গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহীত সাক্ষাৎকার
ঢাকা বিভাগ (পৃষ্ঠা ১২-৬৬)
রাজশাহী বিভাগ (পৃষ্ঠা ৬৭-১৮২)
খুলনা বিভাগ (পৃষ্ঠা ১৮৩-২৬৯)
চট্টগ্রাম বিভাগ (পৃষ্ঠা ২৭০-৩২৪)
হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের বিবরণ
।। রাজশাহী বিভাগ ।।
।। ৩৪ ।।,
মোঃ আরশাদুজ্জামান (আশু)
দি ইউনিভারসাল রেডিও হাউস, ঘোড়ামারা, রাজশাহী
২৫শে মার্চ শহরে যখন মিলিটারীদের তৎপরতা বেড়ে যায় তখন আমি ভাঙপাড়া গ্রামে কোন এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেই। পাকিস্তানী বেতার থেকে ঘোষণা করা হলো যে, মালিকবিহীন দোকান পেলে তারা অন্য জনকে দিয়ে দিবে।
তার পরিপ্রেক্ষিতে ২১শে মে আমি রাজশাহীতে চলে আসি এবং ঘোড়ামারায় চাচাতো ভাইয়ের বাসায় উঠি। জুমআর নামাজ পড়ে আসার সময় একজন বাঙ্গালী পশ্চিমাদের দালাল আমাকে দেখে। দেখার পর জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে যে, আমি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলাম। এরপর অকস্মাৎ দুজন বর্বর সৈন্য গাড়ীসহ দালালের বাড়ীতে যায়। ইতিপূর্বে সে ফোনে মিলিটারীদের সাথে আলাপ করেছিল। তারপরে আমার ভাইয়ের বাসায় মিলিটারীরা ঢোকে। ঢোকার পরে আমাকে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একজন অধ্যাপক সাহেবের রান্নাঘরে নিয়ে যায়। সেখানে অন্য একজন কাস্টম অফিসের আবদুল ওয়াহেদ নামের একজন লোককে দেখতে পাই নামাজ পড়া অবস্থায়। তাকে (ওয়াহেদ সাহেবকে) নানা জিজ্ঞাসাবাদ করায় বাইরে পাহারারত একজন মিলিটারী এসে আমাকে নির্মম্ভাবে বুটের লাথি মারে এবং জৈনক সৈন্য বলে, “আপছমে কৈ বাত কারনে নেহী হোগা”।
তারপরে বেলা তিনটের সময় নওয়াবগঞ্জ কলেজের সহ-অধ্যক্ষ মোনামুল হক সাহেবকে মোটা শিকল দ্বারা দু’হাত বেঁধে নিয়ে আসে। তার কিছুক্ষণ পর কানে বালিওয়ালা লম্বা পাতলা মত একজন মিলিটারী আসে। হাতে কাঠের রোলার দরজা বন্ধ করে উর্দুতে বলে যে, “ত্তুম নবাবগঞ্জ কলেজ কা ভাইস প্রিন্সিপাল হ্যায়?” বলে প্রহার আরম্ভ করে। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, আমি নাকি বিহারীগণকে হত্যা করেছি, নারীর ইজ্জত নষ্ট করেছি, সেই জন্য তারা দুই হাজার মাইল দূর থেকে এসেছে। তারপর কাথের রোলার দিয়ে প্রহার করে, লাথি মারে।
রাত আটটার পরে কাষ্টম অফিসের জনার ওয়াহেদ সাহেবকে বের করে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরে আমাকে ঐ একই ঘরে রাখে এবং জিজ্ঞাসা করে জানতে চায় কাকে ভোট দিয়েছিলাম। উত্তরে আমি বলেছিলাম যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলাম। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে ক্যাপ্টেন জাফর। তারপরে হিংস্র পশুর মত আমাকে প্রহার করে। প্রহারের দরুন মাটিতে পড়ে যাই। তারপরে জিজ্ঞাসা করে যে, আমি বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলাম কিনা। আমি সম্মতি জানাই। তারপরে উক্ত ঘরে নিয়ে রাখা হয়।
পরের দিন সকালে মাটিতে একটি রুটি ও এক কাপ চা তিনজনকে খেতে দেয়া হয়। শরীরে অসুস্থতার জন্য দু’জন চা পান করছিল না বলে বর্বর সৈন্যরা লাথি মারে বেপরোয়াভাবে।
৯ টার দিকে আমাকে দিয়ে সৈন্যদের ব্যবহৃত ড্রেন, থালা বাসন, উঠান পরিষ্কার করে নেয়। বেলা তিনটার দিকে আমাকে ও ওয়াহেদ সাহেবের পিছনে হাত বেঁধে খাড়া অবস্থায় প্রায় এক ঘন্টা সময় রাখা হয়। তার পরে ক্যাপ্টেন জাফর উপর থেকে নিচে নেমে আসে। মান ধরে বলে, “তুমহারা নাম আশু হ্যায়, তুম রেডিও কা কাম জানতা হ্যায়?” উত্তরে আমি সম্মতি প্রকাশ করি। জাফর হাত খুলে দেয় এবং পরে নিয়ে যায় তার একটি রেডিওগ্রাম দেখতে বলে। দেখার পর আমি বলি উক্ত রেডিওর কোন যন্ত্রপাতি না হলে দেখা সম্ভব নয়। পরে আমাকে নিচে নামিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় রাখা হয়। কিছুক্ষন পরে আমাকে জিপে উঠান হয়। পরে জোহা হলের দিকে নিয়ে যায়। গাড়ি থেকে নামিয়ে হলের গেটেই সোজা করে দাঁড় করানো হয়। দাঁড় করানোর পর অনিবার্য মৃত্যু জেনে আমি ওয়াহেদ সাহেবের সাথে শেষ আলাপ করতে প্রয়াসী হই এবং প্রাণভরে বাংলাদেশকে দেখে নেই। ক্যাপ্টেন ইলিয়াসকে জাফর পরিচয় করিয়ে দেয় যে ওয়াহেদ সাহেবের মেয়ে জয় বাংলার গান গেয়েছে এবং আমি বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। তখন ইলিয়াস ক্যাপ্টেন জাফরের সাথে দূরে আলাপে বলে যে, বাংলাদেশের পতাকা, বাংলাদেশের সর্বত্রই উড়ানো হয়েছিল। তারপর ক্যাপ্টেন ইলিয়াস আমাকে ছেড়ে দেয় এবং ওয়াহেদ সাহেবকে উপরের তলায় নিয়ে যায়।
১৫ই আগস্ট (১৯৭১) পর্যন্ত আমি স্বগৃহে অবস্থান করি। রাত দু’টায় একটি পুলিশ জীপ এবং সঙ্গে ডি,এস,পি নাছিম সাহেব দরজায় ধাক্কা মারে। পুলিশদের নির্দেশ দেয় বাড়িটিকে ঘেরাও করার জন্য। তারপরে দরজার কাছে আমি আসি। আমার নাম জিজ্ঞেস করে। নাম জিজ্ঞেস করায় কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর ডাক নাম জিজ্ঞেস করে। উত্তরে জানাই যে, ডাক নাম “আশু”। অতঃপর আমাকে গাড়িতে কিছুক্ষণ রাখার পর আরও দু’জন, যথাক্রমে আব্দুর রশিদ ও আব্দুর রাজ্জাক সাহেবকে গ্রেপ্তার করে জীপে তুলে দেয়।
থানায় কিছুক্ষণ গাড়িতেই রাখার পর গাড়ি জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং তিন তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় অপরাপর ত্রিশজন বন্দীকে দেখতে পাই।
ভোরবেলা তিনজনকে ৩৪০ নং কোঠায় নিয়ে রাখা হয়। সেখানে ইউনুছ মিয়াকে দেখতে পাই। তিনি সেখানে প্রায় অর্ধপাগল অবস্থায় ছিলেন। আমাকে চেনার পর ইউনুছ সাহেব আমাকে পাঁচটি টাকা দিয়ে বলেছিলেন যে, সৈন্যরাতো জীবন শেষই করবে, আপনি যদি ছাড়া পান তবে টাকাগুলি গরীবদের দিয়ে দিবেন।
পরে বেলা ৯ টার দিকে মেজর সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জিজ্ঞাসা করে যে, আমাদের পেশা ও নাম কি? পরে ৩৪০ নং কোঠায় নিয়ে যায়। নিয়ে যাবার সময় ঘর খুলে দেখানো হয়। ঐ ঘরগুলির মধ্যে ছাত্র গোছের কতকগুলি যুবককে ঝুলন্ত অবস্থায় উলঙ্গ করে রাখা হয়েছিল। আশেপাশে ভাঙা হকিস্টিক, বাঁশের লাঠি ইত্যাদি ভাঙা অবস্থায় পড়েছিল। আমাদেরকে বলা হয়েছিল সত্য কথা না বললে আমাদের পরিণতিও ঐ একইরূপ হবে।
এক থালাতে চারজনকে এমনকি সময় সময় মেঝেতে পচা, দুর্গন্ধময়, ভাত খেতে দিত। তাও প্রায় ২৪ ঘণ্টা পরে।
৩৪০ নং কোঠার পাশ্বে একটি সেন্ট্রী রুম ছিল। সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত যার কিছু কিছু মাঝে মাঝে শোনা যেত।
একদিন আমাকে জোর করে বিভিন্ন রুমের বন্দীদের নাম ইংরেজীতে লেখার জন্য নিয়ে যায়। ৩৪০ এর কয়েকটি রুম পরে একটি রুমের মাঝে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিকৃত অবস্থায় দেখতে পাই। তাদের গায়ের চামড়া ছিল না, মাঝে মাঝে কাটা দাগ ছিল।
২৭শে আগস্ট হল থেকে আমাদের থানায় পাঠানো হয়। থানায় পাঁচদিন থাকার পর ইনকোয়ারী হয়। পরে আমাকে মুক্তি দেয়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আরশাদুজ্জামান (আশু)
১৯/০৮/১৯৭২
।। ৩৫ ।।
মোঃ আব্দুস সামাদ
গ্রাম- নওহাটা, থানা- পবা, জেলা- রাজশাহী
১৯৭১ সালের ২৬শে মে তারিখ পাকবাহিনী নওহাটা হয়ে নওগাঁ যাওয়ার পথে অপারেশন করে যায়। নওহাটায় তারা তিনজন লোককে হত্যা করে অগ্নিসংযোগ করে দেয়। এই খান সেনারা নওহাটা বাজারের সমস্ত দোকান লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করে দেয়। তারপর যে সমস্ত স্থানীয় লোককে ধরে ছিল তাদের কে দিয়ে নদী পার হয়ে যাবার জন্য নৌকা গোছিয়ে নেয় এবং যাতে গাড়ি পার করে নিয়ে যেতে পারে তার সমস্ত ব্যবস্থা করে নেয়।
এরপর প্রায় দিনই তারা রাজশাহী টাউন থেকে হঠাৎ হঠাৎ এসে বাজারে যে সমস্ত লোক পেত, তাদেরকে মারপিট করে টাকা-পয়সা কেড়ে নিত এবং তা দিতে অস্বীকার করলে হত্যা করত এবং সেই সঙ্গে নারীদেরও গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে এসে তাদের প্রতি পাশবিক অত্যাচার করে কাউকে ছেড়ে যেত এবং যে সমস্ত নারী তাদের বেশী ভাল লাগতো তাদেরকে ক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যেত।
বিভিন্ন পথযাত্রীদের কাছ থেকে তাদের নগদ টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে তারপর মারপিট করে ছেড়ে দিত। স্থানীয় লোকেরা তাদের অত্যাচারে অতিষ্ট হলে সকলে যুক্তি করে খান সেনাদের অল্পসংখ্যক আসলে তাদের একজনকে ধরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। ইহার পর কিছুদিন নওহাটা বাজারের লুটপাট বন্ধ থাকে। কিন্তু ইহার অল্পদিন পরে আবার এক খান সেনার দল এসে উক্ত ব্যক্তিকে এবং তার সঙ্গে আরো কয়েকজনকে ধরে একত্র করে বেঁধে বেদম প্রহার করার পর গুলি করে হত্যা করে।
উক্ত ঘটনার পর তাদের লুটপাট বন্ধ থাকে কিন্তু তাদের অন্যান্য অত্যাচার বেড়ে যায়। তারা প্রায়ই মাঝে মাঝে রাতে আসতো এবং স্থানীয় লোক ধরে নিয়ে তাদের মাথায় গুলির বাক্স ও বিভিন্ন মালামাল বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করত। রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন গ্রাম ঘেরাও করে নিরীহ জনগণকে হত্যা করত, তাদেরকে মারপিট করত এবং তাদের মালামাল লুটপাট করত।
এইভাবে তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ২০০ লোককে হত্যা করে তাদের রাজত্বকে কায়েম রেখেছিল।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আব্দুস সামাদ
।। ৩৬ ।।
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ রায়
রাণীবাজার, ঘোড়ামারা, জেলা- রাজশাহী
“জুন মাসের ১৩ তারিখে পাক দালালরা ষড়যন্ত্রমূলক আমার শ্বশুরবাড়ির একস্থানে গুলিসহ চাইনিজ রাইফেল রেখে ঐ রাতে তারা আমাদের সাথে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে রাইফেল তোলে। তখন আমাকে আমার দুই ছেলে, আমার সম্বন্ধী ক্ষীতিশচন্দ্র রায় ও নিরোদ কুমারকে থানাতে নিয়ে যায়। ওদের ধারণা ছিল আমাদের কাছে প্রচুর টাকা-পয়সা, সোনা আছে। বন্দী করে সেগুলো আদায় করার পরে হত্যা করবে।
রাত ১-১.৩০ দিকে আমাদের থানাতে নিয়ে যায় স্টেটমেন্ট নিবে বলে। আমাদের পাঁচজনকে চালাকি করে হাজতখানায় বন্দী করে। সারারাত কিছু খেতে দেয়নি। তার পরদিনও না। বিকালে আমার বাড়ি থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসে। ঐদিন শেষ রাতের দিকে আমার স্ত্রী দারোগাকে বহু অনুরোধ উপরোধ করে গায়ের সমস্ত গয়না খুলে দিয়ে নগদ কয়েকশত টাকা দিয়ে বলল যেন সামরিক আইনে তার ভাই, স্বামী, ছেলেকে না দেয়। দারোগাকে টাকা ঘুষ দিলে আমাদের সবাইকে হাজত থেকে বাইরে এনে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। হঠাৎ করে একদিন আবার হাজতে পুরতে বলে। আমার দুই ছেলে আমার সাথে কান কথা না বলে পাশের নদীতে ঝাপ দেয় বাঁচবার জন্য। পিছু পিছু পুলিশ ছুটে। ওদের চিৎকারে গ্রামের লোকজন ধরে ফেলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। থানায় নিয়ে এসে অকথ্য অত্যাচার চালায় আমার দুই ছেলের উপর। একজন কৃষক সে আমার ছেলেদের ধরেনি বলে পুলিশ তাকে থানায় ধরে এনে ভীষণভাবে মারধর করে। এখনই ছেলেদেরকে হত্যা করবে কিন্তু টাকার বিনিময়ে নিরস্ত হয়। চার্জশীটের মধ্যেও পালানোর কথা উল্লেখ করেনি।
১৫ই জুন আমাদের সবাইকে নাটোর চালান দেয়। হাশেম দারোগা চাইনিজ রাইফেল সহ চললো। টাকা পয়সা নেয়া সত্ত্বেও আমাদের হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। পথে পাক বাহিনীর সাথে দেখা হলেই সালাম আলায়কুম জানিয়ে বলে, “দেখিয়ে কেয়া চীজ লেআয়া হ্যায়”। দারোগা বারবার আমাদের দেখিয়ে দেয় মুক্তিফৌজ হিসেবে। থানার ওসি হাশেমকে নিষেধ করেছিল অস্ত্র ঐভাবে খোলা নিয়ে যেতে কিন্তু হাশেম দারোগা তা শোনেনি।
নাটোর কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে এমন সময় ইন্সপেক্টর (পুলিশ) জাফর সাহেবের সাথে আমাদের দেখা। জাফর সাহেব আমার ছেলের এবং ছেলের শালার বিশেষ বন্ধু ছিল। সে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে হাশেমকে। সামরিক কোর্টে নিয়ে যেতে বলে উনি জামাকাপড় পরে তাড়াতাড়ি কোর্টে আসেন। সামরিক কোর্টের সামনের মাঠে আমাদের বসিয়ে রাখে। পাকসেনারা আসে, নাম শোনে আর সবাইকে লাথি চড় মেরে চলে যায়। সামরিক কোর্টে ক্যাপ্টেন ও মেজর আসেন। আমরা ২৫ গজ মত দূরে বসে। চাইনিজ রাইফেলের কথা শোনার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন খতম করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু পুলিশ ইন্সপেক্টর অনুরোধ করে একটি ইনকোয়ারী করার জন্য কারণ ওরা ভালোমানুষ। মেজর বলেন, কেমন করে চিনলে ওদের? ঐ থানাতে আমি থানা ইনচার্জ ছিলাম বহুদিন, ইন্সপেক্টর বলেন। মেজর আমাদের ডাকেন। আমাদের বক্তব্য আমরা বলি। মেজর সব শুনে কোর্টে পাঠাতে বলে ইনকোয়ারীর ভার দিলেন।
এসডিও জেলহাজতে পাঠিয়ে দিলেন। সামান্য একটু ঘরে আমাদের রাখলো। আমরা ৩০/৩৫ জন ছিলাম, শোয়াতো চিন্তা করা যায় না, ভালো করে বসারও উপায় ছিল না। জেল ওয়ার্ডার মোজাফফর খাঁ (বিহারী) বাঁশের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে। বাইরে এম,পি (মিলিটারি পুলিশ) ছিল সেও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতে লাগলো। আমাদের মধ্যে কয়েকজন কয়েদি ছিল যারা স্বাধীনতার প্রথম ক্ষণে জেল ভেঙে পালিয়েছিল। তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। চিৎ করে শুইয়ে দুই হাতে লাঠি তুলে শরীরে যত শক্তি আছে তা দিয়ে ঘন ঘন আঘাত করতে থাকে।
সারারাত শুনলাম মানুষের অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকার। আমার মত এমনি বহু অধ্যাপক, ছাত্র, অ্যাডভোকেট ইত্যাদিকে সারারাত ধরে নির্যাতন চালায়। কান্না, চিৎকারে জেল প্রকম্পিত হচ্ছিলো। পাক সেনারা মারতো আর হাসতো। লোকজনের উপর অত্যাচারের জন্য একটি স্কোয়াড থাকতো যাদের কালো ব্যাজ থাকতো। জেল ওয়ার্ডার হরমুজ আমাদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকে। ১৬/১৭ই জুন আমাদের ১৬ জনকে একসাথে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়।
রাজশাহী জেলে বহু রকমের লোকদের দেখলাম। যাদের আনতো তাদের অধিকাংশ কারো চোখ নাই, কারো হাত পা ভাঙা। বিশেষ করে পাক সেনারা যাদের পাঠাতো তারা প্রায় মৃত বা অর্ধমৃত হয়ে আসতো। জেলে যাদেরকে দেখেছি বেশীর ভাগ শান্তি কমিটির লোকেরাই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। একজন কৃষক কয়েদীর সাথে আলাপ করলাম। সে এসেছিল শহরে জমি বিক্রি করতে। মহুরির সাথে বাজারে বেড়িয়েছে এমন সময় কিছু লোক কৃষকটিকে জোর করে এক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বলে, “তোর ছেলে মুক্তিফৌজ”। সে বলে, “আমার বড় ছেলেই নেই”। তারপর মারধর করে জেলে পাঠিয়ে দেয়।
আমাদের কেস ইনকোয়ারীর জন্য ইন্সপেক্টর গ্রামে যান এবং আমাদের পক্ষে রিপোর্ট দেন। বর্তমান বরিশাল এসপি গোলাম মোর্শেদ তখন রাজশাহী এসপি ছিলেন। তিনি আমাদের ধরিয়ে দেবার জন্য এএসআই হাশেমকে প্রমোশন দিয়ে থানার ওসি করে দেন। নাটোর শান্তি কমিটি জাফর ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে পাকসেনাদের কাছে অভিযোগ করে। জাফর সাহেবের চাকরি যাবার মত। বহু টাকার বিনিময়ে আইনুদ্দিনের (এম,এন,এ মুসলিম লীগ) তদবিরে আমাদের জামিন হয় ২৮শে সেপ্টেম্বর। পরে ইন্সপেক্টর আবার ইনকোয়ারী করে নভেম্বর মাসে আমাদের বিরুদ্ধে কিছু না পেয়ে মুক্তি দেয়। আমরা আবার গ্রামে চলে যায় (গালিমপুর)। আমাদের বাড়ি জামাতে ইসলামীর সভাপতি দখল করে নেয়, সমস্ত কিছু লুট করে রাজাকারের ক্যাম্প করে। আর একটি কক্ষে জামাতে ইসলামীর সভাপতি থাকতো। আমরা আবার গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা আবার আমাদের গ্রামে হামলা চালায়। সমস্ত গ্রাম লুট করে বহু জনকে ভীষণভাবে মারধর করে, কিছু লোকজনকে হত্যা করে। আমাদের সব লুটে নেয়।
তারপর দেশ মুক্ত হয়। মালঞ্চ এবং নদীর অপর পাড়ে সকল গ্রামে তখন এমন কোন বাড়ি ছিলনা যে বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হয়নি। পাক সেনাদের চাইতে রাজাকার, আল বদর এরাই বেশি অত্যাচার চালিয়েছে। দালালরা এবং তাদের সহযোগীরা গ্রামকে লুট করেছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
ডিসেম্বরে যুদ্ধ বাঁধলে আমরা সবাই উল্লসিত হয়ে উঠি। একদিন গোলাগুলির শব্দ না পেলে আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত।
১৬ই ডিসেম্বর যখন শুনলাম পাক বর্বর বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে তখন সেই রাতে আমার এই বৃদ্ধ বয়সে সারা গ্রাম হেঁকে বেড়াই পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। মানুষজন গ্রামকে মাতিয়ে তোলে। স্বাধীনতার আনন্দে সবাই “জয় বাংলা” ধ্বনিতে গ্রামকে মুখরিত করে তোলে।
স্বাক্ষর/-
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ রায়
৩০/০৮/১৯৭৩
।। ৩৭ ।।
সালু মিয়া
থানা- সদর, জেলা- রাজশাহী
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে সাহেব বাজারের নিজস্ব দোকান থেকে জনৈক বিহারীর ইঙ্গিতে আমাকে গ্রেফতার করে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন বিকাল পর্যন্ত থানাতেই বন্দী ছিলাম। তারপর ডিএসপি নাছিম সাহেব জিজ্ঞাসাবাদ করেন যে আপনি কয়টা বিহারী মেরেছেন; ভোট কাকে দিয়েছেন। তারপর মিলিটারী গাড়ি করে জোহা হলে নিয়ে যায়। ৭ দিন সেখানে বন্দী থাকাকালে আমাকে দিয়ে মাটি কাটিয়ে নিয়েছে এবং ত্রিপলাদি শুকিয়ে নিয়েছে। সেখানে ৭-৮ জনকে একই থালায় বসিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত অপর্যাপ্ত ভাত দেওয়া হতো। ডাল হিসাবে শুধু পানি, লবণ, হলুদ দিয়ে সিদ্ধ করে দেওয়া হতো। আর কোন তরকারি থাকতো না।
৭-৮ দিন পরে আবার আমাকে থানায় নিয়ে আসে। সেখানে আমাকে ১৯ দিন রাখা হয়। প্রথমে ক্ষমা ঘোষণার পর বন্দী সকলেই ছাড়া পেলেও আমি এবং আর একজন অধ্যাপক ছাড়া পাননি। একদিন সিকিউরিটি অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং বলেন তোমাকে ইন্ডিয়ায় দেখেছি। না উত্তর দেওয়ায় প্রহার শুরু করে। অতঃপর ডিএসপি নাছিম সাহেব এসে সিকিউরিটি অফিসারকে জানান যে আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আমাকে ছেড়ে দেয়।
এর ১৬-১৭ দিন পর এক রবিবার রাত দুইটার সময় আমাকে বাড়ি থেকে ধরে জোহা হলে বন্দী করে রাখে। সকালের মধ্যেই রাজশাহী ন্যাপ প্রধান আতাউর রহমানসহ বহুজনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সবাইকে দিয়ে ঘাস কাটিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে রোজা এসে যায়। সময় মতো তাদের কোন খাবার দেওয়া হতো না। কোন কোন দিন সেহেরীও দেওয়া হতো না।
পহেলা রমজান রাত ১১টায় আমার রুম থেকে দুইজন, ন্যাপ প্রধানের রুম থেকে একজন, পাশের রুম থেকে তিনজনকে, আর এক রুম থেকে সাহেব বাজারের কেতু মিয়াকে হাত ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। পরদিন সকালে ঔৎসুক্যের বশবর্তী হয়ে জনৈক সেন্ট্রিকে জিজ্ঞাসা করি যে রাতে ছেড়ে দিলে তারা কোথায় গেছে। তখন উত্তর দেয় যে তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি হাত, পা কেটে কষ্ট দিয়ে না মেরে গুলি করে কেন মার না। উত্তরে জানায়, গুলি করে মারা হয়না, রাম দা দিয়ে জবাই করে মারা হয়। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি রাতে যারাই বেরুবেন তাদেরই কি মারা হবে? উত্তর পাই রাত ১১টার পর যারা বেরুবে তাদের সবাইকেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এর ৪-৫ দিন পর থেকে প্রায় প্রত্যহ রাতে ৭-৮ জন করে লোক উধাও হয়ে যেতো।
২৬-২৭ দিন পর একদিন বেলা দেড়টার সময় আমাকে ছেড়ে দেয়। আসার আগে আমি আমার কাছের দশটি টাকা অন্যান্য বন্দিদের ইফতারি কেনার জন্য দিয়ে আসি। কারণ সেখানে কোন ইফতারি দেওয়া হতো না।
ছেড়ে দেয়ার দুইদিন পর পুলিশ আবার আমাকে খোঁজাখুঁজি করে এবং গ্রেফতার করে জোহা হলে মেজরের নিকট নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে মেজর আমাকে বলেন, “উপার যায়েগা না ঘার যায়েগা”? শেষ অবধি আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জোহা হলে বন্দী থাকা অবস্থায় সারাদিন প্রশ্রাব করতে দেওয়া হতো না। তাই বাধ্য হয়ে আমি নিজের জুতার মধ্যে প্রশ্রাব করে তিন তালা থেকে ফেলতাম। পৌর এলাকার ১ নং ওয়ার্ডের ৯৮ জন ধৃত ব্যক্তির মধ্যে আমিই শুধু বেঁচে আছি।
স্বাক্ষর/-
সালু মিয়া
।। ৩৮ ।।
মোঃ আবুল ওয়াহেদ
গ্রাম- সুলতানাবাদ (বেলদার পাড়া), ঘোড়ামাড়া, রাজশাহী
