সময় বিহারীদেরকে এড়িয়ে চলবে।

১৯ শে জুলাই আমি নেভাল বেস থেকে মুক্ত হই। এই সময় আমার অবস্থা এত খারাপ ছিল যে আমি চলতে ফিরতে পারতাম না। আমি একটা রিক্সা করে বোনের বাসায় চলে যাই। সেখানে আমার ফ্যামিলির সাক্ষাৎ পাই। দেখতে পাই যে আমার পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। কারণ কোনদিন না খেয়েও তারা কাটিয়েছে। আমার দুই ছেলে তখন রাস্তায় ফেরি করে যা রোজগার করেছে তা-ই দিয়ে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে আমাদের দিন চলেছে।

স্বাক্ষর/-
কাজী আব্দুল খালেক
১১/৭/৭৩
।। ১২৩ ।।
কবির আহমদ
বি, ডি, আর
খুলনা

২৭ শে মার্চ অবস্থার অবনতি আরও ঘটে। পাকসেনারা ব্যাপকভাবে সারা শহর ঘুরতে থাকে, আমাদের সঙ্গে ব্যবহারও তেমন ভাল ছিল না। আমি গোপনে ওখানে মরিচা খনন করি এবং পরবর্তী অবস্থার জন্য প্রস্তুত হই।

২৮ শে মার্চ আমাকে টেলিফোনে শাখা হেড কোয়ার্টারে ডেকে আনা হয় অন্য জায়গায় পাঠানো হবে বলে অফিসে চলে আসি। এসে দেখি আধ হাত পরপর পাকসেনা সমগ্র শাখা ঘিরে রয়েছে ভারী ভারী অস্ত্র নিয়ে আমি বুঝতে পারলাম। আমার হাতিয়ার (সামান্য রাইফেল) জমা নিয়ে নেওয়া হলো। পর পর ক্রমশঃ আমাদের ১৩৭ জনকে নিয়ে আসে এবং অস্ত্র জমা নিয়ে নেয়। আমাদের পোষাক খুলে নি এবং বেসামরিক পোষাক পরতে বলে ভিতরে থাকতে বলে। নামাজ পড়ারও সময় নির্দিষ্ট করে দিল।

৫ ই এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের সবাইকে এখানে আটকে রাখে। বি, ও, পি, গুলির কি হলো কিছুই জানতে পারলাম না, দুনিয়ার কোন খবর প্রায় পেতাম না। বেশ বুঝলাম যুদ্ধ চলছে পাঞ্জাবীদের সাথে। আমারা বন্দী, মৃত্যু আসন্ন। সবাইকে ঢুকিয়ে দিল। ১১ নং সেলে আমাদের বন্দী করে রাখলো, পাকসেনারা পাহারায় থাকলে।

৭ ই এপ্রিল থেকে ৫/৬ জন করে বের করে আর্মিরা চাকিদিকে ঘিরে অমানুষিকভাবে প্রহার করতে থাকে। জেলখানার সিপাই লাঠি জোগাড় করে দিত। পাক সেনারা যথেষ্টভাবে মারধর চালিয়েছে।

আগষ্ট মাসের শেষের দিকে খুলনা ই,পি,আর এর উইং কমান্ডার গিয়ে আমি সহ সাতজনকে চার্জশীট দিয়ে বাকী সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। ঐ মাসেই আমাদের সাতজনকে বাদ দিয়ে সবাইকে শপথ করিয়ে নানা উপদেশ দিয়ে বাইরে বের করে নিয়ে যায়। আমরা
(১) নায়েব সুবেদার আব্দুল মান্নান,
(২) সৈয়দ আহমদ,
(৩) কবীর আহমদ হাবিলদার,
(৪) ল্যান্স নায়েক জয়নাল আবেদীন
(৫) নায়েক ক্লার্ক শামছুদ্দীন
(৬) সিপাই আব্দুল লতিফ আরমার,
(৭) সিপাই আবুল হাশেম অন্য সেলে বন্দী থাকি।

জেল পুলিশ মতিউর রহমানের মারফত বাইরের খবরাখবর সব আমরা পেতাম, বিদেশী এবং মুক্তিবাহিনীর সব খবর দিত। ডাঃ আবুল মজিদ আমাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করেন এবং সব খবরাখবর দিতে। ওষুধ দেবার নাম করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে খবরাখবর দিতেন।

রোদের ভিতর উপুড় করে খালি গায়ে শুইয়ে ফেলে বুট দিয়ে লাথিয়েছে, রাইফেলের বাট দিয়ে যেখানে সেখানে পিটিয়েছে, মারতে মারতে ড্রেনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে উপুড় করে ফেলে লাঠি পিঠের উপর ভেঙেছে। সমস্ত শরীর রক্তে ভরা, অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত মারতো এবং যথেচ্ছভাবে গালাগালি করতো। বলত ‘বল কত বিহারী মেরেছিস’।

সেপ্টেম্বর থেকে আমর বিরুদ্ধে চার্জ দিয়ে ইন্টারোগেশন শুরু করে। আমার বিরুদ্ধে চার্জ
(১) আমি আক্রমণ করতে গেছি অবাঙ্গালীদের
(২) সীমান্তে সিপাই পাঠিয়েছি সবাইকে আসার জন্য
(৩) অস্ত্র সরবরাহ চেষ্টা এবং অস্ত্র ধ্বংস করা
(৪) সিপাইদের উস্কানী দিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছি।
এক একটি প্রশ্ন করে আর মারতে থাকে। খুব মারধর সহ্য করতে না পেরে সব স্বীকার করে তাদের তৈরী রিপোর্ট দস্তখত করি। চার্জশীটে আমি এ্যাক্ট অনুযায়ী আমার মৃত্যু লেখা ছিল।

আমি মৃত্যুর প্রহর শুনতে থাকি আর বাইরের সব খবরাখবর আমি পেতে থাকলাম। আমি বুঝলাম আমি মরবো তবে দেশ একদিন স্বাধীন হবেই হবে।

নিয়মিত নামাজ রোজা শুরু করি বাংলাদেশের মা-বোনের ইজ্জত বাঁচাবার জন্য, সেই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বিজয় কামনা করে দোয়া করতাম খোদার কাছে।

১৭ ই ডিসেম্বর শুক্রবার বেলা দেড়টায় খুলনা মুক্ত হলে আমরা জেল গেট ভেঙ্গে মুক্তির নিশ্বাস নেই এবং বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ি।

স্বাক্ষর/-
কবির আহমদ
১৯/৬/৭৩
।। ১২৪ ।।
বদিউজ্জামান
হাজী মেহের আলী রোড
খুলনা

আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়ী চলে যাই যশোর দখল হবার পর। টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় কিছু না থাকায় ওখান থেকে ২৭শে এপ্রিল আমি শহরে আসি আমার বাসাতে কাপড় চোপড় নেবার জন্য।

২৮শে এপ্রিল খুব ভোরে থেকে আমাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। লেঃ কঃ তোফায়েলের কাছে হাজির করে। জিজ্ঞাসাবাদ করে এক মেজর আমাকে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে যায়। আমাকে এফ, আই, ইউ-র মেজর খোরশেদ ওমরের কাছে দেয়।

একজন সিপাইকে বানাতে বলে। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শুইয়ে ফেলে লাঠি দিয়ে গরু পিটানো শুরু করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে পা ধরে বারান্দায় টেনে এনে একজন সুবেদার কিল-চড়-ঘুষি যথেচ্ছা মারা শুরু করলো। আমি চিৎকার করতে থাকি। তারপর যেই আসুক না কেন লাথি কিল মারতে থাকে।

বিকালে আমাকে টানতে টানতে একটি ধরে রেখে আসলো। এরপর থেকে প্রত্যেহ সকাল বিকাল বের করতো এবং ভীষণভাবে মারতো। আমাকে জিজ্ঞাসা করতো এস,পি,ডি, কি করেছেন, তুমি কি করেছ? না বললেই মারতো। সমস্ত শরীর দিয়ে রক্ত না ঝরা পর্যন্ত, জ্ঞান হারা না হওয়া পর্যন্ত মারধর করতো।

আমি যেহেতু ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার, সেহেতু সব খবর জানি এই কথাই ধরে নিয়েছিল, তাই অত্যাচারের মাত্রা খুব বেশী ছিল। আমি পতাকা তুলে দিয়েছি সব খবর মুক্তিসেনাদের দিয়েছি ইত্যাদি। আমাকে ঐ ক্যাম্পে তিন মাস তিনদিন আটকে রাখে এবং প্রত্যেহ মারধর করতে থাকে।

আমাদের ছোট্ট একটি ধরে অফিসার, দারোগা, অধ্যাপক, মাষ্টার, পুলিশ, কৃষক, শ্রমিক সবাইকে একত্র রাখতো। সারাদিন কোন খাবার দিত না, সন্ধার আগে অল্প কিছু খাবার দিত। খুব ভোরে পায়খানা প্রস্রাব করাতে বসাতো, দেরী হলে মারধর করতো। সারাদিন রাতে একবার পায়খানা প্রস্রাব করাতো। সকালে আমাদের বের করিয়ে পায়খানা ধোয়াতো, ড্রেন পরিস্কার, জঙ্গল পরিস্কার মাল বওয়ানো অভুক্ত অবস্থায় করিয়ে নিতো। প্রস্রাব অনেকে ভিতরেই করে ফেলতো। মারের চোটে সারা শরীর ঘা হয়ে গিয়েছিল, মাছি বসে পুঁজ জমে সারা ঘরে একটি নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। মাঝে মাঝে এক লোক আসতো। আমরা ভালো করে বসতেও পারতাম না। সন্ধ্যার আগ দিয়ে সামান্য খাইয়ে ঘরে পুরে রাখতো। তিন মাস তিনদিন আমাকে গোছল করতে দেয়নি।

২রা মে ২৯ জনকে হাত, চোখ বেঁধে নিয়ে যায় সন্ধ্যাবেলা, বাকী থাকি আমি, একজন ড্রাইভার ও একজন সি, ও। পরে শুনলাম ওদের ট্রেন্স খুড়িয়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। ওর মধ্যে অধ্যাপকও ছিলেন।

তারপর থেকে প্রত্যহ রাত বারোটার পর ১০/১২ জন করে নিয়ে যেত আর ফিরতো না। প্রত্যেহ নতুন লোক এসে আবার ঘর ভরে যেতো।

জুলাই মাসের শেষের দিক হতে শুনলাম যাদেরকে গাড়ীতে করে নিয়ে যায় রাতে বহু দূরে নিয়ে গিয়ে বোয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করতো।

অপারেশন স্পটে যাদেরকে ধরে আনতো তাদেরকে হাত-পা পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলতো। তারপর শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে দিত এবং গুলি করে হত্যা করতো।

আগষ্ট মাসের ২/৩ তারিখে আমাদের ১০/১২ জনকে সেনানিবাসের মডেল প্রাইমারীর এক ধরে নিয়ে যায়। এখানে নিয়ে আসার পর শুনলাম এর আগে যাদেরকে হত্যা করেছে তাদের কোন তালিকা বা হিসাব নেই। অসংখ্য মানুষকে তারা হত্যা করেছে ঐ সময়। এপ্রিলে যাদেরকে ধরেছিল একমাত্র আমিই বেঁচে ছিলাম।

এখানে আসার পর খাওয়া দাওয়া একটু ভালো হলো। মারধর কম করতে থাকে।

আগষ্ট মাসের ১২/১৩ তারিখ ইনটারোগেশনের জন্য নিয়ে যেত এবং নানা কথা-যেমন বিহারী হত্যা করেছি, পাকসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, অস্ত্র যুগিয়েছি ইত্যাদির কথা লিখিয়ে আমাদের দিয়ে সই করিয়ে নেয়। চিৎ করে শুইয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতো, একটু হেললে লাঠি দিয়ে পিটাতো। তিন দিন ঐ ভাবে অত্যাচার চালায় অমানুষিক।

সেপ্টেম্বরের শেষ অথবা অক্টোবর মাসের প্রথমে আমার বিরুদ্ধে সামরিক কেসের চার্জ নিয়ে একটি কপি দেয় এবং তার পরপরই জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে আরও অতিরিক্ত কেস আমার বিরুদ্ধে আসে। আমার সাথে ডেপুটি ম্যাটিষ্ট্রেট সানাউল হক, ইন্সপেক্টর আক্তার চৌধুরী, নূর মোহাম্মদ, ডাঃ আনিসুজ্জামান এম, বি, বি, এস, আনিসুর রহমান ইত্যাদি লোকদের বিরুদ্ধে মামলা ওঠে।

অক্টোবর মাস থেকেই ম্যাজিষ্ট্রেট সানাউল হক সাহেবের কেস ওঠে। দুটো হিয়ারিং হবার পর কেস বন্ধ হয়ে যায়।

২৮ শে নভেম্বর চিঠি পেলাম আমি চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছি। মুক্তি পাই ২৮শে নভেম্বর।

আমি মুক্তি পেয়ে বাসাতে আসি। আমার দেশের বাড়ী সব পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। আমার পরিবার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেরিয়েছে।

আমি শুনতাম দৈনিক বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়েদের ধরে আনতো এবং সেনানিবাসের ২/৩টি স্থানে রেখে বিভিন্ন সময় ইচ্ছানুসারে তাদেরকে ভোগ করতো।

স্বাক্ষর/-
বি, জামান
১৪/৭/৭৩
।। ১২৫ ।।
শ্রী শক্তিপদ সেন
গ্রাম- কাজদিয়া,
ডাকঘর- আলাইপুর
থানা ও জেলা- খুলনা

১৯৭১ সালের ১৯ শে এপ্রিল রোজ বুধবার বেলা ১১ টার সময় খুলনা ট্রেজারীতে চাকরী কর্মরত অবস্থায় একজন পাক মিলিটারী আমাদের অফিসে আসে এবং আমাকে ডাকে। আমি তার নিকট উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে আমার পিছে রাইফেল ধরে সঙ্গে করে তাদের ক্যাম্প সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাকে বেশ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। যেমনঃ-
(ক) কাকে ভোট দিয়েছ?
(খ) কতজন বিহারী মেরেছ?
(গ) এম এম দাস কোথায়?

আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর আমার দুহাত পিছনে দিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর প্রশ্নবাদ করতে থাকে আর কাঠের রোলার, লোহার রড দিয়ে শরীরের সমস্ত জয়েন্টে প্রহার করতে থাকে। প্রহার করার মাঝে বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারতে থাকে। উক্ত প্রকারে প্রহার করার পর সিগারেটে আগুন ধরিয়ে আমার সমস্ত শরীর চেপে ধরে পুড়িয়ে দিতে থাকে। একটু এদিক ওদিক ব্যাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলে আবার মার শুরু করে দিত। এইভাবে সন্ধ্যা ৮-৩০ পর্যন্ত অত্যাচার করার পর তিন জন মিলিটারী আমাকে হাত খুলে দিয়ে বলে, চল শালা তোকে বাড়ী পৌছে দিয়ে আসি। এই বলে আমাকে সামনে রেখে একজন পিছে আর দুজন দুইপাশে রাইফেল ধরে ১ নং ফরেষ্ট গেটে নিয়ে যায়। তারপর সেখানে নিয়ে দুহাত পিছে দিয়ে পিঠ মোড়া করে বেঁধে ফেলে। আর দুপা একসঙ্গে করে বেঁধে ভৈরব নদীতে পিছন হতে লাথি মেরে ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়ার পর আমি ভাসতে ভাসতে প্রায় ২০০/৩০০ গজ যাবার পর আমার পায়ের রশিটা খুলে যায়। তারপর আমি পায়ের তলায় মাটি পাই। সেখানে আশ্রয় নিয়ে হাতের রশিটি খুলে ফেলি এবং সেখানে আত্নরক্ষার জন্য পানির নিয়ে সমস্ত শরীর ডুবিয়ে রেখে কোনরকম নাক বাঁচিয়ে প্রায় ৩/৪ ঘন্টা সেখানে কাটাই। তারপর নদী হতে উঠে পালিয়ে খুলনা টাউন মসজিদে ইমাম সাহেবের সাথে মসজিদ প্রাঙ্গণে আমার দেখা হয়। মসজিদের ইমাম সাহেব আমাকে বাড়ী পর্যন্ত পৌছে দেওয়ার ব্যপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। তারপর এর মধ্যে দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে আমার নিজ বাড়ী গিয়ে আশ্রয় নেই এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্ব পর্যন্ত আমি বাড়ীতে থেকে যাই।

স্বাক্ষর/-
শক্তিপদ সেন
১৯/৭/৭৩

।। ১২৬।।
রেবা রাণী নাথ
ডাক ও থানা- ডুমুরিয়া
জেলা- খুলনা

জুন মাসের শেষের দিকে আমরা পাথরঘাটা হয়ে ভারতে যাচ্ছিলাম। দলে ছিলাম প্রায় ৮/১০ হাজার লোক, সবাই আমরা ভারতে যাব।

রাত থেকে সকালে ৮/৯ টার দিকে আমরা যা হোক কিছু রান্নাবান্না করছি এমন সময় ৩/৪ গাড়িী মিলিটারি আসে। সঙ্গে সঙ্গে সেনারা গুলি চালিয়ে বহু লোককে হত্যা করে এবং বহু লোককে ধরে গাড়ীতে তোলে। প্রত্যেক গাড়ীতে ১৫/২০ জন করে মেয়েদের তুলে নেয়। ওখানেই অনেকের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। পাক ঘাঁটি ঝাউডাঙ্গাতে আমাদের নিয়ে যায়। ছেলেগুলিকে এক যায়গা করে গুলি করে সবাইকে হত্যা করে শুধু আমাদেরকে নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে ৫০/৬০ জন মেয়েকে দেখলাম বিভিন্ন যায়গার, ঝাউডাঙ্গারও অনেক মেয়ে দেখলাম। অনেক কলেজ পড়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়া মেয়েকে দেখলাম।

পাকসেনারা আমাদেরকে ৪/৫ দিন রাখে। ওখানে ৩/৪ টি তাবু ছিল। একটি একটি সিটের কাছে ২/৩টি মেয়ে নিয়ে এসে রাখতো। পাক সেনারা জোর করে ধরলে দুটি মেয়ে কিছুতেই তাদের শিকার হতে চায় না। তখন পাকসেনারা ভীষণভাবে দৈহিক পীড়ন করে গুলি করে হত্যা করে। পাকসেনারা একদল সবসময় ঘরে থাকতো, অপর দল আসা পর্যন্ত আমাদের উপর অত্যাচার চালাতো।

আমি যে তাঁবুতে ছিলাম সেখানে ১৫/১৬টি মেয়ে ছিল। সীট ছিল ৮/১০টি। পাকসেনারা যখন তখন আমাদের উপর দৈহিক পীড়ন চালাতো। প্রয় সবসময় বিভিন্ন স্থান থেকে পাক সেনারা আসতো আর আমাদের আমাদের উপর অত্যাচার চালাতো। পাক সেনারা বলতো বাংলাদেশ হবে না, তোমাদের আমাদের সঙ্গেই থাকতে হবে, জোর করলে গুলি। আমাদের উপর একই সময় ৫/৭ টি করে পাক সেনা অত্যাচার চালাতো। বিভিন্ন ভাবে তারা তাদের যৌন ক্ষুধা নিবৃত্ত করতো। আমাদের ৪ দিনের মধ্যে ১ দিন ভাত দিয়েছিলো। একজনের সাথে অপরজনের কথা বলতে দিত না। আমরা ওখানে হিন্দু মেয়ে বেশী ছিলাম কিন্তু সবাই আমরা মুসলমান বলে পরিচয় দিই। আমাদের গায়ে ব্লাউজ রাখতে দিত না। সবাইকে কেবল শাড়ী পরিয়ে রাখতো।

আমরা থাকতে আরও প্রচুর মেয়েকে ধরে আনে। পাকসেনারা তখন আমাদের রাজাকারদের হাতে তুলে দেয়। প্রত্যেক রাজাকার এক একজনকে নিয়ে যায়। আমাকে এক রাজাকার তার বাড়ীতে নিয়ে যায়।

৩/৪ দিন রাজাকারটি আমার উপর অত্যাচার চালায়। রাজাকারটির বৌ ও মা নিষেধ করলে গুলি করতে যেতো। এরপর ওখান থেকে রাজাকারের মা এবং বৌয়ের সহায়তায় পালিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখানে গোল পুকুর ক্যাম্পে থাকতাম। দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরে আসতাম। আমি তখন ৭/৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম।

আমি নারী পুর্নবাসন কেন্দ্রে আবেদন করি সমাজকল্যাণ দপ্তরের মাধ্যমে। ওরাই আমার চিকিৎসা এবং কাজের ব্যবস্থা করেন।

স্বাক্ষর/-
রেবা রাণী নাথ
২৫/৭/৭৩

।। ১৬৩ ।।
আখতার হোসেন চৌধুরী
ডি,এস,পি,শিল্প এলাকা
খালিশপুর
জেলা- খুলনা

ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার জন্য আমি সবরকম তদবীর শুরু করি এবং তদবীর করতে গিয়েই আমি ২১ শে মে সকাল ৯ টায় মেজর বাবরের কবলে পড়ে যাই। আর সঙ্গে সঙ্গেই পাকসেনার পাহারাধীনে আমাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়।

যশোর ক্যান্টনমেন্টে এফ-আই-ইউ (ফিল্ড ইনটেলিজেন্স ইউনিট)- এর একাটি ঘরে আমাকে আটক রাখা হয়। সেই ঘরে আমি ছাড়া আরও ৫০/৬০ জন বন্দী। এই এফ-আই-ইউ একটা বিভীষিকাময় স্থান। সবাই ঘরের মেঝেতে জুতার বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়ে থাকতাম। ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র একবার সন্ধ্যায় আমাদের খেতে দিতো। পচা ভাত,ডাল, প্রায় অখাদ্য। ওরই মধ্যে আমার মন বিদ্রোহ ঘোষণা করছিল। ১২ দিন শুধু পানি খেয়েছিলাম। সারাদিন সেখান থেকে যাকে ইচ্ছা বের করে নিয়ে যেয়ে আর এক ঘরে এফ,আই,ইউ এর অফিসাররা ইন্টারোগেশন করতো এবং অমানুষিক অত্যাচার চালোতো। সন্ধ্যা আটটায় একজন জমাদার বা সুবেদার এসে একটা লিষ্ট থেকে নাম ডাকতো। এই লিষ্ট-এ ৩০ থেকে ৩৫ জনের নাম থাকতো। যাদের না ডাকতো তারা লাইন ধরে দাঁড়াতো, তারপর তাদের জামাকাপড় ছিড়ে চোখ আর পেছর দিকে হাত বেঁধে গাড়ী করে দিয়ে মেরে ফেলতো। প্রত্যেকদিন নতুন নতুন লোকদের আনা হতো। অমনি করে মেরে ফেলা হতো। একদিনের কথা আমি কোনদিন ভুলবো না। এটা ছেলে। মুক্তিবাহিনীর একজন। তাকে যখন মিলিটারী অফিসার ইংলিশে ষ্টেটমেন্ট লিখতে বলেছিল তখন সে বলেছিল-“আমি বাঙালি। বাংলায় অনার্স পড়ি। বাংলাকে শত্রমুক্ত করতেই আজ আমার এই অবস্থা। কাজেই কিছুতেই আমি ইংলিশে লিখবো না।“

তাকে যেভাবে মারা হয়েছিল সে কথা আমি লিখতে পারবো না। তারপর এফ,আই,ইউ থেকে এফ,আই,টি (ফিল্ড ইন্টারোগেশন টিম) এর আগুারে এম পি, ইউনিট-এ আমাকে আটক রাখা হয়। এই এফ,আই,টি ইউনিটে আমাকে নিজ হাতে লিখে দিতে হয় যে আমি খালিশপুর পিপলস জুটমিল ও ক্রিসেন্ট জুটমিলের ৭,০০০ হাজার বিহারী হত্যা করেছি। প্রথমে ২ দিন লিখতে চাইনি। তখন আমাকে পা উঁচু আর মাথা নিচু করে ঝুলিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর হয়। মাত্র তিন মিনিট সময় দিয়েছিল। পাশের যেখানে লেখা আছে ‘প্যানিক চেম্বার’ সেখানে ঝুলিয়ে রাখবার ব্যবস্থা আছে। হঠাৎ ঐ ঘরের দিকে নজর পড়তেই দেখি আরও তিনজন সেখানে ঝুছে। তাদের নাক মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। সেই সময় এক অফিসার এসে বললো “দেখো ই-লোককো হলত দেখো। মাগর তুম নেই মানগে তুমহারা হালত এ্যাইসা হোগা” সেই মুহুর্তে আমি ঠিক করলাম ওরা যা বলেছে তাই লিখে দেবো। এখনও মনে আছে আমি ‘বিছমিল্লাহ’ বলে মিথ্যা লিখে দিলাম। একজন বিহারী ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে আমাকে স্বীকার করিয়া নেওয়া হয়। মার্শাল ল কোর্টে আমার বিরুদ্ধে একট কেস দায়ের করা হয়। তখনই আমি বুঝতে পারি কেন আমাকে জীবিত রেখে ছিল। আমার ষ্টেটমেন্ট পড়ে একজন মিলিটারী অফিসার আমাকে ব্যঙ্গ করে বলে- “তুম বহুত আচ্ছা ষ্টেটমেন্ট দিয়া তোমকো জলদি ছোড় দেগা।“ আমি সাত হাজার বিহারী মারা স্বীকার করেছি তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই উক্তি, আমার এই ষ্টেটমেন্ট ডিভিশন হেড কোয়র্টারে পাঠানো হয় এবং সেখান থেকে একজন লেঃ কর্নেল আমাকে দেখতে আসি ও নানা ধরনের প্রশ্ন করে।

পরে তারই অর্ডার অনুসারে আমাকে ১ লা সেপ্টেম্বর পিপলস জুটমিলে নিয়ে এসে প্রায় আড়াই হাজার বিহারী মিল-শ্রমিকদের সামনে তাদের উৎসাহ দেবার জন্য দাঁড় করানো হয়। মেজর খরশীদ (এফ,আই,ইউ) মেজর সরহাদ (এফ,আই,টি), মেজর আখতার হোসেন (ডিভিশন হেডকোয়ার্টার যশোর ক্যান্টমেন্ট) তখন আমার পাশে। বিহারীরা আমাকে দেখে বিচার তাদের হাতে দেবার জন্য চীৎকার করতে থাকে, হঠাৎ তাদের মধ্যে থেকে এক বুড়ো বিহারী ড্রাইভার ভীড় ঠেলে মিলিটারী অফিসারদের সামনে এসে বলতে থাকে যে, সে প্রথমে আমাকে চিনতে পারেনি। কারণ আমার মাথা ন্যাড়া ছিল এবং মুখে দাঁড়ি ছিল। তবে যাবার সময় বলেছিল, “এক যদি তোমরা মারো তবে আল্লা বরদাস্ত করবে না।“ তাই বোধহয় আমাকে আবার ক্যান্টমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

কেস শুরু হোল। কোর্ট বসে যশোর শহরে। আমাদের নিয়ে যেতে সুবিধার জন্য সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আমাকে যশোর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী করে রাখে। এই জেলখানায় এস আবার পি,আই,টি (পুলিশ ইনভেষ্টিগেশন টিম)-এর নির্মম কবলে পড়তে হয়। জেলখানা থেকে লোকদের নিয়ে যেয়ে ক্যান্টনমেন্টে তাদের ক্যাম্পে ভীষণ অত্যাচার করে নানা ধরনের তথ্য বের করতে চেষ্ট করে। এমনিভাবে জেলখানায় দিন কাটতে থাকে। বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের কোন যোগযোগ ছিল না, তবে নতুন যারা আসতো তাদের মুখে কিছু কিছু শুনতে পেতাম। প্রায় সাত মাস বন্দী অবস্থায় ছিলাম, তাই প্রত্যক্ষভাবে আমি দেশের কাজ করতে পারিনি। কিন্তু মনে প্রাণে কামনা করেছি বাংলার স্বাধীনতা, আমি বিশ্বাস করতাম যে এত অত্যাচারের পতন হবেই। হয়তো আমি দেখতে পাবো না কিন্তু বাংলার স্বাধীনার নতুন সূর্য একদিন উঠবেই। তাই যখন ৬ ই ডিসেম্বর ক্যান্টনমেন্ট ফল করে এবং ৭ ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী আমাদের জেল গেট খুলে দিলে আমরা বেরিয়ে পড়ি। জেল থেকে বেরিয়ে মাটিতে প্রথম পদক্ষেপের আগেই আমার চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরেছিল।

স্বাক্ষর/-
আখতার হোসেন চৌধুরী
১১/৭/৭৩
।। ১৬৪ ।।
তাহমীনা বেগম (দিপালী)
গ্রাম-বৈতপুর
ডাকঘর ও থানা- বাগেরহাট
জেলা-খুলনা

২৪ শে এপ্রিল পাকসেনারা কাড়পাড়া হয়ে বাগেরহাট আসে। এসেই কাড়াপাড় এলাকাতেই ১০০ উপরে লোকে হত্যা করে। নাগের বাজার তেলপট্টি ইত্যাদি এলাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া শুরু করে এবং বলে দেয় লুট করার জন্য, মুসলমানের অধিকাংশ ঘরবাড়ী সব লুট করা শুরু করে।

মে মাসে এখানে শান্তি কমিটি সেই সঙ্গে রাজাকার বাহিনী গঠন হয় পরবর্তীকালে রজব আলী ফকির শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়। সমগ্র বাগেরহাট এলাকাতে পাকসেনার চাইতে রাজাকাররাই অত্যাচার চালিয়েছে বেশী।

শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে বাগেরহাট শহর এলাকাতে যত হিন্দু ছিল কিছু হত্যা বাদে সবাইকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে। এরপর গ্রামের দিতে হাত বাড়ায়। গ্রামকে গ্রাম ধরে সবাইকে মুসলমান করতে থাকে।

আমি আমার স্বামী, ছেলেমেয়ে, বাবা, মা, কাকা, কাকীমা তাদের ছেলেমেয়ে সবাই ইসলাম ধর্মে দিক্ষা নিই। কিন্তু রাজাকাররা এর পরেও অত্যাচার করতে ছাড়েনি। এরপরও অসংখ্যা লোককে হত্য করেছে।

২২শে আশ্বিন রাত তিনটার দিকে ৫০/৬০ জন রাজাকার আমাদের বাড়ী ঘিরে ফেলে। প্রথমে তারা মুক্তিবাহিনী বলে পরিচয় দিয়ে থাকতে চায় রাতের মত। অনেক অনুনয়-বিনয় করে। প্রথমে আমার ভাই প্রদীপ গুহ দেখেই চিনেছিল তারা রাজাকার। তাই সে ছাদ দিয়ে গাছ বেয়ে পিছনে নামবার চেষ্টা করেছে। উপর থেকে নিচে নামলেই রাজাকাররা ধরে ফেলে। ওকে কিছু দুর নিয়ে গিয়ে বেয়োনেট দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। তারপর বাবা কাকা এবং পাশের বাড়ীর তিনজনকে কিছু দুর নিয়ে গিয়ে সিরাজ মাষ্টার এবং তার দল গুলি করে মাথা সব উড়িয়ে দেয়। সকালবেলা আমরা সেসব লাশ উদ্ধার করি। হত্যা করে বাড়ীঘর লুট করে সব নিয়ে চলে যায়। আমরা যারা বেঁচে ছিলাম বাগেরহাট শহরে চলে আসি। বাড়ীতে কেবল একজন কৃষাণ এবং আমার ৭০ বছরের বৃদ্ধা দিদিমাকে রেখে আসি।

কার্ত্তিক মাসের ১২/১৩ তারিখ হবে। রাজাকাররা আবার যায় আমাদের গ্রামে। দড়াটানা নদীর ওপার থেকে মুক্তিবাহিনী গোলাগুলি করতো। তাই রজব আলী অর্ডার দেয় সমস্ত এলাকা ঘরবাড়ী ভেঙ্গে ধ্বংস করে গাছপালা পরিস্কার করে ফেলার জন্য। ঐদিন আমাদের বাড়ীতে ঢোকে এবং দিদিমাকে লেপকাঁথা দিয়ে জড়িয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। আগুন দিয়ে দিদিমা আমার কাকার নাম ধরে বার বার চিৎকার করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সমস্ত এলাকা পুড়িয়ে ধ্বংস করে । ভোলা বোসকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। রাধা বল্লভ গ্রামে মেয়েদের রাজাকাররা ধরে নিয়ে আসে। রাজাকাররা সারারাত পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে দিনের বেলা গুলি করে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে। বলরাম সাহাকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে। তার বিরাট গদির উপরে রজব আলী বসত, চারিদিকে রাজাকার ঘিরে থাকতো। ওখানে একটি ঘরে লোকদের জবাই করতো।
প্রত্যেকদিন ১০টি লোক যোগাড় করতেই হতো, ১০ টি করে জবাই করতোই। লোক না পারলে যেভাবেই হোক, ফকির হোক, এনে দিতেই হতো। আমি একদিন এক লোকের সুপারিশ করতে গিয়ে দেখলাম ঘরের ভিতর চাপ চাপ রক্ত পড়েছে। মদনের মাঠ ওয়াপদা রেষ্ট হাউসে একটি কক্ষে অসংখ্য লোককে জবাই করেছে। খাদ্দার গ্রামে এক বাড়ী থেকে সবাই ধরে এনে হত্যা করে। ডাক বাংলো ঘাটে প্রত্যেহ অসংখ্য লোককে জবাই করেছে বেয়োনেট দিয়ে।

এক বৃদ্ধ রামদা দিয়ে অসংখ্য লোককে কেটেছে। সে পিঠ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। লোক ধরে বলতো ‘বাবা নীচু হও তা নইলে কাটতে আমার কষ্ট হয়। তাড়াতাড়ি বসে পড়ে তোমাদের কষ্টও কম হবে, আমারও কষ্ট কম হবে।‘

ইসহাক মিয়ার বাড়ীতে অনেক মেয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও কেউ রেহাই পায়নি। সমস্ত এলাকাতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।

গ্রাম গ্রামান্তর থেকে ব্যাপকভাবে হিন্দু মেয়ে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিতো রাজাকাররা। এছাড়া রাজাকাররা গ্রামে গ্রামে ঢুকে অধিকাংশ মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে।

বাগেরহাট থানার মীর্জাপুর গ্রাম এবং সারাগ্রামে বহু মেয়ে অপমাণিত হয়ে আত্নহত্যা করেছে বিষপানে কেউ বা গলায় দড়ি দিয়ে।

রাজাকার, আল-বদর এদের মানুষ চরমভাবে ঘৃণা করতো। আমার মনে হয় সমস্ত বাংলাদেশে রাজাকাররা এমন ভাবে সন্ত্রাস আর নৃশংস অত্যাচার কোথাও চালায়নি। নদীর ঘাটে দড়ি বাঁধা অবস্থায় এক মাসে ৪/৫ টি লোককে গলা কাটা অবস্থায় পেয়েছি। গলা সম্পূর্ণ কাটতো না অল্প কেটে ছেড়ে দিতো, ছটফট করে শেষ হয়ে যেত। হাড়ি খালীতে (বাগেরহাট থানা) বিষ্ণু মহাশয়কে তার বৌয়ের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিয়ে আরও পাঁচজনকে ধরে ওর স্ত্রীর সামনে গুলি করে হত্যা করে।
অত্যাচার চালায় সারা গ্রামে। বি,এ,পাশ এক মেয়েকে ধরে অত্যাচার চালিয়ে ছুরি দিয়ে হত্যা করে। মদনের মাঠের এক ঘরে ওরা নিয়মিত মানুষ কেটেছে।

স্বাক্ষর
তাহমীনা বেগম (দিপালী)
৩/৮/৭৩

।। ১৬৫ ।।
মোঃ শহীদুল ইসলাম এ্যাডভোকেট
থানা- কোতোয়ালী, যশোর

এপ্রিলের ২৭ তারিখে বাসার খোঁজ নেবার জন্য শহরে চলে আসি। কিন্তু মায়ের অনুরোধে সেদিন বাসাতে রাত্রি কাটানোর জন্য থেকে যাই। কিন্তু সেই দিন রাত্রি দু’টার সময় পাকসেনারা আমাদের বাসাসহ আরও অনেকগুলো বাসা ঘেরাও করে এবং আমাদের বাসার ভিতরে যেয়ে দরজায় ধাক্কা মারতে থাকে। আমার আব্বা দরজা খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার আব্বাকে ধরে ফেলে এবং তার চোখ বেঁধে ফেলে। তারপর লাফ দিয়ে একজন আমার নিকট চলে আসে এবং আমাকে ধরে ফেলে এবং আমারও চোখ হাত বেঁধে ফেলে। তারপর আমাকে এবং আব্বাকে বাসার বাইরে নিয়ে যায়। আমি অনুনয়-বিনয় করে বলতে থাকি আমরা মুসলমান, আমরা মুহাজির। তারপর তারা আমাকে মুখ বন্ধ করতে বলে। আমি আর কোন কথা না বলে চুপ করে থাকি। আব্বা ধরা পড়ার সাথে সাথে জোরে জোরে কালেমা পড়তে থাকেন। আব্বার কালেমা পড়ার জন্য তাকে জোরে জোরে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে। আব্বার বয়স প্রায় ৮০/৮৫ বছর। তারপর তিনি ধীরে ধীরে কালেমা পড়তে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে এবং বলতে থাকে কালেমা মাত কর। আমাদের ঐ অবস্থা দেখে আম্মা কান্নাকাটি করতে থাকেন। আম্মার কান্নাকাটি করা দেখে একজন মিলিটারী বাসার মধ্যে চলে যায় এবং আম্মাকেও বন্দুক দিয়ে বাড়ি মারে। তার হাতের রিঙ খুলতে চেষ্টা করলে অন্য একজন মিলিটারী গিয়ে তাকে বাঁধা দেয় এবং সেখান হতে তাকে বাসার বাইরে নিয়ে আসে। আমার হাত এবং আব্বার হাত একত্র করে বেঁধে ফেলে। তারপর আমাদেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ১০/১২ গজ হাঁটিয়ে নিয়ে এসে এক জায়গায় বসতে বলে। আমরা বসে পড়ি। এর মাঝে আমি পানি চাইলে আবার এসে মারা আরম্ভ করে। তারপর আমরা সেখানে বসে থাকি। তার ৪/৫ মিনিট পর আরও ৮/১০ জন লোককে ধরে মারতে মারতে আমাদের নিকট নিয়ে এসে রাখে। তারপর তারা সবাই একত্রিত হবার পর তাদের মধ্যে থেকে একজন মিলিটারী বলে ওঠে এ তো বুড্ডা একে নিয়ে কি হবে। আমাদের মধ্যে একজন ছোট ছেলে ছিল তাকে এবং আমার আব্বাকে তারা ছেড়ে দেয়।

তার প্রায় আধা ঘন্টা পর আমরা গাড়ির শব্দ পাই। একটা গাড়ি এসে আমাদের সম্মুখে থামে এবং মিলিটারীরা নিজেরাই ধরাধরি করে আমাদেরকে গাড়িতে উঠায়। তারপর গাড়ি ছেড়ে বেশ কিছু দূর গিয়ে গাড়ি থেমে পড়ে। আমাদেরকে গাড়ি হতে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে ফেলে। তারপর একটা ঘরের দরজার নিকট নিয়ে গিয়ে আমাদের সবার চোখ খুলে দেয় এবং ঘরের মধ্যে আমাদেরকে ঢুকিয়ে দেয়। ঘরের মধ্যে আমরা ঢুকে সবাই সবাইকে এক নজর দেখে নিলাম। তার পরপরই ভোরের আযানের শব্দ আমার কানে ভেসে আসতে লাগলো। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পাই প্রায় ২০/২৫ জন লোককে মারতে মারতে পায়খানায় নিয়ে যাচ্ছে আবার মারতে মারতে পায়খানা হতে নিয়ে আসে। তারপর আমাদেরকে পায়খানা করার জন্য বাইরে নিয়ে যায়। পায়খানা করা হলে সবাই অজু করে নেবার পর আবার উক্ত জায়গায় নিয়ে এসে রেখে দেয়। আমরা সবাই নামাজ পড়ে বসে আছি এমন সময় পাশের ঘর হতে মানুষের চিৎকার শুনতে পাই। তাতে আমরা ধারণা করলাম ওখানে মার আরম্ভ করে দিয়েছে। এর মধ্যে একজন মিলিটারী আমাদের রুমে চলে আসে এবং প্রত্যেকের পুরা ঠিকানা ও প্রত্যেকের পেশা একটা কাগজে লিখে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। আমরা খাবার পর সবাইকে ঘুমাতে বলে। আমরা কোন মতে রাত্রি কাটালাম।

তারপর দিন আমাদের দলের বদরউদ্দিন নামক একজন লোককে ঘর হতে বের করে নিয়ে যায়। তার সাথে কি যেন বলাবলি করার পর আবার আমাদের রুমে তাকে নিয়ে এসে রেখে যায় এবং আমাদের সবাইকে জানিয়ে যায় তোমরা কোন লোক বদরউদ্দিন সাহেবের সাথে কথা বলবে না। যদি কোন লোককে তার সাথে কথা বলতে দেখি তাকে আমরা গুলি করে মারবো। তারপর দিন রাজু নামক একজন লোককে নিয়ে যায়। কিছু সময় পর আবার তাকে নিয়ে এসে রেখে যায়।

তার তিনদিন পর আমাদের রুমে এসে জিজ্ঞাসা করে ফকু কোন হায়? তোতা কোন হায়? তারপর আমরা দুজন উঠে দাড়ালাম। তারপর আমাদেরকে বের করে নিয়ে যায়। একটা মাঠের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে শুতে বললে আমরা দুজন মাঠের মধ্যে শুয়ে পড়ি। তারপর আমাকে এমন জোরে একটা বেতের লাঠি দিয়ে পিঠে আঘাত করে যে আমি সহ্য করতে না পেরে ছুটাছুটি করতে থাকি। আবার আমাকে ডেকে নিয়ে শুতে বলে, আমি মাটিতে শুয়ে পড়ি। তারপর আমাকে কতকগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে।
যেমনঃ-
(১) তোমার রাইফেল কোথায়।
(২) তুমি রাইফেল ধরেছ কিনা।
(৩) তোমার গ্রামে যে ১৫/১৬ জন লোক রাইফেল ধরেছিল তাদের নাম বলো। তাদের নেতা কে ছিল।
(৪) তোমাদের গ্রামের কারা ই,পি,আরদের খেতে দিয়েছে।
(৫) তুমি ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগ করো কিনা।
(৬) যশোরে মুজিবের মিটিং-এ তুমি ছিলে কি না।
(৭) মিটিং-এ সে কি বলেছিল।
(৮) মিছিলে কী কী বলা হয়।
(৯) জয় বাংলার মানে কী।
(১০) তোমার ভাই কোথায়।
(১১) তুমি কী কর।
(১২) তোমাদের গ্রামে যে মেজর যেত, তাকে তোমরা কেন মেয়ে জোগাতে না।
(১৩) ভারতে কে গিয়েছে।

সুবেদার মেজর শাহজি আমাকে সবগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। আমি মারে দরুন থাকতে না পেরে কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর স্বীকার করি আর যে গুলো বেশি জরুরী সেগুলো স্বীকার করি না। মারের নিয়মগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো।

(১) প্রথমে মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে দিত। তারপর বেতের লাঠি দিয়ে ঘাড়ে এবং পায়ের তালুতে মারতে থাকে। লাঠি দিয়ে মারা শেষ হলে আবার বুট দিয়ে পিঠের উপর উঠে খচতো বা পাড়াতো।
(২) দ্বিতীয় নিজ কায়দা হলো চুল ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঠাশ করে ঘাড়ে একটা চড় কশিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিত।
(৩) পা উপরে দিয়ে মাথা নিচে দিয়ে একটা ঘরের মধ্যে রশির সঙ্গে লটকিয়ে রাখতো।
(৪) বস্তার মধ্যে পুরে দিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলতো।
(৫) প্রত্যেক গিড়ায় গিড়ায় লাঠি দিয়ে এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতো।
(৬) আট দশজন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে বেয়োনেট চার্জ করে মেরে রেখে আসতো।
(৭) প্রত্যেক হাতের প্রতি আঙ্গুলে সূচ ঢুকিয়ে দিত।
(৮) নিল ডাউন করে রাখতো।
(৯) প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার খাবার দিত। আর পায়খনা প্রশ্রাব করাতে নিয়ে যাবার সময় মারতো আর নিয়ে আসার সময় মারতো। আমাদেরকে একমাস বার দিন রাখার পর আমাদের ১৭ জনের একটা দলকে সুবেদার মেজর শাহজি সবাইকে ডেকে লাইন করে তারপর একটা গাড়িতে আমাদেরকে উঠতে বলে। আমরা গাড়িতে উঠে পড়ি। তারপর আমাদের বাড়ির নিকট গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে নামিয়ে দেয়। আমাকে ধরে ২৭শে এপ্রিল আর ছেড়ে দেয় জুনের ১০ তারিখে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ শহীদুল ইসলাম এ্যাডভোকেট
১৭/০৩/১৯৭৩
।। ১৬৬ ।।
শ্রী নরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
ষষ্টিতলা, যশোর

আমার বর্তমান বয়স ৯৮ বছর। ১৯৭১ সালের ৪ ঠা এপ্রিলে সকাল ৮-৩০ মিনিটে ভারত ও তথাকথিত পাকিস্তানের খবর রেডিওর মাধ্যমে শুনছি এমন সময় দু’জন বিহারী ও তিনজন পাঞ্জাবী আমার বাসায় চলে আসে। বিহারী দুজন আমার পাড়া প্রতিবেশী। তারা আসার সাথে সাথে আমি রেডিও বন্ধ করে দেই। তারা সোজাসোজি আমার নিকট চলে আসে এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার টাকা পয়সা কোথায় রেখেছ? আমি জবাব দেই আমার কোন গচ্ছিত টাকা পয়সা নাই। আমি আবার ত্রিশ বছর চাঁচরা রাজ স্টেটের ম্যানেজার ছিলাম। তারা সেই জন্য মনে করত আমার নিকট প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে। তারপর তাদের মধ্যে থেকে একজন মিলিটারী আমার পাশের ঘর হতে আমার চাকর কালিপদ দাসকে আমার নিকট নিয়ে আসে। তারপর আমাকে এবং তাকে ভয় দেখায়। টাকা কোথায় রেখেছ যদি না বলে দাও তাহলে তোমাদের দু’জনকেই গুলি করে মারা হবে। আমরা জবাব দিলাম টাকা আমরা কোথায় পাবো। তখন আমাদের দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড় করায়। তারপর একজন মিলিটারী কালিপদকে লক্ষ্য করে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক ভেদ করে গুলি বেরিয়ে যায়। তার পরক্ষণেই সে মারা যায়। তার পর আমাকে লক্ষ্য করে দ্বিতীয় গুলি ছোড়ে, গুলিটি আমার এক হাতে লাগে। গুলি লেগে আমার বাম হাতটা প্রায় শরীর হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারপর আবার আরেকটা গুলি আমাকে করে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুণায় গুলিটি আমার ডান হাতের এক পাশে লাগে। সাথে সাথে আমাকে অমনি ফেলে চলে যায়। বাড়ি হতে বের হয়ে যাবার সময় আমার বাসা লুটপাট করে বাসার সমস্ত কিছু নিয়ে যায়। অবশ্য উক্ত জিনিসপত্রগুলো মিলিটারীদের সঙ্গে যে দু’জন বিহারী এসেছিল তারাই লুটপাট করে নিয়ে যায়। আমি ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকি। মিলিটারী ঐ দিনই আমার বাড়ির আশে পাশে ১১ জনকে গুলি করে মারে। তার মধ্যে আমি শুধু বেঁচে আছি। যাদের গুলি করে মারা হল তারা হল আমার বাড়ির উত্তরে আমার বিশিষ্ট বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রহমত উল্লাহ মন্ডল এবং তার দুই শিক্ষিত পুত্র মোছাদ্দেক ও জিন্নাহ এবং তার বাড়িতে তিনজন ভাড়াটিয়া, একজন প্রফেসর ও দুজন শিক্ষিত ভদ্রলোক। আমার বাড়ির উত্তরে ডাক্তার নাছির উদ্দিন খান এবং তার স্ত্রী ও তার বাড়িতে উপস্থিত আরও তিনজন লোক। আমার বাড়ির পূর্বে সত্য চরণ মিত্র ইত্যাদি ১২ জনকে গুলি করে তার মধ্যে ১১ জন মারা যায়। তার মধ্যে আমি পঙ্গু এবং অন্ধ অবস্থায় বেঁচে আছি। তারা চলে যাবার পর আমি আধমরা অবস্থায় পড়ে থাকি।

সেইদিন বেলা তিনটার সময় দু’জন বিহারী এসে আমার ঘর হতে কালিপদের মরা লাশ নিয়ে যায়। তারপর ৭ দিন পর্যন্ত শুধু আমি শরীরে ভীষণ জ্বর নিয়ে না খেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকি। ৭ দিন পর ঘোপের বদরউদ্দিন সাহেবের বাড়ি হতে মহর আলী নামক একজন লোক আমার জন্য দুধ ও রুটি নিয়ে আসে। তারপর হতে তার সেবা শুশ্রুষায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। আমার হাতে পোকা পড়ে গিয়েছিল। তারপর আমি সুস্থ হয়ে উঠি। বর্তমানে আমি অন্ধ এবং আমার বাম হাত পঙ্গু হয়ে গেছে। আমি এখনও খোদার অশেষ কৃপায় বেঁচে আছি আর কি।
টিপ সহি/-
শ্রী নরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
১৭/০৩/১৯৭৩

।। ১৬৭ ।।
ডাঃ এস, এম, আহাদ আলী খান
থানা- কোতোয়ালী, যশোর

এপ্রিলে পাকবাহিনী যশোর পুরোপুরি দখল করে নেয়। আমরা পালিয়ে যাই গ্রামে। সেখান থেকে ভারতে যাবার পথ না পেয়ে পুনরায় শহরে ফিরে আসি। জুলাই মাসের ১৭ তারিখে পাকসৈন্যরা আমাকে ডাক্তার খানা থেকে ধরে নিয়ে যায়। প্রথমে সার্কিট হাউসে নিয়ে গিয়ে ব্রিগেডিয়ারের সামনে হাজির করে। ব্রিগেডিয়ার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। মেজর আনোয়ারের সামনে হাজির করাবার জন্য বসিয়ে রাখে। সেখানে সুবেদার মেজর আমীল হোসেন এবং একটি হাবিলদার ছিল নাম ইকবাল শাহ এবং আরও অনেকে ছিল। হঠাৎ করে অন্য সিপাই এসে আমাকে মারধর শুরু করে তখন সবাই মার আরম্ভ করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখি মেজর আনোয়ার হোসেন সামনে। মেজর আমাকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কোন রাজনৈতিক দলে আছ? আমি উত্তর দিই ন্যাপে আছি। তারপর একটি ছোট্ট কামরাতে নিয়ে যায়, রাতে কোন খাবার এমনকি পানিও দেয়নি। প্রশ্রাব করতে চাইলেও মারধর করেছে। তারপর দিন সুবেদার ইকবাল শাহ আমাকে বলে, যেহেতু মেজর খুরশীদ আনোয়ারের মেয়েকে এক সময় চিকিৎসা করে বাঁচিয়েছি সেহেতু আমাকে নাকি মেরে ফেলা হবে না। ওকে আমি পানির জন্য অনুরোধ করি কিন্তু পানি দেয়নি। সন্ধ্যাবেলা আউন্স দুই পানি এবং একমুঠি পচা ভাত দেয়।

জুলাই মাসের ২০ তারিখে আবার মেজর সাহেবের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে যখন বাঙ্গালী সৈন্যরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করে তখন ওরা কি খেত? আমি উত্তর দেই ‘ছোলা’, অমনি সবাই মিলে মারধোর শুরু করে। দুধ, ডাব, ভাত পাঠিয়েছি কিনা জিজ্ঞাসা করে। আমি হ্যাঁ বলেছিলাম কারণ তখন পাকসৈন্যরা সব খবরই সংগ্রহ করেছে।

জুলাই মাসের ৩১ তারিখ পর্যন্ত সিপাইরা দুবেলা নিয়মিত মারধর করতো। পাঁচ মিনিট সময় দিত তার মধ্যে প্রশ্রাব, পায়খানা, হাতমুখ ধোওয়া সব করতে হতো, দেরি হলে বেত মারতো। সারাদিন খাবার দিত না, সন্ধ্যাবেলা কিছু পচা ভাত এবং আউন্স দুই পানি দিত। পানি চাইলে বলতো তোমরা আমাদের পানি বন্ধ করেছিলে।

১ লা আগস্ট আবার মেজরের সামনে হাজির করে। মেজর প্রিন্স সদর উদ্দিন আগা খাঁকে চিনি কিনা বললে আমি চিনি বললাম। মেজর আমাকে এক প্যাকেট বিস্কুট দেয়। কোর্ট থেকে নামিয়ে নিয়ে এসে সুবেদার মেজর আমীর হোসেন আমাকে ভীষণভাবে মারধর শুরু করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার আর চলবার ক্ষমতা ছিল না। তখন থেকে কিছু কিছু খাবার দিত। সিপাইরা মারধর করতো নিয়মিতভাবে। মফিজ চৌধুরী, নড়াইলের অধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন, ডাঃ মাহবুবুর রহমান এবং আজিজুর হক, এ, বি, এম, বদরুল আলম এরা সবাই আমার সাথে ছিলো।

পুরা আগস্ট মাস প্রায় আমি অজ্ঞান থাকতাম। আগস্ট মাসে আমার মেয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে অনুরোধ করে আমার মুক্তির জন্য কিন্তু কোন কাজ হয়নি এবং অপমানিতা হয়েছে। উপর থেকে কি অর্ডার আসে জানিনা তারপর আমাকে মুক্তি দেয়। যখন মুক্তি দেয় তখন আমার জ্ঞান ছিল না। রাত সাড়ে আটটার সময় প্রত্যহ ধৃত লোকদের মুখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে বাইরে নিয়ে যেত। শুনতাম অবাঙ্গালীরা ছুরি দিয়ে জবেহ করেছে। ধরে নিয়ে এসে পিটিয়ে হত্যা করেছে। উপরে পা ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে মারতে মারতে মেরে ফেলতো। গুহ্যদ্বারের ভিতর বেয়োনেট ঢুকিয়ে দিত, খবরাখবর না দেওয়ার জন্য বরফ ঢুকিয়ে দিত। বাগছড়া হাইস্কুলের শারীরিক শিক্ষককে ধরে নিয়ে গিয়ে খবর না দেওয়ার জন্য অত্যাচার শুরু করে। বিছানার উপর শুইয়ে একটি কেমন যন্ত্র দিয়ে চাপ দিত তারপর ইলেকট্রিক শক দিত, উপরে ঝুলিয়ে মারধর করতো। মেয়েদের ধর্ষণ করে কোন কোন ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেকে বসিয়ে বাচ্চাটিকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে কিন্তু মেয়েটিকে রেখে দেয়। জোর করে পাকিস্তানের পক্ষে ভালো আছি বলে জোর করে জবানবন্দী রেকর্ড করতো টেপ রেকর্ডে। গুলি করে, ছুড়ি দিয়ে হাত পা কেটে, উপর থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে। অনুমান ৮/১০ হাজার লোক মারা যায় এখানে। কর্নেল শামস এবং মেজর বেলায়েত আলী মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। হাজার হাজার মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। স্বামীকে মারধর করে জোর করে বেয়োনেট দেখিয়ে স্ত্রীকে তুলে নিয়েছে পাকসেনারা। একই মেয়ের উপর ৫/৭ জন আর্মি ধর্ষণ করেছে।
স্বাক্ষর/-
ডাঃ এস, এম, আহাদ আলী খান
০৯/০৩/১৯৭৩

।। ১৬৮ ।।
সৈয়দ আলী ইমাম
এস, ডি, ও, এম, ই, এস; (আর্মি)
যশোর ক্যান্টনমেন্ট, যশোর

২০ শে মে ধরা পড়ার পর আমাকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের কাছে অর্পণ করা হয়। সেখানে হাবিলদার মেজর মাসুদ প্রথম লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার শুরু করে। পরে শরীরের সমস্ত জামা কাপড় খুলে চিৎ করে ফেলে পায়ের তলাতে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার শুরু করে। সারাদিন অভুক্ত অবস্থাতেই এই প্রহার চলে। এরপর আমাকে এফ, আই এর নিকটে একটি সেলের মধ্যে পুরে রাখলো। তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। সেখানে তখন প্রায় ৩৪ জন বন্দী অবস্থায় ছিলেন। ২০ টা থালাতে এই ৬৪ জন বন্দীকে খেতে হতো। পরিষ্কার না করেই উক্ত থালাতে খেতে হতো।

সারাদিন একবার খাদ্য দিতো। নামাজের সময় অজু করার জন্য ২ মিনিট করে সময় দিতো। যদি বেশি সময় লাগতো তা হলে তার উপর মারপিট শুরু হয়ে যেত। মাঝে মাঝে বন্দীদের দিয়ে গাড়ির চাকা পরিষ্কার করাতো।

খাদ্যের দরুণ প্রায় বন্দীদের পেটের অসুখ হয়। তার ফলে তারা প্রায় ঘরের মধ্যে পায়খানা করে ফেলতো। তখন তাদের প্রহার করা হতো বেদমভাবে।

একদিন চার পাঁচজন যুবককে ধরে নিয়ে আসে। তাদের পা এমনভাবে বাঁধা ছিল যে খাড়া হয়ে তারা চলতে পারতো না। তাদের বিড়ালের মত হাঁটু ও হাত দিয়ে হেঁটে যেতে হতো। পিছনে পাকসেনারা লাঠি দিয়ে মারতে মারতে নিয়ে যেতো। মনে হতো যেন গরুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

বন্দীদের হত্যা করার সময় মেজর ওমর খুরশীদ নিজে আসতো এবং যাদের হত্যা করা হবে তাদের নামের লিস্ট করে নিয়ে যেতো। পরে তাদের হত্যা করা হতো।

কয়েকজন মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের উপর দিকে পা বেঁধে তাদের লাঠি দিয়ে প্রহার করতো।

একদিন সাধু প্রকৃতির একজন লোককে ধরে নিয়ে আসে। তাকে গুপ্তচর সন্দেহ করতো। দশ বার হাত দূর হতে দৌড়ে এসে উক্ত সাধু প্রকৃতির লোকের বুকে বুট সমেত লাথি মারতো আর বলতো তুমি ভারতীয় বাহিনীর গুপ্তচর। বুটের আঘাতে পড়ে গেলে তার পায়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করতো। পরে তাকে তুলে আবার বুকে বাঁট দিয়ে আঘাত করতো।

এইভাবে প্রায় আড়াই মাস ধরে অত্যাচার করে। প্রায় ৬০ জনকে এই ঘর হতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

৩১শে জুলাই ১৪ জনকে বন্দীশালা হতে ক্যান্টনমেন্টের প্রাইমারী স্কুলে নিয়ে যায়। সেখানে ৩ রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই স্কুলে বন্দী করে রাখে।

কয়েকজন মুক্তিফৌজকে ধরে নিয়ে এসে একদিন বেদম প্রহার করে। প্রত্যেকদিন মুক্তিফৌজ নামে কয়েকজন যুবককে দিনের বেলায় বাইরে বের করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঘরে নিয়ে আসতো। এই ভাবে তাদের সারা শরীর ফুলে ও পরে পচে গিয়ে পোকা হয়ে গিয়েছিলো। তাদের জিজ্ঞাসা করতো ভারতের কোথায় কোথায় ট্রেনিং চলছে। তারা এত অত্যাচারের মুখেও গোপন তথ্য প্রকাশ করতো না। এক মাস পরে তাদের একদিন রাতে নিয়ে যায়। পরে তাদের আর কোন দিন দেখা যায়নি। সন্ধ্যার দিকে যখন বন্দীদের গুনতো তখন চামচ দিয়ে প্রত্যেকের বুকে একটা করে ভীষণ জোরে আঘাত করতো। মনে হতো যেন বুকের হাড় যেন বুঝি ভেঙ্গে গেল। এইখানে বন্দী অবস্থায় একটা ২০০ গজ ট্রেঞ্চে সবার সামনেই প্রত্যেককে পাশাপাশি বসে পায়খানা করতে হতো।

৪ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে স্কুল হতে যশোর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যায়। সেখানে কতৃপক্ষ বাঙ্গালী থাকায় জেল খানাতে কোন মারপিট হয়নি।

আমাদের সাথে একজন পাঠান ছিলেন বন্দী। কারণ সেই পাঠান এক গ্রামে আগুন লাগাতে অস্বীকার করায় মেজরের সাথে গোলমাল হয় এবং মেজরকে একটা চড় লাগায়। ফলে তার নয় মাস জেল হয়েছিলো।
স্বাক্ষর/-
সৈয়দ আলী ইমাম এস, ডি, ও
২৪/০৩/১৯৭৩

।। ১৬৯ ।।
শ্রী গণপতি সরকার
কোতোয়ালী, যশোর

১৯৭১ সালের ২৭ শে মার্চ আমি আধুনিক সেলুনে কাজ করছিলাম। বেলা ১১ টার সময় ৪ জন পাক সেনা আধুনিক সেলুনে চলে আসে এবং আমাকে, শ্রী অজীৎ ভবেন ও জগদীশকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে ধরে ফেলে এবং সবাইকে কালেক্টরেটে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে আমাকে ছাড়া বাকি তিনজনকে রাইফেল, বেতের লাঠি ও বুট দিয়ে গুঁতা, প্রহার আর লাথির পর লাথি মারতে থাকে।

তাদের এইভাবে বেলা তিনটা পর্যন্ত মারার পর জিন্নাহ রাস্তার উপর তাদের ফেলে রেখে আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। তারপর আমার বাড়ি গিয়ে আমার বড় ভাইকে খোঁজ করে কিন্তু তাকে বাড়ি না পেয়ে ঘরের মধ্যে শেখ সাহেবের যে ফটো ছিল তা ভেঙ্গে ফেলে এবং পরে ওতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার বড়ভাই শ্রী পশুপতি সরকার আওয়ামী লীগ করতেন। তারপর আমাকে বাড়ি হতে শহরে নিয়ে আসার সময় একজন বেলুচ মিলিটারী আমাকে মুড়ি ও গুড় কিনে দেয় খাবার জন্য। আমি মুড়ি মুখে দিতেই একজন পাঞ্জাবী মিলিটারী লাথি দিয়ে তা আমার মুখ হতে ফেলে দেয় এবং অকথ্য ভাষায় আমাকে গালাগালি দেয়। তারপর আমাকে কালেক্টরেটে নিয়ে আসে। সেখান হতে তাদের গাড়িতে করে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে গাড়ি হতে নামিয়ে মার্শাল ল কোর্টে নিয়ে হাজির করে। তারপর কর্ণেল আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার নিকট নাকি ওয়ারলেস পাওয়া গেছে? আমি অস্বীকার করি। তারপর আমাকে একটা ঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে হাওলাদার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তোর ভাই কোথায় আমাদেরকে বলে দিবি আর না হয় স্বীকার করবি যে আমার নিকট ওয়ারলেস পাওয়া গেছে। কিন্তু আমি কোন কথাতেই রাজি না হবার দরুন আমার পাছায় ও পিঠে ২৫ টা বেত মারে এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। প্রায় ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবার জ্ঞান ফিরে পাই। তারপর প্রায় ৪০ জনকে মারতে মারতে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে আবার বেতের ছড়ি দিয়ে মারতে মারতে গাড়ি হতে নামায়। গাড়ি হতে নামিয়ে রৌদ্রের মধ্যে চিত করে শুইয়ে রাখে। তারপর বুকের উপর উঠে বুট দিয়ে খচতে থাকে। এইভাবে বেলা ১১ টা হতে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত রৌদ্রের মধ্যে শুইয়ে রাখার পর আবার রাইফেলের গোড়া দিয়ে মারতে থাকে। মারার পর আবার গাড়িতে করে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে এসে রেখে দেয়। এইভাবে প্রত্যেকদিন অত্যাচার করার দরুণ দ্বিতীয় দিন বুটের খচনের সঙ্গে সঙ্গে তিন জন আমির, লতিফ ও গৌর নামক তিন ব্যাক্তি মারা যায়। তিন দিন পর পর এক বেলা খাবার দিত। আর পানি চাইলে প্রশ্রাব করে নিয়ে এসে দিত। পায়খানা করতে চাইলে মার আরম্ভ করে দিত।

এইভাবে ৬ ই এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের উপর একই উপায়ে অত্যাচার করার পর ৭ ই এপ্রিল মেজর আমাদেরকে ডাকে। আমরা ৩৫ জন মেজরের নিকট হাজির হই। মেজর সবার স্টেটমেন্ট নেবার পর আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তা হলে তোমাকে কোন অপরাধে ধরে নিয়ে আসে। আমি প্রতি উত্তরে বলি স্যার আমি ওয়ারলেস চিনি না। আমার বড় ভাই আওয়ামী লীগ করেন। তাকে বাসায় না পেয়ে আমাকে ধরে আনে। তারপর মেজর ৪ জনকে রেখে ৩১ জনকে ছেড়ে দেয়। যে চারজনকে রেখে দেয় তারা হলো অরুণ, অমলা সোম, কেষ্ট এবং আর একজন নাম না জানা। ওদের চার জনকে কারেন্ট চার্জের জন্য নিয়ে যায়। তারা ফিরে আসে না। তারপর আমি ৭ ই এপ্রিল উক্ত ৩১ জনের সঙ্গে ক্যন্টনমেন্ট হতে মুক্তি পেয়ে বাড়ি চলে আসি।
স্বাক্ষর/-
শ্রী গণপতি সরকার
১৬/০৩/১৯৭৩

।। ১৭০ ।।
নূর জাহান
সুইপার, সি,এম,এইচ মহিলা বিভাগ
যশোর ক্যান্টনমেন্ট

৩০ শে মার্চ যখন গোলাগুলি শুরু হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে সেই সময় আমি হাসপাতালে ডিউটিরত ছিলাম। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ৬/৭ জনের এক পাঞ্জাবী দল হসপিটালে আসে এবং বলে তোমরা বন্দী।

৩০ তারিখের পর হতে প্রতি রাতে ৭/৮ বার করে হসপিটাল চেক করতো। তারা বলতো যে কোন পুরুষ মানুষ তোমরা লুকিয়ে রেখেছো। এটা একটা বাহানা ছিলো। ১১ই এপ্রিল তারিখে সামরিক হাসপাতালের ষ্টাফ বাদে যে সমস্ত মহিলারা প্রাণ ও ইজ্জতের ভয়ে হসপিটালে আশ্রয় গ্রহন করেন তাদের সবাইকে রাত অনুমান ১ টার দিকে নিজ নিজ ঘরে ফিরিয়ে দেবে বলে নিয়ে যায়। উক্ত মহিলারা সবাই ছিলেন ই,পি,আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের ও বেসামরিক লোকদের স্ত্রী, কন্যা ও শিশু। প্রথমে তাঁদের আর্টিলারীরা ঘরে নিয়ে আটকে রাখে।

উক্ত ছয় সাত ঘরে ভদ্রমহিলারা ছিলেন। উক্ত এলাকাতে যারা পাহারা দিত সেই পাকসেনারা দু’জন ঘরের দরজা জোর করে ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে এবং দুজন ভদ্রমহিলার উপর অত্যাচার করে। একজন ভদ্রমহিলার পেটে যে বাচ্চা ছিলো তা এই অমানুষিক অত্যাচারের ফলে নষ্ট হয়ে যায়।

এই ঘটনার পর উক্ত এলাকা হতে ৪ জন অভুক্ত রেখে বন্দী মহিলাদের সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়।

লেডী ডাক্তার এবং দুজন সিসটার এবং আয়া ছিলো তিনজন। সবাইকে হসপিটালে বন্দী করে রাখে। দুইমাস হসপিটালে সিসটার জুজুভিনের ঘরে থাকেন বাকী ষ্টাফরা। একটা ঘরে সবাইকে বন্দী করে রাখে। প্রায় প্রতিরাতে পাকসেনারা উক্ত ঘরে এসে তল্লাসী চালাতো। দুই মাস পর সবাই লেডী ডাক্তারের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

একদিন দেখি যে একজন বাঙ্গলী যুবকের দেহ হতে রক্ত বের করে নিয়ে তাকে হত্যা করে। ছেলেটির শেষ কথা ছিলো “মা, স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম না”।

ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে ১০ নং পুকুরের ধারে দুইজন অজ্ঞাত পরিচয় মহিলাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের লাশ ওখানে পড়ে ছিলো। দুজন শিশুও ছিলো।

টিপসহি
নূর জাহান (সুইপার)
২২/৩/৭৩
।। ১৭১ ।।
মোঃ মোহসিন উল্লাহ
গ্রাম-চৌগাছা
থানা-ঝিকরগাছা, জেলা-যশোর

১৯৭১ সালের ১৫ ই অক্টোবর ২০/২৫ জন পাক মিলিটারী রাত প্রায় ১১ টায় আমাদের বাড়িতে চলে যায়। আমাদের বাড়ী ঘেরাও করে আমাকে নাম ধরে ডাকলে আমি ঘর হতে বেরিয়ে আসি। সঙ্গে সঙ্গে দুজন পাকসেনা আমার দুহাত ধরে ফেলে এবং গামছা দিয়ে পিঠমুড়া করে দুহাত বেঁধে ফেলে দেয়। তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় এবং একজন চাকর ঘরের মধ্যে শুয়ে ছিলো তাকেও ধরে ফেলে এবং আমার নিকটে নিয়ে আসে। একজন সুবেদার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার? তোমার গ্রামে কয়জন মুক্তিবাহিনী আছে? তুমি মুক্তিবাহিনীকে আমাদের খবরাখবর পৌছে দাও? তাদের সবগুলো কথার জবাব আমি অস্বীকার করি। তারপর আমাকে হুমায়ূন কবির নামে একজন পাঞ্জাবী ফোন অপারেটার ৪/৫ টা ঘুষি মেরে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আমাকে মোটা একটা কাঠের লাঠি দিয়ে সমস্ত শরীরে আঘাত করে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে সত্যি করে বলো তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নয়। তারপর আরও ৮/৯ জন মিলিটারী আমার নিকটে চলে আসে এবং তারা প্রত্যেকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারতে থাকে। তাদের মধ্যে একজন ছোট ১২/১৪ বছরের বিহারী ছেলে ছিল। সে আমাকে ২/৩ হাত দূর থেকে জাম্প করে এসে আমার বুকে আঘাত করে। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। প্রায় একঘণ্টা পর আবার জ্ঞান ফিরে পেলে আমাকে স্কুলের দোতালায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে একটা আকড়ার সাথে দুহাত ঝুলিয়ে বেতের লাঠি দিয়ে শরীরে বেদম প্রহার করার দরুন সমস্ত শরীর ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। প্রায় ১৫/২০ মিনিট আমাকে মারার পর আমি যে কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি তা আমি বলতে পারি না। তারপর জ্ঞান ফিরে পেলে আমি দেখতে পাই আমি একটা ঘরের মধ্যে পড়ে আছি।