২৫শে মার্চের পরে রাজশাহী শহরকে পাক বাহিনী তাদের আয়ত্তে আনে। বাংলাদেশের স্বপক্ষের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মীবৃন্দকে খুজতে থাকে এবং ধরে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। এপ্রিলের প্রথম দিকে বেলদার পাড়ার দুজন যুবক যথাক্রমে বাদল ও অন্যজনকে প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তার উপরে গুলি করে হত্যা করে।
বর্বর সৈন্যদের এলোপাতাড়ি গোলাগোলির আওয়াজে গ্রামবাসী প্রাণের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আমি এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে মা সহ ভারতে আশ্রয় নেই এবং জুন মাসের ১ তারিখে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরকে নেবার জন্য বেলদার পাড়ায় আসি।
৩ দিন পর পাক বাহিনী রাত ৯টার সময় বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে গ্রেফতার করে। অবশ্য শান্তি কমিটির দালালদের কুপ্ররোচনায়। গ্রেফতার করার সময় বাড়ির চারিদিকে এবং ছাদের উপর থেকে গোলাগোলি করে এক বিভীষিকাময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। গ্রেফতার করার পর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরে গুলি করার জন্য আমাকে লাইনে দাঁড় করায়। কয়েকজন সৈন্যের উদারতার জন্য গুলি করতে বিরত হয় কিন্তু শারীরিক নির্যাতন চালায়। অতঃপর আমাকে জিপে করে হাত বাঁধা অবস্থায় স্থানীয় সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। সেখানে অন্ধকারময় বন্ধ ঘরে পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় দেয়ালের দিকে মুখ করিয়ে সারারাত দাঁড় করিয়ে রাখে। এবং যাতে বসতে না পারি তার জন্য সামরিক বাহিনীর লোকেরা কড়া পাহারা দিতে থাকে। সকালের দিকে এক কাপ চা ও একখানা রুটি খেতে দেয়। ঐ সার্কিট হাউজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পাই। তাদের উপরে বর্ণনাতীত শারীরিক নির্যাতন চালায়।
নির্যাতনের এক পর্যায়ে জনৈক পদস্থ কর্মচারী ছাত্রদ্বয়কে চাকু লাগাতে নির্দেশ দেয়। কিম্ভূতকিমাকার বিশাল বপু বিশিষ্ট একজন সৈন্য অফিসারের নির্দেশের মর্মানুযায়ী তাদের পেটে কুকুরের মতো কামড়িয়ে মাংস ধরে টানাটানি করতে থাকে। ছত্রদ্বয় আর্তচিৎকার করতে থাকে। তিনজনই পূর্বপরিচিত হলেও কেউ কাউকে পরিচয় দেবো না বলে একমত হই।
পরের দিন আমিসহ দু’জন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ে যাবার পর ক্যাম্পের খোলা আঙ্গিনায় আমাদের গায়ের জামা খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। জামা খোলা হলে ১০/১২ জন বর্বর সৈন্য বেত, চাবুক দ্বারা এলোপাতাড়িভাবে প্রহার শুরু করে। রক্তাক্ত অবস্থায় যতক্ষণ না তারা অজ্ঞান হয় ততক্ষণ ঐ অবস্থা চালাতে থাকে। অতঃপর পা ধরে টেনে পাশের একটি ছোট কোঠায় পাশাপাশি রেখে দেয়। কিছুক্ষণ পর ছাত্রদের মধ্যের একজনকে যিনি বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন তাকে পুনরায় টেনে আঙ্গিনায় নিয়ে যায় এবং পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টোভাবে রডের সাথে টাঙ্গিয়ে দেয়। “তুমলোক লিডায় হ্যায়” বলে চাবুক দিয়ে মারতে শুরু করে। তার শরীর দিয়ে দর দর করে বিগলিত ধারায় রক্ত গড়াতে থাকে। অত্যাচারের এক পর্যায়ে হঠাৎ ছেলেটির পায়ের দড়ি ছিঁড়ে পড়ে যায়। তখন তারা সাময়িকভাবে অত্যাচার বন্ধ করে দেয়। অজ্ঞান অবস্থাতেই পুর্বোক্ত ঘরে পুর্বোক্ত পদ্ধতিতে রেখে দেয়া হয়।
সারা দিন ও রাত অভুক্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়। পরদিন সকালে শুধু এক কাপ চা পান করতে দেয়। তারপর এক এক করে পাশের ঘরে সিকিউরিটি অফিসার সেলিমের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি প্রথমবারের মত বিবৃতি নিলেন। বিবৃতি নেয়ার মাঝে মাঝে অফিসারটি নিজের হাতে গ্লাভস পরে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে থাকে। এর ফলে মাটিতে পড়ে গেলে বুট দিয়ে শরীরে চড়ে নির্যাতন করতে থাকে। এবং জ্বলন্ত সিগারেট শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঠেসে ধরে। বলাবাহুল্য, অত্যাচার করে তারা পাশবিক আনন্দ উপভোগ করে। এবং নিজেদের খুশিমতো বিবৃতি তৈরী করে। বিবৃতি নেবার পর পুর্বোক্ত ঘরে আবার বন্দী করে রাখে এবং দুপুরে কোন রকম তারকারি ও প্লেট ছাড়াই মাটিতে লবন দিয়ে কিছু ভাত দেওয়া হয় এবং বলা হয় “তুমলোক বাঙ্গালী হ্যায়, চাউল খাও”।
পরের দিন সকাল আটটায় জিপে করে উক্ত সিকিউরিটি অফিসারের তত্ত্বাবধানে তিনজনকেই জুবেরী হাউসের দোতলার একটি কক্ষে রাখা হয়। এবং সেখানে কড়া সামরিক পাহারা ছিল। সেখানে পাশের কক্ষে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর একজন দারোগাসহ ১০/১২ জন পুলিশের লোক ইউনিফর্মসহ বন্দী ছিলেন। এদের অনেকেই আমার পরিচিত ছিলেন। আমাদের কক্ষে একজন ইউসি চেয়ারম্যানসহ আরো ৬/৭ জন সাধারণ মানুষ ছিলেন। সেখানে তিনদিন থাকাকালে কোন শারীরিক নির্যাতন করা না হলেও অপমানজনক অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে। যেমনঃ- “তুমলোক গাদ্দার হ্যায়, তুমলোক বেইমান হ্যায়, তুমলোক হিন্দু হ্যায়।”
ঐ তিনদিনের এক রাতে আমাকেসহ আরো দুজনের (উপরোক্ত ছাত্রদ্বয় নন) নাম ডেকে দোতলা থেকে নামিয়ে আনে এবং সাহসে ভর করে আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হাম লোগকো কাঁহা লেয়ে যায়েংগে?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তুমলোক কালমা পড়নে পড়নে চলো, তুমলোগকো খতম করেগা।”
নীচে আসার পর সাথী দুজনের নাম ধাম জিজ্ঞাসাবাদের পর দু’জনকে নিরুদ্দেশের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সম্ভবত তাদেরকে হত্যা করা হয়। পুনরায় বিবৃতি নেওয়া হবে এই উক্তির প্রেক্ষিতে আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়। পরের দিন বেলা তিনটায় দুজন ছাত্রসহ আমাকে এক সঙ্গে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় মিলিটারি ট্রাকে নাটোরের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে বুট দিয়ে আমাদের উপর সীমাহীন অত্যাচার করে। জেল গেটের খাতায় “ফাইট এগেইনেস্ট গভর্নমেন্ট” লিখে নেয়। জেল গেটের আঙ্গিনায় তখন তিনজনের উপরে বেয়নেট, লাঠি, বেত, বুট ইত্যাদি দ্বারা নির্যাতন করতে থাকে।
নির্যাতনের পর বিকাল পাঁচটায় আমাদেরকে গলা ধাক্কা দিয়ে একটি কুঠুরীতে বন্দী করে। সেখানে আরো দুজনকে বন্দী অবস্থায় দেখা যায়। অবশ্য জেল গেটেই তাদের হাতের বাঁধন ও চোখের পট্টি খুলে দেয়।
নাটোর জেলখানায় তিনটি কোঠায় তিনশ জনের মত কয়েদী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ সালেহ আহমদ, অধ্যাপক মুজিবর রহমানসহ অনেক বুদ্ধিজীবীও ছিলেন। বলা প্রয়োজন যে ইপিআরদের জন্য তিনটি কোঠার একটি রিজার্ভ ছিল। প্রত্যহ পানি আনা, রাস্তা মেরামত, পুকুর পরিষ্কার, মিলিটারিদের খেলার মাঠ তৈরীসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ তাদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া হতো। এবং সে সময়ে তাদের উপর অত্যাচার করা হতো।
জেলখনায় মাস দুয়েক কাটানোর পর আমাকে জনৈক এফআইটি অফিসারের নিকট বিবৃতি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানে বিবৃতি আদায়ের ফাঁকে ফাঁকে বৈদ্যুতিক চাবুক দ্বারা প্রহার করে। শেষ পর্যন্ত যে বিবৃতিতে তারা সই করিয়ে নেয় তাতে সত্য অপেক্ষা মিথ্যাই ছিল বেশী।
নাটোর জেলখনায় মিলিটারীদের অত্যাচারের সময় জেলখানাতেই জনৈক কয়েদী মারা যান।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আবুল ওয়াহেদ
১৬/০৮/১৯৭২
।। ৩৯ ।।
মোঃ আফজাল আলী মন্ডল
গ্রাম- পারনাথপুর, পোঃ- রাণীনগর, রাজশাহী
“ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহ মঙ্গলবার ভোর বেলায় গাড়ি থামিয়ে পাক সৈন্যরা চকউজির, বাহাদুরপুর, চক বিলাকী গ্রাম ঘেরাও করে। আমি সেদিন চক বিলাকী গ্রামে আত্মগোপন করেছিলাম। আমাকে এবং আরো দুজনকে ধরে বেঁধে রাখে। উল্লিখিত দুজনের একজনের চাচাকে বাড়িতে গুলি করে হত্যা করে রেখে তাকে বেঁধে নেয়। নদীর ধারে ঢাকা থেকে আগত কামলা ৯ জন ছিল। এরা তাদেরকেও ধরে ফেলে। আমার স্বাস্থ্য ভাল বিধায় আমাকে মুক্তিবাহিনীর নেতা বলে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং জানতে চায় মুক্তিফৌজ কোথায় এবং রাইফেলাদি কোথায়?
ইতিমধ্যে আরও তিনজনকে ধরে আনে। তাদের প্রহার করে ও আমি মুক্তিবাহিনীর নেতা কিনা তা জানতে চায়। এরপর সকলকে নদীর ধারে নিয়ে যায় গুলি করার জন্য। সে জায়গা খর স্রোতা নয়, লাশ জলে আটকে থাকবে এজন্য স্থান পরিবর্তন করে আর এক জায়গায় নেওয়া হয়। সেখানে ‘ওয়্যারলেস’ এর মাধ্যমে কথাবার্তা হতো। তারপর আমাদের একটি আম বাগানে নেওয়া হয়। সেখানে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে, যারা মিলিটারীকে দেখতে এসেছিল। এদের একজন অত্যাচারের অসহ্যতার জন্য বলে যে আমি আওয়ামী লীগের নেতা। যাহোক জনৈক রাজাকারের সামান্য সুপারিশে আমাকে ও উল্লিখিত দুজনকে ছেড়ে দেয়। কিছু দূর যাবার পরে আমার মনে হলো যে এ ছেড়ে দেওয়া মানে কিছু দূর যাবার পর গুলি করে হত্যা করবে। এসব ভাবতে ভাবতে আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই। পরবর্তিকালে জ্ঞান ফিরলে দেখতে পাই যে আমি বাড়িতে আছি।
পাক বাহিনী ঐদিন গ্রামগুলি ঘেরাও করে অন্যূন ২৫০/৩০০ জন লোক ধরে এবং তাদের মধ্যে সাতজনকে গুলি করার জন্য আত্রাই নিয়ে যায়। তাদের সবাই মারা গেলেও ভাগ্যক্রমে আক্কেল আলী নামে জৈনক ছেলে গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে যায়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আফজাল আলী মন্ডল
।। ৪০ ।।
মোঃ হামিদুর রহমান
গ্রাম- কুমাইল, পোঃ- কাশিমপুর, থানা- রাণীনগর, রাজশাহী
রাণীনগর থানার আতাইকুলা গ্রামে অপ্রত্যাশিতভাবে জুন মাসে ২৯ তারিখে প্রায় ৮০ জন পাক সৈন্য প্রবেশ করে। পাক বর্বরদের সাথে বিহারীরাও ছিল। সেদিন বেলা দশটার সময় উল্লেখিত পাক বর্বররা ধ্বংস, বীভৎসতা চালানোর জন্য গিয়েছিল। গ্রামে প্রবেশ করার আগে গ্রামের সংলগ্ন যমুনা নদী পার হয়ে সশস্ত্রভাবে দৌড়ে গিয়ে গ্রামটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। অবশ্য গ্রামের পাল পাড়া ধ্বংস করাই উদ্দেশ্য ছিল বলে আমার মনে হয়। গ্রামের অন্যান্য পাড়ায় গুরুত্ব না দিয়ে উক্ত গ্রামের পাল পাড়াতেই বেশি তৎপরতা চালায়। পাল পাড়ায় সমস্ত জনগণকে একত্রিত হতে পাক হানাদাররা আদেশ করে। আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত পাড়ার হিন্দু জনগণ এক জায়গাতে একত্রিত হয়। পরে পাক হানাদাররা তল্লাশি করে ও জোরপূর্বক টাকা-পয়সা, সোনার গহনা, ব্যবহারিক সৌখিন জিনিস লুট করতে থাকে। অন্যূন ৬০ হাজার টাকা উক্ত গ্রাম থেকে লুট করে নিয়েছে। বেলা ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত লুট পর্ব চলে। পড়ে উল্লিখিত ধৃত ব্যক্তিগণকে এক লাইনে দাঁড় করায়। লাইনে দাঁড় করানোর পরে মেশিন গানের গুলিতে ৪০ জন লোক নিহত হন।
উক্ত হত্যাকাণ্ডের আগে পাক বর্বররা গ্রামের প্রায় ৫০ জন কুলবধূকে অন্য এক জায়গায় বন্দী করে রাখে। কুলবধূগণকে গুলি করে না মারলেও তাদের অধিকাংশের শ্লীলতাহানি করে। বলা প্রয়োজন উক্ত হত্যালীলা ও ধর্ষণ চালানোর পরে উক্ত পাড়াতে ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগ করে। ফলে উক্ত পাড়ায় শতকরা ৩০ ভাগ বাড়িঘর সম্পুর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। অবশ্য গ্রামে প্রবেশ করার পূর্বে ও পরে মাঠের দিকে বিক্ষিপ্তভাবে গুলি চালালে ইরি ক্ষেতের মাঝে লুকায়িত ৬/৭ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
কিছুদিন পরে পশ্চিমা বর্বর বাহিনী পুনরায় উক্ত আতাইকুলা গ্রামে পাল পাড়ায় প্রবেশ করে। প্রবেশ করার আগে গ্রামের জনগণ নারী, পুরুষ নির্বিশেষে প্রাণের ভয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। পরে কোন মানুষকে না পেয়ে কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাক পশুরা তাদের নির্দিষ্ট স্থানে চলে যায়।
আত্রাই থানায় তখন বর্বরদের ধ্বংস ও বীভৎসতা চরম ভাবে চলেছিল। বলা প্রয়োজন আতাইকুলাতে দুইবার অভিযান চলার পর পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছুসংখ্যক যুবক ঐ গ্রামে অভিযান হবেনা ভেবে রাত্রিতে অবস্থান করতেন। কিন্তু গ্রামে স্বার্থান্বেষী পাকিস্তানী দালালদের প্ররোচনায় তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছিল। পরে দালালদের আমন্ত্রণে পাক বর্বররা তৃতীয়বার উক্ত আতাইকুলা গ্রামে প্রবেশ করে পাল পাড়াতেই। বলা প্রয়োজন উক্ত পাল পাড়ায় প্রাণের ভয়ে কয়েকজন যুবক আশ্রয় নিয়েছিল। তখন কয়েকজন যুবক পাক দস্যুদের তৎপরতায় ধরা পড়ে। পাক বর্বররা উক্ত ধৃত যুবকদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ হামিদুর রহমান
।। ৪১ ।।
মোঃ ছালামত আলী
গ্রাম- সফিকপুর, ডাকঘর- পালসা, রাণীনগর, রাজশাহী
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে বর্বর নরপশুরা রাজাকারসহ সশস্ত্র অবস্থায় আকস্মাত গ্রামে প্রবেশ করার পূর্বেই গ্রামের জনসাধারণ স্ত্রী-পুত্র, কন্যাসহ বিক্ষিপ্তভাবে প্রাণের ভয়ে পলায়ন করতে থাকে। পড়ে সৈন্যরা এবং রাজাকাররা নৌকা থেকে নেমেই গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ি তন্ন তন্ন করে তল্লাশী চালাতে লাগলো, তাদের ধারণা ছিল হয়তো কোন আওয়ামী লীগার, মুক্তিযোদ্ধা কিংবা কোন স্বেচ্ছাসেবক গ্রামের মাঝে আত্মগোপন করে আছেন। কিন্তু তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লুট করা। ঘরের মাঝে যে সমস্ত মূল্যবান আসবাবপত্র ছিল তা নষ্ট করে দেয়, কতকগুলি শৌখিন জিনিস নিয়েও যায়। ট্রাংক, সুটকেস খুলে খুলে কিংবা উপর থেকে আছাড় মেরে তার ভেতরে যা পায় যেমন দামি কাপড় চোপড়, গহনা পত্র, রেডিও, ঘড়ি সমস্ত লুট করে নিয়ে যায়। পঞ্চান্ন বছর বয়স্ক মজিবর রহমান নামক এক বৃদ্ধকে বেদম প্রহার করে। সেই প্রহারের ক্ষণকাল পর আমাকে ধরে চোখ বাঁধে। চোখ বাঁধা অবস্থায়ই আমাকে নৌকায় তোলে। অনেক অবাঞ্চিত কথা বলার পর পাক বাহিনীর লোকেরা আমাকে আত্রাই স্টেশনে নিয়ে যায়। আত্রাই স্টেশনে নামিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়। স্টেশন সংলগ্ন একটি কোঠায় আমাকে বন্দী করে রাখে। সেখানে আমি নাম না জানা অপরিচিত বারজন লোককে দেখতে পাই। দুদিনে দুইখানা রুটি খেতে দিয়েছে নরপশুরা। অবশ্য কোন থালা বা প্লেটে দেয়নি। হাতে হাতে দিয়েছে।
যে বার জন লোক উল্লিখিত কুঠুরিতে ছিলেন তাদেরকে নিয়ে কয়েকজন মিলিটারী প্রায় দুইশ গজ দূরে নিয়ে যায়। তখন অন্ধকার রাত ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। সেই অন্ধকারের মাঝে ব্রিজের উপরে বার জন লোককে তুলে নেয়। অবশ্য ব্রিজের নিচে অথৈ পানি ছিল। একসময় গুলি করে বার জন লোককে হত্যা করে। আমি স্পষ্ট গুলির শব্দ শুনতে পাই। পরে বর্বর সৈন্যরা নির্দিষ্ট জায়গাই চলে আসে।
উল্লিখিত ঘটনার পড়ে পালা এলো আমাকে হত্যা করার। আমি চাকুরিজীবী বলে পশুরা আমাকে হত্যা করে না। আর পকেটে ছিল পরিচয়পত্র। সেই পরিচয়পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে রাত ৯টার সময় আত্রাই স্টেশন ক্যাম্প থেকে হানাদাররা মুক্তি দেয়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ ছালামত আলী
।। ৪২ ।।
মোঃ আবুল হোসেন
থানা- সদর, জেলা- রাজশাহী
পাকবাহিনী রাজশাহী প্রবেশের পূর্বে বিমান মহড়া শুরু করে জনমনে ত্রাসের সঞ্চার করে। বিমান থেকে যে দিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বোমাবর্ষণ করা হয় সেদিন আমি প্রাণের ভয়ে সপরিবারে দুর্গাপুর থানার পাচুবাড়িয়া স্কুলগৃহে আশ্রয় নেই। সেখানে প্রায় মাসাধিককাল ছিলাম। ইতিমধ্যে গোটা শহর সামরিক বাহিনীর লোকেরা নিজেদের দখলে নেয়। বাজারের দোকান লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে পুড়িয়ে দেয়। জনবসতি এলাকায় বাসাবাড়ি ও লুটপাট করে। এতে আমাদের বাড়ি ও দোকান লুট হয়।
সামরিক বাহিনীর লোকেরা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যখন তৎপরতা শুরু করে তখন আমরা শহরে ফিরে আসি। নিজের বাড়ি বাসোপযোগী না থাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় উঠি (বেলদার পাড়া)। এর দশ বারদিন পর হঠাৎ একদিন রাতে কারফিউ এর মধ্যে রাত দশটার সময় বাসা ঘেরাও করে আমাকে গ্রেফতার করে। পালাবার চেষ্টা করলে গুলি করে। গুলি পেটে লেগে পিছলে বেরিয়ে যায়।
গ্রেফতারের পর প্রথমে এক বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আকারে ইঙ্গিতে শলাপরামর্শের পর আমাকে স্থানীয় সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় সারারাত অত্যাচার করে। কেউ ঘুষি মারে, কেউ চড় মারে, কেউ বা লাথি মারে।
পর দিন সকাল ৯টার সময় জোহা হলে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। একটি অন্ধকার কক্ষে উলঙ্গ করে হাত বাঁধা অবস্থায় রাখে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর হলের আঙ্গিনায় ইলেকট্রিক তার, হান্টার ও লোহার রড় দ্বারা বিরামহীনভাবে ৮ ঘন্টা ধরে অত্যাচার করা হয়। এর মধ্যে আমি ৯ বার জ্ঞান হারিয়েছিলাম। পিপাশায় পানি ও দেওয়া হয়নি। বিকাল বেলা আমাকে আবার ঘরে নিয়ে আসে। রাতে খিচুড়ি জাতীয় সামান্য কিছু খাবার দেওয়া হয়।
পরের দিনও আমাকে ঐ একইভাবে অত্যাচার করে ও নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিকালের দিকে এক বাঙালি দালাল বাসা থেকে এক হাজার টাকা মুক্তিপণ হিসেবে নেয়। এবং পরের দিন সকালে সৈন্যরা আমাকে পূর্বোক্ত বাসায় রেখে যায়। ছেড়ে দেওয়ার সময় বলা হয় তোমার উপর যা ঘটলো তা যদি কাউকে বলো তাহলে তোমার গোটা পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হবে।
জোহা হলে বন্দী অবস্থায় আমি বহু সংখ্যক নারী কন্ঠের চিৎকার, কাকুতি মিনতি ও করুণ কান্নার শব্দ শুনেছি। যদিও কিছুই দেখতে পাইনি তবে এটা বুঝেছি যে নরপশুদের অমানুষিক অত্যাচার চলছে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আবুল হোসেন
।। ৪৩।।
হরিদাসী
গ্রাম- রামজীবনপুর, থানা- পুটিয়া, জেলা- রাজশাহী
৮ই বৈশাখ বৃহস্পতিবার ৮০/৯০ জন পাক সৈন্য সমস্ত রামজীবনপুর ঘিরে ফেলে। এ সময় আমার সেজ ছেলে কানাইলাল হেমন্ত ঘুমিয়ে ছিল। ওদের সাড়া পেয়েই ও চেতন পায়। ইতিমধ্যে পাক সৈন্যরা দরজায় রাইফেলের গুঁতা এবং পায়ের লাথি মারে এবং ঘর থেকে বেরোবার নির্দেশ দেয়। আমার ছেলে যখন দরজা খুলে বেরোয় তখন তাকে এবং তার ছেলে-মেয়েকেও ঘরের বারান্দায় বসায়। আমি এবং আমার স্বামী তখন পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে কান্নাকাটি ও তাদের অনুরোধ করতে থাকি। তারা আমাকে “আন্দর যাও” বলে শাসাতে থাকে।
অতঃপর আমার ছেলের কাছে রাইফেল, বন্দুক, সোনা, সাইকেল, ঘড়ি, টাকা-পয়সা চাইতে থাকে।
তারপর আমার উক্ত ছেলেকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে রশি দুই দূরে জমির মধ্যে নিয়ে যায়। তারা পাশের বাড়ি থেকে আরও দুজনকেও (পিতা-পুত্র) ধরে নিয়ে যায়। এবং সেখানে তাদের গুলি করে হত্যা করে।
গুলি করে হত্যা করার পর তারা আবার আমার বাড়ি আসে এবং আমার বেটার বৌ এর কাছে বলে যে তোমার স্বামীকে শেষ করে দিয়েছি। এখন তোমরা বাড়ি থেকে বেরোও। বাধ্য হয়ে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে তারা বাড়িতে আগুল লাগিয়ে দেয়। তারা আগুন লাগানোর আগে আমার গরুগুলি ছেড়ে দেয়। অতঃপর তারা চলে যায়। এদিন সমস্ত পাড়ায় তারা আগুন এবং অন্যূন ৮ জন লোককে হত্যা করে। এর দুই দিন পর আমি ভারতে চলে যায়। আমার চলে যাবার পর আমার বাড়ির অবশিষ্ট সম্পদ লুন্ঠিত হয়।
স্বাক্ষর/-
হরিদাসী
।। ৪৪ ।।
মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
আনছার কমান্ডার, গ্রাম- গৌরশহরপুর, থানা- চরঘাট, রাজশাহী
১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল পাক সৈন্যরা ৬০/৭০ খানা গাড়িযোগে সারদা আসে। এবং অবশেষে সারদার পতন ঘটে। তারা এসেছে এ খবরে এবং তাদের দেখে সারদা এলাকার লোকজন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রাণের ভয়ে আত্মরক্ষার্থে চরে আশ্রয় নেয়। পাক সৈন্যরা পিটিসিতে ঢুকে আগ্নেয়াস্ত্র দখল করে এবং বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তারা চরে আশ্রয় নেয়া লোকদের ধরে একত্রিত করে। তাদের সংখ্যা ছিল অন্যূন ১০০০/১৫০০। এদের মধ্যে আনসার, পুলিস, সাধারণ মানুষ ছিল। একত্রিত লোকগুলিকে জমা করা হলে তারা সারি করে সকলকে গুলি করে হত্যা করে।