তারপর ৭ দিন আমাকে বিভিন্ন উপায়ে প্রহার করার পর আমি হাঁটতে চলতেও একস্থান হতে অন্যস্থারে সরে যেতে না পারার জন্য আমাকে প্রহার করা বাদ দেয়। আমি আধা মরা অবস্থায় ঘরের একটা কোণে পড়ে থাকি। আমাকে ধরার দুদিন পর আমার চাকরটাকে ছেড়ে দেয়।

তারপর মেজর ২৬শে অক্টোবর আমাকে ডাকে। ৪/৫ জন মিলিটারী ধরাধরি করে আমাকে মেজরের সামনে এসে হাজির করে। মেজর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে তুমি সত্য করে বলো মুক্তিবাহিনী তোমাদের বাড়ীতে আসে কিনা? তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার কি না? তোমাদের গ্রামে কতজন ছেলে মুক্তিবাহিনী হয়েছে? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর আমি অস্বীকার করি। তারপর মেজর একজন সুবেদার ডাকে। উক্ত সুবেদার মেজরের নিকট আসলে মেজর তাদের আদেশ করে এই লোক কোন দোষী নয়। একে গাড়িয়ে করে তার বাড়ীতে রেখে এসো। তারপর আমাকে গাড়িতে করে আমার বাড়ী পৌছে দিয়ে আসে। অর্থাৎ ২৬ শে অক্টোবর আমি ছাড়া পাই। তারপর আমি বাড়ী গিয়ে তিনমাস স্থানীয় চৌগাছ বাজারের একজন ডাক্তারের নিকট চিকিৎসায় ভাল হয়ে উঠি। এখন আমি চলে ফিরে খেতে পারি। কিন্তু কাজকর্ম করে খাবার মত কোন সামর্থ্য আমার নেই। এখনও মেঘ বৃষ্টি হলে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা বেদনা করে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।

চৌগাছা সরকারী ডাক বাংলোর পিছরে ২০/২৫ টা কবরে প্রায় ৭০/৮০ জনকে প্রত্যেক দিন প্রায় ৮/১০ জন করে লোককে ব্যায়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে আধা মরা করে ২/৩ জনকে একই ছালার মধ্যে ভরে ছালার মুখ বেঁধে উক্ত কপোতাক্ষ নদীতে ফেলে দিয়েছে। উক্ত নদীর উপর একটা ব্রীজ আছে, সেখানেও নিয়ে গিয়ে ব্যায়োনেট চার্জ করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। অনেককে উক্ত নদীর উপর যে ব্রীজ পার হয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় ৩০/৪০ টা করে ৮০/৯০ জন লোককে মেরে পুঁতে রেখেছে। যে সমস্ত লোক পাকসেনারা চৌগাছায় মেরেছে এবং তাদের ক্যাম্পের আশাপাশে পুতে রেখেছে এর মধ্যে অধিকাংশই শরণার্থী। কারণ তারা কাশিমপুর মাশিলা হিজলী বর্ডার দিয়ে ভারতে যাবার সময় পাকসেনারা তাদেরকে ধরে এবং চৌগাছায় তাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তারপর নৃশংসভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখে। এইবাবে দীর্ঘ নয় মানে চৌগাছাতে পাকসেনারা ১০০/১৫০ জন লোককে হত্যা করে। তাদের মধ্যে মেয়ে ও পুরুষ উভয়ই ছিল। মেয়েদেরকে ২/৩ দিন রেখে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করার পর ব্যায়োনেট চার্জ করে নদীতে ফেলে দিত। আমি যে এগার দিন ছিলাম ঐ কয়দিনে প্রায় ২০/২৫ জন লোককে ডাক বাংলোর পিছরে রাত আটটার পর প্রতিদিন ৪/৫ জন করে হত্যা করে পুঁতে রাখে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ মহসিন উল্লাহ
১০/০৫/৭৩

।। ১৭২।।
লুৎফর রহমান মোল্লা
মিরপুর থানা, জেলা-কুষ্টিয়া

আলমডাঙ্গা থানায় কাজ করছি এমন সময় একখানা পাক মিলিটারী গাড়ি গিয়ে থানা ঘিরে নেয় এবং আমরা থানার ষ্টাফ ৪ জনসহ মোট ১২ জন ধরা পড়ি। আমাদের প্রত্যেককে গাছের সঙ্গে দুই হাত বেঁধে বেতের লাঠি দিয়ে ভীষণ প্রহার করার পর বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারাতে আমার দুটা দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং আমার সারা শরীর ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। তারপর একজন মিলিটারী আমার বুকের উপর উঠে বুট দিয়ে পাড়ানোর চোখে আমার বুকের হাড় ভেঙ্গে যায়। পরে আর একটা মিলিটারী আমার পায়ে ব্যায়োনেট চার্জ করে। তারপর ক্যাপ্টেন মুজাফফার হোসেন নাগভী আদেশ দেয়, ১২ জনকে ৬টা জোড়া করে দুইজন করে সামনা সামনি হাত বেঁধে হাট বোয়ালীয়া একটা নদীর ধারে নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে চোখ বেঁধে হাঁটু পানির ভিতর নামিয়ে গুলি করে দেয়। এইভাবে পাঁচ জোড়া লুলি করার পর সর্বশেষ জোড়ায় ছিলাম আমি ও আলমডাঙ্গা থানার ও,সি সাহেব। যখন আমাদেরকে গুলি করতে নিয়ে যায় সেই সময় ছানাউল্লাহ নামক একজন কনস্টেবল এবং ইব্রাহিম নামক একজন কসাই ও,সি সাহেবের নিকট এসে বলে যদি ১৫,০০০ টাকা দেন আপনার জান বাঁচিয়ে দেব। সঙ্গে সঙ্গে ও,সি সাহেব সম্মতি জানানোর পর ক্যাপ্টেনের নির্দেশে তাঁর হাতের বাঁধন ছেড়ে দেয় একং তাঁকে ক্যাপ্টেনের গাড়িতে নিয়ে উঠায়। তারপর আমাকে গুলি করার জন্য চোখ বেঁধে হাঁটু পানির মধ্যে নিয়ে দাঁড় করায়। তখন আমি ক্যাপ্টেন সাহেবকে বলি স্যার আমার একটা ফরিয়াদ আছে। আমি কোন দোষ করি নাই, বিহারীরা আমার নামে মিথ্যা বলে আপনার নিকট আমার সমন্ধে বলেছে। তখন ক্যাপ্টেন আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয় এবং বলে আগামীকাল এর বিচার করা হবে, আজ একে থানায় একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে রেখে দাও। দুইজন মিলিটারী আমাকে নিয়ে এসে একটা ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। ঘরটার দরজা ভাঙ্গা ছিল। তারপর পাকসেনারা৪/৫ জন মেয়েকে থানায় নিয়ে আসে এবং তাদেরকে নিয়ে তারা আনন্দ উল্লাসে মত্ত থাকে। এদিকে রাত্রিতে মুষলধারে ঝড় আর বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। তখন আমি চিন্তা করি। আমাকে তো আগামীকাল গুলি করে মারবে, তাই শেষ চেষ্টা করলাম অর্থাৎ দরজাটা একটু জোরে প্রেশার দিলে দরজা খুলে যায়। আমি অমনি চোরের মতন ধীরে ধীরে ঘর হতে বেরিয়ে একটা খালের ধার দিয়ে খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে সারারাত্রি চলার পর ভোর হয়ে গেলে একটা বৃদ্ধ লোককে দেখতে পাই। তাকে দেখে আমি জড়িয়ে ধরি এবং বলি বাবা আমাকে কিছু খেতে দেন। লোকটি আমাকে তার বাড়ী নিয়ে যায় এবং আমাকে খেতে দেয়। তারপর আমি ভারতে আশ্রয় নেই।

এরপর যশোর ক্যান্টোনমেন্ট আমাদের দখলে এসে গেলে আমি একদিন রাত্রি বেলা বাড়ীতে যাই। গিয়ে আমার ছেলেকে ডাকি আমার স্ত্রী দরজা খুলে দেয়। তখন আমি দেখতে পাই আমার স্ত্রী বিধবার কাপড় পরে আছে এবং তার গায়ের অলঙ্কার বলতে কিছুই নেই। আমাকে দেখে সে কেঁদে ফেলে এবং বলে আমি যেদিন শুনতে পাই তোমাকে পাক বাহিনী মেরে ফেলেছে সেই দিন হতে আমি বিধবার কাপড় পরিধান করেছি। তারপর আমি আমার সমস্ত ঘনটা খুলে বলি।

স্বাক্ষর /-
লুৎফর রহমান মোল্লা

।। ১৭৩।।
শ্রী সংকর প্রসাদ ঘোষ
গ্রাম-আউড়িয়া, পোষ্ট-হাট বাড়ীয়া
থানা-নড়াইল, জেলা-যশোর

যশোরের চৌগাছায় পাকসেনাদের হাতে আমরা ধরা পড়ি। পাকসেনারা চৌগাছার হাইস্কুলে আমাদেরকে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাদের ঘড়ি টাকা পয়সা সব কিছু নিয়ে নেয়। তারপর প্রথমে আমাকে, জামা ও প্যান্ট খুলে, দু’জন পাকসেনা বাঁশের লাঠি দিয়ে সারা শরীরের প্রহার করতে থাকে। এই ভাবে প্রায় এক ঘণ্টা প্রহার করার পর আমার দুপা বেঁধে একটা আকড়ার সাথে পা উপর দিয়ে ঝুলিয়ে লাঠি দিতে সমস্ত শরীরের প্রহার করতে থাকে মেজর তখন চেয়ার পেতে বসে আছে। আর একদল আমাকে প্রহার করতে থাকে, আর একদল আমাকে প্রহার করা দেখে হাসতে থাকে, আর বলতে থাকে বল মাদার চোদ, টিক্কা খাঁন জিন্দাবাদ। আমারর সমস্ত শরীরে বেয়োনেট দিয়ে মারতে থাকে আর চাকু দিয়ে প্রতিটি নখ ফেড়ে দেয়। আমার সমস্ত শরীর হতে রক্ত ঝরতে থাকে তারপর যে কী হয় আমি বলতে পারি না। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আমি জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখতে পাই আমার পাশে আমার দুই বন্ধু ইলিয়াছ ও সুনিল কুমার বসু পড়ে আছে। তাদের শরীর হতে আমার শরীরের ন্যায় রক্ত ঝরছে। প্রহারের দরুন তাদের ও আমার শরীর ফুলে যায়। আমরা পানি খেতে চাইলে প্রশ্রাব এনে সামনে দিত। তার গন্ধ পেয়ে আমরা মুখ বন্ধ করতে থাকলে ইট দিয়ে এসে মুখে মারতো। সন্ধ্যার পর আমাদেরকে স্কুলের পিলারের নিকট নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে তিনজনকে তিনটা পিলারে পিঠমুড়া করে জড়িয়ে চেপে বাঁধে। আর মাজার সাথে পিলারে বেস্টন দিয়ে বেঁধে ফেলে আবার প্রহার করতে থাকে। আমরা পিপাসায় পানি পানি করে চিৎকার করতে থাকি। তখন বৃষ্টি নামে। উক্ত বৃষ্টির পানি আমাদের মাথায় পড়ে থাকে। উহা আমাদের শরীরর বেয়ে পড়তে থাকে উক্ত পানি খেয়ে আমরা পিপাসা মিটাই। তারপর দিন, হাত পায়ের রশি খুলে দেয় এবং আবার পিটাতে থাকে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, তোমরা মুক্তিবাহিনী কিনা? এবং ট্রেনিং জানো কি না? তখন আমরা বলি, না, আমরা ট্রেনিং জানিনা ও আমরা মুক্তিবাহিনীও নই। তারপর মারা বাদ দিয়ে পাকসেনারা ৩/৪ জন আমাদেরকে ধরাধরি করে তাদের গাড়িতে তুলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে নিয়ে আমাদেরকে একটা ঘরে বন্দি করে রাখে। তার ১০/১৫ মিনিট পর একজন হাবিলদার ও ৭/৮ জন মিলিটারী আমাদের নিকট আসে এবং আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, সত্যি করে বল, ভারতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং-এ যেতে ছিলে কিনা এবং অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে। তারপর আমরা তাদের কারো কোন জবাব দেই নি। তারপর আমাদের হাত আবার পিঠমুরা করে পিলারের সাথে বেধেঁ ১০/১৫ মিনিট সময় দিয়ে বলে যে এরমধ্যে যদি সত্য কথা না বলো তা হলে গুলি করে হত্যা করবো এই বলে আমাদের দিকে বন্দকু ধরে রাখে। আমরা জবাব দেই যে আমরা সত্যি বলছি আমাদের লোক হারিয়ে গিয়েছি তাদের খোঁজে আমরা এখানে এসেছি। আমরা ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে এখানে আসি নাই। তারপর আমাদের তিনজনকে একটা ঘরের মধ্যে ১৫ দিন রেখে দেয়। ঐ কয় দিনের প্রত্যেক দিনই খাবারের সময় এবং পায়খানা প্রশ্রাবের সময় কিল, ঘুষি, লাথি ইত্যাদি খেতে হতো। তারপর সেখান হতে যশোর কোতয়ালী থানায় পাঠিয়ে দেয়। ওখানে এক রাত্রি থাকার পরদিন কোর্টে ৫৪ ধারায় একটি মামলা দায়ের করে যশোর সেন্ট্রাল জেলে হাসপাতালে রেখে দেয়।

সেখানে বাঙ্গালী চিকিৎসক ছিলেন তারা আমাদেরকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। সেখানে ১২ দিন থাকার পর কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে মুক্তিলাভ করি। তারপর বাড়ী এসে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে উঠি। জুন মাসের ২০ তারিখে আমরা ধরা পড়ি এবং সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে যশোরের প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেট শেখ আবদুল্লা সাহেবের কোর্ট থেকে মুক্তি পাই।

স্বাক্ষর/-
শ্রী সংকর প্রসাদ ঘোষ
৬-৬-৭৩

।।১৭৪।।
মোঃ মানিক শিকদার
গ্রাম- চিলগাছা রঘুনাথপুর
ডাকঘর- কমলাপুর
থানা- নড়াইল
জেলা-যশোর

১৯৭১ সালের ৭ ই জুন রাত্রি প্রায় ভোর চারটার সময় ২০/২৫ জন রাজাকার ও মিলিটারী আমার বাসায় যায়। এবং বাসা ঘেরাও করে বাসার মধ্যে ঢুকে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। আমাকে ধরার সাথে সাথে বাঁশের লাঠি ও রাইফেলের বাট দিয়ে আমার পায়ের তালুতে, ঘারে, হাতের আঙ্গুলীতে এবং শরীরের বিভিন্ন গিড়ায় গিড়ায় প্রহার করতে থাকে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে যথাঃ
ই,পি,আর কোথায়?
তোর রাইফেল কোথায়?
তোর ভাই কোথায়?
তার জবাবে আমি বলি যে, আমি কিছুই জানি না। তারপর আমার বাড়ীতে আমাকে ঘন্টাখানেক প্রহার করার পর নড়াইল নিয়ে আসে এবং সেখানে নিয়ে এসে আবার প্রহার করতে থাকে এবং ঐ একই কথা বার বার বলতে থাকে, আমি অস্বীকার করায় প্রায় দু’ঘন্টা আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রহার করার দরুন আমার শরীর হতে রক্ত ঝরতে থাকে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তার আধা ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে আমি দেখতে পাই আমি ডাকবাংলার একটা কক্ষে এবং সেখানে আরও ১২/১৪ জন লোক আধামরা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। তারপর ৭ দিন উক্ত ডাকবাংলায় রাখার পর আমাকে যশোর মিলিটারীদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।

যশোর পৌছার পর আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়েই ৪/৫ জন মিলিটারী বুট আর বেতের লাঠি দিয়ে এক এক করে লাথি কিল, ঘুষি, আর প্রহার করতে থাকে। একজন মিলিটারী ৪/৫ হাত দূর হতে জাম করে এসে আমার মুখে লাথি মারে উক্ত লাথিতে আমার তিনটা দাঁত পড়ে যায়। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই, তার ঘন্টাখানেক পর আমার জ্ঞান ফিরে পেলে আবার প্রহার করতে থাকে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে যথাঃ
ই,পি,আর কোথায়?
রাইফেল কোথায়?
তোর ভাই কোথায়?
আমি জবাব দিই আমি কিছুই জানি না। তারপর আবার মারা শুরু করে এই ভাবে সার্কিট হাউসে দু’দিন দু’রাত ছিলাম। প্রায় সব সময়ই আমাকে প্রহার করত। উক্ত দু’দিনে আমাকে একটু পানিও পান করতে দেয় নাই। সেখান হতে আমাকে যশোর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একমাস সাতদিন থাকার পর আমি জামিন নিয়ে বের হয়ে আসি। কিন্তু প্রতিদিন আমাকে কোর্টে হাজির হতে হত। এই ভাবে ৪/৫ তারিখ কোর্টে হাজির হবার পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। আমাকে ধরার প্রধান কারন আমার বড় ভাই আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। আর আমার ছেলে ছিল মুক্তিবাহিনীতে। এই দুইটা কারণে আমাকে ধরে এবং প্রহার করে । জেল থেকে বেরিয়ে এসে দু’মাস চিকিৎসা করার পর সুস্থ হয়ে উঠি। এখনও শরীরের বিভিন্ন স্থানে জ্বালা পোড়া করে।

স্বাক্ষর /-
মোঃ মানিক শিকদার
৮/৬/৭৩
।।১৭৫।।
শ্রী বিনয় কৃষ্ণ দত্ত
মহেশপুর, যশোর

১৯৭১ সালের ১৩ শে মে রোজ রবিবার সকাল ১০ ঘটিকার সময় আমি গোসল করার জন্য বাড়ী হতে বের হই। এমন সময় দেখতে পাই দু’খানা খাঁন সেনার গাড়ি এসে আমাদের মহেশপুর টাউন কমিটি ঘরের সম্মুখে থেমে যায়। আমি ঐ গাড়ি দেখার সঙ্গে সঙ্গে গোসল না করে বাড়ী ফিরে যাই। তার ১০/১৫ মিনিট পর টাউন কমিটির চেয়ারম্যান সোজাসুজি আমার বাড়ী চলে আসে এবং আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর আমাকে বলে, চলো টাউন কমিটিতে, মেজর তোমাদের পরিচয় পত্র করে দিচ্ছে। তুমি উহা নিয়ে চলে আসবে। আমি সরল মনে তার সঙ্গে টাউন কমিটির সামনে চলে আসি এবং দেখতে পাই টাউন কমিটি হলের দরজা বন্ধ। তখন চেয়ারম্যান আমাকে বলে এখানে ৫ মিনিট অপেক্ষা কর, মেজর কিছুক্ষনের মধ্যে চলে আসছে। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই দক্ষিন দিক হতে দুটা পাক সেনার গাড়ি এসে আমাদের সামনে থেমে যায়। আমি গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পাই ১০/১২ জন হিন্দু ও মুসলমান বসে আছে। তারপর চেয়ারম্যান মেজরকে আমাকে দেখিয়ে বলে, এ এক মালাউন হায়, অমনি একজন খাঁন সেনা গাড়ি হতে লাফ দিয়ে নেমে আমাকে গাড়িতে উঠতে বলে, আমি গাড়িতে উঠার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট করে মহেশপুর হতে আধা মাইল দূরে ভালায়পুর নামক একটা ব্রীজ আছে, তার পূর্ব দিকে আম কাঠালের বাগান আছে, সেখানে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমাদেরকে গাড়ি হতে নামায়। আমি গাড়ি হতে নেমেই দেখতে পাই, ঐ খানে একটা গাছের নিচে ৪/৫ টা ছাগল আর একটা কাঠাল গাছে একটা যুবক গাছ হতে ঐ ছাগলগুলোর জন্য পাতা পাড়ছে। মেজর তাকে দেখেই ডাকে। লোকটি অমনি মেজরের ডাকে তার কাছে চলে আসে। তার হাতে ছিল একটা দা । মেজর দা খানা তার হাত হতে নেয় এবং ২-৪ মিনিট চেয়ে দেখার পর তাকে জিজ্ঞেস করে ইয়ে কিয়া হায়? সে বলে দা। তারপর দা খানা তার হাতে দিয়ে বলে, এই দা দিয়ে এই লোকগুলোকে জবাই করতে পারবে? লোকটি অস্বীকার করে। সঙ্গে সঙ্গে পিছন হতে একজন পাক সেনা রাইফেল নিয়ে দৌড়ে তার কাছে চলে আসে এবং তার ঘাড়ে এবং পিঠে দু’টা আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে পড়ে যায়। তার ২-৪ মিনিট পর সে মাজা বাঁকা করে সেখান হতে চলে যায়। তারপর আমাদের সবাইকে লাইন করে দাঁড় করায়। ৮ জন পাকসেনার মধ্যে তিনজন রাইফেল নিয়ে তিন দিকে আমাদের থেকে প্রায় ২০/২৫ গজ দূরে চলে যায় এবং আমাদের দিকে পজিশন নিয়ে থাকে। আর বাকি ৫ জন পাকসেনা প্রত্যেক একটা মোটা লাঠি হাতে করে আমাদের সবাইকে ঘাড়ে এক বাড়ি আর মাজায় দু’বাড়ি মারার পরে শেষে আমাদের সবাইকে পায়ে দড়ি লাগিয়ে হেঁচড়ে টেনে একটা গর্তের ধারে নিয়ে সবাইকে বেয়োনেট চার্জ করে আমাদের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। পরে আমাদেরকে একই গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি চাপা দিয়ে তারা চলে যায়। পাক সেনারা চলে যাবার পর প্রায় মিনিট দশেক পর আমি অতিকষ্টে ধীরে ধীরে ঐ গর্তের উপরে উঠি এবং আমার সঙ্গে আরো একজন লোক ধীরে ধীরে উপরে উঠে ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়েই প্রায় ২০/২৫ গজ রাস্তা চলার পর মাটিতে পড়ে যায়। তার কিছু সময় পর সে সেখানে মারা যায়। আমার পেটে একটা বেয়োনেটের খোঁচা গেলে নাড়ি বের হয়ে গিয়েছিল।আমি আমার গামছা দিয়ে পেট বেঁধে ৪০/৫০ গজ চলার পর একটা বাড়ী পাই এবং সেই বাড়ির মালিক আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। আমাকে পানি খাওয়াবার পর আমি সেখানে থাকতে চাইলে বাড়িওয়ালা খান সেনাদের ভয়ে আমাকে রাখতে অস্বীকার করে। তারপর তারা আমাকে ধরাধরি করে ভৌবর নদীর পাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে দেখতে পাই একজন লোক নৌকা নিয়ে জাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরছে। লোকটা আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে দেখে নৌকা নিয়ে নদীর তীরে আসে এবং আমার অনুরোধে আমাকে নদী পাড় করে দেয়। আমি অতিকষ্টে রামচন্দ্রপুর নামক এক গ্রামে সন্ধ্যা ৭ টার সময় এক বাড়িতে গিয়ে থাকার জন্য একটু জায়গা চাই কিন্তু ঐ বাড়িওয়ালা খান সেনাদের ভয়ে জায়গা দিতে অস্বীকার করে। আমি বলি আমার আর চলার শক্তি নাই তখন ঐ বাড়ির ৪ জন লোক একটা তক্তায় করে আমাকে নিয়ে রামচন্দ্রপুর স্কুলে রেখে আসার কথা বলে সুন্দরপুর নদীর ঘাটে ফেলে রেখে আসে। আমি সেখানে আধামরা অবস্থায় পড়ে থাকি। তখন রাত্রি ১০-৩০ মিঃ। সেই সময় কোটচাঁদপুর হাট হতে জালাল নামক একটা লোক সুন্দরপুর নদীর ঘাটে আমাকে দেখে তারাতারি করে মহেশপুর চলে এসে খবর দেয়। তৎক্ষণাৎ মহেশপুর হতে জালাল ও আরও চারজন লোক একটা বাঁশের মাচাল নিয়ে সেখানে চলে যায় এবং ঐ মাচালে করে আমাকে মহেশপুর নিয়ে আসে। আমাকে মহেশপুর নিয়ে এসে কোহিনূর বেগমের বাসায় রেখে এবং বজলু নামক একজন ডাক্তারের চিকিৎসায় ১০/১৫ দিন পর আমি সুস্থ হয়ে উঠলে ডাক্তার একটা গরুর গাড়ী ভাড়া করে আমার পরিবারের সকলকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। তারপর আমি ভারতে গিয়ে সিন্দ্রানী হাসপাতালে প্রায় দু’মাস চিকিৎসা করার পর সুস্থ হয়ে উঠি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই বাংলাদেশে চলে আসি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমি জানতে পারি আমি জানতে পারি আমার সঙ্গে যাদেরকে ধরে নেওয়া হয়েছে এবং আমার সঙ্গে যাদেরকে একই গর্তে পুঁতে রাখা হয়েছিল আমি ছাড়া আর সবাই নাকি মারা গেছে।

স্বাক্ষর/-
শ্রী বিনয় কৃষ্ণ দত্ত
২৭/১/ ৭৩

।।১৭৬।।
যশোর জেলার মহেশপুর থানার অধীন
মহেশপুর হাসপাতালে পাক সেনাদের কার্যাবলী

মহেশপুর থানা থেকে মহেশপুর হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় কোয়ার্টার মাইল হবে। খালিশপুর হতে একটা সরকারী কাঁচা রাস্তা মহেশপুর থানার পশ্চিম পার্শ্ব নিয়ে মহেশপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে বর্ডার পর্যন্ত গিয়েছে। মহেশপুর হাসপাতালটা পূর্ব পশ্চিম লম্বা। হাসপাতালের সামনে একটা মাঠ, পূর্বে ১০/১২ খানা মুচি বাড়ী, পশ্চিমে মহেশপুর বাজার আর উত্তরে হাসপাতালের সঙ্গেই লাগানো সরকারী রাস্তা। ঐ রাস্তার নীচেই একটা মরা নদী এবং নদীর উপরে হাসপাতাল থেকে প্রায় ১০০ গজ দুরে উত্তর দক্ষিন দিক লম্বা একটা ব্রীজ।

১৯৭১ সালের ১৫ ই এপ্রিল খান সেনারা যশোর থেকে কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, খালিশপুর হয়ে মহেশপুর চলে আসে। মহেশপুর এসেই তারা মহেশপুর হাসপাতালে ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদের মধ্য থেকে প্রায় ১৫০ জন মহেশপুর থানায় সব সময়ের জন্য রেখে দেয়। পাঞ্জাবী খান সেনারা মহেশপুর পৌছেই হিন্দু, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের বাড়ী-ঘর লুটপাট করায় এবং মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামের কর্মীদের ছাড়া যাদের সম্মুখে পায় তাদেরকেই গুলি করে মারে। খান সেনাদের মহেশপুর আসার পূর্বেই কিছু লোক ভারতে চলে যায় আর যারা ভারতে যায় নাই এখানেই আশেপাশে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল তাদেরকে ধরে নিয়ে সোজাসুজি হাসপাতলে নিয়ে যেত এবং সেখানে নিয়ে একটি রুমে বন্দী করে রাখত। মেজর আনিছ ছিলেন প্লাটুন ক্যাপ্টেন। খান সেনারা এইভাবে মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জ, খালিশপুর ইত্যাদি স্থান হতে লোকজনকে ধরে কাউকে সেখানেই গুলি করে মারত আর যাদের মারত না তাদের মহেশপুর হাসপাতালে নিয়ে এসে একটা বদ্ধ ঘরে বন্দী করে রেখে দিত। তারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ১০/১২ জনকে বের করে নিয়ে হাসপাতালের এরিয়ার মধ্যেই হাসপাতাল থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে ৫০/৬০ টা গর্ত করা আছে সেখানে নিয়ে কাউকে জবাই করত, কাউকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারত, আবার কাউকে লাইন করে গুলি করে মারত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাকি ২/৩ রাউন্ড গুলির শব্দ মহেশপুর বাজারের লোকজন পেত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গুলি করে লোক মারার খবর মহেশপুরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গেল। তখন থেকে খান সেনারা শুধু গর্তের ধারে নিয়ে জবাই করত আর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারত এবং অনেককে ভালায়পুর ব্রিজের উপর নিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় একটি বস্তায় ভর্তি করে বস্তার মুখ বেঁধে ব্রীজের উপর হতে ফেলে দিত। এ ভাবেই তারা জনসাধারনকে মেরেছে। আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে ৪/৫ দিন পাশবিক অত্যাচার করার পর তাদেরকেও ঐ সব গর্তে মেরে পুঁতে রাখত। এইভাবে প্রায় ৩/৪ শত লোককে একমাত্র হাসপাতালে মারা হয়েছে। কেননা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই মহেশপুরের স্থানীয় জনসাধারণ সেখানে গিয়ে নাকি দেখতে পায় হাসপাতালের পূর্ব দিকে মানুষের গন্ধে যাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে নাকে কাপড় দিয়ে তারা গিয়ে দেখতে পায়, প্রায় ৬০ টির মত গর্ত করা প্রতি গর্তে ৫/৭ টি করে কারও মাথা, কারও ডানা, কারও পা, কারও শরীরের অংশটাই পড়ে আছে। যদিও দীর্ঘ এক বছর পার হয়ে গেছে এবং সেখানে কোন নিদর্শন থাকার কথা নয়। আমি নিজে সেখানে গিয়ে দীর্ঘ একটা বছর পরও একটা মানুষের মাথা, প্রায় ২০/২৫ টা গর্ত ও মানুষের অনেক হাড় পাই।

স্বাক্ষর/-
দেবাসীষ দাস

।।১৭৭।।
আইনুল হক
গ্রাম- কচুবিল
থানা-মহেশপুর
জেলা-যশোর

মহেশপুর থানার কচুবিল পাক সেনাদের ঘাঁটিতে গনহত্যার বর্ণনা। কচুবিলে পাক মিলিটারীদের ক্যাম্প ছিল। সেখানে প্রায় ১০০ জন লোককে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়, প্রথমে তাদেরকে দুপা এবং দুহাত রশী দিয়ে বেঁধে একটা আম গাছের ডালে পা উপর দিকে ঝুলিয়ে রেখে লাঠি দিয়ে ও বন্দুকের বাঁট দিয়ে শুধু শরীরের বিভিন্ন জোড়ায় মারতে থাকে। প্রায় ৩ ঘন্টা মারার পর তারা অজ্ঞান হয়ে গেলে মাটিতে নামিয়ে ফেলে রেখে দেয়। জ্ঞান ফিরলে আবার তাদের মাটিতে শুইয়ে বুট দিয়ে পিঠের উপর উঠে খচতে থাকে এবং কাউকে ছুরি দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে কেটে লবন মাখিয়ে দিয়ে ফেলে রাখে। তাদের উপর দৈহিক পীড়ন করার পর একটা গর্তের মধ্যে নিয়ে ফেলে রেখে কিছু বাবলার কাটা তাদের শরীরের উপর দিয়ে জ্যান্ত মাটিচাপা দিয়ে চলে আসতো। এইভাবে প্রতিটি গর্তে প্রায় ৫/৭ জনকে রেখে বিভিন্ন উপায়ে তাদের উপর অত্যাচার করার পর জ্যান্ত অবস্থায় মাটিচাপা দিয়ে রাখতো। এইভাবে প্রায় ১৫/২০ টা গর্তে ১০০ জনকে জ্যান্ত কবর দিয়েছে।

স্বাক্ষর/-
আইনুল হক

।।১৭৮।।
বনবিহারী সিংহ
নওয়াপাড়া
যশোর

১৯৭১ সালে ২৭ শে মার্চে পাক বাহিনীর একটি দল সমস্ত বেরিকেড সরিয়ে চলে আসে নওয়াপাড়াতে।তারা জনসাধারণকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে এসে বেরিকেড উঠানোর কাজে লাগিয়ে দেয়। সেই সময় আমি সংবাদ পাই যে চেংগুটিয়া রেলওয়ে ষ্টেশন মাষ্টার সাহেবের নিকট হতে পাকবাহিনী নওয়াপাড়ার দিকে যাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে আমি স্থানীয় জনসাধারনদের জানাই। তারা নিরাপত্তার জন্য যে যতটুকু পেরেছে ততটুকু সাবধান হয়েছে। সেই সময় আমার ঘরে ছিলেন রুস্তম আলী সর্দ্দার (গার্ড ২৮ ডাউন এক্সপ্রেস), এস, এম, হক (গার্ড ৬৪ ডাউন প্যাসেঞ্জার), সালে আহম্মদ, নওয়াব আলী (চেকার), আইনুল হক (পোর্টার), ইমান আলী ও আব্দুল ওদুদ (পয়েন্টম্যান) গ্যাংসেট নবুশেখ গ্যাং, খালাসি শামছু। আমরা সবাই ডিউটিরত অবস্থায় ষ্টেশনে ছিলাম। কারন এছাড়া জীবনের আর কোন নিরাপত্তা ছিলো না আর আমরা প্রকৃতপক্ষে কোন অন্যায় করিনি বলে জানতাম। এরপর হঠাৎ ঐ দিন অর্থাৎ ২৭ শে মার্চ বেলা ১১ টার সময় এক দল পাক সেনা ষ্টেশনের অফিস কামড়ায় প্রবেশ করে। অফিসে প্রবেশ করে প্রথম চেয়ারে অবস্থানরত জনাব রুস্তম আলী সর্দ্দার সাহেব ও নওয়াব আলী সাহেবকে প্রথম হত্যা করে। আমি তাদের নিকটে ছিলাম। তারা হত্যা করেই ঘর হতে বের হয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করে বলে যে, কে জীবিত আছো কাছে এসো।এখানে বলা প্রয়োজন যে, উক্ত দু’জনকে হত্যা করার পর ঘরে অবস্থিত অন্য সবাই বেঞ্চের নীচে আশ্রয় করার ফলে তাদের পাক বাহিনী কর্তৃক ব্রাশফায়ারে কোন ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু পরক্ষণে ঢুকেই যখন তাদের সকলকে দাঁড়াতে বলে তখন আমি একটা আলমারির ও দেওয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে আত্নগোপন করে থাকি। দ্বিতীয়বার ঘরে প্রবেশ করে পাক বাহিনী জনাব সালে আহম্মদ ও জনাব এস, এম, হক সাহেবকে নৃসংশভাবে হত্যা করে। এবং আইনুল হক (পোর্টার) কে বাইরে বের করে গুলি করে কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে গুলিটি তার হাতে লাগে, ফলে জীবনে বেঁচে যায়।

প্রায় ২ ঘন্টা পর আব্দুর রব সাহেব (সহকারী ষ্টেশন মাষ্টার) আমার অফিস ঘরে এসে ডাক দেন আমার নাম ধরে এবং বলেন যে, পাক বাহিনী চলে গিয়েছে। তখন আমি উক্ত গোপন স্থান হতে আত্নপ্রকাশ এবং বাড়ী ফিরে এই দৃশ্যের কথা স্মরণ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এইভাবে কর্মরত ট্রেনের কর্মচারীবৃন্দকে তারা হত্যা করে। তবে যারা শহীদ হন তারা নওয়াপাড়া রেলওয়ে স্টাফ নন। তারা জড়ানো দুটো ট্রেনের গার্ড সাহেব ও চেকার সাহেব। ওয়াচম্যান জনাব আতর আলী সাহেবও শহীদ হন ঐ দিন।

এই মৃত দেহগুলি প্রায় ৪/৫ দিন পড়ে থাকার দরুণ পচে যায় কিন্তু সৎকারের ব্যবস্থা হয় নি এবং সাধারন মানুষ করতে সাহস করে নি। পরে কয়েকজনকে সাথে করে আমি মৃতদেহ গুলি সৎকারের ব্যবস্থা করি এবং কবরস্থ করি। পরে পাক বাহিনী নিজেদের দোষ চাপা দেবার জন্য বলে যে, ষ্টেশনে কে হত্যা করেছে তাদের ধরিয়ে দাও। তারা মানুষকে ভুল সংবাদ পরিবেশন করার চেষ্টা করে।

এরপর মাঝে মাঝে আমি ষ্টেশনে আসতে থাকি এবং সাথে সাথে ঘরে চলে যাই। জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি শ্রী যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহাশয়ের বাড়ীতে আশ্রয় করি। কিন্ত ১১ ই এপ্রিল তারিখে একজন পাক মেজর নওয়াপাড়া বাজারে আসে এবং স্থানীয় দালালদের ও দুষ্কৃতকারীদের নিয়ে একটি সভা করে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ী লুট করতে হবে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েদের উপর অত্যাচার চালাতে হবে।

এরপর উক্ত ১১ ই এপ্রিল তারিখে নওয়াপাড়ার বিভিন্ন এলাকার ও আশেপাশে লুটতরাজ শুরু করে দেয়। এতে বিহারীরা সবচেয়ে বেশী নৃসংশতার ছাপ রাখে। আমি যে গ্রামে ছিলাম সেই গ্রাম উক্ত দিন লুটতরাজ শুরু হলে ঐ গ্রাম হতে অন্যত্র পালিয়ে যাই।

স্বাক্ষর/-
বনবিহারী সিং`
২/৫/৭৩

।।১৭৯।।
অনিল কুমার মন্ডল
গ্রাম- পাজিয়া
ডাকঘর- পাজিয়া
জেলা- যশোর

১৯৭১ সালের ২৬ শে জুন, শনিবার সকাল ৭ টার দিকে ৫ জনের একটা পাক সেনার দল আমাকে নিজ বাড়ী হতে ধরে ফেলে। উক্ত দিন প্রায় ৫০/৫২ জন থানা মিলিটারী গাড়ী পাজিয়া গ্রাম ঘিরে ফেলে। সকালে তারা গ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

পাক সেনারা প্রথম ধরে জিজ্ঞাসা করে যে, আমি হিন্দু না মুসলমান। আমি নিজেকে হিন্দু বলে প্রকাশ করায় আমার উপর রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে। এবং উক্ত গ্রামের শ্রী রবি কুমার বাবু কোথায় আছেন তা জানতে চায় এবং আমাকেও মুক্তিফৌজের সাহায্যককারী বলে চিহ্নিত করে। উক্ত স্থান হতে শ্রী রবি কুমার বাবুর বাড়ীতে অবস্থিত পাক মেজরের নিকট নিয়ে হাজির করে।

পাক মেজর তখন বলে যে, তুমি মুক্তিফৌজ কিনা? তুমি ভারতে যাতায়াত কর কিনা? কিন্তু আমি অস্বীকার করি এবং বলি যে, আমি স্কুলে শিক্ষকতা করি এবং দৈনিক হাজিরা খাতায় উপস্থিত আছে সুতরাং উক্ত অভিযোগ মিথ্যা। একথা বলার পর একটা কাঠের লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করে ফলে আমার হাত দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়। তারপর আমাকে ওখানে বসিয়ে রাখে। সেইখানে নারায়ণ প্রসাদ চক্রবর্তীকে বসিয়ে পিঠে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করতে থাকলে সে বিকট চিৎকার করতে থাকে। তখন এক জন বাঙ্গালী এসে মেজরকে সংবাদ দেয় যে এক জন বাঙ্গালী বধুকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করেছে। এই সংবাদে মেজর আমাদের বসিয়ে রেখে চলে যায়।

তখন আমাদের ধরে অন্য ঘরে নিয়ে যায়। আমাদের অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ করে তৎকালীন পাকিস্তানের ২ জন দালাল। ঐ ঘরে গিয়ে দেখি রামচন্দ্র বিশ্বাস নামে একজন লোককে বেদম প্রহার করে ফেলে রেখেছে। উক্ত লোকের সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে।

আমাকে ও নারায়ণকে উক্ত ঘরে নিয়ে গিয়ে এক সেনার লাঠি, রাইফেলের বাঁট, বুট জুতা ও ঘুষি দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে বেদম প্রহার করলো। এইভাবে দিন ৮-৩০ হতে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বিভিন্ন পাক সেনা পর্যায়ক্রমে প্রহার করে।এইভাবে প্রহার করার পর আমাদের শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। তখন তারা প্রহার বন্ধ করে নির্দেশ দেয় যে, তিনজন বাঙ্গালী একে অপরের বিরুদ্ধে প্রহার শুরু করো। সেই নির্দেশমত আমাদের তিনজনের হাতে তিনটি লাঠি দিয়ে দেয় এবং বলে যে, এই লাঠি দিয়ে যদি একে অন্যকে প্রহার না করো তবে তোমাদের হত্যা করা হবে। তখন নিরুপায় হয়ে জীবন রক্ষার জন্য নিজেরা মারামারিতে প্রস্তুত হই। এইভাবে প্রায় এক ঘন্টা নিজেরা মারামারি করি। তখন পাক সেনারা এই মারামারি উপভোগ করতে থাকে এবং আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। নানাভাবে এই সংঘর্ষকে উৎসাহ দিতে থাকে। এইভাবে নিজেরা মারামারি করে প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। পাক সেনারা আমাকে আট স্থানে বেয়োনেট চার্জ করে। বাকী দু’জনকেও ঐ একই ভাবে বেয়োনেট চার্জ করে। রামের ঘাড়ে বেয়োনেট দিয়ে প্রায় দুই ইঞ্চি মতো ক্ষত করে। তখন আমরা মৃতের মত পড়ে থাকি এবং নড়াচড়া হতে বিরত থাকি। সেই সময় আমাদের শরীর হতে রক্তক্ষরণের ফলে দেহ অসাড় হয়ে আসতে থাকে।

তখন পাক সেনারা মৃত মনে করে আমাদের উপর লেপ তোষক দিয়ে ঢেকে দেয়। লেপের উপর বিভিন্ন ধরনের কাঠ চাপ দেয়। আমরা তখন জীবিত অবস্থায় মৃতের মতো শুয়ে থাকি। আমাদের উপর চাপানো কাঠের এক প্রকার সাদা পাউডার ছিটিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন স্থান হতে পেট্রোল ও কেরোসিনের তেল ছিটিয়ে দেয়। এই সমস্ত করার পর দেয়াশলাইয়ের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য আমাদের পুড়িয়ে মারা। তখন প্রায় ৬ টা বাজে। মেজরের বাঁশি বাজার পর পাক সেনারা ঘরের দরজা বাহির হতে বন্ধ করে চলে যায়। আমরা যাতে ঘরের বাইরে যেতে না পারি তার ব্যবস্থা করে।
যখন পাক সেনারা চলে যায় এবং আগুন জ্বলতে থাকে তখন আমরা অতি কষ্টে উঠে দাঁড়াই এবং ঘর হতে বাইরে যাওয়ার জিন্য দরজায় আঘাত করি কিন্তু বাহির থেকে বন্ধ থাকায় তা কিছুতেই সম্ভব হয় নাই। পরে নিরুপায় হয়ে ও আগুনের বিভীষিকা দেখে প্রাণ বাঁচাবার শেষ চেষ্টাস্বরূপ একটা ছোট দরজা লাথি মেরে ভেঙে ফেলি এবং অতি কষ্টে ঘর হতে বের হয়ে যাই। ঘর হতে বের হয়ে আমরা তিনজন নিকটস্থ একটা বাগানে প্রবেশ করি। বাগান হতে তিনজন তিন দিকে চলে যাই। পাক সেনারা তখন গ্রাম হতে চলে গিয়েছে। আমি মহর আলী নামে এক ব্যাক্তির বাড়ীতে আশ্রয় নেই। সেখান হতে আমার আত্নীয়রা আমাকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করায়।

স্বাক্ষর/-
অনিল কুমার মণ্ডল
৪/৪/৭৩

।।১৮০।।
সুধীর কুমার নাথ
গ্রাম- মদার দাঙ্গা
ডাকঘর- পাঁজিয়া
থানা- কেশবপুর
জেলা- যশোর

২৬ শে জুন, (১৯৭১) রাতে পাক বাহিনী গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। আমি এ সংবাদ পেয়ে পালিয়ে যাই এবং একটা ডোবাতে আশ্রয় নিই। পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে পাক বাহিনীর বর্বরোচিত কিছু ঘটনা অবলোকন করি।

সে দিন বৃষ্টি হচ্ছিল। অনুমান সকাল ৯ টার দিকে আমি এই ঘটনার সম্মুখীন হই। জনৈক ব্যক্তির বিধবা স্ত্রীকে এক জন পাক সেনা ধর্ষণ করে ঘরের বাইরে চলে আসে। সেই সময় স্ত্রী লোকটিও ঘর হতে বিবস্ত্র হয়ে বের হয়ে আসে। তখন আর একজন পাক সেনা তাকে ঘরে নিয়ে যায় এবং তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়।

এইভাবে তিন জন পাক সেনা পর্যায়ক্রমে তার উপর অত্যাচার চালায়। তিনি তখন এর হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাক সেনাদের পা জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু বর্বর পাক সেনারা তা শোনে না। তৃতীয় পাক সেনা যখন ঘর হতে বের হয়ে আসে সেই সময় আমি ওখান হতে চলে আসি। আসার পথে তাকে আমি এক ঘরের পাশে কাঁদতে দেখি এবং সারা কাপড়ে অত্যাচারের কাল রক্ত লেগে থাকতে দেখি। মহিলার বয়স অনুমান ২৮ বৎসর। তিনি স্বাস্থবতী ছিলেন বিধায় জ্ঞান হারাননি। আরেক ব্যাক্তির দু’জন অবিবাহিত কন্যার উপর ঐ দিন পাক সেনারা পাশবিক অত্যাচার চালায়। এই গ্রামে প্রায় শতাধিক মহিলার উপর পাক সেনারা পাশবিক অত্যাচার চালায় ঐ একই দিনে ।

স্বাক্ষর/-
সুধীর কুমার নাথ
৪/৪/৭৩
।।১৮১।।
মিঃ মানিক মিয়া (পুলিশ)
থানা- মনিরামপুর
জেলা- যশোর

২৯ শে মার্চ আমি যশোর জেলার কোতয়ালী থানার বসন্দিয়া পুলিশ ফাঁড়ি হতে পাক বাহিনীর আক্রমনের খবর পেয়ে সেখান হতে লোহাপাড়া থানার অন্তর্গত কালনা নামক গ্রামে গিয়ে এক মাস অতিবাহিত করি। সেখান হতে পুনরায় লোহাগড়া থানায় চলে আসি।

মে মাসের ৯ তারিখে আমি আমার এক আত্নীয়ের খোঁজে যশোর শহরে চলে আসি। যশোর শহরের দড়াটানায় আমাকে এক বিহারী দেখে বন্দী করে। এবং আমাকে ক্যান্টনমেন্ট এ পাক সেনার নিকট পৌছে দেয় ক্যান্টনমেন্টে পৌছার পর মিলিটারি সুবেদার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে- মুক্তিবাহিনী কোথায়? তারা কোথায় ট্রেনিং নেয়? আমি তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে অস্বীকার করায় আমাকে বেতের মোটা লাঠি দিয়ে, চীনা রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার পায়ে, হাতে ও পিঠে প্রহার করতে থাকে এবং প্রহার শেষে হাত, পা, বেঁধে আমাকে রৌদ্রে মাঠের মধ্যে ফেলে রাখে। এই ভাবে ৩/৪ ঘন্টা রৌদ্রের মধ্যে রাখার পর আবার ঘরে নিয়ে যেত। এবং আমার চারিদিক প্রহরী রেখে আমাকে কাজ করাত। কাজ করার মাঝে মাঝে লাঠি দিয়ে অথবা বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিঠে আঘাত করত। দিন রাতের মধ্যে অনুমান দু ছটাক চাউলের ভাত খেতে দিত। আমার চোখের সামনে ৮/১০ জন লোককে শুধু লাঠি দিয়ে পিটাতে পিটাতে মেরে ফেলে দেয়। অনেক লোককে বিকাল ৬ টার পর হতে চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে যেত। হাজত থেকে কিছু লোক তাদের দিয়ে গর্ত খোঁড়াতো এবং যাদের গাড়ীতে করে নিয়ে যেত তাদেরকে লাইন করে গুলি করে হত্যা করতো।এই ভাবে প্রত্যেক দিন রাত্রিতে মিলিটারীরা গণহত্যা করতো।

আমি এক মাস ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। আমি যেই কয়দিন ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম ঐ কয়েক দিন তারা অনুমান ৭/৮ শত লোককে বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করেছে। আমার উপর নির্যাতন চালানোর পর আমার উপর গুলির অর্ডার হয়ে যায়। আমি উক্ত খবর আমার স্ত্রীর নিকট ক্যান্টনমেন্ট হতে লোক মারফত পাঠিয়ে দিই। তারপর আমার স্ত্রী একজন পাঞ্জাবী হাবিলদারের নিকট এক জন লোক নিয়ে যায়। এবং তাঁকে অনুরোধ করার পর তিনি মেজরের নিকট গিয়ে আমার জন্য সুপারিশ করেন। তারপর মেজর আমাকে ডেকে বলে আমি তোমাকে হাবিলদারের অনুরোধে মুক্তি দিলাম। হাবিলদারটার নাম ছিল কোরবান খাঁন। মুক্তি দেবার সময় আমাকে মেজর বলে দিলেন তুমি এখনই পুলিশ লাইনে গিয়ে হাজির হবে। যদি হাজির না হও, তাহলে তোমাকে গুলি করে মারা হবে। তারপর দুজন রেঞ্জার পুলিশ আমার সঙ্গে দিয়ে আমাকে পুলিশ লাইনে পৌছে দেয়। সেখানে বিহারী সুবেদার আমির হোসেন সাহেবের নিকট আমাকে হাজির করেন। আমি সেখানে হাজির হয়ে ছুটির জন্য দরখাস্ত করি। দরখাস্ত মঞ্জুর না করে আমাকে মনিরামপুর থানায় পোষ্টিং করে। এখানে এসেই আমার অসুখ হয়। তিন মাস অসুখ অবস্থায় কাটাই। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

স্বাক্ষর/-
মানিক মিয়া
৪/৪/৭৩

।।১৮২।।
মোঃ শহীদুল ইসলাম
গ্রাম-বেড়ী
ডাকঘর- জাদবপুর
থানা- শারসা
জেলা- যশোর

১৫ই আগষ্ট ভোর রাত চারটার সময় আমাকে এক জন রাজাকার নাভারন বাজার হতে ধরে এবং রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়েই আমাকে উক্ত রাজাকার বেতের লাঠি দিয়ে ভীষণ প্রহার করে। এরপর সেক্রেটারীর নির্দেশে আমার চোখ বেঁধে মটরে তুলে যশোর ক্যান্টনমেন্টে চালান দেয়। সেখানে নিয়ে চোখ খুলে দেয় এবং মেজরের নিকট আমাকে হাজির করে। ৪/৫ জায়গায় ষ্টেটমেন্ট দেবার পর আমাকে ক্যান্টনমেন্টে এফ, আই, ও, তে হাজতে আটকিয়ে রাখে। প্রত্যেক দিন সকাল ও বিকালে হাজত হতে বের করার সময় এবং হাজতে ঢুকানোর সময় প্রত্যেককে ভীষণ প্রহার করতো। আমাকে হাজত হতে বের করে বাহিরে নিয়ে যেত এবং প্রথমে বেতের লাঠি দিয়ে প্রহার করার পর বুট দিয়ে লাথি, চড়, কিল, ঘুষি, বুট দিয়ে শরীরের উপর উঠে খচিত এবং সর্বশেষ পায়ের তলায় রুল দিয়ে প্রহার করার পর সিগারেটের আগুন শরীরের বিভিন্ন স্থানে চেপে ধরতো। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করত, সত্যি করে বলো, তোমার সাথে কে কে ছিল। তারপর আমার শরীর হতে এক পাউন্ড রক্ত নিয়ে হাজতের মধ্যে রেখে দেয়।

এইভাবে আমাকে আড়াই মাস যশোর ক্যান্টনমেন্টে রাখার পর নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমাকে সেখান হতে যশোর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেন্ট্রাল জেলে আসার পর পর আমার সমস্ত শরীর ফুলে যায় এবং যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি। ঐ মাসের শেষের দিকে একজন মেজর কয়েকজন মিলিটারীকে সঙ্গে করে সেন্ট্রাল জেলে চলে আসে এবং আমাদের ২০/২৫ জনের প্রত্যেকের শরীর হতে এক পাউন্ড করে রক্ত নেয়।

তারপর ডিসেম্বরের ৭ তারিখে যশোর হতে পাঞ্জাবী সৈন্যরা অন্যত্র চলে যায়। ঐ দিন যশোর শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী জেল খানার তালা খুলে দিলে আমরা জেল হতে বের হয়ে আসি। এবং সেই দিনই আমি বাড়ী চলে আসি। আমি প্রায় আড়াই মাস যশোর ক্যান্টনমেন্ট হাজতে ছিলাম। উক্ত হাজতে আমার চোখের সম্মুখে তিনটা লোক প্রহারের দরুন মারা যায়। এবং প্রত্যেক দিন সন্ধ্যার পর হাজত হতে ২০/২৫ জন করে লোককে বের করে নিয়ে যেত, তাদেরকে আর ফিরে আনতো না। এই ভাবে বহু লোককে তারা বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করেছে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ শহিদুল ইসলাম
২২/৪/৭৩

।।১৮৩।।
মোঃ মনছোর আলী
গ্রাম- হাকোবা
ডাকঘর- মনিরামপুর
থানা- মনিরামপুর
জেলা- যশোর

১৯৭১ সালের ১৪ ই আগষ্ট ৩০/৩৫ জন মিলিটারী হাকোবা হাই স্কুল হতে বেলা ১০ ঘটিকার সময় হাকোবা গ্রামে যায়। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তারা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পাঁচজনের একটি দল আমার বাড়ীতে চলে যায় এবং আমাকে ধরে ফেলে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে, তুমি হিন্দু না মুসলমান? আমি উত্তর দিই দেই যে, আমি মুসলমান। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করে, এই গ্রামে হিন্দু আছে কি? আমি উত্তরে বলি আছে। আমি হিন্দু পাড়া দেখিয়ে দেই। মিলিটারীরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে হিন্দু পাড়ায় ঢুকে পড়ে। আমার বাড়ী হতে হিন্দু পাড়া যাওয়ার পূর্বে আমার পাশের বাড়ীতে একজন স্ত্রীলোক, ১ সন্তানের মাতা, ভাত রান্না করছিল। মিলিটারীরা তাকে ধরে ফেলে এবং ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। তার উপর প্রায় দেড় ঘন্টা সময় পর্যন্ত পাশবিক অত্যাচার করার পর যখন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সেই সময় তাকে ফেলে রেখে মিলিটারীরা হিন্দু পাড়ার দিকে চলে যায়। হিন্দু পাড়ায় গিয়ে উক্ত দল মুরগী খুঁজতে থাকে। বিকাল তিনটার দিকে তারা শ্রী অনিল কুণ্ডের বাড়ীতে ঢোকে। তাঁর বাড়িতে তিনজন স্ত্রীলোক ছিল। তাঁরা হলেন অনিল কুণ্ডের স্ত্রী, তাঁর মাতা, আর তৃতীয়জন তাঁর বোন। তাঁর স্ত্রী ঘরের মধ্যে কাঁথা সেলাই করছিল। তাঁর মাথা ও বোন বারান্দায় বসে ছিলো। মিলিটারীরা উক্ত বাড়ীর ভিতর ঢুকেই দুজন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর একজন সেন্ট্রি দিতে থাকে, আর একজন অনিল কুণ্ডের বোনের হাত ধরে হেঁচড়ে টানতে থাকে। তা দেখে তাঁর মা চিৎকার করতে থাকে। একজন মিলিটারী তার মাতাকে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে।কিন্তু অনিল কুণ্ডের বোনকে ঘরের মধ্যে নিতে না পেরে তাকেও ভীষণ প্রহার করে। তাঁর স্ত্রীকে ৩/৪ জন মিলে প্রায় দু’ঘন্টা পাশবিক অত্যাচার করে। কিন্তু ঐ সময় অনিল কুণ্ডের বড় ভাই সুধীর কুমার কুণ্ড ও একজন বৃদ্ধলোক হরিপদ কুন্ড বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু মিলিটারীরা তাদের বাড়ীতে ঢুকেই তাদের দুজনকে ধরে ফেলে এবং একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে বন্দি করে রেখে দেয়। তারপর মিলিটারীরা উক্ত পরিবারের উপর পাশবিক অত্যাচার করার পর আবার হাইস্কুলে চলে আসে। কিন্তু তাদের সঙ্গে যে অন্যান্য পার্টি গ্রামের ভিতর গিয়েছিল তারা গ্রাম হতে হাঁস মুরগী ইত্যাদি ধরে নিয়ে আসে। তারা কোন মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় নাই। যে দুটা মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হয় তাদের একজন মুসলমান আর দ্বিতীয়জন হিন্দু। তাদের উপর পাঁচজন মিলিটারী পাশবিক অত্যাচার করার দরুন তাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। অনেক ঔষুধপত্র খাওয়ানোর পর বর্তমানে তারা সুস্থ হয়ে উঠেছে। উক্ত ঘটনার এক মাস পূর্বে অনিল কুণ্ডকে পাক মিলিটারীরা রাস্তা থেকে ধরে ফেলে এবং তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং তাকে তারা গুলি করে হত্যা করে। তারপরই উক্ত ঘটনা ঘটে যায়।

স্বাক্ষর/-
মোঃ মনছোর আলী
৫/৪/৭
।। ১৮৪ ।।
বিকাশ চন্দ্র মল্লিক
মনিরামপুর
যশোর

আমি, সিদ্দিক, ও ইউনুস এই তিনজন পাক সেনাদের হাতে বন্দী হই। তারা আমাদেরকে ঝিকরগাছা নিয়ে যায়। ঝিকরগাছা নিয়ে যাবার পথে আমাদেরকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে ভীষণ প্রহার করতে থাকে। ঝিকরগাছা হতে চোখ বেঁধে গাড়ীতে করে সারসা তাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একটা ঘরের মধ্যে দু’ফুট পানি ছিল। সেখানে দু’হাত পিছনের দিকে রশি দিয়ে বেঁধে একটা জানালার শিকের সাথে বেঁধে রাখে। রাত শেষে আবার সেখান হতে বাইরে নিয়ে গিয়ে ছড়ি দিয়ে,বেয়নেট দিয়ে, বুট দিয়ে, লাঠি দিয়ে, ভীষণ প্রহার, চর, ঘুষি, লাথি দিয়ে ৪/৫ জন মারতে থাকে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে কোথায় পার্টি আছে?
কোন কোন এলাকায় অপারেশন করেছ?
কোথায় ট্রেনিং নিয়েছ?
কয়জন পাক সেনা মেরেছ?
ভারতে কার নেতৃত্বে ট্রেনিং নিয়েছ?
তুমি ভারতীয় ক্যাপ্টেন না মেজর ইত্যাদি বলতো আর অকথ্য ভাষায় গালি দিত ও প্রহার করত। জ্ঞান হারিয়ে ফেললে প্রহার করা বাদ দিত। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখতে পেতাম আমার মাথায় পানি।

এইভাবে দুইদিন দুইরাত আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর ১১ ই অক্টোবর আমাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে দুইদিন থাকার পর মেজর আমার ষ্টেটমেন্ট নেয়। তুমি যুদ্ধ করতে এসে অন্যায় করেছ, না ঠিক করেছ? তার জবাবে আমি বলি, মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার্থে ও মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরলে যদি অপরাধ হয় তাহলে আমি অন্যায় করেছি। ঐ কথা বলার পর মেজর আমার প্রহার বন্ধ করে দেয়। পুনরায় আমাকে হাজত ঘরে পাঠিয়ে দেয়। এর তিন দিন পর এক বিহারী আমাকে গোপনে হাজত হতে বের করে গুলি করতে নিয়ে যায়। গুলি করার আগে মেজর জানতে পেরে আমার নিকট চলে যায় এবং আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে আর বিহারীকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়।

সেই দিন অর্থাৎ ১৭ ই অক্টোবর আমাকে ছেড়ে দিবে বলে মেজর দুইজন সেন্ট্রিসহ আমাকে যশোর শহরে নিয়ে আসে এবং সেন্ট্রাল জেলে রেখে যায়। তারপর পাক সেনারা আহত হতে থাকে।

নভেম্বরের শেষের দিকে জোর পূর্বক আমাদের প্রত্যেক আসামীর শরীর হতে এক পাউন্ড থেকে দুইপাউন্ড পর্যন্ত রক্ত জোরপূর্বক নিয়েছে। রক্ত না দিলে ভীষণ প্রহার করত।

৭ই ডিসেম্বর আমরা যশোর জেলখানা হতে মুক্তি পাই। মনিরামপুর থানা ৭ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়। ৮ই ডিসেম্বর আমি, রতন, আখতার এই তিনজন মনিরামপুর থানায় চলে আসি এবং ও, সি, র নিকট হতে রাজাকারদের রেকর্ডপত্র নিয়ে নেই। তারপর আমরা মনিরামপুরে ঘোষণা করে দেই যাদের নিকট অস্ত্রশস্ত্র আছে, তারা ৪/৫ দিনের মধ্যে মুক্তিফৌজ অফিসে জমা দাও। তাদেরকে কিছু বলা হবে না। ঘোষনা করার কয়দিনের মধ্যেই ৩০০/৩৫০ টি রাইফেল আমাদের অফিসে জমা হয়ে যায়।

ডিসেম্বরের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন সফিউল্লা ই, পি, আরদেরকে সঙ্গে করে মনিরামপুর চলে আসেন আমরা তাঁর হাতে আমাদের উদ্ধার করা অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেই। তারপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকা গিয়ে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র তাঁর নিকট জমা দিয়ে আসি।

স্বাক্ষর/-
বিকাশ চন্দ্র মল্লিক
২/৪/৭৩

।। ১৮৫।।
মোঃ আব্দুস সাত্তার
গ্রাম-কবুর হাট
ডাকঘর- জগতী
থানা ও জেলা-কুষ্টিয়া

১২-৬-৭১ সালে বিকাল তিনটার সময় দু’জন পাক দালাল অস্ত্রশস্ত্রসহ কবুর হাটে আমার দোকানে এসে জিজ্ঞেস করে সিরাজ মিয়া কোথায়। আমি উত্তর করি তা তো বলতে পারবো না। তারপর আমাকে বলে তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। কারন মেজর সাহেব তোমাকে ডেকেছে। আমি তাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকার করলে তারা জোর করে আমাকে একটা রিকশায় করে কুষ্টিয়া নিয়ে যাওয়ার সময় চৌহাস ও কুমার গারার ব্রীজ, যেখানে মিলিটারী পাহাড়া দিত, পৌছিবার সঙ্গে সঙ্গে একজন মিলিটারী আমার নিকট চলে আসে এবং আমাকে জিজ্ঞেস করে, ভোট দিয়েছ কোথায়? আমি উত্তর করি নৌকায় দিয়েছি। অমনি আমার গালের উপর তিন চারটা চড় কষে মারে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। তারপর আমাকে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনে নিয়ে গেলে একজন মেজর এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ীতে কয়টা বন্দুক আছে? আমি বলি আমার বাড়িতে কোন বন্দুক নাই। আমি বন্দুক দিয়ে কি করবো। আমি বন্দুকের কথা অস্বীকার করাতে আমাকে মেজরের নির্দেশে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ঘরে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ১৫/২০ জন মিলিটারী এসে আমাকে ঘরে নিয়ে কেউ ঘুসি,কেউ লাথি, কেউ বুট দিয়ে খচন আবার কেউ বা বেতের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করতে থাকে এবং পরস্পর হাসতে থাকে। এইভাবে প্রায় ১৫ মিনিট শারীরিক অত্যাচারের পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। প্রায় আধ ঘন্টা পর আবার জ্ঞান ফিরে পাই। তারপর আমাকে একটা অন্ধকার কোঠায় নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি সেখানে গিয়ে পাই আমার মত তিনটি লোক সেই ঘরের মধ্যে অর্ধ মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বিকেল পাঁচটার সময় আবার একজন মিলিটারী এসে আমাকে সেখান হতে বের করে একটা বড় ঘরের মধ্যে নিয়ে যায় এবং মাটিতে উপুড় করে শোয়ায়ে দেয় তারপর একজন ঘাড়ের উপর এসে চড়ে। দুজন দুহাত পাড়া দিয়ে ধরে। দুজন দুপায়ের উপর চড়ে, আর ৪/৫ জন বুট পায়ে দিয়ে খচতে থাকে তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। ১৫/২০ মিনিট পর জ্ঞান ফিরলে আবার বন্ধ করে রেখে দেয়।

এইভাবে ৪/৫ দিন নিয়মিত শারিরীক নির্যাতন চালানোর পর একজন ক্যাপ্টেন এসে আমাদেরকে বন্ধ ঘরে দেখে যায় এবং একজন মিলিটারীকে জিজ্ঞাসা করে এদেরকে খাবার দেওয়া হয়েছে ? মিলিটারীটা উত্তর করে, না। তখন নির্দেশ দেয় তাড়াতাড়ি এদের জন্য খাবার নিয়ে এসো। এই বলে ক্যাপ্টেন চলে যায়। মিলিটারিটা আমাদের জন্য খাবার আনে। আমার উক্ত খাবার না খেয়ে উহা ফেরত দেই।

ঐ মাসের ১৫ তারিখে ক্যাপ্টেন আমাকে থানা হাজতে পাঠায়। এবং ২০ তারিখে ক্যাপ্টেন কুষ্টিয়া হতে বদলী হয়ে যাবার সময় থানার ও,সি, কে বলে যায়, ছাত্তার নামক লোকটা সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নেবে। এই লোক যদি দোষী না হয় তাহলে একে মুক্ত করে দেবেন। তারপরও ও,সি,-এর নির্দেশে আমাকে ২১ তারিখে থানায় হাজির করা হয়। ও,সি আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ী কোথায়, নাম কি,ইত্যাদি। তারপর ও,সি-এর নির্দেশে আমাকে জেলে নিয়ে রাখা হয়। সেখানে জেলের ভিতর বিহারীরা আমাকে ৩/৪ দিন পরপর মারধর করতো। এই ভাবে জেলের মধ্যে প্রায় পাঁচ মাস থাকার পর আমার গ্রামের জনসাধারণের চেষ্টায় আমাকে জামিন দেয়।

তারপর বাড়ী চলে আসি। মামলা চলতে থাকে। ৪/ দিন মামলা চলার পর মহকুমা হাকিম আমাকে বেকসুর খালাস দেয়।

স্বাক্ষর/-
আব্দুস সাত্তার (বয়াতী)

।।১৮৬।।
মোঃ জহুরুল ইসলাম
গ্রাম- কবুরহাট
ডাকঘর-জগতি
থানা ও জেলা- কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের ৯ ই আগষ্ট আমি সদর হাসপাতালে ঔষুধের জন্য যাই। হাসপাতালে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ২০/৩০ জন বিহারী ও জাতীয় মিলিশিয়া এসে আমাকে ঘিরে নিয়ে ধরে ফেলে। তারপর আমার দুহাত একসঙ্গে বেঁধে ভীষণভাবে প্রহার শুরু করে এবং জিজ্ঞাসা করে তোম লোক কেতনা মিলিটারী মারা? তোম লোক কেতনা বিহারী মারা? সাচ্চা বলেগা ত ছোড় দেগা। তোম ঝুট বলেগা ত খতম কর দেয়া। আমি তাদের কথা অস্বীকার করি। তখন আমাকে শোয়ায়ে আমার বুকের উপর ৩/৪ জন মিলিটারী উঠে খচতে থাকে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি । প্রায় আধা ঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তারপর ৫।৭ বিহারী এসে আবার মারতে মারতে হাউজিং অফিসে নিয়ে যায় এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে আমার চোখ বাঁধবে, এমন সময় ও,সি সেখানে চলে আসে এবং আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার বাড়ীতে কয়টা বন্দুক আছে এবং তুমি কয়টা মিলিটারী এবং কয়টা বিহারী মেরেছ? আমি উত্তর করি আমি কোন বিহারী ও কোন মিলিটারী মারি নাই এবং আমার বাড়ীতে কোন বন্দুক নাই। তখন ও,সি আমাকে তার হাতে যে রুলার ছিল সেই রুলার দিয়ে আমার পিঠে ১০/১২ টা বাড়ীও ঘা মারে। থানায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে রেখে দেয়। তার পরদিন বেলা চারটার সময় মিলিশিয়া ও,সি- এর অফিসে আমাকে নিয়ে হাজির করে। সে দিনও ও,সি আমাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। আমি অস্বীকার করাতে সে দিনও ও,সি- এর অফিসে আমাকে লাঠি দিয়ে ভীষণ প্রহার করে। মারার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আমি একটু পানি চাইলে ও,সি একটা মিলিসিয়াকে এক গ্লাস পানি এনে দিতে বলে। তারপর মিলিসিয়াটি আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। আমি পানিটুকু খাবার পর আবার আমাকে নিয়ে সেই ঘরে রেখে দেয়। আমি তখন জেলা বোর্ডে চাকুরী করতাম। জেলা প্রশাসক আমার ধরা পড়ার খবর পেয়ে আমাকে মুক্ত করার জন্য থানার ও,সি,-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার চেষ্টায় আমাকে ৫ দিন পর রাত্রি ৪ টার সময় বদ্ধ ঘর হতে বের করে ও,সি- এর সামনে হাজির করে। ও,সি, আমার ঠিকানা লিখে নিয়ে আমাকে মুক্তি দেয় আমি সেই দিনই একটি রিকসায় বাড়ী পৌছি। উল্লেখ্য যে থানার ও,সি ছিল বিহারী।

টিপসহি
মোঃ জহিরুল ইসলাম

।।১৮৭।।
মোঃ আব্দুল রশীদ মণ্ডল
গ্রাম- নওপাড়া
ডাকঘর- মীরপুর
থানা- মীরপুর
জেলা- কুষ্টিয়া

আষাঢ় মাসের ২৫ তারিখে বেলা তিনটার সময় এক ট্রাক মিলিটারী রাজাকার মিলে প্রায় ১০০ জন আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমি তখন নওয়াপাড়া স্কুলে বিশ্রাম করছিলাম। এমন সময় কয়েকজন মিলিটারী স্কুলের ভিতরে ঢুকে আমাকে ধরে ফেলে এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে ভীষণ প্রহার করতে থাকে। তারপর তাদের গাড়িতে করে মিরপুর থানা শান্তি কমিটিতে নিয়ে যায়। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নাম চুনু চৌধুরী। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর চুনু চৌধুরী আমাকে বললো- যাও, ডাক্তারের ঔষুধপত্র ভারতে পাঠাওগে। ডাক্তার সাহেবের ছেলে সুফি ছাত্রলীগ কর্মী ছিল। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নির্দেশ দিলেন আমাকে কেলুগড়া রাস্তার পার্শ্বে গুলি করে মারা হবে। কিন্তু ক্যাপ্টেন আমাকে না মেরে কুষ্টিয়া পাক হানাদারদের ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে বেত,লোহার রড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রহার করে, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার পরে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তিন ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে পাই। আমার সমস্ত শরীর মারের চোটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বিভিন্ন জায়গা ফেটে রক্ত ঝরছিল। আমি ব্যথার যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। আমি একটু পানি চাইলে আমাকে পানি না দিয়ে প্রশাব এনে দিত। তিনদিন পর আমাকে মেজরের নিকট নিয়ে যায়। মেজর আমাকে দেখে তখনই তার স্টাফকে নির্দেশ দিল এ লোকটাকে এখনই হাসপাতালে ভর্তি কর। তারা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। সেখানে দুমাস চিকিৎসার পর আমাকে মেজরের আদেশে কুষ্টিয়া জেলে পাঠিয়ে দেয়। থানার দারোগাকে চার হাজার টাকা দেবার পর দারোগা আমার অনুকূলে রিপোর্ট মেজরের নিকট পাঠায় এবং আমাকে নির্দোষী খালাস করে দেয়।