এক একটা দলকে ধরে এনে তারা গুলি করে হত্যা করে। ইতিমধ্যে আর একটি দল জমা হয়। তাদেরকে দিয়ে মৃত লাশগুলি জমা করে। অতঃপর তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। অপর ধৃত লোকগুলি দিয়ে তাদের লাশ জমা করে। শেষাবধি মৃত দেহগুলিকে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
আড়াইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত তারা এই কাজ করে। অতঃপর তারা সন্ধ্যার মধ্যেই এলাকা ত্যাগ করে চলে যায়। এসময় তারা বিরামহীনভাবে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতে থাকে।
এ সময় আমি আর সকলের সাথে চরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাপার বেগতিক দেখে চর থেকে পালিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকি এবং নিজেকে মুক্ত রেখে পাক সৈন্যদের কার্যকলাপ দেখছিলাম।
সন্ধ্যার মধ্যেই এখানে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে ছেলে-মেয়েসহ অন্য গ্রামে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেই। পরদিন অত্র থানার নন্দনগাছি নিমপাড়া ইউনিয়নে আশ্রয় নেয়। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর বুঝতে পারলাম যে সেখানে থাকা নিরাপদ নয়। পাক মেজর এবং শান্তি কমিটির লোকেরা আমাকে খুঁজছে। তাই সেখান থেকে জামনগর গ্রামে যাই। সেখানে থাকা অবস্থায় নন্দনগাছির কতিপয় লোক খবর দেয় যে চেয়ারম্যান আমাকে ডেকেছে, আমার কোন ভয় নেই। তাদের কথামতো নন্দনগাছি পৌছালে তারা আমাকে বন্দী করে এবং পরদিন সকালে জয়েন সরকারের বাড়িতে বন্দী অবস্থায় হাজির করে। সেদিন ছিল ২৯শে মে। সেখানে পৌছার কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাবিলদার মেজরসহ কতিপয় সামরিক লোক গিয়ে আমাকে বন্দী অবস্থায় ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে আসে। নিয়ে যাবার সময় পিছনে হাত এবং ন্যাকড়া দিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। সেখানে মেজর শফি আহমেদের কুঠিতে বন্দী করে রেখে দেয়।
বিকেলে মেজর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে। সে জিজ্ঞেস করেছিল যে তুমি গোপালপুরে কতোজন মিলিটারী মেরেছো এবং কতো রাইফেল নিয়ে গিয়েছিলে? উত্তরে তারা সন্তুষ্ট হতে না পেরে আমার উপর শারীরিক অত্যাচার শুরু করে। বুটের লাথি, চড়, কিল, ঘুষি মারছিল। এ অবস্থায় অত্যাচার করার পর চোখ আবার বাঁধা হয়। হাত তো আগে থেকেই বাঁধা ছিল। এ অবস্থায় গেস্ট হাউসের উপর তলায় রাখে।
রাত আটটার দিকে আবার নতুন করে হাত কষে বাঁধে। পায়ের গিটে বেঁধে হাঁটুর মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে ঘাড় এবং হাঁটু পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধে। অতঃপর ঐ অবস্থায় আমাকে হৃদয়হীনভাবে প্রহার শুরু করে। হাত, লাঠি, রুলার দ্বারা প্রহার করতে থাকে। রাইফেলের বাঁট দিয়ে গর্দানে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রহার করে। এই প্রক্রিয়ায় পালাক্রমে সারারাত ধরে অত্যাচার করে। শেষ রাতের দিকে সেই পশুরা যখন অণ্ডকোষ ও মলদ্বারে লাঠি মারে সে সময় আমি চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
সকাল ৭/৮ টার দিকে যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন আমি ঐ বসা অবস্থায় কুণ্ডলী পাকিয়ে নিজেকে পড়ে থাকতে দেখতে পাই। এবং ঐ অবস্থায় অভুক্তভাবে সারাদিন ঐখানেই পড়ে থাকি।
বিকেল বেলা আমার হাত এবং পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। চোখ বাঁধা অবস্থাতেই গাড়িতে তুলে নিয়ে মেজর আমাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে নিয়ে যায়।
সন্ধ্যার পর চোখ ও হাত পা খোলা অবস্থায় কর্নেল রেজভীর সামনে আবার পূর্বোক্ত প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করতে থাকে। আমি সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করি।
রাত ১১ টার দিকে আমাকে একটি ঘরে বন্দী করে। সেখানে আমি ১০/১২ জন লোককে বন্দী অবস্থায় দেখতে পাই।
পরদিন সকালে কয়েকজন সেপাই আমাকে দেখে প্রহার শুরু করে। পালাক্রমে তারা এই কাজ করে। তাদের রীতি ছিল যে ঐ ঘরে কোনো লোক গেলে তারা বলতো “তোম কাহাসে আয়া, কব আয়া?” আর তার সাথে প্রহার করতো। দুপুরের দিকে ২টা রুটি এবং কিছু তরকারি দেয়। পায়খানা প্রসাব অথবা গোসলাদির কোন ব্যবস্থা ছিল না।
সেখানে তের দিন বন্দী অবস্থায় ছিলাম। এবং সে সময় আমি লক্ষ্য করেছি যে সারাদিন ধরে লোক জমা হতো এবং রাতে অস্ত্রশস্ত্র সহকারে একজন হাবিলদার এবং তিনজন সেপাই আসতো। তাদের সাথে মোটা দড়ি থাকতো। কাগজে নাম লিখা থাকতো। নাম ধরে ডাকতো এবং বলতো “তোম খাড়া হো যাও।” খাড়া হয়ে গেলে পিছনে ঐ দড়ি দিয়ে কষে হাত বাধতো এবং টেনে মাঠের মধ্যে ১০০/১৫০ গজ দূরে নিয়ে যেত। তারপর শোনা যেত গুলির আওয়াজ। যতগুলি লোক ধরে নিয়ে যেত ঠিক ততটি গুলি করতো। প্রত্যেক রাতে ৭/৮/৯/১০টা করে লোক এমনি করে হত্যা করেছে। এ সময় প্রত্যেক দিন আমার উপর অমানুষিক অত্যাচার করেছে।
১৩ দিন পর বিকেলে নাকে লোহার পাত দিয়ে পিছনে হাত বেঁধে (ডাবল হ্যান্ডকাফ দিয়ে) জাহাঙ্গীর পরিবহনে (রাজশাহীর একটি বাসের নাম যা এখনো আছে) করে নাটোর এম, পি, এইচ, কিউ ফুল বাগানে পাঠায়। বাসের দরজা জানালা বন্ধ অবস্থায় ছয়জনের গার্ডে নাটোর পৌঁছায়। সেখানে প্রায় আধ ঘন্টা ছিলাম। সে সময়ই এমপিরা (MP = Military Police) পালাক্রমে প্রহার করে এবং অকথ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালি গালাজ করে। তারপর নাটোর জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়।
জেলখানায় হাত খোলা অবস্থায় হাজত ঘরে বন্দী করে রাখে। সেখানে আরও ৫০/৬০ জন লোক ছিল। ৫/৭ দিন আমি সেখানে ছিলাম। সেখানে একজন এফআইটি প্রত্যহ আসত এবং পালাক্রমে সকলের জবানবন্দী নিত। জবানবন্দী নেবার আগে এক পশলা প্রহার করে নিতো। সকাল, বিকাল ও দুপুরে এই কাজ করতো। জবানবন্দী হয়ে গেলে ঐ সময় আমাকে জেল ঘরে পাঠায়। সেখানে আমরা ৬২ জনের মত লোক ছিলাম।
জেলখানায় থাকার সময় আমাকে একদিন বের করে মেঝের উপর হাঁটুর মধ্যে দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে কান ধরে রাখতে বলে এবং ঐ অবস্থায় ৫০/৬০টি বেত মারে। আমি পড়ে গেলে আমাকে আবার তুলে উপুড় করে শুইয়ে দেয়। এছাড়া কখনো হাত-পা ফাঁক করে দাঁড় করিয়ে রাখতো। কখনো বা টান উপর করে বুকডন দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ঘন্টা খানেক করে রাখতো। তাছাড়াও উপুড় করে শুইয়ে রেখে দুজন সিপাই একই সঙ্গে পিঠের উপর খুচত। বেত পিটানো তো নিয়মিতই হচ্ছিল। প্রত্যেক দিন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ১৬২ জন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, মাস্টারসহ বিভিন্ন ধরণের লোককে অত্যাচার করতো। মাঝে মধ্যে ২০/২৫ জন লোককে ধরে ফুল বাগানে নিয়ে গিয়ে পাথর বালি বইয়ে নিত।
এ সময় নামাজ পড়তে চাইলে তারা বলত “তোম লোগ কাফের হ্যায়, নামাজ কিউ পড়তা হ্যায়?” তাছাড়া নামাজ পড়তে দেখলে তারা দাঁত বের করে হাসতো।
পরবর্তীকালে এফ,আই,ও রা আবার নাটোর রিক্রিয়েশন ক্লাবে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো। সে সময় এক ধরনের কালো রাবারের পাইপ দিয়ে প্রহার করতো। ৫ই সেপ্টেম্বরের সপ্তাহখানেক আগে সামরিক আইনের ১৮ ধারা মতে (সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা) চার্জশীট দাখিল করে। বিচার শুরু হবার আগেই ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমায় আমি ছাড়া পাই।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
।। ৪৫ ।।
মোঃ ওমর আলী শেখ
গ্রাম- গৌরসহর পুর, থানা- চারঘাট, জেলা- রাজশাহী
১৯৭১ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে খান সেনারা গোলাগোলি করতে করতে বাড়ি ঘর জ্বালাতে জ্বালাতে আসতে লাগলো। পাক সেনাদের ভয়ে আমরা নিরাপদ জায়গায় আত্মগোপন করে তাদের গতি লক্ষ করতে থাকলাম। তারা সারদা পুলিশ ট্রেনিং একাডেমীতে যায়। প্রাণভয়ে যে সমস্ত লোক পদ্মানদীর ধারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকে ঘেরাও করে ধরে প্রায় আনুমানিক ১২০০/১৩০০ লোককে গুলি করে হত্যা করে এবং পড়ে সকলকে একত্রিত করে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ইহার দুই ঘন্টার মধ্যেই তারা রাজশাহীতে চলে যায়।
পরের দিন সিএফ পুলিশ নিয়ে এসে এখানে রাখে এই অঞ্চলকে তাদের আয়ত্তে রাখার জন্য। শুধু তাই নয় তাদের সাথে আরো কিছু মিলিশিয়া জমায়েত করে রাখলো।
ইহার ২/৩ দিন পড়ে ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে পুরা ক্যান্টনমেন্ট স্থায়ী করে। তারা বাজার লুট করতে লাগলো, গ্রামে গ্রামে গিয়ে যারা পালিয়ে গিয়েছে তাদের বাড়িঘর ভাঙ্গতে লাগলো এবং মালামাল লুট করতে থাকে।
খান সেনারা পূর্ণ ক্যান্টনমেন্টে স্থায়ী করার পর শান্তি কমিটির সদস্যরা তাদের স্বার্থসিদ্ধিতে অক্ষম হলে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদেরকে ধরে মিলিটারীর হাতে দিতো। তাছাড়া পাশবর্তী গ্রাম থেকে সন্দেহজনক লোককে ধরে এনে খান সেনাদের হাতে দিত। তাদেরকে বিভিন্ন দোষে দোষারোপ করে জরিমানা করা হতো, যদি জরিমানা দিতে অক্ষম হতো তাহলে তাকে জবাই করে হত্যা করা হতো। আর যারা জরিমানা দিতে পারতো তাদেরকে তখনকার মতো ছেড়ে দেওয়া হতো।
খান সৈন্যরা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার করতো। এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশ কিছু নারী নিয়ে এসে তাদের যৌনক্ষুধা নিবারণ করতো। এইভাবে তারা ৮ মাসে প্রায় ২৬০০/২৭০০ লোককে হত্যা করে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ ওমর আলী
।। ৪৬ ।।
মোঃ আনিসুর রহমান
গ্রাম- বাজে গোয়ালকান্দি, ডাকঘর- গোয়ালকান্দি, থানা- বাগমারা, জেলা- রাজশাহী
১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে শান্তি কমিটির সদস্যরা গাঙ্গোপাড়া হিন্দু বর্ধিষ্ণু গ্রামে হানা দেয়। সেখানে গ্রামে মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামী পন্থীদের সহায়তায় তারা হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট করে। সমস্ত কাপড়-চোপড়, সোনাদানা, থালাবাসন লুটপাট করে। এমন কি ঘরে মেঝে, পুকুর ঘাটের সিঁড়ি কোদালী, পাশ দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। তাদের ধারণা সেখানে লুকানো সম্পদ আছে। ঘরের জানালা কপাট খুলে নিয়ে যায়। ধানচাল, গরুবাছুর ইচ্ছামত নিয়ে নেয়। তাদের অনেকে বাস্তুভিটা ত্যাগ করার আগে পাকশাক করে শেষবারের মতো সকলে মিলে চারটি খেতে চেয়েছিল। কিন্তু শান্তি কমিটির লোকেরা তাদের সে সুযোগটুকুও দেয়নি। এমনকি অনেকে যখন ভাত থালে বেড়ে নিয়ে খেতে বসেছিল ঠিক সে সময় তাদের থালাতে লাথি মেরে থালা ফেলে দিয়েছে, খেতে দেয়নি। বলেছে, “পাকিস্তানের ভাত তোদের জন্য হারাম, শীঘ্র পালা, প্রাণে মারলাম না, সেটা শুধু আমাদের দয়া।”
অনুরূপভাবে জিনিসপত্র গরুবাছুরের তালিকা করে হিন্দুদের উচ্ছেদ করা হয় সেন পাড়া, ভবানীগঞ্জ, খাজাপাড়াসহ থানার সমস্ত হিন্দু এলাকা থেকে।
২৩শে এপ্রিল, ৯ই বৈশাখ বিকাল চারটার দিকে শান্তি কমিটির আমন্ত্রণে পাক সৈন্যরা তাহিরপুরে আসে। ঐ দিন ছিল তাহিরপুরের হাটবার। সৈন্যরা হাটে এসে সমগ্র হাটে বিক্ষিপ্তভাবে পজিশন নেয় এবং ১৩ জন লোককে ধরে গুলি করে হত্যা করে। এদের অধিকাংশই হিন্দু ছিল। মিলিটারীরা দাড়িয়ে থেকে হাট লুট করার নির্দেশ দেয়। কেউ অস্বীকার করলে বেদম প্রহার করে। ফলে হাট যথেচ্ছভাবে লুট হয়।
যে সকল হিন্দু দেশের মায়া ত্যাগ করতে না পেরে তখনো ছিল তাদের জোরপূর্বক মুসলমান করা হয়।
মুসলমান হবার সময় দেওয়া হয় মাত্র ৪৮ ঘন্টা। এতে নিরুপায় হিন্দুরা গত্যন্তর না দেখে মুসলমান হয়। একদিনেই ৩০০/৩৫০ জন হিন্দু সপরিবারে মুসলমান হয়। একমাত্র গোয়ালকান্দি ও উর্দুপাড়া গ্রামেই ১৩০ জন হিন্দু মুসলমান হয়। ধর্মান্তরিত করার পরেও তাদের মনের ঝাল মিটেনি। হিন্দুদেরই চালডাল, গরু ছাগল জবাই করে গোয়ালকান্দির মাদ্রাসা মাঠে ঘটা করে মজলিশ করে। উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুদের গোমাংশ ভক্ষন করিয়ে চিরতরে ধর্মচ্যুত করা।
মে মাসে সেন পাড়া গ্রাম থেকে বাঙ্গাল পাড়ার ইয়াছিন আলীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ইয়াছিন আলী সেন পাড়ায় তার শ্বশুরবাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। তারপর তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। সেই এই থানার প্রথম শহীদ ব্যক্তি। বাংলা আষাঢ় মাস ছিল তখন।
শান্তিকমিটি গঠিত হবার পর পরই শান্তিকমিটির লোকেরা দুষ্কৃতিকারীর তালিকা তৈরি করে। আওয়ামী লীগের নেতা ও প্রথম শ্রেণির একনিষ্ঠ কর্মীদের নামের তালিকা তৈরি করে। তাতে জনাব সরদার আমজাদ হোসেন এমপি, বাজে গোয়ালকান্দি গ্রামের আনিসুর রহমান, খামার গ্রামের কাজী সাজেদুর রহমান, থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল ইসলামসহ প্রায় ২২/২৩ জনের তালিকা তৈরি করে। সরদার আমজাদ হোসেন সাহেবকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ১৫ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। এছাড়া আনিসুর রহমানসহ আরও কতিপয়কে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়।
মে মাসের মধ্যেই রাজাকার তৈরি করা হয়। এতে বহু ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়। প্রতিটি ইউনিয়নে রাজাকার মোতায়েন করার কথা থাকলেও তাহিরপুর এবং থানা ছাড়া কোথাও মোতায়েন করা সম্ভব হয়নি। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতায় তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
৩রা আশ্বিন রাতে রায়পুরা গ্রামে হানা দিয়ে সরদার ওসমান আলী সাহেবের বাড়িঘরের সমস্ত জিনিসপত্র লুটপাট করে এবং তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়। আগুন লাগিয়ে দিতে থাকাকালে অন্য আর এক রাজাকারের কৃপায় বেঁচে যান। তাঁর পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে দেয়। এমনিভাবে থানার বিভিন্ন স্থানে লুটপাট করে। বেউকালীতেও অপারেশন করে লুটপাট করে, বেলসিংহেও লুটপাট চালায়।
পাক মিলিটারীরা থানার বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নরহত্যা ও নারী নির্যাতন করে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের খবর পেয়ে মিলিটারীরা ভবানীগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করে। আগস্ট মাসের পর কোন এক সময়ের ঘটনা। সমস্ত ভবানীগঞ্জ বাজার লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ভবানীগঞ্জ গ্রামের বেশ কিছুসংখ্যক মহিলার উপর নির্যাতন চালায়। বলা প্রয়োজন উক্ত গ্রাম ধর্মভীরু গোঁড়া মুসলমান বসতিপূর্ণ। পক্ষান্তরে তারা প্রায় সকলেই পাকিস্তানী সমর্থক ছিল। তবুও খান সেনারা তাদের পাশবিক অত্যাচার করে। তারা উত্তর একডালা গ্রামের শাহ মুহম্মদ জাফর উল্লাহ এম, এন, এ-র বাড়ি সম্পূর্ণ ভস্মীভুত করে দেয়।
খান সেনা ও রাজাকার দল হাজিরকুশলা গ্রামে সরদার আমজাদ হোসেনের বাড়ি অপারেশন করতে যাওয়ার পথে গোয়ালকান্দির নওমুসলিম পাড়া অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়।
বাগমারা থানায় রাজাকার ও আধা মিলিটারীদের ক্যাম্প ছিল তাহিরপুর, বাগমারা থানা এবং বালানগর মাদ্রাসা। উল্লিখিত স্থানে সমানে লোক হত্যা করা হতো। জবাই করে, গুলি করে এবং বস্তায় পুরে পানিতে ফেলে দিয়ে লোক হত্যা করতো। বহুসংখ্যক লোক উক্ত তিন স্থানে তাদের হাতে পাশবিকভাবে মারা যায়।
স্বাক্ষর/-
মোহাম্মদ আনিসুর রহমান
১৭/০৯/১৯৭২
।। ৪৭ ।।
দেলজান বিবি
সাং- বাগমারা, জেলা- রাজশাহী
রমজান মাসের রোজা ছিলাম। বহুসংখ্যক পাকিস্তানী বর্বর সৈন্য আসে এবং কোন রকম পালানোর সুযোগ না দিয়েই তারা আমার ঘরে ঢোকে এবং ধরে পাশবিক অত্যাচার শুরু করে। চিৎকার করবার অথবা সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি শুরু করলে তারা আমাকে হস্তদ্বারা প্রহার করে এবং গুলি করে হত্যা করবে বলে ভয় দেখায়।
টিপসহি/-
দেলজান বিবি
সেপ্টেম্বর, ১৯৭২
।। ৪৮ ।।
সোনাভান খাতুন
সাং- বাগমারা, জেলা- রাজশাহী
রমজানের ১২/১৪ দিনের দিনে একদিন দুপুরে দুজন মিলিটারী যখন গ্রামের মধ্যে আসে তখন গ্রামের আর সকলের সাথে আমিও পালাতে চেষ্টা করি। কিন্তু বর্বর পশুরা আমাকে পথের মাঝখান থেকে তাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসে এবং আমাকে ধরে। কাঁদলে অথবা চিৎকার করার চেষ্টা করলে তারা রাইফেল উচিয়ে বলে চেঁচালে গুলি করে হত্যা করবো।
আমার উপর দুজন নরপশু অমানুষিক হৃদয়হীনভাবে পাশবিক নির্যাতন করে। আমি মাটির তলে লুকালে তারা সেখান থেকে আমাকে টেনে বের করে।
টিপসহি/-
সোনাভান খাতুন
সেপ্টেম্বর, ১৯৭২
।। ৪৯ ।।
এল, পাইনস
বনপাড়া মিশন, থানা- বড়ইগ্রাম, জেলা- রাজশাহী
২০শে এপ্রিল ১৯৭১ সাল। মিলিটারীরা বনপাড়ার আশেপাশে আসে এবং বিক্ষিপ্তভাবে গোলাগুলি চালালে হারোয়াতে চারজন লোক মারা যায়। তারপর থেকে মাঝে মাঝে পাক নরপশুরা অপারেশন চালাতে থাকে। তার প্রতিক্রিয়ায় বনপাড়া এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে অমুসলমানরা পালিয়ে আসে মিশন হাসপাতালে। মিশন হাসপাতাল কতৃপক্ষ তাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা যত্নসহকারে করতে থাকেন। তখন অবশ্য পাক সৈন্যরা নাটোর ও রাজশাহীতে চলে গিয়েছিল। তখন স্থানীয় দুষ্কৃতিকারীরা হিন্দুদের ক্ষতিসাধন করে। তাদের পরিত্যাক্ত বাড়ি-ঘর লুট করে। তখন থেকেই ২/১ জন অমুসলমান ওপার বাংলায় পালিয়ে যেতে থাকে।
২রা মে রাতে অমুসলমানরা ওপার বাংলায় চলে যাবে বলে স্থির করেছিল। কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের দরুণ সেদিন যেতে পারেনি।
৩রা মে। বিকাল সাড়ে তিনটার সময় মিশনের ফাদার লক্ষ্য করলেন যে, মিশন হাসপাতালের চারিদিক মিলিটারীরা ঘিরে নিয়েছে। তার কিছুক্ষণ আগে বনপাড়া সংলগ্ন অন্যান্য গ্রাম থেকে খৃস্টান পুরুষদের ধরে নিয়ে এসেছে। ধরার অভিযান পরিচালনা করেছিল মেজর শেরওয়ানী। পড়ে ফাদারের সুপারিশে সমস্ত খৃস্টানদেরকে নরপশুরা ছেড়ে দেয়।
তারপর নরপশুরা মিশনের অফিস, স্কুলঘর, মহিলা হোস্টেল তল্লাশি করে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও হিন্দুদেরকে খুঁজতে থাকে। খোঁজাখুঁজির পর সর্বমোট ৮৬ জন মানুষকে বের করে ও বন্দী করে। অবশ্য অল্প বয়সের ছেলেরা ও বৃদ্ধেরা রেহাই পেয়েছিল তাদের মনোভাবের উপর নির্ভর করে। তারপর বন্দী লোকদেরকে ধরে নিয়ে মোড়ে ট্রাকের অপেক্ষায় পথপানে চেয়ে থাকে। সত্যি সত্যিই যখন সামরিক ট্রাক এসে হাজির হলো তখন ট্রাকে তুলে ৮৬ জন মানুষকে নিয়ে যায় হত্যা করার জন্য। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধকে রেহাই দিয়ে অন্যান্য বন্দীদেরকে নির্মমভাবে প্রহার করতে করতে নিয়ে যায় তাদের নির্দিষ্ট স্থানে। ৮৫ জন লোককে নিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে অনিল নামক একজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। এ ঘটনা অবশ্য ফাদারের শোনা। দোয়াদপাড়া ব্রিজে নিয়ে হত্যা করা হয়। অনিল ফাদারকে বলে যে, এখান থেকে মাইল দুই নিয়ে যেয়ে রাইফেলের গাদা দিয়ে অমানুষিকভাবে ট্রাকের উপরেই প্রহার করা শুরু করে। দেয়াদপাড়া ব্রিজের কাছে একটি জলাশয়ে নিয়ে যেয়ে উপরে উল্লিখিত মানুষগুলোকে ২/৩ জন করে ধরে নিয়ে গুলি করতে থাকে। আনিলকে গুলি করে কিন্তু সে আঘাতে মরেনি। নাটোরের হাফিজ আবদুর রহমান অন্যান্য অপারশনের মত এখানেও উপস্থিত ছিল। সবশেষে আহত লোকদের উপর মেশিনগানের স্প্রে শুরু করে। অনিলের উরুতে মেশিনগানের একটি গুলি লাগে। এতেও সে খুব বেশী আহত হয় না। ফলে রাতে বর্বররা সরে গেলে সে আস্তে আস্তে স্বগ্রামে ফিরে আসে।
পাক বাহিনী যাবার আগে গ্রামবাসী মুসলমানদের ডেকে এনে এই স্তূপীকৃত মানুষগুলির উপর মাটিচাপা দিতে নির্দেশ দেয়। পরবর্তীকালে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী অত্যাচার করতে সুযোগ পায়নি এই কারণে যে পাক সৈন্যদের সাথে একজন খৃস্টান মেজর ছিলেন যিনি প্রায়ই আসতেন। গীর্জার ফাদারের অনুরোধে, মেজরের সক্রিয় হস্তক্ষেপে অত্র এলাকার মানুষ যথেষ্ট রক্ষা পেয়েছে। একবার ৬ জনকে এ এলাকা থেকে নাটোরে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা আর ফিরে আসেনি। পরবর্তীকালে তিনজনকে ধরে নিয়ে যাবার পর ফাদারের সুপারিশে তারা রেহাই পান। পরবর্তীকালে আবার পাঁচজনের উপরে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি হলে ফাদারের সুপারিশে তারাও মুক্তি পান।
স্বাক্ষর/-
এল, পাইনস
২৭/০৯/১৯৭২
।। ৫০ ।।
কদভানু বেওয়া
গ্রাম- দুর্গাপুর, থানা- দুর্গাপুর, জেলা- রাজশাহী
২৪শে আষাঢ় মঙ্গলবার খুব ভোরে পাক সৈন্যরা গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং সাথে সাথে ফাঁকা গুলি করে এবং লোক দেখেও গুলি করে।
আমার বাড়ির সামনে সামরিক গাড়ি দাঁড় করায় এবং আমার বাড়ি ঢোকে। এবং বন্ধু বন্ধু বলে ডাকে। আমাদের চেতন পাবার আগেই ঘরের দরজা ভেঙ্গে ফেলে। ইতিমধ্যে আমরা চেতন পেয়ে যাই। আমি সাড়া দিলাম এবং তারা কে জানতে চাইলাম। তারা বলে যে তারা থানার লোক। অতঃপর তারা আমার স্বামীকে ঘরের ভিতর থেকে টেনে বের করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। দুজন আমার স্বামীকে ধরে রাখে এবং একজন আমার পিছু নেয় এবং সে বার বার আমাকে ঘরের মধ্যে যেতে বলে। আমি পায়খানায় যেতে চাই কিন্তু সে পায়খানায় যেতে হবেনা বলে জানায়। কিন্তু সকাল বেলা পায়খানা প্রশ্রাব করতে দেবে না এ কেমনতর কথা বলে রেগে উঠি এবং একটি পানির বদনা নিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ির বাইরে যাই এবং অন্য এক বাড়ির গোয়াল ঘরে আশ্রয় নেই। আমি যখন যাচ্ছিলাম তখন ঐ লোকটি “কাঁহা যাতা হ্যায়” বলে পিছে পিছে যেতে থাকে।
বহুক্ষণ এখানে লুকিয়ে থাকার পর যখন বেরিয়ে আসি তখন আমার স্বামীকে চোখ খোলা অবস্থায় পশ্চিম দিকে মাথা পড়ে থাকতে দেখি এবং তখনই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। বলা বাহুল্য আমার স্বামীকে তারা গুলি করে হত্যা করে যায়।
টিপসই/-
কদভানু বেওয়া
।। ৫১ ।।
আবদুল মালেক
দুর্গাপুর
রাজশাহী
“শান্তিকমিটি ও রাজাকারদের সবরাহকৃত তথ্যের উপর ভিত্তি করে মিলিটারীরা বিভিন্ন এলাকায় এসে অপারেশন করেছে। তারা লুটপাট করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে এবং মানুষ হত্যা করেছে। তাদের অপারেশনগুলির মধ্যে নিম্মোক্তগুলি প্রধানঃ
তারা মে মাসের মাঝামাঝি যোগীদের পালশায় অপারেশন করে ৪২ জন হিন্দুকে হত্যা করে। সেখানে মেয়েদের উপর অত্যাচার করেছে।
জুন মাসে তারা দুর্গাপুরে অপারেশন করে ৮/৯ জনকে হত্যা করে। এখানেও তারা হৃদয়হীনভাবে নারী নির্যাতন করে। তাদের নির্যাতনের ফলে জনৈক অফিসারের একটি মেয়ে মারা যায় এবং অপর একজন পঙ্গু হয়ে যায়। এখানে তারা লুটপাট করে।
১লা রমজান শুক্রবার পাক সেনারা গগণবাড়িয়ায় অপারেশন করে। এখানে ত্রিমুখী অভিযান চালিয়ে ১০/১১ শত জন লোককে ধরে এনে তাদের দিয়ে গর্ত করিয়ে নিয়ে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। এখানে কচি শিশুদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। তাদের অপরাধ তাদের মায়ের উপর যখন পশুরা অত্যাচার করছিল তখন তারা কাঁদছিল। এখানে ১০০ বছরের উপর বয়স্ক অন্ধ একটি বৃদ্ধকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। গ্রামে আগুন দিলে মেয়েরা যখন প্রাণভয়ে মাঠে পালায় তখন সেখানেও তাদের ধরে শ্লীলতাহানি করে। বাপের সামনে মেয়েকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে নির্যাতন করেছে।
স্বাক্ষর
সরদার আবদুল মালেক
।। ৫২ ।।
মোঃ সাজ্জাদ হোসেন
নওগাঁ, রাজশাহী
“একদিন বিকেল বেলা আমি দৈনন্দিন কাজ সেরে বাসায় ফিরছিলাম। বাসায় ফিরে বিপুলসংখ্যক পাক সৈন্য ও বিহারীদেরকে দেখতে পাই। কয়েকজন বিহারী আমার বাসার গুরুত্তপূর্ণ মূল্যবান উপকরণগুলো খুলে নিচ্ছিল। আমি সরলভাবে প্রতিবাদ জানাই জনৈক পরিচিত বিহারীকে। উক্ত কুখ্যাত বিহারী আমার জীবনের ক্ষতির হুমকি প্রদান করে এবং ঘরের ভিতরে অবস্থানরত কুখ্যাত মেজর বাংলাদেশের পতাকা হাতে রাখে ও আমাকে অভিযুক্ত করে কারণ আমি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলাম বলে উক্ত মেজরের ধারণা ছিল। পরে বিহারী ও পাক সৈন্যরা আমার বাসা লুট করে অনেক মালামাল নিয়ে যায়। বলা প্রয়োজন ঐ দিনই আমাকে ধরে ইপিআর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আমার অফিসের একজন কর্মচারীর সুপারিশে সেবারের মত মুক্তি পাই। কিন্তু আমাকে কাজে যোগদান করতে বাধ্য করা হয়।
ঘটনা প্রবাহের অবনতির সাথে সাথে আমি জনগণের ভাগ্যের সাথে ভাগ্য মিলিয়ে আমার অফিসের কাজ করতে থাকি। কিছুদিন পর অত্র শহরের পাঞ্জাবী এসডিও দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত হন। উক্ত এসডিওর হত্যার পরে বিহারী ও পাক সৈন্যদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। পাক দস্যুরা বিহারীদের যোগসাজশে হত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। হঠাৎ জুলাই মাসের ১৫ তারিখে আমার বাড়ি ঘেরাও করে। ঘেরাও করার পরে কুখ্যাত মিলিটারী ও বিহারীরা তথাকথিত এসডিওর হত্যাকারী বলে বিবেচনা করে। এখানে প্রকাশ করা প্রয়োজন যে জনৈক বিহারী দৃঢতার সাথে বলে যে, উক্ত এসডিওকে দুটি ছোরা দিয়ে আমি নিহত করেছি এবং ছোরার সাথে তাজা রক্তের ছাপ ছিল। তার সাক্ষ্যে পরে আমার দুই হাত বেঁধে নিহত এসডিওর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে একজন কর্ণেল, একজন মেজর ও কিছুসংখ্যক সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিল। তারা আমাকে বেদম প্রহার করে। রাইফেলের বাঁট, কিল, ঘুষি, লাথি মারতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ প্রহার করার পর আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। পরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আমাকে নওগাঁর ইপিআর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে যাবার পরে আমি অনেক বিহারী ও মিলিটারীদের দেখতে পাই। পুনরায় পাক কুকুরেরা আমাকে প্রহার করতে থাকে। প্রহার করার পরে আমাকে ক্যাম্পের সংলগ্ন একটি ছোট প্রকোষ্ঠে রেখে দেয়। সেখানে ৪/৫ জন লোক থাকার মত জায়গা ছিল অথচ উক্ত প্রকোষ্ঠে প্রায় ২৪/২৫ জন বাঙ্গালী নিরীহ মানুষকে আটকিয়ে রেখেছিল। সেখানে আমি আটদিন অবস্থান করেছিলাম। আটদিনের প্রায় প্রতিদিনই বেদমভাবে প্রহার করতো। পাক বর্বররা পরিমিত খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় সরবরাহ করতো না। ২/৩ দিন পরে পরে কিছু কিছু করে খাবার দিতো কিন্তু তা খাবার অযোগ্য আহার্য ছিল।
বন্দীখানায় অবস্থান করার পর আমি প্রত্যেক দিনই ফুটো দিয়ে দেখতাম যে ২০/২৫ জন করে নিরীহ লোকজনকে মারধর করার পর হাত উল্টো করে বেঁধে ও চোখ বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে বুক চিরে রাস্তায় ফেলে রাখত। পরে মৃতদেহগুলিকে নিকটস্থ নদীতে নিক্ষেপ করত। উপরে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় আটদিনে তারা ২৫০ জন নিরীহ বাঙ্গালিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে বলে আমি অনুমান করি। একমাত্র আমিই অফিসের কতৃপক্ষের সুপারিশে মুক্তি পাই।“
স্বাক্ষর
মোঃ সাজ্জাদ হোসেন
এস, ডি, ও অফিস, নওগাঁ
।। ৫৩ ।।
জয় মণ্ডল
গ্রাম- চকরামপুর, নওগাঁ, রাজশাহী
“২৫শে মার্চের ঘটনাপ্রবাহ অত্র গ্রামের জনগণের জীবনে হতাশা নিয়ে এসেছিল। শান্তাহারে সাম্প্রদায়িক ঘটনার ফলে অত্র গ্রামটিকে পাক বর্বররা ক্ষতি করতে দ্বিধা করেনি।
৯ই বৈশাখ রোজ শুক্রবার শান্তাহার রোড হয়ে চকরামপুর গ্রামে পাক বর্বররা প্রবেশ করে। প্রবেশ করার আগে বিক্ষিপ্তভাবে চারিদিকে গোলাগুলি চালাতে থাকে। এতে জনগণের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। ফলে ধন, মাল রেখে পাইকারী হারে অত্র গ্রামের জনসাধারণ অন্যত্র পালাতে থাকে। অতঃপর পাক বর্বররা চকরামপুরের অধিকাংশ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ও লুটতরাজ চালায়। বলা প্রয়োজন, অত্র গ্রামের সংলগ্ন খৃস্টান মিশনের সাহেবের বাড়িতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। উক্ত ঘাঁটিতে পাক বর্বররা অন্য জায়গা হতে সুন্দরী মেয়েদেরকে ধরে এনে মিশনে সাহেবের বাসার উপর তলাতে আটকে রাখত। পাশবিক অত্যাচার ও ধর্ষণ করার পরে গলা কেটে হত্যা করেছে। হত্যার পরে তাঁদের রক্ত চৌবাচ্চার নল দিয়ে স্থানীয় তুলসী গঙ্গা নদীতে পড়তো। তা ছাড়া অত্র চকরামপুর গ্রামের প্রায় ৪০ জন লোককে গুলি করে হত্যা করেছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে গলা কেটে হত্যা করেছে এবং বহুসংখ্যক আহত অবস্থায় এখনো বেঁচে আছে। এক মাস অবস্থানকালে অত্র গ্রাম হতে পাক বর্বররা গরু, খাসি, হাঁস, মুরগী, যাবতীয় তরিতরকারী লুট করে খেয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে অত্র গ্রামের জনসাধারণ মুক্তিবাহিনীকে খাদ্যদ্রব্য ও সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।“
স্বাক্ষর/-
জয় মণ্ডল
গ্রাম- চকরামপুর
নওগাঁ, রাজশাহী
।। ৫৪ ।।
মোঃ মোসলেম উদ্দিন
গ্রাম- দিঘাপতিয়া, নতুনপাড়া, পোঃ দিঘাপতিয়া, নাটোর, জেলা- রাজশাহী
“আমি ছিলাম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহী। চার বৎসর আমি পশ্চিম পাকিস্তানে চাকুরী করেছি। পঁচিশে মার্চের কিছুদিন আগে আমি ভলান্টারী সার্ভিসে আমি চিটাগাংয়ে আসি। সেখান থেকে আমি ছুটিতে বাড়িতে আসি। তারপর বঙ্গবন্ধুর আহবানে চাকুরীতে চট্টগ্রামে যোগ দেই। ওখান থেকে ষোলশহর, কালিঘাট, ৭ নং জেটীতে পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বরদের সাথে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করি এবং তাদেরকে পর্যুদস্ত করি। পরবর্তীকালে সেখানের পতন ঘটলে এপ্রিল মাসের (৭১) ৫ তারিখে অনেক সঙ্গীসহ ওপার বাংলার আগরতলায় পৌছি। সেখান থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে কুমিল্লার ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ডিফেন্স দেই। তারপর পাক সৈন্যরা বিমান আক্রমণ চালালে সকলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। এপ্রিল মাসে ২২ তারিখে স্বগ্রাম দিঘাপাতিয়ায় পৌছি।
২৪শে এপ্রিল আমার বাড়িতে একদল পাক সৈন্য এসে ঘরের দরজা ভেঙ্গে আমাকে ধরে লাথি মারতে মারতে স্থানীয় কালীবাড়িতে নিয়ে যায়। বলা প্রয়োজন, এখানে অত্যাচারের কেন্দ্রভূমি ছিল। তারা সেখানে আমার হাত পা বেঁধে পা উপরের দিকে তুলে লটকিয়ে অত্যাচার করে। সে অত্যাচারের ভিতর ছিল বেত দিয়ে প্রহার, চাকু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান কাটা। শরীর কেটে তারা আনন্দ পেত। তারা জানতে চাচ্ছিল যে চট্টগ্রামে আমি কতজন পাঞ্জাবিকে হত্যা করেছি, কতটি রাইফেল কোথায়, কিভাবে লুকিয়ে রেখেছি, বাংলাদেশ সম্পর্কীয় কি কি তথ্য আমি জানি।
আমার কাছ থেকে কোন তথ্য উদঘাটন করতে ব্যর্থ হলে তারা আমাকে কালীবাড়ি থেকে নাটোরের ফুলবাগানে অপারেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে বৈদ্যুতিক শক আমার গলায় দেওয়া হয়। হাত-পা বেঁধে ডেকচির মধ্যে করে পানির হাউজে নিক্ষেপ করে। ১০-১২ মিনিট সেখানে রাখার পর অর্ধমৃত অবস্থায় সেখান থেকে তুলে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সেখানেও তারা ব্যর্থ হবার পর আমাকে বেয়োনেট চার্জ করতে নিয়ে যায়। এ সময় ছিল সন্ধ্যার কিছু আগে। তখন আমার হাত পিছনে বাঁধা ছিল। বলা প্রয়োজন, এর কিছু আগে আমার সাক্ষাতেই চারজন লোককে গুলি করে হত্যা করে। পরে আমাকে নিয়ে যায়। বেয়োনেটের সামনে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলাম কৌশলে হাতের বাঁধন খুলবার চেষ্টা করছিলাম। এক সময় আমি আমার হাতের বাঁধন তাদের অগোচরেই খুলতে সমর্থ হই। ফুলবাগানের মধ্যস্থ পুকুরের চারিদিকে মিলিটারীরা তখন সশস্ত্র পাহারায় ছিল। হাতের বাঁধন খুলেই ঘুরে সঙ্গীন উচানো সিপাইয়ের হাতের রাইফেল কেড়ে পুকুড়ে ফেলে দেই এবং বক্সিং মেরে তাকে ধরাশায়ী করি। তারপর পুকুরে ঝাপ দেই। ইতিমধ্যে অবশিষ্ট সৈন্যরা পুকুরের চারিদিকে সচেষ্ট হয়ে উঠে এবং আমাকে লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি চালানো শুরু করে। যখন পুকুরের পাড়ে উঠছিলাম ঠিক সে সময় একটি গুলি এসে আমার ডান কানে লাগে। সাথে সাথে আর একটি গুলিও আমার বাম বাহুর নিচে লাগে। এতে আমি অবশ্য খুব বেশি আহত হই না। তাদের সকলের সব রকমের অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে বর্বরদের ব্যূহ ভেদ করে পালিয়ে আখের জমির ভিতর দিয়ে ক্রলিং করে নাটোরে পৌঁছাই। শরীর থেকে তখন দরবিগলিত ধারায় রক্তপাত হচ্ছিল। উলঙ্গ অবস্থায় যখন নাটোরের সিনেমা হলের মোড়ে পৌঁছাই তখন একদল বিহারী আবার আমাকে ধরে ফেলে। সেখানেও তারা বেদম প্রহার করতে শুরু করে। পূর্বোক্ত বক্সিং প্রক্রিয়ার বদৌলতে তাদের হাত থেকেও রেহাই পাই। এবং শহরের মাঝখানে মামারবাড়িতে প্রথমে আশ্রয় নেই। কিছুক্ষণ পর আমার শ্বশুর ডাক্তার আঃ লতিফের কাছে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেই। সেখান থেকে ঐ রাতেই মেয়ের পোষাকে এক গ্রামে আশ্রয় নেই। তার ১০ দিন পর ভারতে আশ্রয় নেই। এবং সেখানে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেই।
ফুলবাগান থেকে উধাও হবার পর পাক পশুরা আমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং আমার বৃদ্ধ বাবা এবং মাকে মারধর করে এবং বলে যে তোমার ছেলেকে বের করে দাও, তাকে চাকুরী দেব এবং তোমার মেয়েকে আমার সাথে (জনৈক সুবেদার) বিয়ে দাও। পরবর্তী সময়ে তারা আমার বাড়ি লুটপাট করে।
আমার মতে, ফুলবাগানে ন’মাসে অন্ততঃ ১৫-১৬ হাজার লোককে পাক পশুরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ মোসলেম উদ্দিন
গ্রাম- দিঘাপতিয়া, নতুনপাড়া
পোঃ দিঘাপতিয়া, নাটোর
জেলা- রাজশাহী
।। ৫৫ ।।
ডি, এম, তালেবান নবী
প্রতিনিধি, ‘দৈনিক বাংলা’, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী
“৩রা আগস্ট রাত্রি প্রায় ১১ টায় পাঞ্জাবী পুলিশ, স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান, শান্তি কমটির সদস্য ও ভি ডি পার্টির সভাপতিসহ আমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং প্রবেশ করে আমাকে গ্রেফতার করে। অবশ্য গ্রেফতারের পূর্বে সমস্ত বাড়ি তছনছ করে। গ্রেফতার করে সামরিক ক্যাম্পে নিয়ে যায়। নিয়ে যাবার পর মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগকারী ওয়্যারলেস ও রিভলবার কোথায় রয়েছে তা জানাতে বলে। সদুত্তর না পেলে আমাকে পা ফাঁক করে বাঁশ দেয়। অতঃপর চাবুক দ্বারা বেদম প্রহার শুরু করে। প্রায় ঘন্টা তিনেক একের পর এক হাত বদল করে এমনি অত্যাচার চালায়। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। এরপর গভীর রাতে ঐ অবস্থাতেই উঠাবসা করতে নির্দেশ দেয়। হয়তো একশ বার ঐ প্রক্রিয়া চালাতে বললে ৪০ বার করার পর বলে যে পাঁচবার হয়েছে। কিছু সময় এ অবস্থা চালিয়ে অসমর্থ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে আমাকে লাথি মেরে উঁচু বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দেয়। সেখান থেকে আবার তুলে নিয়ে আসে এবং আবার উঠাবসা করায়। আবার পড়ে গেলে আবার লাথি মেরে ফেলে দেয় ও তুলে আনে। এমনি করে সকাল হয়ে গেলে ক্যাম্পের ভিতরে প্রধান রাস্তায় হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে। সেখান দিয়ে যে সমস্ত সামরিক লোক চলাচল করেছে তারা সকলে আমাকে যথেচ্ছভাবে লাথি মেরে পায়ের ঝাল মিটিয়ে নেয়। সারাদিন আমি ঐ অবস্থায় ছিলাম এবং খোলা জায়গায় রোদে সমানভাবে অত্যাচারিত হয়েছি। সন্ধ্যার দিকে ঐখানেই জিজ্ঞাসা করে যে তুমি মুসলমান না হিন্দু। মুসলমান বললে আমাকে কালেমা বলতে বলে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে কালেমা বলা থেকে বিরত থাকি। তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এখানের কলেজে কালেমা পড়া হয় কি না। উত্তরে না বললে আমাকে কাপড় খুলতে নির্দেশ দেয় এবং উলঙ্গ করে। উলঙ্গ অবস্থাতেই আমাকে ঘন্টা দুই রাখা হয়। অতঃপর পূর্ব পদ্ধতিতে আবার উঠাবসা করতে বলে। কিন্তু বসতে পারলেও কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না। কারণ খুব নিস্তেজ হয়ে গেছি। সে অবস্থাতেও আমাকে মারধর করা হয়। তারপর আমাকে টাঙ্গানোর নির্দেশ দেয়। তখন দু’পা উপরের দিকে বেঁধে টাঙ্গিয়ে দেয়। হাত যেন কোন বাঁধার সৃষ্টি না করে সে জন্য হাত দুটিও বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর একজন সিপাইকে ডেকে চাবুক মারতে নির্দেশ দেয় এবং সেরূপ চলতে থাকে। একজন ক্লান্ত হলে আর একজন চাবুক মারত। এমনি করে তিনজন চাবুক মারার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। অত্যাচারের এক পর্যায়ে পানি পান করতে করতে চাইলে মুখে সজোরে লাথি মারে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। রাতের কোন এক সময় জ্ঞান ফিরে পাই। পুনরায় পানি পান করতে চাইলে পাহারারত দুইজন সিপাহীর একজন প্যান্টের বোতাম খুলে এবং মুখে প্রস্রাব করে দেয়। প্রস্রাব করে দিয়ে সিপাইটি তার নিজের আসনে ফিরে যায়। পরের দিন সকাল পর্যন্ত ঐ টাঙ্গানো অবস্থাতেই থাকি। এর মধ্যে মাঝে মাঝে সামান্য জ্ঞান ফিরে আসে এবং পর মুহূর্তেই আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সকালের দিকে আমাকে নামানো হলে বলে যে তুমি লিখে দাও, রিভলবার ও ওয়্যারলেস কোথায় আছে, তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। নেতিবাচক উত্তর দিলে তারা আমাকে চড়-থাপ্পড় দেয়। তারপর আমাকে এক ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। সেদিন দিবাগত রাতে একজন মাস্টারসহ তিনজন মুক্তিফৌজকে ধরে নিয়ে আসে। রাতে তাদেরকে পিটানোর পরে তাদের কাছে স্বীকৃতি আদায় করার জন্য আমার ঘরে দেয়। রাত দুইটার দিকে জিজ্ঞাসা করলে তারা (মুক্তিযোদ্ধারা) স্বীকার করেনি বলে আমি জানাই। সারা রাত তারা আমার কাছেই থাকেন। পরের দিন রাত ১২টার দিকে সেলে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড় ও পায়ের জুতা খুলতে বলে এবং খুলে লুঙ্গি পড়া অবস্থায় বাইরে ক্যাম্পের পিছনে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরে বিকট আ…… চিৎকার ভেসে আসলো। এতে অনুমান করা গেল যে, বেয়োনেট অথবা ছোরা দিয়ে গুঁতিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে।
এভাবে পাঁচদিন প্রায় অভুক্ত অবস্থায় থাকার পর ৭ই আগস্ট দিবাগত রাত ৯টার সময় আমাকে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দেয়। শহরের বাইরে কোথাও যেতে পারব না এটাই ছিল তাদের প্রধান নির্দেশ।
২৩শে এপ্রিল {আগস্ট বা সেপ্টেম্বর হবে}শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে গোমস্তাপুরে পাক মিলিটারীরা অপারেশন করে। থানার পাশের বাজারপাড়া হিন্দু বস্তিতে গিয়ে ৩১ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে আসে। অতঃপর সমস্ত গ্রাম পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ধরে আনা লোকদের থানার পিছন দিকে মহানন্দা নদীর তীরে ১৫ জনের প্রথম দলকে দাঁড় করায় এবং গুলি করে হত্যা করে। অপর দলের ১৬ জনকেও ঐ একইভাবে হত্যা করে। হত্যা করার পর লাশগুলিকে পেট্রোল দিয়ে জ্বালাবার নির্দেশ দিলে মৃত ৩১ জনের মধ্য থেকে অমিল কর্মকার নামে এক ব্যক্তি পুড়িয়ে দেয়ার ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে হত্যা করে।
১৯শে অক্টোবর, রবিবার দিবাগত রাত্র প্রায় তিনটার দিকে পাঞ্জাব বাহিনীর দুটি ব্যাটেলিয়ান সীমান্তবর্তী গ্রাম বোয়ালিয়া ঘেরাও করে। মেজর ইউনুসের নেতৃত্বে ব্যাটেলিয়ান দুটি সকাল হওয়ার অল্প কিছু আগে মোহসীন মুন্সী আজান দেয়ার জন্য মিনারে উঠেছেন এবং আল্লাহু আকবর উচ্চারণ করেছেন ঠিক তখনই তাকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলি চালায়। সাথে সাথে গ্রামের উপর বৃষ্টির মত গুলিবর্ষিত হতে থাকে। এ গ্রামে তিন ঘন্টায় প্রায় ৬৫০ জনকে হত্যা করে। এদের মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ, যুবক ও নারীও ছিল। ১৬৮০টি বাড়ি সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে। এরপর বোয়ালিয়া গ্রামসংলগ্ন নরশিরা, শাহপুরা, পলাশবোনা, দরবারপুর, কালোপুর ও ঘাটনগর বঙ্গেশ্বর গ্রামেও হামলা চালায়। এখানেও ১২০০ লোককে হত্যা করে। এ সমস্ত গ্রামও পুড়িয়ে দেয়। পাক বাহিনী হামলার সময় অসংখ্য মহিলার উপর বলাৎকার ও লুটপাট করে।