টিপসহি
মোঃ আব্দুল রশীদ মণ্ডল

।।১৮৮।।
মোঃ আবুল কাসেম মণ্ডল
গ্রাম- ধর্ম্মদা, ডাকঘর- চর প্রাগপুর
থানা- দৌলতপুর, জেলা- কুষ্টিয়া

আমি সৈয়দপুর চাকুরী করতাম। ২৭ শে মার্চ পুলিশ লাইন পাক বাহিনীর অধীনে চলে যায়। সেই সময় পুলিশ লাইন থেকে আমাকে সহ বহু পুলিশকে পুলিশ লাইনেই অবরোধ এবং নজর বন্দী করে রাখা হয়। নজরবন্দী থাকাকালীন আমাকে দিয়ে যখন প্যারেড করিয়ে নিত। সারা দিন তাদের প্যারেড করতে হতো।

সকালে ২০ থেকে ২৫ জন পুলিশকে ধরে নিয়ে গিয়ে সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট রানওয়ের জন্য মাটি কাটিয়ে নিত। কোন সময় দড়ি বেঁধে নিয়ে যেত। পরাজিত সৈনিকদের মত ব্যবহার করা হত। বিভিন্ন প্রশ্ন করত।কিন্তু আমি সব সময় কিছু জানিনে বলে নির্দোষ প্রমান করার চেষ্টা করেছি এবং প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানতাম না। সামরিক ছাউনিতে আমাকে সাত (৭) দিন রাখে। সেই ৭ দিন খাবার দিত প্রত্যেকদিন সকালবেলা ১ খানা করে রুটি । ক্ষিদে কেউ যদি খাবার চেত তার উপর নেমে আসত দুর্যোগ। তাকে বেত দিয়ে,রাইফেলের বাঁট দিয়ে, ইলেকট্রিক তার দিয়ে বেদম প্রহার করা হত এবং বলতো আমাদের দেশে এইভাবেই খাদ্য দেয়। এই ভয়ে কেউ চেতো না।

সাত দিন পর আমাকে এস, পি কুঠিতে এনে নজরবন্দী করে রাখে। আমার বাড়ী পাক বাহিনী পাহাড়া দিয়ে রাখতো সেখান থেকে ঢাকাতে নিয়ে গিয়ে রাখে। এই সমস্ত পুলিশ দিয়ে এয়ারপোর্ট রাতের ডিউটি দিয়ে নিতো।

কিছুদিন এইভাবে অত্যাচার চালানোর পর এস,পি, জাকারিয়া সাহেব, আর, আই সাহেব এবং সাথে তিনজন পুলিশ ধরে নিয়ে যায় সামরিক ছাউনিতে। তিনজন পুলিশের মধ্যে এস,পি, সাহেবের দেহরক্ষী হিসেবে সামরিক ছাউনিতে আবদ্ধ করে রাখে।

আমাকে জিজ্ঞাসা করতো এস, পি সাহেব কোথায়, কোথায় কি করছে বল এবং তুমি কতজনকে হত্যা করেছো? সেই সময় আমার পায়ের তালুতে বেত দিয়ে আঘাত করত। পায়ের আঙ্গুলে বুটের চাপ দিয়ে এই সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে বলার জন্য বল প্রয়োগ করত। পিন দিয়ে আঙুলের মাথায় আঘাত করে রক্ত বের করতো। সময় সময় ঘন ঘন পিনের আঘাত দিতো আর জানতে চেতো। সে সময় লোকজনকে মৃত লোকের খোঁজখবরের জন্য পুলিশ অফিসে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন সংবাদই আমরা জানতাম না। মানুষকে কেবল ধোকা দেওয়ার জন্য এই চেষ্টা চালানো হতো। সামরিক বাহিনীর লোক বলে দিত যে তোমাদের নিহত,আহত ও নিখোঁজ লোকের সমস্ত খোঁজখবর পুলিশ অফিসে পাবে। যশোর থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়ে আমি স্বাধীনতার দেড় মাস পূর্বে সীমান্ত পার হয়ে ভারত গিয়ে আশ্রয় নেই। সেখান হতে মাঝে মাঝে গ্রাম্য অপারেশন পার্টির সাথে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে বাংলাদেশের জন্য খণ্ড যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি।

স্বাক্ষর
মোঃ আবুল কাসেম মণ্ডল
৭/১/৭১
।।১৮৯।।
শ্রী চিনিবাস সরকার
গ্রাম- দ্বারিকগ্রাম
শিলাইদহ
কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের আশ্বিন মাস রোজ রবিবার সকাল ৬ টার সময় মিলিটারী, রাজাকার, মিলিশিয়া মিলে প্রায় ৫০/৬০ জন আমাদের গ্রামে আসে এবং হিন্দু পাড়া ঘিরে নেয়। সকলেই মিলিটারীর কথা শুনে ছুটাছুটি করে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু যে যেদিক দিয়ে গ্রামের বাইরে যেতে চায় সেই দিকেই মিলিটারী দিয়ে ঘেরা। আমি, কানাই, মোংলা, ভোলা, খালিশা, শ্রী পদ বাড়ী থেকে কোথাও যাই নি। তারপর পাক সেনারা এসে আমাদের কয়েকজনকে ধরে ফেলে এবং বলে শালা মালাউনকো, মুক্তি বাহিনীকো খানা খেলাও? আমরা তাদের কথা অস্বীকার করি। সাথে সাথে সেখানেই মোংলা কে গুলি করে হত্যা করে। তারপর আমাদের চারজনকে দুই হাত বেঁধে পদ্মা নদীর ধারে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাদের সবাইকে মাটিতে শোয়ায়। তারপর ১০/১২ জন পাক দালাল আমাদের পিঠের উপর উঠে খচতে থাকে। অবশেষে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে পানির ধারে এক এক করে সবাইকে গরু জবাই করার মত জবাই করে নদীতে ফেলে দেয়। এই ভাবে সবাইকে জবাই করার পর আমাকে ঠিক একই উপায়ে গলায় ছুরি চালায় এবং পানির ধারে ফেলে রেখে সবাই চলে যায়। কিন্তু তাদের ছোরাটা আমার শরীর হতে বিচ্ছিন্ন না করেই ফেলে রেখে যায়। ফলে আমি কোন অবস্থাতে আধা মরা অবস্থায় পানির ধারে পড়ে থাকি। তারপর ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখতে পাই রক্ত ঝড়ছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি কোথাও কোন লোক নেই। ধীরে ধীরে পানির ধার দিয়ে চলতে থাকি। একটা মাছ ধরার নৌকা নদী দিয়ে যাচ্ছিল। আমি নৌকার মাঝিকে অনুরোধ করে বললাম ভাই, আমাকে নদী পার করে দিবে? মাঝি আমাকে নদীর অপর পারে নামিয়ে দেয়। আমি নৌকা হতে নেমে একজন লোকের বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নেই এবং একজন ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করাই। আমি সেখান হতে শুনতে পাই পাক সেনারা আমাদের হিন্দু পাড়া আগুনে জ্বেলে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং অনেক মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে।

স্বাক্ষর/-
চিনিবাস সরকার

।।১৯০।।
মোঃ শহীদুল আলম
গ্রাম- তেবাড়িয়া
কুমার খালী
কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের ৮ ই ডিসেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার সকালে ৭ টার সময় আমি ভারতের খবর শুনছি। এমন সময় ৬জন বিহারী অস্ত্রশস্ত্র সহ আমাদের বাড়ী গিয়ে আমাকে ডাকে। আমিও রেডিও বন্ধ করে তাদের সম্মুখে এসে হাজির হই। আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবা কোথায়? আমি জবাব দিই, ঘুমিয়ে আছেন। আমি আমার বাবাকে ডেকে দিই। বাবা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা বাবাকে বলে তোমার বড় ছেলে কোথায়? আব্বা তার প্রতি উত্তরে বলেন, ছেলে কোথায় তা আমি বলতে পারি না। তারা আব্বা ও আমাকে সাথে করে পাকদালালরা কুমারখালী বাজারে নিয়ে আসে। সেই সময় শান্তিকমিটির দালাল একটা ফাঁকা ফায়ার করে অন্যান্য লোকজনকে সেখান হতে তাড়িয়ে দেয়। অতঃপর আব্বাসহ আমাকে ও অন্য একজনকে শান্তি কমিটির দালালের নির্দেশে গড়াই নদীর ধারে নিয়ে যায়। নদীর ধারে একটি ঘর ছিল সেখানে নিয়ে আমাদেরকে উক্ত ঘরের মধ্যে কিছু সময় রাখে। তারপর আমাকে পানির কিনারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিচিত এক পাক দালাল রাইফেল উচু করার সাথে সাথে আমি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সাতার কাটতে কাটতে নদীর পরপারের দিকে চলে যাই। আমাকে লক্ষ্য করে উক্ত দালাল বৃষ্টির ন্যায় এলোপাতারিভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। আমি নদীর অপর পারে গিয়ে উঠি এবং হাটতে থাকি। এর মধ্যে একটা গুলি গিয়ে আমার হাতে লাগে। ঐ অবস্থাতেই আমি চলতে থাকি।এমন সময় অন্য একটা গুলি এসে আমার পায়ে লাগে। তখন আমি পড়ে যাই। পড়ে যাবার পরপরই দুটো ফায়ার হয়। আমার আব্বা ও সেই লোকটাকে তারা গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। তার কিছুক্ষন পর একজন রাজাকার নদী সাঁতরিয়ে আমাকে ধরার জন্য রওয়ানা হয়ে যায়। তখন আমি মৃত অবস্থায় বালির মধ্যে পড়ে থাকি। আমাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সে নদী পার হয়ে চলে যায়। আনুমানিক ঘন্টা তিনেক পর আমার কয়েকজন প্রতিবেশী আমাকে মৃত জেনে নৌকা নিয়ে আমাকে আনার জন্য যায়। কিন্তু আমি বেঁচে আছি জেনে তারা ধরাধরি করে আমাকে নৌকায় তুলে বাড়ী নিয়ে আসে এবং আমার চিকিৎসা করায়। দেশ স্বাধীন হবার পর আমাকে কুষ্টিয়া হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখান হতে কিছুদিন পর আমাকে রাজশাহী হাসপাতালে পাঠানো হয়। রাজশাহী হাসপাতালে পাঁচ মাস চিকিৎসা করার পর আমি বাড়ী চলে আসি।

স্বাক্ষর/-
মোঃ শহীদুল আলম
।।১৯১।।
মোঃ খন্দকার নূরুল ইসলাম
গ্রাম- বাটিয়ামারা
থানা- কুমারখালী,
জেলা- কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ৮ তারিখে বাটিয়া মারা গ্রামে ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা এসে আশ্রয় নেয়। মিলিটারীদের ক্যাম্প ছিল কুমারখালী থানা কাউন্সিলে, আর রাজাকার বাহিনী ও মিলিশিয়াদের ক্যাম্প ছিল কুমারখালি রেল ষ্টেশনে। পাক সেনাদের মেজর ও ক্যাপ্টেন থাকতো কুমার খালী থানা ডাক বাংলোয়।

৮ ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর দল সকাল ৮/১০ টার সময় মণ্টুদের ঘরের মধ্যে ভাত খাচ্ছিলো। এমন সময় রাজাকার, মিলিটারী ও মিলিশিয়া মিলে প্রায় ৬০/৭০ জনের বাহিনী বাটিয়া মারা মণ্টুদের বাড়ী চতুর্দিকে হতে ঘিরে নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে এবং মুক্তি বাহিনীর প্রস্তুতি নেবার পূর্বেই পাক হানাদার বাহিনী এসে তাদেরকে হাতিয়ার সমেত ধরে ফেলে ও পরে তাদেরকে প্রহার করতে করতে থানা কাউন্সিলে নিয়ে যায়। থানা কাউন্সিলের পূর্ব দিকে একটা আম বাগানে গর্ত করে রাত্রি ৮ টার সময় তাদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে মেশিন গানের গুলিতে হত্যা করে উক্ত গর্তের মধ্যে ফেলে মাটিচাপা দিয়ে রেখে চলে আসে।

তারপরদিন পাক হানাদার বাহিনী বাটিয়ামারা গ্রামে যায় এবং উক্ত গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ি আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মেয়েদের উপর চালায় পাশবিক অত্যাচার। আবার তারা থানা কাউন্সিলে ফিরে আসে। আজও বাটিয়ামারার অনেক বাড়িতে ঘর উঠে নাই।

তার ৪/৫ দিন পর পাক বাহিনী কল্যাণপুর গ্রামে অপারেশনে যায় এবং নাম না জানা অনেক মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার করে। তার মধ্যে কল্যাণপুরের একটা মেয়ের নাম আছিয়া। মেয়েটি অবিবাহিতা যুবতি ও সুন্দরী। সেই মেয়েটি পাক হানাদার বাহিনীর শিকার হয় এবং তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালানোর দরুন সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পাক হানাদার বাহিনী সেই গ্রাম হতে কুমারখালী চলে আসলে সে জ্ঞান ফিরে পায় এবং তার কলঙ্কিত মুখ সমাজে দেখাবে না বলে রাত্রি কালে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়।

পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন থানা কাউন্সিলের যে ডাক বাংলোয় থাকতো সেই ডাক বাংলোর সম্মুখে একটি কচুরীপানায় ভর্তি পুকুর ছিল। সেই পুকুরে প্রায় ২/৪ দিন পর পর ২/৪ টা সুন্দরী মহিলার লাশ শাড়ি পরা অবস্থায় ভাসতে দেখা যেত।

আমাদের অনুমান এই যে গাড়ীতে যে সকল মহিলা চলাফেরা করতো তাদেরকে গাড়ী হতে নামিয়ে ডাক বাংলোয় নিয়ে এসে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে পরে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে উক্ত পুকুরে ফেলে রাখতো।

একদিন দু’জন মিলিটারী একটা রাজাকার কে বলছে, আচ্ছা দোস্ত আওরাত মিলিয়ে দাও না। তখন রাজাকারটা তাদেরকে একটা বাড়ীতে নিয়ে যায়। মিলিটারীদের খবর পেয়ে উক্ত বাড়ীর পুরুষ মহিলা সবাই বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। রাজাকার ও মিলিটারী দুটি উক্ত বাড়ীর মধ্যে ঢুকে আর কোন লোক খুঁজে পায় না। তখন মিলিটারী দুটি উক্ত রাজাকারকে বলে আচ্ছা দোস্ত তোমার ডেরা কোথায়? তখন রাজাকারটা তাদেরকে সাথে নিয়ে নিজ বাড়ী যায় এবং পাক সেনারা তার বাড়ি গিয়েই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারা দেখতে পায়, ঘরের মধ্যে উক্ত রাজাকারের মাতা বসে আছে। তারপর একজন পাক সেনা ঘরের বাইরে চলে আসে এবং উক্ত রাজাকারের বুকে রাইফেল ধরে রাখে। আর একজন পাক সেনা তার বৃদ্ধা মাতার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারপর দ্বিতীয় জন গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করে। প্রথম জন এসে রাজাকারকে পাহারা দিতে থাকে। তারপর তাদের কাজ শেষ হলে তারা ক্যাম্পে চলে আসে। পরে উক্ত সংবাদ রাজাকার ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়লে উক্ত রাজাকার আর ক্যাম্পে না গিয়ে কোথায় যে চলে গেল তার আর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। উক্ত ঘটনা হতে জানা যায় যে পাক সেনাদের হাত থেকে তাদের আত্নীয় বা বন্ধুদের স্ত্রী, মা, বোন ও মেয়েরা রেহাই পায়নি। এমনকি শান্তি কমিটি জামাতে ইসলামী বা মুসলিম লীগের লোকেরাও না।

স্বাক্ষর/-
মোঃ খন্দকার নূরুল ইসলাম

।।১৯২।।
মোঃ বজলুল করিম
গ্রাম- দুর্গাপুর
থানা-কুমারখালী
জেলা-কুষ্টিয়া

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ রোজ মঙ্গলবার আমি বাজারে রেশন তোলার জন্য যাই এবং রেশন তুলে বাড়ী আসি। দুর্গাপুর স্কুলের সামনে মুজাহিদ ক্যাম্প ছিল। দ্বিতীয়বার বাজারে যাবার সময় দুর্গাপুর স্কুলের সম্মুখের মুজাহিদ ক্যাম্প থেকে কয়েকজন মুজাহিদ আমাকে ধরে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমাদের গ্রামে মুক্তিফৌজ আছে?” আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করলো তোমার ভাই কোথায়? আমাদেরকে বলে দিতে হবে। উত্তরে আমি বললাম আমাদের গ্রামে কোন মুক্তিফৌজ নাই এবং আমার বড় ভাই কোথায় তা আমি জানি না। তখন তারা আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়। তারপর তিনখানা বাঁশের লাঠি নিয়ে এসে আমাকে মারতে থাকে। মারের চোটে তিনখানা লাঠিই ভেঙ্গে যায়। মারের যন্ত্রণায় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। আবার যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে তখন আনুমানিক বেলা চারটা।একজন বিহারী আমার নিকট আসে এবং আমার দুহাত বেঁধে ঘরের ধর্ণার সঙ্গে ঝুলিয়ে আবার বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রহার করতে থাকে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমাকে নামিয়ে মাটিতে ফেলে রাখে। তারপর আমার জ্ঞান ফিরলে আমি বললাম ভাই আমাকে এক গ্লাস পানি দেবেন? তখন সেই বিহারী উত্তর করলো, পানি হবে না। তখন তৃষ্ণায় আমি অতিষ্ট হয়ে পড়ে থাকি। সে দিনই বিকাল ছ’টার সময় মিলিটারী, রাজাকার, মুজাহিদ ও বিহারী মিলে প্রায় ৫০-৬০ জন হাশেমপুর অপারেশন করে দু’জন লোককে ধরে নিয়ে দুর্গাপুর ক্যাম্পে আসে। তারা এসে আমাকে বলতে থাকে রানু কোথায় তোমাকে বলতেই হবে। আমি অস্বীকার করি, তখনই তারা কেউ কেউ রাইফেল দিয়ে, কেউ কেউ বেতের লাঠি দিয়ে, আবার কেউ কেউ ছোরা দিয়ে আমাকে মারতে থাকে। তাদের মারের চোটে আমার সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। তারপর হাশেমপুর থেকে যে দুটো লোককে ধরে নিয়ে এসেছিল তাদেরকে আমার মত মেরে আমার সঙ্গে একই জায়গায় রেখে দেয়। তারপর দিন আবার তারা ঘাসখালী অপারেশনে যায় এবং ১৪ জন লোককে ধরে নিয়ে কুমারখালী থানা কাউন্সিলে রেখে দেয়। তাদের মধ্যে ছিল ৬ জন মুক্তিবাহিনীর, উক্ত ৬ জন অস্ত্র সমেত ধরা পড়ে। এর মধ্যে আমার আব্বা আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নিকট যান। কিন্তু চেয়ারম্যান বলে আগামী কাল যা হয় করা যাবে। তখন রাতে যাওয়া ভালো হয় না। আমার আব্বা ফিরে চলে আসেন। এর মধ্যে রাতে আমরা দেখতে পাই স্কুলের পূর্বে পার্শ্বে দুটি এবং পশ্চিম পার্শ্বে ১টা কবর খোঁড়া হয়েছে। তখন আমরা মরার জন্য দিন গুনছিলাম। আমার পিতা আমার মামাকে আমার জন্য চেষ্টা করতে বললেন। আমার মামার এক বন্ধু যশোর ক্যান্টনমেন্টের মিলিটারী ইন্সপেক্টর ছিলেন। মামা তার কাছে টেলিফোন করেন এবং একটা লিখিত চিঠি পাঠান আমাকে মুক্তি দেবার জন্য। তারপর বেলা ১২ টার সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং মেজর এসে আমাকে ডাকে। আমি উত্তর করি আমি হেঁটে যেতে পারি না, কারন আমার সারা শরীর মারের চোটে ফুলে গেছে এবং ব্যথা করছে সর্বাঙ্গ। তখন একজন মিলিটারী আমার নিকট পাঠিয়ে দেয়। আমি তার কাঁধে ভর দিয়ে মেজরের নিকট যাই। তারপর মেজর আমাকে বলে “তুমি মুক্তি “। তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্বাকে বলে “তোমার ছেলেকে নিয়ে যাও”। আমার পিতা আমাকে নেবার জন্য একটা রিক্সা ভাড়া করেন। কিন্তু রিক্সায় উঠার মত অবস্থা আমার ছিল না বলে আমি রিক্সাওয়ালাকে ফিরিয়ে দেই এবং আব্বার কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ী আসি। বাড়ীতে আসার পর শুনতে পেলাম আমার সঙ্গে যে দু’টি লোককে ধরে রেখেছিল তাদেরকে আমি বাড়ি আসার পরপরই জবাই করে পূর্বে উল্লিখিত গর্তে পুঁতে রেখেছে। আর থানা কাউন্সিলে যে ১১ জনকে ধরে এনেছিল তাদেরকে থানা কাউন্সিলের পূর্বে একটা আম বাগানের ভিতর সবাইকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের দিয়েই গর্ত করিয়ে অবশেষে রাত আটটার সময় লাইন করে গুলি করে মেরে ফেলে। এবং পাশাপাশি দু’টি কবরের মধ্যে ১১ জনকে পুঁতে রাখে। আমি বাড়ী এসে দেড় মাস চিকিৎসা হবার পর সুস্থ হই।

স্বাক্ষর/-
বজলুল করিম
।।১৯৩।।
মোঃ রাজাই সরদার
গ্রাম- মহেন্দ্রপুর
ডাকঘর- বানিয়াকাঁধি
থানা- কুমারখালী,
জেলা- কুষ্টিয়া

১৩৮৮ সাল ২০ শে আশ্বিন রোজ বুধবার পাক বাহিনী দালাল মারফত খবর পায় যে চর ভবানী পুরে খবির উদ্দিন বিশ্বাসের বাড়ীতে মুক্তিবাহিনী থাকে। ঐ খবর পেয়ে প্রায় ৪০/৫০ জন মিলিটারী বিহারী ও রাজাকার ঐ তারিখে ঐ গ্রামটা ঘেরাও করে এবংঐ গ্রাম থেকে ৮ জন যুবক ছেলেকে ধরে। তাদের ধরার পর জিজ্ঞেস করে তোমরা মুক্তিবাহিনী। তোমাদেরকে গুলি করে মারা হবে। কিন্তু যুবক ছেলে কয়টা উত্তর দেয় আমরা জমি চাষ করি। আমরা মুক্তিবাহিনী নই বা মুক্তি বাহিনী কেমন দেখা যায় আমরা তাদের দেখি নাই। ছেলে ৮ টা কে তখন মহেন্দ্রপুর নামক একটা গ্রামে নিয়ে যায়। এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে নানা রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদের পর সবগুলিকে লাইন করে বসায়। তারপর বুট দিয়ে বল শট করার মত লাথি, গুতা এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মারার দরুন তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান ভেঙ্গে যায় এবং মারের চোটে রক্ত বেরুতে থাকে। পরে একটা আম বাগানের মধ্যে নিয়ে তাদের ৮ জনকে এক এক করে জবাই করে ফেলে রেখে তারা কুমারখালী থানা কাউন্সিলে চলে যায়।

ঐ মাসের ২৭ তারিখে দয়ারামপুরে পাক মিলিটারী যায় এবং সেই গ্রামে গিয়ে দিবুক সরদারকে জিজ্ঞাসা করে গোন্ধের বাড়ি কোনদিকে। দিবুক সরদার উত্তর করে আমি বলতে পারবো না। তখন একটা পাক মিলিটারী – বলে কি? বলতে পারবে না?- এই বলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলে তারপর গোন্ধের বাড়ী গিয়ে দেখে কেউ বাড়ীতে নেই। তারপর তার বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঐ আগুন ধরিয়ে দেওয়া দেখে গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সবাই ছোটাছুটি করতে থাকে। তারপর ৬ জন হিন্দুকে পাক মিলিটারীরা ধরে ফেলে এবং বলে এ গ্রামের সব গুলো মালাউনের বাড়ী দেখিয়ে দাও তাহলে তোমাদের ছেড়ে দেবো। লোক ৬ জন নিজেদের প্রাণের ভয়ে সবগুলি হিন্দু বাড়ী দেখিয়ে দেয়। অমনি তারা সব গুলো হিন্দু বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামে ৫০/৫২ খানা হিন্দু বাড়ি তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরে ঐ গ্রাম থেকে যাবার সময় ঐ ৬ জন লোককে গুলি করে মেরে রাস্তায় ফেলে রেখে যায়।

স্বাক্ষর/-
মোঃ রাজাই সরদার
১৯/১২/৭২
।।১৯৪।।
মোঃ দিয়ানত আলী খান
গ্রাম- মালি গ্রাম
ডাকঘর- জানিপুর
জেলা- কুষ্টিয়া

১৩৮৮ সালের ১ লা শ্রাবণ শনিবার রাত্রি ৯ টার সময় প্রায় ৩০/৪০ জন মিলিটারী, মুজাহিদ, রাজাকার ও বিহারী মিলিয়া আমার বাড়ী ঘেরাও করে এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করে আপনার ছেলে আলাউদ্দিন কোথায়? তার প্রতি উত্তরে আমি বলি কোথায় বলতে পারিব না। তখন তাহারা আমাকে এবং আমার মেঝ ছেলেকে ধরিয়া রাত্রি সাড়ে বারোটার ট্রেইনে কুষ্টিয়া নিয়া যায় এবং সেখানে হাজতে রাখিয়া দেয়। তার পরদিন হাজত হতে বাহির করিয়া মেজরের সামনে হাজির করে। মেজর আমাকে জিজ্ঞাসা করে আপনার ছেলে আলাউদ্দিন কোথায়? তাহাকে যদি আনিয়া দিতে পারেন আপনাকে ছাড়িয়া দিব। আমি মেজরের কথা প্রত্যাখান করি। তখন মেজরের আদেশে আমাদেরকে তাদের ক্যাম্পের দোতলায় নিয়া যায় এবং সেখানে আমাদের সঙ্গে আরও তিনজন ছিল। তার ঘন্টা খানেক পর একজন মিলিটারী সেই ঘরের দরজা খুলিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া আমার ছেলেকে কারেন্টের তাদের সঙ্গে দুই পা ঠেকাইয়া দেয় এবং বেতের লাঠি দিয়া ভীষণ প্রহার করে। তারপর আমার অনুরোধে মারা বন্ধ করিয়া দিয়া ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া চলিয়া যায়। সন্ধ্যার পর আমাকে এবং আমার ছেলেকে মেজরের নিকট নিয়া হাজির করে। মেজর সেই একই প্রশ্ন বার বার জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু আমি অস্বীকার করি। তারপর আমাদের থানা হাজতে পাঠাইয়া দেওয়া দিল। সেখানে ৪/৫ দিন থাকার পর আবার জেলে পাঠাইয়া দেয়।

এর মধ্যে ডাঃ মালিক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হইয়া ঘোষনা করে যাহাদেরকে সন্দেহ করিয়া ধরিয়া আনিয়া হাজতে রাখা হইয়াছে তাহাদেরকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ছাড়িয়া দেয়া হউক। আমরা কুষ্টিয়া জেলে মোট ১০১ জন আসামী ছিলাম। তাহার মধ্যে মোট ৪৭ জনকে ছাড়িয়া দেয়। আমরাঐ ৪৭ জনের সঙ্গে মুক্তি পাই। আমাকে এবং আমার ছেলেকে মোট ১ মাস ২২ দিন জেলে রাখে।

স্বাক্ষর/-
মোঃ দিয়ানত আলী খান

।।১৯৫।।
গৌরাঙ্গ বিশ্বাস
গ্রাম- নারায়ণপুর
ডাকঘর- জানিপুর
থানা- খোকসা
জেলা- কুষ্টিয়া

১৯৭১-এর ২৩ শে মার্চ রবিবার পাক-বাহিনীর ভয়ে ভারতের দিকে যাত্রা করি। পাক-বাহিনী রবিবারে জানিপুরে এসে আশ্রয় নেয়। রবিবার পরিবারসহ খোকসা থানার অধীনে বাহরামপুরের মাঠে একটা আম গাছের নীচে রাত্রি কাটাই। সকালে আমি ও অমিয় কুমার সাহা সাইকেল আনার জন্য আবুল মিয়ার বাড়ীতে আসার পথে কমলাপুর খালের মধ্যে পাক-বাহিনীর সাথে দেখা হয়। পাক-বাহিনী রাজাকার ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানসহ গ্রাম অপারেশনে যাচ্ছিল। পাক-বাহিনী আমাদের দু’জনকে আনতে বলে তখন আমরা পালাবার সুযোগ না পেয়ে থেমে যাই। পাকবাহিনী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসা করে এরা আদাব দিলো কেন। চেয়ারম্যান বলে যে এরা দু’জন মালাউন। অমিয় কুমারের (সি, ও অফিসের কেরানী, খোকসা) খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। মালাউনের কথা শুনে পাক বাহিনী আমাদের বলে যে টাকা পয়সা যা আছে তা দিয়ে দাও। আমরা টাকা পয়সা সোনাদানা দিয়ে জীবন ভিক্ষা চাইলাম কথা সর্বস্ব দিয়ে দিলাম। তখন পাক-বাহিনী আমাদের হাত বেঁধে ফেললো। কমলাপুরের ব্রিজের পাশে রাস্তার ধারে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং গুলি করে। অমিয় কুমার তার শিশুদের জন্য অসহায়ের মত তাদের কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়ে ব্যর্থ হলো। গুলি হলে অমিয় কুমারের বক্ষ ভেদ করে আমার মাথায় লাগে। অমিয় কুমার নিহত হয় আর অমিয় কুমারের চিৎকার ও পাক বাহিনীর বিভৎস হাসি শুনে এবং জীবনের কথা চিন্তা করে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। মাথা দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। দু’দিন
ঐ রাস্তার ধারে খালে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকি। দু’দিন পর আফতাব মুন্সির ছেলেরা খাল হতে পাশে পানের বরজে আশ্রয় দেয়। সেখানে আমাকে চিকিৎসা করেন।

ডাক্তারের চিকিৎসার সুযোগ ছিলো না। কারন পাক-বাহিনী বা দালালের কানে পৌছাল তার মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়াতো। আফতাব মুন্সির বাড়ীতে বা তার অধীনে দীর্ঘ আড়াই মাস চিকিৎসা হবার পর সুস্থ হলে ভারতে চলে যাই।

স্বাক্ষর/-
শ্রী গৌরাঙ্গ বিশ্বাস
।।১৯৬।।
ভারতী দেবী চক্রবর্তী
বগুড়া রোড, বরিশাল

১৮ ই এপ্রিল বরিশালে পাক সেনারা ব্যাপক বোমা ফেলে । আমরা আশ্রয় নিই আলুকদিয়া গ্রামে। ওখানে এক মাস থাকি । আমার স্বামী বরিশালে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন । এই সংবাদ প্রচার হয়ে গেলে গৃহস্বামী আমাদের রাখতে অস্বীকৃতী জানায়। শুনলাম হিন্দুরা সব আটঘর কুড়িয়ানাতে আশ্রয় নিচ্ছে । স্থান ছিল দুর্গম, চারিদিকে জল, খানসেনা যেতে পারবে এমন ধারনা কারো ছিল না । আমরা কুড়িয়ানাতে আশ্রয় নিই। ওখানে পর পর ৩৬ টি গ্রাম সম্পূর্ণ হিন্দুর বাস । মে মাসে আমি আটঘর কুড়িয়ানাতে আশ্রয় নিই । আমরা অরূন চক্রবর্তীর বাড়িতে থাকি । ওখানে আরো প্রচুর লোক আশ্রয় নেয় ।
মে মাসের শেষের দিকে খান সেনারা কুড়িয়ানাতে পৌছে অরুণ চক্রবর্তীর বাড়ি ঢুকে মন্দির , ঘর সব ধ্বংস করে ওখানে পাক ছাউনী করে। সমস্ত গ্রাম খান সেনারা পুড়িয়ে দেয়। আমরা ২/৩ হাজার লোক পিয়ারা বাগানে আশ্রয় নিই । খান সেনারা বাগান কাটা শুরু করলো । আমরা বাগানের খালের জলের ভিতর বেলা ১০ টায় নামতাম, বেলা ৪/৫ টার দিকে জল থেকে উঠে বাগানের উঁচু জায়গায় বসতাম । সকালে এসেই খান সেনারা গুলি চালাতো । যারা একটু আধটু মাথা উচু করেছে সাথে সাথে মারা গেছে । ঐ ভাবেই দেড় মাস থাকি । দেড় মাসের মধ্যে আমরা ভাত খেতে পারি নি , পেয়ারা এবং আখের রস খেয়েছিলাম । বাগান কাটতে থাকে আমরা পিছাতে থাকি । জোয়ারে অসংখ্য মৃতদেহ দেখতাম । মৃতদেহের উপর আমরা বহুবার আশ্রয় নিই।

পাকসেনারা প্রত্যহ মানুষ ধরে হত্যা করেছে । ঐ বাগানে লাইন দিয়ে দেড় মাসের মধ্যে ২ হাজারের মত লোককে হত্যা করে । ওখানে আমাদের মত যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই বেশী মারা গেছে । লাইনে দাড় করিয়ে আমাদের সবকিছুই খুলে নেয় । পাশবিক অত্যাচার চালায় অসংখ্য নারীর উপর । আমার স্বামীকে ধরে ফেলে পাক সেনারা নৃসংশভাবে হত্যা করে । গ্রামে গঞ্জে রাজাকাররা আমাদের উপর চালিয়েছে অকথ্য অত্যাচার । আটঘর কুরিয়ানা থেকে আমি হেটে হেটে মাইলের পর মেইল অতিক্রম করে বরিশালে বিভিন্ন স্থানে আত্নগোপন করে থাকি।

স্বাক্ষর/
ভারতী দেবী চক্রবর্তী
২০/৯/৭৩
।।১৯৭।।
ইমদাদুল হক মজুমদার
অধ্যক্ষ, বজ্রমোহন কলেজ
বরিশাল

প্রতি রাতে পাক বাহিনী অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে । দিনের বেলায় ট্রাক ভর্তি করে লোক ধরে আনতো । প্রথম দিকে গুলি করে হত্যা করতো । পরের দিকে জবাই করেছে । অসংখ্য লাশ নদীতে ভাসতে দেখেছি । বেয়োনেট দিয়ে পেট চিড়ে ফেলে রাখতো । আমার ধারণা ৭৫,০০০ মোট লোককে পাক বাহিনীরা হত্যা করছে বরিশালে ।

পাথরহাটা , বাওয়াল (পটুয়াখালী সীমান্তে) নামক স্থানে পাক সেনারা গেলে লোকজন সব দেখতে আসে । লোকজন তখন ভাবতো মুসলমান হলে মারবে না । পাক সেনারা সবাইকে একত্র করে দুর্বল লোকদের ছেড়ে শক্ত সমর্থ লোকদের পুকুরে নেমে সাঁতার কাটতে বলে । সবাই সাঁতার কাটা শুরু করলে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে , তামাশা দেখে ।

ইয়াহিয়ার সাধারন ক্ষমা দেওয়ায় অনেকেই বাইরে বেরোয় । নজরুল , আলমগীর , হাই, শাহাবুদ্দিন (তপন) এরা স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছিলো । বাইরে বেরোলে পাক সেনারা তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করে ।