পরবর্তীকালে নরপশুরা উপরোক্ত হত্যা চালায়। এরপরে বিধ্বস্ত এ গ্রামগুলি পাঞ্জাব বাহিনী ও তার তাবেদাররা সংলগ্ন থানার নিরীহ জনসাধারণকে ধরে নিয়ে এসে হত্যামঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে। দেশ স্বাধীন হবার পর দেখা যায় যে, সমস্ত গ্রামগুলিই বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি কুয়া নরকঙ্কালে ভর্তি। অপর দিকে গ্রামগুলিতে যে সমস্ত দেওয়াল ঘর ছিল, সেসব ঘরে জনসাধারণকে হত্যা করে দেওয়াল ভেঙ্গে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। এসব গ্রামগুলির এমন বাড়ি খুজে পাওয়া যাবে না কাউকে না কাউকে সে বাড়ি থেকে হত্যা করা হয়নি। এমনও অনেক বাড়ি রয়েছে, যে বাড়ির সকলকেই পাক জল্লাদরা হত্যা করে। এমনি একটি পরিবার সেকান্দার আলী। অপর একটি পরিবার সোলেমান মিয়ার যেখানে শুধুমাত্র ছোট ছেলে বেঁচে রয়েছে। মা-বাবা, ভাইবোন সকলকে হত্যা করা হয়েছে।
স্বাক্ষর/-
ডি, এম, তালেবান নবী
প্রতিনিধি, ‘দৈনিক বাংলা’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী
।। ৫৬ ।।
মোহাম্মদ মোছাওয়ার হোসেন
গ্রাম- মাইজপাড়া, ডাকঘর- রাজারামপুর
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী
“৭১ এর ৪ঠা আগস্টের রাত সাড়ে তিনটার সময় আকস্মাৎ শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নির্দেশে প্রায় ৫০ জন শান্তি কমিটির সদস্যসহ পুলিশ আমার বাড়ি ঘেরাও করে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেও তাদের হাত থেকে রেহাই পেলাম না। ধৃত হওয়ার পরে আমাকে কঠোর পাহারার মাধ্যমে পথে নিয়ে এসেছে এবং থানাতে সোপর্দ করে। সেখানে আমি প্রায় ১৫ জন বন্দীকে দেখতে পাই। অবশ্য তারা অনেক আগেই ধৃত হয়েছিলেন।
পরের দিন দিবাগত রাত ৭টায় উপরোক্ত ১৫ জনকে থানায় হাজির করে এবং পাঁচজন করে করে এক একটি ব্যাচ তৈরি করে। পাঁচজনকে একটি ম্যাপ তৈরির ব্যাপারে অভিযুক্ত করে আলাদা করে রাখে এবং একমাত্র আমাকে অবাঙ্গালী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে এবং যাদের কে হত্যা করা হয়েছে তাদের নামের তালিকা চায়। পাঁচজনের ভিতর যে দুজন বেশি দোষী বলে বিবেচনা করেন তাদেরকে থানার মধ্যেই মেজর শেরওয়ানীর নির্দেশে নির্মমভবে রোলার দ্বারা, বুকে লাথি মেরে প্রহার শুরু করে। ঐ সময় শেরওয়ানীর নির্দেশে অপর একজন সিপাহী আমাকে প্রহার করে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি অজ্ঞান হয়ে না যাই ততক্ষণ পর্যন্ত উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় অত্যাচার চালাতে থাকে। জ্ঞান হবার পর পুনরায় হাজতে নিয়ে যায়। তার পরের দিন ম্যাপ তৈরির অভিযোগে গালাগাল করে। পরের দিন সন্ধ্যায় মেজর শেরওয়ানী ১৫ জনকে জেলখানা থেকে বের করে আনার হুকুম করে। আমার তন্দ্রার ভাব হওয়াতে আমি বের হতে পারলাম না। আমি উদ্বেগের ভিতর সময় কাটাতে থাকি। প্রকাশ থাকে যে, উল্লেখিত ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে মহানন্দার নদীতে ফেলে দেয়। তারা জলে ভাসতে থাকে।
পরের দিন আমি যেখানে ছিলাম সেখানে প্রায় ১০-১২ জন আসামী এলো। তাদের কাছ থেকে বিবৃতি ও জিজ্ঞাসাবাদের পর কয়েক দিনের ভিতরেই অন্যান্য সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। এর পরবর্তী ব্যাচে জেলখানাতে উকিল, মোক্তার ও শিক্ষিত ছাত্রসহ প্রায় ৭ জন এলো, তারপর উক্ত ৭ জনসহ আমাকে আঘাত হানতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে বিবৃতি নিয়ে তাদের সবাইকে তাদের সবাইকে রাজশাহী জেলে চালান করা হচ্ছে বলা হয়। অবশ্য এটা ছিল নিছক ভাঁওতা। নবাবগঞ্জ নিউমার্কেটের একটি আলো-বাতাসহীন প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে রাখল। সেখানে আবদ্ধ করার পর রাত ৯টার সময় সবাইকে বাইরে নিয়ে এসে জিপে তুলে অন্যত্র নিয়ে যেতে চায় এবং কঠিনভাবে হাত বন্ধন করে। জিপে তুলে রাস্তায় নিয়ে যাবার পথে জিপ থেকে ১২ জনকে নামিয়ে রাখে এবং বেদম প্রহার করতে থাকে। পরে সারারাত ধরে নিউমার্কেটের উল্লিখিত প্রকোষ্ঠে বন্দী করে রাখে। তার আগে জিপের অন্যদেরকে মেজর শেরওয়ানী গুলি করতে নির্দেশ দেয়। তাদেরকে রেহাই ঘরের শ্মশান ঘাটে মেরে ফেলে। পরের দিন সকালে উক্ত নিউমার্কেটের আসামীগুলিকে জেলখানায় নিয়ে আসে। দুইদিন পরে মেজর শেরওয়ানী নিজেই জেলখানায় গিয়ে আমার কাছে অঙ্গীকারপত্র লিখে নিয়ে মুক্তি দেয়। ইতিপূর্বে আমার পিতার নিকট থেকেও অনুরূপ অঙ্গীকারপত্র লিখে নেয়া হয়েছিল।
স্বাক্ষর/-
মোহাম্মদ মোছাওয়ার হোসেন
।। ৫৭।।
মোঃ আল এমরান
গ্রাম- আজাইরপুর, পোঃ- রাজারামপুর
নবাবগঞ্জ, রাজশাহী
“১৯৭১ এর জুন মাসের ১৬ তারিখে রাত দুটোর সময় আমার বাড়ি ৫০-৬০ জন পাক দস্যু ঘেরাও করে। ঘেরাও করার পর বাড়ির অভ্যন্তরে প্রায় ৪০ জন পাক দস্যু ঢুকে পড়েছিল। বাড়ির সমস্ত ঘর তল্লাশী চালিয়ে আমাকে ধরে ফেলে। ধরে দু’হাত পিছনে বেঁধে নিয়ে যায়। জেলখানায় আমি ধৃত ৩০ জনকে দেখতে পাই। সেখানে দিনভর রাখার পর থানাতে নিয়ে যায়। সেখানে কুখ্যাত মেজর শেরওয়ানী আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বলা প্রয়োজন, সেখানে আরও অনেক মিলিটারী উপস্থিত ছিল। জিজ্ঞাসাবাদ করার পর মোটা বেতের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে। অনেকের হাত-পা ভেঙ্গে চুরমার হয়েছিল।
আমার পা হতে রক্ত ঝরছিল। পুনরায় সবাইকে জেলখানায় নিয়ে এলো। নিয়ে আসার পর রাত ১২টার পরে গুজর ঘাটের শ্মশানপুরীতে নিয়ে যায়। নিয়ে সবাইকে লাইন ধরার নির্দেশ দিল। লাইনের ভিতর থেকে ১২ জনকে বেছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। বাকি লোকগুলিকে পুনরায় জেলখানায় নিয়ে সকালের দিকে মেজর শেরওয়ানী জেলখানায় আসে। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে বেদম মারধর আরম্ভ করে জেলে যত লোক ধৃত হয়েছিল সবাইকে। শ্মশানঘাটে সন্ধ্যার সময় গুলি করার জন্য ৭ জনকে নিয়ে যায়। বধ্যভুমিতে ৭ জনকেই গুলি করে হত্যা করে। রাত ১১টার সময় উক্ত জেলখানায় দু’জন যুবতীকে ধরে নিয়ে আনে। রাত অনুমান ৪টার সময় সে কক্ষের যুবতীদের করুণ কান্নার সুর শোনা যায়; অনুমিত হয় যে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছিল।
সকাল ৮টার সময় জেলখানা থেকে কয়েকজন বর্বর সৈন্য বেরিয়ে যাবার ঘন্টাখানেক পরে মেজরসহ কয়েকজন মিলিটারী যুবতীদ্ধয়কে নিয়ে বাইরে চলে যায়। শেষ পরিণতি জানা যায়নি। সন্ধ্যা ৭টার সময় বাকি সমস্ত বন্দী লোকজনকে শ্মশানঘাটে গুলি করার জন্য নিয়ে যায়। নিয়ে যাবার পর দু’জন করে লাইন করিয়ে গুলি করতে থাকে। আমাকেসহ অন্য তিনজনকে গুলি করার পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। তখন চারজনকে এক সাথে গুলি করার জন্য দাঁড় করালো। সেই মুহুর্তে একখানা সামরিক গাড়ি এসে শ্মশানঘাটে উপস্থিত হলো। গাড়ির কাছে অন্যান্য মিলিটারী যারা গুলি করছিল, তাদের হাজির হওয়ার নির্দেশ দিল। সেখানে কানা-ঘুষা হল। গুলি করা থেকে সাময়িক বিরতি নিল। পরের দিন আনুমানিক ১০টার সময় তিনজনকে ছেড়ে দেয়। আমি তাদের একজন। তিন দিনে প্রায় ৪০-৫০ জনকে গুলি করে পাক বর্বর বাহিনী হত্যা করেছিল।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আল এমরান
।। ৫৮।।
এলাহী বক্স
ফিরোজা হাউস
শিব্বাটা, বগুড়া
এপ্রিলে পাক বাহিনী রংপুর, শান্তাহার, শেরপুর – এই তিন দিন থেকে বগুড়া শহর আক্রমণ করে। তা ছাড়া বিমান থেকেও পাক বাহিনী বগুড়া শহরের উপর আক্রমণ করে। ঐ সময় শহরের লোকজন জীবনের ভয়ে কোন দিকে দৌড়াতে না পেরে পুর্বদিকে মুক্ত দেখে নদী সাঁতরিয়ে চেলোপাড়ার দিক রওয়ানা হয়। পাক বাহিনী আক্রমণ করার সাথে সাথে সমস্ত শহর ঘেরাও করে ফেলে। কাজেই জনসাধারণ পালানোর সুযোগ পায় না। পাক বাহিনীর গুলির মুখে অসংখ্য লোকজন প্রাণ হারায়। আমি নিজের বাড়ী ছেড়ে চেলোপাড়ার দিকে রওয়ানা হই। চেলোপাড়ায় যাবার সময় আমি যে দৃশ্য দেখেছি ইতিহাসে তার নজির বিরল। চার থেকে পাঁচ শতের মত লোক মৃত অবস্থায় রক্তের মধ্যে ডুবে আছে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় তাদের মৃতদেহ পড়ে আছে। আর কুকুরেরা তাদের রক্ত পান করছে। পালিয়ে যাবার কোন উপায় ছিল না আমার। আমার মাথায় একটি টুপি ও হাতে একটি পাকিস্তানী পতাকা ছিল। আরও একজন মৌলভী এবং দুইজন লোক আমার সঙ্গে ছিল। তাদেরও মাথায় টুপি এবং হাতে পাকিস্তানী পতাকা ছিল। হঠাৎ করে একদল পাকসেনা আমাদের দেখে ঘিরে ফেলে। পাক বর্বর বাহিনী জিজ্ঞাসা করে তোমার কে? অবশ্য উর্দূতে।
জবাবে আমি বলি যে আমরা পাকিস্তানী বাঙ্গালী মুসলমান। তখন পাকসেনা কিছু সময় পর আমাদেরকে ছেড়ে দেয় এবং বলে যে তোমরা আগামিকাল সকাল ৮ টার পর আমাদের সঙ্গে দেখা করবে। কারন সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ভোর আটটা পর্যন্ত কার্ফিউ থাকবে। পাকবাহিনীর কার্ফিউ দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সকাল ৮ টার পর জনসাধারণকে একত্রে একযোগে হত্যা করে। আমি সেটা বুঝতে না পেরে পরের দিন আবার বাসাবাড়ী দেখার জন্য শহরের দিকে রওয়ানা হই। আসার সময় অন্য তিনজন লোক আমার সাথে ছিল। ঐ সময় কয়েকজন পাঞ্জাবী আমাদের ধরে ফেলে। ধরার পরপরই একত্রে লাইন করে রাইফেল দিয়ে গুলি করে। গুলি করার সাথে সাথে দুজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। অপর একজন বাম হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় গর্তের ভিতরে পড়ে যায়। একজন পাঞ্জাবী এসে বেয়োনেট দিয়ে তার বুকটা চিরে দেয়। আমি সৌভাগ্যবশত গুলি না খেয়ে রক্তের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। একজন পাঞ্জাবী আমাকে পুনরায় দাঁড় করে পরপর দুই বার গুলি করে। প্রথম গুলিটি ফায়ার না হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার গুলি করে। ভাগ্যবশত গুলিটি আমার বাম পার্শ্বে দিয়ে চলে যায়। পাকসেনা কি যেন মনে করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে যে তোর হেঁয়াছে ভাগ যাও বাঙ্গালী। তখন আমি নিজের বাসার দিকে রওয়ানা হই। বাসায় আসার সময় আমি দেখতে পাই শুধু মানুষের মৃতদেহ। শহরের সমস্ত রাস্তা যেন রক্তে লাল হয়ে আছে। কুকুর তাদের মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করছে। আমি দেখতে পেলাম যে প্রথম দিনে খান দস্যুরা যে সমস্ত লোকজন হত্যা করেছিল সেগুলোকে শহরের রাস্তার পার্শ্বে গর্ত করে ৭-৮ জন করে পুঁতে রেখেছে। তাঁদের কারো হাত বা মাথা দেখা যাচ্ছে। কুকুরেরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাচ্ছে এই বীভৎস ও করুণ দৃশ্য দেখে চোখের পানি মুছতে আমার শিব্বাটী বাসভবনে উপস্থিত হই। বাসায় গিয়ে দেখতে পেলাম যে, একজন মেজর ও তিনজন বেলুচী সৈন্য আমার নিজস্ব ক্যাম্প খাটটি পেতে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে তারা রাইফেল নিয়ে দাঁড়ায়। আমি বকি যে, আমি পাকিস্তানী বাঙ্গালী মুসলমান। এটা আমার বাসা এবং বাসাবাড়ী দেখতেই আমি এসেছি। তখন তারা আমাকে বলে যে এটা তোমার বাসা? তোমার খুব সাহস? এই বলে আমাকে বসতে বলে এবং মাংস ও রুটি খেতে দেয়। তা ছাড়া আমাকে বলে যে তোমার কোন ভয় নাই। রাত্রিতে তুমি তোমার ঘরে শুয়ে থাকবে। আমি কোন রকমে প্রথম রাত্রি অতিবাহিত করি। এখানে উল্লেখ করা হয় যে, পাক সেনা শহরে ঢুকেই অবাঙ্গালীদেরকে ৭২ ঘন্টা সময় দিয়েছিল; বাঙ্গালীদের ধন- দৌলত লুট করার জন্য। পরের দিন সকালে খান সেনারা আমাকে সংগে করে শহরে চলে আসে। খানসেনারা আমাকে লুট করার কথা বলে। তখন আমি বলি যে, আমি লুট করব না বা আমার কোন প্রয়োজন নাই। এইভাবে তিনদিন কেটে গেল। খান সেনার চার জনের মধ্যে একজন ছিল মেজর জাকি। ৪র্থ দিনে তারা আমার বাসা ছেড়ে দিয়ে রংপুর চলে যায়। পুনরায় মেজর শাকিরিয়া আমার বাসায় চলে আসে। এসে আমাকে বকে যে, তুমি এখান থেকে চলে যাও। এই বলে আমাকে সাথে করে সার্কিট হাউসে নিয়ে আসে। সেখানে গিয়ে আমি দেখতে পেলাম, রাজশাহী ভার্সিটি থেকে ধরে আনা কয়েকজন ছাত্রী। তারা বসে বসে কাঁদছে। পাক হায়েনারা তাদের উপর অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার করে । তাদের সারা দেহে ধর্ষনের চিহ্ন বিদ্যমান। ঐ দৃশ্য দেখে আমি মর্মাহত ও অভিভূত হয়ে পড়ি। দুই ঘন্টা পর মেজর শাকিরি আমার নিজের বাসায় ফিরে যাবার অনুমতি দেয়। কোন রকমে আমি নিজের বাসায় ফিরে আসি। এরপরেও মাঝে মাঝে খান সেনারা আমার বাসায় এসে তদন্ত চালায় এবং বলে যে তুমি মুক্তিফৌজকা লিডার বা মুক্তিদের সর্বরকমের সাহায্য কর। আমি সম্পূর্ন অস্বীকার করলে আমাকে দারুণ নির্যাতন ও প্রহার করে । দিনে-রাতে সব সময় আমার বাসায় এসে খান দস্যুরা অমানুষিক অত্যাচার করত। আমার দুই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল বলে খান সেনারা সব সময় দুই ছেলেকে খুঁজে বেড়াত । এরপর আমার বাসায় একটানা এপ্রিলের ২০ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত অতিবাহিত করি। ১৪ ই সেপ্টেম্বর তারিখে নিজ ছেলে-মেয়ে এবং পরিবার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসি। এরপর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তায় বগুড়া শহর মুক্ত হয়ে যায়। বগুড়া শহর ও বাংলাদেশের জয়ের পতাকা উত্তোলিত হয়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ এলাহী বক্স
।। ৫৯।।
শ্যামল রায়
মালতী নগর, থানা- সদর
জেলা-বগুড়া
প্রবল গুলি ও গোলাবর্ষনের ভেতর দিয়ে বর্বর পাক বাহিনী ট্যাঙ্ক সহকারে বগুড়ায় প্রবেশ করে। শুরু হলো নরপিশাচদের ‘বাঙালী চোষা’ বিহারী বেঈমান সহযোগে শহরের বুকে তান্ডব নৃত্য। লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, খুন, তৎসহ ধর্মীয় স্থান কলুষিত ও বিধ্বস্ত করায় মত্ত হয় তারা।
২৫ শে এপ্রিল রবিবার হঠাৎ করেই গ্রামের বাসা হতে গুলি ও ব্রাশফায়ারের শব্দ শুনে বুঝতে দেরী হয়েছিলো না যে, পাকবাহিনী বগুড়া হতে বড় রাস্তা ধরে এদিকে এগিয়ে আসছে (সিরাজগঞ্জ ও উল্লাপাড়ার দিকে)। কিছুক্ষন পর দক্ষিন-পূর্ব কোণ হতে কালো ধোয়ার কুন্ডলী আকাশে উথিত হতে দেখা গেল। অনেকে বললেন কুমারেরা হাঁড়ি পোড়াচ্ছে। কিন্তু সব ধারনার অবসান হল তখনই, যখন শুধু এক জায়গাতে নয়, সমস্ত পশ্চিম দিক হতে ধোঁয়া আর আগুনের লাল আভা দেখা যেতে লাগল। যতই আধাঁর নামছিল আগুনের লেলিহান শিখা ততই প্রকট হয়ে ফুটে উঠছিল চোখের সামনে। আগুনের সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল উল্লাপাড়ার দিক হতে।
পরের দিন শুনলাম চাঁদাইকোনার প্রত্যক্ষদর্শীর এক বিবরণ। তারা লোকজন ডেকে এনে লুট করিয়েছে বাজার এলাকা। অনেক স্বেচ্ছায় এসেছে লুট করার লোভে। লুট করার সময় তারা ছবি তুলেছে। লুটপাট হয়ে গেলে আগুন ধরানোর পালা। আগুনও দিয়েছে লোকজনের সহায়তায়। আগুন ধরানোর সময় তারা ছবি তুলেছে। আর সব কাজ হাসিল করার পর বিক্ষিপ্তভাবে গুলিবর্ষণ করে জনসাধারণকে করা হয়েছে হত্যা। এরকম আরও ঘটনা। খাওয়ানোর নাম করে ডেকে এনে লাইন করে গরীব গ্রামবাসী নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
পরের দিন শুরু হলো সিরাজগঞ্জে ঐ একই দৃশ্যের অবতারণা। ৩-৪ দিন ধরে চলে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, খুন ইত্যাদি। বাসার এত কাছে ঐ সব হচ্ছিল যে, ছাই এসে পড়ছিল বাসার মধ্যে। গ্রামের ও আশেপাশের অনেক লোক শহরে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। এর সংগে সংগে গ্রামে গ্রামে ডাকাতি, লুটতরাজ, রাহাজানি প্রকটভাবে দেখা দেয়। দিনে মিলিটারীর ভয়, রাত্রে ডাকাতের ভয় সবসময় তটস্থ থাকতে হয়েছে। দিনে গ্রামছাড়া আর রাত্রে পাটের ক্ষেত – এভাবে প্রতিটি ক্ষণ কেটেছে। দৌড়ানোর জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়েছে।
একদিন শুনলাম মিলিটারী আসছে। তবুও থাকলাম বাসায়। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, কাছের এক হাট হতে আগুন আর ধোয়া। অনেকে পালিয়ে যেতে লাগল।গ্রামের কিছু দূর দিয়ে উঁচু মাটির রাস্তা। দাঁড়িয়ে ছিলাম মিলিটারীদেরকে দেখবার জন্য। দেখলামও, আমার কাছে ছোট একটা দূরবীন ছিল। তাই স্পষ্ট দেখলাম, একে একে ৭৯ জন সৈন্য পার হয়ে গেল। আমের সময় গাছে কাঁচা আম ছিল। তাই তারা খেতে খেতে চলছে। কি তাদের উল্লাস, এতটুকু অনুশোচনা নেই মনে তাদের এই ধ্বংসলীলার জন্য।
অবশেষে নানান কারনে সে গ্রাম আমাদের ছাড়তে হলো ২৬ শে মে বুধবার। নৌকায় চললাম উল্লাপাড়ার অভিমুখে। দুপুর ২ টার দিকে বুধগাছা নামক গ্রামে আশ্রয় নিলাম। যে বাড়ীতে ছিলাম সে বাড়ীর এক ছেলে সৈন্য বিভাগে কাজ করত। শুনলাম সে ছুটি নিয়ে এসেছিল। মার্চের পর পাক বাহিনীর পক্ষ হতে কাজে যোগ দেবার জন্য আবেদন আসে। কিন্তু বর্বর বাহিনীর সঙ্গে সে যোগ দেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাকে বাংলা মাকে উদ্ধার করার জন্য সে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে নি। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সে যোগ দিয়েছিল।
ঐ বাড়ির ধারেই রাস্তা (বগুড়া- উল্লাপাড়া) । সাহস করে বসলাম এক গাছের ধারে। কিছুক্ষনের মধ্যে মোটরের শব্দ পেলাম। বুঝতে দেরী হলো না মিলিটারীদের গাড়ী আসছে। দেখলাম এক এক করে নয়খানা গাড়ী পার হয়ে গেল। কোন গাড়ীতে শুধু দু-একটা পেট্রোলের ড্রাম। আবার কোন গাড়ীতে মিলিটারী ও গোলাগুলির বাক্স। হাটের দিন দু’একজন করে পাকা আম,কলা এসব নিয়ে যেত হাটে। ওরা জোর করে কেড়ে নিত, আম কলা ইত্যাদি, পয়সা চাইলে মারার ভয় দেখাত।
পরের দিন ২৭ শে মে দুপুরের পর আর এক গ্রামে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম, যুবক ছেলেদের জোর করে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। ভয় পেলাম শুনে। এ গ্রামে আসার পথে কিছুক্ষণ বড় রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটলাম খুব ভোরের দিকে। দেখলাম জ্বালিয়ে দেওয়া বহু বাড়ি। রাস্তা থেকে নেমে আধ মাইলের মত হেঁটে এসে বর্বরেরা পুড়িয়ে দিয়েছে বহু গ্রাম। রাস্তায় শুনলাম বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়ার কাহিনী। প্রথমে তারা নাকি কি একটা তরল পদার্থ ‘স্প্রে’ করত। তারপর একটা সাদা কাঠির মত জিনিসে আগুন ধরিয়ে ফিকে মারত ঘরের মধ্যে। আগুন ধরে যেত সমস্ত ঘরে। খেয়াল-খুশী মত দু-একটা বাড়ীও তারা বাদ দিয়েছে। মনে হয় খেলেছে তারা, আগুন আগুন খেলা।
যে গ্রামে আমরা থাকতাম, তার আশপাশের গ্রাম হতে ছেলেদেরকে ধরে নিয়ে গেছে। ধরে নিয়ে গিয়ে উল্লাপাড়া বাজারে খালের মধ্যে বুকজলে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদেরকে। ট্রেনে করে যাতে মিলিটারীরা না আসতে পারে সে জন্য গ্রামের লোকজন লাইন তুলে ফেলেছে। ফলে তাদেরকে হারাতে হয়েছে ঘরবাড়ী।
মুক্তিবাহিনীর লোকেরা মাঝে মধ্যেই রেল লাইন, ব্রীজ উড়িয়ে দিত। একদিন মোহনপুরের কাছে এক গ্রামে, রাত্রিবেলা দু’জন দালালকে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা মেরে ফেলে। পরের দিন পাক সৈন্যরা সে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়।
২৬ শে জুন শনিবার আমি ও একজন লোক বগুড়া বাড়ী দেখবার জন্য রওনা হই। একটা বাস রাজশাহীর ও একটা বাস বগুড়ার ছিল। বাসে একটা পাঠান ব্যক্তি বাসের সমস্ত পয়সা নিত। কণ্ডাক্টরের হাতে লাগান ছিল শান্তি কমিটির লাল ব্যাজ। পথে মিলিটারীর যাতায়াত চোখে পড়ল।
১-৪৫ মিঃ বগুড়ার পুলিশ লাইনে গাড়ী সার্চ করবার জন্য থামান হয়। অনেকের সঙ্গে আমাকেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কি করি, কোথায় থাকি ইত্যাদি। দেখলাম, পুলিশেরা রাইফেলের বাঁট (দুইজন) উপর দিকে ও নল নিচের দিকে দিয়ে পাহারা দিচ্ছে। ‘বগুড়া কারিগরি মহাবিদ্যালয়কে তারা ঘাঁটি বানিয়েছিল। শহরে ১৮% জন জনসাধারণ তখন এসেছে। দোকানপাট বন্ধ। রাস্তার দু পাশের দোকান, বাড়ীঘর পোড়ানো। যারা বাইরে থেকে শহরে আসে, তখনই কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে তারা চলে যায়। বগুড়া জেলা স্কুল ও হয়েছিল তাদের ঘাঁটি। ঐ স্কুলের হোষ্টেলে বারান্দায় ব্যাটারী চার্জ দেওয়া হতো। ষ্টেশনে কোন বাঙ্গালীকে যেতে দেওয়া হতো না।
বগুড়া পিটি স্কুলের কাছে নামলাম ২-১০ মিঃ। নেমে হেঁটে বাড়ীর দিকে আসছি। বাড়ীঘড় পোড়া। রাস্তা জনমানবশূন্য। প্রায় ১ মাইল রাস্তার মধ্যে মাত্র ৪ জন লোকের সঙ্গে দেখা হয়। রাস্তা চলতে ভয় ভয় হচ্ছিল। যেখানে একদিন ছিল উৎফুল্ল প্রানের স্পন্দন, আজ সেখানে শুধু পোড়া মাটির স্তূপ। দেখে কান্না এসে যাচ্ছিল। বাড়ীর কাছে আসলাম, একই অবস্থা আমাদের বাড়ীর ও তবে সম্পূর্ণ নয়। কেননা জামায়াতে ইসলামীর এক লোক বেদখল করার জন্য বর্বরদের কাছে অনুরোধ জানালে তারা সম্পূর্ন বাড়ী ধ্বংস করেনি। প্রতিটি মন্দির ধর্মীয় স্থান তারা হয় ধ্বংস, না হয় ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমি একটুর জন্য প্রাণে রক্ষা পাই বিহারীদের হাত হতে, এক মুসলমান ভাইয়ের সহায়তায়। প্রাণ নিয়ে ফিরি ঐ গ্রামে।
কিছুদিন পর দালালদের ভয়ে ও নানান কারনে কোন গ্রামেই থাকা সম্ভপর না হওয়ার জন্য ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ভারত অভিমুখে নৌকায় রওয়ানা হই। মাঝে মধ্যেই সিরাজগঞ্জ, পাবনার দিক হতে গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসত।
৩রা সেপ্টেম্বর নৌকা থেকে দেখলাম কাজীপুর এলাকার অগ্নিসংযোগের দৃশ্য। ৪ দিন পর মানকর চরে (আসাম) পৌঁছাই যমুনা পথে।
স্বাক্ষর/-
শ্যামল রায়
১৬.৯.৭৩
।। ৬০।।
বাদশা মিয়া
মালতী নগর
সদর থানা, বগুড়া
পাক বাহিনী চারদিক থেকে অসংখ্য গোলাগুলি বর্ষণ করতে শহরের মধ্যে প্রবেশ করে। শহরের মধ্যে প্রবেশ করেই অগণিত লোকজন হত্যা করে। অসংখ্য দোকান পাট লুট করে। বগুড়া শহরের মালতীনগর ও চক লোকমান গ্রামে অসংখ্য বাড়ীঘরে অগ্নি সংযোগ করে ভস্মীভূত করে দেয়। আমি আড়াল থেকে সবকিছু স্বচক্ষে দেখেছি। কার্ফিউ উঠিয়ে দেবার পর জনসাধারণ যখন শহরের মধ্যে এসেছিল পাক সেনারা সেই সময় মেশিনগানের গুলিতে ৩/৪ শত লোক হত্যা করে। আমিও শহরে এসেছিলাম ঐ দৃশ্য দেখে অতিভূত হয়ে পড়ি। কোন রকমে জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই।
১৯৭১ সালের ৩১ শে অক্টোবর রোজ রবিবার বেলা ১১ টার সময় ১৩ জন খান সেনা ও ৫ জন রাজাকার এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ধরার সময় আমার বাড়ী থেকে হাতঘড়ি ও আমার স্ত্রীর ঝুমকা ও গলার মালা রাজাকারেরা লুট করে নিয়ে যায়। ইহাতে অনুমান করি যে, খান সেনারা আমার তিন হাজার টাকার মত সোনার গহনা ও কাঁসার থালাবাটি লুট করে নিয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে পাক সেনা শহরে প্রবেশ করেই অবাঙ্গালীদের ৭২ ঘন্টা সময় দিয়েছিল। বাঙ্গালীদের ধন সম্পদ লুটতরাজ করার জন্য। প্রথমে আমাকে স্থানীয় সার্কিট হাউজে নিয়ে আসে। খান সেনার বিগ্রেডিয়ার আমাকে উর্দুতে জিজ্ঞাসা করে যে, ব্যাঙ্ক লুট করেছে কারা, মুক্তি ফৌজ কোথায়, আওয়ামী লীগের লিডার কে কে ইত্যাদি বিষয়। আমি খুব ভালো উর্দু জানতাম। তাছাড়া আমাকে দেখতে অবাঙালীর মত দেখায়। তাই উর্দুতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করি। তখন বিগ্রেডিয়ার সার্কিট হাউজ থেকে আমাকে জেল খানায় পাঠায়। জেল খানায় আমি অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করি। সিগারেটের আগুন, লোহার রড, রাইফেলের বাঁট, বুট জুতার লাত্থি ইত্যাদির সাহায্যে খান পিচাশেরা নির্মম নির্যাতন চালায় আমার দেহের উপর। জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনের চিহ্ন এখনও শরীরে বিদ্যমান। এইভাবে আমি ১৩ দিন জেল খানায় বন্দী ছিলাম। অনুমিত হয় যে, এক মাত্র ভাল উর্দু জানায় এবং দৃঢ় মনোবলের জন্য খান সেনারা আমাকে হত্যা করেনি।
স্বাক্ষর/-
মোঃ বাদশা মিয়া
।। ৬১।।
আব্দুস সামাদ
চক সুত্রাপুর, বগুড়া
১৯৭১- এর আগষ্ট মাসের ২২ তারিখ। আমার জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই দিন আমি যখন শহরে আমার নিজের কাপড়ের দোকান থেকে ফিরছিলাম তখন ষ্টেশনের সন্নিকটে তিন চারজন খান সেনা ঘিরে ফেলে। এসময় আমাকে হিন্দু না মুসলমান জানতে চায়। আমি মুসলমান বললে আমাকে বলে যে তুমি মুক্তিফৌজ। আমি তা অস্বীকার করলে আমার গালে প্রথমবারের মত থাপ্পড় মারে। অতঃপর আমাকে গ্রেফতার করে জন্য জনৈক সৈন্য নির্দেশ দেয়। তার পর আমাকে ডানা ধরে নিয়ে যেতে থাকে। কিছুদুর নেবার পর আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলে। আমি তাদের নির্দেশ পালন করার পর জিজ্ঞাসা শুরু করে তুমি তো মুক্তিফৌজ এবং ধরা যখন পড়েছ তখন স্বীকার কর তোমার আর দলবল কোথায় আছে। তোমার অস্ত্রশস্ত্রই বা কোথায় আছে।
স্বাভাবিকভাবে আমি অস্বীকার করি। তখন আমাকে চড় থাপ্পড় লাথি মারতে থাকে। এর সাথে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। কিছুক্ষন এমনিভাবে মারার পর কয়েক মুহূর্ত মারের বিরতি ঘটায়। এ সময় আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে এবং স্বীকার না করলে আমাকে হত্যা করে ফেলা হবে বলে হুমকি দেখায়। যেহেতু আমি কিছুই জানি না, সমস্তই অস্বীকার করি।
অতঃপর আমাকে অনুরুপভাবে আবার মারধোর শুরু করে। এবার রাইফেলের গাদ দিয়েও মারতে থাকে। মারের চোটে অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। নাকমুখ দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মাটিতেও পড়ে যাই। এ সময় আমার পকেট থেকে টাকা মাটিতে পড়ে যায়। তখন আমার কাছে ৫৬৫ টাকা ছিল। উক্ত টাকা গুলো তারা তুলে নেয় এবং আমার পকেট হাতিয়ে যে টাকা পয়সা ছিল তা নিয়ে নেয়। টাকা তাদের হস্তগত হবার পর তারা নিজেদের মধ্যে কি সব আলোচনা করলো। শেষে আমাকে যেতে বলে মিলিটারীরা হাসিমুখে অন্য দিকে চলে যায়।
স্বাক্ষর/-
আব্দুস সামাদ
।। ৬২।।
আমির আলী খান
গ্রাম- তেঘর, থানা- জয়পুরহাট
জেলা- বগুড়া
তখন ৫ই এপ্রিল কিংবা ১০ ই এপ্রিল হবে। চারিদিকে খান সেনারা টহল দিয়ে ঘুরে ফিরছিল আওয়ামী লীগের লোকজনকে ধরার জন্য। আমার বড় ভাই ছিল আওয়ামী লীগের ৩৬ কমিটির একজন সদস্য। আমি কৃষিকাজ করে খাই। আমার ভাই আমার থেকে পৃথক। খান সেনাদের ধরার ভয়ে বাড়ী থাকে না। কোথায় কোথায় থেকে শুধু সংগ্রাম আর সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একদিন হঠাৎ ২৫/২৬ জন খান সেনা রাত্রিতে এসে আমার বাড়ী ও ভাইয়ের বাড়ী ঘেরাও করে। ভাইকে না পেয়ে তারা আমাকে ধরে এবং বেদম প্রহার করতে শুরু করে আর বলে তোর ভাই কাঁহা উছকো বোলাও। আরো কি কি বলে আমি বুঝতে পারি না। আমি তাদেরকে বললাম ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারবো না সে আমার থেকে আলাদা। আমি কৃষক মানুষ সারাদিন মাঠে পরে থাকি কিন্তু তারা আমাকে কিছুতে ছেড়ে দিল না। কিছু দূরে তাদের গাড়ি ছিল। ধরে নিয়ে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গেল। আমাকে যে ঘরে রাখল তার পার্শ্বে আরো কয়েকটি ঘর ছিল। সেখানেও আমার সমান বয়সী এবং কম বয়সী লোক বিভিন্ন ধরনের লোক সেখানে ছিল। সেখানে তাদের বড় ক্যাপ্টেন আসলো, আমাকে জিজ্ঞাসা করলো আমার ভাইয়ের কথা কিন্তু তার খুশি মত জবাব না পাওয়ায় সে নিজে খুব মারলো এবং শেষ পর্যন্ত কখন তারা মার বন্ধ করেছে তা আমি বলতে পারবো না জ্ঞান হলে দেখি আমার শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে সমস্ত শরীর কেটে ফেটে গেছে। এইভাবে দু দিন ধরে পর পর আমাকে মারতো আর ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করতো। শেষ পর্যন্ত যখন তারা আর কিছুই আমার কাছ থেকে জানতে পারলো না তখন একদিন রাতে আমাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আমাকে এক রাস্তায় নিয়ে যায়। সেখানে তারা আবার মারতে শুরু করে। তাদের মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান হলে দেখি তাদের ক্যাম্প থেকে অনেক দূরে এক গর্তের মধ্যে পড়ে আছি। অনেক কষ্টে সেখান থেকে উঠে করিম নামে এক লোকের সাহায্যে বাড়ী পৌঁছি।
স্বাক্ষর /-
আমির আলী খান
।। ৬৩।।
মোঃ আব্দুল মালেক মণ্ডল
গ্রাম ও থানা- সারিয়া কান্দি
জেলা- বগুড়া
১৪ ই আগষ্টে পাক বাহিনী সারিয়া কান্দিতে চলে আসে। সারিয়া কান্দিতে কালো পতাকা ও বাংলাদেশের পতাকা দেখে অসংখ্য বাড়ীঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ আরম্ভ করে। অতঃপর আমার দোকানে চলে আসে। দোকানে আসার পর আমার ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করে। তা ছাড়া মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে আমি অস্বীকার করি অতঃপর সেখান থেকে চলে গিয়ে থানায় ঘাঁটি করে। ঐ দিন বিকেলের দিক কতিপয় খান সেনা ও রাজাকারেরা পুনরায় আমার দোকানে চলে আসে। তারা সরাসরি আমার দোকানের ভিতর ঢুকে পড়ে। খান সেনারা দোকানের বাক্সের ভিতর একটি বাংলাদেশের পতাকা পায়। পতাকা দেখে তৎক্ষণাৎ তারা দোকানের সমস্ত মালাপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়। আমি ঐ সময়ে দোকানে উপস্থিত ছিলাম না। তবে অনুমান করি যে, একমাত্র দোকান থেকে ৭০/৭৫ হাজার টাকার মাল পত্র খান দস্যু ও রাজাকারেরা নিয়ে যায়। অতঃপর দুষ্কৃতকারীদের চক্রান্তে খান পশু ও রাজাকারেরা আমার বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। সেখানে গিয়ে তারা আমার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করে দেয়।
১৫ ই আগস্ট বিকাল বেলায় আমার ছেলে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ কর্মী আবজল হোসেনকে ধরে নেয়। তাদের ক্যাম্পে নেওয়ার পর বুট, লাথি, লোহার রড ও রাইফেলের বাঁটের সাহায্যে তার দেহে ভীষন আঘাত করে। তাছাড়া সিগারেটের জ্বলন্ত আগুন দিয়ে তার শরীর পুড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, পায়খানার ভিতর অনাহারে তিন দিন যাবৎ তালাবদ্ধ অবস্থায় রেখে দেয়। তিন দিন পর খান সেনারা তাকে ছেড়ে দেয়। খান পশুরা যেভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছিল, ইতিহাসে তার নজির নেই।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আব্দুল মালেক মন্ডল
১৯/৯/৭৩
।। ৬৪।।
খোন্দকার ইউনুস আলী
থানা- সারিয়া কান্দি
জেলা- বগুড়া
আগষ্টের ১৯ তারিখে সারিয়াকান্দি থেকে খান সেনারা দ্বিতীয় বার চন্দনবাইশা চলে আসে। গ্রামের জনসাধারণ একত্রে ডেকে হিন্দুর জমির লোভ দেখিয়ে এবং টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে রাজাকারে আসার নির্দেশ দেয়। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় আছে এবং কে কে ইত্যাদি খোঁজখবর জানতে চায়। এরপর খান সেনারা রাজাকারে জোর করে লোক নেবার জন্য ২১ তারিখ মঙ্গলবার দিন ধার্য্য করে আসে। অতঃপর সারিয়াকান্দিতে চলে আসে। আসার পর খান সেনারা বগুড়া থেকে বহুসংখ্যক রাজাকার ও খান সেনা সারিয়া কান্দিতে সংবাদ নিয়ে আসে।
২১ তারিখ মঙ্গলবার ১১ টার সময় প্রায় ২ শত জন খান সেনা ও ৭৫ জন রাজাকার চন্দনবাইশায় চলে আসে। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে ঘাঁটি করে এবং প্রয়োজনীয় বাঙ্কার তৈরী করে উক্ত স্থানে ঘাঁটি করে। খান সেনারা রাত্রি যোগে জনগণের বাড়ী থেকে হাঁস, মুরগী, গরু, খাসী ইত্যাদি নিয়ে যায়। অযথা যে কোন লোক জনকে ধরে ভীষণ নির্যাতন করত। গ্রামে ঢুকে মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। একদিন উক্ত গ্রামে জনৈক ব্যাক্তির স্ত্রীকে খান সেনারা জোর করে ধরতে যায়। ঐ সময় স্বামী তার স্ত্রীর উপর অত্যাচারের ভাব দেখে সহ্য করতে না পেরে তাকে আঘাত করে। খানসেনা তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে হত্যা করে এবং মাটি চাপা দেয়। অতঃপর কয়েক রাউন্ড গুলি এদিক ওদিক ফায়ার করে। খান সেনারা চর চন্দনবাইশার আইনুল হককে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঐ সময় কয়েকজন গ্রাম্য লোক আহত হন। এরপর খান সেনারা প্রকাশ্যে নারী নির্যাতন করতে আরম্ভ করে। অকারনে যে কোন লোক জনকে ধরে নিয়ে খান সেনারা খেত। সেই কথা বলতে গিয়ে উক্ত গ্রামের লোক শাহ মনসুর আলী খান সেনাদের হাতে ভীষন নির্যাতন ভোগ করেন। ঐ সংগে তার ছেলেকে খান সেনারা ভীষণভাবে মারপিট করে। খান সেনারা তাদের দুইজনকে লাঠি, রাইফেলের বাঁট, বুট জুতার লাত্থি ও লোহার রড দিয়ে ভীষণভাবে নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। সংগে সংগে তার বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে বহু টাকার ধন-সম্পদ ভস্মীভূত করে দেয়। রাজাকারেরা বহু টাকার ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আমার পার্শ্ববর্তী বাড়ীর বাসিন্দা শওকৎ হোসেন মুনসীর মিথ্যা চক্রান্তে আমাকে খান সেনারা ধরে নেয়। ধরার সময় চড় ও রাইফেল দিয়ে ভীষণ আঘাত করে এবং খান সেনারা আমাকে ছেড়ে দেয়। পরের দিন আমার নিজ বাড়ী ও বড় ভাইয়ের বাড়ী খান পশুরা লুট করে যথা সর্বস্ব নিয়ে যায়। খান সেনারা আমাদের দুই ভায়ের ৪,০০০ (চার হাজার) টাকার ধনসম্পদ অপহরণ করে নিয়ে যায়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উক্ত এলাকার চতুর্দিকে খান সেনাদের ঘাঁটি থাকায় অসংখ্য বাড়ীঘর লুটতরাজ ও নারী নির্যাতন চালায়। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সারিয়া কান্দি থানার মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র ট্রেনিং সেন্টার এবং কেন্দ্রস্থল ছিল চন্দনবাইশা গ্রাম।
স্বাক্ষর/-
খন্দকার ইউনুছ আলী
২০/৯/৭৩
।। ৬৫।।
মোঃ আজাদুর রহমান মণ্ডল
গ্রাম- হামিদপুর
থানা- গাবতলী
জেলা- বগুড়া
খান সেনারা হঠাৎ একদিন হামিদপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে। আমি কোন উপায় না দেখে অতি চতুরতার সাথে শরীরে কাদামাটি মেখে নিজের জমিতে চাষ করতে যাই। সেখান থেকে একজন খান সেনা আমাকে আক্রমণ করে। তখন আমি হাত থেকে গরু তাড়ানোর লাঠি মাটিতে ফেলে দু হাত তুলে খান সেনার কাছে আত্নসমর্পণ করি। অতঃপর খান সেনা আমার গ্রামের নাম, মুক্তিবাহিনী এবং নিজে মুক্তি কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন উর্দুতে জিজ্ঞাসা করে। জিজ্ঞাসা করার পর আমি উর্দুতে সমস্ত কথা তাকে বুঝিয়ে দেই। কিন্তু খান সেনা অবিশ্বাস করে এবং আমাকে মুক্তি ধারনা করে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। এরপর আমি মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ভাল করে পাকিস্তানী জাতীয় সঙ্গীত উর্দুতে ও বাংলাতে বলি। তারপর আমি আল্লাহর নিকট পাকিস্তানের জন্য এবং পাকিস্তানের সৈন্যদের দীর্ঘায়ু কামনা করি। তখন খান সেনারা গুলি না করে আমার বাড়ীর ভিতর নিয়ে আসে। অতঃপর স্ত্রী পুত্র আছে কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। স্ত্রীকে ডেকে আনে। ঐ সময় আমার ঘরের ভিতর একজন পাঞ্জাবী সৈন্য ডেকে নেয়। ঠিক ঐ সুযোগে ঐ খানটি আমার স্ত্রীর ৫ ভরী সোনার দুইটি বালা বাক্স খুলে নেয়। এরপর তারা ছেলের নাম জিজ্ঞাসা করে। তখন আমি পিস্তল ও জান্টার পর পর দুই ছেলের নাম বলি। তখন পিস্তলের কথা শুনে তারা পজিশন নেয় । আমি তাহা উর্দুতে বুঝিয়ে দেই। কারণ পিস্তল ও জান্টার আমার ছেলেদ্বয়ের ডাকনাম ছিল। এত বলা সত্ত্বেও খান সেনারা আমাকে ভারতের দালাল বলে বিবেচনা করে। আমি মুসলমান কিনা তা দেখার জন্য আমার লুঙ্গী খুলতে বলে। একজন বেলুচী সৈন্য তা নিষেধ করে। ঐ বেলুচী সৈন্যটি আমাকে বারবার সাহায্য করে আসছে। আমি তখন বলি যে, আপনি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলেন। তবুও আমি নিজের ইজ্জত দেখাব না। আরও বলি যে, আমি যদি প্রকৃত মুক্তি হয়ে থাকি, তাহলে আপনাদের ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে চলুন। তিনিই বিচার করবেন। অতঃপর আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। ক্যাম্পে এসে কিছু সময় পর দেখতে পাই যে হাত বেঁধে একটি ছেলেকে রাস্তার উপর নিয়ে আসছে। বিগ্রেডিয়ারের নির্দেশ মোতাবেক তাকে লাথি মেরে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। পরপর কয়েকবার বুট জুতার লাথি মেরে তাকে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলে। এরপর আমাকে গুলি করার নির্দেশ দেয়। তখন আমি বলি খান সাহেব মৃত্যুর আগে আমি কয়েকটি কথা বলব, তখন আমাকে বলার জন্য সময় দেয়। অতঃপর আমি চতুরতার সাথে পাকিস্তানী জাতীয় সঙ্গীত গাই এবং পাকিস্তানী ফৌজ ও পাকিস্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করি। এরপর বিগ্রেডিয়ার আমার লেখাপড়া কতটুকু জানতে চায় আমি আরও চতুরতার সহিত বলি যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে। ব্রিগেডিয়ার বলে যে, তা হলে তুমি এত ভালো উর্দু কেমন করে শিখলে? জবাবে আমি বলি যে, ভাষা আন্দোলনের সময় উর্দু ভাষার উপর যখন জোর দেওয়া হয়েছিল, সেই সময় আমি উর্দু ভাষা শিক্ষা করেছি। বার বার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার পর ব্রিগেডিয়ার পুণরায় গুলির হুকুম দেয়। তখন আমি কোন উপায় না দেখে বলি যে, খান সেনা আপনার মত আমারও একজন পাক ফৌজের ক্যাপ্টেন আছে। যার নাম কুদরতে খোদা (বাবলু)। ১৯৬৫ সনের যুদ্ধে তিনি কুদরতে খোদা খেতাব পেয়েছেন। এই কথা শুনে তিনি ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করেন। এরপর সেখান থেকে সঠিক খবর নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেওয়ার পর খান সেনাদের সাহায্য করার কথা, পাকিস্তানের হেফাজতের কথা এবং মুক্তিদের খোঁজ খবর দেওয়ার কথা বলে। এরপর আমি বাড়ী চলে যাই।
এর কিছু দিন পর খান সেনারা নাড়ুয়া মালা হাটে জনসাধারণ নিয়ে মিটিং এর জন্য নাড়ুয়া মালা হাটে চলে যায়। মিলিটারির কথা শুনে হাটের লোকজন দৌড়ে চলে যায়। আমি একটি গ্রেনেড নিয়ে জঙ্গলের ভিতর শুয়ে পড়ি খানসেনারা সেখান থেকে আমাকে দ্বিতীয়বার ধরে। আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তুমি কেন জঙ্গলের ভিতর। নিশ্চয়ই তুমি মুক্তিফৌজ এই বলে আমাকে গাড়ীতে তুলে পুনরায় হাটে নিয়ে আসে। হাটের ভিতর ব্রিগেডিয়ার জনসাধারণের মধ্যে ভাষণ দিলেন এই বলে যে, তোমাদের কোন ভয় নেই, তোমারা আমাদের সাহায্য কর, মুক্তিফৌজের খোঁজ খবর দাও এবং ভারতের দালাল ধরে দাও ইত্যাদি বিষয়। এরপর আমি ব্রিগেডিয়ারের অনুমতি নিয়ে ঐ সমস্ত কথাগুলি পুনরায় বলি। আমি আরও বলি যে পাক ফৌজ কেন আমাদের মা বোনের ইজ্জত ধ্বংস করছে? তারা আমাদের হেফাজতের জন্য এসেছে। আমাদের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে আমাদের উপর গুলি করা আল্লাহপাক বরদাস্ত করবে না। মুসলমানদের ধর্ম কি তাই? একজন নিরীহ লোককে হত্যা করা এটা বিধর্মীয় কাজ ইত্যাদি ভাষণ দেই। এই ভাষণ শুনে ব্রিগেডিয়ার আমাকে ডেকে ঘরের ভিতর নিয়ে যায়। ঘরের ভিতর নিয়ে জোর করে ৫০ টি টাকা বকশিস দিয়ে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করায় যে, আগামী কাল আমি যেন তাদের ক্যাম্পে দেখা করি। পরের দিন সেই মোতাবেক তার কথা ও ধর্ম রক্ষার্থে ক্যাম্পে গিয়ে দেখা করি। তখন ব্রিগেডিয়ার বলে যে, তোমাকে ১০০০ (এক হাজার) করে টাকা দিতে ইচ্ছুক এবং সমস্ত বগুড়া জেলার রাজাকারের কমান্ডার বানিয়ে দিতে চাই, তুমি কি ইচ্ছুক? তখন আমি বলি যে, স্যার আমি রাজাকার হতে চাই না। এরপর আমাকে অনেকগুলি ৫০০ (পাঁচশত) টাকার নোট দেখায় এবং বলে যে, তুমি যদি রাজাকার কমান্ডার হও তাহলে তোমাকে বহু টাকা দেওয়া হবে। আমি সমস্ত কিছু অস্বীকার করে কোন রকমে বাড়ী চলে আসি। রমজান মাসে আমি নাড়ুয়া মালা হাট থেকে আসছিলাম। তখন দেখতে পেলাম একজন খানসেনা একটি লোকের নিকট থেকে জোর করে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। লোকটি তখন আমার কাছে ঐ কথা বলে দেয়। তখন আমি প্রতিবাদ করলে আমার পকেটে যত টাকা ছিল খানসেনা তা কেড়ে নেয়। গাবতলী বাজারের ভিতর এসে একখানা চাকু সংগ্রহ করি। অতঃপর বাজারের ভিতর খান সেনাকে রাইফেলসহ জড়িয়ে ধরি। অতঃপর আমি লোকজন ডাকলাম খান সেনাকে চাকু মারতে। কিন্তু কেউই আমাকে সাহায্য করতে আসল না। ১০ মিঃ আমাদের এ লড়াই চলে আমিও সুযোগ পাইনা চাকু মারতে। অতঃপর খান সেনাটি তার টাকা এবং তার সাথে আরও বিশটি (২০) টাকা দেয়। আমি খান সেনাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড় দিয়ে প্রাণ বাঁচাই। এই রকম ভাবে আমি তিনবার খান সেনাদের হাতে নির্যাতিত হই। প্রত্যেক বারই আমি সাহস ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে রেহাই পাই।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আজাদুর রহমান মণ্ডল
ইং ২৪/৯/৭৩
।।৬৬ ।।
মোঃ জজবর রহমান
ষ্টেশন মাষ্টার
জয়পুরহাট রেলষ্টেশন, জেলা-বগুড়া
হানাদার বাহিনী ২৪ শে এপ্রিল শনিবার রাত্রিতে জয়পুরহাট চলে আসে। আসার সময় রেলষ্টেশনের অনতিদূরে একটি রেল সেতুর কাছে গুলি করে ৩ জন নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। ইতিপূর্বে আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে জয়পুরহাট থেকে তিন মাইল দূরে এক গ্রামে রেখে আসি। প্রত্যেক দিন ঐ গ্রাম থেকে সকালে ষ্টেশনে আসতাম এবং সন্ধ্যায় ফিরে যেতাম।