অসংখ্য মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে এই শহরে । পাক সেনারা খবর পেয়ে রাত্রে গিয়ে মেয়েদের ধরে নিয়ে আসতো এবং অত্যাচার চালাতো । বাড়ি বাড়ি ঢুকে সব লুট করে ধ্বংস করেছে জ্বালিয়েছে অসংখ্য বাড়ি ঘর । বরিশাল মহিলা কলেজের অধ্যাপিকা এবং তার সাথে আর একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রিকে অস্ত্রসহ পাক বাহিনীরা গৌরনদী অথবা উজিরপুর এলাকার কোন একটি বাংকার থেকে ধরে আনে। বহু অত্যাচার চালায় ওদের উপর তথ্য নেবার জন্য । কিন্তু কোন কথা বের করতে পারে নি । পরে ওদেরকে হত্যা করে । মেয়ে দুজন বলেছে তোমরা হত্যা কর, কিন্তু কোন কথা পাবে না । অত্যাচারের মাত্রা বেড়েছে কিন্তু কোন কথা বের করতে পারেনি। বাড়ী বাড়ী থেকে পাক সেনারা ছাগল, ডিম, এসব নিয়ে আসতো জোর করে । আমার কাছে মুক্তিবাহিনীরা আসতো তাদের জামা কাপড়, খাওয়া এবং বিভিন্ন খবর নিয়মিত দিতাম ।

স্বাক্ষর/-
ইমদাদুল হক মজুমদার

।।১৯৮।।
উপেন্দ্রনাথ দত্ত
গ্রাম -রাজারহাট
ডাকঘর ও থানা- পিরোজপুর
জেলা -বরিশাল

৪ঠা মে, পাক বাহিনী পিরোজপুর আসে। খান সেনারা শহরে প্রবেশ করে দালাল শ্রেণীর কতকগুলি লোককে শহর থেকে লুট করতে বলে । এই সময় তাদের নির্দেশ দেয় যে তোমরা লুট করো কিন্তু ঘর দুয়ার নষ্ট করো না । পাক বাহিনী রাস্তায় যে সব লোকদের পায় তাদেরই সবাইকে গুলি করে হত্যা করে । প্রথম অবস্থায় হিন্দু, মুসলমান কোন কিছু তারা নির্ণয় না করে একাধারে সবাইকে গুলি করে মেরেছে ।

একজন দালালের কাছে আমি এই সময় বলি যে ভাই আমার দোকানে পায় লাখ টাকার মাল আছে , তুমি এগুলো রক্ষা কর। প্রয়োজন হলে তোমার হেফাযত নিয়ে নাও । তার উত্তরে সে আমাকে জানায় যে, আপনার কোন চিন্তা নাই । আপনার কোন ক্ষতি আমরা করবো না । আমি আমার সমস্ত কিছু তার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নদীর অপর পারে চলে গেলাম ।

আমি সারাদিন নদীর অপর পারে পালিয়ে বেড়াতাম । বিকালের দিকে যখন খান সেনারা তাদের ব্যারাকে ফিরে যেত তখন আমি নদী পার হয়ে টাউনের ভিতর চলে আসতাম । এবং যতদূর সম্ভব গা ঢাকা দিয়ে শহরের ভিতর ঘুরে ঘুরে অবস্থা দেখতাম ।

পাক বাহিনী আসার পর পাক বাহিনীদের সহযোগী একটা দল সৃষ্টি হয় । পরবর্তী কালে এই দলই বিভিন্ন অত্যাচারের ক্ষেত্রে পাক বাহিনীকে পরিচালনা করেছে । প্রথম দিকে পিরোজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে লুট করেছে , পরবর্তী পর্যায়ে বাড়ী ঘর ভেঙ্গে নিয়ে যায় এবং জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয় ।

মে মাসের শেষের দিকে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন জায়গা হতে লোক ধরে এনে পিরোজপুর জেটি ঘাঁটে এনে গুলি করে হত্যা করেছে । এমন দিন ছিল না যে ৫০/৬০ জন লোক হত্যা না করেছে। পাক বাহিনী গড়ে প্রত্যেক দিন ১০০ করে লোককে হয়া করেছে। প্রথম দিকে যখনই লোক ধরে আনতো তখনই দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেছে । ২য় পর্যায়ে পাক বাহিনী যে সব লোককে ধরে আনতো তাদেরকে সন্ধ্যার পরে গুলি করে মেরেছে ।

প্রথম দিকে যে সব লোক মারা হত তাদের বেশির ভাগ গুলি করেই হত্যা করেছে । শেষের দিকে যে সব লোককে ধরে আনতো তাদের প্রথম ভীষণভাবে মারধর করতো তারপর বেয়োনেট দিয়ে চার্জ কোড়ে হত্যা করত । অনেক সময় আমি নিজ চোখে দেখেছি যে দুইজন দুই দিক থেকে একটা লোককে পা টেনে ধরত আর একজন কুঠার বা দা দিয়ে দুই ভাগ করে ফেলতো।

ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার থেকে দুই চারজন ধোপা , নাপিত , কামার , কুমার শহরে আসতে শুরু করে । যারা এই সময়ে শহরে আসতো তাদের প্রত্যেককেই শান্তি কমিটির কাছ থেকে পাকিস্তানী ব্যাজ শরীরে লাগিয়ে নিতে হতো।

শহরে রাজাকার গঠিত হবার পর শহরের পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা হলেও রাজাকারেরা ব্যাপকভাবে গ্রাম হতে গ্রামে অভিযান চালিয়ে বহু লোককে ধরে আনতো ।

পাকসেনা আসার ১ মাস ১০ দিন পর্যন্ত আমি বলেশ্বর নদীর অপর পারে আমার বিরাট ফ্যামিলি নিয়ে গ্রাম হতে গ্রামে ঘুরে কাটিয়েছি । এই সময় অধিকাংশ দিন আমাকে এক বেলা কচুর শাক এবং বিভিন্ন শাকসব্জি খেয়ে কাটাতে হয়। পরে অনন্যোপায় হয়ে আমি শান্তি কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করি । তারা আমাকে শহরে আসতে বলে ।

জুন মাসে ১৫ তারিখে আমি নদী পার হয়ে শহরে আসি এবং একজন লোকের সহায়তায় শান্তি কমিটির অফিসে যাই । শান্তি কমিটির সেক্রেটারী আবদুস সাত্তার মিয়া আমাকে ঘরের পিছনে দিকে এক জায়গায় বসতে দেয় । ঐ দিন শান্তি কমিটির মেম্বারদের একটা অধিবেশন ছিল । ধীরে ধীরে বহু লোক এসে কমিটির অফিসে যোগ দেয় ।

শান্তি কমিটির লোকেরা যখন সবাই বসে তখন আমি ঘরের অপর একটা রুমে বসে আছি । দালাল মোসলেম খাঁ এই সময়ে প্রস্তাব করে যে আমরা এখন পর্যন্ত হিন্দুদেরকে প্রশ্রয় দিচ্ছি । তার প্রমাণস্বরুপ আমাকে সে দেখিয়ে দেয় । এই সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেব তার উত্তরে বলেন, যে আজ এ লোকের গায়ে গন্ধ হযেছে তাই না ? কিন্তু আপনারা কে অস্বীকার করতে পারবেন ইয়ে, সে আপনাদের কাছ থেকে টাকা পাবে না ? তখন সবাই চুপ মেরে যায় ।

সাত্তার মোক্তার সাহেব আমাকে তার নিজের বাড়ীতে ঐ দিন রাত্রিতে লুকিয়ে রাখেন । পরের দি্ন ভোর হবার আগেই আমাকে নদী পার করে দেন এবং বলে দেন যে আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখলেই আপনাকে জানাবো , আপনি তখন আমার বাসায় চলে আসবেন ।

৬ দিন পর শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ডাক্তার মিয়া আমাকে আসার জন্য চিঠি দেন । তার চিঠি পেয়ে আমি শহরে চলে আসি এবং সেক্রেটারী সাহেবের তত্ত্বাবধানে থাকি । এই সময় কতোগুলি লোকের কথার উপির ভরসা করে আমি যে লোকের কাছে আমার সমস্ত কিছু গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলাম সেই লোকের কাছে আমার দুরাবস্থার কথা খুলে বলি এবং তার কাছে কিছু টাকা চাই। তার উত্তরে তিনি আমাকে ভীষণ গালাগালি করেন এবং পাক বাহিনী দিয়ে আমাকে গুলি করাবেন বলে ভয় দেখান ।

২৯ শে শ্রাবণ আমি রাত্রে ৮টার সময় শহরের ভিতর একটা হোটেল থেকে কিছু খেয়ে বাসায় ফিরতেছিলাম এমতাবস্থায় পিরোজপুর জামে মসজিদের কাছে রাজাকাররা আমাকে ধরে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায় । এই সময় তারা আমার প্রতি নানা রকম গালাগালি ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে থাকে ।

ক্যাম্পে নিয়ে যাবার সময় খান সেনারা আমাকে বলে যে তুমি মুক্তিবাহিনী হ্যায় । তুমি দুশমন হ্যায় । এই বলে তারা আমার উপর অত্যাচার আরম্ভ করে । একটা মোটা বেতের লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে প্রহার করে , বুট জুতা দিয়ে লাথি মারে এইভাবে আমার সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে ।
প্রায় দুই ঘন্টা আমার উপর অকথ্য অত্যাচার চালানোর পর আমাকে তাদের হাজত অর্থ্যাৎ সেকেন্ড অফিসার সাহেবের বাসায় একটা রুমে বন্দী করে রাখে । আমাকে বন্দী করার সময় পকেট থেকে ২৪ টা টাকা তারা নিয়ে নেয় ।

আমাকে যে ঘরে রাখা হয় ঐ ঘরে আরও ১৮ জন বন্দী ছিল । প্রতি ২ ঘন্টা পর ডিউটিরত সিপাই চেঞ্জ হয়ে যেত । প্রতিবারই আমার উপর সিপাইরা লাথি ঘুষি মারতে থাকে আর জিজ্ঞাসা করে মুক্তিবাহিনী কোথায় ?
এনায়েত মিয়া , ডা: আব্দুল হাই , ডা ক্ষিতিশ মণ্ডলে এই সব আওয়ামী লীগের নেতারা কোথায় আছে ?
রাইফেল কোথায় আছে ?
৩ দিন আমার উপর এইভাবে অত্যাচার চালায় । এই সময় আর কোন নতুন আসামী তারা ঢুকায় না । তবে ঘরের বাইরে যে লোক ধরে এনে ভীষণভাবে প্রহার করে এটা আমি হাজতের ভিতর থেকে টের পাই ।

১০ দিন পর বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও ১৪ জন লোককে ধরে আনে এবং তাদের সঙ্গে আমাকে এসডিও সাহেবের বাসার ভিতর একটা পায়খানার মধ্যে বন্দী করে রাখে । এদের মধ্যে আলী আশরাফ নামে একজন ছেলে । ঢাকা থেকে আসার পথে ‘হুলার হাট’ লঞ্চ ঘাটে পাক সেনারা তাকে আটক করে । তাকে আটক করার পর ক্যাপ্টেন একটা হোটেলের চুলার ভিতরকার আধাপোড়া কাঠ এনে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চেপে ধরে । সারা শরীরের চামড়া ও মাংস পুড়ে দুর্গন্ধ হয়ে ওঠে । এবং ছেলেটার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালান হয় । হাজতে আনার পর আমাদের উপর নিয়মিত অত্যাচার চালাতে থাকে ।

আমাকে হাজির করার পর ক্যাপ্টেন এজাজ আমাকে প্রশ্ন করে যে, তুমি মুক্তিবাহিনী , তুমার কাছে রাইফেল আছে , তোমাদের বাহিনী কোথায় আছে আমার কাছে বল । আমি তার উত্তরে উর্দুতে বলি যে, আমি একজন সাধারন ব্যবসায়ী মানুষ , ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করি , কাজেই যদি কিছু জিজ্ঞাসা করতে হয় তবে ব্যবসা সম্পর্কে করুন । প্রায় আড়াই ঘন্টা ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়।

অতঃপর ক্যাপ্টেন আমাকে প্রশ্ন করে যে , তুমি এত উর্দু কথা কেমন করে শিখছো ? তখন আমি কিছুটা ভীতু হয়ে পড়ি । কেননা আমি বৃটিশ আমলে ৭ বছর আর্মিতে চাকুরী করেছি জানতে পারলে আমাকে তখনই গুলি করে হত্যা করবে । তখন আমি বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলতে লাগলাম যে হুজুর আমি ব্যবসায়ী লোক কাজেই আমি খুলনাতে পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করি, তারা আমাকে খুব পেয়ার করে এবং প্রতি ৭ দিন অন্তর আমি তাদের কাছে ১ দিন থাকি- এই সব সত্য মিথ্যা বলি । এবং সেই সঙ্গে কতকগুলি পাঞ্জাবী লোকের নামে একাধারে বলে যাই।

আমার কথা ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করে এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে যে , তোম মেরা দোস্ত হ্যায়। আরও বলে যে তুমি মুক্ত । আজ শহরে কারফিউ কাজেই সকাল বেলা তুমি তোমার ঘরে ফিরে যেও।
এখন আরাম কর । এই বলে আমাকে পুনরায় সেই হাজত রুমে নিয়ে আসে ।

হাজত রুমে আসার পর আরও যে ১৪ জন ছিল তারা আমার কাছে আকুতি মিনতি করে নানা কথা বলতে লাগলো যে ভাই তুমি ত সকালে বাড়ী যাবে কাজেই আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে তুমি সংবাদ দিবে তারা যেন টাকা পয়সা যা লাগে তাই আমাদের এইখান থেকে বাচিয়ে নিয়ে যায়।

রাত্রি ১১ টার সময় একটা প্লেটে করে ৪ টা রুটি ও একটু মাংস নিয়ে আসে একটা সিপাই আমার জন্য । তখন আমি জোরে জোরে বলি যে ও রুটি আমি খাব না , তোমরা ফিরিয়ে নিয়ে যাও । কেননা আজ ১১ দিন হলো শুধু পানি খেয়ে আছি আর আজ শুধু আমার জন্য ৪ টা রুটি এনেছো । কিন্তু এই হাজতের মধ্যে ত মোট আমরা ১৫ জন আছি, সবাই না খাওয়া , কাজেই আমি খাব না । সিপাইটি তখন ফিরে যায় এবং ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে সমস্ত কথা খুলে বলে ।

রাত্রি ১২ টার সময় একটা বড় ঝুড়িতে করে রুটি ও একটা বালতিতে করে আলু ও মাংস নিয়ে আসে এবং আমাকে সবাইকে সঙ্গে করে খেতে বলে।

রাত্রি ১২ টার সময় ক্যাপ্টেন আমাকে পুনরায় তার চেম্বারে ডেকে পাঠায়। আমার তখন ভয় হয়ে যায় যে আমি প্রথমে রুটি খেতে চাইনি বলে হয়তো তার রাগ হয়েছে। কাজেই আমাকে মেরে ফেলবে। একজন সিপাই আমাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেবের সম্মুখে হাজির করে আমাকে দেখতে পেয়ে ক্যাপ্টেন পুনরায় জিজ্ঞাসা করে তুমি খেয়েছো। আমি বলি যে হ্যা আমি এইমাত্র রুটি মাংস খেয়েছি । ক্যাপ্টেন পুনরায় হেঁকে ওঠে যে না আবার তোমাকে আমার সম্মুখে খেতে হবে। এই বলে ডাকাডাকি আড়ম্ভ করে। এই বলে একজন সিপাই দুইটা পরাটা ও একটা আস্ত মুরগীর রোস্ট নিয়ে আসে। ক্যাপ্টেনের হুকুমে আমি তা খেয়ে ফেলি। পরে আমাকে পুনরায় আরাম করার জন্য হাজত রুমে নিয়ে আসে।

পরের দিন সকালে আমাকে পুনরায় ক্যাপ্টেনের রুমে ডেকে নিয়ে আসে এবং আমাকে কিছু খেতে দেয়। এই সময় ক্যাপ্টেন আমাকে বলে যে এখন তুমি বাড়ি যাও এবং ঠিকঠাকমত চলাফেরা করবে। আমি বাড়ীর দিকে চলে আসি এবং বাড়িতে না গিয়ে রাত্রিতে আর সব বন্দী যে সব কথা বলে দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের বাসায় গিয়ে আমি তা বলে আসি। এই সময় যে ছেলেটিকে হুলার হাট থেকে ক্যাপ্টেন ধরে আনে তার খালুর সঙ্গে দেখা করি এবং বলি যে বন্দী আশরাফ আমার কাছে কাকুতি মিনতি করে বলে দিয়েছে যে তাকে যদি গুলি করে হত্যা করা হয় তবে যেন তার আত্নার সৎগতি করা হয়।

রাত্রিতে আমার ঘুম আসছিল না কাজেই বসে নানা চিন্তা করছি এমনি সময় জেটিঘাটে দশ রাউন্ড গুলির শব্দ পেলাম ।

পরের দিন সকালে উঠে খবর নিযে জানতে পারি যে যাদের বন্দী করে রেখেছিল তাদের সবাইকে রাত্রিতে গুলি করে হত্যা করেছে । তখন আমার বন্দী আশরাফের করুণ স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে এবং আমি দৌড়িয়ে জেটি ঘাটে চলে আসি । জেটি ঘাটে বেশ কয়েকটি লাশ দেখতে পাই কিন্তু আশরাফের লাশ দেখতে পাই না । একজন নৌকার মাঝির সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি নদীর ভাটিতে কিছুটা দূরে দুইটা লাশ ভেসে আসে । আমি জেটি ঘাটে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং নদীর ভিতর দিয়ে সাতার কেটে লাশের কাছে আসি এবং নিজ হাতে আলী আশরাফের লাশ তুলে নিয়ে তার বাবা-মার কাছে হাজির করি এবং তার শেষ অনুরোধের কথা জানাই । লাশ দেখে তার বাবা-মা ভয় পেয়ে যান যে মিলিটারী জানতে পারলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলবে । আমি সারাদিন সে লাশ গোপনে লুকিয়ে রেখে রাত্রিতে কয়েকজন লোক ডেকে লাশ মাটির ব্যবস্থা করি । আমি শহরে বাস করতে থাকি এবং মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে শহরের খবরাখবর আদান প্রদান করতে থাকি ।

ক্যাপ্টেন এজাজ ছুটি নিয়ে পাকিস্তান চলে যায় বিবাহ করতে । তখন ক্যাম্পের চার্জে সুবেদার সেলিম থাকে । এই সুবেদার তখন দালাল নিয়ে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করল। ব্যাপক হারে মেয়েদের ধরে এনে ক্যান্টনমেন্টে ধর্ষন করতে লাগলো। হিন্দু মুসলমান বলে কোনো বিচার তখন ছিল না – যেখানে যাকে পায় তাকেই ধরে আনতে থাকে। দেখতে দেখতে শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল।

আশ্বিন মাসের শেষের দিকে আমার বাসার সম্মুখে থেকে দুটি সিপাই আমাকে ডেকে নিয়ে যায় যে তোমাকে সুবেদার সাহেব বোলতা হ্যায় আমাকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে গিয়ে সুবেদার বলে যে আমি তোমার জীবন নেব , তুমি আমাদের সঙ্গে বহুত দুশমনী করেছো । এঈ বলে তারা আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে । আমাকে মারতে মারতে সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে এবং এসডিও সাহেবের পায়খানার মধ্যে আটকে রাখে । ৬ দিন আমি সেখানে বন্দী থাকি । এই সময় আমি দেখতে পাই যে খান সেনারা প্রত্যেকদিন ক্যাম্পের সম্মুখে বাঙ্গালীদেরকে মিলে শূন্যে তুলে পাকা রোডের উপর আছড়িয়ে মারতো বা এইভাবে আধা মরা হয়ে গেলে বস্তাবন্দী করে তারপর বেয়োনেট চার্জ করে নদীর ভিতর ফেলে দিত । অনেককে আবার জীপ গাড়ির পিছনের দিকে বেঁধে সারা শহরের মধ্যে টানতো । এর ফলে সমস্ত মাংশ শরীর থেকে পড়ে যেত । আমি এ সব ঘটনা নিজ চোখে দেখেছি । প্রত্যেক দিন আমাকে হাজত থেকে বার করে ক্যান্টনমেন্টের সম্মুখে একটা বাদাম গাছের সঙ্গে কপি কল দিয়ে পা উল্টো দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে দিত এবং ভীষণভাবে প্রহার করতো ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি জেট ঘাটে ২,০০০ লাশ নিজের চোখে দেখেছি। প্রত্যেক দিন আমি ভোর বেলা ঘাটে গিয়ে যে সব লাশ পড়ে থাকতো তাদের উলটিয়ে পালটিয়ে দেখতাম এবং চেনা শোনা হলে তার বাড়িতে গিয়ে খবর দিতাম।

আমি নিজের চোখে মানুষকে কুপিয়ে, রাস্তায় টেনে , বস্তাবন্দী করে বেয়োনেট চার্জ করে এবং গুলি করে মারতে দেখেছি। পাক বাহিনীর চেয়ে রাজাকার, শান্তি কমিটির মেম্বার এরা অত্যাচার বেশী চালিয়েছে। পাক বাহিনী যাদেরকে ছেড়ে দিতো দালালরা তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতো। পিরোজপুর জেটি ঘাটে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩/৪ হাজার লোককে হত্যা করেছে। কত নারীকে যে ধর্ষণ করেছে তার কোন হিসাব নাই।
স্বাক্ষর/-
উপেন্দ্রনাথ দত্ত
১৮/৮/৭৩

।।১৯৯।।
আফতাব উদ্দিন আহাম্মদ
থানা-পিরোজপুর
জেলা- বরিশাল

৪ঠা মে পিরোজপুর শহরে পাক বাহিনী প্রবেশ করে। পাক বাহিনী বরিশাল হুলার হাট হয়ে পিরোজপুর প্রবেশ করে। মিলিটারী তিন দিক থেকে পিরোজপুর পুরো শহর আক্রমণ করে।

৫ই মে পাক বাহিনী আমার বাড়ী ধ্বংস করে। প্রথমে লুটতরাজ চালায়। তারপর অগ্নিসংযোগ বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। এই দিনই পাক বাহিনী পিরোজপুর সেকেন্ড অফিসার, এসডিপিও ট্রেজারী অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে।

পাক বাহিনী যখন ভান্ডারিয়া থানায় প্রবেশ করে তখন আমি আমার জীবনের নিরাপত্তার অভাব অনুভব করি। ভাণ্ডারিয়া আমার নিজ বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি বরগুনা(পটুয়াখালী) চলে যাই। এখানে আমি প্রায় দেড় মাস কাল অতিবাহিত করি। তারপর আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে চিঠি লিখি আমার অসুস্থতার খবর জানিয়ে। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে চেয়ারম্যান সাহেব আমার কাছে চিঠি দেন এবং বলেন যে আমি ক্যাপ্টেন এজাজ সাহেবের সঙ্গে আপনার ব্যপারে আলাপ করেছি,কাজেই আপনি এখানে আসতে পারেন।

শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাহেবের চিঠি পাবার পর পিরোজপুর চলে আসি এবং চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে গোপন থাকতে বলে। তিনদিন পর চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে ডেকে পাঠান এবং ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে নিয়ে যান। ক্যাপ্টেন এজাজ সাহেবের কাছে আমি এই সময় একটা দরখাস্ত দেই যে আমার ছেলে ” ক্যাপ্টেন জিয়া” আমার বাধ্য নয়, সে আমার অমতে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।

আমি শহরে আসার ৭/৮ দিন পর জানলাম পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে আমার নামে বলা হয়েছে যে, তার ছেলে প্রত্যেকদিন রাত্রিতে মুক্তিবাহিনী নিয়ে এসে তার সঙ্গে দেখা করে যায়। এরপর প্রায় ১০০ মিলিটারী নিয়ে আমার বাড়ি আক্রমণ করা হয়। আমার বাড়িতে এসে পাক বাহিনী আমার বুকের উপর, আমার স্ত্রীর বুকের উপর এবং আমার ছেলের বুকের উপর রাইফেল ধরে। এই সময় পাক বাহিনী আমাদের ঘেরাও করে যে তোমার ছেলে ক্যাপ্টেন জিয়া তোমার ঘরে আছে, তুমি তাকে বের করে দেও। আমি তার উত্তরে বলি যে আমার ছেলে বাড়ীতে নাই, তোমরা ইচ্ছা করলে আমার ঘর সার্চ করে দেখতে পারো। তখন আমার ঘর সার্চ করে তারা চলে যায়।

পাক বাহিনী সব সময়ই নারী ধর্ষণ করেছে। তারা রাজাকার দিয়ে গ্রাম থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদেরকে ধরে আনতো। অনেক সময় তারা নিজেরাও কোন কোন বাড়ীর উপর চড়াও হতো এবং মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যেত।

পাক বাহিনী বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী ও হিন্দু এদের খোঁজ বেশী করেছে এবং যাদের সন্দেহ হয়েছে তাদেরকেই মেরে ফেলেছে। এমন কোন রাত নাই যে পাক বাহিনী পিরোজপুর জেটি ঘাটে ৫০-১০০ জন লোককে হত্যা না করতো। শেষের দিকে নদীর ভিতর শুধু মৃত লাশ ভাসতে দেখা যেত। আমার মনে হয় একমাত্র বলেশ্বর নদীর জেটি ঘাটেই ৪/৫ হাজার লোককে পাক জল্লাদরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পাক ক্যাপ্টেনের একমাত্র কথাই ছিল ‘জেটিমে ভেজ দেও।’

প্রথম অবস্থায় যে সব লোককে ধরেছে তাদেরকে জেটি ঘাটে গুলি করে হত্যা করেছে । কিন্তু শেষের দিকে তাদের বেয়োনেট দিয়ে জবাই করা হতো । যাকেই ধরা হতো তাকেই ভীষনভাবে প্রহার করতো ।

আমি নিজের চোখে ৩ জন লোককে জীপ গাড়ির পিছনে বেঁধে রাস্তায় টেনে মেরে ফেলতে দেখেছি । তাদের সেই করুণ চিৎকারের কথা আমার এখন পর্যন্ত কানে বাজে ।

শেষের দিকে নারী নির্যাতন ব্যাপকভাবে চলতে থাকে । শামসুদ্দীন তালুকদার নামে একজনকে দুই জন পাক বাহিনী দিয়ে তার দুই পা দুই দিকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় । এই সময় আবদুল গফুর মিয়া বিএ সাহেবকে সে নিজে তার মুখের মধ্যে স্প্রিট ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে ।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম ৩ মাস আমার ছেলের কোনো খবর পাই না। ৩ মাস পর একজন আমার বাসার মধ্যে প্রবেশ করে এবং বলে যে আমাকে তারাতারি কোন জায়গায় লুকান , আমি ক্যাপ্টেন জিয়ার কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছি । সে আমাদের কাছে ক্যাপ্টেন জিয়ার খবর দেয় এবং বলে যে সে ভাল আছে আপনি কোন চিন্তা করবেন না । দেশ খুব তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে । এর পর থেকে প্রায়ই সেই ছেলেটি এসে ক্যাপ্টেন জিয়ার খবর আমাদের কাছে এসে দিয়ে যেত ।

পাক ক্যাপ্টেন এজাজ একদিন ঘোষনা করে দেয় যে , ক্যাপ্টেন জিয়া মঠবাড়িয়া যুদ্ধে মিলিটারীর হাতে এরেস্ট হয়েছে এবং তাকে বরিশাল পাঠানো হয়েছে ।এই খবর আবার দালাল দিয়ে আমার কাছে পৌছে দিত যেন আমি ভেঙ্গে পড়ি । অনেক সময় দালালরা আবার এসে বলতো যে আমার ক্যাপ্টেন জিয়ার মৃত লাশ বলেশ্বর নদীতে ভাসতে দেখেছি ।

স্বাক্ষর/-
আফতাব উদ্দিন আহমদ
১৯/৮/৭৩

।। ২০০ ।।
খাদিজা বেগম (দুলু)
থানা- পিরোজপুর
জেলা- বরিশাল

পাক বাহিনী ব্যাপক অত্যাচার চালায় সারা শহরে। কালিবাড়ী রোডের দুইধার, মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, রাজারহাট, কুকারপাড়া, ডুমুরতলা, কদমতলা, নামাজপুর, আলনকাঠি, ঢুলিগাতি, রানীপুর, পারের হাট, চিংড়াখালী ইত্যাদি এলাকা পাক বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে, ঘরবাড়ী লুট করে জ্বালিয়ে ধ্বংস করেছে।

পাক বাহিনীর অসংখ্য মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। রাধারমণ ঘোষ নামে এক ব্যাক্তি ও তার ছেলেকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পাক বাহিনীর লোকেরা তার মেয়েদের চায়। আষাঢ় মাসের এক রাতে তিন জন মেয়েকে ধর নিয়ে যায় পাক ছাউনীতে। পর পর তিন দিন তিন রাত অমানুষিক দৈহিক অত্যাচার চালায়। তিন দিন পর শয্যাশয়ী অব্স্থায় গাড়ী করে বাড়ী দিয়ে যায়। দৈহিক অত্যাচারের ফলে মৃত অবস্থায় ছিল, পরে বহু চিকিৎসা করে বাঁচে।

সুন্দরী মেয়েকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। বাবা, ভাই অনেক আকুতি মিনতির পর পাক সেনারা অত্যাচার চালায়। শেষ রাতে দিয়ে যায় তার পরদিন আবার ধরে নিয়ে যায়। পরপর কয়েকদিন রেখে অমানুষিক দৈহিক অত্যাচার চালিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় তাদের বাড়ী দিয়ে যায়।

পাকসেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে মেয়ে ধরে পিরোজপুর সেনানিবাসে নিয়ে যেত এবং অকথ্য অত্যাচার চালাতো। ভাগিরথী নামে এক মেয়েকে মুক্তিবাহিনী পক্ষের গোয়েন্দাগিরি করার অপরাথে গাড়ীর পেছনে ১০/১২ হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে সারা শহর ভীষণ বেগে গাড়ী চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।

মন্টু নামে এক ছেলেকে পাকসেনারা ভাণ্ডারিয়া থেকে ধরে এনে উপরে পা ঝুলিয়ে দিনের পর দিন বেত পিছিয়েছে। কোন খাবার দেয়নি। শরীর কেটে কেটে লবণ দিয়েছে। তিন রাত ঐ ভাবে ঝুলিয়ে পিটিয়েছে আর নানা খবর জিজ্ঞাসা করেছে। এত অত্যাচারের পরও কোন কথা সে স্বীকার করেনি। তিন দিন পর অর্ধমৃত অবস্থায় বেয়োনেট দিয়ে চার্জ করে হত্যা করেছে।

স্বাক্ষর
খাদিজা বেগম (দুলু)
২০/০৮/৭৩

।। ২০১ ।।
রেনুবালা বারুই
গ্রাম- বাইনকাঠি
ডাকঘর-নাজিরপুর
জেলা-বরিশাল

পাকসেনা প্রথম আমাদের গ্রামে যায় শ্রাবণ মাসে। আমি তখন গোবর্দ্ধন গ্রামে স্বামীর বাড়ী ছিলাম। কাঠালিয়া গ্রাম, বাইনকাঠি, তারাবনে গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। গ্রামকে গ্রাম লুট করে বাড়ীঘর ভেঙ্গে নিয়ে গেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে। অসংখ্য হিন্দু লোককে জোর করে মুসলমান করেছে।

অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে। বহু মেয়েকে পাকসেনারা ধরে পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। প্রায়ই ঘরের মেয়েকে পাকসেনারা ধর্ষণ করেছে। তিনজন মেয়েকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায় তাদের ছাউনী নজিরপুর থানার পাশে সাত কাছিমা নামক স্থানে মাদ্রাসাতে। ক্রমাগত সাত আট দিন অসংখ্য রাজাকার তাদের উপর অত্যাচার চালায়। দিনের পর দিন দৈহিক অত্যাচার চালায়। রাজাকাররা তাদের ছাউনীতে আরও বহু মেয়ে রাখতো এবং দিনে রাতে ভোগ করতো। দেশ মুক্ত হলে অসুস্থ অবস্থায় মুক্তি বাহিনীরা মেয়ে তিনটিকে উদ্ধার করে।

আমার স্বামী কৃষক ছিলেন, জমি চাষ করা ফসল ফলানো তার কাজ ছিল। যুদ্ধ বাঁধলে আমার খুড়তুতো শ্বশুর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। আমার স্বামীও উৎসাহ ভরে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখান। তারপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় গেছেন অপারেশনে।

২৭ শে আষাঢ় গোবর্ধন স্কুলের পাশে মুক্তি সেনাদের সাথে আমার স্বামীও ছিলেন। দলে প্রায় ৫০০ মত ছিল। ঐ দিন পাকসেনা রাজাকার মিলে ৭০০/৮০০ ছিল। তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিসেনারা তাদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে ব্যার্থ হয়ে পিছু হটে। সেই সময় আমার স্বামী পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। আমার স্বামী সহ আরও ৬ জনকে ধরে। সাত জনের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর রাজাকাররা আমার বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং অত্যাচার চালায়। শিকদার বাড়ীর সবাইকে হত্যা করে। তারপর বাড়ী ছেলে পালিয়ে যাই। গ্রামের পর গ্রামে ঘুরে পালিয়ে বেড়িয়েছি। আজ আমি অবহায় নিঃস্ব সর্বহারা। যেখানে গেছি সেখানেই দেখেছি পাক বর্বর আর পশু রাজাকারদের অত্যাচারের বীভৎস রূপ। আজ দেশ স্বাধীন কিন্তু আমি কি নিয়ে বাঁচবো বলতে পারেন?