খান সেনাদের আগমনের সাথে সাথে আমি জীবনের ভয়ে কাজ ফেলে দূরে গিয়ে পালাতে বাধ্য হই। আর অফিসে আসি নি। খান সেনারা এখানে এসে স্কুল কলেজ এবং সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত খোলার ব্যবস্থা করে। ষ্টেশন মাষ্টার সাহেবের খোঁজ করতে থাকে। বহু গুপ্তচরকে আমার পিছুনে লাগিয়ে দেয়। স্থানীয় এক বুকিং ক্লার্ক (অবাঙ্গালী) আমার তল্লাশী চালায়। শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে ধরতে না পেরে এই মর্মে চিঠি লিখে পাঠায় যে, যদি আমি নিজ কার্যে যোগদান না করি , তবে ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে ধরে এনে হত্যা করা হবে। সত্য সত্যই কয়েকদিন পর সেই অবাঙ্গালী বুকিং ক্লার্ক এবং আরও কয়েকজন অবাঙ্গালী খোলা তলোয়ার হাতে আমার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। উপায় না দেখে আমি ধরা দিতে বাধ্য হই। অতঃপর মহকুমা প্রশাসক কার্যে যোগদান করেছেন কিনা তা জানার উদ্দেশে তাদের সাথে তার কাছে যাই। মহকুমা প্রশাসন আমাকে কাজে যোগদান করতে আদেশ দেন। আমি মেজরের সাথে দেখা করি। দেখা করার সময় একজন পাঞ্জাবী আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দেয়। মেজর কার্যে যোগদানের জন্য আদেশ দেন। অতঃপর অফিসে চলে আসি। অফিসে আসার পথে প্লাটফরমে একজন পাক সেনা আমাকে ধরে পকেট থেকে টাকা-পয়সা নিতে চেষ্টা করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অফিসের বেশ কিছু টাকা খান সেনাদের ভয়ে সরিয়ে ফেলেছিলাম। খান সেনাটি আর কিছু না বলে ছেড়ে দেয়। দিনের পর দিন খান সেনারা অত্যাচার আর গনহত্যা চালাতে থাকে। পূর্ব উল্লেখিত খান সেনার সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব জমে উঠে। ঐ খান সেনার সহযোগীতায় আমি বহু নিরীহ লোকজনকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করি। অত্র এলাকার ঘাঁটি করে থাকাকালীন খান পশুরা অসংখ্য লোক জনকে হত্যা করে। খান সেনারা অবাঙ্গালীও ধরে আনে রেল মিস্ত্রীর সাহায্যে। রেললাইন মেরামত করে স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত শান্তাহার থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ করে। এরপর ভারতীয় মিত্র বাহিনীর প্রবল আক্রমণে বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জয়পুরহাটও মুক্ত হয়ে যায়।
স্বাক্ষর/-
মোঃ জজবর রহমান
১১/১০/৭৩
।।৬৭।।
মোঃ আবুল কাসেম
থানা-গাবতলী
জেলা- বগুড়া
২৫ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনী বগুড়া শহরে আক্রমন করে ব্যর্থ হলে অতঃপর ১৩ ই এপ্রিল তারিখে ত্রিমুখী আক্রমন ও বিমান আক্রমন করে বগুড়া শহর তাদের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসে। অতঃপর কয়েক দিন পর এক দল খান সৈন্য গাবতলী থানায় চলে আসে। গাবতলীর সি, ও, অফিসে তারা ঘাঁটি স্থাপন করে। এরপর খান সেনারা চারিদিকে টহল দিতে থাকে। হঠাৎ করে একদল খান বর্বর বাহিনী সুখান পুকুর রেলষ্টেশনে এসে উপস্থিত হয়। পর পর বহু দোকান পাট ও বাসাবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে। বাজারের অসংখ্য দোকানপাট ও বাসাবাড়ীতে লুটপাট আরম্ভ করে দেয়। যাকে যে অবস্থায় যেখানে পায় খান হায়েনারা তাকে সেখানেই বেয়োনেট চার্জ করে অথবা রাইফেলের গুলি দিয়ে হত্যা করে। এক সংগে ৭২ জন নিরীহ জনগণকে একত্রে দাঁড়া করে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার মেরে হত্যা করে। গাবতলী থানার ভিতর সুখান পুকুরে এত গণহত্যার নজির আর কোথাও পাওয়া যায়নি। বাজারে ঢুকে সর্বপ্রথম কয়েকটি মালজাত গুদাম ঘরে তারা অগ্নিসংযোগ করে বহু টাকার ধান চাল ভস্মীভূত করে দেয়। তাছাড়া বাজারের বহু দোকানদারকে ধরে ভীষণ নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে। এদিনই পাক সেনারা আমার বাড়ীতে বহু টাকার ধনসম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। খান বর্বর বাহিনী আমার বাড়ি থেকে ৭/৮ হাজার টাকার জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। বহু সংখ্যক হিন্দুর বাড়ী অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করে দেয়। গ্রামে ঢুকে মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে। বাজারের সমস্ত দোকানপাট ও ঘরবাড়ী অগ্নিসংযোগ করে পাক হায়েনারা আবার গাবতলী সি, ও, অফিসে যায়। গাবতলি থেকে খান পশুরা প্রত্যহ সুখান পুকুরে যাওয়া আসা করতে থাকে। প্রত্যেক বারই তারা দু’চারজনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতার ১২/১৩ দিন পূর্বে মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে গাবতলী থানা তথা সুখান পুকুর শেষ বারের মত শত্রুমুক্ত হয়। স্বাধীনতার পতাকা সর্বত্র ঊড়াতে থাকে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আবুল কাসেম
২৫/৯/৭৩
।।৬৮।।
আরিফুর রহমান (বাদশা)
সন্ধ্যাবাড়ী, থানা- গাবতলী
জেলা-বগুড়া
জৈষ্ঠ্য মাসের একদিন রাতে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে পাক সৈন্যরা আমাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে অবশ্য আমার বাড়ীর দামী জিনিসপত্র ও সোনাদানা লুটপাট করে। মিলিটারীদের সাথে কতিপয় অবাঙ্গালীও ছিল। তাদের মধ্যে বাঙ্গালীও থাকা সম্ভব।
গ্রেফতার করার পর আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। বলা প্রয়োজন, আমার হাত বাঁধা অবস্থাতেই নেয়া হয়। পথের মধ্যেই কয়েক দফা চড় থাপ্পড় মারা হয়।
সার্কিট হাউসে নেয়ার পর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, আমি মুক্তিবাহিনীকে খবর সরবরাহ করি। তারা আমার কাছ থেকে জানতে চায় যে, মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে, তাদের সংখ্যা কত এবং তাদেরকে কিভাবে খবর সরবরাহ করি? আমি মুক্তিবাহিনীর লিডার না অন্য কেউ লিডার আছে? তার নাম কি? মুক্তি বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র কোথায় আছে?
আমি সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করলে আমার উপর দৈহিক নির্যাতন শুরু করে। কয়েকজন মিলে পর্যায়ক্রমে আমাকে নানানভাবে অত্যাচার করতে থাকে। রুলার দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জোড়ায় বেদম প্রহার করে। শরীরের গিট ছাড়াও বিভিন্ন অংশে হৃদয়হীন ভাবে অত্যাচার করে।
এ ছাড়া খাড়া করে পা টান করে রেখে পিঠ কুঁজো অবস্থায় ঘাড় টান করে হাতের কব্জি দিয়ে ঘাঁড়ে মারত। শরীর একটু এদিক ওদিক করলে অথবা যন্ত্রণায় কাতরালে আরো বেশী করে অত্যাচার করতে থাকে। মারের সাথে সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এই অবস্থায় এত বেশী করে আমার উপর অত্যাচার করা হয়েছিল যে, আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। এ ছাড়া রাইফেলের বাঁট, গাদা, গুতা আর পিটান দিতে থাকে। এ ছাড়া লাত্থি তো আছেই।
অত্যাচারের সময় তারা কয়েক পদে অত্যাচার করে। এরা উনিশ পদে অত্যাচার করত। তাদের সুবিধা মত কখনও তারা আমার হাত বেঁধে রাখত আবার কখনও পা খোলা রাখত।
দু দিন বন্দী থাকার পর শান্তি কমিটির সুপারিশে ছাড়া পাই। অবশ্য এ জন্য আমার আত্নীয়স্বজনকে আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে।
স্বাক্ষর/-
আরিফুর রহমান।
।।৬৯।।
ডাক্তার মোঃ হাবিবুর রহমান
সুখানপুকুর ষ্টেশন বাজার
থানা-গাবতলী, জেলা-বগুড়া
প্রথমবারে (২৬শে মার্চ) পাক হানাদার বাহিনী ব্যর্থ হওয়ার পর ১৩ ই এপ্রিল ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়ে বগুড়া শহর পূর্ণ দখলে আনে। কয়েকদিন পর একদল হানাদার বাহিনী গাবতলী সি, ও, অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। গাবতলী থাকাকালীন হঠাৎ একদিন খান পশুর অত্র সুখানপুকুরে হানা দেয়। হানা দিয়ে অসংখ্য দোকানপাট ও ঘড়বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ৭২ জন নিরীহ জনগণকে একত্রে লাইন করে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায় যে, খান সেনারা বাজারে ঢুকেই সর্বপ্রথম আমার বাসায় অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করে দেয়। আমি অনুমান করি যে, খান সেনারা প্রায় এক লক্ষ টাকার ধন-সম্পদ ভস্মীভূত করে দেয়। রাজাকার ও বিহারীরা বাজারের বিভিন্ন দোকানপাট লুট করে নিঃশেষ করে দেয়। জনসাধারণকে ডেকে খান সেনারা মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের খোঁজ জানতে চায়। জনগণ অস্বীকার করলে তাদেরকে ধরে ভীষন নির্যাতন করার পর বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদেরকে হত্যা করে। গ্রামে গ্রামে ঢুকে খান কুকুরেরা নিরীহ অবলা বালার প্রতি পাশবিক অত্যাচার শুরু করে। প্রথম দিনের মত খান সেনারা গাবতলীতে পুনরায় ফিরে যায়। এরপর প্রত্যেক দিন গাবতলী থেকে বর্বররা গাড়ীযোগে সুখানপুকুরে টহল দিতে থাকে। প্রত্যহ আসার পথে অথবা যাওয়ার পথে বর্বর দস্যু বাহিনী ২/৪ জনকে হত্যা না করে ফিরে যেত না। খান সেনারা গাবতলী তথা সুখানপুকুরের আশেপাশের সমস্ত জনগণের মনে ত্রাশের সৃষ্টি করেছিল। প্রত্যেকদিন গ্রামের অভ্যন্তরে ঢুকে মেয়েদেরকে জোর করে বা তাড়িয়ে ধরে পাশবিক অত্যাচার চালায়। কাউকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যেত। এদের প্রায়ই মরে যেত।
আবার কেউ কেউ পশুদের হাত থেকে বেঁচে কোন রকমে বাড়ী চলে আসত। দীর্ঘদিন নির্যাতন চলার পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণে শত্রুর হাত থেকে নিস্তার পাই।
স্বাক্ষর/-
ডাক্তার মোঃ হাবিবুর রহমান।
।।৭০।।
সুকচান
গ্রাম – সাইন্দ্রা
পোঃ- শান্তাহার
জেলা- বগুড়া
বগুড়া জেলার অর্ন্তগত আদমদিঘী থানার শান্তাহার ইউনিয়নের অধীন সাইন্দ্রা গ্রামটি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও বিহারদের দ্বারা অত্যাচারিত। মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সাইন্দ্রা গ্রামে পাক বর্বররা প্রবেশ করে। উক্ত গ্রামে প্রথমে লুটতরাজ এবং পরে অগ্নিসংযোগ করে। অগ্নিসংযোগের ফলে প্রায় ৩শ বাড়ি পুড়ে যায়। উক্ত ৩শ বাড়ির যাবতীয় মালামাল ভস্মীভূত হয়। এখন ও ধ্বংসের সাক্ষ্য বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। উল্লিখিত গ্রামে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে।
এই গ্রামে ঢুকে পাক বর্বররা ছাগল, গরু, হাঁস, মুরগী ও তরকারী ইত্যাদি লুট করেছে। কয়েকজন নারী যারা পালাতে সক্ষম হয়নি তাদেরকে ধর্ষন করে ও ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। ক্যাম্পে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই গ্রামের প্রায় ১৫০ জন লোক পাক বর্বরদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন।
স্বাক্ষর/-
সুকচান।
।।৭১।।
ওমর আলী প্রামাণিক
গ্রাম-নাপুরগাছি,
থানা-পাঁচবিবি
জেলা-বগুড়া
এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমি আমার বাড়ী দেখার জন্য নাপুরগাছি চলে আসি। এবং নিজ বাড়িতে গিয়ে দেখি পাক হানাদার বাহিনী বাড়ীর আশেপাশে বাঙ্কার করে বাঙ্কারের মধ্যে মেশিনগান বসিয়ে পজিশনে আছে। আমি বাড়ীতে ঢুকে দেখতে পাই আমার বাড়ীতে খাট চৌকি ইত্যাদি সবকিছু পাক হানাদার বাহিনী নিয়ে তাদের কাজে ব্যবহার করেছে। তারপর আমি বাড়ী হতে খিড়া পাথার রওনা হয়ে যাবার সময় পথে এক জঙ্গলের মধ্যে পাক হানাদার বাহিনী ও বিহারীরা আমাকে দেখে ফেলে। এবং আমাকে পাঞ্জাবী একজন সৈন্য ডাকে। আমি তার নিকট গিয়ে দেখতে পাই জঙ্গলের মধ্যে হানাদার বাহিনী দুটি গর্ত করে রেখেছে, তার গভীরতা প্রায় ২০/৩০ হাত এবং দৈর্ঘ প্রায় ৩০/৪০ হাত। আমি সেখানে পৌছালে একজন পাক সেনা বিহারীদেরকে নির্দেশ দেয় আমাকে উক্ত একটা গর্তের মধ্যে ফেলে দিয়ে জ্যান্ত কবর দিতে। তারপর বিহারীরা ও একজন পাক সেনা আমাকে উক্ত গর্তের মধ্যে নামতে বলে। আমি গর্তের মধ্যে নামার সাথে সাথে আমাকে চিত হয়ে টান হয়ে শুইতে বলে। আমি ভয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে থাকি। তারপর পাক হানাদারদের মধ্যে একজন বিহারীদেরকে নির্দেশ দেয় জ্যান্ত অবস্থায় আমাকে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে। দুইজন বিহারী কোদাল হাতে করে একজন মাথার দিকে গিয়ে দাঁড়ায় আর একজন পায়ের দিকে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর তারা কোদালে মাটি তুলে আমার শরীরের উপর মাটিচাপা দিবে। এমন সময় একজন পাক সেনাদের ক্যাপ্টেন ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয় এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস দেয় যে, এই লোকটাকে কেন তোমারা জ্যান্ত কবর দিচ্ছ। তারপর ক্যাপ্টেন আমাকে গর্ত হতে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ করে তোমার বাড়ী কোথায়, কোথায় যাবে তুমি? আমি ভয়ে ভয়ে তার প্রশ্নের জবাব দিই। তারপর ক্যাপ্টেন তার সিপাইদেরকে ও বিহারীদেরকে বেশ শাসন করে। এবং আরও বলে এ লোক একজন বুড্ডা আদমী, একে তোমরা কেন জ্যান্ত কবর দিচ্ছিলে। এ তো কোন অপরাধ করে নাই। তারপর ক্যাপ্টেন আমাকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কোথায় যাবে। আমি জবাব দেই আমি পূর্বদিকে যাবো। তারপর ক্যাপ্টেন আমাকে পূর্বদিকে যেতে নির্দেশ দিলে আমি রওনা হয়ে চলে আসি। এবং খিড়া পাথার গিয়ে আমার পরিবার পরিজনের সাথে সাক্ষাত করি এবং ঘটনাদি খুলে বলি। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমি নিজ বাড়ী চলে আসি।
স্বাক্ষর/-
ওমর আলী প্রামাণিক
৬/১১/৭৩
।।৭২।।
ফকির মামুদ মন্ডল
গ্রাম-দানেজপুর
ডাকঘর- পাঁচবিবি
থানা- পাঁচবিবি
জেলা- বগুড়া
১৯৭১ সালের বাংলা আষাঢ় মাসের ২০/২৫ তারিখে ৫০/৬০ জন রাজাকার পুলিশ বিহারী ও পাক মিলিটারী মিলে আমার বাসায় যায় এবং বাসা ঘেরাও করে এবং আমাকে বাসা হতে ধরে ফেলে। বাসার বাইরে নিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তোমার চার নাতী মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকে যদি তুমি এনে না দাও তাহলে আমরা তোমাকে গুলি করে হত্যা করব। তার প্রতি উত্তরে আমি জবাব দেই তারা কোথায় গিয়েছে তা আমি বলতে পারবো না, আর আপনারা যদি তাদেরকে কোথাও খুঁজে পান তা হলে তাদেরকে আপনারা গুলি করে মেরে ফেলবেন আমার কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু আমার নাতিরা কোথায় গিয়েছে তার জন্য তো আমি দায়ী হতে পারি না। কারন তারা এখন বড় হয়েছে নিজ নিজ স্বাধীনতা নিয়ে তারা যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। আমি এখন বৃদ্ধ হয়েছি আর কি তাদের খোঁজখবর আমার পক্ষে রাখা সম্ভব। তারপর পাক হানাদার বাহিনীরা আমাকে চোখ বেঁধে পাঁচবিবি রেল লাইনের উপর নিয়ে আসে। এনেই স্থানীয় বিহারীদের নেতারা আলাপ-আলোচনা করার পর চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাকে রেল লাইনের উপর ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আমি বাড়ী চলে যাই।
ঐ ঘটনা ঘটার ৭/৮ দিন পর আয়ুবের নির্দেশে ২০/২৫ জন রাজাকার বিহারী ও পাক সেনা মিলে আবার আমার গ্রামের বাসায় গিয়ে ঘেরাও করে আমাকে ধরে পাঁচবিবি নিয়ে আসে। এসেই সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, আমি আমার জবাবে একই কথা বলি। তারপর সেদিনও পাক হানাদার বাহিনী কুখ্যাত বিহারী নেতার সাথে আলাপ আলোচনা করে আমার চোখ বেঁধে সি,ও, অফিসের নিকট নিয়ে ছেড়ে দেয়। আমি বাড়ী চলে যাই। তারপর আমি আমার পরিবার পরিজনের সবাইকে নিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখানে আমার পরিবারের সকলকে রেখে ৮/১০ দিন পর আমি বাংলাদেশে চলে আসি। এর মধ্যে দালাল বিহারী নেতা আমার গদিঘর দখল করে নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে বসবাস করছিল।
আষাঢ় মাসের শেষের দিকে পাক হানাদার বাহিনী পাঁচবিবি হতে কান্দি যাবার পথে কান্দিয়া ব্রীজে ৪/৫ টা চীনা মাইন ব্রীজ হতে উদ্ধার করে। এবং মাইন কারা পুঁতে রাখে তাদের খোঁজ করতে থাকে। কুখ্যাত আয়ুব পাক হানাদার বাহিনীকে জানিয়ে দেয় যে, উক্ত মাইন পাতার মূলে রয়েছে ছমির উদ্দিন মণ্ডল ও মামুদ মন্ডল।
শ্রাবন মাসের তিন তারিখে ৪০/৫০ জন পাক সেনা রাজাকার ও বিহারী মিলে আমাদের বাসায় যায় এবং বাসা ঘেরাও করে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই ছমির উদ্দিন মণ্ডলকে ধরে দুই ভাই- এর হাত একত্র করে বেধেঁ কোমরে দড়ি দিয়ে বেধেঁ পাঁচবিবি থানায় নিয়ে যায় এবং বলে ব্রীজে তোমরা মাইন পুঁতেছিলে, তোমরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। তোমার চার নাতি মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকে এনে দাও। নতুবা তোমাদের দুই ভাই কে গুলি করে হত্যা করবো। তারপর আমরা দুই ভাই মেজরকে বলি আমরা মাইন কেমন দেখা যায় চিনি না এবং মাইন পাতা সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারবো না। আর আমার নাতীদের খোঁজখবর আমরা কিছুই বলতে পারবো না। তারপর আমাদের দুই ভাইকে মেজর পাঁচবিবি থানায় চালান দিয়ে যায়। পাঁচবিবি থানায় সেই সময় পাঞ্জাবী পুলিশেরা থাকতো এবং বিহারীরা থাকতো। আমাদের দুই ভাইকে থানার হাজতে রাখে। আমরা হাজতের মধ্যে ঢুকে দেখতে পাই মুজাফফর ন্যাপের একজন কর্মী নাম বছির মিয়া (বাড়ী আটুয়া পাঁচবিবি থানা) আধা মৃত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। তাকে একজন পাঞ্জাবী পুলিশ এমন প্রহার করেছে যে, প্রহারের দরুণ তার সমস্ত শরীর হতে রক্তপাত হচ্ছে। আমি জেলে ঢুকেই তাকে দেখে বললাম বছির মিয়া তুমি এখানে। বছির আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। আমি তাকে সান্ত্বনা বাণী শুনিয়ে বলি আল্লাহ আল্লাহ করো।
আল্লাহ ছাড়া আর কোন গতি নাই। তারপর আমরা দুই ভাই জেলের মধ্যে থেকে যাই। সেই দিন রাত ৮ টার পর একটা পাক হানাদার বাহিনীর গাড়ি গিয়ে থানায় উপস্থিত হয় এবং একজন পাঞ্জাবী জেলের দরজায় গিয়ে বছিরকে ডাক দেয়। বছির নড়তে-চড়তে পারে না, দুই তিনজন বিহারী ও একজন পুলিশ বছিরকে হাজত হতে বের করে গাড়ীতে তুলে দেয়, গাড়ী চলে যায়। তার আধ ঘন্টা পরেই আমরা সি, ও, অফিসের সম্মুখে একটা ফায়ারের শব্দ শুনতে পাই। আমরা মনে করলাম বছির হয়তো বাংলাদেশের মাটিতে হানাদার বাহিনীর গুলিতে মিশে গেল। আমরা দুই ভাই আল্লাহর নাম স্মরণ করতে থাকি। এবং মনে মনে বলতে থাকি এরপর মনে হয় আমাদের পালা। কোন মতে রাত্রি কেটে যায়।
তার ৫/৭ দিন পর মেজর আবার আমদের সাথে জেলে দেখা করে এবং বলে শালা বাঙ্গালীকা জাত, বড় হারামীহায়। শালা মাইন পোঁতে হাম লোককে মারতে চায়। এবং আমাকে আরও বলে তোম লোককা দুনিয়াছে নেকাল করদেগা, আজ রাতমে তোম বিদায় নিয়ে গা। তারপর জয়পুরহাট চলে যায়।
এর মধ্যে আমি জেলের একজন বাঙ্গালী পুলিশের মারফত শুনতে পাই যে, আমাদের দুই ভাই- এর জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে সি, ও, অফিসের পার্শ্বে। এটা শোনার সাথে সাথে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে থাকি। কিন্তু আয়ুব বিহারীর নির্দেশে জেলের মধ্যে আমার উপর কোন শারিরীক ও মানসিক অত্যাচার করা হয় না।
মেজর চলে যাওয়ার ৮/১০ দিন পর একজন বেলুচ মেজর পাঁচবিবি আসে। এসেই জেলে গিয়ে আমাদেরকে দেখতে পায়। তারপর কাগজপত্র দেখে ও,সি, কে নির্দেশ দেয় যে, এখনই আমাদেরকে বগুড়া সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুই ভাইকে গাড়ীতে করে বগুড়া সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। আমরা জেলে ঢুকে দেখতে পাই জেলের মধ্যে ৮০/৯০ জন বাঙ্গালী পড়ে আছে। তাদের কারোর শরীরের শত শত লাঠির আঘাতের চিহ্ন। আবার কারুর শরীরে শত শত বেয়োনেটের খোঁচার চিহ্ন। কারোর শরীর হতে অঝোরে রক্ত ঝরছে। দ্রুত সব দৃশ্যাবলী দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জেলের দারোয়ান আমাকে বলতে থাকে বুড্ডা তুম আর নেহি বাচেগা। তারপর আমরা জেলে ঢুকার মধ্যে ঢোকার আধ ঘন্টা পর একজন পাঞ্জাবী লাঠি হাতে করে জেলের মধ্যে ঢোকে। সকলেই তাকে দেখে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে সড়ো চুপচাপ হয়ে বসে। তারপর পাঞ্জাবীটা ঘরের মধ্যে ঢুকেই কোন কথা না বলে এক এক করে সবার পিঠে একটা করে লাঠির আঘাত করে। তারপর আমার নিকট গিয়ে থমকে দাঁড়ায় এবং আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বুড্ডু তুম কাহাছে আয়া। আমি জবাব দিই আমি পাঁচবিবি হতে এসেছি। আমার কোন দোষ নেই আমাকে বিহারীরা ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর মিনিট পাঁচেক চুপ করে থাকে এবং আমাকে বলে বুড্ডা তোমার কোন ভয় নেহি। তারপর আমার ভাই এর নিকট গেলে আমি বলি আমার ছোট ভাই। তারপর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে জেল হতে বেরিয়ে চলে যায়। তারপর সন্ধ্যা নেমে এলে ৪/৫ জন লোককে জেল হতে বের করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। তাদেরকে আর জেলে ফিরে নিয়ে আসে না। এইভাবে প্রতি দিন ৪/৫ জন করে জেল হতে বের করে নিয়ে হত্যা করতো। কয়েকদিন পর বগুড়া শহরে আমার আত্নীয়ের তদ্বীরের দরুন মুক্তি পাই।