স্বাক্ষর/-
রেনুবালা বারুই
২০/০৮/৭৩

।। ২০২।।
আলী হায়দার খান
পিরোজপুর, বরিশাল।

কর্ণেল আতিকের নেতৃত্বে পাক সেনারা হুলার হাট আসে। ঢুকেই ঘরবাড়ী জ্বালাতে থাকে। মুসলিম লিগাররা তাদের স্বাগত জানায়। পাক সেনারা বলে হিন্দু বাড়ী কোথায়? এরপর থেকে হিন্দু ঘরবাড়ী জ্বালাতে থাকে। লুটপাট হত্যা অনবরত করতে থাকে।

পিরোজপুর মহকুমা প্রশাসক মহিবুল্লাহ শাহ (সিন্ধী, পাকিস্তানের বিশিষ্ট ন্যাপ নেতা বাকের শাহর ভাইপো) আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্পূর্ন সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেছিলেন দোস্ত তোমরা স্বাধীনতা পেয়েই যাচ্ছ, আমরা পেলাম না।

৫ ই মে ষড়যন্ত্র করে ওসি ভারপ্রাপ্ত, এসডিও আব্দুর রাজ্জাক
(২) এসডিপিও ফয়জুর রহমান আহমেদ
(৩) ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানকে ডেকে আনিয়ে মিটিং শেষ করে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। বাড়ীঘর লুট করে। এরপর অত্যাচার শুরু করে। পিরোজপুরের চৌদ্দ আনা ঘর দুয়ার ধ্বংস করেছে, লুটপাট করেছে।

পাক সেনারা হুকুম দেয় প্রতি ইউনিয়ন থেকে ২০ জন করে যুবক দিতে হবে। এই মোতাবেক গ্রাম থেকে ধরে ধরে শত শত লোককে হত্যা করেছে। চার হাজারের বেশী লোককে পাক সেনারা হত্যা করেছে। ভাগীরথী নামে একজনকে স্পাই সন্দেহে ধরে গাড়ীর পেছনে বেঁধে সারা শহর ঘুরিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সম্পূর্ন উলঙ্গ অবস্থায় বিশিষ্ট ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গণপতি হালদারকে (ম্যাট্রিকে প্রথম, আইএসসিতে প্রথম) নির্মমভাবে হত্যা করেছে। দৈনিক হত্যা করেছে।

ঘাটের পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। গাছের সাথে বেঁধে বেয়নেট চার্জ করেছে। চিৎ করে শুইয়ে বাঁশের গোড়া দিয়ে পিটিয়ে হাড় সম্পূর্ন ভেঙ্গে গেলে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করেছে, পিটিয়ে অনেককে হত্যা করেছে। বেঁধে পায়ে আগুন চেপে ধরেছে, সুঁচ ফুটিয়েছে।

এসডিওর বাংলোতে যেখানে পাক ক্যাম্প ছিল সেখানে অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করেছে। ফুলু রাণী বিশ্বাসের (কলেজ ছাত্রী) উপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতনের ফল তার মৃত্যু ঘটে। সমস্ত থানাতেই পাক সেনারা ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে।

স্বাক্ষর/-
আলী হায়দার খান
১৬/৮/৭৩

।।২০৩।।
ভারতী রাণী বসু
গ্রাম – স্বরুপকাঠি
জেলা – বরিশাল

২৭শে এপ্রিল আমি কাঠালিয়া থানার মহিষকান্দি গ্রামে যাই আত্মরক্ষার জন্য। তখন চারদিকে সব বিচ্ছিন্ন অবস্থা। হিন্দু বাড়ি বিভিন্ন স্থানে লুট হচ্ছে, হত্যা চলছে। ওখানে পৌছানোর পরপরই স্থানীয় কিছু লোক হিন্দু বাড়ি লুট শুরু করে দেয়। ২০/২৫ জনের বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সকালে, দুপুরে, রাতে, ভোরে যখন তখন বল্লম, দা এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দু বাড়ি আক্রমণ করে সব লুট করে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমি স্বরুপকাঠিতে ফিরে আসি ৫ই মে। সেদিন ছিলো হাটবার। ঐ দিনই সমস্ত এলাকা লুট করে নেয় দুষ্কৃতিকারীরা।

৬ই মে সকালে পাক সেনা প্রথম স্বরূপকাঠিতে যায়। ওখানকার পীর শর্ষিনার বাড়ীতে গিয়ে পাক বাহিনী ওঠে। ওখান থেকে থানায় আসার পথে শর্ষিনার পুল থেকে থানা পর্যন্ত (সাহাপারা) সমগ্র হিন্দু বাড়ী প্রথমে লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে পাক বাহিনীর একটা দল অলঘারকাঠির দিকে গিয়ে ঘর বাড়ী জ্বালানো ও সেই সাথে মানুষ হত্যাও শুরু করে। আর একটা দল স্বরূপকাঠি এসে শুধু হিন্দু বাড়ী বেছে বেছে সকল হিন্দু বাড়ী লুট করে পুড়িয়ে দেয়। কালী প্রতিমার উপর অসংখ্য গুলি চালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। বহুজনকে হত্যা করে। তারপর পাক বাহিনী ফিরে যায়। তারপর থেকে ক্রমাগত সাত দিন পাক বাহিনী স্বরূপকাঠিতে যায়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে আর লুট করেছে। স্থানীয় কিছু লোক এবং পীরের দল পাক বাহিনীর সাথে থাকতো। লুট করতে বলে তারা যখন লুট করতে আরম্ভ করে তখন পাক সেনারা ছবি তুলতো।

কুড়িয়ানা আটঘর, জলাবাড়ী, সমুদয়কাঠি, জুলুহারা, নান্দিঘর, সোহাগদল, ইন্দ্রিরহাট, মণিনাল, বাটনাতলা ইত্যাদি গ্রামসহ ৯টি ইউনিয়নে পাক বাহিনীরা গ্রামের প্রতিটি কোনাতে ঘুরে সব ধ্বংস করেছে, লুট করেছে।

কুড়িয়ানা আটঘরে পিয়ারার বাগানে বহুজন আশ্রয় নিয়েছিল। পাক বাহিনী হঠাৎ করে ঘিরে ফেলে অসংখ্য লোককে হত্যা করে। এক মেয়েকে পিয়ারা বাগান থেকে ধরে এনে সবাই মিলে পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারপর তিনদিন যাবৎ ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে কেটে লবণ দিয়েছে। অশেষ যন্ত্রণা লাঞ্ছনা দেওয়ার পর মেয়েটিকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েটি ম্যাট্রিক পাশ ছিল। অন্য একজন মহিলাকে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে অধিকাংশ লোককে গুলি করে এবং বেয়নেট চার্য করে হত্যা করেছে। শত শত লোককে এই এলাকাতে হত্যা করেছে।

কাউখালি স্টেশনে আমি নিজে দেখেছি একজনকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহে রাজাকাররা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। স্বরূপকাঠিতে টিকতে না পেরে মহিষকান্দিতে যাই। ওখানে গেলে আমাকে সবাই মুক্তিবাহিনীর চর মনে করলো এবং অস্ত্র আছে বললো। আমি ওখান থেকে রাতে পালিয়ে যাই রাজাপুরে।

রাজাপুর থানাতে হামিদ জমাদার সমগ্র থানাতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে, হত্যা করেছে। হিন্দু কোন বাড়িঘর ছিল না। সব ধ্বংস করেছিল। ওখানে শুক্কুর মৃধা শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ছিল। আমি সহ আরো তিনজন তিন হাজার টাকা দিয়ে কোন রকম সেবারের মতো বাঁচি। আমি তখন কুমারী ছিলাম। সবাইকে মুসলমান হতে হবে এবং মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে সুনীল কুমার দাস নামে এক ভদ্রলোককে আমি বিয়ে করি সে সময় দুষ্কৃতিকারীর হাত থেকে বাঁচবার জন্য। সময়টা ছিল জুন মাসের শেষ অথবা জুলাই প্রথম।

রাজাপুরে আছি স্বামীসহ। ভোরবেলা রাজাকার, পুলিশ মিলে প্রায় ৩০/৪০ জন আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। স্বামীকে লুকিয়ে রাখি। ওরা এসে সব কিছু লুট করে গালাগালি করে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে আবার এসে আর যা ছিলো সব নিয়ে অত্যাচার চালায়। পাশের একটি লোককে হত্যা করলো।

নৈকাঠি রাজাপুর থানা গ্রামে শতকরা ৯৮ জনকে হত্যা করে। ওখানকার সব হিন্দু। ৯৮% মহিলা আজ বিধবা। নৈকাঠির প্রায় সব পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের যথাসর্বস্ব আত্মসাৎ করে হামিদ জমাদার ও তার দল। ঐ বিপদের মাঝে জঙ্গলে জঙ্গলে এ বাড়ি ও বাড়ি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমার সব কিছু লুটে নেয় রাজাকার আর পাক বাহিনী। আমি কোন মতে পালিয়ে বাহিরচরে যাই জুলাই মাসের ১৭ তারিখে। আমি আমার কাজে যোগ দেই। তার পরপরই আমাকে সাসপেন্ড করে রাখে তিন মাস । বাহিরচরে সমগ্র এলাকা খুন, ডাকাতিতে ভরা। সমগ্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।

অক্টোবর মাসে কুদ্দুস মোল্লাকে (মুক্তিবাহিনী) চিকিৎসা করার জন্য কর্নেল আমাদের সবাইকে ডেকে লাঞ্ছনা দেয়। যাবার পথে গানবোট থেকে আমাদের হাসপাতালে শেল ফেলে। আমরা দারোয়ান পাহারা রেখে মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসা করেছি। আমাদের ডাঃ শামসুল হক মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গোপনে গিয়েও তাদের চিকিৎসা করেছেন। আমরা সবাই সবকিছু দিয়ে তাদের সাহায্য করতাম।

বাহিরচরে পাক বাহিনীরা মেয়েদের উপর চালিয়াছে অকথ্য নির্যাতন। বোয়ালিয়া, কাঁদপাশা, রাজগুরু, বাবুগঞ্জ থানা, দুয়ারিকা ইত্যাদি এলাকা থেকে বহু মেয়ে ধরে এনে ভোগ করেছে। আমার জানা এক হিন্দু মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ধরে নিয়া যায়। মহিলা খুব সুন্দরী ছিল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চারদিন ক্রমাগত অকথ্য দৈহিক নির্যাতন চালায়। অসহ্য যন্ত্রণায় মহিলা ছটফট করেছে। চারদিন পর মহিলা ছাড়া পায়। আমরা তার চিকিৎসা করে ভালো করি।

আমি স্বামীসহ বাস করছিলাম। আমার সর্বস্ব যাওয়া সত্ত্বেও স্বামী নিয়ে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার স্বামী স্বাধীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। আমাকে প্রায় বলতেন ডিসেম্বর মাস যদি বাঁচি জানুয়ারীর মধ্যে নিশ্চয় স্বাধীনতা পেয়ে যাবো।

৯ ই ডিসেম্বর গৌরনদী থানার মাহিলারার ব্রিজের উপর দিয়ে আমার স্বামী যাচ্ছিলেন। তখন পাক বাহিনী প্রায় আত্মসমর্পণ করে এমন অবস্থায় ব্রিজে ডিনামাইট স্থাপন করে রেখেছিলো। সেই ডিনামাইট ফেটে ব্রিজ ধ্বংস হয়। আমার স্বামী ওখানেই নিহত হন। সব হারিয়ে একমাত্র স্বামী ছিলো তাও স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্তে হারাতে হলো।

আমি বাহিরচর থেকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার পাঠিয়েছি। রাতে যখন তখন আমার ওখানে তারা এসে থাকতো, যেতো। আমার স্বামী মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে মাঝে মাঝে যেতেন। আমার স্বামীর বড় সাধ ছিলো স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাস করা। তার সে সাধ পূর্ণ হলো না।
স্বাক্ষর/-
ভারতী রাণী বসু
১৮/৮/৭৩

।।২০৪।।
উষা রাণী মল্লিক
গ্রাম: জুলুঘাট, ডাকঘর: মৌশানি
থানা: স্বরুপকাঠি, জেলা: বরিশাল
২২ শে বৈশাখ ঝালকাঠি থেকে রাজাকার ও মিলিটারী স্বরুপকাঠি থানাতে আসে। প্রথম দিন স্বরুপকাঠি থানাতে প্রবেশ করে ১৮ জন হিন্দু পুরুষ ছেলেকে পাক বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। পাক বাহিনী আমাদের বাড়ির পাশেই জুলুঘাট স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাক বাহিনী আসার ৩ দিন পর আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে গ্রাম থেকে পালিয়ে আটঘর কুড়িয়ানা চলে যাই।

প্রায় ২ মাস দেশের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে থেকে শেষে বাধ্য হয়ে আমাদের গ্রামে ফিরে আসি। হিন্দু বলে লোকে আমাদের জায়গা দিতে চাইতো না। ঠিক মতো খাবার মিলতো না, লোকের কাছে চেয়ে চেয়ে খেতে হতো। সব জায়গায় ঐ একই কথা, মিলিটারি আসবে পালাও। রাজাকাররা রাত্রের অন্ধকারে গ্রামে গ্রামে ঢুকে বহু যুবতী সুন্দর নারীকে ধর্ষণ করেছে এবং ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে। এই সময় তারা পুরুষদেরকে ধরে নিয়ে যায় এবং সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। যাকে একবার ধরে নিয়ে যেত সে আর ফিরে আসতো না।

আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি একদিন পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে। আমার বাড়ির পিছনে কলাবাগানের মধ্যে লুকিয়ে থেকে সব কিছু দেখছিলাম। আমার বাড়ির উপর দিয়ে আমার পাশের বাড়িতে ঢুকে পাক বাহিনী দুইজন মেয়েছেলেকে ধরে ফেলে এবং ঘরের ভিতর জোর করে নিয়ে যায়। আমরা ঝোঁপের ভিতর থেকে দেখতে থাকি কিন্তু করার কিছুই থাকে না। মেয়ে দুইটাকে যখন ঘরের ভিতর নিয়ে যায় তখন তাদের কোলের ছোট ছেলেকে আছাড় মেরে বাইরে ফেলে দেয়। ঘরের ভিতর থেকে মেয়ে দুইটার করুণ চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। দুইটা মেয়ের উপর পরপর ৪ জন মিলিটারি ধর্ষণ করে। মিলিটারি চলে যাবার পর আমরা মেয়ে দুইটার কাছে যেয়ে দেখি তারা অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের সারা শরীরে ক্ষতের চিহ্ন। পরনের কাপড় দূরে রয়েছে। সে এক করুণ দৃশ্য। তারা ঐদিন গ্রাম থেকে আরো কয়েকজন মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে।

পাক বাহিনী থাকাকালে তারা প্রায়ই আমাদের গ্রামসহ আশে পাশের গ্রামগুলিতে আসতো। তাদের আসার খবর পেলেই সব লোক যে যেদিকে পারতো পালাতো। রাজাকাররা এই সময় সব জায়গা খুঁজে খুঁজে লোকজনকে ধরেছে। পুরুষদের সেখানেই গুলি করে হত্যা করতো আর মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যেত। অনেককে আবার ধর্ষণ করার পর ফেলে রেখে যেত।

শেষের দিকে রাজাকারদের অত্যাচার চরমে ওঠে। তারা প্রত্যেকদিন গ্রামের ভিতর যেতে থাকে এবং যেখানে যাকে পায় তাকেই মারতে থাকে। তখন বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে থাকি।

দেশ স্বাধীন হবার পর চারিদিকে আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। মানুষ সব কষ্ট ভুলে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে।
স্বাক্ষর/
উষা রাণী মল্লিক
২০/৮/৭৩

।।২০৫।।
যতিন্দ্রনাথ মন্ডল
গ্রামঃ শশীদ
ডাকঘরঃ মৌশানী
থানাঃ স্বরুপকাঠি
জেলাঃ বরিশাল
১৭ ই বৈশাখ পাক বাহিনী গানবোট নিয়ে ঝালকাঠি দিয়ে কাটাখালী নদী দিয়ে শশীদের হাটে আসে। তারা এসে হাটের পাশে গানবোট রেখে গ্রামের উপর নেমে পড়ে। পাক বাহিনী গ্রামের ভিতর প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের নারী পুরুষ প্রাণের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে চেষ্টা করে। পাক বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমে দামী দামী জিনিসপত্র লুটতরাজ করে এবং পরে ৯ খানা বাড়ি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে দেয়। ঐ দিন ২ জন লোককে তারা গুলি করে। এদের একজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় আর একজন গুরুতর রুপে আহত হয়।

২৬ বৈশাখ পাক বাহিনী ও রাজাকাররা পুনরায় আমাদের গ্রামে আসে। তারা গানবোট ও স্পিড বোট নিয়ে ছোট খাল দিয়ে গ্রামের ভিতর ঢুকে পড়ে। মতিলাল দেবনাথ (ব্যানার্জী) ও হিরালাল দেবনাথের কাপড়ের দোকান লুট করে স্পিডবোট বোঝাই করে কাপড় নিয়ে যায়। এই সময় ওরা মতিলাল দেবনাথের কাছ থেকে নগদ ১২,০০০ টাকা নেয় এবং তাঁকে বেয়োনেট চার্জ করে পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই দিন আমাদের গ্রামে ১৮ জন লোককে পাক বাহিনী গুলি করে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। এর মধ্যে জিতেন নামে একজনকে পাক বর্বর বাহিনী নারিকেল গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার পায়ের কাছে খড়কুটো দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার সারা শরীরে আগুন ধরে গেলে সে ভীষণভাবে চিৎকার করতে থাকে। তখন পাক বর্বর বাহিনী গুলি করে তার মাথার অর্ধেক অংশ উড়িয়ে দেয়।

এই ঘটনা তার স্ত্রীর সম্মুখে হয়। কেননা পাক বাহিনী তার স্ত্রীকে ধরে এনে তার সম্মুখে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই সময় ক্ষীরদা সুন্দরী নামে বিধবা মেয়েকে পাক বাহিনী সারা শরীর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম্ভাবে হত্যা করে। এ সময় আর এক মহিলা পাশের জঙ্গলের ভিতর পালিয়ে ছিলো তার ছোট ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে। পাক বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে এক গুলিতে ছেলে, মেয়ে সহ তিনজনই মারা যায়। ঐদিন আমাদের গ্রামের মোট চারখানা বাড়ি বাদে আর সব বাড়ি অগ্নিসংযোগ করে দেয়।

৫ই জ্যৈষ্ঠ পাক বাহিনী ঝালকাঠি থেকে গানবোট নিয়ে পুনরায় শশীদ হাটে আসে এবং হাটের উপর ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐ দিনই পাক বাহিনী আমাদের গ্রাম থেকে ২ জন লোককে হত্যা করে। তার মধ্যে একজন ছিলো স্থানীয় স্কুলের সেক্রেটারী কালী কান্তা মন্ডল। এই সময় পাক বাহিনী স্কুলের লাইব্রেরী লুট করে এবং ভেঙ্গেচুরে সব তছনছ করে দেয়। লাইব্রেরীর ভিতরে ছাত্রদের দেওয়া রিলিফের গমে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই আগুন নেভাতে গিয়েই সেক্রেটারী সাহেব গুলি খান।

পাক বাহিনী এই সময় ১০ দিন শশীদ হাটে ক্যাম্প করে থাকে। এই সময় তারা ব্যাপক হারে নারী ধর্ষণ করে। আমাদের গ্রামের অনেক মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করে। পাক বাহিনী রাত্রিতে গ্রামের ভিতর ঢুকে মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে এবং কিছু কিছু মেয়েকে তারা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং এক একজনের উপর পরপর কয়েকজন পাক পশু ধর্ষণ করে। এই সময় ১০ বছরের একটা ছোট মেয়েকে পাক বাহিনী তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং একাধারে তার উপর চলে পাশবিক অত্যাচার। পাক বাহিনী চলে যাবার পর এই মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। ৩ মাস পর্যন্ত এই ছোট মেয়েটি হাঁটতে পারতো না।

৮ মাসের গর্ভবতী একটি মেয়ের উপর পাক বাহিনী এই সময় অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার চালায় যার দরুন সন্তান প্রসব করার পর সে ও সন্তান মারা যায়।

২৫ শে শ্রাবণ পাক বাহিনীর দালালের সহযোগীতায় ঝালকাঠি থেকে গানবোট নিয়ে শঙ্কর ধবল গ্রামে আসে। আছমত আলি ও রহিনী মিস্ত্রিকে ধরে নিয়ে শশীদ গ্রামে আসে এবং সুনীল সরকার নামে এক ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এই সময় খুব বৃষ্টি নেমে পড়ে। পাক বাহিনী তখন রহিনী কুমার মণ্ডলের ঘরে আশ্রয় নেয়। হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা নিয়ে খুব গান বাজনা করে এবং কলা খায়। বৃষ্টি শেষে যাবার সময় গৃহকর্তা রহিনী কুমার মণ্ডলকে গুলি করে হত্যা করে যায়। যে দুইজন লোককে তারা বন্দী করে আনে তাদের একজনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় এবং একজনকে শশীদ হাটে বসে গুলি করে হত্যা করে। তাঁকে হত্যা করার আগে খুব মারপিট করে এবং গালাগালি দেয়। যাকে এই সময় ছেড়ে দেয় তাঁকে বলে তোমরা জয় বাংলা বলতে পারবে না। বলবে “জয় পাকিস্তান”।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বরূপকাঠি থানার অশ্বথকাঠি, জিনহার, মাদ্রা, পুর্বজলা বাড়ী, মৌশানী, জুলুহার, আতা, জামুয়া, জৌসার, গণপতিকাঠি, আরামকাঠি প্রভৃতি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বহু লোককে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এই সময় মাদ্রা গ্রাম থেকে দুইজন লোককে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অপরাধ ছিল পাক সৈন্য যখন একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার জন্য যায় তখন তারা দুইজন বাধা দেয়। এই সময় তারা বহু মেয়েকে ধর্ষণ করে। একমাত্র স্বরূপকাঠি থানাতেই ১ হাজারের বেশী মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করেছে।

বিভিন্ন সময় আমাদের থানাতে প্রায় ২০০/৩০০ লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। স্বাধীনতার পর আটঘর কুড়িয়ানা স্কুল ঘরের পেছনে একটা পুকুরের ভেতর থেকে ১৫৬ টা মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়।

পাকবাহিনী স্বরূপকাঠি দখল করার পর স্বরূপকাঠি, কুড়িয়ানা, শশীদ, বাউকাঠি, জলাবাড়ী এইসব জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে এবং এখান থেকেই বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালায়। জলাবাড়ী ক্যাম্প অঞ্চলে ৩৩ টা গ্রাম শুধু হিন্দু বসতি ছিল, পাকবাহিনী সব গ্রাম একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
স্বাক্ষর/
যতিন্দ্র নাথ মন্ডল

।।২০৬।।
শ্রী ফনীন্দ্র ভূষণ পাল
ঝালকাঠি, বরিশাল
আমি পশ্চিম ঝালকাঠি গ্রামে গুরুচরণের পরিত্যক্ত বাড়ী হতে রাজাকার এবং পুলিশ দ্বারা ধৃত হই। পরে ঝালকাঠি থানার ওসি সেকান্দার সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। উক্ত গ্রাম হতে আজহার নামক অপর এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে আসে। তাঁকে বেদম প্রহার করা ফলে তাঁর গুহ্যদ্বার দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। আমাকে থানায় নিয়ে আসে। সেদিন প্রায় ৪০ জন বব্দী ছিল। যাদের ধরে আনতো তাদের রাইফেল দিয়ে বেদম প্রহার করতো। এর ফলে অনেকের দাঁত, হাত, পা ভেঙ্গে যেত।

প্রত্যেক দিন ভোর রাতে বন্দীদের থানা হতে কিছু দূর এক বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতো। রাতে গোপনে একটা কমিটি বসতো ধৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে। যাদের ছেড়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করতো তাদের উক্ত রাতে ছেড়ে দিত, বাকীদের বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতো। আমাকে যেদিন ধরে নিয়ে যায় সেদিন আজহার ও তার পুত্র মুক্তিফৌজ জনাব রশিদকে ধরে নিয়ে আসে। আজহার তার পুত্রের চিন্তায় খাদ্য পরিত্যাগ করে। আমি তাকে বলি যে তোমার পুত্র দেশের জন্য শহীদ হচ্ছে এবং এটা বীরত্বের কথা, সুতরাং দুঃখ পাবার কিছুই নেই। তখন তার পুত্র রশিদ বলে যে, “আব্বা মরে তো যাবই, কিন্তু যাবার পুর্বে তোমার সাথে একত্রে আহার করি।” উক্ত পুত্র আমাকেও তার সাথে আহার করে বলল এবং আমাকে তাকে আহার করিয়ে দিতে বলে। তখন আমরা একত্রে আহার করি। তখনকার সেই দৃশ্য সহ্য করার মতো ছিল না। সে দৃশ্য অত্যন্ত করুণ ছিলো। সে আমাকে তার পিতাকে সাহায্য করার কথা বলে। পরে উক্ত ৪০ জনকে রাতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

এরপর আমি বাড়ী যাই। পরে পাঞ্জাবী বাহিনী এসে পুনরায় শহরে লুটপাট শুরু করে এবং নারী ধর্ষণ বেশী করে। এরা মানুষকে হত্যা করে কবর দিতো। এর পূর্বে মানুষদের হত্যা করে নদীতে ফেলতো। কিন্তু তখন বিভিন্ন মিশন ঝালকাঠিতে আসতে থাকায় তাঁরা অনেক ভাসমান লাশ দেখে এবং পাকবাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে সন্দেহ করে। এই জন্য তাদের হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে পাকবাহিনী চেষ্টা করেছে তাদের কৃতকর্মের নজির চাপা দিতে। পাকবাহিনী সেই সময় শহরে অবস্থিত বহু পরিবারের নারীদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এরপর তাঁদের দালাল বাহিনী ধরে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করে।
স্বাক্ষর/
শ্রী ফনীন্দ্র ভূষণ পাল
১৫/৮/৭৩

।।২০৭।।
মোঃ মেমবর আলী সরদার
গ্রামঃ উত্তর তালগাছিয়া
জেলাঃ বরিশাল
অসহযোগ আন্দোলনে জনগন স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগীতা দেখিয়েছে। আমরা অফিস আদালত বন্ধ করে আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেই।

আমি গোসল করতে যাবার সময় দেখি যে দুই ব্যক্তিদের তাদের একসঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। তাদের রাস্তায় ফেলে চলে যায়।

বাগেরহাট ডাক বাংলোয় ঘাটে আমি চার/পাঁচজন মানুষকে এক সাথে হত্যা করতে দেখেছি। তার মধ্যে দুই একজন তখনো জীবিত ছিল। তারা রাস্তায় মানুষ দেখলে বাচাঁও বাচাঁও বলে চিৎকার করতো বাচঁবার আশায়। কিন্তু তাদের সাহায্য করলে পাকবাহিনী সাহায্যকারীকেও হত্যা করতো। মানুষ মুমূর্ষু ব্যক্তিকেও সাহায্য করতে পারতো না এই বর্বর পাক সেনাদের ভয়ে।

একদিন দুজন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করে তারা ডাক বাংলোর সামনে ঝুলিয়ে রেখে পিঠে কাগজ লাগিয়ে লিখে রেখেছে উক্ত ব্যক্তিদ্বয় নক্সাল। তাদের পিঠ রাস্তার দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। এইভাবে মৃত ব্যক্তিদের দেখিয়ে অমানুষিক ও বর্বরোচিত কার্য করে মানুষকে ত্রাসের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করেছে।

একদিন দুজন যুবককে ধরে নিয়ে আসলো। শুনলাম তারা মুক্তিফৌজ। পাকবাহিনীর একটি জাহাজ মাইন দিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে বাগেরহাটে এসে রাত কাটানোর সময় স্থানীয় দালাল দ্বারা ধৃত হয়ে পাকবাহিনীর হাতে পড়ে। তাদের ধরে নিয়ে এসে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। বেদম প্রহার করে তাদের নিকট মুক্তিফৌজের বিভিন্ন গোপন সংবাদ জানার জন্য। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তাদের গোপন তথ্য ও সঙ্গীদের নাম শত অত্যাচারেও প্রকাশ করেনি। তারা মৃত্যু পূর্ব মুহুর্তেও বলেছে তোমরা আমাদের মেরে ফেলতে পারো কিন্তু আমি আমার গোপন তথ্য ও সঙ্গীদের নাম বলবো না। পাকিস্তানী সেনারা তাদের পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলার জন্য চাপ সৃষ্টি করলেও তারা জয়বাংলা বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।

ওয়াপদার রেস্ট হাউজ ও ব্যারাকের সমস্ত এলাকা পাকবাহিনী দখল করে সেখানে শক্তিশালী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। আমার নিবাস ছিল উক্ত ক্যাম্পের অতি নিকটে। সুতরাং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থায় আমি পাকবাহিনীর ধ্বংসাত্মক ও নির্যাতনের বহু দৃশ্য দেখেছি।

রায় সাহেব কিরণ চন্দ্র দাস মহাশয়ের বাড়ীতে একদিন একদল পাকবাহিনী প্রবেশ করে। তারা রায় সাহেবকে তার বাড়ির গোপণ স্থান সমূহ দেখাতে বলে, তিনি তা পালন করেন। পরে তাঁকে বলে যে ওটা কি? যখন তিনি সেই দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন তখন গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয় এবং সমস্ত মুল্যবান জিনিস লুট করে নিয়ে যায়।

ভোলা বোস নামে এক ব্যক্তিকে আহারের সময় গুলি করে হত্যা করে। ভোলা বোসের আহার সমাপ্ত করার অনুরোধও উপেক্ষিত হয় এই বর্বরদের কাছে।

পাক সেনারা গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল অপারেশন করে যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে আসতো পাকবাহিনীর ক্যাম্পে। তাদের সারারাত ধরে অফিসারগণ উপভোগ করতো। সময় সময় নির্যাতিত মহিলাদের করুণ আর্তনাদ মাঝ রাতে শুনতে পেতাম। পরে তাদের হত্যা করতো বলে মনে হয়।

সাধারণ সৈন্যগণ দিনের বেলায় প্রকাশ্যে শহরের বস্তি এলাকায় গমন করতো এবং বস্তি এলাকার মহিলাদের উপর জোর করে পাশবিক অত্যাচার চালাত। এই দৃশ্য কখনো যদি কোন পথচারীর দৃষ্টিতে পড়ে যেত তাহলে উক্ত পথচারীকে বেদম প্রহার করতো। এইভাবে তারা মহিলাদের উপর নির্যাতন চালাতো।
স্বাক্ষর/
মোঃ মেমবর আলী সরদার
৮/৮/৭৩

।।২০৮।।
সুধা রাণী বসু
গ্রামঃ ছাচলেপুর
ডাকঘরঃ পিংড়ী
থানাঃ ঝালকাঠি
জেলাঃ বরিশাল
১৩৭৮ সালের ৭ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে ঝালকাঠি থানা হতে ১৪ জন বাঙ্গালী পুলিশ স্থানীয় শান্তি কমিটির দালালসহ ছাচলেপুর গ্রাম অপারেশনে যায়। সকালবেলা পুলিশগণ আমার পিতার বাড়ী আক্রমণ করে এবং তা জ্বালিয়ে দেয়। আমরা সবাই নিকটস্থ জঙ্গলে পালিয়ে যাই। আমি আমার বড় মেয়ে রমাবাতী বসুকে নিরাপত্তার জন্য মোতাহার গোমস্তার বাড়ীতে রেখে দেই। পুলিশেরা পরে উক্ত বাড়ীতে গিয়ে মোতাহারের সাহায্যে আমার মেয়ে এবং অপর দুজন মেয়ে কমলা রানী দাস (বয়স ১৭) ও কল্পনা রানী দাসকে (বয়স ১৮) ধরে নিয়ে যায়। পরে মেয়েদের খুঁজতে গিয়ে দেখি যে কমলা ও কল্পনাকে গুলি করে বিষখালি নদীর পারে হত্যা করেছে এবং রমাকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করেছে। এছাড়াও আমার আত্মীয় দুর্গাশংকর দাসকেও গুল করে হত্যা করে। আমরা পরে উক্ত লাশ দেখতে পাই। উক্ত মেয়েদের নৃশংসভাবে হত্যা করে এই পুলিশ বাহিনী।

তার পরের দিন পূর্বোল্লিখিত পুলিশগণ পুনরায় উক্ত গ্রামে অপারেশনে যায়। তখন আমার স্বামী নদী পার হয়ে পিংড়ি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং সেখান হতে অন্যত্র চলে যায়। বহু দিন তার কোনো সংবাদ জানতে পারিনি। পুলিশের ভয়ে আমি দুই মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে চৌকিদার বাড়ীর জঙ্গলে আশ্রয় নেই। আমি আমার ছোট ২ পুত্র এক স্থানে গোপন করে থাকি। অন্যত্র আমার দুই মেয়ে আত্মগোপন করে থাকে। চৌকিদার তখন উক্ত পুলিশদের বলে যে এই হচ্ছে লিডার সঞ্জিবের মা, একে ধরো। তখন পুলিশেরা আমাকে ধরে ফেলে এবং ওসি বলে থানায় যেতে হবে।

সেই সময় আমার সঙ্গের মেয়েটি পুলিশকে বলে আমাদের মেরো না, আমার কাছে টাকা আছে নিয়ে যাও। তখন পুলিশ তার নিকট হতে ৩,০০০/= (তিন হাজার) টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং আমাদের থানায় নিয়ে আসে। আমার অপর দুজন মেয়ে অসহায় হয়ে যায়। তারা আশ্রয়ের জন্য ঘুরতে থাকে কিন্তু ভয়ে কেউ আশ্রয় দিতে স্বীকার হয়নি। একজন তাদের কান্না দেখে সদয় হয়ে তার বাড়ীতে আশ্রয় দেয়। যাহোক আমাকে থানায় নিয়ে এসে প্রায় দেড় মাস আটকে রাখে। তখন নিম্নে বর্ণিত দৃশ্যগুলি দেখেছি।

থানা হতে পুলিশেরা বিভিন্ন গ্রামে অপারেশন চালিয়ে নিরীহ লোকদের ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং রাত ৩ টার দিকে তাদের হাত বেঁধে দলবদ্ধ ভাবে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। ভোর চারটার দিকে সুগন্ধা নদীর তীরে এবং থানা হতে কিছুটা দূরে বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। আমি থানা হতে বহু মানুষের চিৎকার ও করুণ আর্তনাদ শুনেছি। কাউকেই রক্ষা করে নি।

অনেক মানুষকে থানা হতে ঝালকাঠি মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যেত এবং সেখান হতে যখন উক্ত ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনতো তখন তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়া ক্ষতের চিহ্ন দেখেছি। পাকবাহিনী লোহার রড গরম করে উক্ত ব্যক্তিদের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতো। পরে তাদের থানায় এনে রাতে উক্ত বদ্ধভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতো।

একদিন প্রায় ৯৫ (পচাঁনব্বই) জন নিরীহ লোকদের ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। প্রত্যেক দিন ধৃত ব্যক্তিদের নাম জিজ্ঞাসা করতো। কিন্তু সেইদিন তাদের সবাইকে নিয়ে লাইন ধরে হত্যা করেছে। সকালে একজন পুলিশ এসে তৎকালীন সি,আই (পুলিশ) কে জানায় যে ৯৫ (পচাঁনব্বই) জনের মধ্যে একজন জীবিত আছে। তখন উক্ত সি,আই উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ দেয়। প্রত্যেক দিন এই ভাবে ভোর রাতে ধৃত ব্যক্তিদের হত্যা করেছে। সি, আই এর নির্দেশে এই এক মাসে প্রায় ১,০০০ (এক হাজার) লোককে উক্ত বধ্যভূমিতে হত্যা করেছে বলে আমার মনে হয়।

আমার নিকত হতে ৩৮ ভরি সোনা এবং ৫০০ টাকার বিনিময়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি তখন নিজ বাড়ীতে চলে যাই। আমি আসার পর আমার স্বামীর সাথে দেখা হয়নি। আমার পুত্র সঞ্জীব মুক্তিফৌজ হওয়ায় তার খোঁজ পাইনি। বড় ছেলে দীলিপের সংবাদও পাইনি। এইভাবে এক মর্মান্তিক ও করুন অবস্থায় আমার দিন কেটেছে। স্বাধীনতার পর সবাই একত্রিত হই।

স্বাক্ষর/-
সুধা রানী বসু
১৩/৮/৭৩
।।২০৯।।
আজাহার আলী
গ্রামঃ গবিন্দ ধবোল,
ডাকঘরঃ কীর্ত্তিপাশা
থানাঃ ঝালকাঠি, জেলাঃ বরিশাল
১৯৭১ সালের ২৭ শে এপ্রিল পাকবাহিনী ঝালকাঠি শহরে আসে। এসেই তারা ঝালকাঠি শহরে আগুন দিয়ে সমস্ত শহরটা পুড়িয়ে দেয় এবং গণহত্যা শুরু করে। পাকবাহিনী বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আমার ছেলে মোঃ সাত্তার নিজ গ্রামে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে ৭ই আষাঢ় বেশাই খান গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ঐ দিন ঝালকাঠি ও স্বরূপকাঠি থানার পাকবাহিনী বেশাই খান গ্রামে গিয়ে উক্ত গ্রামটা সম্পুর্ণ ঘিরে নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে দেয়। তারপর পাকবাহিনী আমার ছেলে সাত্তারসহ মোট ৫৫ জন যুবক ছেলেকে ধরে। এবং জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে রাইফেল কোথায়? শরোজ বাবু কথায়? এই কথা বলতে থাকে আর কিল, ঘুষি, লাথির পর লাথি, বেতের লাথি দিয়ে প্রহার আর বন্দুকের বাট দিয়ে প্রহার করার পর তাদের মধ্যে হতে ১৩ জনকে একটা খালের পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে খালের মধ্যে ফেলে আসে। আর ৪২ জনকে গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝালকাঠি নিতে আসার সময় গান বোটে বসে সবার সামনে সাত্তারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে বেয়োনেট দিয়ে ফেঁড়ে ফেঁড়ে নাইট্রোজেন এসিড মাখিয়ে দেয়। তারপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এখনও বল শরোজ কোথায়, তার পরিবার কোথায় এবং মুক্তিবাহিনী কোথায়? সাত্তারের শরীরে এসিড মাখিয়ে দেয় আমাদের স্থানীয় এলাকার দুইজন কুখ্যাত মুসলিম লীগের দালাল চেয়ারম্যান আজহার কারিগর ও শাহাজউদ্দিন সরদার (সাজি)। তারপর তাদেরকে থানায় নিয়ে এসে হাজত ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। পরদিন সকাল বেলা আমি বাজারে এসে শুনতে পাই যে আমার ছেলে সাত্তারকে স্থানীয় দালালদের নির্দেশে পাক সেনারা তাকে ধরে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে গেছে এবং ভীষণ প্রহার করেছে। তারপর আমি থানায় চলে যাই এবং আমার ছেলে সাত্তারের সাথে দেখা করি। সাত্তার তখন আমাকে বলে পাক সেনারা আমাকে গুলি করে না মারলেও দালালরা আমাকে রক্ষা করবে না। তাই আপনি তাদের কাছ থেকে আমার জীবন ভিক্ষা চেয়ে দেখেন তারা কি বলে। আমি দালালদের নিকট চলে আসি এবং তাদের পায়ের উপর কেঁদে পড়ে আমার ছেলের জীবন ভিক্ষা চাইলে তারা আমকে লাথি দিয়ে দূরে ফেলে দেয় এবং বলে আগামীকাল সকাল বেলা এসো। তারপর আমি বাড়ী চলে যাই।

ঐ দিন রাত্রিতে আমার ছেলে সাত্তারসহ ২৮ জনকে নদীর ধারে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে লাইন করে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ভোরে আমি তাদের নিকট গেলে তারা আমাকে বলে তুমি গত রাত্রিতে গুলির শব্দ শোন নাই? তমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একথা শোনার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে সেখানে পরে যাই। ২০/২৫ মিনিট পর আমার জ্ঞান ফিরলে আমি সাত্তারের লাশের জন্য থানায় অনুমতির জন্য যাই। তখন থানায় পুলিশকে নির্দেশ দেয় আমাকে গুলি করতে। এবং আরও বলে সে যদি এখান থেকে চলে না যায় তাকে গুলি করে হত্যা করবে। তারপর আমি সেখান হতে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী চলে যাই। আমার ছেলের মরা লাশ সেখানে পরে থাকে। আমি বাংলাদেশের একজন গরীব কৃষক। দু’টা ছেলের মধ্যে মাত্র একজন ছেলে বেঁচে আছে। মাত্র দুই বিঘা জমি আমার। কিন্তু সংসারে ৭/৮ জন লোক। অতি কষ্টে ছেলেটাকে বি,এ, পর্যন্ত পড়া লেখা শিখিয়েছিলাম। সে ছেলেকেও হারালাম।

স্বাক্ষর/
আজহার আলী
১৭/৮/৭৩

।।২১০।।
আজাহার আলী মিঞা
গ্রাম-পশ্চিম ঝালকাঠি
জেলা- বরিশাল

রশিদ ও মানিক হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর দালালরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে তাদের সমস্ত শরীরে আঘাত করে। আঘাত করার দরুন তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। তারপর তাদেরকে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে আসে। থানায় কিল, ঘুষি, লাথি, এবং শরীরের বভিন্ন স্থান চাকু দিয়ে কুচা কুচা করে কেটে লবণ দিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় হাজত ঘরের মেঝেতে ফেলে রাখে। আর ঐ দিনই ৩০/৪০ জন পুলিশ রাজাকার, মিলে মুসলীম লীগের দালালের নির্দেশে আমার বাসা ঘেরাও ৪/৫ রাউন্ড গুলি করার পর বাসার মধ্যে প্রবেশ করে এবং আমাকে রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায় ধরে ফেলে। এবং আমার বাড়িঘর লুটপাট শুরু করে দেয়। তখন তাদের মধ্য থেকে হতে একজন হাবিলদার পুলিশ লুট করা বারণ করলে তারা লুট বন্ধ করে দেয়। তারা আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে এরেস্ট করে। ঝালকাঠি থানায় নিয়ে আসার সময় ঝালকাঠি খেওয়া ঘাটে তাছোনউদ্দিনের চায়ের দোকানে বসে আমার ঘাড়ে, হাটুতে, হতের তালুতে ও পায়ের তালুতে এবং শরীরের প্রতিটি গাটে রাইফেলের বাঁট দিয়ে, বেতের লাঠি দিয়ে এবং বুট দিয়ে আঘাত করে। যার দরুণ শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। এবং আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

তার বিশ পচিশ মিনিট পর জ্ঞান ফিরে পেলে আমাকে রিক্সায় করে ঝালকাঠি থানায় নিয়ে আসে। যখন আমাকে প্রহার করত তখন শুধু আমাকে বার বার বলত এমন ছেলে জন্ম দিয়েছ যে সে আজ পাকিস্তানের শত্রু। আমি থানায় এসে দেখতে পাই যে, আমার ছেলে হাত-পা বাধা অবস্থায় হাজতে আধমরা হয়ে পড়ে আছে। আমাকে থানায় নেবার পর আমার ছেলে রশীদ ক্যাপ্টেন আজমতের সাথে কথা বলতে চায়। একজন পুলিশ রশিদকে আজমতের নিকটে নিয়ে যায়। রশীদ ক্যাপ্টেনকে জানায় যে, “আমি আপনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি। কিন্ত আমার বৃদ্ধ পিতা তো আর আপনাদের সাথে যুদ্ধ করে নাই। এর জন্য তো আমার পিতা দায়ী নয়। তাকে কেন আপনারা নির্যাতন করেন?”

তারপর ক্যাপ্টেন কিছু সময় চিন্তা করে আমাকে হাজত থেকে মুক্তি দেয় এবং আমার ছেলেকে হাজতে রেখে দেয়। আমাকে মুক্তি দেবার পর আমি আমার ছেলের সাথে দেখা করি। তারপর চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেখান থেকে বের হয়ে আসি। তার দুই দিন পর অর্থাৎ ১৯ তারিখে রাত্রি দুইটার সময় নদীর ধারে আরো ১২ জন সহ মানিক ও রশিদ কে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপর তাদেরকে একটা গর্তের মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে রাখে।

স্বাক্ষর /-
আজাহার আলী মিঞা
১১/৮/৭৩

।।২১১।।
শ্রী রমেন কর্মকার (রঙ্গ)
ঝালকাঠি
জেলা- বরিশাল

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাক বাহিনী ঝালকাঠি চলে আসে। এসেই তারা ঝালকাঠি শহরে লুটপাট শুরু করে। আগুন জ্বালিয়ে ৯০% দালান ও ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। পাক বাহিনী ঝালকাঠি আসার একদিন পূর্বে আমরা তারপাশা গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেই।

এপ্রিল মাসের ২৫/২৬ তারিখে ঝালকাঠি হতে প্রায় ৭০/৮০ জন পাক সেনা তারপাশা অপারেশনে যায়।পাক সেনারা সংবাদ পেলে আমরা তারপাশার একটা জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকি। তারা একজন মুসলিম লীগের দালালের সহযোগিতায় উক্ত জংগল ঘেরাও করে গোলাগুলি শুরু করে দেয়। ফলে আমরা প্রান রক্ষার জন্য ছুটাছুটি করে পালাতে চেষ্টা করলে আমাদের ১০ জন ছেলেকে তারা ধরে ফেলে। এবং আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে, “ তোম মুসলমান হ্যায়? কালেমা বাতাও”।

আমরা উত্তর দেই আমরা মুসলমান কিন্ত তারা আমাদেরকে দুই হাত বেঁধে ঝালকাঠি নিয়ে আসে। এবং থানা কাউন্সিলে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। অতঃপর হাত, পা লাইট পোস্টের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে পা উপরের দিকে, মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে প্রত্যেককে বালতি ভর্তি পানিতে মাথা ডুবিয়ে রাখে ও বেতের লাঠি, লোহার শিক ও বৈদ্যুতিক তার দিয়ে প্রায় আধা ঘন্টা পর্যন্ত আমাদের সমস্ত শরীরে আঘাত করার দরুন আমাদের মধ্যে ৪/৫ জন অজ্ঞান হয়ে যায়। আঘাতের দরুণ আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান হতে রক্ত ঝরতে থাকে। তারপর পুলিশ দিয়ে আমাদের থানায় নিয়ে জায়। পিটানোর সময় আমাদের শুধু বলতে থাকে মুক্তিফৌজ কোথায়? এই বলে আর প্রহার করে। আমাদেরকে থানায় নিয়ে এসে হাজতের মধ্যে রেখে দে। এবং ভোর রাত্রি চার টার সময় দু জন করে একত্রে বেঁধে মোট ৮ জন কে গুলি করে হত্যা করে। উক্ত দলের মধ্য থেকে আমাকে ও নিতাইকে হাজতে আটকে রেখে দেয় ।

এই ঘটনা ঘটার দুইদিন পর আমাকে ক্যাপ্টেনের নিকট হাজির করে। এবং ক্যাপ্টেন আমাকে জিজ্ঞাসা করে তোর কোন বোন আছে? আমি উত্তর করি আমার তিনটা যুবতী বোন আছে। আমি তোকে ছেরে দেব তুই তাদেরকে শহরে নিয়ে আসবি। আমি তোকে ঘরবাড়ি , টাকা-পয়সা সব দিব। আমি তার কথায় রাজি হয়ে যাই এবং আমাকে আর আমার চাচাত ভাই নিতাই কে ছেড়ে দেয়। তারপর আমরা ছাড়া পেয়ে চলে যাই এবং তাদের সাথে দেখা না করে পালিয়ে পালিয়ে দিন কাটাতে থাকি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আবার আমি ঝালকাঠি চলে আসি।

স্বাক্ষর/-
রমেন কর্মকার
১৮/৮/৭৩

।।২১২।।
সন্তষী বালা ঢালী
গ্রাম- সুবিদপুর, ডাকঘর- পাশসাতরিয়া
থানা- কাউখালী, জেলা- বরিশাল
বৈশাখ মাসের শেষের দিকে পাক সেনারা আমাদের গ্রামে গিয়ে ( নিলতাগ্রাম) সমগ্রগ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমে লুট কর পরে সমগ্র গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। লোক পালাতে চেষ্টা করলে গুলি করে হত্যা করেছে। ছোট ছোট বাচ্চা ধরে আগুনে ফেলে হত্যা করেছে। ১০ ই জ্যৈষ্ঠ পাক সেনারা আবার আসে। গ্রামের লোকজন মনে করে যেহেতু নিলতাগ্রাম একবার পুড়িয়েছে সেহেতু সেখানে পাক সেনারা আর আসবে না। তাই সমস্ত আশে পাশের লোক ঐ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পাক সেনারা রাজাকার মারফত এই খবর পেয়ে যায়। তারপর তারা সমস্ত নিলতাগ্রাম ঘিরে ফেলে লুট করার পর জ্বালিয়ে দেয় একই সাথে ২০ জন লোককে গুলি করে হত্যা করে ও পাশবিক অত্যাচার চালায়।

ঐ তারিখে আমার স্বামী পালিয়ে এক পুকুরের ভিতর মাথা উঁচু করে ছিল। পাক সেনারা খুঁজতে খুঁজতে জল থেকে উঠিয়ে আনে এবং ঐ পুকুরের পারেই ভীষণভাবে মারধোর করে। হিন্দু বলে অকথ্য গালাগাল করে, অত্যাচার চালায়, পরে গুলি করে ওখানেই হত্যা করে। আমার স্বামীকে হত্যা করে পাকবাহিনী আমার বাড়ি আক্রমন করে। বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে আমার দুটি শিশু সন্তানকে হত্যা করতে নিয়ে যায়। আমি পা চেপে কান্নাকাটি করলে আমার কাছে টাকা চায়। আমার ২০০ টাকা, দুই জোড়া রিং এবং একটি আংটি ছিল ( সোনার) সেগুলো সব দিলে আমার ছেলেদের ছেরে দেয়।

চিড়েপাড়া থেকে পাক সেনারা মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় ভোগের জন্য। নিলতাগ্রামে লুট করে পাটি তৈরী করে এমন একটি লোকের বাড়ি ঢুকে জ্বালিয়ে দে তারপর স্বামীকে গুলি করতে গেলে স্ত্রী ছুটে গিয়ে পাক সেনাদের পা জড়িয়ে ধরে বলে, আমার বাড়ি ঘর সব গেছে এখন আমার স্বামীকে মারার আগে আমাকে মারো। সাথে সাথে পাক সেনারা মেয়েটির উপর অত্যাচার করে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে এবং পরে স্বামীকেও গুলি করে হত্যা করে। তারা অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে। গন্ধর্ব গ্রামে পাক সেনারা গিয়ে গ্রাম জ্বালিয়ে বহু লোক কে কুড়াল দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ধর্ষিতা হয়েছে অসংখ্য নারী। স্বামীর মৃত্যুর পর আমি গ্রামে গ্রামে পালাতে লাগলাম ছেলে দুটিকে নিয়ে। মাইলের পর মাইল না খেয়ে হেটে বহু কষ্টে শিশু সন্তান দুটিকে নিয়ে ৫ ই শ্রাবণ ভারতে যাই। সেখানে বিলাশপুর চক্রবাটা ক্যাম্পে ছিলাম। দেশ স্বাধীন হলে আমি নিজ গ্রামে ফিরে আসি।
টিপ সহি /-
সন্তষী বালা ঢালী

।।২১৩।।
মোঃ খালেদ
নির্বাহী প্রকৌশলী
পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভোলা, বরিশাল

৫ ই মে পাক সেনারা ভোলাতে আসে। পাক সেনারা আমাদের ওয়াপদা কলোনীতে সেনানিবাস তৈরী করে। মেজর থাকত ওয়াপদা রেস্ট হাউজে। মে মাসেই শান্তি কমিটি গঠন হয়। জুন মাস থেকে রাজাকারে লোক ভর্তি শুরু হয়।

৬ ই মে মেজর ইয়াহিয়া অফিসারদের নিয়ে সভা করে। সবাইকে দেশের জন্য কাজ করতে বলে এবং এ ওবলে হিন্দু এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা হবে। ৭/৮ ই মে গাজীপুরের রোডে ৩/৪ জন হিন্দুকে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করে। এর পরই পাক সেনারা নিয়মিত ভাবে লোক ধরে দুষ্কৃতিকারী বলে হত্যা করত। হত্যার স্থান ছিল ভোলা খেয়া ঘাট, ওয়াপদা কলোনী এবং শিবপুর মেঘনার পাড়।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি আসে ভোলাতে। সকালে উঠে দেখলাম একটি আর্মি নেই কলোনীতে। কোথায় গেছে জানতে পারলাম না। বিশ্ব ব্যাংকের লোক সব খবর নেয়। খাদ্যের অবস্থা, পাক সেনারা কেমন অত্যাচার করছে ইত্যাদি। তাঁরা আমাদের রেস্ট হাউজে তিন দিনের মত ছিলেন আবহাওয়া খারাপ ছিল বলে। আমি এক ভদ্রলোককে অবস্থা বুঝিয়ে বলি। শিবপুর মেঘনার পাড়ে যে গনহত্যা শুরু হয়েছিল, এখনো ২/৪ টি মৃতদেহ পরে ছিল। তারা তার ছবি তুলে নেয় এবং অবস্থা মোটামুটি বুঝতে পারে। আমি পাক সেনাদের হত্যা দেখে বিচলিত ছিলাম। আমার পকেটে সব সময় রিভলবার থাকত। যে কোন অবস্থার জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতাম।

পাক সেনারা বিভিন্ন স্থান থেকে লোক ধরে আনত, তারপর এখানে তাদের গুলি করে হত্যা করত। সেপ্টেম্বর/অক্টোবর মাস থেকে হত্যা ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়। কারণ ঐ সময় থেকেই বিভিন্ন থানায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়। জুন/জুলাই মাসে কাজের জন্য আমাকে বিভিন্ন থানায় আয় যেতে হত। গাড়ি দেখে প্রথমে মানুষ পালাত। পরে আমাকে দেখে কাছে আসত। অক্টোবর মাসে হত্যার সংখ্যা বেড়ে যায়। সৈন্যরা বাস থামিয়ে লোক নামিয়ে হত্যা করত। গুজব রটলো, মুক্তিবাহিনীর লোক কাল গেঞ্জী পরিধান করে। তারপর দেখা গেল, খান সেনারা কাল গেঞ্জী পরা লোক দেখলেই ধরতো, অত্যাচার করতো ও হত্যা করতো।

যাদেরকে ধরে আনত, তাদেরকে খেতে দিত না। পরে হাত, পা বেঁধে গরু পিটানো পিটাতো যতক্ষন জ্ঞান থাকত। পিটিয়ে অনেককে হত্যা করত। শেষের দিকে খান সেনারা গুলি খরচ করত না কলোনীর একটি ঘরে জবাই করত। স্বাধীনতার পরে দেখলাম ঘরটি চাপ চাপ রক্তে ভরা। আমি দেখেছি জবাই করে টানতে টানতে একটি গর্তে মাটি চাপা দিয়ে রাখত। এই ভাবে আমার ধারনা, ২০০০ লোককে তারা হত্যা করেছে।

পাক সেনারা বহু মেয়ের উপরও পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। অনেক সময় বলতো দুষ্কৃতিকারীরা ভারতীয় সিপাইয়ের পাল্লায় পড়ে এরকম কাজ করেছে এদেরকে খতম করবই। মুক্তিবাহিনী আমাদের শত্রু, এদেরকে খতম করতে হবে। পাক সেনারা প্রচুর পয়সা নিয়ে অনেক লোক ছেড়ে দিয়েছিল। বোরহানউদ্দিন এবং দৌলতখান থানা দুটিতেই পাক সেনারা অত্যাচার চালিয়েছে ব্যাপক। মুক্তি এবং মিত্র বাহিনীর চাপে ৯ ই ডিসেম্বর পাক সেনারা ভোলা থেকে পালিতে যায়। শোনা যায় চাঁদপুরের কাছে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মেজর সহ সবাই নিহত হয়।

স্বাক্ষর/-
মোঃ খালেদ
১২/৯/৭৩
।। ২১৪।।
মোঃ ফরিকুর রহমান
কালীবাড়ি সড়ক
ভোলা , বরিশাল

পাকসেনারা ভোলায় আসার পর পরই মানুষ খুন করে। মেয়ে ধরে এনেও পাশবিক অত্যাচার করে।

সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি রাত ২ টায় হটাৎ আমার বাড়ি ঘিরে ফেলে ১০ জনের মত খান সেনা, একজন রাজাকার এবং বাঙ্গালী ড্রাইভার। তারা প্রথমে আমার আব্বার সাথে কথা বলে আমার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি উপর থেকে নিচে নেমে আসি। সুবেদার সিদ্দিক আমাকে বন্দী করে গাড়িতে তোলে। গাড়িতে ডাঃ ফজলে হোসেন (এম, বি, বি, এস) কে বন্দী অবস্থায় দেখলাম। গাড়ি মাকছুদুর রহমান এডভোকেটের বাড়ি যায় তাকে ধরার জন্য কিন্ত তাকে না পেয়ে গাড়ি চলতে থাকে। রাইফেল পরে গিয়ে সুবেদার সিদ্দীকের পায়ের নখ উঠে যায় এবং রক্তপাত হতে থাকে। আমি এবং ডাক্তার মিলে তারাতারি করে জয়নাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে ব্যান্ডেজ করে যত্ন করি। সুবেদারের মন একটু নরম হলো বুঝলাম। গাড়ির ড্রাইভারকে বললো গাড়ি খেয়া ঘাটে যাবে না, ওয়াপদা নিয়ে চলো। খেয়া ঘাট মানেই মৃত্যু ছিল। বুঝলাম, আপাততঃ বেঁচে গেলাম। অতঃপর তারা আমাদেরকে ওয়াপদা কলোনীতে নিয়ে যায় এবং একটি ঘরে আটকে রাখে। বাইরে পাহারা থাকে।

পর দিন চা নাস্তা খাইয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে আমাদের কে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাবার পর জিজ্ঞেস করে, ‘মুক্তিবাহিনী কোথায়, বল’। আমরা জানিনা বললে ভীষণ ভাবে মারধোর করে। আমরা মৃতপ্রায় হয়ে পড়ি। তখন জেলে নিয়ে আতকে রাখে। আমি এবং ডাক্তার শহরে মোটামুটি পরিচিত ছিলাম। প্রতিবাদে শহরের সকল দোকান পাট বন্ধ হয়। রিক্সা সহ সমস্ত শহর অচল হয়। ইতিমধ্যে আমার আত্মীয় স্বজন আমার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। টাকা দিলে তাদের মন কিছুটা নরম হয়। শান্তি কমিটি শহরের এই অবস্থায় অধিবেশন ডাকে এবং আমাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের যেখানে রেখেছিল সেখানে অনেক রক্ত এবং রক্ত মাখা জামা দেখলাম। দুইদিন রাখার পর অত্যাচার করেও কোন তথ্য যখন বের করতে পারে নি তখন আমাদের দুই জনকে ছেড়ে দেয়। আমি বাড়ি চলে আসি।

১০/১২ দিন পর মিলিটারীর একান্ত সহকারীর মারফত খবর পেলাম আমাকে আবার ধরার ষড়যন্ত্র করছে। আয়ুবী আমলে আমি ডি পি আর এর আসামী ছিলাম ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী বলে।

আমি গোপনে নৌকা ভাড়া করে বরিশাল পালিয়ে যাই এরপর আর ভোলাতে আসি নি। ভোলা শত্রুমুক্ত হলে আমি ভোলাতে ফিরে আসি।
স্বাক্ষর /-
মোঃ ফরিকুর রহমান
১৩/৯/৭৩
।। ২১৫।।
শ্রী বিমল কৃষ্ণ দাস
সরকারী স্বাস্থ্য সহকারী
ভোলা জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র
ভোলা, বরিশাল

২৮ শে মে রাজাকাররা রাত ১২ টার দিকে আমাদের গ্রামের বাড়ি ঘিরে ফেলে
লোকজন দেখে ভাবলাম, গ্রামে পাহারা দেয় তারাই হয়ত আসছে। দারোগা এসেই আমার নাম জিজ্ঞাসা করে। নাম বলার সাথে সাথে আমাকে আটকাতে বলে। রাজাকারদের একজন আমাদের পরিচিত। এবং দুইজন আমার সহপাঠী ছিল। আমাদের বাড়ি ঢুকে সবাইকে গ্রেফতার করে বলে তোমাদের কাছে বন্দুক আছে তোমরা মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করছ। আমার দাদা বিজয় ভূষণ দাস
(২) আমি
(৩) ব্রজমোহন দাস (জ্যাঠা)
(৪) হরিপদ দাস (কাকা)
(৫) সুনীল কুমার দাস (খুড়তুতো ভাই)
(৬) সহদেব হালদার (কৃষাণ বাড়ির)
(৭) যোগেন্দ্র বৈদ্য
(৮) শ্যামল কৃষ্ণ দাস
(৯) সৈয়দ আহম্মদ
(১০) রুহুল আমীন
(১১) ইনা আলী।
দারোগা সবাইকে থানায় নিয়ে যায়। পথে বালক বলে শ্যামল কৃষ্ণ দাস, রুহুল আমীন এবং ইনা আলীকে ছেরে দিয়ে আমাদের আট জনকে থানায় নিয়ে আসে। পথে জনৈক রাজাকার বলে তোমার জ্যাঠাত বোনকে দিলে তোমাদের বাঁচিয়ে দেওয়া হবে। আমি অস্বীকার করলে আমার জ্যাঠাকে বলে। জ্যাঠা মহাশয় বলেন, ‘আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও মেয়ের ইজ্জত দিতে পারব না, টাকা নিতে পারো’। রাজাকাররা ক্ষিপ্ত হয়ে সবাইকে হাজতে আটকে রাখে।

২৯ শে মে সকালে রাজাকার আবার এসে আমার বোনকে চায়। আমি অস্বীকার করি। রাজাকার ফিরে যায়। আমার বৃদ্ধ আরেক জ্যাঠা দারোগাকে ছেড়ে দেবার অনুরোধ করলে সে বলে, ক্যাপ্টেন বরিশাল থেকে ফিরলে তখন দেখা যাবে।

ক্যাপ্টেন ছিল কায়ানী। ২৯ মে ভোলা ডাক বাংলাতে শান্তি কমিটির সভা বসে আমাদের নিয়ে। বরিশাল থেকেও জেলা শান্তি কমিটির লোক আসে আমাদের বিষয়ে। বরিশালের শান্তি কমিটির পুরাতন অনেকেই আমার বড় জ্যাঠাকে চিনতো। তারা এসে ছেরে দেবার জন্য অনুরোধ করে। আমি একটু আশ্বাস পেলাম হয়তো বাঁচবো।

৩০ শে মে সকাল ১০ টার দিকে ক্যাপ্টেন নিজে ১০/১২ জন খান সেনা নিয়ে আমাদের দেখতে যায়। আমার ভাইপো ৭/৮ বছর বয়স, ক্যাপ্টেনের পা ধরে খুব কান্নাকাটি করলে ক্যাপ্টেন বলে, আচ্ছা ছেড়ে দেব। আমাদের শিবপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ইলিয়াস মাষ্টার কে আমাদের পক্ষে সুপারিশ করতে নিষেধ করে। আমার জ্যাঠা ড: শশী ভূষণ দাস দারোগা কে ৫,০০০ টাকা দিতে রাজী হলে সে বলে, ‘ কালকে আসবেন’।

পাক কর্তৃপক্ষ একটি ব্যাজ দেন (সি, এস)। এই ব্যাজ কমন সারভেন্ট, সাধারণ কৃষক, মুচি, মেথর, নাপিত এদের দেওয়া হত। আমাদের বাড়ির কৃষক হিসেবে ব্রজমোহন দাস, হরিপদ কুমার দাস এবং সুনীল কৃষ্ণ দাসের নামে ব্যাজ দেবার জন্য তারা টাকা নেয়। ব্যাজ বুকে থাকলে পাক সেনারা ধরবে না বা গুলি করবে না।

৩০ শে মে রাত আট টা ১৫ মিনিটে ক্যাপ্টেনসহ ১৪/১৫ জন খান সেনা আসে। আমাদের ৫ জন করে হাত বেধে ২ টি দলে ১০ জনকে গাড়িতে তোলে। আমাদের ৮ জন ছারা আর ২ জন ছিল বাপতা গ্রামের অনিল এবং চরফ্যাশনের আর একজন।

তারা আমাদের কে বরিশাল নিয়ে যাবার নাম করে ভোলা খেয়াঘাটে নিয়ে যায়। আমাদের ৫ জনকে ট্রাকে বসিয়ে রেখে অপর ৫ জনকে নদীর কূলে নামিয়ে আমাদের সামনে এক এক করে গুলি করে হত্যা করে। ঐ ৫ জনের দলে আমার খুড় তুতো ভাই তখনো মরেনি, ‘মা’ ‘মা ‘ করে কাঁদছে, আমরা শুনতে পাচ্ছি। ঐ অবিস্থায় সারা রাত থেকে পরদিন আমার ভাই মারা যায়। আমাদেরকে তীরে নামিয়ে একেকজনের জন্য দুজন করে সেনা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আমাদের বলল জলে নামতে। খান সেনারা চায়না অটোমেটিক রাইফেল প্রস্তুত করতে থাকে। আমি বলি, দাদা, সময় যায় ঝাপ দে। দড়ি বাধা অবস্থায় আমরা ৫ জন নদীতে ঝাপ দেই। খান সেনারা গুলি চালায়। আমরা টানাটানি করে হাতের দড়ি খুলে ফেলি। আমি সাঁতার দিয়ে নদীর ওপাড়ে চলে যাই। দাদা আরেক দিকে চলে যায়। গুলি অনবরত চলছে আর খান সেনারা গালাগালি করছে। একটি কারগো লঞ্চ দাড় করানো ছিল তারা ডাকতে থাকে আমি তীরে উঠে ক্রলিং করে ধান ক্ষেতের দিকে পালাতে থাকি।

সাত মাইল দূরে টংচর গিয়ে পৌছাই এক আত্মীয়ের বাড়ি। ওখানে দুই দিন থাকি। জানাজানি হয়ে গেলে বালিয়া গ্রামে পালিয়ে যাই এক বন্ধুর বাড়ি। ওখানে কাওছর হালদারের (প্রাইমারির শিক্ষক) বাড়িতেন ২ মাস থাকি। পরে আমার আহত দাদার খোঁজ পেলাম। জানতে পারলাম আমাদের ৫ জনের মধ্যে ৩ জন বেঁচে গেছি, বাকি ২ জন মারা গেছে।

গ্রামে গ্রামে পালিয়ে দিনের পর দিন জলের ভেতর থেকে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতে গিয়ে পৌছাই। তারা আমাদের বাড়িঘর সব লুট করে নিয়ে যায়। আমাদের গ্রামের রাজাকারদের সহযোগীতায় তারা সমস্ত গ্রামের হিন্দু পরিবারদের ধ্বংস করে। তারপর দেশ মুক্ত হলে আমি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসি।

স্বাক্ষর /-
শ্রী বিমল কৃষ্ণ দাস।

।।২১৬।।
আব্দুল করিম
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
পিরোজপুর কলেজ, পটুয়াখালি

মে মাসে পাক বাহিনী পাথরঘাটা যায়। ঐ দিন ই ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। সি, ও (রেভ), পুলিশ, জমাদার, এদেরকেও গুলি করে হত্যা করে। কনস্টেবল পালানোর চেষ্টা করলে তাকেও হত্যা করে। আমি পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকি। সমস্ত পটুয়াখালি জেলার বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম।

জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক সেনাদের তরফ থেকে ঘোষনা করা হয়, অধ্যাপক করিম কে ধরে দিতে পারলে নগদ দশ হাজার টাকা এবং একটি রিভলবার পুরষ্কার দেওয়া হবে। এ সংবাদ যখন পেলাম তখন আরো ভীত হয়ে পড়ি।

তারপর আমি পিরোজপুর পালিয়ে আসি। পাথরঘাটা থানাতে ১০০ -র বেশি লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। অত্যাচার চালায় ব্যাপক ভাবে। চরদুয়ানী, কালীবাড়ি, কাঁঠালতলী, পাথরঘাটা ইত্যাদি এলাকা পাক বাহিনী ধবংস করে। প্রথমে লুট করে পরে জ্বালিয়ে দেয়।

বিভিন্ন সময় পাক বাহিনী অপারেশনে গিয়ে মেয়েদের উপর অত্যাচার চালায়। লক্ষণ চন্দ্র দাস নামে এক ব্যবসায়ী ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে পালিয়েছিল। দালালরা সুন্দরবন এলাকা থেকে লক্ষণ দাস সহ ৫ ছেলেকে ধরে আনে। অকথ্য অত্যাচার চালাবার পর তাদেরকে বরগুনার মহকুমাতে পাঠানো হয়।

সেখানে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ছেলে, তারপর লক্ষন দাস, তারপর ছোট দুটিকে লাইন দিয়ে দাড় করায়। পরপর তিনটি ছেলেকে গুলি করলে লক্ষণ দাস হার্টফেল করে মারা যায়। পাক সেনারা কি মনে করে ছোট দুটিকে বাঁচিয়ে রাখে। তারপর ওদেরকে মুসলমান করে পাথরঘাটাতে পাঠিয়ে দেয়। একটির বয়স ৭/৮ আরেকটির বয়স ১০/১১ বৎসর হবে। অনেককেই এভাবে পাক সেনারা শেষ করেছে। কনক নামের এক ভদ্রলোককে তার স্ত্রীর কাছ থেকে জোড় করে ছিনিয়ে নিয়ে তার সামনেই গুলি করে হত্যা করেছে। প্রাইমারী শিক্ষক আব্দুল মালেক ও তার ছেলে শাহজাহানকে মুক্তি বাহিনীকে সহযোগিতা এবং স্পাইং করার জন্য পাক সেনারা বাপ ছেলেকে একসাথে গুলি করে হত্যা করে।

আমি পালিয়ে এসে পিরোজপুর তৃতীয় হাকিম আব্দুল মান্নান হাওলাদারের সাথে সব কথা বলি এবং বাঁচার উপায় আনতেন বলি। পিরোজপুরের চার্জে তখন ক্যাপটেন এজাজ। মান্নাম সাহেব বললেন, যদি এজাজকে আয়ত্ত্বে আনতে পারো, তবেই বাঁচা সম্ভব। এজাজের ছিল ক্লাবে যাওয়ার অভ্যেস। সেই সাথে জুয়ারও। আমি ক্লাবে গিয়ে তাস নিয়ে বসি। এই পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের বিশ্বাস ছিল যারা তাস খেলে তারা দুষ্কৃতিকারী হতে পারে না।এই বিশ্বাসের উপর হিন্দু ড: ইন্দ্রভূষন বিশ্বাসসহ আমরা অনেকেই বেঁচে যাই। আমরা খেলার মারফত ক্যাপ্টেনের বেশ কাছে গিয়েছিলাম। ক্যাপ্টেন বলতো, ‘বাংলাদেশ মুক্ত হবেই, আমরা আটকে রাখতে পারব না’।

১৫ ই নভেম্বর পাক সেনারা আমার ভাই (বি, এস, সি, ছাত্র) আব্দুল কাইয়ুমকে ধরে পাথর ঘাটা থেকে এবং অকথ্য নির্যাতন চালায়। তার হাত পায়ের কোথাও অক্ষত ছিল না। শেষ পর্যন্ত এগার হাজার টাকা দিয়ে সে প্রাণ ভিক্ষা পায়।

স্বাক্ষর /-
আব্দুল করিম
১৮/৮/৭৩

।।২১৭।।
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান
থানা-বরগুনা
জেলা- পটুয়াখালী

পাক দালালরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। তারা সংগ্রামী মানুষদের ধরে গুলি করে হত্যা করে । বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়। মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায় । মুক্তি বাহিনীর ভয়ে সাধারনত তারা গ্রাম অঞ্চলে ঢুকতো না।

প্রথমে বরগুনাতে শান্তি কমিটি গঠন করে উক্ত দালালরা পাক বাহিনীকে পটুয়াখালী হতে বরগুনায় পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। তাঁদের নির্দেশ মতো পাক বাহিনী গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশন চালিয়েছে। দালাল শ্রেনীর লোকেরা সুযোগ পেয়ে লুটপাট করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে।

অক্টোবর মাসের শেষের দিকে শান্তি কমিটির দালালেরা নির্দেশে পাথরঘাটার কনক নামে একজন নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করে। হত্যার সময় কনকের স্ত্রী কান্না এবং আকুল অবস্থা দেখে বহু মানুষ চোখের জল রাখতে পারে নি। এমনকি বর্বর খান সেনারা কনককে রেহাই দেবার কথা বলেছে কিন্তু নিষ্ঠুর দালালরা তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে কনককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। বরগুনার শান্তি কমিটি বন্দর এলাকা হতে বহু নিরীহ মানুষদের ধরিয়ে দেয় এবং পাক বাহিনী তাঁদের হত্যা করে। তারা বহু নারীর সর্বনাশ করে।

স্বাক্ষর /-
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান
২৭/০৮/৭৩

==============

গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণঃ

বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত সাক্ষাৎকার

ঢাকা বিভাগ (পৃষ্ঠা ১২-৬৬)
রাজশাহী বিভাগ (পৃষ্ঠা ৬৭-১৮২)
খুলনা বিভাগ (পৃষ্ঠা ১৮৩-২৬৯)
চট্টগ্রাম বিভাগ (পৃষ্ঠা ২৭০-৩২৪)

Scroll to Top