স্বাক্ষর/-
ফকির মামুদ মণ্ডল
৭/১১/৭৩
।।৭৩।।
মোঃ জালাল উদ্দিন
সারিয়াকান্দি
জেলা- বগুড়া
১৯৭১ এর জুলাই আগষ্ট মাসের দিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অধিক সামরিক শক্তি সরঞ্জাম নিয়ে সারিয়াকান্দিতে তাদের ঘাঁটি ফেলে। হানাদার বাহিনী বাঁধে যাওয়ার পথে বেণীপুর চরের তমিজউদ্দিন প্রামাণিকের ভগ্নিপতিকে সাপাড়ার রাস্তায় ধরে এবং রাইফেল দ্বারা আঘাত করে হত্যা করে। তারা প্রত্যেক দিন সকালে দল বেঁধে বিভিন্ন গ্রামে রুটিন মোতাবেক হামলা করত। নারী নির্যাতন, হত্যা, মারধোর ও লুন্ঠন করে মূল্যবান জিনিসপত্রাদি নিয়ে বিকালে তাদের ঘাঁটিতে ফিরত। এমনি একদিন গণকপাড়ায় যেয়ে তারা মুক্তি বাহিনীর হাতে আটকা পড়ে। সারাদিন সারারাত দু’দলের মধ্যে যুদ্ধ হয় কিন্তু মুক্তি বাহিনীর গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানী বাহিনী রক্ষা পায়।
অতর্কিতে হানা দিয়া পাক বাহিনী দেলুয়াবাড়ী গ্রাম হতে মুক্তিযোদ্ধা নজির হোসেন, সাহায্যকারী কোরবান আলী, মন্তেজার রহমান ও বাবু খাঁকে আটক করে। বাঁধের নিকট নিয়ে হাত পাঁ বেঁধে নজির হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে এবং অপর তিনজনকে নিয়ে ঘাঁটিতে আসে। অতি কষ্টে পরে তারা মুক্তি পায়। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর প্রায় সপ্তাহখানেক তাদের দু’জনকেই অজ্ঞান অবস্থায় দেখা গেছে। বাঙ্গালীর পশ্চিম পাড়, রামচন্দ্রপুর গ্রামে অপারেশন চালাতে গিয়ে মুক্তি বাহিনীর গুলিতে ছোট দারোগা নিহত হয় এবং সামরিক বাহিনীর একজন গুরুতররূপে আহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা রীতিমতো বেড়ে যায়। হানাদার বাহিনী বাইরে যাওয়া কম করে ফেলে। তাদের অত্যাচারে পলাতক বাড়িওয়ালাদের খাসী, মোরগ কুড়াতে থাকে। একদল হানাদার বাহিনী বগুড়া থেকে আসার পথে ফুলবাড়ী খেয়াঘাটে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। খেউনিরুপী মুক্তিযোদ্ধা খেয়ার নৌকা নদীর মধ্যে আসলে গুলি ছুড়তে থাকে। ঘটনাস্থলেই তিনজন কনষ্টেবল প্রাণ হারায়। তারপর শুরু হয় স্থানীয় দোকানপাঠ লুন্ঠন। তবিবর মণ্ডলের দোকানের সম্মুখে ট্রাক রেখে মালপত্র বোঝাই করে সেগুলো রংপুরের গাইবান্ধায় পাচার করে। হাবিবুর প্রামাণিকের দোকান লুট করে এবং তাকে পর পর দুই দিন দোকানের মধ্যেই বেদম প্রহার করে। নৌকাতে পাঠ উঠানোর অভিযোগে দৌলতুজ্জামান তরফদার সাহেবকে ভীষণ মারধোর করে। তখন মুক্তি বাহিনীর আর সহ্য হয় না। এদিকে সোজাসুজিও তারা মিলিটারীদের ঘাঁটিতে হানা দিতে পারে না। কারন পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে হানা দিলে আশেপাশের গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় এবং লোকজন মেরে সাফ করে ফেলে। তবুও সময় ঠিক করে একদিন মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা আরো বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানী বাহিনীর এই খবর বগুড়ায় তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছিয়ে দেয়ার পর সামরিক বাহিনীর লোককে সারিয়াকান্দি পাঠিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। সারিয়াকান্দি বাজারের সমস্ত বাড়ী ও দোকানপাট তল্লাশী চালিয়ে মালেক মণ্ডলের দোকান হতে বাংলাদেশের পতাকা উদ্ধার করে। ফলে তার দোকানের সমস্ত মালপত্র থানাতে উঠাবার আদেশ দেয়। তারপর মন্তেজা রহমান মণ্ডলকে পাকিস্তানী পতাকা না উঠাবার অভিযোগে আটক করে তাদের সামরিক গাড়িতে উঠায়ে নেয়। মফিজ মাষ্টার সাহেবের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তার বাড়ীতে পাহারারত কামলা খটটুর বাবাকে আটক করে এবং গাড়ীতে তুলে নেয়। জামাল ডাক্তারের শ্বশুর ময়েজ ডাক্তার, জামাল ডাক্তার, মালেক মণ্ডলের ছেলে এবং অন্যান্য বেশ কিছু লোককে হানাদার বাহিনীর জোয়ানরা আটক করে। সামরিক বাহিনীর উক্ত দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল লেফটেন্যান্ট আতিক। মালেক মণ্ডলের ছেলেকে থানায় তার বুকে পায়ের শক্ত জুতার দ্বারা বার কয়েক আঘাত করে। ফলে সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং তার মুখ হতে রক্ত বের হতে থাকে। সকলকে নিয়ে বাউলে আটা ঘাঁটিতে চলে যায় এবং রাতে তাদের প্রতি অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। তাদের ঘাঁটিতে রেখে জামাল ডাক্তারের বাসায় পুনরায় আসে এবং তার স্ত্রীকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। তার স্ত্রীকে না পেয়ে তার শ্বাশুড়ীকে ধরে মোটরে উঠায় ও তার মেয়েকে বের করে দেয়ার জন্য ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। রাত্রিতে মুক্তিবাহিনী অতর্কিতে থানা আক্রমণ করে। তখন সারিয়াকান্দি থানায় মিলিটারী ছিল। থানা আক্রমনের পরপরই ভীষণ বৃষ্টি আরম্ভ হয়। দুই পক্ষের ভীষণ গোলাগুলি হয় কিন্তু বৃষ্টির বেগ আরো প্রবল হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তারপর প্রায়ই খবর পাওয়া যেতে লাগল আজ এ দালাল খতম, কাল ও দালাল খতম। পাকিস্তানী বাহিনী তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে লাগল। ইতিমধ্যে থানায় পশ্চিম ও,সি কে পাঠানো হয়েছে। তার চেষ্টায় প্রায় ৭০/৮০ জন রাজাকার সংগ্রহ করা হয়েছে। এলো পশ্চিমা পুলিশ। এদের বাবা-মা মানুষ কিনা আমার জানা নেই। তবে এরা আকৃতিতে মানুষ হলেও আসলে ছিল কুকুর। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় তাদের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হল। রাজাকাররূপী একজন মুক্তিবাহিনীর ছেলেকে তারা টের পেয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এবং হাত-পা কেটে নদীতে ফেলে দেয়। সারিয়াকান্দি এক্সচেঞ্জ হতে পাকবাহিনীর সংখ্যা এবং তাদের গোলা বারুদের খবর জেনে ভোর পাঁচটায় সারিয়াকান্দি আক্রমণ করা হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ উক্ত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দুইজন যুবক প্রথমেই নিহত হওয়ায় তারা ফিরে যেতে বাধ্য হন। বগুড়া ও গাবতলী থেকে হানাদার বাহিনীদের ডাক আসে এবং তাদেরকে থানা ছেড়ে অতিসত্বর বগুড়া চলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই মুক্তিবাহিনী কতৃক রাস্তা বন্ধ হওয়ায় তারা চলে যাবার কোন পথ পেল না।
১৯৭১ সালের ২৬ শে নভেম্বর সকাল ঠিক এগারটায় মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে সারিয়াকান্দি থানাতে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীদেরকে আক্রমণ করে। বিকাল তিনটার সময় এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত বাহিনীদের পতন ঘটে। সারাদিন এবং সারারাত যুদ্ধের পর ২৭ শে নভেম্বর সকালে হানাদার বাহিনীসহ থানার পতন ঘটে। শতাধিক রাজাকার ও পুলিশ মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আটক হয়। আটককৃত পুলিশদেরকে ভারতে বিচারের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। রাজাকারদের বিচার করা হয় যমুনা নদীর পাড়ে। বিচারে কিছু রাজাকার রক্ষা পায় এবং অবশিষ্ট গুলো যমুনা নদীতে তাদের সলিল সমাধি লাভ করে। থানার পতনের পর শুরু হয় উড়োজাহাজ থেকে বোমা বিস্ফোরণ ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ । উক্ত এমনি গুলিতে নিহত হয় পাকুড়িয়া গ্রামের পুকরা মণ্ডলের ছেলে দুদু মণ্ডল। সে মুক্তিবাহিনীদেরকে নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল এবং মেশিনগানের গুলিতে নৌকা থেকে নদীতে পড়ে যায়। বর্বর পাক বাহিনীর রাইফেলের গুলিতে নিহত হয় উক্ত গ্রামের জাফর সরদারের ছেলে জহির উদ্দিন। মেশিনগানের আর একটি গুলিতে সারিয়াকান্দির আছমতের মা নিহত হয়।
দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় সারিয়াকান্দি থানা পতনের পূর্ব রাত্রিতে পাকিস্তানী বাহিনীর অধিকাংশ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং তার কিছু অংশ রাস্তায় মারা পড়ে। বাকীগুলো সমন্ধে কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। ফলে অত্র থানার অনেক অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে আসে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ জালালউদ্দিন
২২/০৯/৭৩
।।৭৪।।
মোঃ ছানোয়ার হোসেন
গ্রাম- বালীস্বর্বা
ডাকঘর- পাঁচবিবি
জেলা- বগুড়া
১৯৭১ সনের ২২ শে জুলাই রাজাকারদের হাতে গ্রেফতার হলে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাবার পর আমাকে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে দেয়। তারপর আরম্ভ হয় দৈহিক নির্যাতন। প্রায় ১৫/২০ জন পাঞ্জাবী ফুটবল খেলার মত লাথি মারতে থাকে। একজন লাথি মেরে আরেকজন এর কাছে দেয়, সে আবার আর একজনের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে কিল ঘুষি, রাইফেলের বাঁটের বাড়ি চলতে থাকে। প্রায় ৪০ মিনিট তারা আমার উপর নির্যাতন চালায়। শেষের দিকে আমি জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। সারা শরীর ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। আমার উপর দৈহিক নির্যাতন চালাবার পর প্রায় জ্ঞানশূন্য অবস্থায় থানাতে পৌছে দেয় এবং হাজতে চোখ, হাত বাঁধা অবস্থায় বন্দী করে রাখে। রাত্রি ৮ টার দিকে একজন বাঙ্গালী পুলিশ আমার চোখ ও হাতের বাধন খুলে দেয় এবং কিছু ভাত খেতে দেয়। এই সময় আমি দেখতে পাই হাজতের ভিতর আরও ৮ জন বন্দী আছে।
অতঃপর আমাকে ১০ দিন থানা হাজতে বন্দী করে রাখে। প্রত্যেকদিন বহু পাঞ্জাবী সৈন্য ও বিহারীরা আমাকে দেখার জন্য থানা হাজতে আসতো কেননা তারা নাকি মুক্তিফৌজ কেমন দেখা যায় তা জানে না। তারা এসে নানাভাবে আমাকে গালিগালাজ দিত এবং লাঠি দিয়ে হাজতের ভিতরেই আমাকে খোঁচাতো। অনেকে আবার উপহাস করে আমাকে বন্ধু বলে ডাকতো।
আগস্ট মাসের ১ তারিখে আমাদেরকে থানা হাজত থেকে বের করে এবং আমার দুই পার্শ্বে দুইজনকে দাঁড় করে আমার দুই হাত দুই জনের হাতের সঙ্গে বেঁধে মাজায় দড়ি বেঁধে টেনে রেল স্টেশনে আনা হয়। তারপর গাড়ীতে করে বগুড়া নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। বগুড়া জেলে দুইটা পাঞ্জাবী কে “জেল” দেয়া হয়েছিল। এই পাঞ্জাবী দুটি জেলের ভিতর যখন তখন আমাদেরকে মারধোর করতো।
৩ রা আগস্ট আমাকে জেল থেকে বের করে বগুড়া কটন মিলের নিকট একটা ছোট ঘরের ভিতর নিয়ে যায়। এখানে নিয়ে প্রথমে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়। এই সময় তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে-
‘তুমি কত বিহারী ও পাঞ্জাবী মেরেছো? কোথায় মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং দিয়েছো, তোমাদের লিডার কে, কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছো, ভারতীয় সৈন্য বর্ডারে যুদ্ধ করছে, কিনা, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত? পাক বাহিনীর প্রশ্নের জবাবে আমি শুধু এ কথা বলি যে, আমি এ সব কিছু জানি না। আমি ভারত থেকে পালিয়ে আসছিলাম, আমি ট্রেনিং নেই নি।
আমার কাছ থেকে কোন কথা বের করতে না পেরে ৩ জন মিলে এক সঙ্গে আমাকে মারতে আরম্ভ করে। কিল, ঘুষি, লাথি, রাইফেলের বাটের বাড়ি এবং লাঠি দিয়ে ভীষণভাবে পিটানো আরম্ভ করে। প্রায় দেড় ঘন্টা যাবত এইভাবে মারধোর করার পর আমাকে পায়ের ভিতর হাত দিয়ে কান ধরে রাখতে নির্দেশ দেয়। আমি যখন তাদের কথা মত নিচু হয়ে পায়ের ভিতর হাত দিয়ে কান ধরে থাকি তখন পিছন থেকে চাবুক দিয়ে পিটান হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে একই প্রশ্ন বারবার করতে থাকে। সময় সময় বাইরে থেকে যারা দেখতে আসে তারাও হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে পিটায়।
প্রায় ৩ ঘন্টা যাবত এইভাবে নির্যাতন চালানোর পর সন্ধ্যা ৭ টার দিকে আমার পায়ে চিকন রশি শূন্যে ঝুলিয়ে দেয়। এই সময় এমন লাগতে থাকে যে জীবন বোধ হয় পা দিয়ে বের হয়ে যাবে। ঝুলে থাকা অবস্থায় মোটা রোলার দিয়ে প্রত্যেক গিরায় গিরায় মারতো এবং মাথার পিছনের দিকে আঘাত করতো। প্রায় ২০ মিনিট রাখার পর আমি বলি যে, আমাকে মাটিতে নামানো হলে আমি সব কথা বলবো। তখন তারা আমাকে নিচে নামায় এবং তখনই বলার হুকুম দেয়। কিন্তু আমি জিরিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে আবোল তাবোল বলতে থাকি। আমার চালাকি বুঝতে পেরে বর্বর সৈন্যরা আমাকে লাথির পর লাথি মারতে থাকে। কিছুক্ষন পিটানোর পর পুনরায় আমাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং পূর্বের চেয়ে আরও বেশী প্রহার করতে থাকে এবং প্রশ্ন করতে থাকে। আমার ঐ একই উত্তর যে আমি জানি না।
২য় বার আমাকে ঝুলানোর প্রায় ১৫/২০ মিনিট পর পাশের রুম থেকে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন বের হয়ে আসে এবং আমাকে বলে “ছানোয়ার, আমি একজন মুসলমান তুমি বিশ্বাস কর?” আমি তার জবাবে বলি যে। “হাঁ আপনি মুসলমান।“তখন ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে পুণরায় বলে যে “আমি মুসলমান হয়ে আর এক মুসলমান এর কাছে প্রতিজ্ঞা করছি যে যদি তুমি আমার কাছে সত্য কথা বলো তবে তুমাকে আর মারা হবে না, এবং আমি চেষ্টা করবো তোমাকে ছেড়ে দিতে।“তখন আমার তার কথা বিশ্বাস হলো এবং আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম যে “আমি সত্য কথা বলবো?” এই সময় আমাকে মাটিতে নামান হয় এবং বলে যে তুমি “খাওয়া দাওয়ার পর বলবে না এখনই বলবে?” আমি বলি যে আপনি যা বলেন সেই হিসাবেই আমি কাজ করবো। তখন আমাকে রুটি ও তরকারি এনে খেতে দেওয়া হয়।
খাওয়ার পর ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে জানায় যে তুমি আজ বিশ্রাম কর কাল তোমার কাছ থেকে সব কিছু শোনা হবে। এই বলে আমাকে পুনরায় জেলে নিয়ে একটা সেলের ভিতর বন্দী করে রাখে। এই সময় আমি এত কাহিল হয়ে পড়েছিলাম যে আমি মোটেই নড়াচড়া করতে করতে পারতাম না।
৪ ঠা আগষ্ট সকাল ৯টার দিকে আমাকে জেল থেকে বের করে পূর্বের সেই ঘরে ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে প্রশ্ন করে যে, বল তুমি কি করেছো? তার উত্তরে আমি জানাই যে আমি ৭দিন ট্রেনিং নিয়েছি। তারপর অপারেশনের জন্য আমরা বগুড়া যাবার পথে “গয়েশপুর” এসে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং আমার দলের লোক আমাকে রেখে বগুড়া চলে যায়। তখন আমি পুনরায় ভারত চলে যাই এবং কিছু দিন পর যখন ইয়াহিয়া খান সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করেছেন তখন আমি দেশে ফিরে আসার সময় রাজাকারদের কাছে ধরা পড়ি। ক্যাপ্টেন আমার কথা লিখে নেয় এবং আরও বহু প্রশ্ন করে, ভয় দেখায়, লোভ দেখায় উত্তর দেবার জন্য। আমি বলি যে যদি আমাকে মারতে মারতে মেরেও ফেলা হয় তবুও আমি এর বেশি আর কিছু বলতে পারবো না।
৭ ই আগস্ট আমাকে বগুড়া জেল থেকে বের করে ” মিলিটারী পুলিশ “হাত বেঁধে গাড়ীতে করে রেল স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের কথা থেকে আমি বুঝতে পারি আমাকে নাটোর সামরিক জেলে পাঠান হচ্ছে। গাড়ী আসার পর মিলিটারী পুলিশ আমাকে অন্য মিলিটারীর হাতে তুলে দেয়।
গাড়ীর ভিতর তুলে আমাকে ও অন্য আরও একটি ছেলেকে ছিটের নিচে বসিয়ে আমাদের ঘাড়ের উপর পা তুলে বর্বর সৈন্যরা বসে থাকতো এবং প্রত্যেক স্টেশনে গাড়ী থামলে বিহারী ও অন্যান্য সৈন্য রা এসে আমাদের দুই জনকে ভীষণভাবে মারধোর করতো। প্রত্যেক ষ্টেশনে আমাদের এই ভাবে নির্যাতন চলতে থাকে।
নাটোর রেল স্টেশন থেকে আমাদের নাটোর সামরিক জেলের কাছে নিয়ে যায় এবং বলে যে এদেরকে নতুন “মেহমান” হিসাবে প্রাথমিকভাবে কিছু “খেদমত” করে দেওয়া হোক। এই বলে ভীষণ মারধোর আরম্ভ করে। মারতে মারতে প্রায় জ্ঞানশূন্য অবস্থায় আমাকে জেলের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।
প্রত্যেক দিন জেল থেকে বের করে কাজ করানোর জন্য নাটোর ফুল বাগানে নিয়ে যেত। প্রত্যেক দিন ৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো। সকাল ৮টা থেকে রাত ১২ টা এবং ৩টা থেকে ৫ টা একটানা কাজ করতে হতো এর ভিতর কোন বিশ্রাম নিতে দিতো না। সব সময় “ডবল” হিসাবে কাজ করাতো। এরপরও বর্বর সৈন্যরা চাবুক দিয়ে আমাদের প্রহার করতো।
জেলখানার ভিতর যে ঘরে আমাদের রাখা হতো সে ঘরে খুব বেশি হলে ১০/১২ জন থাকতে পারে। সেখানে আমাদের ৬০ জনকে রাখতো। রাত্রিতে শোবার কোন ব্যবস্থা ছিল না। আমি যে ঘরে ছিলাম সে ঘরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ডঃ কাজী সালেহ আহম্মেদ, লেকচারার মজিবর রহমান, ওয়াপদার ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার এম, ডি, ছারোয়ার হোসেন (রাজশাহী) ছিলেন। আমাদের মত এদের উপরও চলতো সমানভাবে নির্যাতন এবং আমাদের মতো এদেরও কাজ করতে হতো। জেলের ভিতর সর্বমোট ১৫০ জন কয়েদী বন্দী ছিল।
মোট ২৮/২৯ দিন আমি নাটোর জেলে ছিলাম। আমাদের খাবার দেবার জন্য জেল থেকে বের করে লাইন ধরাতো। আমরা যখন নিচু হয়ে খাবার নিতাম তখন বর্বর সৈন্যরা চাবুক দিয়ে আমাদের প্রহার করতো। মার ছিল আমাদের একমাত্র সঙ্গী। প্রত্যেক দিন সকালে ছোট একটা পুরি ও একটু চা। দুপুরে দেয় ছটাক চাউলের ভাত ও পানির মত একটু ডাউল অথবা একটু নিরামিশ তরকারী। বিকালে ২ টা ছোট রুটি ও একটু আলুর ঝোল। কোন সময়ই আমাদের খাবার খেয়ে পেট ভরতো না। আমরা সবাই সব সময় ক্ষুধার জ্বালায় ভুগতাম।
প্রত্যেকদিনই দেখতাম জেল থেকে ২/৩ জন লোককে নিয়ে যেত জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। বিকালে তাদের যখন জেলে ফিরিয়ে আনতো তখন তাদের দেহ ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় দেখা যেত- সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতো।
এত বিপদের মধ্যেও রাত্রির বেলা জেলখানার ভিতর গান বাজনা করতাম। কেউ গান গাইত কেউবা তালি বাজাত। এইভাবে আমরা আমাদের দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম।
আমাদের কাছ থেকে ‘চুক্তি পত্র’ লিখে নেওয়া হয় যে যদি পুনরায় ভারত চলে যাই তবে আমার অবর্তমানে আমার পরিবারের উপর নির্যাতন চালানো হবে। জেল থেকে আমাদের বের করে প্রত্যেককে ৫ টা করে টাকা ও একটা করে সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। মুক্তি পাবার পর আমি ৭ই সেপ্টেম্বর পাঁচবিবি হয়ে আমার বাড়ীতে পৌঁছি।
মুক্তি পেয়ে আমি বাড়ী আসার পর প্রায়ই পাক বাহিনী আমাকে চাপ দিত রাজাকারে ভর্তি হবার জন্য কিংবা বর্ডার স্পাইং করার জন্য। কিন্তু আমি অসুস্থ বলে বাড়ীতে থাকতাম এবং বলতাম যে আগে ভালো হয়ে নেই।
২৮ শে নভেম্বর বিকাল ৪ টার দিকে একজন রাজাকার আমার বাড়ীতে গিয়ে বলে যে, এখনই থানায় যেতে হবে। আমি যদিও বুঝতে পারি যে আমাকে বন্দী করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তবুও আমি তার সঙ্গে থানায় রওনা হই কিন্তু রাস্তায় নেমে দেখতে পাই যে পাক বাহিনী গাড়ি নিয়ে আমার বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রাস্তার ভিতর থেকেই আমাকে তুলে নেয় এবং জয়পুরহাটে নিয়ে যায়।
আমাকে যখন বন্দী করে গাড়ীতে তোলা হয় তখন গাড়ীর ভিতর লেঃ আলতাফ (বিহারী) বসে ছিল। আমাকে জয়পুরহাট বি, আই, ডি, সির শিক্ষানবীশ আবাসিক এলাকায় ২ নং ব্যারাকে পাক বাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এখানে আমাকে “মেজর আফজালের” কাছে নিয়ে যায় এবং লেঃ আলতাফ আমার নামে বহু মিথ্যা অভিযোগ মেজর সাহেবের কাছে বলে এবং বলে যে আমি নাকি ২ জন বিহারীকে হত্যা করেছি তা লেঃ আলতাফ দেখেছে। মেজর আমাকে এই সব কথার সত্যতা জিজ্ঞাসা করে। এক কথায় আমি সব অস্বীকার করি। তখন মেজর সাহেবের সঙ্গে আমার কিছুটা কথার কাটাকাটি হয়। এই সময় মেজর সাহেব একজন সৈন্যকে ডাকে এবং আমাকে ধোলাই দেবার জন্য বলে। এই সময় আমাকে এমনভাবে প্রহার করা হয় যে আমি প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি।
আমাকে বহু সময় মারধোর করার পর লেঃ আলতাফ আমাকে মেরে ফেলার জন্য মেজর সাহেবের কাছে এজাজত চায়। মেজর সাহেব লেঃ আলতাফ কে এজাজত দেয় আমাকে মেরে ফেলার জন্য।
এই সময় আমাকে হত্যা করার জন্য লেঃ আলতাফ হোসেন আমাকে করে খোঞ্জনপুর রাস্তার উত্তর পারে মাঠের ভিতর পাক বাহিনীর ডিফেন্স- এর কাছে নিয়ে যায়, ৩/৪ জন মিলিটারীর হাতে তুলে দেয় এবং বলে দেয় যে একে চাকু দিয়ে জবাই করে কিংবা বেয়োনেট দিয়ে হত্যা কর। বর্বর সৈন্যরা আমাকে হত্যা করার জন্য প্রায় ১০০ গজ দূরে নিয়ে যায়। রাস্তাটা ছিল উঁচু, আমাকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তারা আমার চোয়ালে ঘুষি মারতে থাকে।